‘সাহিত্যকেই মনে হয় আমার বিকল্প জীবন’ : কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় রনজু রাইম
প্রচ্ছদ রচনা : মুখোমুখি মঞ্জু সরকার
[মঞ্জু সরকার (১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩) সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক। স্বাধীনতা-উত্তর সমাজবাস্তব ও প্রান্তিক জনজীবনের দক্ষ রূপকার তিনি। পরিবর্তনশীল সমাজে শ্রেণিদ্বন্দ্ব, ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত ও ব্যক্তি-অস্তিত্বের লড়াই নানা মাত্রা পায় তাঁর গল্প-উপন্যাসে। প্রথম গল্পগ্রন্থ অবিনাশী আয়োজন ১৯৮২ সালে প্রকাশের মাধ্যমে বিদগ্ধ পাঠক-সমালোচকের স্বীকৃতি লাভসহ কথাসাহিত্যে নিজের আসন ও গতিপথ চিহ্নিত করেন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের সাধনায় ছোটগল্প, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্যে প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা অর্ধ শতাধিক।সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ১৯৯৮। আবাসভূমি, প্রতিমা উপাখ্যান ও উজানযাত্রা উপন্যাসের জন্য ফিলিপস, আলাওল ও সমকাল-ব্র্যাক ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার এবং ছোট্ট এক বীরপুরুষ ও নান্টুর মেলা দেখা গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামের ২০০৬ সালের মনোনীত আবাসিক লেখক হিসেবে লাভ করেন অনারারি ফেলোশিপ ইন রাইটিং অ্যাওয়ার্ড। দেশের কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ে ও পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখকের ছোটগল্প ও উপন্যাস এমফিল ও পিএইচডি কোর্সের জন্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
শিক্ষাজীবনে কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় এবং কারমাইকেল কলেজে পড়াশোনা করেছেন। কর্মজীবনে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রকাশনা কর্মকর্তা পদ থেকে ২০০১ সালে স্বেচ্ছা-অবসর নেন। এরপর সাংবাদিকতার জগতে দৈনিক আমার দেশ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন দশ বছর। বর্তমানে সার্বক্ষণিক লেখালেখির কাজে নিয়োজিত।
লেখকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ছোটগল্প : অবিনাশী আয়োজন, মৃত্যুবাণ, উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা, অপারেশন জয়বাংলা ও ডিজিটাল দেশের কৃষ্ণবিবর; উপন্যাস : তমস, নগ্ন আগন্তুক, অন্ধ যোদ্ধা, প্রতিমা উপাখ্যান, আবাসভূমি, দাঁড়াবার জায়গা, বরপুত্র, সিন্দুকের চাবি, যমুনা, অন্তর্দাহ ও উজানযাত্রা; শিশুসাহিত্য : ছোট্ট এক বীরপুরুষ, যুদ্ধে যাওয়ার সময়, একাত্তরের বোবা ভূত ও মস্ত বড়লোক।]―শব্দঘর-এর পক্ষে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কবি রনজু রাইম
প্রশ্ন : আপনি বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক। লিখছেন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। সত্তর দশকের লেখক হিসেবে সাহিত্যের সমালোচক ও পাঠকদের কাছে আপনি পরিচিত হলেও প্রথম বই তমস প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। এই উপন্যাসের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। অন্তর্দাহ উপন্যাসের বিষয়ও মুক্তিযুদ্ধ। আপনি এবং আপনার সহযাত্রী, সময়ের সতীর্থ লেখকগণ যে সময় কথাসাহিত্যের চর্চা শুরু করেছিলেন, সেই সময়টা ছিল স্বাধীনতা-উত্তর প্রত্যাশা-প্রাপ্তি ও রাজনৈতিক স্বপ্নভঙ্গের হিসেব নিকেশের। সেই বিবেচনায় আপনাদের প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের লেখক প্রজন্ম বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানাবেন।
