আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

মঞ্জু সরকারের শ্রেষ্ঠ গল্প : শক্তিনাথ ঝা

মঞ্জু সরকারের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

মঞ্জু সরকার বাংলাদেশের সুপরিচিত কথাকার। লেখকের এ যাবৎ রচিত শতাধিক ছোটগল্প থেকে বাছাইকৃত ২৭টি  গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে আলোচ্য শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলনটি। 

লেখক যৌবনে দেখেছেন  বহু হত্যা, যুদ্ধ, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম; শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন, মুজিব হত্যা এবং রাজনৈতিক পালাবদল, অবশেষে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসা। বাংলাদেশে ধর্ম বনাম ভাষিক জাতীয়তাবাদের যুক্তিসঙ্গত অসাম্প্রদায়িকতার এক দীর্ঘ লড়াই চলেছে। হিংস্র রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বাংলাদেশে স্মরণীয় কবিতা-নাটক-গল্প-উপন্যাসের জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্র এবং সরকারের কর্মকাণ্ডের সমান্তরালে বয়ে চলেছে বঙ্গের নিম্নবর্গের জীবনপ্রবাহ। এ জীবন থেকে মঞ্জু সংগ্রহ করেছেন তাঁর গল্পের উপাদান।

গ্রামের ভগ্ন সামন্ততান্ত্রিক জীবনযাত্রায় রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড শিকড় ছড়াচ্ছে। পার্টি, এনজিও, মুদ্রা অর্থনীতি, সর্বোচ্চ মুনাফার বিবেকহীন প্রসার ছায়া ফেলছে গ্রামে-গঞ্জে। কৃষিজমিতে চলেছে নগরায়ন, মোবাইল ইন্টারনেট মিলে গ্রামে। গ্রামের কর্মহীন নারী-পুরুষ নগরের বস্তিতে যায়, পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে যায় আরবে। ফসলের মজুরি দেওয়ার ধার-বাকিতে বিপন্ন নাপিত কানাই নগদ মজুরির লোভে শহরে ‘স্বর্গযাত্রা’ করে। প্রাচীন উচ্চবর্গের মিঞা চরম দারিদ্র্যে দিন কাটায়, অন্যদিকে জমি-সুদ-ব্যবসায় সমৃদ্ধ রজব মণ্ডল নব্য ধনিক হয় (আবরণ)। জনসংখ্যার চাপে, ভূমি গ্রাসের লোলুপতায়  জলাশয়, গাছগাছালি, ঝোপঝাড় হারিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র এবং প্রশাসন ছড়িয়ে দিচ্ছে দূষিত মূল্যবোধ। গ্রামীণ সততা, সদাচার, মানবিক সম্পর্ক ভাঙ্গছে। সর্বোচ্চ মুনাফার সংস্কৃতিতে দেখি পরস্পর পরস্পরকে ঠকাতে চায়, শ্যালকের মৃতদেহের টাকা গায়েবের জন্য তৎপর হয় জামাইবাবু। কাপড়ের কারখানার কর্মী শ্যালিকাকে গিলে খায় জামাইবাবু (ভেতরে মানুষের কান্না)।

নগর এবং গ্রাম, নিম্নবর্গ এবং উচ্চবর্গের বিচিত্র জীবন নিয়ে মঞ্জু সরকার তাঁর গল্পে রচনা করেছেন বাংলাদেশের এক সামাজিক ইতিহাস। গ্রামে দরিদ্র মানুষের নিদারুণ যন্ত্রণার জীবনের ছবি বহু গল্পে ধরা পড়েছে। নগরের বস্তি, রাষ্ট্র―রাজনৈতিক নেতাদের যুগলবন্দিতে শ্রমজীবী মানুষের নিরুপায় দুর্দশা পাই গল্পে। গল্পে উচ্চবর্গের আমলা, রাজনৈতিক নেতাদের ঘুষ, মূল্যবোধহীনতা, নারী লোলুপতার নিখুঁত বর্ণনা আছে (ক্ষমতায়নের খড়গ, উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা)। এ জীবনের রাত্রি, তুলসী দাস কথিত দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রহরের। তখন জেগে থাকে ভোগী এবং তস্করেরা। কিন্তু জীবনের মলমাসে, নিবিড় ঘন আঁধারে স্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে ওঠে সততা নিষ্ঠা, মূল্যবোধ―অপরাজেয় মানবতা (ভূতের সঙ্গে যুদ্ধ, পাখির মা, দলছুট, মৃত্যুবাণ, ক্ষমতায়নের খড়গ, দুধওয়ালির পুষ্টি উৎস)।

