আর্কাইভক্রোড়পত্র

অনন্য আকরগ্রন্থ শেখ মুজিব তারিখ অভিধান : শাকিল আহমদ

ক্রোড়পত্র : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনটি বই

স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জাতির পিতা। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের এই মহানায়কের জীবন ও কর্মের ব্যাখ্যা শুধু নয়, জীবনের উল্লেখযোগ্য দিনক্ষণের সুনির্দিষ্ট তারিখ অভিধান প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ছিল গবেষক-ইতিহাসবিদদের জন্য অপরিহার্য একটি কাজ। কিন্তু সুনির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে তথ্যসূত্র সঠিকভাবে সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ জীবনপঞ্জি দাঁড় করানোটা ছিল সময়সাপেক্ষ, শ্রমনিষ্ঠ ও দুরূহ একটি কাজ। এই সময়সাপেক্ষ, গুরুত্ববহ কাজটিকে সাহসিকতার সঙ্গে পরম নিষ্ঠায় সম্পন্ন করেছেন গবেষক ড. মাহবুবুল হক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৪৮ বছর পর এসে শেখ মুজিব তারিখ অভিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই ও প্রামাণ্য তারিখ সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে নিরন্তর। তবে তিন বছরের অক্লান্ত শ্রম ও মেধার সমীকরণে বাঙালি জাতির এই মহান রাষ্ট্রনায়কের জীবন-কর্ম ও চিন্তা-চেতনার কালানুক্রমিক এবং ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত প্রণয়নের সফল প্রয়াস ড. মাহবুবুল হক রচিত শেখ মুুুজিব তারিখ অভিধান।

দুই

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে ব্যক্তিগতভাবে ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রচিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। অনেক গ্রন্থই পরিকল্পিতভাবে রচিত নয়। তবে প্রতিটি গ্রন্থেই রয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি লেখকের গভীর আবেগ আর প্রগাঢ় ভালোবাসা। এসব প্রকাশনার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমির প্রকাশনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবর্ষ গ্রন্থমালা প্রকাশের যে পরিকল্পিত কর্মসূচি একাডেমি প্রণয়ন করেছে তাতে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের বহুমাত্রিক পরিচয়ের পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির নানা দিকও উঠে এসেছে। অনেক গ্রন্থে বিষয়-বৈচিত্র্য, অনালোকিত অধ্যায় এবং জানা-অজানা তথ্য উঠে আসায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও চিন্তার অনেক নতুন পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা একাডেমির এ-ধারার একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ চট্টগ্রামে শেখ মুজিব। এটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন ড. মাহবুবুল হক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এটি হতে পারে একটি আকরগ্রন্থ।

তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে ড. মাহবুবুল হক রচিত বঙ্গবন্ধুভিত্তিক অনন্যসাধারণ গ্রন্থটি হচ্ছে শেখ মুজিব তারিখ অভিধান।

গবেষক ড. মাহবুবুল হকের অবশ্য এ-ধারার গবেষণা কাজের ওপর (তারিখ অভিধান) রয়েছে পূর্বতন সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা। তাঁর এই তারিখ অভিধান রচনার বিষয়টিতে রয়েছে এক ঐতিহাসিক যোগসূত্রও। কারণ এই জাতিরাষ্ট্রের দুই দ্রোহী জাতিভাস্করের একজন হচ্ছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর অন্যজন হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ড. মাহবুবুল হক ২০১০ সালে সফলতার সঙ্গে রচনা করেন নজরুল তারিখ অভিধান। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে রচিত এ বই রচনা একটি দুরূহ কাজ বলে বিবেচিত হয়েছে। এই শ্রমনিষ্ঠ একাগ্র গবেষণার জন্য জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ^বিদ্যালয় তাঁকে নজরুল পদকেও ভূষিত করে।

