আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনাপ্রবন্ধ

বইয়ের দোকান : দেশের মুখচ্ছবি : মফিদুল হক

আবার পড়ি : মফিদুল হকের প্রবন্ধ

বইয়ের দোকান বরাবরই আমাকে খুব টানে। বইয়ের দোকান যেন একটি জাতির সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। দোকানের হাল দেখে জাতির হকিকত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক যে-মাপের গ্রন্থপ্রেমী তার কোনও তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার। যে-কালে বিলেতফেরত অধ্যাপকদের চেনা যেত তাঁদের সদ্য আনীত গাড়ি দেখে, সেই সময়েও তিনি ফিরেছিলেন বইয়ের বিশাল ভাণ্ডার নিয়ে। চট্টগ্রামের জাহাজঘাটার শুল্ক কর্মকর্তারা গাড়ি ছাড় করার বিধিব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল, কিন্তু এত বই কোন সরকারি আইনে ছাড়া যাবে সেটা নিয়ে তাঁদের বিব্রতদশা ঘটেছিল। এহেন বই যদি দোকানে বিক্রির জন্য আমদানি করা হতো সে-এক কথা, আমদানি বিধি-মোতাবেক বাড়তি কর মিটিয়ে বই নিয়ে যেতে পারেন যথাযথ মালিক। কিন্তু একজন মানুষ পড়তে এনেছেন বই, এত এত বই, সেসবের জন্য কোন বিধান প্রযোজ্য হবে ? যাই হোক, শেষ পর্যন্ত স্নেহভাজনদের দৌত্যে স্যার ঠিকঠাক মতো পেয়েছিলেন তাঁর বই। পরিচিতজন কেউ বিদেশ ভ্রমণে গেলে সর্বদা স্যারের সদুপদেশ ছিল, দেখবেন বইয়ের দোকান, মানুষের ভাবজগতের হদিশ পাবেন তাতে, আর দেখবেন কাঁচাবাজার, নিত্যদিনের আহার্য কোন মূল্যে কেমন লভ্য, তাতে পাবেন জীবনধারার পরিচয়। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তাঁর ইস্তাম্বুল দর্শনের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিলেন, বইয়ের দোকানে দেখা গেল দু ধরনের বই―বামপন্থী সাহিত্য ও ইসলামি ধর্মচিন্তাবিষয়ক এন্তার বই রয়েছে শেলফ জুড়ে। অনুকরণীয় ভাষায় স্যারের উক্তি, বুঝবার পারলাম, সমাজটা দুই ভাগ হইয়া আছে।

তো নিজের মধ্যে স্যারের গুণ কিছু নাই থাকুক, তাঁর আদেশ শিরোধার্য করতে কোনও বাধা তো নেই। তবে অচিরেই বুঝতে পারলাম এই দুই সাদামাটা কাজে সাফল্য পেতে হলে সিদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন। বাজার ঘুরেফিরে সার সার সামগ্রী দেখলেই হবে না, সরবরাহের প্রকৃতি কী, জোগানদারদের অবস্থা কেমন, মূল্যমানের সঙ্গে জাতীয় আয়ের সমন্বয় কতটুকু রয়েছে, সপ্তাহ-মাস-বছরে পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি বা প্রাচুর্যের ওঠানামা কেমন, নিম্ন আয়ের লোকদের সংস্থান কোন বাজারে, উচ্চ আয়ের গৃহবাসী কীভাবে সওদাপাতি করেন ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নের জবাব মিলিয়ে না দেখলে সে-দেখা তো হবে অর্থহীন। চকিতে এই পর্যবেক্ষণ করে নিতে পারেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কেবল তিনিই এটা পারেন। আর ঢাকার কাঁচাবাজারে সাপ্তাহিক আনাগোনা এবং বেসাতি ও বিক্রেতার নিবিড় পর্যবেক্ষণ তো ছিল তাঁর আনন্দকর বিলাস। সামান্যকে ঘিরে উপলব্ধির অসামান্য স্তরে পৌঁছে যাওয়ার দক্ষতা অর্জন খুব সহজ কাজ নয়। তাই বিদেশে গিয়ে কাঁচাবাজারে ঘোরাঘুরি করার পথ আমি নিইনি, তবে বইয়ের দোকানে সবসময়ে হাজির হয়েছি। উপলব্ধি অর্জনের জন্য নয়, মনেরই আনন্দে। সেই আনন্দের কিছুটা ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে পাঠকের সঙ্গে।

