আর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

‘উপন্যাসের কলাকৌশল’ : নোবেলজয়ী ওলগা তোকার্জুকের সঙ্গে আলাপচারিতায় মার্তা ফিগলেরোভিচ

বিশ্বসাহিত্য : বরেণ্য সাহিত্যিকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার

বাংলা অনুবাদ : এলহাম হোসেন

[ওলগা তোকার্জুক অপেক্ষাকৃত কম বয়সে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। চার বছর আগে যখন তাঁর বয়স সাতান্ন তখন তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করেন। জীবনের গণ্ডি পাড়ি দেওয়ার জন্য অতি বিস্তৃত আবেগে অনুরণিত কল্পনার বয়ান নির্মাণের জন্য তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর কষ্টসহিষ্ণু গবেষণালব্ধ উপন্যাসগুলো পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের বহুভাষিক ও বহু সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তৃত ইতিহাস, প্রথম শতাব্দীর ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ভাবধারা, ইহুদিদের মধ্যে প্রচলিত অতীন্দ্রিয়বাদ, প্রাচীন বাইবেলের বাণী, জ্যোতিষবিদ্যা, প্রাক-খ্রিস্টান পৌত্তলিকতা ইত্যাদি বিষয় ঐতিহ্যের মাটি খুঁড়ে বের করে আনে। পোলিশ সংস্কৃতির সঙ্গে ইহুদি সংস্কৃতির অঙ্গাঙ্গিকতা এবং লৈঙ্গিকতাকে তরল ও সামাজিক নির্মাণ হিসেবে উপস্থাপনার জন্য তিনি তাঁর রক্ষণশীল দেশ পোল্যান্ডে বিতর্কিত। ২০১৯ সালে পোল্যান্ডের সংস্কৃতি মন্ত্রীকে যখন তোকার্জুকের সাহিত্যকর্ম নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো, তখন তিনি উত্তরে বললেন, তাঁর কোনও উপন্যাসই তিনি পড়েননি।

তোকার্জুকের জন্ম পশ্চিম পোল্যান্ডের সুলেচোতে। যখন তাঁর বয়স নয়, তখন তাঁর পরিবার দক্ষিণাঞ্চলের সিলেসিয়ায় চলে যায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই জায়গা তার মালিকানা বারবার পরিবর্তন করেছে। এটি ইউরোপের স্বাস্থ্যনিবাসে পরিণত হয়েছে। টমাস মানের The Magic Mountain-এর দাভোশ এখানে অবস্থিত। তাঁর বাবা ছিলেন ইউক্রেন থেকে আসা উদ্বাস্তু। গত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে যে নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দাঙ্গা হয়, তা থেকে কোনও রকমে তিনি পালিয়ে যান। তাঁর মা পোল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কৃষক পরিবারের মেয়ে। পুরোপুরি লেখকবৃত্তি গ্রহণের পূর্বে তুকার্জুক সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। একটা ছোট্ট প্রকাশনা ও বইয়ের দোকানও চালিয়েছেন। ১৯৯৩ সালে প্রথম Podroz ludzi ksiegi (বইওয়ালাদের অভিযাত্রা) উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্য-জগতে তাঁর পদচারণা শুরু হয়। এটি প্রথম দিকের আধুনিক স্পেন ও ফ্রান্সের পটভূমিকায় রচিত রূপকধর্মী উপন্যাস। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস E. E. (১৯৯৫) কার্ল ইয়ুং এবং মনোসমীক্ষণের বিষয় নিয়ে রচিত। এরপর রচনা করেন Primeval and other Times (১৯৯৮)। এটির ইংরেজি অনুবাদ হয় ২০১০ সালে। এটি জাতীয় বেস্টসেলার হয়ে ওঠে। তাঁর House of Day, House of Night একটি বহুস্বরিক উপন্যাস। সিলেসিয়ার নিম্নাঞ্চলের কিংবদন্তি ইতিহাস নিয়ে এটি রচিত। বইটি ইউরোপজুড়ে সমালোচকদের ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে।

ইংরেজি ভাষাভাষী বিশ্ব বেশ দেরিতে তাঁর অনুবাদক ও প্রথম ইংরেজি ভাষার প্রকাশক গ্রান্টা বুকস, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি প্রেস, টুইস্টেট স্পুন প্রেস এবং তাঁর বর্তমান ব্রিটিশ প্রকাশক ফিট্জকারালডো এডিশন্স-এর মাধ্যমে তোকার্জুকের ব্যাপারে জানে। ২০১৭ সালে জেনিফার ক্রফ্টের অনুবাদে Flights (২০০৭) ২০১৮ সালে ম্যানবুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার লাভ করে। এন্টোনিয়া লয়েড-জোনস কর্তৃক অনূদিত Plow over the Bones of the Dead-এর পরের বছর একই পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়। তোকার্জুকের সবচেয়ে বড় কাজ হলো নয়শ’র বেশি পৃষ্ঠার মহাকাব্যিক উপন্যাস The Books of Jacob (২০১৪)। এটি অষ্টাদশ শতাব্দীর ইহুদি অতীন্দ্রিয়বাদী জেকব ফ্রাঙ্কের গল্প বিধৃত করেছে। তিনি নিজেকে মসিহ ঘোষণা করেন এবং বিস্ময়করভাবে দীর্ঘ ধর্মীয় প্রার্থনা-প্রথার প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রফ্টের করা ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে। তাঁর ছোটগল্পের অনেকগুলো এবং উপন্যাস Empuzjon ও The Magic Mountain-এর পুনর্লিখন এখনও অনূদিত হয়নি।

সিলেসিয়ার নিম্নাঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম ক্রাজানোতে পৌঁছাতে আঞ্চলিক রাজধানী থেকে ওয়ান-কার ট্রেনে চাপলাম। ওখানে তোকার্জুক তিন দশক ধরে বাস করছেন। রাজধানী রোক্লো, যেটি জার্মান ভাষায় ব্রেসলো নামেও পরিচিত, সেখান থেকে পরবর্তী গ্রাম নওয়া রুদায় গেলাম। সেখানে তোকার্জুক এবং তাঁর স্বামী গ্রেগর্জ তাঁদের পোষা কুকুর টিমিকে সঙ্গে নিয়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। তারপর ভাঙ্গাচোরা পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে একসঙ্গে গেলাম তাঁর বাড়িতে। গুহার মতো  দেখতে বাড়ির রান্নাঘরের জানালা দিয়ে গাছগুলো আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তোকার্জুক আর ওর বোন তাতিয়ানা এখানে থাকেন। প্রতি বসন্তে আশপাশের গাছগুলোর গুঁড়িতে সজীব নীল রংয়ের চোখ আঁকেন। লাইব্রেরিতে, যার বিপরীত দিকে একটা লোহার লাঙ্গল ঝোলানো আছে, সেখানে দেখলাম  তোকার্জুকের ছবি আঁকা রয়েছে। মাথাভর্তি চুলের পরিবর্তে সাপ নিয়ে মেডুসার মতো তিনি আয়নায় নিজের চেহারা দেখছেন। বাস্তব জীবনে তোকার্জুক মাথায় নীল রংয়ের পুঁতির মাথা পরেন। স্থানীয় কুসংস্কার অনুযায়ী এমন চুলের সাজ, যা কলটুন নামে পরিচিত (পোলিশ ভাষায় এ ধরনের চুলের বেণীকে Plica Polonica বলা হয় সেই মধ্যযুগ থেকেই), তা এর ধারণকারীকে রোগ-বালাই এবং অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখে।

আমাদের মধ্যে আলাপচারিতা চলল চারদিন ধরে। বেশ চা-কফি খেলাম। বিভিন্ন ভেষজ দিয়ে ঘরে তৈরি ব্রান্ডিও। আপেলের স্ট্যু খেলাম। তাইওয়ানের হরর মুভি দেখলাম। একদিন অপরাহ্নে একটি ছোট্ট গির্জা দেখতে গেলাম। সেটি অবশ্য রাস্তার পাশেই। উইলগিফোর্টিসের উদ্দেশ্যে তৈরি। তিনি ছিলেন শ্মশ্রুবিশিষ্ট মহিলা, লোকজ সন্তু। তাঁর কিংবদন্তিকে তোকার্জুক তাঁর House of Day, House of Night এ কল্পকাহিনির রূপ দিয়েছেন। গির্জার সদস্যরা উইলগিফোর্টিসের বিরক্তিকর শ্মশ্রুকে বালি দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। বিকেল পাঁচটার সময় ছায়া এসে পড়ে কাঠের তৈরি তাঁর অবয়বের চোয়ালের নিচের অংশে।]

মার্তা ফিগলেরোভিচ : এত দূরের একটি স্থানে থাকতে আপনার কি কখনও নিঃসঙ্গ লাগে না ?

ওলগা তোকাঅর্জুক : অনেক দূরে। শহরে কয়েক বছর থাকার পর ১৯৯৩ সালে আমরা যখন এখানে এলাম, তখন প্রথম দিকে তো ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। হিপ্পিদের কাছ থেকে বাড়িটা কিনেছিলাম। ওরা এই বিরানভূমিতে বসবাস করা ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িটা যখন কিনি তখন এটি ছিল পুরোপুরি ভাঙ্গাচোরা। রাস্তাঘাট ছিল ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা। নিয়মিত বরফ পড়ত। আশেপাশে তখন কোনও প্রতিবেশীও ছিল না। চারপাশে শুধু ধু-ধু বিরানভূমি। এমন পরিবেশ মানব বসতির প্রতি সত্যিই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। তবে আমার কাছে এর সবকিছুই ছিল আশীর্বাদ। এখানে বসেই আমি শেষ করলাম Primeval and Other Times. মনে হচ্ছিল আমি যেন দেয়ালগুলোর ভেতর থেকে গোপন এক কানাকানি শুনছি। এটি শুনতে শুনতে লিখে ফেলি House of Day, House of Night.

আমিসহ আরও অনেকেই মনে করত, আমরা একটা অজানা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের ওপর বসবাস করছি। সবসময়ই মনে হতো, আমি বাড়ির ভেতর জলের কুলকুল শব্দ শুনছি। ভূগর্ভস্থ ঘরটি সংস্কার করতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেনি। যখন আমরা খুঁড়ে খুঁড়ে এর ভিত্তিমূলে পৌঁছলাম তখন দেখলাম, ঠিক এর নিচ দিয়ে একটা ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। এভাবে জার্মানরা পর্বতের ঢালে বাসা তৈরি করত। এরা জলপ্রবাহের গতিপথ আটকাত না। বাড়ির মধ্য দিয়ে জলকে বয়ে যেতে দিত। যুদ্ধ চরমে পৌঁছার পর থেকে কিছু লোককে ভাগ্য তাড়া করে এখানে নিয়ে এসেছিল। এক পর্যায়ে আমি উইলিয়াম ব্লেকের তিনজন অনুবাদকের প্রতিবেশী ছিলাম। এ ঘটনা আমাকে Drive Your Plow over the Bones of the Dead লিখতে উৎসাহ দিয়েছে। এই জায়গাটি ওঁদের আকৃষ্ট করেছিল। জায়গাটি অবশ্য মেইস্টার একহার্ট এবং জেকব বোহমির অতীন্দ্রিয়বাদী ভক্তদেরকেও  আকৃষ্ট করেছিল।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি এই অঞ্চলটা ইতিমধ্যে চিনে ফেলেছেন ? আপনি কোথায় বেড়ে উঠেছেন ?

ওলগা তোকার্জুক : কাছেই একটা জায়গায়। সিলেসিয়ার নিম্নাঞ্চলের একটা আলাদা অংশে আমার শৈশব কেটেছে। আমার বাবা-মার সাক্ষাৎ হয়েছিল সুলেকোর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি মফস্সল শহরে। এটি অবশ্য জিওলোনা গোরার কাছে। ওখানেই পরে আমার জন্ম হয়। বাবা-মা একটা অসাধারণ প্রকল্পে অংশ নিতে ওখানে যান পঞ্চাশের দশকে। যুদ্ধ পূর্ববর্তীকালে। গিয়েছিলেন ওখানকার পিপল্স বিশ্ববিদ্যালয়ে বা ফোক হাইস্কুলে পড়াতে। ইংরজিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তখন এমনটাই বলা হতো। ষোলো থেকে বিশ বছর বয়সী তরুণদের গতানুগতিক বিষয় থেকে শুরু করে দক্ষতা তৈরির জন্য উপযোগী, যেমন―কৃষিকাজ, গাড়িচালনা― সব বিষয়ই পড়ানো হতো। আমার মা পড়াতেন সাহিত্য, নাট্যসাহিত্য এবং লোকসাহিত্য। বাবা লাইব্রেরিয়ানের চাকরি করতেন। একটা প্রসিদ্ধ লোকজ দলকে তিনি নেতৃত্ব দিতেন। ওটা ছিল অবশ্য একটা আবাসিক স্কুল। ওখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পাশাপাশি থাকতেন। শিক্ষকদের প্রফেসর বলা হতো না। বলা হতো আঙ্কেল বা আন্টি। আমার বয়স যখন নয় আর আমার বোন তাতিয়ানার বয়স যখন তিন বছর, তখন আমরা পোল্যান্ডের ছোট্ট শহর ওপোলে চলে যাই। এটি চেচনিয়ার সীমান্তের খুব কাছে। ওখানে মা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পোলিশ ভাষা পড়াতেন, আর বাবা স্কুলের লাইব্রেরি চালাতেন। পাশাপাশি গাইডেন্স কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করতেন।

মার্তা ফিগলেরোভিচ: জনতার বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়ে ওঠা বলতে আপনি কী বোঝাতে চান ?