গল্পে পাই মুক্তিযুদ্ধের সমসময়ে জাল মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ড (অপারেশন জয়বাংলা)। ফাঁপা মানুষেরা দেখা দেয় রাজনৈতিক দলে এবং প্রশাসনে। মুক্তিযোদ্ধা আমানুল্লা দারিদ্র্য, বার্ধক্য এবং বিস্মৃতির অন্তরালে সরে যায় (প্রিয় দেশবাসী)। রাষ্ট্র-প্রশাসন-রাজনীতির গণবিরোধী ছবি এ গল্পগুচ্ছের সর্বত্র। তথাপি অশুভ এ কালবেলায় বেঁচে থাকে সূর্যোদয়ের প্রত্যাশা। বস্তির ঘর হারিয়ে পাখির মা বলে, ঢাকা টাউনে একটা না একটা কাজ জুটবে, ‘হাত দুইটা তো খইসা যায় নাই’ (পাখির মা)। অভাবসর্বস্ব সামন্তী গাঁয়ে দারিদ্র্য, মৃত্যুর মিছিলে চলে গুপ্তধনের সন্ধান, ‘পায় নাই কিন্তু পাওয়ার আশা আছে’ (মৃত্যুবাণ)। ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ রচনায় শেষ শক্তি দিয়ে মফিজ অন্ধকার ভেঙে বাড়ির দিকে দৌড়ায়। দুধওয়ালির পুষ্টি উৎস, ক্ষমতায়নের খড়গ, দলছুট গল্পে তিন কন্যার দৃঢ় প্রতিবাদে এবং প্রতিরোধে অন্য এক স্বদেশ উদ্ভাসিত হয়। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার, আশাবাদের গতানুগতিক ছক কিন্তু ফিরে এসে এখানকার গল্পগুলিকে সেøাগানে পরিণত করে না। বহু ক্ষেত্রে সময়, ভিন্ন চরিত্র এবং ঘটনা মর্মান্তিক পরিণাম পায়। গল্পের চরিত্রগুলি পরাজিত এবং ধ্বংস হয়। কিন্তু চরিত্রের অন্তর্গত কোনও ত্রুটির জন্য ঘটে না এ শোচনীয় বিপর্যয়। দানবীয় রাষ্ট্র, প্রশাসন নিজ স্বভাবে, শোষণে-শাসনে মানুষকে পিষ্ট করে। তা বাংলাদেশ থেকে আরবে সর্বত্র দৃশ্যমান (আবরণ, ছেলে ধরা, ফাঁদ, আমৃত্যু আকালু, ভেতরে মানুষের কান্না, মরা নদীর ময়না)। কোনও বাঁধা ছক বা পূর্ব পরিকল্পিত তত্ত্বে এসব গল্প শেষ হয় না। মরা নদীর ময়নাতে সহৃদয় লেখক জনতার মার খায়। ‘ছেলে ধরা’তে মমতাময়ী নির্দোষ নারী গণপ্রহারে মরে।  ‘আমৃত্যু আকালুতে’ নির্দোষ আকালু মরে। ‘আবরণ’-এ ধর্ষক হয় সম্মানিত।

এ গল্পগুলি গ্রাম ও নগরের এবং মূলত নিম্নবর্গের নরনারীর। দেশ-সমাজ বদলাচ্ছে। অর্থনীতি প্রাধান্য বিস্তার করছে ধর্ম এবং প্রাচীন সমাজনীতিতে। স্বামীর মৃত্যুর পর চাষের দায়িত্ব নেয় টুনির মা (টুনির মায়ের পুলিশ জামাই)। ছোট দোকান দেয় বিধবা ময়না (মরা নদীর ময়না)। দুধের ব্যবসা করে হাদির মা, শহরে গিয়ে ঝি, পোশাকের কারখানায় কাজ করে কদবানু, জয়গুন। শহরে চাকরি করে মীরা, শান্তা। বিদেশে যায় পিয়া। কিন্তু নারীমুক্তি ঘটেনি। গ্রামে চালু হয় ধনতান্ত্রিক মূল্যবোধও। রাষ্ট্র-প্রশাসনের দোসর হয় সামন্ত পুরুষসংস্কৃতি। রাষ্ট্র―পোশাকের কারখানার অবৈধ গৃহ নির্মাণে সাহায্য করে, লাশ গায়েবে সাহায্য করে। গ্রামের অর্থও দেহলোলুপ ওকিজুদ্দি পুরুষ হিসাবে শ্যালিকার দেহ এবং উপার্জন গ্রাস করে (ভেতরে মানুষের কান্না)। শিক্ষা সামন্ত সংস্কৃতি বা লিঙ্গ বৈষম্য ঘুচায় না (শিকড়ের রস)। এ ছক বদলে যায় মীরার ছুরি হাতে রুখে দাঁড়ানোয় (ক্ষমতায়নের খড়গ)। অন্য ছক নির্মিত হয় নারীর সমানাধিকারে (যৌথ একাকিত্ব)।

