আর্কাইভকথাসাহিত্য

অনুসরণকারী : মূল : হুলিয়ো কোর্তাসার : স্প্যানিশ থেকে বাংলা অনুবাদ : জয়া চৌধুরী

বিশ্বসাহিত্য : নভেলা

[উপন্যাসটি কোর্তাসার ১৯৫৮ সালে রচনা করেন। আগ্রহী পাঠকেরা জানেন তিনি সংগীতে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। বিপপ সংগীতের স্রষ্টা ইউএসএর স্যাক্সোফোন বাদক চার্লি পার্কারের চরিত্র মাথায় রেখে এই উপন্যাসের নায়ক জিমি কার্টারকে সৃষ্টি করেন। ধ্রুপদী জ্যাজ সংগীতে আধুনিকতার হাওয়া নিয়ে আসে এই বিপপ জ্যাজ। এই বইয়ে জ্যাজসম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য এবং বাস্তবের খ্যাতনামা শিল্পীদের নিয়ে এসেছেন তিনি। সুররিয়াল রীতিতে লেখা নভেলাটি অনেক বিদগ্ধ সমালোচক কোর্তাসারের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ১৯৬৩ সালে লেখা Rayuela বা Hopscotch অর্থাৎ এক্কাদোক্কার সমতুল্য বা আরও ভালো লেখা বলেন।]

এ কাজ তো প্রায়ই করি―উৎফুল্ল হয়ে বললাম।

তোকে এত শান্ত দেখাচ্ছে। আমি পারি না, ব্রুনো। এক দিন রাতে আমি সব ছুড়ে ফেলেছিলাম, সবকিছু। টেবিলের ঐ প্রান্তে একজন জাপানি ভদ্রলোক বসেছিলেন, ছুরিটা প্রায় তাঁর চোখে গিয়ে লাগছিল আর কী। ওটা লস এঞ্জেলসের ঘটনা। এত বিশ্রী ঘটনা ছিল… ওদের যখন সব ব্যাখ্যা করে বললাম তখন ওরা আমায় জেলে পুরে দিল। সবকিছু এত সহজ করে ব্যাখ্যা করে দিলাম তবু করল। সেবার আলাপ হয়েছিল ডক্টর ক্রিস্টির সঙ্গে। দারুণ একজন মানুষ। আর ডাক্তারবাবুদের মধ্যে…

বাতাসে একটা হাত ছুড়ল জনি। চারদিকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে লাগল। যেন তার চিহ্ন ছেড়ে যাচ্ছে সব জায়গায়। হাসি পেল। মনে হচ্ছিল ও একলা, একেবারে একলা। পাশে বসে নিজেকে স্রেফ একটা গর্ত মনে হচ্ছিল। জনির যদি মাথায় চাপে তাহলে আমার দিকেও হাত চালাবে। আমাকে মাখনের মতো কেটে ফেলতে পারে ও। ধোঁয়ার মতো কাটতে পারে। হয়তো সে কারণেই মাঝে মাঝে আমার মুখে ব্রাশ বুলানোর মতো করে হাত বুলায়, সাবধানে।

তোর রুটি টেবিলক্লথের ওপরে আছে―জনি শূন্যে আঙুল তুলে বলে―বেশ কড়া বস্তু ওটা। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সুন্দর রঙ, অপূর্ব সুগন্ধ। ওটা এমন একটা কিছু যা আমি নই। একটা আলাদা ব্যাপার, আমার চেয়ে আলাদা রকম কিছু। কিন্তু যদি ওটা ছুঁয়ে দিই, আঙুল বাড়িয়ে দিই, জাপটে ধরি, তাহলে কিছু একটা বদলে যাবে। তোর মনে হয় না ? রুটি আমার থেকে অনেক বাইরে রয়েছে। কিন্তু আমি আঙুল দিয়ে ওটা ছুঁই। ওটা অনুভব করি। বুঝি ওই হলো পৃথিবী। কিন্তু আমি যদি ছুঁয়ে দেখি আর অনুভব করি তাহলেও তখন সত্যি সত্যি বলা যাবে না যে ওটা অন্য কিছুও হতে পারে! নাকি তুই বিশ্বাস করিস না এভাবে কথা বলা যায় ?

ডিয়ার, হাজার হাজার বছর আগে বহু তাবড় তাবড় জ্ঞানী মাথা ফুটো করে ঘামিয়েছেন সমস্যার সমাধান খুঁজতে।―মানুষের দিন দাঁড়িয়েই থাকে রুটির ওপর―মুখ ঢেকে বিড়বিড় করতে থাকে জনি―আমি ওটা ছোঁবার সাহস করলাম। দু টুকরা করে ফেললাম। মুখে পুরে দিলাম। কিস্যু হলো না। জানি তো; ওটাই তো ভয়ংকর। খেয়াল করে দেখলি যে কিস্যু হলো না ? এটা ভয়ংকর ব্যাপার তো। রুটি দুই টুকরা করলি, চামচ দিয়ে গাঁথলি, আর বাকি সবকিছু আগের মতোই পুনরাবৃত্ত হলো। এগুলো কেন ? আমি বুঝি না এসব, ব্রুনো।

জনির মুখ-চোখ, ওর উত্তেজনা আমাকে ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে ফেলতে শুরু করল। যতবার জ্যাজ প্রসঙ্গে, ওর স্মৃতি নিয়ে, ওর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে যাই, ওকে বাস্তবে নিয়ে আসতে চাই, ততবার প্রসঙ্গটা শুরু করাই কঠিন হয়ে পড়ে। (বাস্তবে―শব্দটা লেখামাত্র আমারই কেমন অদ্ভুত লাগছে। জনি ঠিক বলেছে, বাস্তব এমন হওয়া উচিত নয়। জ্যাজের সমালোচনা করা বিষয়টা বাস্তব হতে পারে না। কেননা সেক্ষেত্রে কেউ একজন থাকবে যে আমাদের চুল টেনে ছিঁড়বে। তবে একই সঙ্গে জনিও তো এভাবে চলতে পারে না। আমাদের সমস্ত পাগলামি তো শেষ করতেই হবে।)