উত্তর : তমস প্রথম বই নয়, তবে প্রথম উপন্যাস। এ উপন্যাসের বিষয় কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির এক যুগ পরে এক রাতের চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমাজবাস্তবকে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে স্বল্পায়তন উপন্যাসটিতে। আর ৪০০ পৃষ্ঠার অন্তর্দাহ সময় ও বিষয়ের দাবিতে পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস। হ্যাঁ, আমাকে সত্তর দশকের বা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের লেখক বলতে পারেন। কারণ সাহিত্যকে নিজের জীবনের ধ্যানজ্ঞান করে লেখালেখি শুরু করেছিলাম তো গত শতাব্দীর সত্তর দশকেই। আর মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমার লেখক-সত্তাকে প্রভাবিত করেছে ব্যাপকভাবে। আত্মকথনমূলক গ্রন্থ পথে নেমে পথ খোঁজায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
প্রশ্ন : ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনায় বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন। এমন দেখা যায় অনেক লেখক ছোটগল্প ভালো লিখলেও উপন্যাস রচনায় ঠিক ততটা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে না, আবার অনেক লেখক উপন্যাস রচনায় সাবলীল হলেও ছোটগল্প রচনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েই উঠে না। আপনি এই দুটো শাখাতে সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অবিনাশী আয়োজন গল্পগ্রন্থ আশির দশকেই প্রকাশিত ও ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। গল্প ও উপন্যাস রচনার পরস্পরবিরোধী শক্তি, অভিজ্ঞতা ও কৌশল সম্পর্কে জানাবেন।
উত্তর : ছোটগল্প ও উপন্যাস কথাসাহিত্যের দুটি ভিন্ন শাখা এবং এ-দুয়ের সংজ্ঞা, মিল-অমিল ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে সাহিত্যের পণ্ডিত-সমালোচকেরা বিস্তর বলেছেন। দুই শাখার একটিতে সফল, অন্যটিতে কম সফল, দুটিতেই দক্ষ বা দুটিতেই সমান ব্যর্থ―এমন লেখকের দৃষ্টান্ত বিশ^সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্য থেকেও বিস্তর পাওয়া যাবে। লেখক হিসেবে আমি দুটোতেই দক্ষতা, নাকি দুটোতেই কমবেশি ব্যর্থতার পরিচয়ও দিয়েছি, এ বিষয়ে পাঠক-সমালোচকরা ভালো বলতে পারবেন। আমি এ দু-শাখায় লেখার অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে বলতে পারি। ছোটগল্প দিয়ে শুরু হয়েছিল লেখক-জীবন। কারণ তরুণ বয়সে জীবনের নানাবিধ দাবি পূরণে কাজে-অকাজে অনেক সময় যেত। লেখার জন্য সময় পেতাম কম। ছোটগল্প দু-এক সপ্তাহে লেখা যেত, প্রকাশের উপযোগী পত্র-পত্রিকাও ছিল অনেক। কিন্তু উপন্যাস লিখতে দীর্ঘ সময় ধরে লেগে থাকার ব্যাপার আছে। নবীন লেখকের জন্য প্রকাশের সুযোগও কম। ছোটগল্প লিখে কিছু নাম-পরিচিতি হলে উপন্যাস লিখতে হবে, এটাই ছিল যেন তখন দেশের সাহিত্যজগতের অলিখিত নিয়ম। স্বাধীনতার পর দেশে কলকাতার পূজাসংখ্যা পত্র-পত্রিকার অনুকরণে দৈনিক পত্রিকাগুলো বার্ষিক ঈদসংখ্যা প্রকাশ করতে থাকে। প্রথমে সাপ্তাহিক বিচিত্রা, পরে অন্য সব সাপ্তাহিক এবং প্রতিটি দৈনিক সংবাদপত্র ঈদ-ম্যাগাজিন প্রকাশের ফ্যাশন-বাণিজ্যে শরিক হয়। এসব ঈদসংখ্যা ভরানোর জন্য উপন্যাসের চাহিদা বাড়ে। অতি বিখ্যাত এবং কলকাতা থেকে আমদানিকৃত উপন্যাসের পাশাপাশি আমার মতো অল্পস্বল্প খ্যাতির সম্ভাবনাময় লেখকেরও উপন্যাস ছাপা হতে থাকে। আমার প্রায় সব উপন্যাসের প্রথম খসড়া ঈদসংখ্যা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পরে সেগুলোকে ঘষামাজা ও পুনর্লিখন করে বই করেছি। উপন্যাসগুলি বই হওয়ার পর যে রয়্যালটি পাই, তার থেকে ফাঁকি-ঝুঁকি দিয়ে উপন্যাস লিখে আয় হতো বেশি। টাকার দরকার ছিল তাই লিখেছি। এখন মনে হয়, তাৎক্ষণিক বা কোনও বাণিজ্যিক চাহিদা মেটাতে নয়, দীর্ঘ সময় ধরে শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে নিজের মনের মতো করে বড় উপন্যাস লেখা প্রয়োজন। শেষ বয়সে সেই শেষ চেষ্টাই করছি।
প্রশ্ন : সমসাময়িক সতীর্থ লেখকদের থেকে আপনি কোন অর্থে স্বতন্ত্র ? আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন কীভাবে―যখন সতীর্থ সব লেখক একই বাস্তবতার মুখোমুখি ছিলেন ?