আমার এই ছাপোষা জীবনে প্রায় অলৌকিক বিভিন্ন সূত্রে বিদেশ ভ্রমণের নানা যোগ ঘটেছে। সেই সুবাদে হানা দেওয়া গেছে বহু নগরকেন্দ্রের বইয়ের দোকানে। ইংরেজিভাষী নগরকেন্দ্রে কোনও বইয়ের দোকানে ঢোকাটা বিষণ্ন অভিজ্ঞতাও বটে। বিদেশের বইয়ের দোকান বলতে মূলত বোঝায় শক্ত মলাটের উচ্চমূল্যের বইয়ের সমাহার। বাংলাদেশের সীমিত আয়ের মানুষের জন্য সেসব বেশির ভাগ বই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই এ-কেবলই হয় উইন্ডো শপিংয়ের ব্যাপার, দেখার সঙ্গে অধিগ্রহণের যে-সম্পর্ক সেটা ভুলে যাওয়ার মনোকষ্ট  সবসময়ে বহন করে চলতে হয়। তবু তো দেখাটা হয়, সেটা কোনও অংশে কম বড় পাওনা নয়।

লন্ডন-নিউ ইয়র্কের বইয়ের দোকান সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলা অবান্তর। বৃহত্তম গ্রন্থ বিপণি হিসেবে লন্ডনের ফয়েলসের গর্বের অনেক ভাগীদার হয়তো এখন জুটেছে, কিন্তু গ্রন্থপ্রেমীদের জন্য ফয়েলস-এ যাওয়া এখনও মূল্যবান অভিজ্ঞতা। তবে ডিলন্স্, ওয়াটারস্টোন কিংবা ডব্লিউ এইচ স্মিথের তুলনায় ফয়েলসকে অনেক অগোছালো মনে হবে। লন্ডনের আকর্ষণ হচ্ছে নগরীর অজস্র বইয়ের দোকান, বিশেষ বিষয়ে আলোকসম্পাতী পৃথক চরিত্রের বিভিন্ন দোকান। বামপন্থি বইয়ের খোঁজ পাওয়া যাবে সেন্ট্রাল বুকস, কোলেৎস্, বুকমার্কস কিংবা এমন আরও কিছু দোকানে, নাটকের জন্য স্যামুয়েল ফ্রেঞ্চ, এমনি আরও কত বিভাজন যে রয়েছে! লন্ডনের আরেক আকর্ষণ পুরনো বইয়ের খোলাবাজার। সপ্তাহের বিশেষ দিনে বারবিকানের সামনে কিংবা সপ্তাহান্তে সাউথ ব্যাংকে কাঠের ঠেলাগাড়িতে বই সাজিয়ে বসে পুরনো বইয়ের ভাণ্ডারিয়া। হাতে যদি সময় থাকে প্রচুর এবং পকেটে কিছু অর্থ, তবে এই বাজার থেকে যে-কেউ পছন্দসই জহরত তুলে নিতে পারবেন।

লন্ডনের মতো নিউ ইয়র্ককেও বলা যেতে পারে ভূমণ্ডলের গ্রন্থরাজধানী, যেমন বিচিত্র ধরনের অজস্র দোকান, তেমনি তাদের বাহার। ফয়েলসের মতো নিউ ইয়র্কে রয়েছে ‘স্ট্র্যান্ড’, যারা গর্ব করে বলে থাকে সারি দেওয়া বইয়ের তাকের দৈর্ঘ্য বিচারে তাদের তুল্য আর কোনও দোকান ভূ-ভারতে নেই, ফয়েলস-এর মতো স্ট্র্যান্ডও কিছুটা অগোছালো, এত বড় দোকান গুছিয়ে রাখাও চাট্টিখানি কথা নয়, বিশেষত সারাদিন অজস্র ক্রেতা বই নাড়াচাড়া করে গোছানো শেলফ অগোছালো করে দিয়ে গেলে সবটুকু সংশোধন বোধহয় আর সম্ভব হয় না। সারা আমেরিকা জুড়ে বার্নস অ্যান্ড নোবেলের বইয়ের দোকান পাঠকদের মন জয় করেছে। বিন্যাস, আয়েশ করে বই ওল্টাবার সুযোগ, কফি পারলার ইত্যাদি বার্নস অ্যান্ড নোবেলকে পাঠকপ্রিয় স্থান করে দিয়েছে। ম্যানহাটানের আকাশচুম্বি দরদালানকে অস্বীকার করে গ্রিনউচ ভিলেজে ষাটের দশকে হিপি সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল এবং ভিলেজের বেসমেন্টের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে ঢুকলে সেই কাউন্টার-কালচারের ছোঁয়া এখনও অনুভব করা যাবে। আমেরিকা ও ব্রিটেনের বইয়ের দোকানে বাড়তি আকর্ষণ সেখানে লেখক-লেখিকাদের উপস্থিতি। নতুন বই প্রকাশকালে বড় দোকানগুলোতে ঘোষিত সময়ে উপস্থিত থাকেন তাঁরা, স্বাক্ষর দেন বইয়ে, আলাপ করেন পাঠকদের সঙ্গে। এমনি সূত্রে আমিও একবার আলাপ করতে পেরেছি অভিনেত্রী রাজনৈতিক কর্মী ভ্যানেসা রেডেগ্রেভের সঙ্গে, স্বাক্ষর নিয়েছি তাঁর আত্মজীবনীতে।