এখন ও ঘুমিয়ে পড়েছে। কিংবা হয়তো অন্তত চোখ দুটো বুজেছে। তাই ঘুমিয়েও পড়েছে। আরেকবার খেয়াল করে দেখলাম আমার পক্ষে ব্যাপারটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে এটা জানা যে, কী করছে জনি, জনি নিজেই-বা আসলে কে। ও কি ঘুমায়, ওকে কি ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা যায়, ও কি ঘুমে বিশ্বাস করে ? বন্ধুরা যেমন হয় জনি তার চাইতে ঢের দূরের, ঢের অন্যরকম মানুষ। অন্য কেউ ওর চেয়ে এত অশ্লীল হতে পারবে না, এত সাধারণও হতে পারবে না। জীবনের সবকিছুর সঙ্গে এতখানি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে পারবে না। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুর সঙ্গে এত চলাচল বজায় রাখা আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আপাতদৃষ্টিতে ও মোটেই ব্যতিক্রমী কোনও মানুষ না। যে কেউ জনির মতো হতে পারে। বরাবরই সহজেই বিশ্রী অসুখে পড়ে যেতে পারে, চক্রান্তকারীর মতো মন নিয়ে। আবার অনিচ্ছা করেই এসব করে যেতে পারে। অথচ কবিতা আর প্রতিভায় ভরপুর। আপাতদৃষ্টিতে। আমার জীবনটা কেটেছে প্রতিভাবানদের কদর করে। পিকাসো, আইনস্টাইন, তালিকার যত মহান মহান সন্ত আছে, এক মিনিটেই যাদের নাম গড়গড় করে বলে ফেলে মানুষ (গান্ধী, চ্যাপলিন, স্ত্রাভিন্সিক)। মেঘের ওপর দিয়ে যারা চলাচল করেন তাদের মধ্যে যে কোনও মহান ব্যক্তিকেই কদর করবার জন্য সবসময় প্রস্তুত। এদের কারও কোনও কিছুই অদ্ভুত মনে হবে না। এরা আলাদা। এদের দেখে ডিগবাজি খাবারও কিছু নেই। উলটোদিকে জনির সবেগ আচরণে পার্থক্যটা গোপন। এর রহস্য থাকার কারণেই বিরক্তিকর। কারণ জনির আচরণের কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। জনি এমন কোনও প্রতিভাধর নয়, কোনও কিছু সে আবিষ্কারও করেনি। জ্যাজ বাজায় যেরকম আরও হাজারো সাদা বা কালো মানুষ বাজান। যদিও তাদের সকলের চাইতে বেশি ভালো বাজায়। এখানে বুঝে নেওয়া দরকার যে বাজনা ব্যাপারটাও শ্রোতাদের সমর্থনের ওপরেই নির্ভর করে। কী ফ্যাশনের পোশাক পরবে, কোন সময়ে অনুষ্ঠান করবে… সংক্ষেপে সেসব কিছুই শ্রোতা দর্শকদের ওপর নির্ভর করে। উদাহরণ স্বরূপ পানাসসিয়ের কথা বলি। পানাসসিয়ে দেখল যে জনি সোজা কথায় একজন বদ শিল্পী। আমরা অবশ্য বিশ্বাস করি খোলাখুলি যে, বদ আসলে পানাসসিয়ে নিজে। এমন বহু বহু বিষয় খোলাখুলি বিতর্কিত বিষয় বলা যায়। এসব কিছু এটাই প্রমাণ করে যে জনি অন্য কোনও দুনিয়ার লোক নয়। (এক্ষেত্রে পানাসসিয়েই বরং প্রথম অচেনা ব্যক্তি)। জনিকে যদি এমন কথা ওরা বলে তাহলে ও হয়তো হো হো করে হেসে উঠবে। আমি ভালো করেই জানি ও কী কী ভাবে। এসব বিষয় নিয়ে কীভাবে বাঁচে। আমি বলছি এসব নিয়ে যে ও বাঁচে, তার কারণ জনি… তবে ওরকম হবে না। আসলে নিজেই নিজের কাছে যা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাইছি তা হলো জনির সঙ্গে আমাদের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যার কোনও অবকাশই এখানে নেই। মনে হয় এসবের ফলে সবচেয়ে মূল্য যাকে চোকাতে হয়েছে সে হলো জনি নিজেই স্বয়ং। এসব ব্যাপার আমাদের মতো ওকেও বেশ সমস্যায় ফেলছে। ওদের পরক্ষণেই বলতে ইচ্ছে করবে যে জনি আর সব মানুষের চেয়ে আলাদা… দেবদূতের মতো, যতক্ষণ না প্রাথমিক সততাবোধ ওদের শব্দটা গিলে ফেলতে বাধ্য করে। সুন্দর এক পালটি খাওয়ায়। হয়তো এটাই চিনিয়ে দেবে যে জনি দেবদূতেদের মধ্যে থাকা একমাত্র  মানুষ, সব অবাস্তবের মধ্যে থাকা একমাত্র বাস্তব। হয়তো এজন্যই জনি আঙুল দিয়ে আমার মুখটা ছুঁয়ে দেখছিল। ব্যাপারটা আমায় এত অসুখী করে তুলছিল, এত কাচের মতো স্বচ্ছ দেখিয়ে দিচ্ছিল ওর কাছে নিজেকে। আমার সুস্বাস্থ্য, আমার বাড়িঘর, আমার বৌ, আমার প্রতিষ্ঠা সবকিছু এত সামান্য করে তুলছিল। সবচাইতে সামান্য করে তুলছিল আমার প্রতিষ্ঠা। সবার ওপর তো আমার প্রতিষ্ঠা।