উত্তর : সমসাময়িকদের থেকে কোন অর্থে স্বতন্ত্র, আমি কী করে বলব, রনজু ? পাঠক-সমালোচক-সম্পাদক যারা আমার ও সমসাময়িকদের লেখা পড়েছেন, তারা আমার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন হয়তো, যদি জিনিসটা আমার মধ্যে থেকে থাকে আর কী। স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের কিছু নেই। সাহিত্য তো কোনও ব্যক্তি-প্রতিভার একক আবিষ্কার নয়, সাহিত্য না পড়ে কোনও লেখকই সাহিত্য রচনা করতে পারে না। একই রকম দেশ-কালের বাস্তবতা মোকাবিলা করে সমসাময়িক যারা লেখেন, তাদের লেখার স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টিতে প্রতিভা ছাড়াও কিছু লেখক-বৈশিষ্ট্য কাজ করে সম্ভবত। আমি নিজের লেখক-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এটুকু বলতে পারি, ব্যক্তিজীবনে যেমন, তেমনি লেখক হিসেবেও নিজের অভিজ্ঞতা, বোধ-বুদ্ধির কাছে সৎ থাকতে চেষ্টা করেছি। এমন ভাবনা-কল্পনা এবং বোধ-অভিজ্ঞতাও এসেছে জীবনে, তখন মনে হয়েছে, এগুলো আমার মতো করে কেউ আর লিখতে পারবে না। আবার তড়িঘড়ি করতে গিয়ে অনেক সম্ভাবনাময় লেখারও ক্ষতি করেছি। লেখার পর অন্যদের থেকে স্বাতন্ত্র্য এল কি গেল, এ নিয়ে আর ভাবি না।
প্রশ্ন : গল্প ও উপন্যাস রচনায় আপনি কোন বিষয়টার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন সবচেয়ে বেশি―ফর্ম নাকি কনটেন্ট ? নাকি দুটোই। বিশদে জানাবেন।
উত্তর : ফর্ম নিয়ে আগে ভাবি না কখনও। বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফর্ম-এর ধারণা আসে, অনেক সময় বিষয়ের সঙ্গে ফর্ম আসে। আবার লিখতে গিয়ে কখনও-বা ফর্ম বিষয়কেও প্রভাবিত করে। মোদ্দা কথা, ফর্ম-টর্ম ও শিল্পের অন্য সব অনুষঙ্গ লিখতে লিখতে বিষয়ের সঙ্গে একীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় আর কি।
প্রশ্ন : আপনার গল্প উপন্যাস রচনার সিক্রেট কী ? বিষয়বস্তু ও চরিত্র আগে থেকে নির্মাণ―ভেবেচিন্তে তারপর কি লেখা শুরু করেন ? নাকি অন্য কোনও কৌশল অবলম্বন করেন। পাঠকদের উদ্দেশে বলবেন।
উত্তর : ওপেন সিক্রেট হলো, লিখতে চাওয়া তথা লেখক হওয়ার অদম্য বাসনা। বাধা আসে, ব্যর্থ হই, কিন্তু সেই যে নবীন যৌবনেই সাহিত্যের সঙ্গে প্রেম-পরিণয় সূত্রে বাঁধা পড়েছি, সেই সম্পর্কটা টিকে আছে বলে এখনও লিখে চলেছি। হ্যাঁ, লেখা শুরুর আগে গভীর ভাবনা-চিন্তা করি। বিষয়-চরিত্র নিয়ে কল্পনা-পরিকল্পনা চলতে থাকে। এখন তো সব লেখাই কম্পিউটারের কি-বোর্ডে হাত চালিয়ে স্ক্রিনে দাঁড় করাই প্রথমে। প্রাথমিক ভাবনা-চিন্তা বা মূল থিমটি অবলম্বন করে কম্পিউটারে খসড়া শুরু করলে, তা রদবদল ও সম্পাদনার কাজটি অনেক সময় ধরে চলতে থাকে। তবে যে লেখাটি কম্পিউটারে বসার আগে মগজের নোটবুকে কাটাকুটি ও সম্পাদনার মাধ্যমে চূড়ান্ত আকার পায়, সে লেখা কম্পিউটারে কপি করতে সময় লাগে কম। আর কৌশলের কথা কী বলব, মোটেও কুশলী লেখক নই আমি। নতুন লেখা শুরু করলে, এই বৃদ্ধ বয়সেও নিজেকে আনকোড়া নতুন লেখক মনে হয়।
প্রশ্ন : বাংলা কথাসাহিত্যে একটি গতিশীল ধারা প্রবহমান। রবীন্দ্র-উত্তর তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, এছাড়াও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সতীনাথ ভাদুড়ী, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ অনেক শক্তিমান লেখক আছেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে এঁদের কাউকে আদর্শ মনে হয়েছে কি কখনও ?
উত্তর : ভালো বলেছো, কথাসাহিত্যের গতিশীল ধারাবাহিকতা ও ঐতিহ্যে আমিও বিশ্বাসী। ওপরে যাদের নাম বললে এবং তারা ছাড়াও আরও যারা সাহিত্যের গতিশীল ধারায় অবদান রেখেছেন, তাঁদের অবদান ও কীর্তি সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে নতুন কিছু ও বড় কিছু সৃষ্টি সম্ভব নয় বলে মনে করি। এককভাবে আদর্শ মনে হয়নি কাউকে, তবে প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত করেছেন অনেকেই।
প্রশ্ন : অগ্রজ লেখকের প্রভাবে ক্ষুদ্র লেখক নিঃশেষ হয়ে যায়, বড় লেখক আরও শক্তিমান হয়। কারণ বড় লেখকেরা জানেন কীভাবে অগ্রজের ঋণ গ্রহণ করে স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল হতে হয়। আপনার লেখায় কারও ছায়া বা প্রভাব লক্ষ্য করেছেন কি কখনও, সচেতন কিংবা অবচেতন ভাবে ?
