আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

মঞ্জু সরকারের দেশ-কাল ও মানুষজন : ওয়াসি আহমেদ

মঞ্জু সরকারের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

গত শতকের সত্তর-আশি দশকের অন্যতম প্রধান কথাকার মঞ্জু সরকার। কথাটা যেমন অবিসংবাদী, তেমনি এও স্বীকার্য যে, তাঁর সৃজনশীলতার স্বাতন্ত্র্যময় বিকিরণ উল্লিখিতকাল উতরে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে সমুজ্জ্বল। দীর্ঘদিন তাঁর লেখালেখির সঙ্গে থেকে, তাঁর ভাবনা-চিন্তা ও জীবনদর্শনের আঁচ পেতে পেতে আমার কুন্ঠাহীন উপলব্ধি―তিনি সেই বিরলগোত্রীয়দের একজন যিনি জাগতিক নানা টানাপোড়েনের অভিঘাতেও অপার ধৈর্য, কঠোর অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাসের শক্তিতে লেখালেখিতে অবিচল থেকেছেন।

বিষয়-আঙ্গিকে যতটা না, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি উপলব্ধিতে, পর্যবেক্ষণে ও ভাষ্যে মঞ্জু সরকার তাঁর সমকালের অগ্রগণ্য লেখক। বিষয় বা ঘটনার গূঢ় অন্তঃস্তলে পাঠককে আহ্বান জানিয়েই তিনি থেমে থাকেন না, আলো-আঁধারিময় অনির্দেশ্য গলিঘুঁচিতে নিয়ে উন্মোচন করেন জীবনের বহুমাত্রিক প্রতিবেদন। শুরুতে কিছু গল্প ও দুটি উপন্যাস (অবিনাশী আয়োজন ও তমস) তাঁকে সম্ভাবনাময় লেখক হিসেবে চিনিয়ে দিয়েছিল বটে, তবে গল্প সংকলন মৃত্যুবাণ বেরোনোর পর সে সম্ভাবনা পোক্তই হলো না, অল্প বয়সেই তাঁর অধিষ্ঠান ঘটল দেশের একজন প্রধান কথাসাহিত্যিকের উঁচু আসনে। মনে রাখা দরকার, সে-সময়, অর্থাৎ আশির দশকের মাঝামাঝি আমাদের কথাসাহিত্যের দুই মহিরুহ হাসান আজিজুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লেখালেখিতে প্রবল সক্রিয়। পরবর্তী কয়েক বছরে মঞ্জু নিজের অবস্থানকে আরও সংহত করেছেন প্রতিমা উপাখ্যান ও আবাসভূমি উপন্যাস দুটির মাধ্যমে। আবাসভূমি নিঃসন্দেহে তাঁকে খ্যাতি দিয়েছে, ফিলিপস পুরস্কারই যে এর কারণ তা বলব না; নিম্নমধ্যবিত্ত দম্পতি শহরের অচিন উপকণ্ঠে ঠাঁই গেড়ে নাগরিক শহরবাসী হওয়ার স্বপ্নকে কায়ক্লেশে বাস্তবায়িত করে বটে, কিন্তু এ কেমন ঠাঁই যেখানে নিজেদের আত্তিকরণ করতে গিয়ে তাদের মুখোমুখি হতে হয় নানা বিড়ম্বনার! প্রতিমা উপাখ্যান সম্পূর্ণ ভিন্ন আবহের উপন্যাস, সেই সঙ্গে এ কথা বলা প্রয়োজন―রচনাটি যোগ্য পাঠকের কাছে পৌঁছুতে না পারা আমাদের সাহিত্যের দৈন্যকেই ধরিয়ে দেয়।