তবে এ তো বরাবর হয়। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। জুতার ফিতাও ঠিক করে বাঁধা ছিল না। পথে নেমে পড়লাম। সেই সময় এমন মনের অবস্থা যে আমি যে কোনও কিছু করতে পারি। রুটি তখন বলদের মতো আকাশে গোলপানা চক্কর কাটছে, ফিরে ফিরে ঘুরে আসছে। বেচারা জনি, বাস্তবের চাইতে এতখানি দূরে থাকে ও। (এটাই তো, এটাই তো। এটাই তো হয়―নিজেকে এরকম বোঝানো আমার পক্ষে ঢের সহজ। এখন যখন আমি একটা ক্যাফেতে বসে আছি, হাসপাতালে দু ঘণ্টা ভিজিট করে এসেছি জনিকে, ওপরে যা যা কিছু আমি লিখেছি সবকিছুই জোরে লিখেছি, মনে হচ্ছে আমি যেন কোনও অভিযুক্ত আসামি। নিজের সঙ্গে অন্তত সামান্য হলেও ভদ্রতা তো করতেই পারি।)

সৌভাগ্যক্রমে ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার দিয়ে আগুন আয়ত্তে আনা গেছে। যেটা ভাবা একেবারে খাপে খাপ হয়ে যায় সেটা হলো আগুন আয়ত্তে আনার জন্য মারকেসা নিজে তার কর্তব্য করেছিল। দেদে আর আর্ট বউকাইয়া খবরের কাগজের অফিসে এসেছিল আমায় খুঁজতে। তিনজন ভিক্সে গেলাম ঐ সংগীত শুনতে এখন যেটা বাজারে খুব বিখ্যাত―কিন্তু তখনও সেটা গোপন ছিল―আমোরোউস ডিস্কটা। ট্যাক্সিতে দেদে আমায় বলেছিল মারকেসা কী রকম অনিচ্ছুকভাবে জনিকে আগুনের বিপদ থেকে টেনে বের করেছিল। মুলতা হোটেল (আগেই টাকা মেটানো হয়ে গেছিল, রু লাংরাজ হোটেলের। ওখানে যত আলজিরিয়ানরা থাকছিলেন তাদের কাছে আর পাশের হোটেলের (যেটা তিকা আগেই বুক করে রেখেছিল) বাসিন্দাদের কাছে এই আগুন লাগার ঘটনাটা সাঙ্ঘাতিক এক বিপর্যয় ছিল। জনি যেমন বিরাট এক সুন্দর বিছানায় শুয়ে আবোলতাবোল প্রলাপ বকছিল, মাঝেমাঝে প্যারিস ম্যাচ আর নিউ ইয়র্কার সংবাদপত্র পড়ছিল, মাঝে মাঝে ওর বিখ্যাত পকেট নোটবই যেখানে ডিলান টমাস আর কবিতা বা অসংখ্য পেন্সিলে লেখা নোটস ছিল সেগুলো গুলিয়ে ফেলছিল পত্রিকার সঙ্গে… এসব কিছুই হতো না যদি না আগেই ওকে আগুন থেকে সরিয়ে আনা হতো।