উত্তর : মন্তব্যটি সমর্থনযোগ্য মনে হচ্ছে। আমার লেখায় কারও ছায়া বা প্রভাব কী পরিমাণে পড়েছে, কখনও খুঁজে দেখিনি। এরকম খোঁজাখুঁজির কাজ করেন সাধারণত সাহিত্যের গবেষক-সমালোচক, তাদের কাছেও কিছু শুনিনি। তবে লেখা শুরুর আগে পূর্বসূরি অনেকেরই কাজ ও প্রভাব অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আমার লেখায় তাদের ছায়া পড়তে পারে বলে মনে হয়েছিল। কিছু উদাহরণ দিয়ে বলি। আমার অন্যতম প্রিয় লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায় পড়তে গিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ভেবেছিলাম, আমার দেখা উত্তরবঙ্গের গ্রাম ও মানুষ নিয়েও আমি এরকম লিখব। বিভূতিভূষণের সারল্য ও প্রকৃতিপ্রেম, জীবনকে দেখার ক্ষেত্রে মানিকের দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়বোধ, ঢোঁড়াই চরিতমানস ও তিস্তাপারের বৃত্তান্ত রচনায় সতীনাথ ভাদুড়ী ও দেবেশ রায়ের পর্যবেক্ষণ, রাজনৈতিক জ্ঞান ও প্রান্তিক চরিত্র সৃষ্টিতে ডিটেইলসের ব্যবহার―তাঁদের মতো লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু-কে মনে রেখে ধর্মীয় সংস্কার ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছি নগ্ন আগন্তুক, অবগুণ্ঠন নামে দুটো উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলির গুরুত্ব মেনে নিয়ে নদীকেন্দ্রিক জীবনধারা নিয়ে লিখেছি অচল ঘাটের আখ্যান, যমুনা, নগ্ন আগন্তুক। সচেতন বা অবচেতনভাবে আমার লেখায় পূর্বসূরি আগ্রজদের ছায়া ও প্রভাব কোথায় কীভাবে পড়েছে, ঠিক বলতে পারব না। তবে আমি অগ্রজদের ঋণ স্বীকার করি অকুণ্ঠচিত্তে।
প্রশ্ন : লেখকের স্বাতন্ত্র্য নির্ভর করে বিষয়বস্তু ও গল্পভাষার অভিনবত্বে। এই দুটো গুণের নিরিখে আপনাকে সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যে কতখানি আলাদা করে চেনা যায়।
উত্তর : আমি নিজের বইয়ের ফাইনাল প্রুফটা পড়ি, প্রকাশের পর আর কখনই পড়ি না। কাজেই আমাকে আলাদা করে চেনা যায় কিনা, নিজের লেখা বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এমন জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজি না। একজন সচেতন পাঠক হিসেবে এ প্রশ্নের জবাবটা তুমি বরং খুঁজে দেখো ভাই, তাতে পাঠক-দুর্ভিক্ষের কালে একজন পাঠক অন্তত বাড়বে আমার। প্রশ্ন দেখে তো মনে হচ্ছে, আমাকে কিছু না পড়েই সাক্ষাৎকার নিতে এসেছো। লেখককেই তার লেখার একমাত্র পাঠক ভেবে জানতে চাইছো অনেক কিছু।
প্রশ্ন: গল্প ও কবিতা, দুটো আলাদা শিল্পমাধ্যম হলেও―সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যে কাব্যভাষার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব লক্ষ করা যায়। এই বিষয়টা কি আপনি সমর্থন করেন ? বিশদে বলবেন।
উত্তর : সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য সবটা পড়ার সুযোগ হয় না। কাজেই কার লেখায় কাব্যভাষার প্রভাব আছে বলতে পারব না। তবে কথাসাহিত্য তো কবিতা হয়ে উঠতেই পারে। কথাসাহিত্য, বিশেষ করে উপন্যাস শুধু কাব্যভাষা কিংবা কবিতার মতো শৈল্পিক ব্যঞ্জনা নয়, সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার প্রভাব ও শিল্পমান সমন্বিত করে বড় সৃষ্টি হয়ে উঠতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। জীবনের বহুমুখী বাস্তবতাকে সমন্বিত ও হজম করার ক্ষমতা উপন্যাসের সবচেয়ে বেশি বলে মনে হয়।
প্রশ্ন : গল্প-উপন্যাসে পাঠককে কি শুধু গল্প শোনাতে চান, না কি অন্য কিছু ? একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে সামাজিক দায় কতখানি অনুভব করেন। সাহিত্য সমাজ বাস্তবতার দায় পূরণে সক্ষম নাকি অক্ষম ? বিশদে বলবেন।
উত্তর : শুধু গল্পের জন্য তো গল্প হয় না, গল্পের মধ্যে অনেক জিনিস থাকে। একটা গল্প গল্প হয়ে ওঠার জন্য তার ভিতরে এবং পেছনেও অনেক চাপ থাকে। গল্পে পাঠক কী দিতে চান, তার চেয়ে পাঠক কাহিনি বা গল্পরসের সঙ্গে কী পান, সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কোন গল্প-উপন্যাসে কী বলতে চেয়েছি, তা নিয়ে বিশদে কিছু বলতে পারব না। হ্যাঁ, লেখক হিসেবে সামাজিক দায় অবশ্যই অনুভব করি। তবে একজন রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজসেবী ও অন্যান্য সফল পেশাজীবীরা যেভাবে সামাজিক দায় পালন করেন, সামাজিক দায় পালনের জন্য তাদের সামনে যেমন বৃহৎ সামাজিক জনগোষ্ঠী থাকে, নগদ দেনা-পাওনার হিসাব থাকে, লেখকের সামাজিক দায় পালন অবশ্যই সেরকম নয়। লেখকের সামনে থাকে তার নিজের মতোই নিভৃত একজন পাঠক, সেই নিভৃত পাঠকের মাধ্যমে লেখক কী দায় পালন করলেন, তা প্রোপাগান্ডা লিখে, স্লোগান বা বক্তৃতা দিয়ে বোঝানো যাবে না। একটি জনগুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যায় রাজনীতিক বা সাংবাদিক তাৎক্ষণিক যে দৃষ্টিগোচর দায় পালন করেন, সামাজিক দায়বোধ সম্পন্ন লেখকও তার লেখার মাধ্যমে অনুরূপ দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে পারেন, কিন্তু লেখাটিকে শিল্পোত্তীর্ণ বা কালোত্তীর্ণ করার দায় মেনেই তাকে সে দায়িত্ব পালন করতে হয।
প্রশ্ন : গল্প-উপন্যাস লিখে পাঠক ধরতে চান কি ? অনেক লেখক চান তাদের বই বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছে যাক। এজন্য বিভিন্নরকম কৌশল অবলম্বন করেন। সস্তা বিনোদনের জাল ফেলে পাঠকদের কব্জা করেন। এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী ?
