আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনাপ্রবন্ধ

ঔপনিবেশায়নের সীমানা : স্বপন নাথ

মফিদুল হকের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

উপনিবেশ ও ঔপনিবেশায়নের চারিত্র্য ক্রম-পরিবর্তনে নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। এর ফলে উপনিবেশ সম্পর্কিত ধারণারও পরিবর্তন ঘটছে। একুশ শতকের আগে ঔপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া যা ছিল, এখন তা আর নেই। সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদ যা-ই বলি, সকল ধরনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কৌশল আমরা লক্ষ করেছি। একালে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা বা ঔপনিবেশায়নের পরোক্ষ কর্মসূচি আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে বলে অনুভব করা যায়। এ সময়ে উন্নত প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন অক্ষের পুঁজি ক্রম-প্রসারমান। একই সঙ্গে বিস্তৃত বাজারব্যবস্থা থেকে শুরু করে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ভূগোলকেও নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছে। আবার বিশ^ায়নের উপকরণ উপনিবেশের বিস্তার আরও সহজ করে দিয়েছে। ঔপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় সবকিছু পালটে যাবার কারণ হলো―‘প্রাযুক্তিক কারণেই আজকের দিনে বিশে^র এক প্রান্তের সঙ্গে আর এক প্রান্তের মধ্যে নিয়ত যোগাযোগ এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে।… আন্তঃসংযোগের পরিধি ও চরিত্র কেমন হবে তা নির্ভর করে বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক শক্তির ভারসাম্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের উপর। বিশে^র সামাজিক দ্বন্দ্বগুলির স্তর এবং আন্তর্জাতিক শক্তি ভারসাম্যের উপরই নির্ভর করে যোগাযোগ ব্যবস্থার কার্যকারিতা। ঔপনিবেশিক প্রাধান্যের যুগে স্বভাবতই উপনিবেশগুলির জনগণের পক্ষে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গণমাধ্যম ব্যবস্থার সুষম সুযোগ নেওয়া সম্ভব ছিল না।’ [বেরা ২০০৬ : ২০৩]

এ ধরনের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতির মধ্যে উপনিবেশের পরিসর মনোজগতিক স্তরে কীভাবে বহুমাত্রিকতায় বিস্তৃত এবং দখল ও সম্মতি প্রতিষ্ঠা করেছে, এর মূল্যায়ন করেছেন মফিদুল হক।  

যে সময়ে মনোজগতে উপনিবেশ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে, সে সময় প্রযুক্তি প্রসারের অভিঘাত বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়নি। লেখক স্বীয় বৈশি^ক অভিজ্ঞতার আলোকে গুরুত্বপূর্ণ বইটি লিখেছেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের চিন্তার অগ্রসরমানতার পরিচয় বিবেচনায় নিতে হয়। কারণ তিনি ওই পিছিয়ে থাকা সময়ে এ ধরনের বই লিখতে সমর্থ হয়েছেন। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের বিদ্বৎসমাজে এ বিষয়ে কেউ ভাবলেও অভিমত দেননি বা কথা বলেননি। বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন, অভিজ্ঞতা প্রতিফলনের কারণে তথ্য ও সম্প্রচারের উপনিবেশ চমৎকার বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ আলোচনা উপস্থাপন করেছেন মফিদুল হক। বিভাজিত অধ্যায়কেন্দ্রিক আলোচনার আগে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবতরণিকা। পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত এ গ্রন্থের অধ্যায়গুলো বিন্যস্ত করেছেন বিভিন্ন শিরোনামে। এগুলো হলো : প্রথম অধ্যায় : তথ্যজগতের প্রতিকৃতি; দ্বিতীয় অধ্যায় : খবরের খবর; তৃতীয় অধ্যায় : পড়েছি ধরা টেলি-বন্ধনে; চতুর্থ অধ্যায় : মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে; পঞ্চম অধ্যায় : চাই তথ্যের নতুন ব্যবস্থা।

মনোজগতে উপনিবেশ বিষয়ক আলোচনা এখন অতীব প্রাসঙ্গিক বলে আমরা মনে করি। কারণ তথ্যপ্রযুক্তির ক্রম-উন্নতির ফলে সাম্রাজ্যবাদের নতুন শক্তি এর ওপর বাহক হয়ে সমগ্র বিশ^কেই নিয়ন্ত্রণে উন্মুখ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে গণমাধ্যম সম্পর্কিত বাস্তবতা ও ধারণা জনসমাজের কাছে এখন আর আগের মতো নেই। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত মনে হলেও আসলে তা নয়। লক্ষণীয়, খুব স্বল্প সময়ে প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমের বৈশিষ্ট্য, কলাকৌশল, চারিত্র্য বদলে যাচ্ছে। কেউ স্থির হয়ে বলতে পারছে না, পরের দিন কী হতে যাচ্ছে। বিশ^ায়ন ও খোলামেলা বাজারব্যবস্থার ঘাতে এখন প্রথাগত গণমাধ্যমের কাঠামো, রীতি, প্রচারকৌশল বদলে যাচ্ছে ক্রমশ। গণমাধ্যমের কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা আপাত বোঝা যায় না। যা-ই আছে, তা হলো পুঁজির প্রতিনিধিত্বশীল পরিচালনা ও তার বিস্তৃতকরণ কর্তৃপক্ষ। প্রাযুক্তিক উৎকর্ষে এখন যে কেউ চাইলেই একটি মাধ্যমের মালিক ও পরিচালক হতে পারে। এমন ডানা মেলার কারণ হিসেবে অবতরণিকায় তিনি বলেছেন : ‘আধুনিক গণ-যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠার ইতিহাসকে দু’ভাবে বিচার করা যেতে পারে। এর একটি তথ্যসংগ্রহ ও সরবরাহ সংক্রান্ত প্রযুক্তির ক্রমোন্নতির ইতিহাস যা আজ এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসে গোটা বিশে^র জীবনধারাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে চলেছে। … মানুষ সামাজিক উৎপাদনশীলতার মধ্য দিয়ে নিয়ত প্রকৃতি ও চতুষ্পাশের্^র জগতের উপর আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে।… এই নব বিকশিত প্রযুক্তি শ্রমের প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত হয়ে মানবজীবনের পরিবেশ পাল্টে দেয়, সৃষ্টি করে নবতর প্রযুক্তিগত বিকাশের সম্ভাবনা। তাই প্রযুক্তিগত বিকাশের সঙ্গে সবসময়েই তার সামাজিক প্রয়োগের দিকটি যুক্ত।’ [হক ১৯৮৭ : ১১]

