আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

আখ্যানের ছোট সময় যখন বড় সময়ের স্পর্শক : সাধন চট্টোপাধ্যায়

মঞ্জু সরকারের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

দাম্পত্য কি মানুষের জীবনে কোনও বিলাসদ্রব্যের মতো ? চটুল কোনও খেয়াল বা উপযোগিতা মিটে যাবার পর, বাতিল করে দিয়ে, দ্বিতীয় কোনও নারী-পুরুষের সহবাসে খেলাঘর গড়ে  উঠবে ? যেমন ইদানীং সচ্ছল শ্রেণি ফ্ল্যাটে তাঁদের লোশন, ক্রিম, পমেটস বা নানা ইলেকট্রনিক গ্যাজেট-এর ব্রান্ড বদলায়।

পরিবার, দাম্পত্য, বিবাহ ইত্যাকার বিষয়গুলো যুগ যুগ ধরে প্রথায়, প্রয়োগে বিবর্তিত হচ্ছে। বিষয়টির সামাজবীক্ষণের অন্তর্গত যেমন, কৃষ্টিরও অন্যতম নিয়ামক। এ-শুধু নিছক দুই বিপরীত লিঙ্গের মিলন, ভোগ, সন্তান উৎপাদন, তাদের প্রতিপালন ইত্যাকার বিষয় নয়; আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নানা দৃষ্টিকোণের একটি সন্দর্ভ। এবং কঠিন আইনগত অক্ষদণ্ডের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। নানা দেশে সমলিঙ্গের বিবাহের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলবার দাবি উঠছে। ফলে, সামাজিক একক, পরিবার, যৌনতা, আইন, কৃষ্টি―সব কিছু মিলেই ‘দাম্পত্য’ সম্পর্কটাকে নিছক কোনও ব্যক্তিবিলাসের আওতায় পণ্য হিসেবে দেখলে চলবে না। এবং এই দেখারও গ্লোবাল বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। এবং শ্রেণিগত মূল্যায়নও বিচার্য।

এইসব ভাবনার জটিল সূত্রগুলো উঠে এল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কথাকার মঞ্জু সরকারের দাম্পত্য বিলাস উপন্যাসটি পাঠান্তে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মঞ্জুর স্বতন্ত্র একটি বৈশিষ্ট্য আছে। আমাকে মঞ্জু সম্পর্কে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রথম অবহিত করেছিলেন। একটি চিঠিতে বন্ধুবর ইলিয়াস তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের উল্লেখযোগ্যদের প্রসঙ্গে নামটি করেছিলেন। পরে, ২০০০ সালে বাংলাদেশে যাবার সুযোগে, ঢাকায় মঞ্জুর সঙ্গে আমার আলাপ। তার বছরখানেক আগেই লেখক কথাসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। আলাপে মনে হলো লেখক সামান্য নিভৃতচারী। স্বল্পবাক, অপরের কথা শোনেন বেশি। তার আগেই মঞ্জুর কিছু গল্প পড়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। বুঝেছিলাম লেখকের ‘লিখন কৌশল’ নিচু স্বরে কথা বলার। নাটকীয়তা কম, অথচ ঘটনাগুলো কাহিনি হয়ে গভীর অন্তঃস্রোতে বয়ে চলে।

মঞ্জুর আখ্যান রচনার গুরুত্ব এখানেই, সামাজিক দায়বদ্ধতা খুব সোচ্চারে উচ্চারিত না হয়েও, একটি ভাবনাসমৃদ্ধ সন্দর্ভ হয়ে ওঠে। দাম্পত্য বিলাস উপন্যাসটিতে আখ্যানের সূচনা তার চলন কিংবা গতিপথে কোনও দেশ-রাষ্ট্র বা সামাজিক উথালপাতালের আঁচ নেই। বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ২০০০ সালে। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হবার মাত্র তিনটি দশক পর। সময়খণ্ডটি স্বল্প হলেও, জাতির জীবনে রাজনৈতিক ও সামাজিক যে ঘাত-প্রতিঘাত ঘটে গেছে, সে-সবের কথা আপাতচক্ষুতে উচ্চ রিখটার স্কেলে চলছিল। মুক্তিযুদ্ধ, দখলদারী খা সেনাদের হাতে তিরিশ লক্ষ বাঙালি হত্যা, স্বাধীনতা লাভ, দীর্ঘ মিলিটারি শাসনের ধার, বাঙালি জীবনে গণতন্ত্র, স্বৈরাচার থেকে স্বস্তি, অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, ফের মিলিটারি একচ্ছত্র ক্ষমতার ছায়া―ইতিহাসের গতিপথ স্বাধীন বাংলাদেশের জনজীবনে খুবই পিচ্ছিল হয়ে পড়েছিল। এই আবর্তের মধ্যেই মঞ্জুর এই পাণ্ডুলিপি তৈরি হচ্ছিল, সম্ভবত।