উত্তর : শুনতে পাই, অনেক লেখক ছেলেধরার মতো পাঠক ধরার জন্য বইমেলায় ওঁত পেতে থাকেন। আমি তো রনজু বইমেলাতেও যাই না। গেলেও চুপেচাপে একদিন গিয়ে বই হয়তো কিনে আনি। বই তো শুধু মৌসুমি ফলের মতো বেশি চোখে পড়ে বইমেলায়। বইমেলা এলে লেখকেরাও ফেসবুকে গ্রুপ করে নানা কায়দায় প্রচারণা চালান। তরুণদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমিও ফেসবুকে নিজের নতুন বইয়ের খবর দিতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু দেখেশুনে এমন বাজে অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এখন সোস্যাল মিডিয়াতে আত্মপ্রচারণা ও সস্তা সামাজিকতা ভালো লাগে না। তবে সত্য যে, পাঠকের কাছে পৌঁছতে চান সব লেখকই। বড় লেখক হবার স্বপ্ন নিয়ে যখন যাত্রা শুরু করেছিলাম, ভাবতাম, আমার লেখাও একদিন সারা বিশে^র অগণিত পাঠক পড়বে, এমনকি আমি মরে যাওয়ার পরও পড়বে। কিন্তু ৫০ বছরে বিশে^ এত বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেছে যে, এখন শুনি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সও লেখক-পাঠকের কাজ করবে। তথ্য-সাম্রাজ্যবাদীদের মুনাফা জোগাতে বিশ^বাসী এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাধারণভাবে সাহিত্যের পাঠক সারা বিশে^ কমছে বলে মনে হয়। বিশে^ ত্রিশ কোটিরও উপরে বাংলাভাষী মানুষ, কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত লেখকের বই ছাপা হয় মাত্র তিনশত কপি, তাও তিন বছরে বেচাবিক্রির নিশ্চয়তা নেই। এই সংকটের সমাধান তো একা লেখকের দায় নয়, সম্ভবও নয়। আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, বৃহত্তর পাঠক ধরার জন্য কলা-কৌশল করাটা কিংবা বিনোদনের জাল-ফেলা জালুয়া হওয়াটা লেখকের কাজ নয়। আমার কাজটি নিজের মতো করে নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাব। প্রয়োজন বোধ করলে বর্তমান ও আগামীর পাঠক নিজের গরজে খুঁজে নেবে, না নিলে নেই হয়ে যাব।
প্রশ্ন : অর্থের জন্য, পুরস্কারের জন্য, সামাজিক মর্যাদার জন্য, সামাজিক দায়বোধ থেকে নাকি মানসিক প্রশান্তির জন্য লেখেন ? বিশদে জানাবেন।
উত্তর : লেখালেখির উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে চারটি কারণ বললে, তার মধ্যে প্রথমটা অস্বীকার করতে পারব না। আমি যেহেতু পেশাদার লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি, লিখে অর্থ চেয়েছি, এখনও চাই। পুরস্কার পাওয়ার জন্য লিখি না। সামাজিক মর্যাদা বাড়াবার জন্য তো মোটেই না। যে সমাজে লাখে দু-চারজনও সাহিত্য পড়ে না, ঘরের লোকজনও লেখক হিসেবে মর্যাদা দেয় না, সেই সমাজে লেখকের সামাজিক মর্যাদা না খুঁজে, তার বরং সমাজবিরোধী হওয়াই উত্তম। তারপর জানতে চাও, সামাজিক দায় বোধ থেকে লিখি কি না ? এ প্রশ্নের উত্তর আগের এক প্রশ্নে দিয়েছি। আর মানসিক প্রশান্তি ? লিখে তা পুরোপুরি মেলে কই রে ভাই! একটি লেখা শেষ করে অতৃপ্তি বা ব্যর্থতার বোধে আক্রান্ত হই। ফলে আবার নতুন লেখা শুরু ও শেষ করার যন্ত্রণায় ভুগি। তারপরও লিখি কেন ? আসল কারণটা সম্ভবত এই, লেখা ছাড়া অন্য কোনও কাজ ভালো পারি না। সাহিত্যকেই মনে হয় আমার বিকল্প জীবন, সাহিত্যের মাধ্যমে খুঁজি জীবনের মানে, বেঁচে থাকার আনন্দ এবং সার্থকতা।
প্রশ্ন : বাংলা কথাসাহিত্যে অনেক বড় মাপের লেখক থাকলেও বিশ্বসভায় তাদের আসন নেই বললেই চলে―কেন ? বিশদে বলবেন।
উত্তর : হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরও তো বাংলা সাহিত্যে অনেক লেখক এসেছেন, তারা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য হয়েও পাননি, ব্যাপক অনুবাদের মাধ্যমে বিশ^সাহিত্যের পাঠকের কাছেও পৌঁছতে পারেননি। এর কারণটা বিশদে তুমি প্রকাশনা-প্রচারণা বিশেষদজ্ঞদের কাছে জেনে নিও, আমার অন্য কাজ আছে।
