প্রিয় মানুষ ও প্রিয় লেখক মঞ্জু সরকার : সুব্রত বড়ুয়া
মঞ্জু সরকারের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা
মঞ্জু সরকার আমার প্রিয় মানুষ এবং প্রিয় লেখকও। প্রিয় মানুষ এজন্য যে বিগত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক অন্তরঙ্গতা অব্যাহত রয়েছে এবং সম্প্রতিককালে দেখাসাক্ষাতের বিরতি দীর্ঘতর হলেও তা কোনওভাবে ম্লান হয়ে যায়নি। আমি ঠিক স্মরণ করতে পারছি না, লেখক মঞ্জু সরকারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আগে নাকি ব্যক্তি মঞ্জু সরকারের সঙ্গে। বিগত শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে আমি ঢাকার মালিবাগ রেল ক্রসিংয়ের সঙ্গে একেবারে গা-লাগানো একটি বাড়িতে থাকতাম। মঞ্জু থাকতেন, যতদূর মনে পড়ে, খিলগাঁও শাহজাহানপুরের দিকে। এই দুই অবস্থানের জন্য সহজ যোগাযোগের পথটি ছিল রেল লাইনের পাশ দিয়ে তৈরি নতুন রাস্তাটি। কর্মসূত্রেও আমাদের নৈকট্য ছিল। মঞ্জু কাজ করতেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে, আমি বাংলা একাডেমিতে। খুব স্বাভাবিক যে, আমাদের আলাপের অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকত এই দুটি প্রতিষ্ঠান এবং অবশ্যই বই ও লেখালেখি। আমি ইতোমধ্যে মঞ্জুর তমস পড়েছি এবং সেটি আমার ভালো লেগেছে। আমার মনে হয়েছে, নিজের বক্তব্য মঞ্জু সরাসরি বলতেই ভালোবাসেন এবং সেটি সহজভাবেই বলতে চান। তাছাড়া তাঁর লেখায় সময় ও সমাজের একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরার প্রয়াসও আছে। তিনি তাঁর পাঠকদেরকে কিছু বার্তাও দিতে চান, কিন্তু সেটি কোনও মতবাদের মোড়কে ঠাসা নিরেট বস্তুর মতো নয়।
সেই সময়ে সপ্তাহে একাধিকবার আমাদের দেখা হতো, কথাও হতো প্রচুর। মঞ্জু সরকার তাঁর লেখার ব্যাপারে যে খুবই যত্নবান সেটি তাঁর কথাতেই বুঝতে পারা যেত। লেখালেখির কাজটা তাঁর কাছে অবসর বিনোদন কিংবা বাড়তি রোজগারের বিষয় ছিল না। তবে লেখক নিজেও যে একজন শ্রমিক এবং তাঁর শ্রমের মূল্য যে তাঁর ন্যায্যত প্রাপ্য সেটি তিনি বিশ্বাস করতেন এবং, যতদূর জানি, এখনও করেন। কিন্তু তিনি যে কেবল অর্থোপার্জনকেই তাঁর লেখার উদ্দিষ্ট ভাবতেন তাও নয়। মঞ্জু সরকারের লেখার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে তাঁরা অবশ্যই জানেন, তিনি তাঁর চেনা জগতের মানুষদের নিয়েই লিখতে আগ্রহী, তবে সেই মানুষদের জাগতিক প্রেক্ষাপট তথা আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে বাদ দিয়ে নয়, ভুলে গিয়েও নয়। কিন্তু তাই বলে তত্ত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকার মানুষও তিনি নন। তিনি যেভাবে সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটকে চিহ্নিত করতে পারেন সেভাবেই তা দেখাতে চান তাঁর লেখায়। আর যতটা সম্ভব সহজে―সেটিই তাঁর নিজস্বতা। সে-কারণেই তাঁর লেখায় যে মানুষদের আমরা দেখতে পাই তাদের কাউকে আমাদের মোটেই অচেনা কিংবা দূরের মানুষ বলে মনে হয় না। তবে এ-কথাও ঠিক―মঞ্জু সরকার নিছক গল্প বলার জন্য তাঁর লেখা নিয়ে হাজির হন না। তিনি তাঁর সময় ও সমাজকে বুঝতে চান এবং তাঁর নিজের মতো করে অন্যদেরও তা বোঝাতে চান। এ কাজটি নিশ্চয়ই কোনও সহজ কাজ নয়। কিন্তু মঞ্জু সরকারের লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো―সেই বুঝতে চাওয়া ও বোঝাতে চাওয়ার কাজটিকে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল করে তুলতে পারা। আমার ধারণা, তাঁর এই সহজতার চেষ্টাই তাঁর কাছ থেকে পাঠক হিসেবে আমাদের বড় প্রাপ্তি।
এই লেখা আমি লেখক মঞ্জু সরকারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও নৈকট্যের কথা বলা দিয়েই শুরু করেছিলাম। সে সম্পর্ক এতদিন পরও যে অটুট রয়েছে তার প্রধান কৃতিত্ব মঞ্জু সরকারেরই। তিনি যে সহজ মানুষ এবং সহজতার জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে ও কাজ করতে চেয়েছেন―সেটিই আমার কাছে তাঁর আকর্ষণের প্রধান বিষয়। কিন্তু তাই বলে তিনি যে কথা নিতান্ত সহজভাবে বলেছেন তাও নয়। তাঁর সহজ উপস্থাপনের অন্তরালে আছে গভীর চিন্তা ও উপলব্ধির শক্ত ভিত, মানুষের জীবন ও সমাজ যেখানে নোঙর বেঁধে আছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক
সম্পাদক, কালি ও কলম