ওলগা তোকার্জুক : ওখানে সবসময়ই কিছু না কিছু চলত। কেউ আমাদের ওখানে আসছে, থাকছে, আবার চলে যাচ্ছে রাতের ক্লাসে। স্কুলটার কাজকর্ম চলতো একটা পুরাতন হান্টিং হাউজে। এর মালিক ছিলেন অভিজাত রাজিউইল পরিবার। ওখানে একটা বড় ডাইনিং রুম ছিল। সঙ্গে রান্নাঘর। শিক্ষার্থীদের জন্য ডর্মেটরি আর শিক্ষকদের জন্য তিন-চারটা অ্যাপার্টমেন্ট। শিক্ষকরা জোড়ায় জোড়ায় আসতেন―স্বামী-স্ত্রী। তবে ওদের কারও বাচ্চাকাচ্চা ছিল না বললেই চলে। আমি প্রায়ই আমার বাবা-মার ক্লাসে ঢুকে পড়তাম। তাদের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নাচতাম, গান গাইতাম। ভাবতাম, সব স্কুল বোধ হয় ওরকমই। পরে বুঝতে পারলাম―এটা কেমন স্পেশাল ছিল। জন্মের পর এমন পরিবেশে বেড়ে উঠতে পেরে আমি কতই না সৌভাগ্যবান ছিলাম।

আমাদের সঙ্গে ওখানে আরেকটা ছোট্ট মেয়ে নিজেকে বিকশিত করেছিল। ও হলো আমাদের ইতিহাস শিক্ষকের মেয়ে। ও আর আমি একসঙ্গে খেলতাম। পুরো বাড়ি আমরা চষে বেড়াতাম। প্রায়ই অবাক হতাম এই ভেবে যে, এই প্রাসাদে আগে কারা থাকত এবং যুদ্ধের সময় এই বাড়িটা ধ্বংস বা লুট হয়নি কেন। এখানে বিশাল একটা বলরুম ছিল। একপাশে বিরাট এক ফায়ারপ্লেস। এই ফায়ারপ্লেসের পাইপে আমরা শব্দ করলে অদ্ভূত এক ধরনের প্রতিধ্বনি শোনা যেত। মনে করতাম, এই চুল্লিটা অন্য আরেকটি জগতে প্রবেশ করার দরজা। চারপাশে পুরাতন অনেক বইপুস্তক ছিল। অনেক চিত্রকর্মও ছিল। বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে আমার প্রিয় চিত্রকর ছিলেন পল ক্লি । তাঁর চিত্রকর্ম―‘দৈত্য, আমার ধীর লয়ের গানের তালে তালে নাচো-এর জন্য আমার তাঁকে ভালো লাগত। চিত্রকর্মটি দেয়ালে  ঝোলানো ছিল। এটি যেন কাচা হাতে আঁকা একটি রেখাচিত্র। একটা নাদান বালিকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। ছবির নিচের দিকে দাঁড়িয়ে মেয়েটি হাত নাড়ছে। যেন সে একটা বাদক-বাদিকার দলকে নির্দেশনা দিচ্ছে। তার নির্দেশ অনুযায়ী দৈত্য উড়ে বেড়াচ্ছে। এই ছবিটার নিচে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতাম, আমিই সেই ছবির মেয়ে।

বাবা-মা সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করতেন। আট ঘণ্টারও অনেক বেশি সময় ধরে। তাঁদের মনোযোগের কেন্দ্রে ছিলাম না বললেই চলে। আয়াদের কাছে আমাদের রেখে ওরা চলে যেতেন। মাঝে মাঝে আমাকে আর তাতিয়নাকে একা রেখেই চলে যেতেন। এভাবে থাকতে থাকতে আমার একবার নিউমোনিয়া হয়েছিল। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা-মা বাড়িতে নেই। চেষ্টা করলাম বাইরে গিয়ে খুঁজতে। তাতিয়ানা মা-বাবার চাইতে তার বড় বোনের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ―এই ব্যাপারটি দেখে বাবা-মা খুশি হতেন। শহরের বাইরে গেলে আমাদেরকে তাদের পুরাতন বন্ধু, যাকে আমি কুবিকা নানি বলে ডাকতাম, সে এবং তার স্বামীর কাছে রেখে যেতেন। কুবিকা নানির স্বামী স্কুলের স্ট্যুয়ার্ডের কাজ করতেন। যুদ্ধের সময় কুবিকা নানি জেনারেল বার্লিং সেনাসদস্য হিসেবে কাঁধে বন্দুক আর পায়ে বুট পরে সাইবেরিয়া থেকে বার্লিন পর্যন্ত হেঁটে গেছেন। এর জন্য আমি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

আমার বাবা-মা ও আমার সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বাবা-মা আমাকে নানা বই সম্বন্ধে কথা বলতেন। যে বইগুলো গুরুত্বপূর্ণ―সেগুলোর কথা। অভিজ্ঞতা থেকে আমি একটি তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছি। চৌদ্দ বছর বয়সের পূর্বে যারা বেশি পড়াশুনা করে না, তারা পরবর্তী জীবনে ব্রেনের যে অংশটা বিভিন্ন কল্পচিত্র ও অভিজ্ঞতা প্রসেস করে, সেই অংশের পুরোপুরি উন্নতি ঘটাতে পারে না। আপনি যদি আপনার কলেজ জীবনে সিরিয়াস পাঠক হতে পারেন, তবে পরবর্তী জীবনে আপনি বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণাত্মকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। এই বিষয়টি আমি মাঝে মাঝে সাহিত্য-সমালোচকদের মধ্যে দেখতে পাই। এরা খুবই বুদ্ধিমান। তারপরেও এদের মধ্যে কী যেন কী নেই।

একটা সিগারেট খেতে চাই। আপনার কোনও আপত্তি আছে ?

মার্তা ফিগলেরোভিচ : একদম না। আচ্ছা, আপনি কি ভালো ছাত্রী ছিলেন ?

ওলগা তোকার্জুক : চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত আমি একেবারে সবার উপরেই ছিলাম। এই গ্রেডে এসে গুণ আর ভাগের অংক ঢুকে পড়ল সিলেবাসে। জীবনে এই প্রথম ধাক্কা খেলাম। অংকে আমি ভালো নই। অন্য বাচ্চারা আমার চাইতে ভালো ছিল। এই অভিজ্ঞতা আমার জন্য হালকা ট্রমার মতো, যেহেতু আমি সর্ববিষয়ে বুদ্ধিমান থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ফলে, নিজেকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মানিয়ে নিলাম যে, আমি বিজ্ঞান পড়ার যোগ্য নই। এখন অবশ্য মনে হয়, আমার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা রয়েছে।

আমার একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের কথা মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, আমি নাকি খ্যাপাটে। একটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমি কি এখন তাহলে নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারি ?’ এরপর একটা স্যান্ডউইচ আর সোডার বোতলে দুধ নিয়ে খেতে বসে পড়লাম। তখন অবশ্য অন্য বাচ্চারা ছিল কাজে ব্যস্ত।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : তরুণ বয়সে আপনি কী কী পড়তেন ?

ওলগা তোকার্জুক : ছোট্ট বেলায় আমি আর তাতিয়ানা গ্রিক ও রোমান ভাষায় পৌরাণিক কাহিনি, যা জঁ প্যারান্ডোভস্কি পোলিশ ভাষায় পুনর্লিখন করেছেন, সেই চিরায়ত লেখা আবিষ্কার করি। আমাদের অবশ্যই ঐ বইয়ে দুই-তিন খণ্ড পড়তে হয়েছিল। জল ও গাছের দেবতাদের আবিষ্কার করে আমি তো হতবাক হয়ে যাই। প্রকৃতির মধ্যে স্বর্গীয় আত্মার উপস্থিতি উপলব্ধি করি। গ্রিক মিথ আমাকে এদের নাম জানতে ও এদের সম্মান করতে শিখিয়েছে। বাতাস আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়। এটি যেদিকে খুশি, যে নামে খুশি এবং যেখানে খুশি বয়ে যেতে পারে। আমার মার পোলিশ ভাষার অনেক প্রসিদ্ধ লেখা মুখস্থ ছিল। তিনি আমাকে স্তেফান, জোরোনস্কি এবং জারোস্ল ইয়াজেউইক্জ-এর লেখা পড়তে বলতেন। তবে পোলিশ সাহিত্যে আমি খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না। ওটা ছিল তার এলাকা―এ কথা বলতে আমি অবশ্য বিব্রত বোধ করছি। আমার বাবা আবার ছিলেন উচ্চাভিলাষী লেখক। তিনি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা Literature na swiecie-এর নিয়মিত সাবস্ক্রাইবার ছিলেন। সেই সুবাদেই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে।

প্রতিটি গ্রীষ্ম আমরা নানা-নানির বাড়িতে কাটাতাম। স্টেট লাইব্রেরির কাছেই একটা গেস্ট হাউজ চালাতেন ওঁরা। ওখান থেকেই আমি রাক্ষুসে পাঠক হয়ে উঠি। তরুণ বয়সে টি. এস. এলিয়টের কবিতার বেশিরভাগ পংক্তি আমি মুখস্থ করে ফেলি ইংরেজি ও পোলিশ উভয় ভাষায়। লাইব্রেরি থেকে একটা দোভাষী বই চুরি করেছিলাম। ওটাই আমার একমাত্র চুরি করা বই। সে সময় ফকনারের Absalom, Absalom! আমাকে পেয়ে বসে। আর কোনও বই আমার কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আজও মনে হয়, তাঁকে আমি পুরোপুরি হজম করতে পারিনি। তবে The sound and the Fury পড়ার সময় আমার Stream of consciousness রচনাকৌশলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ১৯৭৫ সালে ফ্রয়েডের Beyond the Pleasure Principle-এর পোলিশ ভাষার প্রথম অনুবাদ ছাপা হয়। পনের বছর বয়সে বইটি পড়েছিলাম। অর্থের লুক্কায়িত ব্যবস্থা, যা আমাদের সঙ্গে আমাদের বাস্তবতার সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে, সে-ব্যাপারে ফ্রয়েডীয় ধারণা আমাকে মুগ্ধ করেছিল ব্যাপকভাবে। আমার স্কুলের অ্যাসাইনমেন্টে Absalom পড়তে আমি ফ্রয়েডের পদ্ধতি প্রয়োগ করেছি।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি খুব অল্প বয়সে লেখালেখি শুরু করেছেন ?