প্রশ্ন : ইংরেজি ও কমনওয়েলথ ইংরেজি লেখকদের বই যেমন লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয় বাংলা ভাষার জনপ্রিয় লেখকদের ইংরেজি অনুবাদ সেদিক থেকে প্রায় বিক্রি হয় না বললেই চলে। তাহলে কি ধরে নেব―আমরা যাদের বড় লেখক বলে জানি তারা আদপে বড় লেখক নন, এবং একই সঙ্গে আমাদের সাহিত্য-রুচি তলানিতে ঠেকেছে।
উত্তর : ইংরেজিতে রচিত ও প্রকাশিত হলেই কি সাহিত্যের বই লক্ষ কপি বিক্রি হয় ? আমি তো আমেরিকায় গিয়ে দেখেছি কবিতার বই ৫০০ কপি এবং উপন্যাস এক-দু হাজারের বেশি চলে না, এমন লেখকও সে-দেশে অনেক। বইয়ের আন্তর্জাতিক বিপণন-বাজার সম্পর্কে আমার ধারণা তেমন গভীর নয়। দেশে জনপ্রিয়দের কার কী বই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে এবং তা কেমন চলেছে, ঠিক জানি না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজাজ্জান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, নাসরীন জাহান, ওয়াসি আহমেদ ও মশিউল আলমের বইও তো ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে শুনেছি। দেখি, শেষোক্তদের কাছে জেনে নেব, ইংরেজিতে তাদের বাজার কেমন। তবে মার্কেজ বা নোবেলজয়ী অনেক বড় লেখকের বই মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে বলেই পুরস্কার, বিক্রি বা জনপ্রিয়তাই কিন্তু বড় লেখক বা ভালো সাহিত্য নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি নয়। এটা বিশ্বাস করি বলে, বই তেমন বিক্রি হবে না জেনেও মানসম্পন্ন সাহিত্য রচনার স্বপ্ন দেখি, চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : সাহিত্যের রাজনীতিকে ভাষা এবং অর্থনীতি কতটা প্রভাবিত করে ? বিশদে বলবেন।
উত্তর : তোমার এ প্রশ্নটা ঠিক বুঝতেই পারলাম না, উত্তর দেব কী ? আমার মনে হয় সাহিত্য বিশেষজ্ঞ, ভাষাবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা বুঝবেন ও বিশদের বলতে পারবেন।
প্রশ্ন : এখন তথ্যপ্রযুক্তি ও মিডিয়ার যুগ। মিডিয়ার আশীর্বাদে কেউ কেউ বড় লেখক। রাতারাতি বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন। পাশাপাশি ক্ষমতা ও অর্থের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ফায়দা নিতেও দেখা যায় অনেক লেখককে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
উত্তর : যাদের এসব দরকার আছে, তারা করুক না। আমি বাধা দিলেই কি শুনবে ? ব্যক্তিগতভাবে মিডিয়া, ক্ষমতা বা অর্থবিত্তের আশীর্বাদ কিংবা বৃহত্তর পাঠক কোনওটাই আমার দরকার নেই। এসব অর্জনের প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থেকে, নিজের কাজটি করে যেতে চাই।
প্রশ্ন : সাহিত্যের পুরস্কার এনজয় করেন কি-না ? শুনেছি তদবির না করলে কপালে পুরস্কার জোটে না। আপনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেতে কোনও তদবির করেছিলেন নাকি-না ? কিংবা আপনার জন্য পুরস্কার কতখানি অপরিহার্য ছিল ?
উত্তর : আমার তো লেখক জীবন শুরু হয়েছিল পুরস্কার দিয়েই। শুরুতে বেশ এনজয় করেছিলাম, বিশেষ করে পুরস্কারের টাকাটা। ১৯৯৮-এ বাংলা একাডেমির পর, দীর্ঘ প্রায় দু যুগের ব্যবধানে গত বছর পেলাম ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার। পুরস্কার গ্রহণ উপলক্ষে হোটেল সোনারগাঁয়ে যাওয়া, আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান―এনজয় করিনি। তবে পুরস্কারের টাকা দু লক্ষ কাজে লেগেছে। পুরস্কার পাওয়ার জন্য তদবির কখনওই করিনি। এ জিনিসটা আমার স্বভাবের সঙ্গে মেশে না, এটা আমার শত্রুরাও বলবে। তবে আমার জন্যে তদবির-সুপারিশ পুরস্কারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ করেছেন নিশ্চয়ই। নইলে পেলাম কী করে ?