অনেকেরই সঙ্কল্প থাকে―হয়তো কঠোর সঙ্কল্প―লেখক হওয়ার। কেউ কেউ নিশ্চয়ই সফল হন। তবে মঞ্জু সরকারের মতো কজনকে পাওয়া যাবে! শুধু লেখালেখিতে নিবিষ্ট থাকতে তিনি শ্রেণিকক্ষের জ্ঞান আহরণকে ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি, এমনকী পারিবারিক বন্ধনকেও এক রকম ছিন্ন করে ট্রেনে চেপেছেন―ঢাকায় যাবেন, লিখবেন, বড় লেখকদের সান্নিধ্যে নিজেকে প্রস্তুত করবেন, আর নিজেও তা-ই হবেন। এমন ভবিতব্য নিজের জন্য অতি অল্প বয়সে নির্দিষ্ট করা দুরূহ কাজই নয়, সেই ভবিতব্যে আত্মাকে সঁপে দিয়ে হাজারো প্রতিকূলতায় জীবনভর অটল থাকা ও সফল হওয়ার নজির আমার জানা মতে এ দেশে সম্ভবত একমাত্র মঞ্জু সরকারের।

মঞ্জু সরকারকে নিয়ে লিখতে বসে মনে হচ্ছে, পরিপাটি একটা লেখার চেয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটা রচনা নিয়ে লেখা আমার পক্ষে সুবিধাজনক।

আগেই বলেছি মৃত্যুবাণ গল্প সংকলন দিয়ে তিনি নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছেন। এ গ্রন্থের নয়টি গল্পে যা পাওয়া যায় তা এসেন্সিয়াল মঞ্জু সরকারকে যথার্থভাবে চিনিয়ে দেয়। গ্রামীণ নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন মানুষের কথা অনেকেই লেখার বিষয় করেছেন, তবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যলাঞ্ছিত জীবনকে মঞ্জু যে অকৃত্রিম নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলেছেন তা অবশ্যই ব্যতিক্রমী। কখনও কখনও এমন মনে হওয়া বিচিত্র নয়, এই চিরপুরাতন বিষয়টি তাঁর কলমে ভিন্ন মাত্রাই পায়নি, বরং বলা চলে, ক্ষুধার চিত্রপটকে এমন তীব্র ও শাণিত উপস্থাপনায় তুলে ধরায় তাঁর কোনও পূর্বসূরি নেই। আর তৃতীয় বিশ্বে আমাদের মতো ভূখণ্ডে ক্ষুধা যে পরিত্রাণহীন জৈবিক যন্ত্রণার অতিরিক্ত এক অপরিণামদর্শী বাস্তবতা, যার সঙ্গে মিশে আছে গোটা সমাজব্যবস্থার হাড়কাঠামো, তার তল খোঁজা ও বিশ্লেষণ-প্রয়াস মঞ্জুর লেখালেখির বিশিষ্টতাকে চিনিয়ে দেয়।

   মৃত্যুবাণ গল্প সংকলনের প্রথম গল্প ‘ভূতের সাথে যুদ্ধ’ এমনই এক রচনা যা ক্ষুধা-দারিদ্র্যের জগৎকে এক ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে মঞ্জু দেখিয়েছেন ক্ষুধা কেবল ক্ষুধা নয়―এক আদিম ভূত। আর এর সঙ্গে যুদ্ধই যখন নিয়তি, সেই ভূতকে চ্যালেঞ্জ করা ছাড়া কী করার থাকে! সেই সঙ্গে মঞ্জু পাঠককে মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না ক্ষুধা নিজেই এক আদিম পাপ, যা মফিজের মতো ভাগ্যপীড়িত মানুষকে অমানুষ বানিয়ে তুলতে কসুর করে না। মরণাপন্ন বৌয়ের কাতরধ্বনি তার কানে যেতে সে অবচেতনে নিশ্চিন্ত হলেও পরপরই বৌয়ের বেঁচে থাকায় বিরক্ত হয়। বৌয়ের চিকিৎসা-খরচ পঁয়ত্রিশ টাকা জোগানো অসম্ভব জেনে সে ধরে নেয় এ অসুখ সারানো ওষুধের কাজ না―বৌকে তার ভূতে ধরেছে। বৌয়ের রোগটা রোগ বটে, তবে ভূতে-ধরা রোগ। এই ভূতকেই সে পায় মাঝরাতে নিধুয়া চড়কবিলে। বাহ্যজ্ঞানহীন মফিজ তার চিরপ্রতিপক্ষ কাল্পনিক ভূতের সঙ্গে যুদ্ধ চালায়―হার না মানা, মরণপণ যুদ্ধ। এ গল্পে অনাহার এক দিকে মফিজ ও তার পরিবারকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাখে, অন্য দিকে খিদাপেটে মফিজের মেয়ের মুখে কল্পিত আহারের ফ্যান্টাসি কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও খিদার দাপটকে যেন হটিয়ে দেয়। কিশোরী বোন কান্নারত ছোট ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে :

কান্দিস না বাইও, কাইল হামরা টাউনত বুবুর কাছে যামো।

ভাত না খাইলে হাটবো কেমন করি ?

এলগাগাড়িত চড়ি যামো―উহ্হ্ ঝিক ঝিক করি যামো।

খামো কী ?

বুবু হামাক পেট ভরায় ভাত খিলাবে।

বুবু ভাত পাইবে কোনঠে ?

বুবু যার বাড়িত কাম করে, তারার ভাতের শ্যাষ নাই, পইসার নেখা-জোকা নাই, ভাত বোঝাই একখান টাউন আছে―কত খাবু ?

হামাকে তারা খাওয়াইবে ক্যান ?

আমরা যে তামার সাগাই (আত্মীয়) হই। …হামরা গেলে বসিবার পিড়া দেবে, কাঁইচার প্লেটে জলপান দেবে, দই দেবে, তার সঙ্গে গুড়ও দেবে। তার পাছে গামলা বোঝাই ভাত দেবে, ভাতের সঙ্গে চড়াউর গোশত, তা বাদে ঠাকড়ি কলাইর ডাইল―কত খাবু!

খিদা পেটে উদরপূর্তির কল্পনা বাংলা ভাষায় বিরল নয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও আরও দু-একজনের লেখায় পাওয়া যায়। তবে বলতেই হবে, মঞ্জুর গল্পে এই যে বোন ভাইকে সান্ত্বনার ছলে গল্পটা ফাঁদে তাতে আত্মপ্রতারণা সত্ত্বেও রয়েছে এক কুহকী সুখ, যা হয়তো-বা সে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে না বা করতে পারেও না।

গ্রামীণ পটভূমি মঞ্জুর গল্পের প্রধান উপজীব্য হলেও এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই, গ্রামকে তিনি দেশীয় ভূগোলের খণ্ডাংশ হিসেবে যেমন দেখেন না, তেমনি গ্রামে বসবাসকারী মানুষজনও তার লেখায় প্রতিনিধি গোটা দেশ-সমাজের। তৃতীয় বিশে^র বাংলাদেশে অর্থনীতি যেমন কোনও নির্দিষ্ট স্থাননিরপেক্ষ নয়, রাজনীতিও তাই। ফলে সামাজিক আচার বা মুখের বুলি স্থানভেদে আলাদা হলেও রাজনীতি-অর্থনীতির মেলবন্ধনে ও চাপে সেই ভিন্নতার কোনও স্বতন্ত্র প্রকৃতি অবশিষ্ট থাকে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি মঞ্জুর লেখাকে একদিকে যেমন করেছে গভীর অনুসন্ধানী, তেমনি বহুস্বরিক। সেই দিক থেকে তাঁর গল্প গোটা দেশ-সমাজের অন্তর্ভেদী বয়ান।