এসব সংবাদ শুনে আর রাস্তার কোণের ক্যাফে থেকে এক কাপ কনিয়াক নিয়ে আমরা অডিশন রুমে জাঁকিয়ে বসলাম আমোরোউস আর স্ট্রেপ্টোমাইসিন রেকর্ড দুটো শুনতে। আর্ট অনুরোধ করল আলো নিভিয়ে দিতে। কারণ মেঝেয় শুয়ে শুনলে আরও ভালো শোনাবে। তখন জনি সেখানে ঢুকল। গলা দিয়ে সুর ভেজে তার মিউজিক শোনাল। ওখন ওখানে ঢুকল বটে অথচ ও কিন্তু হোটেলে বিছানায় শুয়েছিল। পনের মিনিট ধরে মিউজিক শুনিয়ে আমাদের একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। বুঝলাম আমোরোউস যে প্রকাশ হতে চলেছে সেটাই ওকে রাগিয়ে তুলেছে। কেননা দোষটা ডিস্ক শুনলে যে কেউ বুঝবে। কিছু লাইনের শেষে চলতে থাকা সেই সুরের ঝাপট নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করা, আর তারপর সবার উপরে সংগীতের শেষটায় এক বন্য অবরোহণ। ভোঁতা ও সংক্ষিপ্ত সুরটা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যেন কারও হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে, যেন তা রুটির ভিতর চেপে বসা এক ছুরির কোপের মতো (কদিন ধরে জনি রুটির কথা বলছে)। পরিস্থিতির বদল এমন যে জনি আমাদের কাছে যা ভয়ংকর সুন্দর ও তার কাছ থেকে পালাচ্ছিল। এই বদল থেকে, উদ্বেগজনিত প্রশ্নের হাত থেকে, কিংবা মরিয়া অঙ্গভঙ্গির থেকে পালানোর ইচ্ছা এবং তার জন্য সব দিকই খোলা রয়েছে বলে জনি বেরনোর ঠিক পথটা খুঁজছিল। জনি বুঝতে পারছে না (কারণ ওর কাছে যা বিপুল ব্যর্থতা, আমাদের কাছে সেটাই পথ, অন্তত পথের ইশারা)। আমোরোউস ডিস্ক আসলে জ্যাজ সংগীতের ক্ষেত্রে এক বিপুল মুহূর্ত। জনির বড় আকাক্সক্ষার এই রেকর্ড। যতবার শুনছিল ততবার ভেতরে ভেতরে ওর শিল্পী সত্তা রাগে উন্মাদ হয়ে উঠছিল। রাগারাগি করতে করতে ও মিউজিক নিয়ে আসলে কিছু বলতে চাইছিল। হাত পা ঠুকছিল, মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়লে সেটা সামলানোর চেষ্টা করছিল। ও যা বিশ্বাস করে সেসব কথা প্রকাশ করতে গিয়ে আরও বেশি বেশি একা হয়ে যাচ্ছিল। এটা কৌতূহল উদ্দীপক। সে কথা শোনা প্রয়োজন যদিও সবকিছুই একত্র হয়েছে আমোরোউস ডিস্কে। আমি লক্ষ করে দেখলাম জনি পরিস্থিতির কোনও শিকার নয়। সবাই যেরকম মনে করে জনি ঠিক সেভাবে নির্যাতিত নয়। আমি ওভাবেই আমার আত্মজীবনীতে লিখেছি (নিশ্চিত ইংরিজি সংকলনে এটা পাওয়া যাচ্ছে আর কোকাকোলার মতোই সে সংকলন বিক্রিও হচ্ছে)। যদিও এখন জানি ব্যাপারটা এরকম নয়। অনুসৃত হওয়ার বদলে জনি নিজে অনুসরণ করছে। ওর জীবনে যা যা কিছু ঘটছে তা হলো শিকারির ভাগ্য, কোনও নিগৃহীত পশুর ভাগ্য নয়। কেউ জানতে পারবে না জনি কীসের পিছনে ছুটছে কিন্তু বিষয়টা ওরকমই। ওটা ওখানেই রয়েছে আমোরোউস ডিস্কের মধ্যে, ওর মারিজুয়ানার মধ্যে, এত সব বিষয় নিয়ে বলতে থাকা এমন অসম্ভব প্রলাপের মধ্যে, প্রলাপ আবার চাগিয়ে ওঠার মধ্যে, ডিলান টমাসের নোটবইয়ের মধ্যে… সবকিছুর মধ্যে বেচারা হলো জনি। এটাই ওকে বিশাল করে তুলেছে, ওকে জীবন্ত এক অসম্ভব কিছু করে তুলেছে। এক এমন শিকারি করে তুলেছে যার হাত নেই, পা নেই। এক এমন খরগোশে পরিণত করেছে যে ঘুমন্ত সিংহের পিছনে তাড়া করেছে। আমি দেখি মানে সংক্ষেপে বলতে চাই আমোরোউস শুনবার পরে ভেতরে ভেতরে আমার বমি করতে ইচ্ছে করেছিল। মনে হচ্ছিল এভাবে হয়তো ওটার থেকে মুক্তি পাব। ওটার ভেতরে যা যা ছিল সবকিছু আমার অথবা বাকি সকলের বিরুদ্ধে যায়। হাত-পাবিহীন সেই কালো স্তূপ, সেই উন্মত্ত শিম্পাঞ্জি ওর আঙুল দিয়ে আমার সারা মুখে চলাচল করেছে, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে।

আর্ট আর দেদে আমারোউসের ঘোষিত সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছু দেখেনি। (মনে হয় ওরা দেখতে চায়ওনি) তাছাড়া দেদের বেশি পছন্দ হয়েছে স্ট্রেপটোমাইসিন রেকর্ডটা। ওখানে জনি অনায়াসে নিজের সহজ ভঙ্গি আরও উন্নত করে দেখিয়েছে। পাবলিক যা বোঝে তা হলো নিখুঁত হলো কি না। আমার যা মনে হয়েছে জনির ক্ষেত্রে সে হলো বেশ ভালো রকমের ব্যতিক্রম। সে সংগীত নিজের খেয়ালে বইতে দিয়ে নিজে অন্য জায়গায় থেকে যায়। পথে দেদেকে জিজ্ঞাসা করলাম ওর পরিকল্পনা কী ? বলল জনি খুব কমই হোটেল ছেড়ে বেরোয়। (এখনকার মতো পুলিশও ওকে বের হতে না করেছে)। ও যা যা চেয়েছে সেগুলো রেকর্ড করে এক নতুন ডিস্ক বের করলে ওরা ভালো টাকা দেবে। আর্ট সহ্য করে জনির মাথায় যত রকমের আইডিয়া কিলবিল করে সবকিছু ও শোনে। ও আর মারসেল গাভোতি নতুন করে কাজ করবে একসঙ্গে জনির সঙ্গে। যদিও গত কয়েক সপ্তাহের পর আর্টের সঙ্গে আর সবকিছু নেই যদিও। তাছাড়া আমার দিক থেকে মনেও করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিউ ইয়র্কে ফিরে একজন এজেন্টের সঙ্গে কথাবার্তা বলা দরকার। অতিরিক্ত হিসেবে যা যা ঘটছে সবই তো বুঝি, বেচারা ছেলেটা।

তিকা খুব ভালোভাবে সবকিছু শেয়ার করছে―দেদে বেশ প্রশংসা করে বলে উঠল―হ্যাঁ। আসলে ওর পক্ষে বিষয়টা এত সহজ। সবসময় শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছায়। ব্যাগ খোলা আর সবকিছু ঠিক করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু জানে না। বদলে আমি…