ওলগা তোকার্জুক : যখন আমার বয়স বারো বছর, তখন আমি আমার প্রথম উপন্যাস  লেখার কাজ শুরু করি। অবশ্য ওটা ছিল ডাকিনীদের বিষয়ে। ওরা থাকত বনে। মা আর তার মেয়ে। প্রত্যেকের বিশেষ বিশেষ মন্ত্র ছিল। ক্ষমতা ছিল। তবে আমি ভাবিনি যে, কখনও লেখক হব। আমি নৃত্যশিল্পী হতে চেয়েছিলাম বা নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়তে চেয়েছিলাম বা মহাশূন্য যাত্রার ঔষধশাস্ত্র নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে যখন জানলাম, পরের বিষয়টা কোনও বস্তু নয়, তখন হতাশ হলাম। আমার তরুণ বয়সে কিশোরদের ম্যাগাজিন Na Przelaj (off-Read)-এ ছোট ছোট কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। ওগুলো আনাড়ি ধাঁচের, অসংলগ্ন অদ্ভুত বিষয়-আশয় নিয়ে লেখা গল্প। জোসে দোনোসো এবং হুলিও কোর্তেজারকে অনুকরণ করার চেষ্টা করছিলাম সে-সময়। দীর্ঘতম রচনা Piesn O Psim Oowstanin (Canticles of the conquering canines) একটা বিকল্প বাস্তবতার বর্ণনা হাজির করেছে। এখানে কুকুর বিশ্বের দখল নিয়ে নিয়েছে। আর একটা গল্প ছিল পোলিশ প্রথা সংক্রান্ত যেখানে স্থানীয়রা রুই মাছ কিনে বাথটাবে দিনের পর দিন জিইয়ে রাখে। তারপর ক্রিসমাস ডের প্রাক্কালে এরা মাছটাকে মেরে ফেলে। দেয়ালের ওপারেই দেখবেন আমাদের লোকজন এ কাজটি করে। আমার বাবা ছিলেন আমার লেখার মহৎপ্রাণ সমর্থক। আমার গল্প টাইপও করে দিতেন। আমি বলতাম, আর বাবা লিখে যেতেন। আমি যা লিখেছি তা আবার আরেকজনকে পড়ে পড়ে শোনানো আমার কাছে বিব্রতকর। তবে বাবা একেবারে সিরিয়াসলি টাইপ করে যেতেন।

হাইস্কুলে পড়ার সময় আমরা বন্ধুবান্ধবরা মিলে একটা সভা করতাম। এর নাম দিয়েছিলাম Uposathas.  এটি অবশ্য একটি সংস্কৃত শব্দ। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রতিফলন ঘটিয়ে এটি করা হয়ে থাকে। সে সময় বৌদ্ধদের যে ধর্মগ্রন্থ আমি পড়তাম সমাবেশে সেটিও সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম। আমাদের দলের কোনও একজনের ব্রিটিশ সঙ্গীতের ব্যাপারে জানাশোনা ছিল। সবাই মিলে লেড জেপেলিন এবং ডিপ পার্পলের রেকর্ড শুনতাম। আমার প্রথম ছেলে-বন্ধুর কাছ থেকে আমি অনেক শুনেছি। সে-ই আমাকে ব্রুনো স্কালজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ও ওয়ার শোতে দর্শনশাস্ত্র পড়তে গিয়েছিল। ওর পেছন পেছন আমিও সেখানে মনোবিজ্ঞান পড়তে চলে যাই।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : ওয়ার শোর স্কুল আপনার কেমন লাগত ?

ওলগা তোকার্জুক : আমার মনে হয়, মনোবিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করার মানে হলো মনোসমীক্ষণের চাইতে আরও বেশি কিছু শেখা। তবে পোলিশ প্রজাতন্ত্রে আমাকে কেউ মনোসমীক্ষণ পড়ায়নি। যখন ওখানে পৌঁছলাম তখন বুঝলাম, যদিও অনেক দেরিতে, যে, আমি একটি বিশেষ আচরণ-রীতির মধ্যে গভীরভাবে ঢুকে পড়েছি। ইঁদুর এবং প্রতিবর্ত ক্রিয়ার ওপর অনেকগুলো বক্তৃতা শুনলাম। ওয়ার শো নিজেই আমাকে ট্রমাক্রান্ত করে ফেলে। জামেনহফ স্ট্রিটের ডর্মেটরিতে উঠলাম। রাজধানীর দোকান-পাট, থিয়েটার এবং রেস্তোরাগুলো একেবারে ফাটাফাটি রকমের চমৎকার। যখন আমার ছেলে-বন্ধুর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, তখন নিজেকে খুবই একা লাগছিল। ১৯৮১-এর শেষের দিকে পোল্যান্ড রাজনৈতিক সংকটে পড়ে। পৃথিবীটা যেন হতাশার চাদরে ঢেকে গেছে বলে মনে হলো। চারপাশের মানুষদের প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখলাম। এ দৃশ্য দেখে কান্না পেল। অনেক দিন বিষাদগ্রস্ত থাকলাম। প্রত্যেকে বেশ পার্টি করল। তবে হতাশায়।

শ্রেণিবৈষম্য আমার বিচ্ছিন্নতাবোধকে আরও বাড়িয়ে দিলো। আমি ছোট্ট একটা শহর থেকে আসা বালিকা; কমিউনিস্ট-শাসিত পোল্যান্ডে মনোবিজ্ঞান একটি অভিজাত পাঠের বিষয়। আমার এক সহপাঠী ছুটি কাটাতে গিয়েছিল ফ্রান্সে। আরেকজন গিয়েছিল গ্লাসগোতে তার ফুপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে আমেরিকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একদল হিউম্যানিস্টিক মনোবিজ্ঞানী কর্তৃক পরিচালিত একটি আউটপ্যাসেন্ট ক্লিনিকে স্বেচ্ছাসেবক থেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করতে লাগলাম। ওঁদের সঙ্গে আমার প্রথম সমীক্ষণ শুরু করলাম। কাজটা এক ধরনের দলবদ্ধ থেরাপি। আমাকে অল্প কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কাজ করতে বলা হলো। কাজটা ছিল কঠিন। আজকের দিনে কেউ কোনও ছাত্রকে এমন সাংঘাতিক মনোবৈকল্যের রোগী নিয়ে কাজ করতে দেবেন না।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : কে কে আপনার রোগী ছিলেন ? আপনি কি তাদের নিয়ে কখনও লিখেছেন ?

তোকারর্জুক : এদের একজন ছিলেন এক বেকার লোক। তাঁকে প্রতিবেশীরা জান্সে পার্টি জ্যান্ট বা জনি দ্য পার্টিজ্যান বলে ডাকত। তাঁর বয়স চল্লিশের মতো হবে। বেশ ট্রমাক্রান্ত ছিলেন। সৈনিকের পোশাক পরে এমনভাবে হাঁটতেন যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা। এক হাতে থাকত ছুরি, আরেক হাতে পিস্তল। অত্যন্ত উদ্বিগ্নতায় ভুগতেন। একদিন যখন আমি তাঁকে তাঁর এপার্টমেন্টে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম তখন একটা কৌশল অবলম্বন করলাম। ওটা আমি আমার প্রশিক্ষণ কোর্সে শিখেছিলাম। বিভ্রমের মধ্যে প্রবেশ করে আবার সেই বিভ্রমেরই বাইরে নিয়ে যাওয়া আর কি। উনি আমাকে বলছিলেন, কেউ একজন তাঁর পানিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। লোকজন তাকে গাছের আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে এবং তাঁকে আক্রমণ করার জন্য রাস্তায় ট্যাংক অবস্থান নিয়েছে। ‘চলুন, পানিটা দেখি’, আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। পানি সত্যিই ঘোলা ছিল, কারণ অতি সম্প্রতি পাইপ পরিষ্কার করা হয়েছে। কিছু মেরামতের কাজের জন্য পানি একটু ঘোলা বটে তবে ওয়ার  সো’তে এটিই সর্বোৎকৃষ্ট পানি। কাজেই, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ আরও বললাম, ‘দেখুন, বাইরে কেউ নেই। সবকিছু ঠিকঠাক আছে।’ সেদিন আমরা উভয়েই জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তার বাতিগুলো এবং যে বরফ পড়ার দৃশ্য দেখেছিলাম, তার কথা আমার আজও মনে পড়ে। এরপর উনি অপেক্ষাকৃত ভালো বোধ করার পর ডর্মেটরিতে ফিরে গেলাম। তারপর গেলাম এক পার্টিতে। সকাল বেলা জানলাম, সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। রাস্তায় ট্যাঙ্ক মোতায়েন করা হচ্ছে। আমার ছোটগল্প ‘চে গুয়েভারা’তে আমি এই আখ্যানটুকু বর্ণনা করেছি। এর জন্য আমি জ্যাস-এর কাছে ঋণী। সে সময় আমি মূলত কবিতা লিখতে ব্যস্ত ছিলাম। তাই মনে হলো, উপন্যাসের চাইতে কবিতা দ্রুত লেখা যায়। ‘Oddzial psychogeriatryczny’ কবিতাটি Mandragora ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। ওগুলোর খোঁজ-খবর করে দেখতে পারেন। খুব একটা ভালো হয়নি।

আমার ক্যারিয়ারের পরবর্তী পর্যায়ে আমি এক যুবকের চিকিৎসা করেছিলাম। ওর ছিল জটিল পারিবারিক ইতিহাস। ও আমাকে সবিস্তারে সব বলেছিল। বছর দুয়েক পর ওর ভাই আমার রোগী হিসেবে এল। সে-ও আমার অফিসে এসে একই ঘটনার বর্ণনা করল। এদের বর্ণনার মধ্যে তেমন কোনও ফারাক নেই। একজন বলল, ওর মা একটা ‘ভাবাবেগহীন কুত্তি’। এ ধরনের ভাষা ব্যবহারের জন্য মাফ করবেন। তবে ওদের বাবা ওদের মানসিকভাবে সাহায্য করেন। আরেকজন বলে, ওদের বাবার বাজে ব্যবহার থেকে ওদের মা ওদের বাঁচায়। এতে আমি পেশাগত জটিলতার সম্মুখীন হলাম। আমি কি ওদের একেবারে শক্তপোক্ত ট্রমার গভীরে খুঁড়ে খুঁড়ে অনুসন্ধান চালাব ? আপনি কি বলতে পারবেন, ওদের এক পরশ্রীকাতর দুষ্ট প্রকৃতির চাচা এই হযবরল পরিস্থিতিগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন এবং ওদের মানসিক ভারসাম্যহীনতার চিকিৎসা করাবেন ? মনোসমীক্ষণ যে একটি বিজ্ঞান, সে ধারণা তিরোহিত হলো আমার এ ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : তো আপনি কতদিন সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন ?

ওলগা তোকার্জুক : হ্যাঁ, তা প্রায় পাঁচ বছর হবে। থেরাপিউটিক ট্রেনিং নেওয়ার সময় আমার প্রথম স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সে সময় আমি একটা ওয়ার্কশপ করছিলাম। সে তখন সাবালক ছাত্র। ব্যাপারটা ছিল প্রথম দর্শনেই প্রেম। ওয়ালব্রিখে ও উত্তরাধিকার সূত্রে একটা অ্যাপার্টমেন্ট পেয়েছিল। ওটা খনি অধ্যুষিত এলাকা। আমরা ওখানে গেলাম। সেখানে আমার চারপাশে বউ-পেটানো স্বামী, ধূমপান ও বিয়ারে আসক্ত পুরুষ আর ঘিঞ্জি ও নোংরা সব ঘরদোর দেখে বিস্মিত হলাম। মনে মনে বললাম, এ আবার কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা। ওখানে সেন্ট্রাল হেলথ ক্লিনিকে মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ নিলাম। আমি আর আমার স্বামী অঅ-এর স্থানীয় একটা ভার্সন চালু করলাম যাতে ওরা মাদকাসক্তি থেকে বের হয়ে আসতে পারে। আমার ছেলের জন্মের পর স্ট্রলারে করে ওকে নিয়েই মিটিং-এ যেতাম। আমি অবশ্য স্বতন্ত্র ধরনের থেরাপি দিতাম। ওটা বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল পদ্ধতির সংমিশ্রণ।

এরপর সবকিছুতে খুব দ্রুত আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। আটকে গেছি বলে মনে হলো। রোগীর চিকিৎসা করতে করতে মাঝে মাঝে মনে হতো, রোগীর চাইতে থেরাপি তো আমারই বেশি প্রয়োজন। বুঝতে পারলাম, আমি মানুষের জন্য কী করতে চাই, আর আমার নিজের জন্য কী দরকার―এই দুয়ের মধ্যে আমি আটকে গেছি। ছোটবেলায় শিখেছি, যে কারোই মানুষকে সাহায্য করা উচিত। অথচ এখন আমি এর বিরুদ্ধাচরণ করছি। আমার কাছে একটা বই ছিল। তখনও সেটা পড়লে শিশুর মতো একটা প্রেতাত্মাকে ভয় পেতাম, যে একটা বনে বাস করত। ঐ প্রেতাত্মাটি নির্জন বাড়িতে হানা দেয়। কী সব লেখে, ঘুর ঘুর করে। ইতিমধ্যে পিঁপড়া, ফড়িং এবং এ রকম আরও অনেক কিছু দরজায় কড়া নাড়ে। তার কাছে সাহায্য চায়। প্রেতাত্মা বিরক্ত হয়। বলে, ‘আমাকে একা থাকতে দাও।’ চিৎকার করে বলে, ‘আমার কাজ আছে।’ তারপর রাগ প্রশমিত হলে ফড়িংকে সাহায্য করে। একটা সেতুবন্ধ তৈরি করে। অতএব, এখন সে সব প্রাণির সঙ্গেই থাকতে শুরু করে। আজ আমি নিজের অন্তর্মুখীনতা ও অন্যকে সাহায্য করার বাধ্যবাধকতার মাঝখানে পড়ে ক্ষতবিক্ষত, জর্জরিত। আমার বার্থচার্টে এই টেনশনের বিষয়টি আপনি দেখতে পাবেন।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনার রাশি কী ?