পাঠক হিসেবে লক্ষ করি, এইসবের বহিরঙ্গের কোনও বর্ণই আখ্যানে লাগেনি। আপাতদৃষ্টিতে প্রথম পাঠে, একটি প্রসাদগুণসম্পন্ন অরাজনৈতিক ও বাজার নিয়ন্ত্রিত বেস্টসেলার মনে হবে। এর প্রকাশনা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রথম ফ্ল্যাপে তেমনই একটি উপন্যাস-পরিচিতি মুদ্রিত।

‘ভালোবেসে বিয়ে করেছে নোমান ও লতা। সুখী ও সুন্দর দাম্পত্য যাপনের জন্যে স্বপ্ন ও স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব নেই তাদের। উচ্চবিত্ত সমাজের ভোগ-বিলাস ও পার্টি-কালচারে অভ্যস্ত লতা স্বামী ও সংসারকে গড়ে নিতে চায় একান্ত আপন আকাক্সক্ষার আদলে। কিন্তু লতার চোখে নোমানের স্বপ্নভুবন মানে বই, ছন্নছাড়া কিছু কবিলেখক বন্ধু, শিকড়বিহীন আদর্শবিলাস নিয়ে মদ্যপানের সঙ্গে বল্গাহীন আড্ডার আনন্দ আর অজস্র কথার ফুলঝুড়ি মাত্র। ফলে ভালোবাসার স্বামী হয়ে ওঠে ভণ্ড, স্ববিরোধী, স্বার্থপর, কখনওবা অসহ্য এক ঘৃণ্য জীব। আত্মমুক্তির জন্য সন্তান, সংসার ও চাকরি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখে লতা। অন্যদিকে স্ত্রীকে সকল প্রকার ব্যক্তিস্বাধীনতা দিয়ে নোমান তার সাহিত্যিক আড্ডায়, কখনও-বা স্ত্রীর বান্ধবী স্বপ্নার সঙ্গে পরকীয়ায় মেতে উন্মুল বাসনার শিকড় খুঁজে পেতে চায়। ভোগবাদী সমাজের তীব্র সম্ভোগ পিপাসায় ভেঙে পড়ে পুরোনো মূল্যবোধ, লতার সংসার গড়ে তোলার প্রয়াস পরিবারের ভাঙনকেই করে ত্বরান্বিত। কিন্তু পরস্পরকে ঘৃণা করেও ওরা পরস্পরকে ছেড়ে দিতে পারে না।’

কাহিনির এটুকু সারাৎসারে উপন্যাসটির বিচার করলে, লেখকের প্রতি অবিচার করা হবে। লেখক নিজেই আমাদের জানাচ্ছেন, উপন্যাসটি তিন খণ্ডে ‘ফুল খেলা’, দাম্পত্য শিল্প’ ও ‘ভোগে ও দুর্ভোগে একা’ নামে বিভিন্ন ঈদসংখ্যায় প্রকাশের পর, একত্র করে  পরিমার্জনের মধ্যে পূর্ণ আখ্যানটি গড়ে ওঠে।