চীনের কাছে হস্তান্তরের পরবর্তী সময়ে হংকংয়ে উপস্থিত হওয়ার কারণে বোধ করি সেখানকার বইয়ের দোকানে হস্তান্তরবিষয়ক বইয়ের প্রাধান্য দেখা গিয়েছিল। এছাড়া হংকংয়ের বইয়ের দোকানের আলাদা আকর্ষণ বিশেষ নেই। দোকানের সিংহভাগ জুড়ে আছে কম্পিউটার ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বই, যে-সমাজ বিশ্বের ব্যবসা-কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে সেখানে এর অন্যথা হওয়ার কারণ নেই। আর রয়েছে সচিত্র বইয়ের ভাণ্ডার, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় কফি-টেবিল বুক। কিন্তু হংকংয়ের জৌলুসের তুলনায় বইয়ের দোকানকে নি®প্রভই মনে হয়। সেই তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ার সউলের গ্রন্থ বিপণি যেন জেগে-ওঠা ব্যাঘ্র-অর্থনীতির সঙ্গে সমতালে বিকশিত হয়েছে। রাজধানী সউলের ডাউনটাউনে ছয়তলা বিশাল ভবন নিয়ে যে বইয়ের দোকান তার আবহ আশপাশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পথচারী পারাপার টানেলের আলোকোজ্জ্বল দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নোবেলবিজয়ী লেখকদের প্রতিকৃতি। দোকানের বিভিন্ন তলে বিভিন্ন বিষয়ের বই থরে থরে সাজানো। এর সিংহভাগই কোরীয় ভাষার বই, তবে মুদ্রণ সৌকর্য ও পারিপাট্যে তা যে-কোনও পশ্চিমা প্রকাশনার সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম। কোরীয় সমাজ যে কোরীয় ভাষা ও সংস্কৃতির শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা বইয়ের দোকানের সম্পদ-সম্ভার দেখলে বেশ বোঝা যায়। কোরীয় গ্রন্থবিপণির সবচেয়ে ঝলমলে অংশ এর শিশুগ্রন্থ বিভাগ। খেলনা, পুতুল, জনপ্রিয় লোককথার চরিত্রের বিশাল মূর্তি ও আরও বিভিন্ন রকম সজ্জা এই অংশকে শিশুদের জন্য পরম আকর্ষণীয় করে রেখেছে। শিশুরা নিজেরাই বই টেনে নামাচ্ছে নিচু সব তাক থেকে, চেয়ারে বসে কিংবা কার্পেটে দু-পা ছড়িয়ে দেখছে বই, উল্টাচ্ছে ছবির পাতা। এই মনোহর দৃশ্য বুঝিয়ে দেয় কোরীয় জাতির অন্তর্নিহিত শক্তিমত্তা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিকাশের জন্য তাদের আয়োজনের বহুমাত্রিকতা।

তবে ভাষা না জানা থাকলে কোনও দেশের বইয়ের দোকানের চরিত্রের খুব বেশি ভেতরে প্রবেশ করা যায় না। ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে আমাদের এই অসুবিধাই ঘটেছিল। হিসপানি ভাষার সব বই, তবে কোনটা ভেনেজুয়েলার নিজস্ব প্রকাশনা, কোনটা ল্যাটিন আমেরিকার অন্য দেশের তা আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। ল্যাটিন মহাদেশ অন্য যে কোনও মহাদেশের চেয়ে অনেক বেশি করে যে সাংস্কৃতিক অভিন্নতার মধ্যে রয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলত এক ভাষার বন্ধনে আবদ্ধ বলে এক দেশের লেখক সহজেই হয়ে যেতে পারেন অন্য দেশে পাঠকপ্রিয় এবং বইয়ের শেলফে যেসব বরেণ্য লেখক শোভা পান তাঁরা কেউ চিলির, কেউ কলাম্বিয়ার, কেউ পেরুর, কেউ-বা আর্জেন্টিনা কিংবা খোদ ভেনেজুয়েলার। দেশ থেকে দেশের ফারাক সেখানে মোটেই মুখ্য নয়। আর রয়েছে চে গুয়েভারাবিষয়ক বই, স্বপ্নভরা চোখের এই বিপ্লবী যে এখনও লাতিন মহাদেশের মানুষের মনের গভীরে আসন পেতে রয়েছেন সেটা চকিত পর্যবেক্ষণেও ধরা পড়বে।

পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার একাধিক সুযোগ ঘটেছিল মস্কো বইমেলায় অংশগ্রহণের সুবাদে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সমাজের নানা সমস্যার পরিচয় সেই কারণে মিললেও বাস্তব-বার্তা উপেক্ষা করে প্রশ্নহীন আনুগত্য সর্বদা প্রাধান্য পেয়েছে মনে। নিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক সমাজে বইয়ের জোগানও ছিল নিয়ন্ত্রিত, আবার জনকল্যাণের রাষ্ট্রীয় তাগিদ থেকে অনুমোদিত গ্রন্থের জন্য সমর্থনও ছিল  অঢেল। ফলে মস্কোতে বই ছিল শস্তা এবং চিরায়ত বই পাওয়া যেত দেদার। পশ্চিমি লেখকদের অনুবাদের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের পছন্দ ছিল বড় বিবেচনা, কখনওই পাঠকের চাহিদা নয়। ফলে যখন অনুমোদন পেয়ে প্রকাশিত হতো পছন্দসই এমন কোনও বই যা পাঠকের আগ্রহের বৃত্তে রয়েছে, সেক্ষেত্রে হুমড়ি খেয়ে পড়ত পাঠককুল। যেমন ঘটত ইয়েভতুশেঙ্কোর কোনও কবিতার বই, ইলিয়া এরেনবুর্গের ইতিপূর্বে অপ্রকাশিত ও বর্তমানে অনুমোদিত কোনও বইয়ের ক্ষেত্রে। তখন দোকান খোলার আগে থেকেই সারিতে দাঁড়ানো শুরু হয়ে যেত ক্রেতাদের। বইয়ের জন্য খ্যাতিমান ছিল কালিনিন প্রসপেক্টে ‘দম কিèগা’ বা গ্রন্থভবন। আরবাৎস্কায়া মেট্রো স্টেশনে নেমে সুপ্রশস্ত কালিনিন প্রসপেক্ট পার হয়ে যেতে হয় দম কিèগায়। পথের কোণে পড়বে একটি সপ্তদশ শতকের চার্চ, অবয়ব দেখে বোঝা যায় সংরক্ষণ সযত্নে করা হচ্ছে। তবে রাশিয়ার অধিকাংশ চার্চের মতো এটা ছিল নন-ফাংশনাল বা পরিত্যক্ত চার্চ। কারণ এই চার্চে প্রার্থনা করবার মতো ধর্মানুসারী নাকি ছিল না! তাই পৌর কর্তৃপক্ষ চার্চটি দিয়েছেন প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থাকে, মাঝে-মধ্যে তাদের প্রদর্শনী আয়োজিত হয় চার্চে। বেলারুশিয়ার রাজধানী মিনস্কের নগরকেন্দ্রে প্রধান এক চার্চে যাওয়ার সুযোগ একবার ঘটেছিল। সেটাও ছিল তথাকথিত পরিত্যক্ত উপাসনালয় এবং চলচ্চিত্রকার সমিতিকে প্রদান করা হয়েছিল তাদের কাজে ব্যবহারকল্পে। সোভিয়েত শাসনাবসানে এইসব চার্চ যে স্বগৃহ আবার ফিরে পেয়েছে বিশ্বাসীদের এবং প্রার্থনা-গীতে মুখরিত হয়ে উঠছে সে বলাই বাহুল্য। তবে সমাজতন্ত্রের রমরমা দিনে তুচ্ছ হিসেবে গণ্য এইসব সামাজিক বাস্তবতা আমাদের মনে কোনও প্রশ্ন জাগায়নি। তো এই চার্চ তথা প্রকৃতি সংরক্ষণ সমিতির প্রদর্শশালা পেরুলেই কালিনিন প্রসপেক্টের সারি সারি ভবনের শুরু এবং প্রথম ভবনের কয়েকতলা জুড়ে রয়েছে দম কিèগা, মূলত রুশি বইয়ের দোকান। তবে আমদানিকৃত কিন্তু একান্ত নির্বাচিত বিদেশি বই এবং ইংরেজিতে প্রকাশিত সোভিয়েত প্রকাশনালয়ের বই এখানে পাওয়া যায়। এসব বই দামে বিশেষ শস্তা, কেননা রাষ্ট্র থেকে বইয়ের জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নানা ভর্তুকি রয়েছে। ইংরেজি বইয়ের লেখক-তালিকা অবশ্য খুব আঁটোসাটো, কী বই পাওয়া যাবে না তার চাইতে অনুমান করা সহজ কী বই পাওয়া যাবে। হালফিল বই প্রায় নেই, চিরায়ত বইয়ের কদর এখানে বেশি, যতটা না পাঠকদের কাছে, তার চেয়ে বেশি রাষ্ট্রের কাছে। থিওডোর ড্রেইজার, জ্যাক লন্ডন, সিনক্লেয়ার লুইস, কিছুটা আর্নেস্ট হেমিংওয়ে রয়েছেন অনুমোদিত লেখক তালিকায়। তবে আমি কখনও একদা আদৃত হাওয়ার্ড ফাস্টের কোনও বই মস্কোর কোনও দোকানে দেখিনি। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির একসময়কার সক্রিয় সমর্থক হলেও পঞ্চাশের দশকে হাঙ্গেরিতে গণ-অসন্তোষ দমনে ট্যাংকবহর নিয়ে রুশ বাহিনীর হামলায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পার্টি পরিত্যাগ করেন। পরবর্তী বিভিন্ন লেখায় হাওয়ার্ড ফাস্ট তাঁর জনদরদি সমাজবাদী চেতনার অব্যাহত প্রতিফলন ঘটিয়ে চললেও সোভিয়েত নেতৃত্বের অনুমোদন আর তিনি পাননি। ক্ষেত্রবিশেষে কমিউনিস্টরা উদার হতে পারেন, তবে দলত্যাগীদের প্রতি তারা সর্বদা নিষ্ঠুর। মস্কোতে ইংরেজি বইয়ের জন্য আদর্শ দোকান ছিল বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের পেছনের সরু গলিতে। ছোট এই দোকানে ছিল কেবল বিদেশি বই এবং পুরনো ইংরেজি বইও মাঝে-মধ্যে বিক্রি হতো। মস্কোর দুই দোকান তাদের গ্রন্থসম্ভার, ক্রেতা প্রতিক্রিয়া সব মিলিয়ে সোভিয়েত সমাজের একটি খুদে সংস্করণ ছিল নিঃসন্দেহে। কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে মস্কোর গ্রন্থবিপণী ও প্রকাশনা চারিত্র্য আমূল পাল্টে গেছে নিশ্চয়ই, তবে সেই পরিবর্তনের স্বরূপ দেখার বাসনা এখনও অপূর্ণ থেকে গেছে।