প্রশ্ন : বিশ্বসাহিত্যে আপনার প্রিয় লেখক কারা ? বিশ্বসাহিত্য পঠন অভিজ্ঞতা ও প্রিয় লেখকদের লেখা সম্পর্কে বিশদে জানাবেন।
উত্তর : অনেকে আছেন। আমার সৌভাগ্য যে, যৌবনের শুরুতে আমি একাধিক গণ-পাঠাগারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলাম। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রেও দীর্ঘদিন চাকরি করেছি। প্রচুর পড়ার সুযোগ পেয়েছি সে সময়। বিশ্বসাহিত্য অনুবাদে বাংলায় যা সহজলভ্য, কেবল তা পড়ে পাঠতৃষ্ণা তৃপ্ত হয়নি। ফলে বেশি পড়ার জন্য ইংরেজি ভাষাটাও রপ্ত করেছি পড়তে পড়তেই। এরপর কালজয়ী ক্লাসিক হিসেবে চিহ্নিত লেখক যাঁদের বই পড়েছি, তাদের মধ্যে টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, গোর্কি, চেখভ, ও হেনরি, হেমিংওয়ে, ফকনার, ডিকেন্স, বালজাক, ক্যামু, কাফকা, গুন্টার গ্রাস, মিলান কুন্ডেরা, মার্কেজ, য়োসাসহ ল্যাটিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজম বা বুম জেনারেশনের লেখক, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদ নিয়ে কাজ করা অনেক আফ্রিকান লেখক এছাড়াও ভারতীয় ইংরেজি ভাষার লেখকদের মধ্যে অরুন্ধতি রায়, ঝুম্পা লাহিড়ি প্রমুখ বিশ^খ্যাতদের নামগুলো মনে পড়ছে। সাহিত্যবোদ্ধাদের প্রশংসিত ক্লাসিক সাহিত্যের বই যখন যেটা জোগাড় করতে পেরেছি, পড়েছি। কিনে পড়ার মতো টাকার জোর ছিল না। পাঠাগার ছাড়াও ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বিশ্বসাহিত্যের নানা বই দিয়ে আমার পাঠতৃষ্ণা মেটাতে সাহায্য করেছিলেন কিছু গ্রন্থকীট মানুষ, তাঁদের মধ্যে জহুরুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মফিদুল হক ও বন্ধুদের মধ্যে নাঈম হাসান, ওয়াসি আহমেদ-এর কথা মনে পড়ছে। সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্যের নোবেল জয়ী দুই লেখকের দরকারি দুটি বই, জে. এম. কোয়েটজির ডিসগ্রেস এবং মারিও ভার্গাস য়োসার ফিস্ট অব দি গোট পড়ার জন্য খুঁজছিলাম। আমার এক পাঠকবন্ধু বই দুটি উপহার দেওয়ায় পড়ে বেশ এনজয় করলাম, লেখক হিসেবেও উপকৃত হলাম। বিশ্বসাহিত্যের প্রিয় লেখকদের লেখা নিয়ে বিশদে এখন আলোচনা সম্ভব নয়। তবে পাঠক হিসেবে এসব মহৎ সাহিত্য পড়ে কী পাই, দু-এক কথায় সংক্ষেপে এভাবে বলা যায় : কালজয়ী সাহিত্য পড়ে আমি নিজের জীবনকে চিনতে শিখি, এক জীবনে বহু জীবন যাপনের আনন্দ পাই। মানুষের প্রতি সমবেদনা সহানুভূতির বোধ এবং বিশ্বমানবতার সঙ্গে একাত্মতার বোধ গভীর হয়। মানবসমাজের অতীত, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আস্থা ও বিশ্বাস দৃঢ় হয়। এরকম কত যে লাভ হয়, লিখে শেষ করা যাবে না।
প্রশ্ন : বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ বাংলা সাহিত্যে এত কম কেন ? বাধা কোথায় ? আপনার কী মনে হয়।
উত্তর : আমার মনে হয়, বিষয়টা নিয়ে তুমি দেশের অভিজ্ঞ অনুবাদক, প্রকাশক ও সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারো। সামগ্রিকভাবে দেশের প্রকাশনার সংকট ও সাহিত্যের পাঠক কমে যাওয়াটাও একটা বাধা। বাধাগুলি সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণ ও তা দূর করার উদ্যোগ খুবই জরুরি।
প্রশ্ন : ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকান লেখকরা সমাজ পরিবর্তনে, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একই সঙ্গে লেখার টেবিলে ও রাজপথে সোচ্চার। সেদিক বাংলাভাষার লেখকরা ক্ষমতার মাখনের ভাগাভাগি ও মোসাহেবিতে সাবলীল। এ বিষয়ে কিছু বলবেন ?
উত্তর : জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমাজ পরিবর্তনের বড় হাতিয়ার তো রাজনীতি, যা রাজপথেও সোচ্চার হয়। শুধু ল্যাটিন আমেরিকা-আফ্রিকা কেন, আমাদের দেশেও ঔপনিবেশিক আমলে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে যখন কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা জোরালো ছিল, তখন কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়সহ অনেক লেখক-কবিও এসব আন্দোলন-সংগঠনে জড়িত ছিলেন। ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন অনেক মানবতাবাদী লেখকও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও লেখক- বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ যুক্ত ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর পরিস্থিতির বদল হতে থাকে। এখন জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার বা সমাজ বদলের জন্য বিশ্বাসযোগ্য রাজনীতি-আন্দোলন রাজপথে নেই, লেখকেরা আর যাবে কোথায় ?
প্রশ্ন : ভাষা বাংলা হলেও দুই বাংলা (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম) এবং প্রবাসে বাংলা কথাসাহিত্যের মৌলিক পার্থক্য কোথায় ?