পূর্ণ আখ্যানটিতেও আমরা তিনটি পর্ব লক্ষ করি। স্বপ্ন ও শঙ্কা পর্ব, সন্তান ও স্বাধীনতা পর্ব এবং ভোগ ও দুর্ভোগ পর্ব। পর্বের তিন তিনটি নামকরণের মধ্যে বিপরীত মেরুকরণের খেলা লক্ষ করি, স্বপ্ন এবং শঙ্কা―কল্পিত বাস্তবতার মধ্যে দ্বন্দ্বের বীজ। সন্তান ও স্বাধীনতা পর্ব―কর্তব্যের বন্ধন এবং স্বাধীনতার নামে তা এড়িয়ে যাওয়ার স্বেচ্ছাচার এবং ভোগের স্রোতে দুর্ভোগের ক্লাইমেক্স। ব্যক্তি লতার মধ্যে, তার আশা-আকাক্সক্ষার লক্ষ্য ও তা প্রাপ্তির মধ্যে উপরোক্ত তিন প্রকারের দ্বন্দ্বচরিত্র লেখক আখ্যানে ফুটিয়ে তুলেছেন। লতার সামাজিক স্ট্যাটাস, শ্রেণি অবস্থান থেকে যে-স্বপ্নের কাঠামো গড়ে উঠেছিল, সে-সবের গর্ভেই ছিল শঙ্কার বীজ। এতে কাহিনি যে-ভাবে এগিয়েছে, শঙ্কার বীজগুলো ক্রমশ উপ্ত হয়ে, স্বপ্নের পাশাপাশি অ্যান্টি-স্রোত তৈরি করেছে। আমরা শুরুর অধ্যায়েই টের পাই, লতার জীবনের প্রথম রাতেই নোমানের ছোট্ট একটি ব্যবহারে শঙ্কার অশনি।

‘কনের বেশবাস খুলে বাথরুমে ফ্রেশ হওয়ার পর লতা এরই মধ্যে হালকা প্রসাধন নিয়েছে। দামী পারফিউম ছড়িয়েছে শরীরে। ঘরে ফিরে  আসতেই ঘ্রাণটা পায় নোমান।

এই  জানো, বাবা এতক্ষণ নামাজে বসে আল্লার কাছে আমাদের সুখের জন্য দোয়া করলেন।

বাবা আমার সুখের জন্য আল্লার কাছে যা যা প্রার্থনা করবেন তাতে আমার সুখ হবে না লতা, বরং দুঃখ বাড়বে।

প্রথম দিনেই শ^শুর-শাশুড়িকে অনেকটা বাগে আনতে পারার আনন্দে লতা যখন উচ্ছ্বসিত, নোমানের বিরূপ মন্তব্য তাকে ধাক্কা দেয়।’

পুরো আখ্যানেই―যখনই কাহিনি এগিয়ে চলেছে―লতার অন্তরে জেগেছে নানা বিরূপতার ধাক্কা। এই বিরূপতার ধাক্কাই উপন্যাসটির চাবিকাঠি।

‘সন্তান ও স্বাধীনতা পর্ব’ শুরুই হচ্ছে চরম একটি বিরূপতার মুখোমুখি হয়ে। দাম্পত্যজীবনে প্রথম সন্তান আগমনের বার্তা যে-কোনও নারীর জীবনে গভীর আনন্দ ও এক প্রকার অনির্দিষ্ট মুক্তির স্বপ্ন। বিবাহিত জীবনের উত্তেজনা কয়েক বছরে পুনারাবৃত্ত ক্লান্তির বৃত্তে আবর্তিত হতে থাকলেই নারী সন্তান চায়। এই কামনার নিহিত সুরের মধ্যে, অন্যরকম একটি নোট নারীত্বের স্বাধীনতা। এ-স্বাধীনতার স্বরূপ যৌনক্লান্তির বাইরে, স্বামিত্বের পৌরুষ বন্ধনের সীমা ভেঙে, অনাবিল কোনও আনন্দ-তরঙ্গ। আমরা টের পাই, সন্তান ক্রোড়ে কোনও নারীর ছবি এক প্রকারের প্রাকৃতিক আনন্দের অন্যতম উপলক্ষ্য। এ ধারা অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। দাম্পত্য বিলাস-এর দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, লতার সেই গূঢ় কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা পর্বে বিপুল কোনও বিরূপতার ধাক্কা এসে লাগছে :

‘গোপন খবরটিকে সুখবর ভেবে নোমান খুশি হয় না, আবার অ্যাকসিডেন্ট ধরে নিয়ে আঁতকেও ওঠে না। ঠোঁট উল্টে তৎক্ষণাৎ পরামর্শ দেয়, এটা কোনো ব্যাপার হলো। কোনও ক্লিনিকে গিয়ে এম আর করে এসো।

লতা অবাক হয়। ছেলেরা, যাকে বলে তাদের ঔরসজাত অঙ্কুর এত সহজে ধ্বংস করতে চায়! কিন্তু লতাকে ভালমন্দ ভূত-ভবিষ্যৎ ভাবতে হচ্ছে অনেক। একান্ত ভাবনায় নোমানকে শরিক করার জন্যে সে তাকে হালকা খোঁচা দেয়।

মনে হচ্ছে অনেক এম আর করিয়েছো তুমি।

মেয়ে হলে নিশ্চয়ই করতাম, বিয়ের আগেও করাতাম। কেন তুমি করাওনি ?