ভাষিক এবং ধর্মীয় সংস্কৃতিতে ভিন্ন সোলায়মান সৌদির পথে আবর্জনা কুড়িয়ে জীবন নির্বাহ করে। তার সহকর্মী অন্ধ্র প্রদেশের হিন্দু আধারু। দুজনেরই দেশে পরিবার আছে। উপার্জনের জন্যই এ দেশে আসা। তাদের পার্থক্য ছিল প্রবল। কিন্তু বাড়ির এক মৃত্যু-সংবাদে মুহ্যমান আধারুকে সমবেদনা জানাতে গিয়ে ধরা পড়ে তাদের শ্রেণিগত ঐক্য। কুড়িয়ে পাওয়া পেপসি ভাগ করে খায় তারা। নারীর যে পোশাকগুলি সোলায়মান পেয়েছিল, সেগুলি দেশের ইসলামে বৈধ নয়। সেগুলি সে দেয় আধারুকে, তার কাছে চায় বোরখা। ‘মরুপাহাড়ের বিমূর্ত চাষী’তে ফিরে আসে রাষ্ট্র, ঘুষ, ভূমিহীন-দেশহীন চাষীর আর্তনাদ।

উচ্চবর্গের দুর্নীতির বিস্তারকে আত্মকথনে লিখেছেন গল্পকার (ক্ষমতায়নের খড়গ)। কিন্তু ফাঁদ, যা গ্রাম্য ধূর্ততার এক গল্প, তাও আত্মকথনের রীতিতে লেখা। অবিবাহিতা এক গ্রাম্য মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করার এ গল্পটি কিন্তু অনন্য হয়ে ওঠে, যখন নায়ক মেয়েটিকে এ সংকট থেকে তাকে উদ্ধার করতে বলে। উত্তরে মেয়েটি বলে, ‘আমাকে কে উদ্ধার করবে ?’

রংপুর নিবাসী গল্পকার তাঁর জন্মভূমির কামরূপী উপভাষা সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। রংপুরের মধ্যে ছিল জলপাইগুড়ি জেলাঞ্চল। এ ভূখণ্ডের সংস্কার সংস্কৃতি ব্যবহার করেছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। মঞ্জু সরকার মাটির এ সংস্কৃতিতে দেখেছেন যূথবদ্ধতা। পিয়ার চোখে য়ুরোপীয় প্রগতিশীল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে মানুষ নিঃসঙ্গ। গল্পে  ঢাকার বস্তিতে ঢাকার কথ্য বাকরীতি পাই। নাগরিক শিষ্ট চরিত্রগুলি শিষ্ট বাংলায় কথা বলে। ভাষায়, প্রকৃতি চিত্রণে গল্পগুলি বাস্তবজগতের অনুসরণে বাস্তবতার নানা বিভঙ্গ নির্মাণ করেছে। ফলত বিষয়বস্তুতে, কায়াকান্তির প্রসাধনে, সমাপ্তিতে প্রতিটি গল্পই বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে। নির্বাচিত গল্পগুলি চরিত্রে, প্রকৃতিচিত্রে, বন-নদী-জলাশয়ের বর্ণনায় স্থানিক বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। আরবের পটভূমিকায় লেখা গল্প দুটি এ বিচারে নিখুঁত। গল্পের অনন্যতা পাই এগুলির ঘটনাখণ্ডে এবং সমাজবাস্তবতায়। গল্প নির্মাণেরও নানা বিভঙ্গ। কোথাও লেখক কথক, কোথাও তিনি কথক ও নায়ক। কোথাও চরিত্র গল্প বলে। অন্যত্র লেখক এবং চরিত্র বহন করে গল্পের দায়। গল্পের ঘটনা, চরিত্র, সমাজ বাস্তবতা এবং উপসংহারগুলি বহুবিধ। গল্পকার পরিবেশ এবং চরিত্রগুলিকে জীবন্ত এবং দৃশ্যমান করে তোলেন, এবং আমাদের আবিষ্ট করে রাখেন। এ গল্পগ্রন্থ বিচিত্র ঘটনা ও চরিত্রের এক চিত্রশালা।

গল্পের ভাষা মেদহীন, সংযত, সংহত। চরিত্রগুলির বলনে, চলনে, আত্মপ্রকাশে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, ভাষিক, সাংস্কৃতিক ভূমিখণ্ড সহসা দৃশ্যগ্রাহ্য হয়। মঞ্জু সরকারের শ্রেষ্ঠ গল্প এক বিপণ্ন সময়ের বিষণ্ন মানুষের দিনপঞ্জিকা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button