আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

নতুন আবাসভূমি : বাসা বদলের বৃত্তান্ত : সুরঞ্জন মিদ্দে

মঞ্জু সরকারের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

বাংলাদেশের ইতিহাস ও ভূগোল

বাংলাদেশের ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে―যে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের, নিম্ন প্রান্তিক মানুষের মর্মান্তিক বাসস্থান সমস্যাকে এক জীবন্ত আখ্যান করা হয়েছে। বাংলাদেশে গ্রামীণ মানুষের সমাজভাবনাকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে―যেখানে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ভূগোল সামনে এসেছে। সামনে এসেছে বাংলাদেশে প্রধান স্মরণীয় ঘটনা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ (১৯৭১)।

: একাত্তরে আপনি রাজাকার ?

: আমি একজন ফ্রিডম ফাইটার।

: তাই নাকি ?

: অপারেশন করে অনেক রাজাকার খতম করেছি।

শুধু আরমান ও কালামের সংলাপ নয়, জামাল-পত্নী পদ্ম-পদ্যের ক্ষোভ-অভিমান ঝরে পড়ে!

: ‘একাত্তরে আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিল। সে আজ বাঁইচা থাকলে রাজাকার আরমানের এত বাড়াবাড়ি সইহ্য করত না।’

আবাসভূমি আখ্যানে নিজের অঞ্চলের বাইরের লোক ‘বিদেশি’ নামে চিহ্নিত। একই দেশের নোয়াখালীর মানুষ নিশ্চিন্তাপুরে বিদেশি। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ যারা সবাই এক দেশ এক বাঙালি তারা ১৯৯৪ এসে ‘বিদেশি’ তকমায় চিহ্নিত। দেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিবের ভক্ত রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান―আজ সেও বাঘ মুজিবর নামে খ্যাত হয়েও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা। ঢাকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের অর্থনীতি। সেই অর্থনৈতিক মানচিত্রে যেমন কোটিপতি সোলেমান সাব আছে, তেমনি সালুর মতো দরিদ্র কামলা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভূগোলে―ঔপন্যাসিক বাঘ মুজিবর ও কালামের দুই বিপরীতমুখী পরিণতি দেখিয়েছেন। বাঘ মুজিবরের এত দাপট থাকা সত্ত্বেও তাঁর ছেলেরা দেখে না, বিপরীতে কালামের দুই কন্যা উচ্চশিক্ষা নিয়ে চাকরির স্বপ্ন দেখে। বাংলাদেশে ইতিহাস-ভূগোলের মধ্যে অর্থনৈতিক জীবন-বিজ্ঞান―অনন্য রসশিল্পে উন্নীত।

পরিবর্তিত সমাজচিত্রমালা

সাহিত্যিক মঞ্জু সরকারের (১৯৫৩) আবাসভূমি (১৯৯৪-২০১০) উপন্যাসের অধ্যায়ের সাব-হেডিংগুলি আখ্যানকে যেমন এগিয়ে নিয়ে যায়―তেমনি এমন অনেক বাক্য আছে, যা প্রবাদের মতো গভীর ব্যঞ্জনা দিয়েছে। যা আবাসভূমির আখ্যানকে আধুনিক সাহিত্যভাবনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সেই অনন্য সমাজচিত্রকে সাজিয়ে  দেওয়া যেতে পারে যা হয়ে উঠেছে আধুনিক প্রবাদমালা :

ভালো রাস্তা নেই, বিদ্যুৎ নেই; গ্যাস নেই, আবার গ্রামসুলভ সমাজবদ্ধতাও যেন নেই।

টিনের চালে বৃষ্টি, নিজের ঘরে বসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে গরম খিচুড়ির স্বাদ অপূর্ব লাগে।