ফলে শ্রম ও প্রয়োগের মাপকাঠিতে সমাজের রূপান্তর প্রসঙ্গ বিশ্লেষণ জরুরি। একই সঙ্গে মানুষের চলমানতাও বিচার্য। মানুষের চিন্তাভাবনা প্রযুক্তির প্রয়োগসাফল্যে ভিন্ন ও ভবিষ্য প্রযুক্তির ধাপে উন্নীত হচ্ছে। প্রযুক্তির এই স্পাইরাল উন্নয়ন এখন দ্রুতগতিতে ধাবমান। 

উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশ ও বিশে^ এখন ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা হলো বাস্তবতা। উন্নত দেশে এ ডিজিটাল কর্মসূচি ষাটের দশকে শুরু হলেও আমাদের এ ব্যবস্থাপনার মধ্যে প্রবেশ করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এর মধ্যে গণমাধ্যম্যের বহুস্তরীভূত পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটেছে। ক্যাস্টেলস যেভাবে দেখেছেন―The digitization of communication has prompted the diffusion of a technologically integrated media system in which products and process are developed on diverse platforms that support a variety of content and media expressions within the same global/local communication network. [Castells 2009: 72]

বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলের শাসনক্ষমতা, বাণিজ্যিক লেনদেন, রাজনীতি ও অর্থনীতির পালাবদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যোগাযোগ মাধ্যম। ব্যক্তির চিঠিপত্র থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক তরঙ্গে প্রবহমান সবই। যোগাযোগ ব্যতীত কোনওকিছুই সফল হয়নি। এ পরিবর্তনের দ্রুত বিস্তার ও সম্প্রসারণ ঘটে নগররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। মোদ্দাকথা হলো উৎপাদনব্যবস্থা ও বাণিজ্যের বিস্তারে বিশে^র ক্ষমতাকাঠামো বদলে যায়। কৃষি, চাষাবাদি সমাজের পরিবর্তনে শিল্পবিপ্লবের কালান্তর ও উত্তরকালে মানুষের রুচি, আচরণ, পছন্দের পরিবর্তন ঘটে। ক্রম-উত্তরিত চিন্তার বিবর্তনে সাধারণ মানুষের কল্যাণকেন্দ্রিক চিন্তা প্রধান হয়ে ওঠে। ফলে মানুষের মধ্যে আর্থসামাজিক চিন্তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক চিন্তা পুনর্গঠিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে মানবসমাজে উৎপাদনব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে ঘটে নয়া উদারবাদ ও পুঁজির উত্থান। এর সঙ্গে রাষ্ট্রবিষয়ক চিন্তাকাঠামো, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পে পরিবর্তন হয়ে ওঠে অনিবার্য। বিশেষত পুঁজিকেন্দ্রিক বিশে^ আমরা গণমাধ্যমকে হিসেব ও বিবেচনা করি ভিন্নভাবে। এসব গণমাধ্যম শুধু যোগাযোগের ক্যাটালিস্ট বা তথ্য আদানপ্রদানের বাহন হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকে না। কাল ও ক্ষমতার পরিসর বিবেচনায় অন্যতম অংশী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে গণমাধ্যমকে যেহেতু বাণিজ্যপুঁজির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো হয়, সেহেতু চালাকি করেই এ বিষয়ক আলোচনাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে।

বস্তুত ঔপনিবেশিক শক্তি উপনিবেশিত অঞ্চলে পরিকল্পিত আধিপত্যের কাঠামো নির্মাণ করে। এক্ষেত্রে উপনিবেশিত জনসমাজের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। এমন সমর্থন আদায়ে মনভোলানো, চমকিত, তাক লাগানো প্রচারণা অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ সুযোগে ঔপনিবেশিক শক্তি নানা কৌশল অবলম্বন করে উৎরে যায়। উপনিবেশের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণে অ্যামি সিজর, অ্যানিয়া লুম্বাসহ অনেকেই যা বলেছেন, এসব বক্তব্যের সারাংশ হলো : অপর অস্তিত্বকে আলাদা রূপদান ও তৈরি করা। যে অপর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথমত একটি সাধারণ বয়ান তৈরি করা হয়। যাতে বলা হয়, ঔপনিবেশিত ভূমি মূলত অন্ধকার, সংস্কৃতিহীন, অসভ্য অঞ্চল। এসব বয়ানের আলোকে ঔপনিবেশিক শক্তি সেসব স্থানে বিকল্প কর্মসূচি ঘোষণা করে। দখল ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে কর্মসূচির মাত্রা বানোয়াট হলেও উন্নত দুনিয়ার খোলস তৈরি করে। ফলে এসব অঞ্চলের আর্থ-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য, উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তন করে ফেলা হয়।  Colonialism can completely change the existing social structure, physical structure, and economics of an area; it is not unusual that the characteristics of the conquering peoples are inherited by the conquered indigenous populations. Few colonies remain remote from their mother country. Thus, most will eventually establish a separate nationality or remain under complete control of their mother colony. [https://en.wikipedia.org/wiki/Imperialism; retrieved: 03 December 2023]

দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অপরের ওপর চাপ ও শক্তি প্রয়োগ করা হয়। তবে উপনিবেশিত এলাকায় আগে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হতো। এতে সরাসরি পছন্দের রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি এবং মনোনীত করা হতো পছন্দের শাসক, ক্ষমতার এজেন্ডা ও ভাবাদর্শ। ফলে এসব এলাকার মানুষ নিজস্ব দৃষ্টিতে আর বিশ^কে দেখে না। তারা দেখে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিতে। পরিণামে এর মনোজাগতিক এলাকাও বদলে যায়।

এখন ইন্টারনেটের ভূমিকায় গড়ে উঠেছে ইন্টারনেট-সমাজ। ইন্টারনেট সমাজের শক্তিতে তৈরি হয়েছে ইন্টারনেট-স্ট্যাট। যেখানে এককেন্দ্রিক সংস্কৃতি, ক্ষমতা পরিচালনা স্বাভাবিক বিষয়। ফলে এ ইন্টারনেট প্রযুক্তি সাংস্কৃতিক উপনিবেশ তৈরিতে অত্যন্ত সহায়ক হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণমাধ্যমের সাম্রাজ্যবাদ। বিনোদন থেকে মুনাফাই যখন মূল উদ্দেশ্য হয়ে যায়, তখন বাণিজ্যপুঁজির ঘনত্ব ও শক্তি উভয়ই বাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষের পছন্দ, যৌক্তিক অধিকার সেখানে গৌণ। বাণিজ্যপুঁজির বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য হলো ব্যবসা এবং বাজার সম্প্রসারণ। সবকিছুকে তারা পণ্য হিসাবে বিবেচনা ও গণ্য করে। বিশেষত যারা প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদন সংস্থার মালিক তারা বিভিন্ন কৌশলে বাজারে পণ্য সরবরাহ ও ক্রেতাসাধারণের কাছে পৌঁছাতে চায়। বাজার যেখানে মুখ্য, সেখানে মানুষের অন্য কোনও পরিচিতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। লেখক এ বইয়ে তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগের একটি পূর্বাপর ইতিহাসও তুলে ধরেছেন সংক্ষেপে। লক্ষণীয়, এক পর্যায়ে সামরিক শক্তির বদলে পশ্চিমাবিশ^ ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ভাবাদর্শের দিকে নজর দেয়। এ কৌশল আর্থ-রাজনৈতিক আধিপত্যকে আরও বেশি শক্তি জোগান দেয়। নয়া-উপনিবেশের এ জমানায় সাম্রাজ্যবাদের কৌশল পালটে গিয়েছে। যেক্ষেত্রে বিশ^ায়নের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বেশি জোর দিয়েছে প্রযুক্তির ব্যাপকত্বে। মূলত অল্প শক্তি ক্ষয়,  দ্রুত সময়ে সহজেই ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। এমনকি অত্যাধুনিক দুনিয়ার সকল মাধ্যম ব্যবহার করেই ক্ষান্ত নয়, নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে তৎপর। বিশ্বগ্রাম ও বিশ^ায়নের ফ্লাট-নীতির সুললিত বাতাবরণে একেবারে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে আজকের নয়া-উপনিবেশের মালমশলা। সেখানেই বিপদের আকর নিহিত। মূলত ‘নয়া উপনিবেশবাদী শাসন ও শোষণ বিশ^ব্যাপী যে পুঁজির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সেজন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও তথ্য প্রচারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন। অর্থনীতির বিকাশের এই ধারায়  আমরা দেখি পুঁজিবাদী অর্থনীতি ক্রমশ : যেমন আরও কেন্দ্রীভূত হয়ে বিভিন্ন একচেটিয়া বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আকার ধারণ করল, তেমনি তথ্য বিস্ফোরণ ও তথ্যের ব্যাপকতার যুগেও এক্ষেত্রে কয়েকটি মেট্রোপলিটান কেন্দ্রের প্রায় নিরংকুশ আধিপত্য সৃষ্টি হলো।’ [হক ১৯৮৭ : ২৮]