ওলগা তোকার্জুক : আমি কুম্ভ রাশির জাতক। ওখান থেকেই আমার অতিমাত্রায় সামাজিক হওয়ার ভাবনাটা আসে বা আমার চরিত্রের উৎসুক দিকটা আসে। তবে আমার বার্থচার্টে বৃশ্চিক রাশিতে নেপচুন আছে। সেটা আবার এগুলোর পুরো উল্টো।

যাই হোক, এরপর আমি আর আমার স্বামী আরও বেশি বেশি সৃজনশীল কাজের দিকে ঝুকলাম। আমরা তরুণ শিক্ষকদের জন্য একটা সহায়ক দল গঠন করলাম। শিক্ষকরাও মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুরু করলাম ১৯৯১ সালে। নাম দিলাম ‘ইউনাস’। সেই গ্রুপে ক্লাসে যা ঘটে সেগুলো নিয়ে প্রচুর কাজ করলাম। যেসব দ্বন্দ্ব বাঁধে ক্লাসে সেগুলো নিয়েও কাজ করলাম। ওয়ালব্রিখের অনেক শিক্ষক আমাদের ঐ ওয়ার্কশপগুলোর জন্য আজও মনে রেখেছেন।

বছর দুয়েক আগে আমি ইয়ুং-এর একটি লেখা খুঁজে পাই। তাঁর কাছ থেকে সমন্বিত নির্জ্ঞান-এর ধারণা নিয়েছি। একটা ধারণাও পেয়েছি যে, আমরা একটা জীব-জগতের বাসিন্দা। মানুষের চেতন বোঝার জন্য আমাদের চারপাশের গাছপালা, পশুপাখি এবং এমনকি মাশরুমকেও বুঝতে পারা জরুরি। উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে ইয়ুং-এর বিশ্লেষণ বা সমীক্ষণ প্রক্রিয়ার পোলিশ ভাষার একটা ডিকশনারি প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করি। শুধু ওয়ালব্রিখে নয়, সব স্থানেই। সে সময় ইয়ুং পোল্যান্ডে পরিচত ছিলেন না। এমনকি কয়েক বছর পরেও আমি যখন আমার বইয়ে ইয়ুংকে উদ্ধৃত করি তখন লোকজন তাঁকে চিনতে পারেনি। কেউ কেউ আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, ইয়ুং হস্তরেখা বিশারদ কোনও জ্যোতিষী কি-না যিনি জোতিষশাস্ত্র নিয়ে লেখেন। আমরা গ্রুপ থেরাপির উপর অনেকগুলো ম্যানুয়াল প্রকাশ করলাম। কমিউনিকেশন ট্রেনিং-এর ওপরও। এরপর একটা বইয়ের দোকান খুললাম। ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত এই সব প্রকল্প আমাকে সাহায্য করেছে জীবিকা উপার্জনে। Primeval and Other Times লেখার সময় যে কাজগুলো লেখকসুলভ নয়, সেগুলো ছেড়ে দিই। আড়াইটা বই পকেটস্থ করে ভাবলাম, এবার লেখালেখি করে জীবিকা উপার্জনের সুযোগ আছে বৈকি।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : মাতৃত্ব কীভাবে আপনার কাজকর্মের ওপর প্রভাব ফেলেছে ?

ওলগা তোকার্জুক : তরুণ বয়সে বাচ্চা নেওয়ার সুবিধা আছে। মাতৃত্বকে অসাধারণ কিছু মনে হয় না। একটা ছোট্ট মানুষ আপনার জীবনে এল আর আপনি তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলেন। আপনার তখন প্রচুর শক্তি। আপনি তাই শেষ রাতেও পার্টি করতে পারেন। তারপর সকালে ঘুম থেকে উঠে একসঙ্গে খেলতে এবং পর্বতে যেতে পারেন। এগুলোর সবই স্বাভাবিক। আমি আমার মার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছি। তাই জবিন্সকোকে মানুষ করে তুলতে আমি পুরো পরিবারের সাহায্য পেয়েছি। আমি আর আমার স্বামী একসঙ্গে কাজে গেছি। ভ্রমণে বেরিয়েছি। আমার মনে হয় না, বাচ্চা থাকলে কাজের ক্ষতি হয় বা জীবিকা উপার্জনের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। মা হওয়ার চাইতে Beyond the Pleasure Principal পড়াকে অস্তিত্বের দিক থেকে আমার কাছে অধিকতর বেশি পরিবর্তন আনয়নকারী কাজ বলে মনে হয়।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি আশি এবং নব্বইয়ের দশকে রাজনীতি করেছেন ?

ওলগা তোকার্জুক : প্রত্যেকেই কি করেননি ? হাই স্কুলে পড়াকালে আমাকে নৈরাজ্যবাদী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারপর মাওবাদী। আমার মনে হয়, সংহতি আন্দোলন যথেষ্ট মৌলিক নয়। আমি পুরোপুরি বিপ্লব চেয়েছিলাম। আমি যেহেতু সংহতির ব্যাপারে অধিকতর ভালো জানতাম, তাই তাদের ধার্মিকতা আমাকে তখনও ভাবাত। সবকিছু ছিল পোপসংশ্লিষ্ট। ক্যাথলিক চার্চ ও প্রার্থনা সংক্রান্ত। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিলাম। তবে আমি তো আর সংগঠক ছিলাম না। ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতন হলে আমার মনে হলো বিশ্বে পরিবর্তন আসছে। তবে মাদকাসক্তদের সঙ্গে কাজ করার দরুন এমন সব দুঃখ-দুর্ভোগের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটল যে, সেখানে দাঁড়িয়ে আমি আর আশাবাদী হতে পারলাম না। যে তারতম্যটা আমি লক্ষ করলাম, তা হলো বার্লিন প্রাচীরের পতনের পূর্বে আমি শুধু লোহার ভেদরেখাটা, অর্থাৎ পূর্ব-জার্মানি পর্যন্ত যেতে পারতাম, আর এর পতনের পর অর্থ উপার্জনের জন্য আমি আমেরিকায় যেতে সক্ষম হলাম।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : লন্ডনে আপনার কি পরিবর্তন হলো ?

ওলগা তোকার্জুক : সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার পর কয়েক বছর লেখালেখি বাদ দিয়েছিলাম। কিন্তু লন্ডনে গিয়ে আমি আবার লেখালেখি শুরু করলাম। চারিং ক্রস রোডে ‘সিলভার মুন’ নামের একটি মৌলিক নারীবাদী বইয়ের দোকানে যাতায়াত করতাম। কোনও বই কিনতাম না। সবকিছুর দাম ছিল অনেক চড়া। তবে ওখানে বসে Women who Run with the Wolves-এর মতো বই এবং ইয়ুং-এর ভাবধারার লেখক, যেমন ম্যারি-লুইস ভন ফ্রানৎস-এর বই পড়তাম। নিজেকে তখন আবিষ্কার করেছি বিদ্বেষ ও উদ্দীপনার মাঝখানের ভেদরেখায়, নারী ও পুরুষের মধ্যকার বিভাজনকারী রেখার ওপর নিজেকে দাঁড় করিয়ে; নারী ও পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির বিভাজন রেখায় নিজেকে স্থাপন করে। এরপর জেন্ডারের ব্যাপারে একটি তত্ত্ব নিয়ে ফিরে এলাম পোল্যান্ডে।

এমনকি যখন ছোট্ট বালিকা ছিলাম তখনও দেখেছি, লাইব্রেরিটাকে পুরুষ কর্তৃক ও পুরুষদের জন্যই ডিজাইন করা হয়েছিল। যে বইগুলো পড়তাম সেখানে দেখতাম, নারীচরিত্রগুলোর কাজই হলো পুরুষ চরিত্রগুলোকে সাপোর্ট করা। তবে হ্যাঁ, গ্রিন গ্যাবলস এবং এমা বোভারির অ্যান ছিল, তবে এমন কোনও নারীচরিত্র ছিল না যে কোনও কিছুকে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে পারে বা বিশ্বটাকে বদলে দিতে পারে বা কেউ বিস্ময়কর কিছু বেছে নিতে পারে। আমি যে ধরনের বই পড়তে চাইতাম, তা খুঁজে বের করাই ছিল কঠিন। মনে হতো, লাইব্রেরিতে ঢুকতে হলে আগে আমার নারীবাদী ভাবনা ত্যাগ করতে হবে। এটাই আমার লাইব্রেরির প্রবেশ-মূল্য। পুরুষবাদী চিন্তাকাঠামো বুঝতে পারাটাই আমার লন্ডনে থাকার উপকারিতা। তখন থেকেই বিষয়গুলো নিয়ে আমি  ভেবেছি। কয়েক বছর পর আমি লিখলাম আমার প্রথম উপন্যাস House of Day, House of Night.  এখানে  জেন্ডারসংক্রান্ত অস্পষ্ট ধারণাবিশিষ্ট চরিত্রগুলোকে আমি নিয়ে এলাম। Empuzjon আমার সাম্প্রতিক উপন্যাস। এখানে আমি টমাস মানের The Magic Mountain উপন্যাসের পুনঃপাঠ হাজির করেছি। এটি একটি পুরুষতান্ত্রিকতার প্রত্যুত্তরে যুক্তিবাদী রচনা। The Magic Mountain-এর মতো বড় বড় লেখার মধ্যে আলতোভাবে প্রবেশ করলেই আপনি দেখবেন সেখানে নারীবিদ্বেষী ধারণা কেমনভাবে গেঁথে দেওয়া হয়েছে।

লন্ডনে একটি আধা বৈধ ও আধা অবৈধ টিভির এন্টেনা তৈরির কারখানায় কাজ করতাম। যারা আমার সঙ্গে কাজ করতেন তারা এসেছিলেন সেন্ট্রাল আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং আর্জেন্টিনা থেকে। কাজের সময় আমরা সবাই একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করতাম। সপ্তাহান্তে মেইডের কাজও করতাম। যে হোটেলগুলো চিনতাম সেখানে গিয়ে বলতাম, ‘আমি কাজ করতে চাই।’ রিসেপশনিস্ট ভয় দেখাতেন, বলতেন, ‘এ পথে নয়, তোমাকে পেছনের দরজা দিয়ে আসতে হবে।’ তারপর আমাকে নিয়ে গিয়ে রুম পরিষ্কার করার কাজে লাগিয়ে দিতেন। এ অভিজ্ঞতা আমাকে আমার প্রথম সফল ছোটগল্প ‘Numery’ (Number) লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। যে বিছানা ছেড়ে লোকজন উঠে চলে যায় তার পরতে পরতে জীবনটাকে উল্টে-পাল্টে আমি দেখেছি। এরপর পোল্যান্ডে ফিরে আরও বেশি গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে শুরু করলাম Podroz ludzi Ksiegi (Journey of the People of the Book) নিয়ে।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : প্রথম উপন্যাসটি কি সহজেই প্রকাশ করতে পেরেছিলেন ? প্রকাশক খুঁজে পেলেন কীভাবে ?

ওলগা তোকার্জুক : ফিরে তাকালে দেখি, এটা সেই বই নয় যা একজন লেখক লিখেছিলেন, বরং এটি সেই বই যা একজন পাঠক লিখেছিলেন। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর ফ্রান্স ও স্পেন নিয়ে লেখা সত্যিই বেশ সাহসী ব্যাপার ছিল, বিশেষ করে যখন আমি নিজে কখনও স্পেন বা ফ্রান্সে যাইইনি। এই জায়গাগুলো সম্বন্ধে যা লিখেছি তার সবই এসেছে আমার পড়া বইগুলো থেকে। বিশেষ করে, Zycic codzienne সিরিজের বইগুলো থেকে যেগুলো লেখা হয়েছে সারা বিশ্বের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। এই বইগুলো আমার কিশোর বয়স থেকেই  পছন্দ করতাম। একটা বড় নোটবুকে আমি Ludzi Ksiegi গ্রন্থটি রচনা করেছিলাম। ধীরে ধীরে টাইপ মেশিনে টাইপ করি। চারটি মাত্র কার্বন কপি করেছিলাম। সবার নিচের কপিটা এতটাই ঝাপসা হয়েছিল যে সেটি প্রায় পড়া যাচ্ছিল না। যে কারণে আমি তিনজন সম্পাদকের কাছে তিনটা কপি পাঠাই। প্রথম দুজন বাদ দিয়ে দেন। একজন আমাকে পাণ্ডুলিপিটি ফেরত দেবেন না বলে জানালেন। আরেকজন বললেন, তার ফেলে দেওয়া পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্য থেকে আমারটা খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু জারেক মারকিউইজ, যিনি ছোট্ট একটা অখ্যাত প্রকাশনা চালান, তিনি আমাকে ‘হ্যাঁ’ বললেন। আমাকে অবশ্যি কাগজের দাম দিতে হয়েছিল। তবে বইটি সম্মানজনক পোলিশ পুরস্কার পেয়েছিল। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে একটা জুতার প্যাকেটে করে আমার দ্বিতীয় উপন্যাস E. E. এর পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়েছিলাম। ইয়ুং-এর পিএইচ.ডি. থিসিসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলাম এই উপন্যাস। বাস্তবতাকে আমি বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছি। প্রতিটি পরিপ্রেক্ষিত ইয়ুং-নির্দেশিত চার ধরনের ব্যক্তিত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এদের মধ্যে কখনওই বোঝাপড়া হয় না।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি আপনার প্রথম ড্রাফটটা সবসময় হাতে লেখেন ?