নোমান! হোয়াট ডু ইউ মিন ?’

এভাবেই নানা বিরূপতার ধাক্কায় পাঠক দেখতে পাবেন, লতা মা হয়েছে। তার জীবনে জটিলতা বেড়েছে, দায়িত্বের চাপ ঘন হয়েছে এবং নোমানের মধ্যে জীবনযাপনের উচ্ছৃঙ্খলতা বেড়েছে যেমন, শিকড়হীন বুদ্ধিবিহীন পাগলামির চর্চাও বেড়েছে অনেক। আর লতার শাশুড়ি-শ^শুর ? নূরজাহান ও সাখোয়াত ?

স্বভাবতই, আমেরিকায় অনাবাসী ননদ সাদিয়া এই সব বিরূপতার ধাক্কায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে নানা সময়ে, বিচিত্র সুর তুলেছে, যা মঞ্জুর পরিণত কলমে সার্থক ফুটে উঠেছে।

‘ভোগ ও দুর্ভোগ পর্বে’ বিরূপতার মাত্রা চূড়ান্তে পৌঁছায়। দাম্পত্য তখন লতার পক্ষে না হলেও, নোমানের পক্ষে গলার ফাঁস হয়ে উঠেছে। সে গোপনে লতারই বান্ধবী  আমেরিকা থেকে আসা স্বপ্নার সঙ্গে পরকীয়ায় মশগুল।

যাক, শাশুড়ি এবং লতার মধ্যে মানসিক টেনশন, নূরজাহানের আধিপত্যের দাপট ও পুত্রবধূর উচ্চ স্ট্যাটাসের ক্ষমতাকে সরাসরি অগ্রাহ্য করার দৃশ্যে আমরা উপলব্ধি করি একটি দুর্ভোগ পর্ব লতার  দাম্পত্য অবস্থানে ছায়া ফেলছে। শাশুড়ি আর লতার সম্পর্কের মধ্যে কোনও শালীনতার পর্দাটুকুও ঝুলিয়ে রাখতে চাইছে না। সুযোগ পেলেই সরাসরি আক্রমণ করছে।

‘বিকেল থেকেই আজ নোমানের বাসায় থাকার কথা। লতার ধারণা ছিল, বাবার আদর-যত্ন পেয়ে নীলা (দাম্পত্য সন্তান) হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু মুহূর্তেই বুঝতে পারে সে, নোমান এখনও ফেরেনি। যেহেতু বুয়ার (কাজের মেয়েটি) প্রতি নির্দেশ আছে, তারা দুজন বাসায় না থাকলে বুয়া নীলাকে নিয়ে নিচতলায় থাকবে। বারান্দায় বুয়াকেও দেখতে পায় লতা। উপরে ওঠার  সিঁড়িতে যাওয়ার বদলে দ্রুত বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়।’

কী হয়েছে মা, নীলা এত কাঁদছে কেন ?

কী এমন চাকরি করো, বুঝি না বাবা। রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত একা মেয়েমানুষকে অফিসের কাজ করতে হয়!

বিলম্বের কোনও কৈফিয়ত না দিয়ে, এখন এ বিষয়ে শাশুড়ির সঙ্গে কোনওরকম কথা বলার অরুচি বোঝাতে লতা  স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দেয় শুধু, হ্যাঁ। নীলার কী হয়েছে ? বুয়া ?