প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের পরিণামে স্বল্পকালের ব্যবধানে খুব প্রভাবশালী দুটো মাধ্যম বেতার ও টেলিভিশন সারা বিশে^ প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। একালে স্যাটেলাইট এবং ক্লাউডভিত্তিক গণমাধ্যমের ওপর মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশমান ধারায় বিভিন্ন রাষ্ট্র, প্রান্ত, সংস্থার মধ্যে পরস্পর যোগাযোগ হয়েছে সহজ ও নিবিড়। ভাষা, সংস্কৃতি, বহুমাত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর পার্থক্য থাকলেও সাম্প্রতিক বৈশি^ক আবেদনে সকলেই খুব কাছাকাছি ও পরস্পর সম্পর্কিত হয়েছে। এর মধ্যে বহুরৈখিক ব্যক্তি, সমাজ, রাজনৈতিক পদ্ধতির দল-গোষ্ঠীও রয়েছে। এ যোগাযোগের বাইরে কেউ থাকতে পারছে না।

মানুষের সহজাত, সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, চাকচিক্য ও ঝলমলে বিষয় পছন্দ করা। এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায় মিডিয়া। আবার যে গণমাধ্যম পুঁজির শক্তি ছাড়া বিকাশ লাভ করতে পারে না, অর্থাৎ পুঁজির সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও মিডিয়ার বিস্তার লাভের বৈশিষ্ট্যসমূহ এক জায়গায় মিলিত হতে শুরু করে। হয়েও যায় খুব সহজে। ফলে জনসমাজকে আকৃষ্ট করতে কথামালার চমৎকারিত্ব সাধারণ জনসমাজে উপস্থাপিত হতে থাকে। একাকার হওয়ার ফলে কোনও অস্তিত্বেরই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আর অবশেষ থাকে না। যেখানে সাধারণ মানুষের পছন্দ, আনন্দকে হরণ ও দখল করে নেয় বাজারকেন্দ্রিক গণমাধ্যম। ফলে সাধারণ জনসমাজ কনজ্যুমার হিসেবে চরম পুলকে ঝলমল ও চকচকে বিষয় অনায়াসে গ্রহণ করে এবং তা এখন চলমান রয়েছে। ইন্টারনেটকেন্দ্রিক বাণিজ্যপুঁজির বিকাশে বিশ^ায়ন সম্পর্কে চমৎকৃত কথা―Global village বলেছেন মার্শাল ম্যাকলুহান। বিশ^ায়ন ও গণমাধ্যম আলোচনায় যা প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তিনি এ বিষয়ক আলোচনায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ইলেকট্রিক মিডিয়া ও প্রযুক্তির বিকাশমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণে। যেসব বাস্তবতা এখন আমরা লক্ষ করছি। ষাটের দশকে ম্যাকলুহান বলেছিলেন, প্রযুক্তির বিকাশমান স্রোতকে নির্ভর করে মানুষের ইন্দ্রিয়শক্তি আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবে। তার নিজের কথা―The medium, or process, of our time electric technology―is reshaping and restructuring patterns of social interdependence and every aspect of our personal life. It is forcing us to reconsider and reevaluate practically every thought, every action, and every institution formerly taken for granted. Everything is changing you, your family, your neighbourhood, your education, your job, your government, your relation to ‘the others’. And they are changing dramatically. (McLuhan 1967:8)

এ পরিস্থিতিতে এখন আলোচনায় যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নানা প্রসঙ্গ। বস্তুত গণমাধ্যমের প্রভাব ও তাড়নাবিষয়ক ম্যাকলুহানের তত্ত্ব গণমাধ্যম বিশ্লেষণ সহজ করে দেয়। এ পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের দাপট ও প্রতাপ সম্পর্কে মফিদুল হক বলেছেন :

‘টেলিভিশন দ্বারা সম-আবেগ সৃষ্টি তথা মনোজগতের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের যে সম্ভাবনা ম্যাকলুহান প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেটা আজ ভয়ংকর বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। বিশ^ বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে টেলিভিশন ক্রমশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করছে। পণ্য বিপণনের উপযোগী মানসিকতা গড়তে এর চাইতে ফলপ্রসূ বোধ হয় আর নেই।’ [হক ১৯৮৭ : ৮১]  

দুটি বিশ^যুদ্ধের আগে-পরে উন্নত রাষ্ট্র, পুঁজির নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো, যে উপনিবেশ বিস্তৃত করেছে সারা বিশে^, এর ক্রমপ্রসারমানতা আরও আগ্রাসী হয়েছে। এ আগ্রাসনের ফলে সাম্রাজ্যবাদের নানামুখী তৎপরতা নতুন উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। এমন উপনিবেশের ধরন আবার নতুন আঙ্গিক ও মাত্রায় বিকশিত হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ফলত আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগের মফিদুল হকের চিন্তা নতুনভাবে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, চল্লিশ বছর আগে স্মার্ট বলতে আমাদের এখানে শুধুই ফ্যাশন বোঝাত। যে শব্দ এখন প্রযুক্তির সীমানা ছাড়িয়ে জাতীয় লক্ষ্যের অঙ্গীভূত হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে না হলেও ইন্টারনেটভিত্তিক দুনিয়ার যাত্রা শুরু হয়ে গেছে বিশ^ব্যাপী পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। প্রযুক্তির বিকাশ অবলোকনে বৈশি^ক ক্ষমতা সম্প্রসারণে বিশে^র সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো বিবিধ কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। অন্য কোনও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, নিজের পছন্দমতো ক্ষমতা পরিচালনা, শাসক বাছাই, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, আর্থ-রাজনৈতিক প্রভাব, বাছাইকৃত গোষ্ঠী তৈরি, উন্নয়নের খোলসে বন্ধুত্ব তৈরি, রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার ও প্রসারে মানুষের সমর্থন আদায় ইত্যাদি। এত সব আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হয় তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত এবং তথ্যকে পণ্যে রূপান্তর করা। সেভাবেই নয়া উপনিবেশবাদের বিকাশ ঘটেছে। বিশেষত নেটকেন্দ্রিক বিস্তার বিশে^র সবকিছু পালটে দিয়েছে। দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে তথ্য প্রচারের মাধ্যম―গণমাধ্যমের ধারণা, বৈশিষ্ট্য। লেখক জানাচ্ছেন, রেডিও ও টেলিভিশন এক সময় নিছক বিনোদন উৎপাদন করত। কিন্তু বেতার, টেলিভিশনের কর্মকাণ্ড শুধু বিনোদনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এরপর বিকশিত হলো টেলিযোগাযোগ। ভূ-স্টেশন স্থাপনের পর যোগাযোগব্যবস্থার প্রচলিত ব্যবস্থাই পালটে গেল। একই সঙ্গে যুক্ত হলো কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি। এখন এ যন্ত্র ব্যবস্থার উন্নয়নে মানুষের গবেষণা মানুষকেই করে তুলছে অপ্রাসঙ্গিক। এমন ক্রম-উন্নয়ন বিদ্যমান মানবসমাজকে উদ্বিগ্ন করলেও বাস্তবতা অস্বীকারের কোনও অবকাশ নেই। 