আর্ট আর আমি আমরা দেখিনি। ওকে আমরা কী বলতে পারি ? মেয়েরা জনি বা জনির মতন মানুষের চারপাশে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে জীবন শেষ করে দেয়। এটা বিচিত্র কিছু নয়। জনির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে গেলে মহিলা হবার কোনও দরকার নেই। কঠিন হলো একজন ভালো উপগ্রহের মতো, একজন ভালো সমালোচকের মতো পালা বদলাতে গেলে ওর থেকে দূরত্ব না বাড়িয়ে পারা যায় না। আর্ট তখন বাল্টিমোরে ছিল না। কিন্তু জনির সঙ্গে যখন আলাপ হয়েছিল তখন আমার সেই সময়ের কথা মনে পড়ত। ও তখন লান আর অন্য ছেলেদের সঙ্গে থাকছিল। লানকে দেখে খারাপ লাগত। কিন্তু জনির সঙ্গে একটা ঋতু কাটানোর পর, ওর মিউজিকের সাম্রাজ্য একটু একটু করে গ্রহণ করবার পরে, ওর দিনের আলোর সম্পদ, যেসব ঘটনা ঘটেইনি তার অসম্ভব সব ব্যাখ্যা পেয়ে, হঠাৎ করে ওর বড্ড নেতিয়ে নরম হয়ে যাবার দশা দেখলে তবেই কেউ বুঝতে পারত লান কেন ওরকম মুখ করে থাকে। অন্যরকম মুখ করে থাকাটা ওর পক্ষে কেন এত অসম্ভব ছিল। কেনই-বা সে মাঝে মাঝে জনির সঙ্গে থাকত। তিকা আরেকটা ব্যাপার। সে আবার অশ্লীলতার ট্র্যাক থেকে পালিয়ে যেত। বিপুল জীবন থেকে পালিয়ে যেত। তার ওপর ওর পাছায় ডলার ছিল, গুলিভরা বন্দুকের চাইতে সে বস্তু ঢের বেশি কার্যকরী। অন্তত আর্ট বউকাইয়া যখন তিকার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বিরক্তি প্রকাশ করত অথবা ওর মাথা ব্যথা করত তখন সে এসবই বলত।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসবেন―দেদে আমায় অনুরোধ করল―আপনার সঙ্গে কথা বলতে ওর ভালো লাগে। 

আগুন নিয়ে ওকে জ্ঞান দিতে পারলে আমার ভালো লাগত (আগুনের কারণে, যে ব্যাপারে ও নিশ্চিত করেই দক্ষ) কিন্তু সেটা এতটাই নিরর্থক হবে জনির ক্ষেত্রে। জনিকে যদি বলা যায় আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠতে তাহলে তা যতখানি নিরর্থক লাগবে এটা ঠিক সেরকম নিরর্থক ব্যাপার। ওই সময়ের জন্য সবকিছু ঠিকঠাক যাচ্ছিল। কৌতূহলী (ও অস্থির) বলে জনিকে ঘুরে ঘটা কোনও ঘটনা খুব কমই ঠিকঠাক চলে। আর তখন সেসব দেখে আমিও দারুণ তৃপ্ত হয়ে থাকি। এখন সত্যি বলতে কী আমি এতটাও সরল নই যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেব। এটা স্থগিত করলেই ভালো হয়। মানে এক রকমের একটা রেহাই। মুখের সঙ্গে নাক আটকে থাকাটা যেভাবে অনুভব করি, ঠিক সেরকমভাবেই ভালো করে ব্যাপারটা অনুভব করছি। আর কোনও ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কেবল আমিই এটা অনুভব করছি দেখলে অবশ্য রাগ হয়। আমিই সবসময় কষ্ট পাচ্ছি এ কথা ভাবলে রেগে যাই। আর্ট বউকাইয়া, তিকা, দেদে খেয়াল করছে না যে প্রতিবার জনিই কষ্ট পাচ্ছে। কখনও জেলে যাচ্ছে, কখনও বা অন্যকে মারতে চাইছে, বালিশে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, কিংবা হোটেলের প্যাসেজ দিয়ে নগ্ন হয়ে দৌড়ুচ্ছে। ওদের সঙ্গে লেপটে রয়েছে, একেবারে যেন মরে যাচ্ছে―এসব ব্যাপারস্যাপার দেখলে আমার রাগ হয়। যারা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বড় বড় বক্তৃতা দেন অথবা মানবতার খারাপ দিকগুলো ধিক্কার জানিয়ে ভারী ভারী প্রবন্ধ লেখেন তারা এসব জানেন না যে পৃথিবীর পাপ ধুতে গেলে শূন্যে পিয়ানো বাজানো যেমন অর্থহীন, ঠিক সেরকমই অর্থহীন এসব। বেচারা স্যাক্সোফোন বাজিয়ে! স্যাক্সোফোন বাজিয়ে শব্দটার মধ্যে যেমন অদ্ভুত এক অসম্ভাব্যতা রয়েছে; যত সামান্যই তা হোক না কেন ও আসলে অসংখ্য বেচারা স্যাক্সোফোন বাজিয়ের মধ্যে অন্যতম একজন বাজিয়ে শুধু।