চুম্বনে জিভের ব্যবহার করতে গিয়ে চকিতে সাপের জিভটা দেখে শিউরে ওঠে।

জাল তো নয়, কেবলই কই-শিং-মাগুর মাছ দিয়ে গাঁথা লম্বা এক শাড়ি যেন।

ধানের কাজে বিদেশি কামলারা―বিদেশি পাখির ঝাঁকের মতো ফি মওসুমে তারা দলে দলে আসে।

ভাণ্ডে শব্দ করে জমা হচ্ছে দুধের চিকন ধারা।

বিদেইশ্যাগো দুধ খাওয়াইবা! হালাগো বিষ খিলাইয়া মারা উচিত।

বুড়ি মাগি না, এক্কেরে বোম্বের হিরুইনের রান।

পরের বদনাম গেয়ে আপন দুর্বলতা আড়ালের চেষ্টা কিংবা পরচর্চায় আনন্দ বাঙালির স্বভাব।

দুর্নীতি যেখানে বড় নীতি, সে দেশে তো দালালদের জয়জয়কার হবে।

মেঠোপথে হাঁটা যেমন ব্যায়ামের কাজ দেয়, তেমনি নির্জন মাঠে কবি স্বভাবের রসদ জোগায়।

ভেজা শাড়িতেও মধ্যবয়সী নারী-শরীর আকর্ষণ জাগায় না, বরং মাথায় ডগমগ কলমিলতা চোখ কাড়ে।

খেটে-খাওয়া মেয়েমানুষ, যাদের বলা হয় কাজের মেয়ে, ‘মাতারি’ কিংবা ‘বুয়া’।

বিশ^াস উৎপাদন করা প্রতারকের কাজ, কারণ সমাজ চলছে অবিশ^াসের ভেতরে।

ভয়ের কারণে ভালো না-লাগা প্রতিবেশীর প্রতি সহমর্মিতা জাগে।

গ্রামে বাড়ি কইরা শান্তিতে থাকব, কিন্তু গ্রামে দেখি শহরের চাইতেও বেশি সন্ত্রাস।

ঘুষ ছাড়া কাম হইব না। কারেন্টের অফিসের লোক কারেন্টের মতো ঘুষ খায়।

প্রান্তরে গড়ে ওঠা দলের ঐক্য ভেঙে, নগরগামী বাসের ভিড়ে ঠেলাঠেলির প্রতিযোগিতা।

এ সমাজে যার যতো খুঁটির জোর, তার ততো প্রতিষ্ঠা।

এ যুগে পাবলিকের ভালো করতে গেলেও নিজের অনেক ক্ষতি।

ঘুষ দেওয়া আর খাওয়াটা এই দ্যাশে আর অন্যায় নয়, এইডা সরকারি নিয়ম, মানতে হয়।

স্ত্রীর সৌন্দর্যের চেয়েও যেন টাকা-পয়সায় গড়া বাস্তবকে বেশি ভালোবাসে।

স্ত্রীর মেজাজ বিগড়ালে তাকে আদিম, বড় হিংস্র দেখায়।

‘আল্লা যা দিয়েছে, তাতে হাজার শোকর’।

দালাল, মিডলম্যান মানে এজেন্ট তো সব দেশে সব ব্যবসাতে আছে।

জায়গা-জমিনের ভেজাল বোঝা মেয়েমানুষের কাম না।

পরিস্থিতি যখন ভয়ংকর, মৃত্যু যে-কোনও সময় আসতে পারে।

আগে ভয় ছিল শুধু রাতে, এখন সন্তানদের ভয়ে দিনেও দরজা বন্ধ করতে হবে।

টিনের চালের বৃষ্টির নূপুর এখন রিমঝিম বাদ্য করছে।

টেবিলের লণ্ঠনটির আলো ঘরের নিথর পানির ওপর অদ্ভুত সৌন্দর্য ছড়িয়েছে।

যত বৃষ্টিই হোক, বৃষ্টির পানিতে কেউ ডুবে মরবে না।

বাড়িঘরের মায়া আর করো না, এখন জান বাঁচানো ফরজ।

রাজনীতি মানুষের জন্য, এখন রাজনীতি কালো টাকার মালিক হওয়ার জন্য।

কামিনী ফুলের ঘ্রাণ―তার গালের তিলটির ওপরেও এক ফোঁটা জ্যোৎস্না, হীরের টুকরা যেন।

দুনিয়াটায় এত বাড়িঘর, রাস্তা ছাড়া কোনও বাড়ি আছে ?