উত্তর : একই ভাষা নিয়ে লিখছি সবাই, তারপরও ওপার বাংলা ও এপার বাংলার লেখায় কিছু পার্থক্য তো ঘটবেই। কারণ ভারত ও বাংলাদেশ পৃথক রাষ্ট্র, দু দেশের রাজনীতি ও সামাজিক পরিবর্তনের গতি-প্রকৃতি তো একইভাবে ঘটেনি। ভারতে সামরিক শাসন হয়নি, আমরা সেটা ভালো করে দেখেছি। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। এখন ভিন্নতর রাজনৈতিক বাস্তবতা সংস্কৃতিতেও ভিন্নতার ছায়া ফেলে। এসব পার্থক্য ছাড়াও ধর্ম-সংস্কৃতির পার্থক্যটাকেও বড় মনে হয়। তবে দু বাংলার সাহিত্যের বর্তমান মৌলিক পার্থক্য কোথায়, সাহিত্য গবেষকরা ভালো বলতে পারবেন। প্রবাসী বাংলা কথাসাহিত্য নামে সাহিত্যের কোনও শাখা হতে পারে বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন : লেখালেখি নিয়ে আগামীর ভাবনা কী ? কী এমন লিখতে চান এখনও লেখা হয়ে ওঠেনি।
উত্তর : বলেছি বোধহয়, লেখক হিসেবে আমি বেশ অতৃপ্ত। প্রায়শ ব্যর্থ লেখক মনে হয় নিজেকে। এই ব্যর্থতা-অতৃপ্তির বোধ থেকে দুটো বড় উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করে যাচ্ছি বছর দুয়েক ধরে। একাগ্র শ্রম ও সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা আসে নানা রকম। জানি না শেষ পর্যন্ত শেষ করতে পারব কি না।
প্রশ্ন : বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা কথাসাহিত্য পা চালাতে পারছে না কেন ?
উত্তর : জানি না। আমি তো লেখার সময় কারও সঙ্গে পা মিলিয়ে চলার কথা ভাবিও না।
প্রশ্ন : আপনি যাদের উত্তরাধিকারী মনে করেন, তাদের প্রস্তুতি কেমন হওয়া সমীচীন ?
উত্তর : কে বা কারা আমার উত্তরাধিকারী, আদৌ তেমন কেউ আছে কি না, জানি না রনজু রাইম। তুমি সেরকম কাউকে খুঁজে পেলে জানাবে, চা-টা খাইয়ে দেব। তবে আমার পরে যারা আসবেন, সময়ের দাবি পূরণে অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেদের পথ নিজেরাই খুঁজে নেবেন তারা। পথের অন্বেষণে, পূর্বসূরিদের অভিজ্ঞতা, সাফল্য ও ব্যর্থতা তাদের সহায়তা করতেও পারে।
প্রশ্ন : আপনার লেখালেখির কালে বাংলা কথাসাহিত্যের কতখানি বিবর্তন করেছেন।
উত্তর : বিশ্বায়নের ধাক্কায়, তথ্যপ্রযুক্তি তথা ইন্টারনেটের আগ্রাসনে আমাদের সাহিত্য শিকড়চ্যুত হচ্ছে। এখনকার তরুণ লেখকরা আলোচিত হাতেগোনা দু-একটি নাম জানা ছাড়া পূর্বসূরিদের লেখা পড়ে বলে মনে হয় না। পরের মুখে ঝাল খাওয়া সাহিত্য-বোদ্ধা এ দেশে আগেও ছিল, এখন ইন্টারনেটে তথ্য-সুলভতার কারণে তাদের সংখ্যা যেন বাড়ছে। এরা অন্যের করা মন্তব্য ও মতামত জেনে নিজেদের সাহিত্যজ্ঞান জাহির করবে, হয়তো বলবে, হাসান-ইলিয়াস-জহির খুব বড় লেখক, কিন্তু কেন বড়―নিজেরা পড়ে সেটা উপলব্ধি করেনি।
প্রশ্ন : কমলকুমার মজুমদার, সুবিমল মিশ্র, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহির ও মামুন হুসাইনের মতো বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যিকগণ ভাষার ওপর যে জবরদস্তি করেন―তা পাঠকের জন্য কতখানি স্বস্তিদায়ক।
উত্তর : একটি ভাষার সাহিত্যে সব লেখক তো একইভাবে লিখবে না, নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে এবং সেটা হওয়া ভাষার জন্য ও সাহিত্যের জন্য উপকারী। সহজ ভাষায় সুখপাঠ্য সাহিত্য পাঠে অভ্যস্তরা হয়তো কমলকুমারদের পাঠে স্বস্তি বোধ করবে না, কিন্তু পরিশ্রমী পাঠক পড়ে ঋদ্ধ হবেন বলে বিশ্বাস করি।
প্রশ্ন : ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম। ভাষা সাহিত্যের বাহন। সাহিত্যের ভাষা কতখানি সাবলীল হওয়া প্রয়োজন ?
উত্তর : যতখানি সাবলীল হলে তোমার মতো সচেতন কবি-পাঠকও কাত হয়ে পড়বে, সাহিত্যের ভাষা তেমন বলশালী হওয়াই তো ভালো। না কি বলো ? এর আগে পত্র-পত্রিকা বা অনলাইন-মাধ্যমে অনেকে সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে ফিরিয়ে দিয়েছি তাদের (টিভিতে অবশ্য দু-একবার কথাবার্তা বলেছি নগদ সম্মানী প্রাপ্তি এবং একান্ত এক নায়িকাকে টিভিতে তার নায়ককে দেখানোর সুযোগ নিতে)। কিন্তু শব্দঘর আমার ওপরে বিশেষ সংখ্যা করবে, তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি সাক্ষাৎকার দিতে কথা দিয়েছিলাম। এরপরেও যদি কোথাও দিই, আমার সাক্ষাৎকার প্রদানের ইতিহাসে তুমিই কিন্তু প্রথম হয়ে থাকবে রনজু রাইম। ধন্যবাদ তোমাকে।