মনে রাখা ভালো গণমাধ্যমের সমস্ত কলাকৌশল, প্রযুক্তির নির্মাতা ও বাজার নিয়ন্ত্রণকারী হচ্ছে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো। স্বাভাবিকভাবেই তারা পুঁজি বিস্তৃতির কৌশলে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তথ্য উৎপাদন, প্রচার ও বাজারজাত করতে তারাই সবচেয়ে বেশি অগ্রসর। বস্তুত তারা সত্যমিথ্যা যা-ই প্রচার করুক না কেন, ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় সেসব আমরা গ্রহণ করছি, বিশ^াস করছি। এর ফলে ‘প্রচারেই প্রসার’ প্রবাদের বহুল প্রয়োগ লক্ষ করছি বিশে^। বিচিত্র প্রচার মাধ্যম, তথ্য বাণিজ্য, গণমাধ্যমের কলাকৌশল বিশে^র জনরুচির পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। মানবসমাজের অধিকাংশই ভোক্তা হিসেবে কোনও বিচার বিবেচনা না রেখে ওই রঙিন দুনিয়ার কারসাজিকে বাস্তব বলে বিশ^াস ও গ্রহণ করছে। এর মানে মানুষের মনোজাগতিক ভূমিকে দখল করে  নেওয়া হয়েছে। চলমান বিশে^ বিষয়টি আরও কার্যকর বলেই আমরা লক্ষ করছি। কোনও একটি ঘটনার ভয়াবহতা বর্ণনা না করে, বরং আক্রান্ত গোষ্ঠীর বিপক্ষে জনসমর্থন আদায়ে সমর্থ হয়েছে এ প্রচারযন্ত্র। সেখানে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার তাত্ত্বিক ও কাণ্ডজ্ঞানের ভিত্তি থাকলেও উল্টা নিয়ন্ত্রণকারী বা শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে জনসমর্থন চলে যাচ্ছে। যেক্ষেত্রে মূল কথা হলো তথ্যের উপস্থাপন, ক্ষমতা ও আর্থ-সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। মফিদুল হক তথ্য জগতের প্রতিকৃতি-ভাবনায় গণমাধ্যমের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বস্তুত, গণমাধ্যমের ভূমিকা বা জনসমাজের রুচি, পছন্দ পরিবর্তন, বৈশি^ক চ্যালেঞ্জ অনুধাবনে নিছক বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন আলোচনায় এর সমাধান টানা যাবে না। কারণ, ‘ভাবাদর্শগত আধিপত্য সুগম করে দিচ্ছে অর্থনৈতিক আধিপত্যের পথ’। 

বস্তুত বাণিজ্যিক পুঁিজ শক্তি বাড়ানোর উচ্ছ্বাসে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কোনও কোনওটি অনেক বড় কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। স্বভাবতই কোম্পানিসমূহের পুঁজির শক্তি ও ক্ষমতার লক্ষ্য থাকে বাজারের নতুন ঠিকানা ও প্রসারতার দিকে। নতুন বাজার ও ক্রেতা বৃদ্ধির সওয়ার হয়ে ওঠে তথ্যপ্রযুক্তি, গণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বলা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত হবে এবং কৃত্রিম বাধাগুলো আর থাকবে না। আমরা জানি মানুষ সাধারণত প্রথাগত জীবন ও কর্ম পছন্দ করে। তবে কোনও ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতেই পারে। এ সুযোগ গ্রহণ করে পুঁজির বাজার ও এর আগ্রাসন নীতি। আবার বাজারের লাবণ্য বৃদ্ধিতে কৃত্রিম ও অপ্রয়োজনীয় পছন্দ, চাহিদা তৈরি করে চলছে বাণিজ্যপুঁজির শক্তি। মফিদুল হক সূক্ষè দৃষ্টিতে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন :

‘পুঁজিবাদের অগ্রগতির ধারায় প্রাকৃতিক প্রয়োজনগুলোর স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ঐতিহাসিক সৃষ্ট প্রয়োজন। অগ্রসর পুঁজিবাদ এখন সৃষ্টি করে চলেছে অপ্রয়োজনের প্রয়োজন। … কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি ও তা পূরণে বাস্তব পণ্যসামগ্রীর বিপণন―জীবনাদর্শ ও অর্থনীতির এই যুগল সম্মিলনে এগিয়ে চলছে বহুজাগতিক করপোরেশনের বিস্তার ও মুনাফা অর্জনের প্রয়াস। তৃতীয় বিশে^ও নব্যস্বাধীন দেশে নতুন শাসকশ্রেণি ও মধ্যবিত্তের বিকাশকে এই পণ্যভোগের বেড়াজালে বেঁধে ফেলা হচ্ছে। তাই এই বাংলাদেশেও জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি প্রতিরাতে পেটে ক্ষুধার জ¦ালা নিয়ে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেও ফরাসি সৌরভের প্রতিশ্রুতি ও ধর্মোৎসবে নতুন ফ্যাশনের ফিরিস্তিময় প্রচ্ছদকাহিনি ছাড়া আমাদের চলেছে না।’ [হক ১৯৮৭ : ৩৭]

বস্তুত পণ্যসামগ্রীর জন্য বাজার সৃষ্টিতে প্রথম কাজ হলো মানুষের মধ্যে পণ্যাসক্তি তৈরি করা। সে আসক্তি তৈরিতে একালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে গণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তা আমরা প্রবলভাবে লক্ষ করছি। আগেই বলা হয়েছে ইলেকট্রিক মাধ্যম ও তথ্যের অবাধ প্রবাহ সাধারণ মানুষের জীবন ও রুচি বদলে দিচ্ছে। নয়াউদারবাদ, উপনিবেশের কৌশলগুলো সাধারণ মানুষের সামনে লোভনীয় অনেক প্রচার, প্রচারণার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছে। বিশ^ায়ন, বাণিজ্যপুঁিজর নয়া বিশ^ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের পছন্দ অনুযায়ী বিবিধ তথ্য সম্প্রচারে তৎপর। মূলত এই ব্যবস্থা মানুষের চিন্তা, ভাবনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছে। সমূহ ভোগবাদের বিকাশ, সমাজকাঠামোর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বদলে যাচ্ছে সবই। পুঁজির মালিকানা বিকাশের জন্যই পঞ্চাশের দশক থেকে এখন পর্যন্ত ঝলমলে দুনিয়ার পছন্দকেই বেছে নিচ্ছে নিয়ন্ত্রকেরা। উপনিবেশবাদের পরিকল্পনাই হলো, সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো। এর আলোকে তারা ঝলমলে, আপাত উচ্ছ্বাস, আনন্দময় একটি জগৎ উপস্থাপন করছে মাত্র। যেখানে একবার প্রবেশ করার পর আর সেখান থেকে বের হওয়ার অবসর থাকে না। তাদের লক্ষ্যই হলো একটি মনভোলানো ইন্দ্রজালের জগতে মানুষকে আটকে রাখা। ফলত এমন শস্তা বিনোদনই তারা উৎপাদন করছে। মফিদুল হক বলেছেন :

‘পণ্যভোগী মানুষ সৃষ্টির জন্য তার মনোভূমির দখল নেয়া একান্ত প্রয়োজন, কেননা যে চাহিদা কৃত্রিম তার জন্য বাস্তব তাগিদ সৃষ্টি করতে হলে দরকার ব্যাপক আয়োজনের। শুধু পণ্যাসক্তি নয়, পণ্যভোগী সমাজের মন মানসিকতাকেও এমনভাবে প্রভাবিত করা দরকার যেন মানুষ জীবন বলতে বোঝে শোষণ ব্যবস্থার সহায়ক কোনও উপলব্ধি, যেন জীবনকে প্রভাবিত করার বদলে জীবনস্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়াতেই জানে সার্থকতা, যেন গভীর জীবনবোধের বদলে আচ্ছন্ন করে রাখে হাল্কা অর্থশূন্য ভাবনা-চিন্তা। এই আয়োজনের প্রধান উপাদান হচ্ছে এমনিতর  তথ্যপ্রবাহ ও ভাবাদর্শের প্রসার।’ [হক ১৯৮৭ : ৩৮] 

বিবিধ প্রয়োজনে সাধারণ মানুষকে গণমাধ্যমের আশ্রয় নিতে হয়। কারণ জীবনসংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি ছোট হলেও প্রচার হয়ে থাকে। এ সামান্য মোহ অপ্রয়োজনীয় চাহিদার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। দরকার হয় বিজ্ঞাপনের। মূলত আনন্দ, উৎসবমুখরতা হলো বিজ্ঞাপনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তা সহজেই মানুষের রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যেখানে ভালো, মন্দ সবই একাকার। কেউ বুঝতে পারছে না, কী বিষয় তার জন্য জরুরি বা জরুরি নয়।  বিজ্ঞাপন শুধু পণ্যকে পরিচয় করিয়ে দেয় না, বিজ্ঞাপনের ফাঁকে সংস্কৃতিও পৌঁছে যায় সহজে। মানবসমাজের ভাবনাজগতের দেয়াল ক্রমে ভাঙতে-ভাঙতে প্রচারিত সংস্কৃতির ভাষা, প্রকাশভঙ্গি এবং পণ্যসংশ্লিষ্ট ভূগোলের পছন্দে মোহাবিষ্টতা তৈরি করে বিজ্ঞাপন। যেক্ষেত্রে চমৎকার এক পরনির্ভরশীলতার প্রতি মানসিক সমর্থন তৈরি হয়। যা কি না দর্শক-শ্রোতা, ক্রেতা মোহাবিষ্ট থাকার কারণে বুঝে ওঠতে পারে না, কী গ্রহণ করছে। ফলত :