সবচেয়ে খারাপ হলো ব্যাপারটা যদি এভাবেই চালিয়ে যাই তাহলে শেষমেষ আমি জনির সম্পর্কে যত না লিখব তার চেয়ে ঢের বেশি নিজের সম্পর্কে লিখে চলব। নিজের সঙ্গে দেবদূতের মিল খুঁজে পেতে শুরু করেছি। অবশ্য আমায় তা কম সম্মান যোগ করছে না। বাড়ি ফিরে আমিও ছিদ্রান্বেষীদের মতো ভেবেছি আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া দরকার। জনির ওপরে লেখা হাজার বইয়ের মধ্যে আমি কেবল ওর এসব ঘটনা নিয়ে লিখেছি। একদম অনুপুঙ্খ করে তা লিখেছি। তার মানবসত্তার আবেগপ্রবণ দিক নিয়ে লিখেছি। আমার কাছে এটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন মনে হয়নি যে জনি কেন বিশ্বাস করে ও পাতাভর্তি জারে পরিপূর্ণ মাঠে রয়েছে। কিংবা ও যেসব ছবির দিকে চেয়ে থাকে তারা নড়াচড়া করে―এমন কথা ব্যাখ্যা করবারও প্রয়োজন মনে হয়নি আমার। কিংবা জনি মারিজুয়ানার ফ্যান্টাসিতে থাকে তা সম্পর্কেও লিখিনি। কারণ যাই হোক না কেন, সবকিছুর শেষে ওরা নেশা ছাড়ানোর চিকিৎসাতেই তো বিশ্বাস করে। তবে এটা বলা যেতে পারে যে জনি আমায় অঙ্গীকারবদ্ধ করে রাখে যে আর বলে নিজে ওসব ফ্যান্টাসিতেই থাকবে। ওর ব্যাগে থাকা বাকি কতশত রুমালের মতো আমার কাছে ওগুলো রাখে যাতে সেসব উদ্ধার করবার সময় চোখের সামনেই দেখা যায়। বিশ্বাস করি একমাত্র আমিই ওর সবকিছু সহ্য করি। ওদের সঙ্গেই থাকি, ওদের ভয় পাই। এ কথা কেউ জানে না, এমনকি জনিও নয়। কোনও বড় মানুষের কাছে লোকে যেভাবে স্বীকারোক্তি করে জনির কাছে তারা এসব কিছু স্বীকার করতে পারবে না। তিনি এমন এক মায়েস্ত্রো যার একটা স্বীকারোক্তির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা সকলেই অনুগত থাকি। এ কেমন দুনিয়া ভাই যে আমাকে গাঁটের মতো আচরণ করতে হয় ? কোন শ্রেণির দেবদূত আমি ? জনির মধ্যে কম তো বিপুলতা নেই। যেদিন থেকে ওকে চিনেছি, ওর কাজের অনুরাগী হয়েছি সেদিন থেকে এ কথা আমি জানি। কিছু দিন যাবৎ এসব আমায় আর অবাক করে না। যদিও প্রথমটায় এই বিশালতার অভাব দেখে বিরক্তিই লেগেছিল। এর হয়তো একটা কারণ হতে পারে কেউ যখন কারও সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হয় তখন এটা যে তার একটা চারিত্রিক দিক সেকথা ভাবতে চায় না। তার ওপর আবার ও একজন জ্যাজম্যান, সুতরাং এ সম্বন্ধে তো ভাবতে রাজিই হয় না। জানি না কেন (জানা নেই কেন) আমি এক বিশেষ মুহূর্তে বিশ্বাস করি, সে বিশেষ মুহূর্তে জনির ভিতর সেই বিরাটত্ব ছিল। অথচ যাকে দিনের পর দিন সে অস্বীকার করেছে (হয়তো বা আমরাই অস্বীকার করেছি। বাস্তবে ব্যাপারটা তো এমন নয়)। কারণ আমরা সৎ লোক, আর জনির ভেতরে যতদূর সম্ভব অন্য এক জনির ভূত থাকে। সেই অন্য জনি মহত্ত্ব দিয়ে পরিপূর্ণ। সেই ভূত খেয়াল করে যে এই পক্ষে না থাকাটা উল্লেখ করলেও সেটা নেতিবাচকভাবেই প্রকাশিত হবে। ও অবশ্য সুখীই থেকে যায়।

এটা বলছি কারণ জীবন বদলানোর জন্য জনি যা যা চেষ্টা করেছে, ওর আত্মহত্যার চেষ্টা, ভ্রƒণহত্যা থেকে মারিজুয়ানা নেওয়া পর্যন্ত… সেসবই আমরা প্রত্যাশা করে থাকি ওর মতো এক শিল্পীর কাছ থেকে যার কোনও ইগো নেই। মনে হয় এজন্যই ওকে আরও বেশি পছন্দ করি আজও। কারণ ও এক সত্যিকারের শিম্পাঞ্জি যে পড়তে শিখতে চায়। একজন বেচারা মানুষ যে কি না দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকবে তবু সে নিজেকে বুঝবে না বরং নতুন করে ফের শুরু করবে তার চেষ্টা।

আহ! কিন্তু শিম্পাঞ্জি এক দিন পড়তে শিখে যায়! কী বিপুল দেউলিয়াপনা! একজন যতখানি পারে ততখানি রেহাই! আমি হলাম সেই প্রথম ব্যক্তি। এ ভয়ংকর যে একজন মানুষ যার ততখানি বিপুলত্ব নেই সে নিজেকে এভাবে দেয়ালের গায়ে ছুড়ে দেয়। তার সমস্ত হাড়গোড় দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমাদের নিন্দা করে। তার সংগীতের প্রথম স্তবক দিয়েই আমাদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। (শহীদেরা, নায়কেরা, আমি সহমত―এদের সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্ত থাকে। অন্তত জনি তাই বলে!)