ওলগা তোকার্জুক : Flights লিখেছিলাম একটা বাঁক বদলের কথা মাথায় রেখে। তখন প্রথমে উচ্ছিষ্ট কাগজে লিখতাম। পরে তা টাইপ করতাম। আজকাল যখন কোনও ধারণা মাথায় উঁকি দেয়, তখন আমার ল্যাপটপে বসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। এম.এস. ওয়ার্ডে লিখি। ছোট ছোট ফাইলে। পরে সেগুলো বড় একটা ফাইলে নিই। এটাকে আমি ‘কপার্স’ বলি। এখানে নেওয়া হলে আমি আর এতে হাত দিই না। ড্রাফট তৈরির সময় অনেকগুলো ফাইল খুলে রাখি। প্রয়োজনে সেগুলো থেকে আমি কপি করি, পেস্ট করি। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর যে উপন্যাসটা নিয়ে কাজ করছিলাম, তা লেখা থামিয়ে দিই। এটি যুদ্ধপরবর্তী সিলেসিয়ার গল্প অবলম্বনে লেখা। ফিরে এসে দেখি একই নামে কয়েকটা কম্পিউটারে আমি ড্রাফট সেভ করে রেখেছি। আমার তিনটা কম্পিউটার আছে। তাই প্রায়ই আমি পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে থাকি। আবার একই দৃশ্যের দুই-তিনটা ভার্সনও লিখে ফেলি। Empuzjon-এর পাণ্ডুলিপি লেখার সময়ও আমার একই ঘটনা ঘটেছিল। আমার উপন্যাসের চরিত্র ক্যাফেতে একটা খাবারের অর্ডার দেয়। এরপর আমি বেমালুম ভুলে যাই। তারপর কয়েক অনুচ্ছেদ পর আমি আবার এই দৃশ্য লিখি। উপন্যাসের বয়ান নির্মাণে যে কল্পনা আমি কাজে লাগাই, তা বেশ গভীর। কিন্তু স্মৃতির সঙ্গে এটি মিশে কখনও কখনও ঝাপসা হয়ে যায়। আমার মনে হয়, অপেক্ষা করুন,―এ কথাটা কি আগে বলেছি, নাকি এ কথা বলার কথা আগে ভেবেছি ?

ছাত্রাবস্থায় শিক্ষার মনস্তত্ত্ব বিষয়ে আমার পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। সেটা ছিল বিখ্যাত এক অধ্যাপকের কাছে মৌখিক পরীক্ষা। তিনি ছিলেন আমাদের টেক্সট বইয়ের লেখক। খুব ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। পাশও করেছিলাম। কিন্তু যখন তিনি আমাকে গ্রেড দিচ্ছিলেন তখন বললেন, ‘তোমার স্মরণ রাখা ও শেখার একটা অদ্ভুত পন্থা আছে। এমনটা আমি কখনও দেখিনি। তোমার ছোটখাটো অনেক বিষয় মনে পড়ে যায়। তুমি সেগুলো আবার বিস্তারিত বলতেও পারো। কিন্তু তুমি সমস্যার কেন্দ্রটাই হারিয়ে ফেলো।’ তিনি অবশ্য ঠিকই বলেছিলেন। যে ট্যাপ ড্যান্সিং নাবিককে আমি অনেক আগে দেখেছি আড়চোখে, তার কথাও আমি নির্ভুলভাবে বর্ণনা করতে পারি। অথচ পরিবারের সদস্যদের আমাকে মাঝেমাঝে মনে করিয়ে দিতে হতো যে, আমি কোনও আলাপচারিতার মধ্যে আছি। ভয় হচ্ছিল, এটি আবার আমাকে বাজে লেখক বানিয়ে দেয় কি-না। কিন্তু এরপর আমি নবোকভের Speak Memory গ্রন্থটি পড়ে ফেলি। ওখানে তিনি এ ধরনের স্মরণশক্তির ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন। বইটি পড়ে বেশ শক্তি পেলাম। ভাবলাম, তিনি যদি এমন অস্বাভাবিক স্মরণশক্তির এমন চমৎকার ব্যবহার করতে পারেন, তবে আমি পারব না কেন ?

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কীভাবে আপনার অস্বাভাবিক স্মরণশক্তি ব্যবহার করতে শিখলেন ?

ওলগা তোকার্জুক : চিন্তাভাবনা কীভাবে তার শরীর গঠন করে, Fights লেখার সময় আমি তা বুঝতে পারি। ভেবেছিলাম, ঐ উপন্যাস হবে অনেক কিছুর সমষ্টি; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক কিছুর একত্রীকরণ। ছড়ানো-ছিটানো যে বাস্তবতাগুলোর মধ্যে আমরা বসবাস করি, সেগুলোকে আমি একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে অংকন করতে চেয়েছিলাম। এর জন্য দরকার ছিল একটা রেখা যা বরাবর পাঠক এগিয়ে যাবেন। বুঝতে পারলাম, এর জন্য উত্তম পুরুষ গল্পকথক-এর প্রয়োজন। সম্পূর্ণ দৃশ্যপট একসঙ্গে তুলে ধরে এমন বর্ণনাকৌশলের চাইতে উত্তম পুরুষ গল্পকথকের মধ্য দিয়ে গল্প বলা সহজ। কিন্তু ভাঙ্গা-ভাঙ্গা আখ্যান পাঠককে দ্বিধাগ্রস্ত করবে। এক্ষেত্রে আপনি আপনার নিজের সত্তাকেই উৎসাহ উৎসারণকারী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। যখন আমি সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিটি আমার প্রকাশক উইডানিক্টু লিটারেকির কাছে পাঠালাম, তখন ওঁরা আমাকে ই-মেইল পাঠালেন। বললেন, সম্ভবত আমি ভুল ফাইল এটাচ করেছি। ওঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, এই অসম্পূর্ণ, ভাঙ্গা-ভাঙ্গা জিনিসটা কি ? আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি কিন্তু ঐ প্রকাশনাকে পছন্দ করি। কিন্তু আমার সম্পাদক গতানুগতিক গদ্যে অভ্যস্ত ছিলেন।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি প্রথমেই কাউকে আপনার ড্রাফটটা দেখান ?

ওলগা তোকার্জুক : নিয়মানুযায়ী কখনওই না। গুরুত্বপূর্ণ এডিটিং পর্যন্ত অপেক্ষা করি। যদি মনে হয় এর ওপর আর সৃজনশীল কিছু আমাকে করতে হবে না, তখন প্রথম যে ব্যক্তি এটি পড়েন, তিনি হলেন আমার স্বামী গ্রেজর্জ।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : কীভাবে বোঝেন, আপনার লেখা প্রস্তুত হয়ে গেছে ?

ওলগা তোকার্জুক : আমার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে। উৎসাহ নিঃশেষ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে লেখাকে আমার কাছে ক্ষুধা বা আকাঙ্ক্ষা মনে হয়। আপনি আরেক কামড় খেতে পারবেন বা আপনি আরেক অধ্যায় লিখতে পারবেন, এ রকম কখনও অনুভব করবেন না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণকালীন ভাষা ব্যবহার করে বলতে পারি―এই প্রক্রিয়াটিকে শারীরবৃত্তীয় বা শরীর ও মন উভয়টা মিলিয়ে এমন এক প্রক্রিয়া মনে হয়, যেমন ধরুন―তা পুনর্জন্ম প্রক্রিয়া বা প্রাকৃতিক কর্মসাধন ইত্যাদি। যেই মাত্র আপনি জন্ম দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যাথাটা ভুলে গেলেন―ঠিক এমনই। যেই মাত্র উপন্যাসটি লেখা শেষ হলো ঠিক তখনই আপনি এটা লিখতে গিয়ে যে কষ্ট সয়েছেন, তা ভুলে গেলেন। তবে এটা শরীরের ওপর একটা চাপ। সর্বোপরি, মনোযোগের জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিশ্রম।

The Books of Jacob লেখা শেষ করে আমি অসুস্থ বোধ করেছিলাম। গতানুগতিক চাইনিজ মেডিসিন প্র্যাকটিস করেন―এমন একজন ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তিনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কী কাজ করছেন ? এটা ধীরে ধীরে আপনার জীবনীশক্তিকে খেয়ে ফেলছে যা আপনি আর কোনও কিছু দিয়েই পুনঃস্থাপন করতে পারবেন না!’ আমার ভয় হলো―আমি আমার একটা অংশ হয়তো নষ্ট করে ফেলেছি যা আর কখনও ঠিক হবে না।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনার গতানুগতিক লেখার দিকটি কেমন ? লেখার ক্ষেত্রে আপনার কি কোনও আনুষ্ঠানিকতা আছে ?

ওলগা তোকার্জুক : যারা রুটিন করে লেখেন তাদেরকে আমার হিংসে হয়। যেমন ধরুন, যিনি সকালে ঘুম থেকে উঠে তিন ঘণ্টা লেখেন; তারপর হাঁটতে বের হন। আমি এসব পারি না। মাঝে মাঝে বাড়ির আশেপাশে টুকিটাকি কাজকর্ম থাকলে তা করি। ছন্দ ফিরে পাওয়া মাত্রই আমি কাজে লেগে পড়ি এবং লেগে থাকি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। চাঙ্গা থাকার জন্য এক কাপ চা খাই এবং সলিটেয়ার খেলি। এটা মস্তিষ্কে চিরুনি চালানোর মতো কাজ করে।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : কোথায় লেখেন ?

ওলগা তোকার্জুক : বাড়িতে, চিলেকোঠায় বসে লেখি। আমার শান্ত, প্রশান্তিময় পরিবেশ দরকার। তবে জায়গার চাইতে আমার ল্যাপটপের সঙ্গে যোগাযোগটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেখানেই আমি আমার ল্যাপটপ রাখি সেখানেই আমি লিখতে বসে যাই। কোনও হোটেলে যদি তিন দিনের বেশি থাকি, তবে সেখানেই কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসে যাই। তবে ট্রানজিটের সময় একদম মন বসাতে পারি না।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি মনোসংযোগের জন্য অফলাইনে থাকেন ?

ওলগা তোকার্জুক : হায় ঈশ্বর, নাহ। আমি সবসময়ই ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করি। কখনও ঐতিহাসিক ঘটনা, কখনও আবার কোনও কিছুর প্রকৃত নাম, সমার্থক শব্দ ইত্যাদি দেখতে থাকি। এটি আমার কল্পনার জগৎকে মজবুত করে। The Book of Jacob লেখার সময় উইকিপিডিয়া থেকে সাহায্য নিই জানার জন্য যে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে ধূমকেতু ইউরোপের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিল, তা পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চল থেকে দৃশ্যমান ছিল কি-না। আবার সেই ধূমকেতুটা দেখতে কেমন ছিল―তা জানার জন্য আমি গুগল স্ট্রিট ভিউ ব্যবহার করি। যে জায়গায় আমি কখনওই যাইনি, যেমন―চেচনিয়ার শহর ব্রনো―সেই জায়গাগুলোর বর্ণনা করতে এটি আমাকে সাহায্য করে।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি সব গবেষণা অন-লাইনে করেন ?