“বিজ্ঞাপন ও ব্যবসা জগতে ‘কনজুমার ডেমোক্র্যাসি’ বা ‘পণ্য-গণতন্ত্র’ কথাটির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বিজ্ঞাপনী আদর্শের উপজাত পণ্যভোক্তা গণতন্ত্র মানুষকে একমাত্র পণ্যভোগী রূপেই বিবেচনা করে এবং খুঁজে পায় মানবজীবনের সার্থকতা।… দরিদ্র বঞ্চিত মানুষ যে পণ্য কোনওদিন ভোগ করতে পারবে না সে পণ্যের বিজ্ঞাপন দ্বারা আবিষ্ট হয়ে থাকে। পুঁজিবাদী সমাজে বিজ্ঞাপন কখনওই শ্রেণি আদর্শ নিরপেক্ষ কিংবা শ্রেণি-উর্ধ্ব নয়। বরং পুঁজিবাদী সমাজ-আদর্শের বলিষ্ঠ প্রচারকের ভূমিকা পালন করছে বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন ব্যবস্থা সচেষ্ট রয়েছে এমন এক মানসিকতা গড়ে তুলতে যা মানুষকে পণ্যের অর্থময়তা যোগান দেবে।” [হক ১৯৮৭ : ১২২-১২৩]

প্রতিদিনের সংবাদ প্রচারে সত্যমিথ্যা, সত্যতা বলে অবশেষে কিছু থাকছে না। বরং অকাট সত্য হলো আমরা যারা প্রচারমাধ্যমের দাসে পরিণত হয়েছি, তারা এ বিষয়টি আর উপলব্ধি করতে পারছি না। কারণ আমরা উপনিবেশের ক্রীড়নক মাত্র :

“পুজিবাদী সমাজের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গঠিত ও সক্রিয় সংবাদসংস্থাগুলোর পক্ষে বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন সোনার পাথরবাটির মতোই ব্যাপার। কেননা সংবাদ সম্পর্কিত তাদের ধারণা ও উপলব্ধি এই গঠনবৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্দিষ্ট ও সীমিত হয়ে আছে। মার্কিন সংবাদপত্র জগতের অন্যতম একচেটিয়া অধিপতি উইলিয়াম র‌্যানডলফ হার্স্ট বলেছিলেন ‘যা গুরুত্বপূর্ণ সেটাই সংবাদ নয়, যা আগ্রহোদ্দীপক তাই সংবাদ।’ সংবাদ সম্পর্কিত এই ধারণা পুঁজিবাদী সমাজকাঠামোর সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে যায়।” [হক ১৯৮৭ : ৬৭]

এছাড়াও টেলিভিশন প্রসঙ্গে একটি অধ্যায় রয়েছে। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কীভাবে প্রভাব রাখছে তা এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আমরা লক্ষ করেছি আমাদের দেশ ও সমাজে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে বেতার, টেলিভিশন ও প্রিন্টমিডিয়াতে সীমাবদ্ধতা ছিল। এখনও অনেক দেশে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রচলিত। এক সময় গণমাধ্যম হিসেবে বেতার ও টেলিভিশন ছিল ভরসা। বিশ^ায়ন, মুক্তবাজার ব্যবস্থাপনায় নতুন নতুন দিক খুলে যাচ্ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গণমাধ্যমের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। ক্রমশ বদলে যাচ্ছে গণমাধ্যমের চরিত্র। ফলে এখন আর নির্ধারিত মাধ্যমে স্থির নয় মানুষ। এক সময় আমাদের দেশে বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান শুরু ও শেষ হওয়ার সময় ছিল নির্ধারিত। এখন গণমাধ্যম যেমন নির্ধারিত নয়, তেমনি সময়েরও কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। এমন পরিস্থিতিতে লেখক ঠিক বলেছেন, ‘পড়েছি ধরা টেলি-বন্ধনে’। কারণ, ‘টেলিভিশন যে মনোজগতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকামীদের কাছে অতি প্রিয় মাধ্যম গণ্য হয়েছে তার কারণ এর মনোহারী আকর্ষণ ক্ষমতা। টেলিভিশনের দৃশ্যগুণ মাধ্যমটিকে করে তুলেছে সর্বজনীন। সংবাদপত্রের মতো এখানে সাক্ষর-নিরক্ষরের কোনও ফারাক নেই।’ [হক ১৯৮৭ : ৮০]  

অপ্রিয় হলেও সম্মতি উৎপাদনই সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের অনন্য কৃতিত্ব। বিশ^ায়নের নতুন নতুন কৌশলে দখলের কৌশল বদলে যাচ্ছে। আগে করপোরেট শক্তিগুলো সরাসরি অন্য ভূগোলে হানা দিত, রাষ্ট্রক্ষমতা হয় ধ্বংস, না হয় নিজের মতো করে নিত। নয়া উপনিবেশবাদে সাংস্কৃতিক উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে বেশি। কেননা পণ্য ও প্রচারমাধ্যমকে কাজে লাগানো খুবই সহজ। নীরব বাধাহীনভাবে যা সম্পন্ন হয়ে যায়। ‘বহুজাতিক করপোরেশনগুলো নয়া-ঔপনিবেশিক যুগে যে অর্থনৈতিক থাবা বিস্তার করছে তার আদর্শগত ভিত্তি রচনার কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে টেলিভিশন প্রোগ্রাম পণ্যের প্রবাহ।’ [হক ১৯৮৭ : ৮৭] 