নজরুল ও শেখ মুজিবের জন্মের ব্যবধান প্রায় একুশ বছর। তাঁদের বয়সে ব্যবধান থাকলেও উপলব্ধি, মুক্তিচিন্তা ও অভিব্যক্তি প্রকাশে দুজনের মানসিকতা ছিল প্রায় সমগোত্রীয়। দুজনেই কবি―একজন কবিতার অন্যজন রাজনীতির। নজরুলের ‘বাংলার জয়’ আর বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’ অভিন্ন ভাবনা থেকে উৎসারিত। নজরুল বিবর্তিত বাঙালির পরিস্রুত প্রতিকৃতি। বঙ্গবন্ধু বাঙালির পরিপূর্ণ অবয়ব। উভয়েই ছিলেন জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী, গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী।

১৯৪২ সাল থেকে বিদ্রোহী কবি নজরুল চেতনারহিত। তারও প্রায় ত্রিশ বছর পরে ১৯৭২ সালের ২৪ মে তিনি তাঁর কাক্সিক্ষত স্বাধীন বাংলায় পদার্পণ করেছিলেন। আজ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। স্বাধীন বাংলায় তাঁর এই আগমনে মূল ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অর্থাৎ বাংলাদেশের জাতীয় কবিকে স্বাধীন বাংলায় নিয়ে আসার উদ্যোগ যে মূলত জাতির জনকের―এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য। সুতরাং বাঙালি জাতিসত্তার প্রাণভোমরা নজরুল ও শেখ মুজিবের মতো স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীন বাংলার বাস্তব স্রষ্টার নামাঙ্কিত তারিখ অভিধানটি জাতির সঠিক ইতিহাসের জন্য অপরিহার্য। আর এই অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ নির্ভরযোগ্যভাবে প্রণীত হলো ইতিহাস-সচেতন ড. মাহবুবুল হকের মতো গবেষকের হাতে। উল্লেখ্য তিনি ২০০০ সালে বিশ^ তারিখ অভিধানও প্রণয়ন করেন। এতে বিশে^র উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি ও উল্লেখযোগ্য সাহিত্যসাধক, বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনায়কদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সন-তারিখসহ ঘটনার বিবরণ রয়েছে। গ্রন্থটি পাঠকমহলে বেশ আদৃত হয়েছে।

তিন

বাঙালি জাতির মহান রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন, কর্ম ও চিন্তাধারার কালানুক্রমিক রচনা এমনকী তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্তের ঘটনাসহ ইতিবৃত্ত প্রণয়নের ফসল শেখ মুজিব তারিখ অভিধান। বঙ্গবন্ধুর জানা-অজানা অসংখ্য ঘটনাসম্ভারে ঠাসা এই গ্রন্থ। অভিধানটির সূচনা তারিখ ১৭ মার্চ ১৯২০ সাল। অর্থাৎ শেখ মুজিবের জন্মমুহূর্ত থেকেই। ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে ১৯২৪, ১৯২৭, ১৯২৯, ১৯৩০ বর্ষ হয়ে.. ১৯৭৫ Ñ ১৪ আগস্ট, ১৫ আগস্ট এবং ১৬ আগস্ট ১৯৭৫-এ এসে তারিখ-অভিধানের সমাপ্তি ঘটে।

শেখ মুজিব তারিখ অভিধান-এর শুরুর থেকেই কিয়দংশ তুলে ধরা যাক :

“১৭ই মার্চ ১৯২০ : ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ২০ চৈত্র বুধবার রাত ৮ টায় শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তখনকার গোপালগঞ্জ মহকুমা বর্তমানে জেলার মর্যাদা পেয়েছে। তাঁর বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তাঁদের ৪ কন্যা এবং ২ পুত্রসন্তানের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। মা-বাবা তাঁকে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন। শৈশব-কৈশোরের সাথীরা সম্বোধন করত তাঁকে ‘মুজিব’বলে। বড় হলে সহকর্মী বন্ধুরা এবং বয়ঃকনিষ্ঠরা তাঁকে ডাকতেন ‘মুুজিব ভাই’।

(শেখ মুজিব তারিখ অভিধান) পৃষ্ঠা ১১।

গ্রন্থটির সমাপ্তি হয়েছে এভাবে :