ওলগা তোকার্জুক : নাহ। লাইব্রেরি এবং আর্কাইভেরও দরকার আছে। মাঝে মাঝে ভ্রমণেও যাই। যে কল্পকাহিনির ভিত্তি সুদৃঢ় নয়, তা আমি পছন্দ করি না। যেমন ধরুন―এ রকম বাক্য আমি পছন্দ করি না―‘সে বাইরে গেল। বসল। চা পান করল। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তখন বাইরে একটা গাড়ি চলে যাচ্ছিল।’ আমি বরং জানতে চাই, সে কী চা পান করছিল, কোন জানালা দিয়ে সে বাইরে তাকিয়েছিল, কী ধরনের গাড়ি রাস্তা দিয়ে চলে যেতে দেখল, রাস্তায় আর কী কী ছিল; চেয়ারটাতে বসে তার কেমন লাগছিল; ঘরটাই বা কেমন; বাইরে দিনের উজ্জ্বলতা কেমন ছিল। হতে পারে, পাঠকের মতো বিশেষ এক রকমের কল্পনাপ্রবণ আমি নই। তবে আমার মনে হয়, সে-কাজ করা লেখকের দায়িত্ব।

মোটামুটিভাবে সোজাসাপ্টা বই, যেমন―Anna In a w grobowcach swiata (Anna in the Tombs of the World)-এর কথাই ধরুন। এখানে আমি সুমেরু অঞ্চলের মিথের পুনঃকথন হাজির করেছি। প্রাচীন মেসোপোটেমিয়া সম্বন্ধে যতটুকু পেরেছি হাজির করেছি। সুমেরু অঞ্চলের বাসিন্দারা কী পান করত ? পণ্ডিতেরা বলেন, তারা নাকি শুধু বিয়ার পান করত। কিন্তু সেই বিয়ার তৈরিতে কী ধরনের বার্লি ব্যবহার করত তারা ? নিশ্চয়ই যে ইস্টার্ন ইউরোপিয়ান বার্লির কথা আমি জানি, সেটি তা নয়। আমি সিরিয়ায় গিয়ে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের চারপাশে হাঁটতে থাকি। সেখান থেকে বুনো বার্লির ডগা সংগ্রহ করি। এই বার্লিই ওখানে এবং ওখানকার আশেপাশে জন্মাত। মাঝে মাঝে আমার উপন্যাসের একটা বাক্য লিখতে আমাকে বেশ কষ্টকর গবেষণা করতে হয়। পাঠক এই ব্যাপারটি জানল না-কি জানল না―তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। বরং আমার নিজের খাতিরেই এবং আমি যা লিখছি তা ঠিকঠাক  জেনে নেওয়ার জন্য এ কাজ করি।

প্রায়ই আর্কাইভে কাজ করতে করতে অনেক কিছু সামনে চলে আসে। The Book of Jacob-এর মূল চরিত্রের সঙ্গে আমার হঠাৎই সাক্ষাৎ হয়ে যায়। একটা পুরাতন বইয়ের দোকানে তাঁর শিষ্যের লেখা একটা পুস্তিকা পেয়ে যাই। যে সময় এই বই ছাপা হয় সে সময় পোলিশ উইকিপিডিয়াতে জেকব ফ্রাঙ্কের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। যখন আমি আরও গভীর অনুসন্ধান চালালাম তখন আমার পুরো পাঠের বিষয় পেয়ে গেলাম। এ যেন একটা গবেষণাপত্র পেয়ে গেলাম। আমি ইহুদি অতীন্দ্রিয়বাদ, লোককাহিনি, অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্ব-ইউরোপের দৈনিন্দিন জীবন, অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাস, বিশেষ করে আলোকায়ন এবং পোল্যান্ডে-এর প্রভাব এবং সেই সময়ের সাহিত্য সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলাম। জেকব ফ্রাঙ্কের ষাটটি ঘাত-সংঘাতময় বছরের জীবনে কে কে ছিলেন এবং তাদের সঙ্গে কী কী ছিল, তা আমি বিস্তারিত জানতে চেয়েছিলাম। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি কি জানেন, ফ্রাঙ্কের কিছু অনুসারীকে ফরাসি বিপ্লবের সময় গিলোটিনে হত্যা করা হয় ? আমার আফসোস যে, আজকের দিনে এই বইয়ের শেষে কোনও গ্রন্থতালিকা সন্নিবেশিত করা হয়নি। ইতিহাসবিদগণ বলেছেন, আমার তেমন একটা ভুলত্রুটি হয়নি। সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে এর পোলিশ ভাষার সংস্করণের টাইপসেটিং-এ। কিছু উদ্ধৃতিতে হিব্রু ভাষার শব্দের কিছু কিছু বর্ণ কম্পোজিটর ছেড়ে দিয়েছেন। আমি এটা ধরতে পারিনি।

আপনি একবার যদি গবেষণার গভীরে প্রবেশ করেন, তাহলে আপনি এমন অনেক কিছুর সন্ধান পেয়ে যাবেন যার ব্যাপারে আপনি আগে মনোযোগ দেননি। তখন মনে হবে, পৃথিবীটা আপনাকে সাহায্য করছে। যিনি আগ্রহী তিনি ফ্রাঙ্কের পূর্বপুরুষদের খোঁজে ইস্তোনিয়ায় যেতে পারেন। কেউ হয়তো আগ্রহভরে যেতে যেতে কাউন্টেস কাতারজিনার গল্প বলতে পারেন। পোল্যান্ডের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যেতে পারে। এ ঘটনা কি সম্ভব ? আমার মনে হয়, সাহিত্যের মনস্তাত্ত্বিকরা এই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবেন।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি মনোসমীক্ষণের ঢংয়ে লেখার কথা ভেবেছেন ?

ওলগা তোকার্জুক : ভেবেছি। সৃজনশীল লেখার মনস্তত্ত্ব আমাকে মুগ্ধ করে। ভিন্ন ভিন্ন স্বর, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। পাঠকের যোগাযোগও গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয়, যে পন্থায় একজন ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাস শুরু করেন, তা আসলে ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞান কীভাবে শুরু হয়, তার মতো। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে পাঠক এমনভাবে প্রবেশ করেন যেন রোগী তাঁর সাইকোথেরাপিস্টের সঙ্গে কোথাও প্রবেশ করছে। আপনাকে একটা পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে হবে যার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে এবং নানা পর্যায়ে এর প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ, পরিবর্তন করা যায়। এই সবকিছু একটি নির্দিষ্ট নিষ্কৃতির দিকে নিয়ে যায়। এটি অবশ্য পরিশোধন প্রক্রিয়া বা ক্যাথারসিসের মতো, অর্থাৎ সাইকোথেরাপির শুরুতে রোগী যেমন ছিলেন, এর শেষে তিনি আর তেমন থাকেন না। পাঠকও তাই। এ কাজটিই লেখক করে থাকেন। এভাবেই উপন্যাস তাঁর পাঠককে প্রভাবিত করে। একটি বিশ্বাসযোগ্য বোঝাপড়া স্থাপনের মধ্য দিয়ে পাঠককে উৎসাহিত করা হয় গ্রন্থটি পড়ে যেতে, যাতে নানা কিছুর দ্বারা বিব্রত হলেও তাঁরা শেষ পর্যন্ত পড়েন এবং পড়া শেষে বদলে যান। আমার বিশ্বাস, প্রতিটি ভালো উপন্যাস পাঠককে তার নিজের মতো করে বদলে দেয়।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি কখনও একসঙ্গে একাধিক উপন্যাস নিয়ে কাজ করেন ?

ওলগা তোকার্জুক : আমি The Books of Jacob এবং Drive Your Plow পাশাপাশি রেখে লিখেছিলাম। যারা উপন্যাস দুটো পড়েছেন তাদের কাছে বিষয়টি অদ্ভুত লাগতে পারে। দুটি বইয়েরই চুক্তি ছিল। আমি জানতাম The Books of Jacob আমাকে আটকে দেবে। সে সময় পোল্যান্ডে সবাই ক্রাইম ফিকশন পড়ত। তাড়াতাড়ি কিছু একটা  লিখতে চেয়েছিলাম।

একসঙ্গে দুটি টেবিল পাতি। একটা ভরিয়ে ফেলি ঐতিহাসিক ম্যাপ এবং জটিল আখ্যানের খসড়ায়। আমি এই দলিল-দস্তাবেজকে মই বলি। এগুলো দিয়ে একগাদা শব্দবন্ধের তালিকা তৈরি করি। একটা শিকলের মতো বয়ান নির্মাণ করি। এর কোনও কোনওটা অর্থের মডিউল। এগুলোকে নড়ানো-চড়ানো বা পুনঃসজ্জিত করা যায়। তবে নম্বর উল্লেখ করা উপভাগগুলোতে খসড়া লেখা চলে। বুলেট পয়েন্ট দিয়ে চিহ্নিত করি নিচে সংখ্যা বসিয়ে বসিয়ে। The Books of Jacob-কে সুশৃংখলভাবে তৈরি করা খুব কঠিন কাজ। আমার অন্য টেবিলে লেখার কাজ চলছিল Drive Your Plow-এর। এর আখ্যান অবশ্য বেশ পরিষ্কার ও অধিকতর সুগঠিত।

সে-সময় নেদারল্যান্ডে গিয়েছিলাম ফেলোশিপ নিয়ে। তখনই আমার বর্তমান স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়। আমার দরখাস্তে অঙ্গীকার করি, আমি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসকি উপন্যাস নিয়ে কাজ করব। তবে Drive Your Plow লেখার দুরারোধ্য আকর্ষণ ছাড়তে পারলাম না। একবার শুরু করলে আমি এর বয়ানের মধ্যে ডুবে যাই। নিজেকে জোরালোভাবে আবিষ্কার করি দুসজেকোর মধ্যে। যে নতুন অধ্যায় লিখতে যাচ্ছিলাম সেখানে কি ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমি অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। এরকম অনুমান করে শুরু করলাম যে, বনের সব প্রাণি নিজেরাই শিকারিদের খুনিতে রূপান্তরিত হবে। মাঝখানে গিয়ে আমার মনোভঙ্গি পাল্টে ফেললাম। দুসজেকো নিজেই খুনি হয়ে যাবে। শুনেছিলাম, আগাথা ক্রিস্টি নাকি তাঁর একটা ক্রাইম উপন্যাসে এমনটাই করেছিলেন। যদিও আমার মনে নেই যে, এ তথ্য আমি কোথায় পেয়েছিলাম। শেষ অধ্যায়টা লেখা সমাপ্ত করে বেলকনিতে গিয়ে একের পর এক কয়েকটা সিগারেট ফুকলাম। দুসজেকোর জন্য এতটাই দুঃখ হচ্ছিল যে, আমি কেঁদেই ফেললাম। ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : Drive Your Plow উপন্যাসটি বেশ মজার। এমনকি খুন করার অস্ত্রগুলোও অভিনব।

ওলগা তোকার্জুক : আমারও তাই মনে হয়। তবে আমার বৌদ্ধ বন্ধু-বান্ধবরা আমার উপর চটেছেন। ওরা ভেবেছেন, এই উপন্যাসে মানুষকে হত্যা করার আহ্বান রয়েছে।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কীভাবে আপনার বইগুলোর কাঠামো তৈরি করেন, সে ব্যাপারে আরও কিছু বলুন।

ওলগা তোকার্জুক : আরও জটিল রচনাকাঠামো তৈরি করার জন্য প্রয়োজন প্রচুর বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম এবং এর জন্য কঠিন পথ বেছে নিতে হয়। The Books of Jacob-এর ঐ দৃশ্যটার কথা ভাবুন যেখানে জেকব ফ্রাংক সীমান্ত পার হচ্ছে এবং সেখানে তাকে পাসপোর্ট দেখাতে হচ্ছে। কোনও দিক থেকে নাম-পুরুষের একজন বর্ণনাকারী এই দৃশ্য দেখবে ? ওরা কি শুধু পাসপোর্টই দেখবে ? ওরা কি জানে যে, ফ্রাংকের আশেপাশের লোকজন কী ভাবছে ? এই প্রশ্নগুলোর নামপুরুষ গল্পকথক বা চতুর্থ পুরুষ গল্পকথক অনবরত উদ্রেক ঘটায়, বিশেষ করে যদি অনেকগুলো প্রধান চরিত্র থেকে থাকে। অবশেষে একটা  যোগসূত্র দিয়ে এই সবগুলো কণ্ঠ ধরে ফেলা যথেষ্ট নয়। এর জন্য আমি প্যাকিং পেপার কিনেছিলাম এবং তাতে পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন গল্পপ্রবাহ এঁকে নিয়েছিলাম। পরে এর সঙ্গে আঠা দিয়ে আরও কিছু পেপার লাগিয়ে নিয়েছিলাম।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : চতুর্থ পুরুষ গল্পকথক কী ?