জমির মালিক যেই হউক রাস্তা কাটা কিন্তু বেআইনি কাম…

জান দেব তবু জমি দেব না।

উত্তরবঙ্গে কাতিমাসী মঙ্গাকে পরাস্ত করে দিনের পর দিন অর্ধাহারে অনাহারে কত মানুষ বেঁচে আছে।

যেন আমার চেয়ে আমার চাকরিটাই তোমার আসল স্বামী।

সমাজে সৎ লোকের ভাত নেই।

দেশ নিয়ে ভাবা আর দেশোদ্ধার করা তো এক কাজ নয়।

মুরগি ডিম পেড়েছে―শিলাবৃষ্টির সময় শিল কুড়ানোর আনন্দও তুচ্ছ হয়ে যায়।

সবাইকে অবিশ^াস করে ব্যবসা-বাণিজ্য করা যাবে না।

মানুষের ডাক্তারের মতো পশুপাখির ডাক্তার এত সহজলভ্য নয়।

আগে মানুষ মরত জন্তু-জানোয়ারের কামড়ে, অহন মানুষ মরে মানুষের হাতে।

যত বাড়ি তত মাতবর।

ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টরাই বেশি ডেঞ্জারেস।

লাইক ফাদার লাইক ডটার হবে এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে।

গোপন শত্রুতাবোধ আড়াল করে হিংস্র বাঘকে কিছুটা শান্ত রাখা।  

আবহাওয়া পরিবর্তনে সমুদ্রের পানি বাড়বে, বাঙলাদেশে তিন ভাগের এক ভাগ জায়গা ডুবে যাবে।

আমরা দুবোন চাকরি করে তোমাদের ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে দেব।

মর্মান্তিক আবাসভূমির জন্য বার বার মানুষকে বাসা বদল করতে হয়। স্থানান্তরিত মানুষের জীবন সংগ্রামকে নিয়ে ঔপন্যাসিকের তীক্ষè জীবনদৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়েছে মানবসভ্যতার নয়া সংকট  কেন্দ্রিক বাক্যব্যঞ্জনা। যেখানে গভীর শিল্পবোধের পরিচয় দিয়েছেন কথাশিল্পী মঞ্জু সরকার।

দ্বিখণ্ডিত বঙ্গের মুসলিম সংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র ভারতভূমির কাছে―বাংলা ভাষার বাঙালি মুসলমানদের জীবন ও সংস্কৃতি যেন বাড়তি উপহার-অনুষঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির কাছে কিছুটা চেনা হলেও সবটা নয়। আবাসভূমি সেই বৃহত্তর পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের অচেনা-অদেখা বাঙালি মুসলিম জীবনের ছবিকে নিখুঁতভাবে সামনে এনেছেন লেখক। একজন চিত্রশিল্পীর তুলির টানে যেন জীবন্ত ছবি এঁকেছেন। আবাসভূমি থেকে উদাহরণ দিয়ে দেখা যেতে পারে। ঔপন্যাসিক নিরপেক্ষ ও নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখেছেন বাংলাদেশের দরিদ্র নিরক্ষর মুসলমান, কোটিপতি ধনী মুসলমান নারী-পুরুষ-যুবা-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নির্বিশেষে এক জীবন্ত দলিল। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে পড়তে পাঠক তার সন্ধান পাবেন :

আল্লাহ আকবর, নিশ্চিন্তাপুর যুব ক্লাব, কুতুবপুর ইউনিয়ন।

কেরামতি মওলার কাচে তাজিব।

ঘরে জায়নামাজে বসে গুনগুনিয়ে কোরান শরিফ পড়া।

স্ত্রী নার্গিসের নামাজ-রোজায় কালাম বাধা দেয় না।

সালু মসজিদের ইমাম হুজুরের কাছ থেকে একটি তাবিজ এনে বাড়ির কোণে পোঁতে।

ফজরের আজান হাঁকার আগে মুয়াজ্জিন মাইকে ফুঁ দেয়।

সামনাসামনি বেবাকই হুজুর হুজুর করে। আবডালে কত বদনাম, মানুষ এমুন খবিজ হইয়া   গেছে।

মানুষের ঈমান-আমান চরিত্র ভালা না।

মাদ্রাসা আর নতুন মসজিদের কাজ শুরু হোক।

আজ রাইতে আল্লার কেয়ামত নাজেল করব।

আল্লার দেয়া পানি লইয়া  যারা এমন করে, আল্লায় তাদের পানিতে ডোবাইব না ?