এর প্রমাণে লেখক আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিসর থেকে বিভিন্ন জরিপভিত্তিক কয়েকটি ডাটা উপস্থাপন করেছেন।             

বাণিজ্যপুঁজির সম্প্রসারণ ও প্রতিষ্ঠায়  বিশ^ায়ন ধারণা অত্যন্ত সহায়ক, তা আমরা জানি। আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বিভিন্ন মাধ্যমের কারণে। বিশ^ায়নের সমান্তরাল ও সমানুপাতিক ধারণার বাণী মানুষকে বোকা বানিয়ে করপোরেটের নিছক দাস তৈরি করেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের আবেগ, উপলব্ধি, সংবেদনা, কামনা, বাসনা সবকিছু দখল, নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছে এবং নির্দেশক হয়ে উঠেছে এ করপোরেট বিশ^। এখন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই। যা হয়তো অনেক সময় স্পষ্ট, সরলভাবে অনুভব করা যায় না। ‘কর্পোরেট গণমাধ্যম প্রবৃত্তির কামনা বাসনাগুলোকে শুধু অবদমনের হাত থেকে রক্ষার আহ্বান জানায় না, কামনা বাসনাগুলোকে সাংস্কৃতিক প্যাকেজের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলে, উদ্দীপ্ত করে এবং অত্যাধুনিক সংস্কৃতি রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। হার্বাট মারকুজ এর নাম দিয়েছেন রহংঃরঃঁঃরড়হধষরুবফ ফবংঁনষরসধঃরড়হ. এর মাধ্যমে যে প্রক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক প্যাকেজ নির্মাণ করে করপোরেট সংস্থাগুলো। তারা ডিসাবলিমেশন-এর মাধ্যমে সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করে। ফলে ধান মাড়াই মেশিন বা পাম্পের বিজ্ঞাপনেও নারীকে উপস্থাপন করা হয়। সকল বিজ্ঞাপনের মূল লক্ষ্য থাকে কামোদ্দীপক ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপস্থাপনা। প্রসঙ্গত মারকুজকৃত প্রতিবেদনের আংশিক এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।’ :

[…] It has often been noted that advanced industrial civilization operates with a greater degree of sexual freedom―… by the availability of cheap, attractive clothing, beauty culture, and physical hygiene; by the requirements of the advertising industry, etc. The sexy office and sales girls, the handsome, … Sex is integrated into work and public relations and is thus made more susceptible to (controlled) satisfaction Technical progress and more comfortable living permit the systematic inclusion of libidinal components into the realm of commodity production and exchange But no matter how controlled the mobilization of instinctual energy…The technological and political conquest of the transcending factors in human existence, so characteristic of advanced industrial civilization, here asserts itself in the instinctual sphere: … In contrast to the pleasures of adjusted desublimation, sublimation preserves the consciousness of the renunciations which … The Superego, in censoring the unconscious and in implanting conscience, also censors the censor because the developed conscience registers the forbidden evil act not only in the individual but also in his society. … This society turns everything it touches into a potential source of progress and of exploitation, of drudgery and satisfaction, of freedom and of oppression. Sexuality is no exception…]  [Marcuse 2007: 76-80]

লেখক যে কথাটি শেষে উত্থাপন করেছেন তথ্য প্রচার ও বাজারজাতকরণে বিভাজন প্রসঙ্গে। এ অসাম্য থেকেই গেলো। বর্তমানে  ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ পরিভাষায় তা লক্ষ করছি। তা হলে এ কথা থেকে কী বুঝে নিতে পারি আমরা। স্পষ্টত বিশে^ সকল কাজেই বিভাজন রয়েছে। ফলত, তা অনুধাবন করে লেখক কিছু কথা বলেছেন। অবশেষে তিনি দাঁড়াচ্ছেন এ বিভাজন সৃষ্টি ও কনজুমার তৈরির কারখানার বিপক্ষে। কারণ মনোজাগতিক উপনিবেশ ক্ষমতাকাঠামোর উপনিবেশকে ভিত্তি প্রদান করে। আমরা তো জানি  মনস্তাত্ত্বিকভাবে পরাধীন মানুষেরা কখনই একটি স্বাধীন সমাজ তৈরি করতে পারে না। ফলে লেখক মানবসমাজের মনোভূমির স্বাধীনতা কামনা করেছেন। তিনি সমাজে তথ্য আদান-প্রদান এবং প্রয়োগে শোষণ ও আধিপত্য বিস্তারের ঘটনাবলির অবসান কামনা করেছেন।

সহায়ক

বেরা, অঞ্জন (অমিয়কুমার বাগচী, সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি)। ২০০৬/ ২০০২। বিশ্বায়নের গণমাধ্যম, গণমাধ্যমের বিশ্বায়ন- দ্বিতীয় খণ্ড। কলকাতা : ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড

Castells, Manuel. 2009. Communication Power. Oxford University Press

Marcuse, Herbert. 2007/1964. One-Dimensional Man Studies in the ideology of advanced industrial society.  Routledge: London 

McLuhan, Marshall. 1967. Understanding Media: The Extensions of Man. NY: Ticknor & Fields

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button