ক্রম। এর চেয়ে ভালোভাবে বলতে জানি না আমি। এটা একটা ধারণা যা দিয়ে হঠাৎ করে কোনও মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর কিংবা বোকা বোকা ঘটনাক্রমগুলো নিজেরাই নিজেদের অস্ত্রে সজ্জিত করে তোলে। শ্রেণিবদ্ধ আইনগুলোর বাইরে বাড়তি কোনও আইন সিদ্ধান্ত নেয় না। ব্যাপারটা এমন নয় যে টেলিফোন করে একটা নির্দিষ্ট ডাক দিলেই সঙ্গে সঙ্গে আউভেরনিয়াতে থাকা আমাদের বোন এসে উপস্থিত হবে কিংবা পাত্রে রাখা দুধ নিজে উজিয়ে গিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেবে অথবা বারান্দা থেকে তাকিয়ে দেখব কোনও কিশোর বাসের চাকায় চাপা পড়েছে। ফুটবল টিমগুলো আর তাদের ক্লাবের বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের মধ্যে দেখতে দেখতে মনে হবে শিরোনাম যদি ব্যর্থ হয় তবু নিয়তি সবসময় কিছু পরিবর্ত বিষয় রেখে দেয়। আজ সকালে খবরের কাগজের এমার্জেন্সি থেকে ওরা আমায় ফোন করেছিল। বলল―জনি কার্টার ভালো আছে, উন্নতি করছে। এ সংবাদ পেয়েও সুখী হতে আমার দেরি হচ্ছিল। ফোনটা তিকা করেছিল। আসল খবর হলো শিকাগোতে বি মারা গেছে। জনি আর লানের ছোট মেয়ে বি। স্বাভাবিকভাবেই জনি যেহেতু পাগল সেক্ষেত্রে আমি নিজে যদি বন্ধুদের খবরটা জানাই তাহলে ভালো হয়।

আবার হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলাম। জনি আর আমার বন্ধুত্বের ওপর দিয়ে কত কিছুই না ঘটল―তিকার সঙ্গে আলাপ হওয়া, একসঙ্গে চা খাওয়া, দেদের সঙ্গে একসঙ্গে তোয়ালে ভেজানো…। আর্ট, দেলাউনাই আর পেপে রামিরেস নিচু গলায় স্যাক্সোফোন বাজিয়ে লেস্টার ইয়ং-এর সাম্প্রতিক খবরগুলো জানাচ্ছে। জনি খুব শান্ত হয়ে খাটে বসে রয়েছে। কপালে একটা তোয়ালে জড়ানো। নিখুঁত শান্ত এক পরিবেশ, প্রায় ঘৃণামিশ্রিত অবজ্ঞায় ভরা। সঙ্গে সঙ্গে আমিও পরিস্থিতি অনুযায়ী মুখ বানিয়ে ভাবনাগুলো পকেটে পুরে ফেললাম। জনির হাত ধরে একটু চাপ দিয়ে রাখার মধ্যে নিজেকে সীমিত রাখলাম। একটা চুরুট ধরিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ব্রুনো, এখানে আমার কষ্ট হচ্ছে―এক মুহূর্ত যেতে না যেতেই নিজের বুকে হাত রেখে বলে উঠল জনি―ব্রুনো, ও ছিল আমার হাতের পাতায় রাখা এক টুকরো সাদা পাথরের মতো। আমি তো সামান্য হলদে চামড়ার ভদ্রলোক ছাড়া আর কিছু নই, কেউ না, কেউ না। আর কেউ কখনও আমার চোখের জল মুছিয়ে দেবে না।

এত আন্তরিকভাবে বলল। তিকা আর্টের দিকে তাকাল। দুজনেই ব্যাপারটা অনুমোদনের চোখে তাকিয়েছিল। মুখে ভেজা তোয়ালে চাপা দিয়ে জনি বলছিল। ওদের তাই দেখতে পাচ্ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে শস্তা কথা শুনলে আমার বিবমিষা হয়। কিন্তু কোথাও পড়েছি বোধহয় যে জনি এভাবে কথা বলে। আমার কানে অবশ্য এসব মুখোশের মতো শোনাল। কথা বলবে বলে মুখের ওপর তোয়ালে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফাঁপা বাক্য। নিরর্থক কথা। দেদে আরেকটা তোয়ালে নিয়ে এল। জনির ব্যান্ডেজ পাল্টে দিল। এসবের ফাঁকেও জনির মুখ উজ্জ্বল করে তুলতে পেরেছিলাম। ভাঙাচোরা মুখ আর চোখ এত ছোট করে প্রায় কোঁচকানোর মতো করে রেখেছিল যে, মুখটা প্রায় ধূসর ছাইরঙা দেখাচ্ছিল। বরাবর জনির সঙ্গে যেমন হয়ে থাকে! লোকে যা প্রত্যাশা করে তার ঠিক উলটোটা জনির ক্ষেত্রে হয়। পেপে রামিরেস যে কি না বড় কিছু জিনিস চেনে না সেও তখন চমকে গিয়েছিল। মনে হয় কেচ্ছা দেখে আরও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। কারণ একটু পরে জনি খাটে বসেছিল। তারপর প্রতিটা শব্দ চিবোতে চিবোতে ধীরে ধীরে অপমানে রেগে উঠছিল। আমোরোউস ডিস্কটা প্রকাশ করবার ভার যাদের ছিল, প্রকাশিত হবার পরে তাদের ওপর সেই ক্ষোভ উগরাতে চাইছিল। কারও দিকে না তাকিয়ে আটকে পরা ছারপোকার মতন আমাদের দায়ী করে অবিশ্বাস্য নোংরা ভাষার নখ দিয়ে ফুঁড়ে দিচ্ছিল জনি। পাক্কা দুই মিনিট ধরে আমারোউসের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের সবাইকে অপমান করল। দেলাউনাই আর আর্ট দিয়ে শুরু করে। তারপর আমি, (যদিও আমি…) শেষে গিয়ে দেদে। সর্বব্যাপী খ্রিস্টের মতো করছিল। এদের জন্ম যেসব বেশ্যা দিয়েছে সব্বাইকে ধরে ধরে অশ্লীল গালাগালির স্রোতে ধুইয়ে দিল জনি। একজনকেও ছাড়ল না। এগুলো ঘরের ভেতরে ঘটেছিল। এই ঘটনা আর শিকাগোয় নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়া জনির মেয়ে ঐ শ্বেতপাথরের মতো ছোট্ট বির শেষযাত্রায় প্রার্থনা করা―এই সমস্ত ঘটনাই ঘটেছিল।