শুক্রবারের জামাতে নামজ পড়তে সময় পায় না কালাম।

বেধার্মিকদের হেদায়েত করতেই মসজিদ-সমাজ বাড়ি বয়ে এসে প্রায়ই উত্যক্ত করে।

মাইক বাজিয়ে হুজুরদের ওয়াজ-নছিয়তের কান ফাটানো সুর।

নামাজ-রোজা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তেমন বিরোধ সৃষ্টি করেনি কখনও।

হজরত মোহাম্মদ (স.) এর জীবনীর গল্প।

মসজিদের মাইকগুলো―কেউ মরে গেলে শোকসংবাদ দেয় এবং জানাজায় শরীক হওয়ার জন্য আমন্ত্রণও জানায়।

মসজিদের টুপি মাথায় রেখেই দুই বেলায় ঘোরে গ্রামে।

শুক্রবার জুম্মাতেও যায় না। তার পরেও মানষে কয় কালাম সাব খুব ভালা।

আবাসভূমি উপন্যাস বাংলাদেশের মুসলিম জীবন ও সংস্কৃতি এমন অনুপম চিত্র, এমন নির্মোহ পটচিত্র―আমি পাঠক হিসেবে মুগ্ধ। তবে কয়েকটি শব্দের ফুটনোট থাকলে ভালো হতো―অন্তত পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের জন্য। যেমন―‘জানাজা’ ’ওয়াজ-নছিয়ত’, ‘তাবলিগ জামাত’, ‘কেয়ামত’, জায়নামাজ’ শব্দগুলি।

উপন্যাসের চরিত্রগুলির মধ্যে মুসলিম অনুষঙ্গ আছে। সেই সঙ্গে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। দেশভাগ কাঁটাতার দিয়ে থামানো যায় না ও যাবেও না। বই সেই সীমানা ভেঙে দিতে পেরেছে। আবাসভূমির সংকট ও জীবনদর্শন শুধু মুসলিম শব্দ বা সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ‘আবাসভূমি’র আখ্যান-দর্শন আরও ব্যাপক, শুধু বাংলাদেশের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়। বাসস্থান বদলের আখ্যান বাংলাদেশে মুসলিম জনজীবনকে ঘিরে চিত্রিত হলেও তা সামগ্রিক দেশ-বিদেশের পাঠককে মুগ্ধ করবে। কেননা কালাম-নার্গিসদের বাসসংকট ও সংগ্রাম যেন যে কোনও উন্নয়নশীল দেশের এক প্রধান সমস্যা। নতুন আবাসভূমির সংকটের আলোকবর্তিকা―বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশের বাইরের পাঠকের কাছে সাড়া ফেলেছে। বাংলাদেশের নিশ্চিন্তাপুরের মুসলিম গ্রামের মানুষ এখানে প্রতিনিধি মাত্র।

চরিত্র মনস্তত্ত্ব: নারী ও পুরুষ

আবাসভূমি উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলিকে হয়তো আঙুলে গুনে বলা যাবে; কিন্তু পুরুষ চরিত্র অসংখ্য। পুরুষ চরিত্রগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করলে বোঝার সুবিধা হয়। প্রথমত অন্যতম প্রধান চরিত্র, যাদের মাধ্যমে মূল আখ্যান আবর্তিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত যাদের আমরা অপ্রধান চরিত্র বলি। আর শেষতম চরিত্র হচ্ছে―অতি ক্ষুদ্র সময়ে চরিত্রগুলি এসেছে, আবার হারিয়ে গেছে। দ্বিতীয় শ্রেণির চরিত্রগুলির মধ্যে মনস্তত্ত্বের এমন নিখুঁত বর্ণনা―পাঠক আশ্চর্য হবেন। মনে হচ্ছে সেই অধ্যায়ে তিনিই তখন প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছেন। যার  ফলে সেই অধ্যায়ের কাহিনি পাঠকের কাছে  চমকপ্রদ হয়ে উঠেছে।