সবশেষে বলতে হয় আমার দেখা দুই স্মরণীয় বইয়ের দোকানের কথা। এর একটি প্যারিসে, আকারে বেশ ছোট কিন্তু প্রকৃতিতে বিশাল। প্যারিসে খুব স্বল্পসময়ের অবস্থানে আতিথ্য প্রদান করেছিলেন নীরবতার শিল্পী পার্থপ্রতিম মজুমদার। তাঁর সঙ্গে প্যারিসের বিখ্যাত লেফট ব্যাংক, সিন নদীর বাম তীরের শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান ঘুরে বেড়ানোর সময় চোখে পড়েছিল পুরনো বইয়ের ছোট্ট এক দোকান―এরা জুলে ভার্নের বইয়ের কেবল প্রথম সংস্করণ বিক্রি করে। সেই সঙ্গে রয়েছে জুলে ভার্নের সমসাময়িক উনিশ শতকের কম্পাস, গ্লোব ও নানা অ্যাডভেঞ্চার সরঞ্জাম। কালেক্টরদের জন্যই এমন দোকান, আর সেটা প্যারিসেই সম্ভব। এর কিছুটা দূরে সেই বিখ্যাত দোকান ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’। পোশাকি ঠিকানা যাই থাকুক, দোকান থেকে আমি যে বই কিনেছি তাতে সিল দেওয়া আছে ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি, কিলোমিটারে জিরো, প্যারিস’, অর্থাৎ তারা যেখানে অবস্থিত সেটাই প্যারিসের কেন্দ্রবিন্দু কিলোমিটার জিরো। এমন প্রবল গর্ববোধ দুনিয়ার আর কোন বইয়ের দোকান প্রকাশ করতে পারবে ? ছোট দোকানের ভেতর গাদাগাদি করা বই, নতুন ও পুরনো মিলেমিশে একাকার। ওপরে ওঠার কাঠের সরু সিঁড়ির গোড়ায় দেখি মাথার ওপর লেখা রয়েছে, ‘ঈশ্বরের গৃহে কোথাও যেতে কারও কোনও বাধা নেই।’ এমন আমন্ত্রণ পেয়ে ওপরে গিয়ে দেখি একটা বিছানা পাতা, পাশে বেসিন। বোঝা গেল দোকান মালিক এখানে থাকেন। এখানেও মেঝেতে দেয়ালের তাকে গাদাগাদি করা বই ও পত্রিকা। আমি ১৯৬৮ সালের কয়েক সংখ্যা পার্টিজান রিভিউ পেয়ে লুফে নিলাম। নিচের কাউন্টারে যে হাসিখুশি তরুণী বসে সে জানালো ওগুলো বিক্রির নয়, দোকানে বসে পড়ার জন্য। আলাপে জানা গেল দোকান-মালিক বৃদ্ধ হুইটম্যান এখন নেই, পরে ফিরবেন। প্রতি সোমবার দোকানে কবিতা পাঠের আসর বসে, আমি চাইলে যোগ দিতে পারি, দর্শক পাঠক যে কোনও ভূমিকায়। দোকান থেকে দু-একটি বই কিনলেও আরও কয়েকটি বইয়ের জন্য মন পড়ে রইলো। পয়সায় কুলোলে পরে এসে কিনবো ভেবে জানতে চাইলাম দোকান কতক্ষণ খোলা থাকে। মেয়েটির জবাব শুনে আমার ভ্রƒ কপালে ঠেকল। বলল, আমরা সারারাত খোলা, তোমার যখনি কোনও বইয়ের প্রয়োজন হবে বাইরের কলিংবেলে চাপ দিলে আমরা নিচে এসে দোকান খুলে দেব।