এ বয়ান তৈরিতে সামাজিক বৈষম্য তথা শ্রেণিস্বার্থের অনিবার্য ভূমিকা নানা ভঙ্গিতে ও মাত্রায় তাঁর গল্পে হানা দেয়। কিন্তু মঞ্জু ইচ্ছাপূরণের কারবারি নন। তিনি তাঁর চরিত্রদের কাল্পনিক সাফল্যের মুখাপেক্ষী করেন না, বরং এর মধ্য দিয়ে যে বাস্তবকে তিনি নাঙ্গা করে তোলেন (যেমন ‘গ্রাস’ গল্পে) তা হয়ে ওঠে দেশ-সমাজের এক পরিত্রাণহীন অন্তর্দাহ। ইচ্ছপূরণের কাহিনি ফাঁদতে যেহেতু তাঁর চরম অনীহা, নিদান বা পথ বাতলে দেওয়া থেকেও তিনি দূরে থাকেন। সম্ভবত বয়ানকার হিসেবে এই নির্মোহ ও ক্ষেত্রবিশেষে দয়া-মায়াহীন পর্যবেক্ষণ তাঁর লেখার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

‘পালাবার কানাগলি’ গল্পের শুরুটা এ রকম : ‘রুগ্ন স্ত্রীর বেঢপ ফোলা পেট মনসুর আলী কেবলই ভয় পায়। জ্বলজ্যান্ত টাইমবোমা যেন … স্ত্রীর গর্ভ যত ফোলে, মনসুর আলীর উদ্বেগ তত বাড়ে।’ মনসুর আলী যে ভয় পায় তার অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো স্ত্রী যদি মরে যায়, সন্তানরা মা-হারা হবে জানা কথা, তবে অন্য যে ভয়টি তার মাথায় হানা দেয় তা অনাত্মীয় শহরে কবরের জায়গা পাওয়ার অনিশ্চয়তা। ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকে না। যদি সত্যি সত্যি ঘটনাটা ঘটে যায়, স্ত্রীর সৎকারের কাজ-কর্ম তার একার পক্ষে সামলানো কঠিন হবে, আর এ জন্য তাকে যাতে দায়িত্বহীন ভাবা না হয় তার আগাম প্রতিবিধানস্বরূপ সে তার শ^শুরকে এই সমূহ দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে চিঠিও লেখে। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুসম্ভাবনা তার মনে তেমন কোনও অভিঘাত তৈরি করে না, অভাবের সংসারে নিত্য অভাবের সঙ্গে লড়াই করেও সে অবাক হয়ে অনুভব করে সে এক অন্য অভাবে অক্রান্ত―যৌনতা, যা তার কাল্পনিক আসন্ন বিপত্নীক জীবনকে রাঙাতে পারে।

 রাঙাতে পারার এই স্বপ্ন―দুরাশা হলেও―মানুষকে মাতায়। অভাবের তাড়নায় গুপ্তধন পাওয়ায় তাড়নায় হোক (‘মৃত্যুবাণ’) বা শহরবাসী নিম্নমধ্যবিত্তের অস্থিরচিত্ত স্বপ্ন-কল্পনায় হোক (‘বাড়ি পাকা হবে’)। আবাসভূমি উপন্যাসে এর খানিকটা বিস্তৃত কলেবর পাওয়া যায়। গ্রামীণ নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের শহরে পাড়ি দেওয়ার সঙ্গে ওতপ্রোত যা জড়িয়ে থাকে তা অর্থ উপার্জনের সঙ্গে শহুরে হয়ে ওঠার বাসনা―সেই সঙ্গে অতীতকে যতটা সম্ভব দূরে হঠিয়ে দেয়া। এর জন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়ানো চলে, আর আকাক্সক্ষা কিছুটা ফলপ্রসূ যদিবা হয়, অধরা স্বপ্ন ও অনিশ্চয়তা তাদের জন্য বয়ে আনে এক অস্থিরতা, যার বিহিত দূর-কল্পনাতেই রয়ে যায়। এমন ঘটনা শহুরে হতে চাওয়া নিম্নমধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে যেমন, গ্রামের সম্পন্ন কৃষকের আরও সচ্ছল হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও প্র্রায় একই। এই যে টানাপোড়েন, যাকে সংগ্রাম বলাই সঙ্গত, তাকে বয়ানের বিস্তারে দেশ-সমাজ সংলগ্ন করতে মঞ্জু সরকার টেনে আনেন অপরাজনীতি, দুঃশাসন, গ্রামীণ শ্রেণিকাঠামোর বৈষম্য, এমনকী বিশ^ ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক খবরদারি সংস্থাকেও। এ প্রসঙ্গে ‘প্রিয় দেশবাসী’ ও ‘উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা’ গল্প দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অভাবতাড়িত গ্রামীণ জীবনের অ্যাখ্যান থেকে এ গল্প দুটি আলাদাই শুধু নয়, লেখক হিসেবে মঞ্জু সরকারের উপলব্ধি ও গভীর পর্যবেক্ষণের এক মাইলফলক বললে অত্যুক্তি হবে না। 