আবাসভূমি দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। দুই খণ্ডের মধ্যে চরিত্রের ব্যবধান নেই। নিম্নবিত্ত মানুষের মনস্তত্ত্ব এমন সাবলীলভাবে চিত্রিত হয়েছে―মনে হচ্ছে চোখের সামনে ভাসছে―জীবন্ত―চলমান। যেমন ঢ্যাঙা মাতবর খালেক কিংবা সালু, আরমান, বাঘ মুজিবর, জামাল। প্রত্যেকটি চরিত্রই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট। তাকে আলাদা করে মনে পড়বে। ঔপন্যাসিকের এমন গভীর ও আন্তরিক পর্যবেক্ষণ যে, প্রধান চরিত্র না হয়েও ভোলার নয়। শুধু ভালো চরিত্র নয়, মন্দ চরিত্রগুলিও জীবন্ত। মনে হচ্ছে মন্দ চরিত্রগুলি বেশি জীবন্ত।

নারী চরিত্রগুলির মধ্যে নার্গিস, পদ্ম-পদ্য, হুমার মা, চম্পা-টুম্পা―সংখ্যায় কম হলেও, আবাসভূমি আখ্যানের কৌতূহল পাঠককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে। নারীর ক্ষোভ-অভিমান-হিংস্রতা-নীচতার সঙ্গে পরচর্চা-পরনিন্দা এক ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। নারী সংসার ও সমাজের অর্ধেক, তা পূর্ণ হয়েছে―আবাসভূমির আখ্যানে। আবুল কালাম চরিত্রটি আলাদাভাবে আলোচনায় আসবে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত―কালামের আত্মবিশ^াস এক দীপ্ত দীপ্র চরিত্রে পরিণত করেছে। কালাম হেরে যেতে চায়নি―মানুষ তো অমৃতের সন্তান―পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শত সংঘাতে নির্বিবাদী নায়ক বাংলা কথাশিল্পের নতুন আস্বাদ দিয়েছে―সাম্যবাদী মুক্তিযোদ্ধা কালামকে স্যালুট। তার স্রষ্টাকেও।

আঞ্চলিক ভাষা: আন্তর্জাতিক আখ্যান

‘বাঘ মুজিবরের চোখে অশ্রু!―‘আপনার পোলা-মাইয়া ভালোমতো পাস দিব, চাকরি করব, কিন্তু আমার পোলাপান মানুষ হইব না, ফেন্সিডিল খাইব, সরকারি দলে ঢুইকা লুটপাটের ধান্ধায় থাকব।’

ঢাকার উপকণ্ঠে নিশ্চিন্তাপুরের প্লাবনে সবাই প্রায় ঘরছাড়া―মুক্তির পথ অনুসন্ধানে শত শত মানুষ দিশেহারা, প্রত্যেকের হাতে সংসারের জিনিসপত্র। ফাঁকা জমিগুলো সীমাহীন পুকুরে পরিণত হয়েছে। স্বপ্নের আবাসভূমি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে―ভাবী প্রজন্মের আগামী দিনের নতুন অর্থনীতিতে।

হতে পারে ভাষা আঞ্চলিক, হতে পারে মুসলিম পরিবারের জীবনসংগ্রাম, হতে পারে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার কিন্তু আখ্যানের জীবনদর্শন―বাংলাদেশের সংকট পেরিয়ে বিশ^জনীন হয়ে উঠেছে। গ্রাম থেকে শহরে আসা, শহর থেকে শহরের উপকন্ঠে গ্রামে আসা―আবার শহরের ঘিঞ্জি বস্তিতে ফিরে যাওয়া―হয়তো পরে ফ্ল্যাট কিনবে। মানুষের নিরন্তর স্থানান্তরের অভিযান―আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে হলেও আঞ্চলিক সীমানাকে অতিক্রম করে গেছে।