মনে হতে পারে এ-উন্মাদের গ্রন্থবিপণি। বস্তুত এই ক্ষ্যাপাটে চরিত্রই শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানিকে প্যারিসে অনন্যতা প্রদান করেছে এবং টুরিস্টদের কাছেও এর রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। দোকানের বর্তমান অবস্থানস্থলের খুব কাছেই ছিল সিলভিয়া বিচ প্রতিষ্ঠিত আদি শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি, বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে যে-দোকান হয়ে উঠেছিল আঁভাগার্দ শিল্প-সাহিত্যের এক প্রধান কেন্দ্র। ১৯২২ সালে এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল জেমস জয়েসের ইউলিসিস, আর কোনও প্রকাশক যে-বই বের করতে সম্মত হয়নি এবং যে-গ্রন্থ এখন বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। হেমিংওয়ে, গারট্রুড স্টেইন, জন ডস প্যাসোস প্রমুখ একগাদা তরুণ সাহিত্যিকের আড্ডা ছিল এই দোকানে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গোড়ায় প্যারিস দখল করার পর জার্মানরা এই দোকান বন্ধ করে দেয়। যুদ্ধের পর জর্জ হুইটম্যান, আজকের বৃদ্ধ মালিক ও সেকালের টগবগে মার্কিন তরুণ, শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি আবার শুরু করেন বর্তমান স্থানে। নিজেকে তিনি ওয়াল্ট হুইটম্যানের জারজ পৌত্র হিসেবে দাবি করেন। ১৯৬৮ সালের প্যারিসের যুব বিদ্রোহে শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি একটি প্রধান প্রেরণা-কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। গ্রন্থপ্রেমীদের জন্য এ-এক ঐতিহাসিক স্থান।

শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি যেমন ছোট দোকান, বিপরীতভাবে তেমনি বিশাল পিলগ্রিমস বুক হাউজ। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে দেখার মতো বইয়ের দোকান পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা ছিল না। বাইশ লক্ষ লোকের এই শহর বিশ্বের অন্যতম দরিদ্রতম দেশের রাজধানী। দেশের প্রধান ভাষা নেপালি, আর রয়েছে নেয়ারি ভাষাভাষী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক, যাঁদের বাস মূলত কাঠমান্ডু উপত্যকায়। তবে নেপালে হিন্দি ভাষার প্রাধান্য বিশেষ প্রবল। এহেন শহরে এক স্বপ্নের গ্রন্থবিপণি এই পিলগ্রিমস বুক হাউজ―তিনতলা ভবন জুড়ে কেবল বই আর বই। তাছাড়া আছে, যেমন থাকে বিদেশে যে-কোনও বড় বইয়ের দোকানে, স্টেশনারির পৃথক বিভাগ, যেখানে শোভা পাচ্ছে আধুনিক সামগ্রীর পাশাপাশি হ্যান্ডমেড পেপার বা তুলোট কাগজের অজস্র সামগ্রী। আছে হস্তশিল্পের পৃথক এক বিভাগ। বিস্ময়করভাবে পেছনের চত্বরে আছে এক ক্যাফে―এর নান্দনিক সজ্জা মনে করিয়ে দেবে কোনও আর্ট গ্যালারির কথা। কাউন্টারে আছে বিদেশি নানা পত্রিকা, চা-কফি কিংবা নেপালি রামে চুমুক দিতে দিতে আপনি পত্রিকার পাতা উল্টোতে পারেন। শহরের ব্যস্ত ট্যুরিস্ট কেন্দ্র থামেলে অবস্থিত এই বইয়ের দোকান মূলত বিদেশি পর্যটকদের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্য কোনও বইয়ের দোকানে যা নেই, পিলগ্রিমে তা আছে―সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে পিলগ্রিম অনুমোদিত এক তান্ত্রিক সাধু এখানে আসেন এবং আগ্রহীজনের হস্তরেখা বিচার করে জীবন সম্পর্কে তন্ত্রসিদ্ধ বাণী প্রদান করেন।