শাশুড়ির মনের জ্বালা তখনও ফুরায়নি, এবার সরাসরি আক্রমণ করে, ‘যেরকম সাজগোজ করে অফিসে যাও, দিনরাত অফিসে এত যে কলম পেষো, মনেই হয় না, বাইরে গেলে নীলার কথা , সংসারের কথা মনে থাকে তোমার।’

শাশুড়ি-বউয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ছিঁড়ে-ফেঁড়ে, কদর্য ইঙ্গিত। বিরূপতার দ্বন্দ্বটি আর  বন্ধুতামূলক থাকে না, যন্ত্রণায় পরিণত।

ইতোমধ্যে নোমান ওপরে উঠে আসার পর ‘বইয়ের সংগ্রহ আরও বেড়েছে। দেশের বিখ্যাত অনেক কবি-লেখকই নোমানের পড়ার ঘর দেখে মুগ্ধ হয়েছে। অবসরে নিজের ঘরে সাজানো বইপত্র দেখে নিজেও নোমান মুগ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে। মুশকিল হলো, দীর্ঘ সময় ধরে একটি বইয়ের ভেতর ডুবে থাকার মতো মানসিক স্থৈর্য নোমানের প্রায়শ থাকে না। আগেও  ছিল না, এখন আরও কমে গেছে। ঘরে একা হলে ঘুরেফিরে স্বপ্নার কথা মনে পড়ে তার।’

‘দাম্পত্য বিলাস’-এ নোমান নেতিবাচক চরিত্র নয়, স্রেফ ভণ্ড। এক ধরনের মেকি, ফাঁপা, শিকড়বিহীন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি। শিক্ষিত, অর্থবান, সংস্কৃতির সেন্ট-পাউডার মাখা শ্রেণির  মেয়েরা আপাত মুগ্ধতায় এদের মোহিনীশক্তিতে ছুটে আসে। বলা চলে, আধুনিক কর্পোরেট সংস্কৃতির এক প্রকার প্রোডাক্ট। প্রেম, বিবাহ, দাম্পত্য এদের কসমেটিকসের মতো এক প্রকার বিলাসদ্রব্য। দেশ, সমাজ, জীবন―কোনও কিছুর প্রতি খাঁটি দায়বদ্ধতা নেই। আবার পশ্চিমি সংস্কৃতির মতো দাম্পত্যকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে, পুরানো সম্পর্ক ছিন্ন করতেও পদক্ষেপ নিতে জানে না। একে বলা যায় দুর্বল ব্যভিচারিতা। আর ব্যভিচারিতাকে পশ্চিম কি পুব কোনও সংস্কৃতিই মান্যতা দেয় না।

‘স্বপ্না! লতার সন্দেহ অমূলক নয়। আমি আপনাকে ভালোবাসি স্বপ্না।’

স্বপ্নার হাসিতে অনুমোদন নাকি প্রত্যাখ্যান বেজে ওঠে, নোমান বুঝতে পারে না। নোমানের চোখে চোখ রেখে কথা বলে সে।

শুধু লতাকে ভালোবেসে মন ভরছে না ?

লতাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি সত্য। কিন্তু আপনার প্রতি ভালোবাসাটা একটুও মিথ্যে নয়। বরং লতার চেয়ে বেশি সত্য, অনেক বেশি গভীর ও মধুর হয়ে উঠছে দিন দিন।’

আমরা প্রোডাক্ট বোঝার জন্য বিজ্ঞাপনী ভাষায় লক্ষ করি যেমন ‘দিল মাংগে মোর’ বা ‘বেস্ট অব দি বেস্ট’ বা ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট থেকেও বেশি’― ইত্যাকার ফ্যান্টাসিগুলো, নোমানের প্রতিশ্রুত শব্দগুলো তেমনি। ‘লতার চেয়েও বেশি সত্য,  অনেক বেশি গভীর… ইত্যাদি ইত্যাদি।’

অবশেষে স্বপ্নাকে নিয়ে নোমান দূর গ্রামে পরিচিত বন্ধুর বাড়িতে ওঠে। সেখানে গিয়ে বিকেলে নৌবিহারে বেরিয়ে স্বপ্নার মুখে মুহূর্তের জন্য কালো ছায়া নেমেছিল। ‘আমার খুব ভয় করছে গো নোমান! কী যে কপালে আছে! ভবিষ্যতের শঙ্কা নোমানেরও ছিল। মাথা নেড়ে গভীর স্বরে জবাব দিয়েছিল সে, আমাদের প্রেম বন্ধুত্ব কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সকল পরীক্ষায় জয়ী আমাদের হতেই হবে, তাই না ?