আমার মতো একজন পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবাসীর চোখেও জল এসেছিল! এক আশ্চর্য আখ্যান যা দেশকাল পেরিয়ে চিরসত্য হয়ে গেছে আবুল কালামের সপ্তমবারেও তার বাসাবদল স্থায়ী হয়নি। নিম্নবিত্ত মানুষের অভিযান কি কখনও শেষ হয় ? একুশ শতকে এসেও গ্রামীণ সমাজে কি আগের শান্তি আছে ? ঈর্ষা আর দুর্নীতি সর্বত্র গ্রাস করেছে। দেশের মানুষ নিজের স্বদেশে কি ‘বিদেশি’ হতে পারে ? আবার স্বদেশের অর্থনীতি জোগাতে মধ্যপ্রাচ্যের মতো বিদেশে গিয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। ঢাকার বিমান বন্দরে প্রতিদিন সহস্র বেকার যুবক মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিচ্ছে―জীবন-জীবিকায় সচ্ছলতায় স্থায়ী হতে। স্বদেশে বিদেশি বা বিদেশে স্বদেশিদের অভিযাত্রা―এক নতুন অভিমুখ। কথাকার মঞ্জু সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দরদি ও নির্মোহ মন দিয়ে, গভীর শিল্পবোধের স্বাক্ষর রেখেছেন, যা বাংলা উপন্যাসে নবদিশা।

নতুন বাংলাদেশ: নতুন আখ্যান

একজন মুক্তিযোদ্ধার চোখে দেখানো হয়েছে নতুন বাংলাদেশের অর্থনীতি-দুর্নীতি আর রাজনীতি। চারদিকে যখন দালাল আর দুর্নীতি-ঘুষ, চারদিকে অন্ধকারের মাঝে আলোর শিখা―নির্বিবাদী নায়ক আবুল কালামকে, কথাশিল্পী মঞ্জু সরকার আন্তরিক সৃজনে মনপ্রাণ যেন ঢেলে দিয়েছেন।

আবাসভূমির আখ্যানে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে―সংস্কার আর বাস্তবতার যুগল দর্শনকে। যা শুধু আধুনিক নয়―এক স্বতন্ত্র সৃষ্টিসুধা। নতুন ঘরে প্রথম দিনে সর্প দর্শনের মধ্যে অমঙ্গল আছে! শেষ পর্যন্ত সেই বাসা ছাড়তে হচ্ছে নিম্নভূমিতে প্রাকৃতিক ‘প্লাবনে।’ কথাকার প্রশ্ন তুলেছেন―প্রকৃতির পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভয়ানক পরিণতি হবে। বঙ্গোপসাগরের জল বৃদ্ধি হবেই―বাংলাদেশের একটা বড় অংশ জলের তলায় চলে যাবে। বিশে^র উষ্ণায়নে শুধু কি বাংলাদেশ―না সমগ্র বিশে^র একই দশা হবে!

আবাসভূমি এমন একটি উপন্যাস―যেখানে গ্রামীণ নিম্নবিত্ত মানুষের গালাগালিÑঅশ্লীল শব্দ আছে। কিন্তু কোথাও অবৈধ যৌনতা নেই। প্রেমের আবেদন আছে, সেই প্রেম শরীরকে ঘিরে নয়। একুশ শতকের আখ্যানে অবৈধ যৌনতাহীনতা এক নতুন দিশা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দালালরাজদের চরম সংঘাতে শেষ পর্যন্ত, হয়তো যোদ্ধা পরাজিত হয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে চিরযোদ্ধাতে উন্নীত হয়েছে।

কন্যাসন্তানদের পিতৃ-সম্পত্তি পাবার অধিকার প্রসঙ্গ এসেছে কিন্তু তা পরিবারে কতটা গৃহীত হয়েছে―সেই জিজ্ঞাসা উত্থিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় সামনে এসেছে―কন্যাসন্তানদের উচ্চ-শিক্ষা, চাকরিজীবনের ইঙ্গিত; যা বাংলাদেশের পক্ষে এক নব যুগান্তর। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের নতুন ভুবনে আবাসভূমির স্থান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আবাসভূমির প্রধান চরিত্র পুরুষ কিন্তু সেই পুরুষের আগামী প্রজন্ম দুই কন্যা―দুই উচ্চশিক্ষিতা নারী। নার্গিসের মতো নয়, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারী―মুক্তমনা নারীর আবাসভূমি।

লেখক : পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button