ওলগা তোকার্জুক : ঐ বইটা লেখার সময় শব্দটা পেয়েছিলাম। বইটা শুরু করেছিলাম একটা ঐতিহাসিক প্রবন্ধ হিসেবে। পরে বুঝলাম, এভাবে পাঠক ফ্রাংকের ইতিহাস সরাসরি ও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন না। তখন ঠিক করলাম, একটি উপন্যাসের বয়ান নির্মাণ করব একটি নামপুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সে হবে এমন এক গল্পকথক যে সবকিছু দেখে, শুনে গল্পটি বলবে এবং আখ্যানটিকে এগিয়ে নেবে। তবে  সেটি করতে গিয়ে আমাকে একটি বিষয়ী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হয়েছিল এবং গল্পের বহু পার্শ্বচিন্তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়েছিল। তাই আমি বাস্ক শহরের পণ্ডিত ব্যক্তি নাহমানকে উত্তম পুরুষ গল্পকথক হিসেবে বেছে নিলাম। নাহমান ছিলেন ফ্রাংকের সবচেয়ে অনুরক্ত শিষ্য। নাহমানকে তাঁর নিজের ভাষা, বাগবিধি, মেজাজ-মর্জি ও স্বভাবসুলভ কাজকর্মের কাছে ছেড়ে দিলাম। তাঁকে কিছুটা ফ্রাংকের প্রেমেও পড়তে দিলাম। এরপর মনে হলো, সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক―এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির মাঝখানে আমি অবস্থান করতে পারি। এটি একই সঙ্গে অধিকতর নৈর্ব্যক্তিক, আবার ব্যক্তিক। কিন্তু আমার চরিত্রগুলোর সংখ্যা তাদের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে আরও আরও বৃদ্ধি পেতে থাকল। নামপুরুষ গল্পকথক এদের সবাইকে ধারণ করার মতো যথেষ্ট নয়। আমার আরও শক্তিশালী উপষঙ্গের প্রয়োজন হলো, যেটি শুধু ফ্রাংকের গল্পটাই দেখবে না, বরং আমি কীভাবে লিখছি তার পুরো প্রক্রিয়াটাই লক্ষ করবে। শুধু ওপর থেকে নয়, বরং ভেতরে থেকে পুরো ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করবে। ভুতুড়ে মহিলা ইয়েন্তির চরিত্রের মধ্য দিয়ে ভিন্ন একটি পরিপ্রেক্ষিত হাজির করেছি। এই ইয়েন্তি উপন্যাসের পুরো কাহিনির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। কখনও জুম করে ছোট ছোট ব্যক্তিগত বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। আবার কখনও দূর থেকে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে চারপাশের পুরো দৃশ্য একবারে দেখেছি। শেষ পর্যন্ত সে সবকিছুকে কাছে আনে। কখনও কখনও তার দৃষ্টিভঙ্গিকে মনে হয়েছে, এটি সেই দৃষ্টিভঙ্গি যাতে বাইবেলের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। বুক অব জেনেসিস-এর মতে, ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর ‘দেখলেন এবং বললেন, সবকিছু ভালোই হয়েছে।’ কিন্তু কে এটি দেখতে পেয়েছিল এবং কে ঈশ্বরের  গোপন ভাবনা-চিন্তা বুঝতে পেরেছিল ? আমার মনে হয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার বর্ডার লাইন। এটি একটি অতীন্দ্রিয় ব্যাপারও বটে।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আমি আপনার বাথরুমের একটি পোস্টারে gnosis শব্দটি দেখেছি। আপনি কিভাবে অতীন্দ্রিয়বাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন ?

ওলগা তোকার্জুক : আমার প্রজন্মের অনেক পোালিশকে আমি পছন্দ করি। ইহুদিদের সংস্কৃতি আমাকে মুগ্ধ করে। তাই এটা ইহুদিদের অতীন্দ্রিয়বাদী শিক্ষাপদ্ধতি ‘কাবালাহ’ থেকে আসতে পারে। অতীন্দ্রিয়বাদী যে ধারণা আমি নিয়েছি, তা এসেছে Pardes দর্শন থেকে। বলা হয়েছে, এই দর্শনে বাস্তবতার চারটি স্তর রয়েছে। এর এক একটি স্তরে এক এক উপায়ে প্রবেশ করা যায়। এগুলো হলো peshat, remez, derash এবং sod. এগুলোর অর্থ হলো যথাক্রমে আক্ষরিক অর্থ, রূপক, দৃষ্টান্ত এবং অতীন্দ্রিয় উন্মোচন। আমার কাছে gnosis ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার। আবার একই সঙ্গে বাস্তবতা সম্বন্ধে আকর্ষণীয় একটি ধারণা। আমরা কী দেখছি এবং কী ভাবছি―তা জানা-বোঝার জন্য সবসময় সজাগ থাকতে হয়।

যখন বেড়ে উঠছিলাম তখন যে ধর্মীয় আবহের মধ্যে ছিলাম, তার বিরোধিতা করতে গিয়েও আমি অতীন্দ্রিয়বাদের প্রতি আকৃষ্ট হই। কিছু কিছু সূত্র মতে, এটি খ্রিস্টধর্মের চাইতেও প্রাচীন। তবে পরবর্তীকালে এই দুয়ের মধ্যে প্যাঁচ আবার লেগেছে। এটিকে খ্রিস্টধর্মের অন্ধকার দিক হিসেবে গণ্য করা হয়। এর বিপরীতে রয়েছে পৃথিবী। বর্তমানে আমার মনে হয়, পৃথিবী খ্রিস্টধর্ম থেকে অতীন্দ্রিয়বাদের দিকে সরে যাচ্ছে। The Matrix সিনেমা দেখে আমি কেমন আহত ও উত্তেজিত হয়েছিলাম, তা আমার মনে পড়ে। সিনেমাটি প্রশ্ন করেছে―বাস্তব কী আর ভুয়া কী ? বাস্তব পৃথিবী কি আদৌ রয়েছে ? এতে প্রবেশ করার জন্য আপনার কি কোনও চাবি দরকার ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য আপনাকে কি অতীন্দ্রিয়বাদী হতে হবে ? আমার ছেলেকে বলেছি, ‘এটাই বিশুদ্ধ অতীন্দ্রিয়বাদ।’

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনিই আপনার উপন্যাস বেছে নেন, নাকি আপনার উপন্যাসই আপনাকে বেছে নেয় ?

ওলগা তোকার্জুক : আসলে উপন্যাসগুলো শুরু হয় এমন সব ধারণা দিয়ে যেগুলো আমি চাইলেই ঝেড়ে ফেলে দিতে পারি না। গল্পের শুরুটার জন্ম দেয় এটিই। এটি আমাকে সূক্ষ্ম বিষয়বস্তু ও উপ-আখ্যানের জোগান দেয়। আমাকে পড়তে উৎসাহ দেয়। তারপর ধীরে ধীরে একটি চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। অবশ্য পুরোপুরি নয়, তবে আমি আস্তে আস্তে তাদের অবয়ব ঠাহর করি। এরা কে এবং কী চায়, তা উপলব্ধি করি। আমি এদের সঙ্গে নিজেকে মিলাই। এরপর এই চরিত্ররা কথা বলতে শুরু করে। প্রথমে বলতে পারি না, এরা আসলে কী নিয়ে কথা বলছে। তবু এদের কথা শুনতে থাকি।

আমার মনে হয়, আমরা নিজেরা অনেক গল্পের কুঁড়ি বহন করে চলেছি। আমার শৈশবে একদিন দেখলাম, মা একটি মুরগি রান্না করার জন্য প্রস্তুত করছেন। আমার জায়গায় নিজেকে রেখে ভাবুন, বিষয়টা কেমন বিরক্তিকর। কিন্তু কেউ তো আর আপনার হয়ে মুরগিটা রান্নার আগে সাফ করবে না। আপনি জবাই করা মাথা ছাড়া একটা মুরগি কিনেছেন দোকান থেকে। মা যখন মুরগির পেটটা চিরে ফেললেন, দেখলাম, ওটা একটা বাচ্চা মুরগি। এরপর দেখলাম, এর পেটের ভেতর ডিমের কুঁড়ি গজাচ্ছে। আমরা তো শুধু ডিমটাই দেখি। কিন্তু এর পূর্ণতা পেতে অনেকগুলো মধ্যবর্তী পর্যায়ের মধ্য দিয়ে একে যেতে হয়। প্রথমে ছোট থাকে। তারপর এর মধ্যে কুসুম তৈরি হয়। একটা পাতলা স্বচ্ছ পর্দার দ্বারা বেষ্টিত হয়। ভাবুন, একটা ছোট্ট কুঁড়ি কীভাবে এর ভেতরে বেড়ে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে এর চারপাশের খোলসটা শক্ত ও অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে। এই ডিমগুলো একের পর এক সাজানো থাকে। এগুলো আসলে এদের উৎসই নির্দেশ করে। আমি গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হই যখন চিন্তা করি―এই ডিম তো রেডিমেড কিছু নয়। এটি একটি সৃষ্টি-প্রক্রিয়া। এভাবে কি আমরা আমাদের ব্যক্তিত্বেরও নির্মাণ করি না ? এছাড়া আমরা যা সৃষ্টি করি, তার বাইরেও কি আমাদের ভেতরে ক্রমবর্ধমান কিছু বহন করছি না ? আমরা যখন লিখি তখন কি এই ভ্রƒণগুলোই প্রসব করি না ?

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি নিজেকে ধার্মিক হিসেবে উপস্থাপন করতে চান ?

ওলগা তোকার্জুক : আমি বলব, করি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। যেগুলো অবশ্য সিস্টেমেটিক নয়, সেসব ক্ষেত্রে আমি ধার্মিক। ধর্মীয় ব্যবস্থা নিয়ে আমি প্রচুর ভাবি। ক্যাথলিক পরিবারে বেড়ে ওঠার জন্য আমি প্রায়ই ভাবি, দেবতার বেদিতে যে পশুগুলো বিসর্জন দেওয়া হতো সেগুলোর ব্যাপারে খ্রিস্টধর্ম কি অপরাধবোধে  ভোগে ? যিশু তো অন্যের পরিবর্তে নিজের জীবনটাই বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁর অনুসারীদের নিজের রক্ত-মাংস খাইয়েছেন। আনুষ্ঠানিকতার কথা বিবেচনা করলে দেখা যায়, কোরবানিকৃত পশুর রক্ত ও নাড়িভুঁড়ি গির্জার মেঝে মাখিয়ে ফেলত। একদিক থেকে কিন্তু মানবসভ্যতা এই রক্তাক্ত আনুষ্ঠানিকতাগুলো এখনও ত্যাগ করেনি। আমরা এখনও অন্ন-বস্ত্রের জন্য প্রাণি হত্যা করি। বিনোদনের জন্যও। সম্ভবত স্বর্গে ওটাই ছিল আমাদের প্রকৃত পাপ। নিষিদ্ধ আপেল খাওয়া নয়, বরং প্রাণি হত্যা করা। খুব সম্ভবত এ কারণেও মানুষ নিজেকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে। আমরা আমাদের পাপের বোঝা উপলব্ধি করতে পারি।

সম্প্রতি আমি জাঁ ভ্যান ইক এর গেন্ট এর বিখ্যাত বেদিমূল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। ওখানে একটা চিত্রকর্ম এ রকম ছিল যে, একটা পাটাতনে একটা মেষশাবককে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। গোটা দুনিয়া থেকে লোকজন এসেছে এটিকে শ্রদ্ধা জানাতে। এই চিত্রকর্মের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এই সব রাজা-মহারাজা, সন্তু মেষশাবকের অবয়বের অন্তরালে যিশুকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেনি, বরং প্রকৃতপক্ষে একটি পশুর সামনে বা প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা এভাবে নিজেরা প্রকৃতিকে প্রতারিত করছি।

ধরুন, যখনই আমি কোনও ইঁদুর বা শেয়াল দেখি এবং এর চোখের দিকে তাকাই, তখনই এর চোখ দুটোর পেছনে পুরো বিশ্বটাকে দেখি, অনুভব করি। এই প্রাণীটিকে খাটো করে দেখার মানে হলো এই জগতের অস্তিত্ব অস্বীকার করা। এর চোখ দু’টোর ভেতরে একটা জগত আছে যার সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না। গতকাল সকালে আপনি আসার আগে আমাদের উপত্যকায় হরিণের পাল বেরিয়েছিল। ওরা চেক প্রজাতন্ত্রের দিকে যাচ্ছিল। একটা হরিণের পেছনে পেছনে ত্রিশটা হরিণী যাচ্ছিল। এই সপ্তাহের প্রথম দিকে আমার এক প্রতিবেশীর কুকুর একটা হরিণীকে মেরে ফেলেছে আমার বাড়ির দরজার ঠিক ওপারে। আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে, এই গল্পগুলোই তো আমি লিখতে চাই। এর অন্তিম যাত্রার গল্প।

এবার আমাকে উঠতে হবে। কয়েক ঘণ্টা একটানা বসে থাকলে আমার মেরুদণ্ডে ব্যথা করে। এটা অবশ্য আমার পেশার জন্যই হয়েছে। আরেকটা ড্রিংকস চলবে কি ?

মার্তা ফিগলেরোভিচ : হ্যাঁ, প্লিজ। The Books of Jacob পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে রাজনৈতিক উষ্মা উস্কে দিয়েছিল। বর্তমান সরকারের প্রতিও। আপনি কি আগেভাগে জানতেন যে, এটা এতটা বিতর্কিত হবে ?

ওলগা তোকার্জুক : উপন্যাসটা আদতে রাজনৈতিক। বিদেশিদের চোখে এটিকে রাজনৈতিক উপন্যাস বলে মনে হবে না। কিন্তু পোলিশ প্রেক্ষাপটে এটি সুস্পষ্টভাবেই তর্ক উস্কে দেওয়ার মতো কথা বলে। পূর্ব-ইউরোপের ইহুদি সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমি এটি লিখেছিলাম। লিখেছিলাম তাদের পক্ষ থেকে মতদ্বৈধের প্রকাশ হিসেবে যারা গণহত্যা ও এর পরবর্তী ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে পোল্যান্ডে ইহুদিদের বসতি সংকীর্ণ করে এনেছিল। জেকোব ফ্র্যাঙ্কের গল্প জানতে পেরে তার সূত্রের খোঁজে লাইব্রেরি ও আর্কাইভে ঢুঁ মেরেছি। আমার উপন্যাস পড়ে কাউন্টেস কোসাকোয়া আমাকে চিঠি লিখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। পোল্যান্ডের শহর রোহাতিন এর বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, এখনে কি এমন কেউ আছেন যিনি পোলিশ ভাষায় কথা বলেন ? দেখা গেল, কেউ বলেন না যে, ডানপন্থি জাতীয়তাবাদীরা আমাদের ইতিহাসের এই দিকটা মুছে ফেলে দিতে চেয়েছিল; এর বহুভাষিক ও বহুসাংস্কৃতিক চরিত্র ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : কিন্তু আপনি কি পোলিশ ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বোধ করেন না ? আপনার কি মনে হয়, অনুবাদের ফলে আপনার বইগুলো কিছু হারিয়েছে ?