১৬ আগস্ট, ১৯৭৫: ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসের আলী (পরে এয়ার কমোডার) তেজগাঁও এয়ারপোর্ট থেকে বেলা আড়াইটা নাগাদ হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ নিয়ে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। হামলার আশঙ্কায় হেলিকপ্টার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। হেলিকপ্টার টুঙ্গিপাড়ার আকাশে পৌঁছলে আশপাশের লোকজন ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওখানে আগেই পুলিশ পাঠাবার জন্য সংবাদ দেওয়া হয়েছিল। মেজর মহিউদ্দিন পুলিশের সহায়তায় কোনওক্রমে ১৫-২০ জন লোককে জানাজার জন্য জড়ো করেন। একজন স্থানীয় মৌলভীকে ডেকে এনে জাতির জনকের লাশ গোসল করানো হয়। গোসল শেষে পিতার কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

(শেখ মুজিব তারিখ অভিধান, পৃষ্ঠা ৪০৮)।

অভিধানে ১৯৪৭ পরবর্তী সময় থেকে ইতিহাসের চুম্বক অংশগুলো অল্প কথায় সন্নিবেশিত হয়েছে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ববাংলা যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে তার একটি ধারাবাহিক স্বচ্ছ ধারণা শেখ মুজিব তারিখ অভিধানে বিধৃত হয়েছে। অভিধানে বিধৃত হয়েছে পুরো ষাটের দশকের একের পর এক ঘটনাবলি। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের ছয় দফা দলীয় ইশতিহারে পরিণত করে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আরও ঘনীভূত হতে থাকে। ইতিহাসের আলোয় পুরো ষাটের দশকের ঘটনাবলি অত্যন্ত সচেতনভাবে তারিখ অভিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা একজন অনুসন্ধানী পাঠকের জন কৌতূহলজনক।

বঙ্গবন্ধু যতই রাজনীতি-ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, ততই তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনের উল্লেখযোগ্য দৈনন্দিন তথ্য বাড়তে থাকে। সেটি আমরা লক্ষ করি ১৯৪৮ সাল থেকে। ১৯৪৯ সালে তারিখ অভিধানে যুক্ত হতে থাকে তিনশত পয়ষট্টি দিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনেকগুলি দিন। বস্তুত তাঁর রাজনৈতিক, সামাজিক এসব কর্মব্যস্ত দিনের তথ্যবহুল ঘটনাবলির কোনটি কোন তারিখে হয়েছিল তা সঠিকভাবে, নির্ভুলভাবে তুলে আনাটাই ছিল একটি দুরূহ কাজ। যেমন ১৯৪৯ সালের পুরো এক বছরে তারিখ অভিধানে যুক্ত হয়েছে মোট ৭১টি তারিখে ৭১টি ঘটনার ভুক্তি। ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সর্বোচ্চ তারিখ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বছরটিতে প্রায় ৩০০টির অধিক ঘটনার বর্ণনা আছে। তবে এখানে একদিনে একের অধিক পরিস্থিতির বর্ণনাও আছে। অভিধান-প্রণেতা ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে দিনের সময় উল্লেখ করে আলাদা আলাদাভাবে বিবরণ তুলে ধরেছেন। এই তারিখ অভিধানে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন সময়ের, যা একাত্তরের দিনগুলির এক তথ্যসমৃদ্ধ অনন্য দলিলও বটে।

বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং বাঙালির একাত্তরের স্বাধীনতাবিষয়ক যে-কোনও তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য কেউ যদি বছর, মাস, দিন কিংবা দিনের সময়কে ধারণ করে শেখ মুজিব তারিখ অভিধানে প্রবেশ করেন তাহলে অনায়াসে অজানা তথ্যটি তার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর মধ্য-আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ থেকে দেশ গড়ার নানা কর্মসূচি ও স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে নিরলস প্রচেষ্টার যাবতীয় তথ্য সন্নিবেশিত আছে এই তারিখ-অভিধানে। বস্তুত শেখ মুজিব তারিখ অভিধানে আপসহীন ও অকুতোভয় বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামশীল জীবনের বাঁকবদল ও পথরেখা প্রতিটি পাতায় পাতায় সন্নিবেশিত হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবন, কর্মপ্রয়াস ও  কর্মপরিকল্পনাকে জানতে হলে এই গ্রন্থ হতে পারে আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক।