অবশ্যই। আধবুড়া মাঝি তাদের কথাবার্তা শুনে কী বুঝেছিল সে জানে, হেসে সাহস জুগিয়েছিল, কোনও ডর নাই, মাঝখানটায় দুইজনে থির হইয়া বহেন, তাইলে নাও আর টলমল করব না।’

এ কি সাধারণ কোনও মাঝির মামুলি সংলাপ ? নাকি, লেখক এর থেকে বড় কোনও ভাবজগতের  ইঙ্গিত দিচ্ছে ? ঐ যে ‘সন্তান ও স্বাধীনতা পর্ব’র পর, নোমান-লতার জীবনে আমরা ‘ভোগ ও দুর্ভোগ পর্ব’ লক্ষ করছিলাম, তা কি নিছক কোনও দম্পতির জীবনগল্প, নাকি বাংলাদেশের জন্ম, স্বাধীন সন্তান হিসেবে ভূমিষ্ঠ হবার পর,  ভোগ ও দুর্ভোগের যে পালা চলছিল, উত্তাল  সামাজিক পরিস্থিতি, উন্মাতাল অবস্থাটা যেভাবে দুই ভিন্ন মেরুর টানাটানিতে অনিশ্চিত হচ্ছিল, তাতে মধ্যপন্থাই সমাধানের পথ ? ‘মাঝখানটায় দুইজনে স্থির হইয়া বসেন, তাইলে নাও আর টলমল করব না।’

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর যে-মধ্যবিত্তের সৃষ্টি, তাদের উপরিভাগের অংশটির জীবনযাত্রা থেকে মানসিকতা, মিশ্র সংস্কৃতি এবং রোম্যান্টিকতার নামে শিমুল তুলোর মতো ভেসে বেড়ানো, অস্থিরতার নানা ছায়া-আলোর চিহ্ন এ-উপন্যাসে আছে। আছে কিছু দিশাহীনতার চিহ্ন।

সুলিখিত একটি উপন্যাস। ভাষা, চরিত্রের উহ্য অন্তর্দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তোলাতে লেখকের সাফল্য প্রমাণ করে, মঞ্জুর কলমটি জবরদস্ত। তবে, লতা ও নোমানের প্লেনে পাশাপাশি বসে সন্তানসহ আমেরিকায় পাড়ির যুক্তি যথেষ্ট বাস্তবতার ভূমিতে দাঁড়িয়ে নেই। অনেকটা যেন লেখকের ইচ্ছেপূরণ। তাছাড়া, লতার ব্যক্তিসংকটে তার বাপের বাড়ির ভূমিকা প্রায় অনুপস্থিত। লতা তো সামান্য মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেনি। বরং ঢাকায় অবস্থিত অভিজাত অঞ্চলের বাসিন্দা এবং আর্থিক সচ্ছলতা আছে। নব্য উচ্চবিত্ত পরিবার। সুতরাং ক্ষমতার অধিকারী। দেশের শাসনব্যবস্থায় মিলিটারি শক্তি এবং অভিজাত শ্রেণির ছাপ আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর। লতার সমস্যায় বাপের বাড়ির ভূমিকাটি লিখিত থাকলে, আমরা স্বাধীন দেশটির শাসনের শ্রেণিচরিত্র সম্পর্কেও খানিকটা নমুনা পেতাম।

এ-প্রত্যাশার কারণ, লেখকের আখ্যানের অধ্যায়ভাগ ও নামকরণের মধ্যে দ্বৈত ছায়া আছে। এই দ্বান্দ্বিক পরিণতিগুলো যেমন নোমান ও লতা দম্পতিটির পক্ষে সত্য, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে  মুক্তির ছয় দফা, নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ হয়ে দেশের শাসনযন্ত্রের কাঠামোও এ-সব দ্বন্দ্ব ও বাস্তবতা সকলের মধ্য দিয়ে গেছে। তুল্যমূল্য বিচারের মধ্য দিয়ে পাঠক লতার দাম্পত্যজীবনের ছোট সময়ের লেন্স দিয়ে, বাংলাদেশের একটি বড় সময়ের ইতিহাস বুঝে নিতে পারত। কিছুটা আভাস আখ্যান বিশ্লেষণে দেখতে পাই। মঞ্জু সরকারকে অভিনন্দন। এ-আখ্যান বিশেষ-এর গর্ভে নির্বিশেষ চেতনার ইঙ্গিত বহন করে। 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button