পিলগ্রিমস বুক হাউজ নিজেদের সম্পর্কে বলে থাকে, ‘হিমালয়-বিষয়ক নতুন, পুরনো, দুর্লভ বইয়ের বৃহত্তম এশীয় ভাণ্ডার।’ পিলগ্রিমের বইয়ের ভাণ্ডার যেমন পরিব্যাপ্ত, তেমনি বিস্ময়কর। এই ভাণ্ডার মূলত ইংরেজি বইয়ের এবং পর্যটক চাহিদা মেটানোর জন্য সবচেয়ে বেশি রয়েছে নেপাল ভ্রমণ, পর্বতারোহণ, ট্রেকিং ইত্যাদিবিষয়ক বই। আর আছে তিব্বত-সম্বন্ধীয় গ্রন্থ। অনিবার্যভাবে নেপালের সব বইয়ের দোকানে পাওয়া যাবে জেমস হিলটনের লস্ট হরাইজন। যে সাংগ্রিলার অধরামাধুরী ইউরোপীয় ও মার্কিনী পর্যটকদের টেনে আনে নেপালে তার এক প্রধান উদ্গাতা তো ছিল ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত জেমস হিলটনের এই উপন্যাস―যুদ্ধপীড়িত চীন থেকে পলায়নপর চার ব্যক্তি বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে আশ্রয় লাভ করেন হিমালয় কোণের সাংগ্রিলা রাজ্যে, মর্ত্য মাঝে স্বর্গসম এই ভূখণ্ডে পরিচিত হন লামা বৌদ্ধতন্ত্রের সঙ্গে, জীবনের আরেক বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে। নেপাল যাওয়া সুগম হয়ে উঠলেও তিব্বত এখনও প্রায় অগম্য, তাই তিব্বত ভ্রমণ ও তিব্বতবিষয়ক বইয়ের আকর্ষণও দুর্মর। একান্ত সুলভ টিবেটান বুক অব ডেড থেকে শুরু করে তিব্বতবিষয়ক বহু দুর্লভ বই রয়েছে পিলগ্রিমের ভাণ্ডারে। আর আছে প্রায় সব বিষয়ের কিছু কিছু বই―এভরিথিং আন্ডার দি সান। এহেন বইয়ের দোকানে দিনমান কাটিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে। তবে স্বল্পসময়ে নিছক মুগ্ধতা নিয়েই ফিরে আসতে হয়, ভাণ্ডার তলিয়ে দেখার অবকাশ বিশেষ হয় না।

তদুপরি থামেলের দোকান দেখলে পিলগ্রিমের সবটুকু দেখা হয় না। পাটানের কুপুনডলেতে রয়েছে তাদের শাখা। এটি একটি চারতলা ভবন, তবে পরিসরে কিছুটা ছোট। এখানে বইপত্রের বাইরে হস্তশিল্পের অংশ ছাড়াও রয়েছে একটি ছোট চিত্রশালা। চারতলায় আছে এক কফি পার্লার যেখানে বসে হিমালয় পর্বতমালার তুষারাবৃত শৃঙ্গ আপনি দেখতে পাবেন। পিলগ্রিমস বুক হাউজের আরও একটি শাখা রয়েছে বারানসিতে, তবে সেটা চাক্ষুষ করবার সুযোগ আমার ঘটে নি। কিন্তু পিলগ্রিমের কর্মকাণ্ড এই তিন শাখা পরিচালনাতেই সীমিত নেই, তারা বড় ধরনের প্রকাশকও বটে। পিলগ্রিমের দেড়শ’ পৃষ্ঠার ক্যাটালগে বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশিত বইয়ের বিবরণী সংবলিত রয়েছে। আট পৃষ্ঠার একটি ত্রৈমাসিক পুস্তকবার্তা পিলগ্রিম প্রকাশ করে। তাদের প্রকাশনার একটি আলাদা দিক হচ্ছে পুরনো দুর্লভ বইয়ের পুনর্মুদ্রণ। মোটা চামড়ার বাঁধাইয়ে সোনার জলে নাম-লেখা সীমিত মুদ্রণ এসব বই সংগ্রাহকদের জন্য বড় পাওয়া।