ওলগা তোকার্জুক : এ কথা সত্য যে, অন্যদের চাইতে আমার শৈলী অন্য ভাষায় অনুবাদ করা অধিকতর সহজ। ফরাসি ভাষা কঠিন। এর সুশৃংখল বুদ্ধিবৃত্তি এবং উদ্ভট শব্দবন্ধের মধ্যে টানাপড়েন আছে। পোলিশ ভাষা এটি এড়াতে পারে। এ কথাও সত্য যে, পোল্যান্ডের অনেক লোক পোলিশ ভাষাকে লালন করেন তাদের জাতীয়তাবাদী চরিত্রের চিহ্নায়ক হিসেবে। এটা ইউরোপের রোমান্টিসিজমের দীর্ঘ উত্তরাধিকার। জাতির ধারণা-উদ্দীপক চিহ্নও বটে। পোলিশরা এটি তীব্রভাবে অনুভব করে, কারণ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত আমরা স্বাধীন দেশ ছিলাম না। পোলিশ আধুনিকতাবাদীরা সতর্কতার সঙ্গে আমাদের ভাষাকে আধুনিকায়িত করেছেন। এ কাজ এরা এমনভাবে করেছেন যেন এর সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধতা রক্ষাই ছিল শেষ কথা। আমি এগুলোকে পাত্তা দিই না। আমি বরং ভাষাকে এর বাইরে যে জিনিসগুলো আছে, সেগুলো বের করে আনার হাতিয়ার হিসেবে দেখি। আমার বেশ আহ্লাদ হয় যখন আমার পাঠক আমাকে বলেন, ‘ওলগা, যখন আপনার গদ্য পড়ি তখন সঙ্গে সঙ্গে আপনি যা বর্ণনা করেন তা দেখতে পাই।’ মানুষের চেতনাকে রূপদানে কল্পচিত্রের গুরুত্বের বিষয়টি আমি ইয়ুং-এর কাছ থেকে শিখেছি। সেই থেকে আমি নিজে এ কাজ করার চেষ্টা করি। যখন Primeval and Other Times প্রকাশ হলো তখন কিছু সমালোচক বললেন, এর ভাষা বেশ সরল, প্রায় বাইবেলের ভাষার মতো। সম্পাদনা করার সময় খুব যত্নের সঙ্গে আমি সব জটিল বাক্য, পরোক্ষ বাক্য, নামবাচক শব্দ, ক্রিয়া বিশেষণ বাদ দিয়ে দিই। এগুলো আমি অপছন্দ করি। গল্পের একটা স্বচ্ছ বুনন নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম যেটা প্রাইমেভাল শহরের রক্ষাকারী দেবদূতদের দেখতে বাধাগ্রস্ত করবে না।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনার কি মনে হয়, পোল্যান্ডের চাইতে বহির্বিশ্বেই আপনার বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা বেশি ?

ওলগা তোকার্জুক : একেবারে ঠিক বলেছেন। এখানে কখনওই আমার সমালোচক-ভাগ্য ভালো নয়। E. E.-তে কেউ ইয়ুং-এর এল্যুশন বুঝতেই পারেনি। এক সমালোচক তো একে ‘রজঃস্রাব সংক্রান্ত উপন্যাস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ এর প্রধান চরিত্র বয়ঃসন্ধি পার করছে। এর কিছু পরে পোল্যান্ডের পুরুষতান্ত্রিক সমালোচনা- কৌশল নতুন প্রজন্মের সব নারী-লেখকদের গায়ে এই তকমা সেঁটে দিয়েছে। Primeval and Other Times উপন্যাসে আমি মিথলজি, নৃতত্ত্ব ও ইতিহাস একসঙ্গে গেঁথে দিয়েছি। একটা পত্রিকায় তো এটিকে মুখ থেকে লালা ঝরা হাবাগোবার গল্প বা একেবারে সাদামাটাভাবে বলতে গেলে এটিকে জীর্ণ গল্প বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঐ যে পুরাতন একটা কথা আছে না―নিজের দেশে কেউ কখনও দৈবজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি পায় না, ব্যাপারটি ঠিক সেরকম।

মার্তা ফিগলেরোভিচ : আপনি কি দৈবজ্ঞ বা স্বপ্নদ্রষ্টাদের প্রতি আগ্রহ বোধ করেন ?

ওলগা তোকার্জুক : নব্বইয়ের দশকে আমি যখন ব্লেইককে আবিষ্কার করলাম, তখন মনে হলো, আমি শুধু একজন দৈবজ্ঞকেই আবিষ্কার করলাম না, বরং একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পীকে আবিষ্কার করলাম। তিনি লিখেছেন, এঁকেছেন, তাঁর ভাবনায় দার্শনিক-রঙ দিয়েছেন। ফ্ল্যামেরিয়ন কাঠের খোদাইকৃত শিল্পের মতো যেন স্বর্গ থেকে মস্তক বের করে দিয়েছেন তিনি।

আরেকজন লেখক যিনি আমার Primeval and Other Times এবং অন্যান্য বইয়ের পেছনে উৎসাহ জুগিয়েছেন, তিনি হলেন অষ্টাদশ শতকের পোলিশ যাজক বেনেডিক্ট মিলোস্কি। তিনি Nowe Ateny (New Athens) গ্রন্থের রচয়িতা। এটি পোলিশ ভাষার প্রথম দিকের বিশ্বকোষ। তিনি ছিলেন ইউরোপের উপকণ্ঠের বাসিন্দা, যেখানে আলোকায়নের হাওয়া লাগেনি বললেই চলে। যে অভিনবত্বই তিনি দেখেছেন তাকেই তিনি নিয়েছেন এবং অনেক চেষ্টা করে শ্রেণিবিন্যস্ত করেছেন। তিনি ছিলেন চেচ দার্শনিক কোমেনিয়াসের অনুসারী। তাঁর কাছ থেকেই বিশ্বকোষীয় ধারণা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সর্বজনীন জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে মানবতা মুক্তি লাভ করবে। Nowe Ateneতে বাস্তবতা কল্পনার সঙ্গে লেপ্টে যায়। এতে ড্রাগন, জাদুবিদ্যা এবং প্রচুর পরিমাণে উপকরণ রয়েছে যেগুলো ল্যাটিন ভাষা থেকে ধার করা হয়েছে। যখন আপনি একে দিদেরতের বিশ্বকোষের সঙ্গে তুলনা করবেন, যেটি সেই সময়ে বের হয়েছিল, তখন দেখবেন, একটা বিশাল সভ্যতা সম্বন্ধীয় ফারাক এদেরকে আলাদা করে ফেলে। আমার মনে হয় না, মিলোস্কি কখনও শুনেছিলেন যে, এগুলো বর্ণের ক্রমানুযায়ী সাজাতে হয়। আজকের দিনে পোলিশ সাহিত্যের ইতিহাসবিদগণ পেছন ফিরে তাকিয়ে তাঁকে বোকা মনে করেন। ভাবেন তিনি এমন এক গর্দভ যে বায়ুকলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। অথচ তাঁর জ্ঞানপিপাসা এবং আধা-সত্য বিশ্ববীক্ষা আমাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়।

Empuzjon-এর জন্য একইভাবে আমি এমেরেন্তিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তিনি একজন নারী এবং তাঁকেও আমার কাছে দৈবজ্ঞ মনে হয়। টমাস মান-এর উপন্যাসে অল্প সময়ের জন্য তাঁকে দেখা যায়। বয়স্ক পরিচারিকা, যাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় মিনহির পিপারকর্ন নামক এক প্রলাপ বকতে থাকা মাতাল। আমি The Magic Mountain কমপক্ষে ছয়বার পড়েছি। প্রতিবারই একেবারে নতুন মনে হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থবার একে পুরোপুরিভাবেই মজার মনে হয়েছে। আমার আগের তরুণ সত্তার ব্যাপারে আমি হতাশ হয়ে পড়ি যে আগে এটিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। নাফতা ও সেতেম্ব্রিনির স্ব-স্ব ধারণার ডায়াগ্রাম তৈরি করেছিল। পরবর্তী পুনর্পাঠের সময় এমেরেন্তিয়া আমার দৃষ্টিগোচর হয়। ভাবলাম, এই চরিত্র আবার কোত্থেকে এল ? একে নিয়ে গবেষণা করলাম। শেষ পর্যন্ত দেখলাম, এমেরেন্তিয়া অবিশ্বাস্যরূপে একটি অসাধারণ নাম। বাইবেলের অপ্রাসঙ্গিক অংশে তাকে যিশুর দাদির দাদি হিসেবে পাওয়া যায়। জার্মানির বাভারিয়াতে সন্তু এমেরেন্তিয়ার কিংবদন্তি চালু আছে। ধর্মীয় প্রতিমূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে পারেন যেখানে তাকে এভাবে অঙ্কন করা হয়েছে যে, তিনি রক্ষা করার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে পোশাক মেলে ধরে সন্তু অ্যান, কুমারি ম্যারি এবং যিশুকে আগলে রেখেছেন। দেখতে কুৎসিৎ, বয়স্ক ও জ্ঞানী একজন মহিলা যিনি প্রথা বহির্ভূত নারীকেন্দ্রিক পবিত্র একটি পরিবারকে আগলে রেখেছেন। আমি নিশ্চিত, তিনি একজন নিপীড়িত পৌত্তলিক দেবী। হারিয়ে যাওয়া মাতৃতান্ত্রিক বিশে^র অবশিষ্টাংশ। আধুনিক বিশে^র শিকড় থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। মান-এর মতো একজন নারীবিদ্বেষী ও সমকামী ব্যক্তি কি ভেবেচিন্তে তাঁকে তাঁর বয়ানে হাজির করেছেন ? সম্ভবত বাভারের কোনও প্রতিমূর্তির মধ্যে তিনি কি এমেরেন্তিয়াকে পেয়েছিলেন ? নাকি তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে পিতৃতান্ত্রিকতার সম্মিলিত অচেতনকে তাঁর মধ্য দিয়ে উচ্চারিত হতে দিয়েছেন ?

মার্তা ফিগলেরোভিচ : লোকজন কি মাঝে মাঝে আপনার মধ্য দিয়ে আপনার উপন্যাসে কথা বলে ?

ওলগা তোকার্জুক : আপনাকে তাহলে একটা গল্প বলি। এই বাড়িতে ওঠার কিছুদিন পর আমরা জানতে পারলাম, এক জার্মান দম্পতি এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। তারা হলেন মি. এবং মিসেস ফ্রাঞ্জ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই বাড়ি ছেড়ে তাঁরা পালিয়ে গেছেন। একটু ঘুরুন, দেখুন, চুল্লির ওপরের দেয়ালে একটা ছবি আঁটা আছে। এই ছবিটি কীভাবে আমার হলো ? যখন আমি House of Day, House of Night লিখছিলাম, যা আসলে এই বাড়ির প্রতি আমার শ্রদ্ধাজ্ঞাপক, এমনকি এই জায়গার প্রতিও, তখন মার্তা নামক একজন বৃদ্ধ মহিলার চরিত্র তৈরি করলাম, যিনি একটা অ্যামব্রয়ডারি করা কার্ডিগান পরে আশেপাশে ঘুরে বেড়ান। তিনি আমার উপন্যাসের প্রধান গল্পকথক। এই উপত্যকার প্রাণ। তিনি  আখ্যানের সুতো ধরে টানেন। কয়েক বছর পর জার্মানিতে একটি বইয়ের অনুষ্ঠানে ফ্রাঞ্জের নাতি-পুতিরা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। আমরা বন্ধু হয়ে যাই। ওরা ওদের পরিবারের সদস্যদের ছবি সঙ্গে করে নিয়ে আসে। যখন একটা ছবি দেখলাম, অর্থাৎ তাদের দাদির ছবি যিনি একজন বয়স্ক মহিলা, সোয়েটার পরা, ঠিক তার মতো যার কথা আমি উপন্যাসে বর্ণনা করেছি, তখন আমার পুরো শরীর হিম হয়ে এল। ওদের জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে ? ওরা উত্তর দিল, ‘মার্তা’। সেই থেকে আমার মনে হয়, ওরা এখনও এখানে রয়েছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button