চার

শেখ মুজিব তারিখ অভিধান-এর মতো ভিন্নধারার গ্রন্থটির রচয়িতা ড. মাহবুবুল হক (১৯৪৮) মূলত শিল্প, সাহিত্য, গবেষণা, সম্পাদনা, অধ্যাপনা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির জগতের এক পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ মানুষ। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মেলনে সেমিনার ও আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক ফোকলোর উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেছেন (২০০৭)। তাঁর গবেষণার সীমানাও সুদূর প্রসারিত। প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর গবেষণায় রয়েছে তাঁর বিশেষ অবদান। ফোকলোর বিষয়ে দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে উপস্থাপন করেছেন গবেষণা প্রবন্ধ। এ ধারায় তাঁর অনন্য গ্রন্থ লোকসংস্কৃতি চর্চা। পি.এইচ.ডি থিসিসের গ্রন্থরূপ তিনজন আধুনিক কবিসহ (সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য)  রয়েছে আরও উল্লেখযোগ্য সম্পাদনা, অভিধান, অনুবাদগ্রন্থ, শিশু-কিশোর গ্রন্থসহ প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ। তাঁর গ্রন্থ প্রকাশের স্থানিক সীমানায় রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত ও অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন। জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বাংলা পাঠ্যবই প্রণয়নে গুণগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। মাহবুবুল হক বিশেষজ্ঞ হিসেবে বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় গণমাধ্যম ইনিস্টিটিউটসহ নানা বিদ্বৎ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি এবং ১৯৭২-এ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে চট্টগ্রামে অসহযোগ আন্দোলনসহ জুন মাসে আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং আগরতলায় দুটি ক্যাম্পের পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নিবেদিতপ্রাণ অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণের পর উপাচার্য হিসেবেও গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন কুমিল্লায় সি.সি.এন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে।

লেখালেখির সামগ্রিক অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ফিলিপস পুরস্কার, চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা পদক ও পুরস্কার। জন্মস্থান ফরিদপুরে হলেও বাবার কর্মসূত্রে সেই ছোটবেলা থেকেই শহর-চট্টগ্রামে। জীবনের প্রান্তবেলায়ও তাঁর প্রিয় শহর চট্টগ্রামে বসেই নিভৃতে গবেষণাকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

পাঁচ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর রচিত গ্রন্থের মধ্যে তথ্যগত দিক দিয়ে এত সমৃদ্ধ গ্রন্থ কমই রচিত হয়েছে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সময় নিয়ে শেখ মুজিব তারিখ অভিধান রচিত হওয়ার পরও কিছুটা অপূর্ণতা থেকেই যায়। গ্রন্থের শেষাংশে স্বল্প পরিসরে হলেও একটি তথ্যসূত্রের তালিকা থাকলে ভালো হতো। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনকালের মধ্যে শুরুর দিকের কয়েকটি বছরের কোনও ঘটনাবলি যুক্ত করা যায়নি। সম্ভবত শেখ মুজিবের শিশুকালের ছয় বছরের জীবন সম্পর্কে কোনও তথ্যের সন্ধান মেলেনি। এ বিষয়ে লেখকের কোনও মতামতও ভূমিকাতে উঠে আসেনি।

এই সামান্য সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ কথা অবিসংবাদিত যে, বঙ্গবন্ধুর যে-কোনও গবেষণার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ড. মাহবুবুল হক প্রণীত শেখ মুজিব তারিখ অভিধান গ্রন্থটি একটি অনন্য আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে।

বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবনটাই ছিল যেন একটি মহাকাব্যিক রচনা। বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ভোররাত পর্যন্ত। তবে বাঙালি ও বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে এই মহাকাব্যের পরিসমাপ্তি ও আবেদন কখনও বিলীন হবার নয়। কারণ বাঙালির আত্মপরিচয়ের অমর মহাকাব্যের রচয়িতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিববুর রহমান নিজে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button