মঞ্জু সরকারের লেখালেখি নিয়ে বলতে গেলে প্রতিমা উপাখ্যান উপন্যাসটিকে কিছুতেই বাদ দেওয়া চলে না। উপন্যাসের শুরুর বাক্যটি দিয়ে গোটা আখ্যানকে তিনি যেন এক আঁটো বাঁধুনিতে আটকে ফেলতে চেয়েছেন―‘প্রতিমার সঙ্গে আহমদ বিএসসি-র অবৈধ গোপন সম্পর্কটি যেদিন ভোলারহাট স্কুলের সাদা দেয়ালকেও কলঙ্কিত করল, সেদিন থেকেই প্রেমের গল্পটার ভেতরে পলিটিক্স ঢুকতে শুরু করেছে।’ অত্যন্ত সাবধানে মঞ্জু এখানে পলিটিক্স শব্দটি ব্যবহার করেছেন। পলিটিক্স এখানে আক্ষরিক অর্থে রাজনীতি নয়, বরং হিংসা-বিদ্বেষ, নীচতা, পরশ্রীকাতরতা ও সর্বোপরি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার এক কুজ্ঝটিকাময় বিষবাষ্প। ‘প্রেমের গল্প’ কথাটা শুরুর বাক্যে থাকলেও এটি প্রেমের উপন্যাস নয় মোটেও। হ্যাঁ, প্রেমের গুজব-গুঞ্জনের রেশ ধরে মঞ্জু গল্পটা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু তা খোলস মাত্র―একে তিনি ব্যবহার করেছেন এক দুশ্চরিত্র সমাজের চালচিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে। যে রণজিৎ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে বাম রাজনীতিকে নিজের ধ্যান-জ্ঞান ভাবে, সে কিন্তু নিজের অজান্তেই একটা ‘ভুল’ জগতে বাস করে। তার মাথাজুড়ে একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ ও মানুষের মুক্তির অকাক্সক্ষা। ভুলটা তার বাবা তাকে ধরিয়ে দিতে চেয়েও ব্যর্থ হন। বাবা অবিনাশ তাকে হুঁশিয়ার করতে চান এই বলে যে সময় পাল্টেছে। তার ভাষায় : ‘এটা ৭১ সাল নয় রণজিৎ’। এই একটি বাক্য বা বাক্যাংশ বলতে গেলে এ আখ্যানের শেকড় ধরে টান দেয়। মঞ্জু এই বদলে যাওয়া সময়কে ধরতে গিয়ে আখ্যানে অনেক কিছুর অবতারণা করেছেন। রণজিৎ-এর হার মানে তো গোটা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থারই হার।

এই ক্ষুদ্র লেখায় মঞ্জু সরকারের লেখালেখির কিছু প্রবণতার ওপর আলতো আলোকপাত করতে গিয়ে মনে হয়েছে, আমার সমকালের এই শক্তিমান লেখকের যথাযথ মূল্যায়ন আমাদের সাহিত্যের অঙ্গনকে বহুলাংশে সমৃদ্ধ করবে।

 লেখক : কথাশিল্পী      

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button