বিস্ময়কর পিলগ্রিম্স্ বুক হাউজের প্রতিষ্ঠাতা ততোধিক বিস্ময়কর রামা তিওয়ারির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন পাঞ্জাবি ভাষার প্রখ্যাত লেখিকা অজিত কৌর। থামেলের গ্রন্থবিপণির চারতলার ঘরে ছোট শয্যা পাতা রয়েছে, রামা তিওয়ারি অনেক সময় সেখানে রাত্রিযাপন করেন। সেই রাতে তিনি ছিলেন খুব ব্যস্ত, সুইস একটি দলকে নিয়ে পরদিন সকালে জমসন যাবেন ট্রেকিং করতে। আমাকে জানালেন দলটি এসেছে নেপালে ভেষজ ওষুধের কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখতে। তিনি দলটির সন্তুষ্টিবিধানে সচেষ্ট রয়েছেন, যদি এর দ্বারা নেপাল কিছুটা উপকৃত হয়। রামা তিওয়ারির বয়স জিজ্ঞাসা করা হয়নি। একমুখ কালো দাড়ি ও মাথার চুলের লঘুতার কারণে তাঁকে কিছুটা বয়সী দেখালেও তাঁর উদ্যম ও ছুটোছুটি জানিয়ে দেয় যে তিনি এখনও নবীন, বয়স চল্লিশের কোঠা পেরিয়েছে কিনা সন্দেহ। রামা তিওয়ারি স্বশিক্ষিত স্বনির্মিত ব্যক্তি, সদা প্রফুল্ল এই মানুষটি হাসতে হাসতে জানালেন তাঁর জীবন-সংগ্রামের কথা। কাজ শুরু করেছিলেন বেনারসের এক বিখ্যাত বইয়ের দোকানে ফুট-ফরমায়েশ খেটে। কৌতুকভরা দৃষ্টি মেলে বললেন, আমি ফ্লোর মোছার কাজও করেছি সে-দোকানে। তারপর শুরু করলেন একান্ত ছোটভাবে নিজের ব্যবসা। শেখার প্রবল আগ্রহ থেকে বইপত্র সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল প্রখর। তিনি একটি জুতোর বাক্সে বই ভরে অফিসে বাড়িতে ফেরি করে বেড়াতে লাগলেন। একসঙ্গে এর বেশি বই সংগ্রহ করার মুরোদ তার ছিল না। ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বইয়ের বাজার ও চাহিদার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ধ্যান-ধারণা আরও পুষ্ট হয়। জীবনসংগ্রামী তিওয়ারি কাঠমান্ডুতে তাঁর পিলগ্রিমস বুক হাউজ প্রতিষ্ঠা করেন বছর পনেরো আগে। কোথায় কীভাবে শুরু করেছিলেন জানতে চাইলে তিওয়ারির জবাব ছিল, বলতে পারেন গুহাচারী ছিলাম তখন। তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল এক বাড়ির বেসমেন্টে।

আজ পিলগ্রিমস বুক হাউজ কেবল এশিয়ার বৃহত্তম হিমালয়-বিষয়ক বইয়ের ভাণ্ডারি নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উদ্দীপক গ্রন্থবিপণি নিশ্চয়ই এটি। ভ্রমণকথার খ্যাতমান লেখক পিকো আইয়ার তাঁর ভিডিও নাইটস ইন কাঠমান্ডু গ্রন্থে পিলগ্রিমস বুক হাউজকে তুলনা করেছেন দুনিয়ার কতক সেরা গ্রন্থবিপণির সঙ্গে। তিনি লিখেছেন, ‘হারভার্ড বুক স্টোর কাফে অথবা ওয়াশিংটনের ক্রামার বুকস কিংবা ঘিরাবাল্ডি স্কোয়ার থেকে কভেন্ট গার্ডেন পর্যন্ত স্থানে অন্য যে-কোনও গ্রন্থ ও অনিন্দ্য পানীয়-মিষ্টান্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, যা শরীর ও মনের জন্য খাবারের জোগান দেয় সেসবের তুলনায় এই জায়গাটা আরও কেতাদুরস্ত। মধ্যরাত পর্যন্ত এটা খোলা থাকে এবং যন্ত্রে বাজে ধ্রুপদী সঙ্গীত, উপযুক্তভাবে সিজন করা স্বর্গীয় স্বাদের চা-পানের সঙ্গে ক্রেতাদের জন্য রয়েছে ইন্টারভিউ, কনোসিয়র, নিউ ইয়র্কারের সর্বশেষ সংখ্যা।’

পিলগ্রিমস বুক হাউজ নামের সার্থকতা প্রমাণ করে গ্রন্থপ্রেমীদের তীর্থস্থানসম হয়ে উঠেছে। জগৎবিচ্ছিন্ন নেপালে এমন বইয়ের দোকান গড়ে ওঠার পেছনে আছে একজন রাজা তিওয়ারির ভূমিকা এবং এটা ভালোভাবেই প্রমাণ করে ব্যক্তিমানুষের দক্ষতা ও নিষ্ঠা কীভাবে সমাজ ও দেশের বাস্তব হিসাব পালটে দিতে পারে। পিলগ্রিমের তীর্থদর্শন তাই সর্বভাবেই উদ্দীপনামূলক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button