পনেরো দিন ফাঁকা কেটে গেল। পাহাড়প্রমাণ কাজ, সংবাদপত্রের নিবন্ধ, এখানে ওখানে দেখা করতে যাওয়া, ―একজন সমালোচকের জন্য ভালোই সংক্ষিপ্ত কাজ বটে। ওদিকে সে মানুষ শুধু ধার করা, নিত্যনতুন খবরে ভরা, অদ্ভুত যত সিদ্ধান্ত নেওয়া জীবনযাপন। বলতে বলতে মনে পড়ল আমরা কজন―তিকা, বেবি লেনক্স আর আমি একটা ক্যাফেতে অনেক রাতে বসে কথা বলছিলাম। মনে মনে খুব আনন্দ। জনি গ্রিনের গাওয়া আউট অফ নো হোয়ারের সুর ভাজছি গুনগুন করে। বিলি টেলর গানটার সঙ্গে যিনি পিয়ানো বাজিয়েছেন কেবল তাকেই আমাদের তিনজনের পছন্দ বলে আলোচনা করছিলাম। সবার উপরে বেবি লেনক্স প্যারিসের শঁ জাঁম্য দে পাই-এর ফ্যাশনেবল পোশাকে সেজেছিল। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছিল! চেয়ে চেয়ে দেখবার মতো। বেবি দেখবে জনি তার বিশ বছরের ক্ষত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। জনি তার দিকে না তাকিয়েও চেয়ে থাকবে। আর যতক্ষণ না সম্পূর্ণ মাতাল হবে কিংবা ঘুমন্ত অবস্থায় অন্য টেবিলে গিয়ে বসবে ততক্ষণ জনি এভাবেই থাকবে। টের পেলাম তিকা আমার হাঁটুতে হাত রেখেছে।

দেখলি কাল রাতে আমি ফের ধোঁয়া টানা শুরু করেছি। কিংবা সেই বিকেলে। ওই মেয়ে…

বাকি সবার মতোই দেদেও যে দোষী সে কথা জেনে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও উত্তর দিলাম। ওর সঙ্গে ধূমপান করা শুরু করে এখনও পর্যন্ত ডজন ডজন দফায় দফায় জনির সঙ্গে বসে ধূমপান করেছি। আবার যেদিন এই ইচ্ছা জেগে উঠবে সেদিন আবারও এ কাজ করবে। আমারও খুব ইচ্ছে জেগে উঠল―উঠে গিয়ে একলা বসি। কারণ জনির খুব কাছে যাওয়া, পাশে বা সঙ্গে থাকা সবসময়ই অসম্ভব। হয়তো দেখব টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে ছবি আঁকছে। কোনও পানীয় নেবে―ওয়েটার জিজ্ঞাসা করলে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত জনি শূন্যে একটা তিরের ছবি আঁকবে আবার সঙ্গে সঙ্গে সেটা দু হাত দিয়ে আগলাতে যাবে যেন সেটা এক ধরনের অসভ্যতা। অন্য টেবিলগুলোতে বসে লোকজন ওসব উপভোগ করবে। ফ্লোর রেস্টুরেন্টে যেমন হওয়া স্বাভাবিক ঠিক সেরকমই নিজস্ব রীতিতে তারা উপভোগ করবে। তিকা তখন বলবে―ফালতু। জনির টেবিলের পাশ দিয়ে যাবে। বলা বাহুল্য মুখময় আশার দীপ জ্বালিয়ে বেবি আমায় আস্থা জাগাতে দৌড়ে আসবে। কিন্তু আমি অন্যমনস্ক হয়ে বলব রাতটা জনিকে একলা শান্তিতে থাকতে দেওয়া ভালো। ভালো মেয়েরা তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যায় বিছানায়। সম্ভব হলে একজন জ্যাজ সমালোচকের সঙ্গে হলে তাই সই। বেবি মিষ্টি করে হাসবে। আঙুল দিয়ে আমার চুল ধরে পাকাবে। তারপর আমরা একসঙ্গে বসে শান্তিতে মেয়ে দেখব। সে মেয়ে আবার সাদা শিশার ঢাকনা দিয়ে নিজের মুখ ঢাকবে। চোখ রঙ করবে সবুজ দিয়ে আর এমনকি মুখও সেই রঙে রাঙাবে। বেবি বলবে ওর এসব মোটেই বাজে লাগছে না। আর আমি চাইব যাতে লন্ডন আর স্টকহোমে যেসব গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ওসব ব্লু মিউজিকের থেকে একটা দুটো গান করুক। তারপরে না হয় আমরা আবার আউট অফ নো হোয়ারে ফিরে আসব। আজ রাতে কুকুরের মতো ওটাই অন্তহীন হয়ে সঙ্গে যাবে, যে কুকুরের চোখ সবুজ কিংবা সাদা শিশার মতো নয়।

জনির নতুন পাঁচ সঙ্গীদের মধ্যে দুজন চলে যাবে পাশ দিয়ে। আমি রাতটার সুযোগের সদ্ব্যবহার করব। দেখব সে রাতে জনি বাজনায় প্রায় হাতই ছোঁয়াতে পারেনি। যেহেতু সামান্য হলেও ধরেছিল তাই সেটার মূল্য আরেক স্যাক্সোফোন বাদক জনি লুইসের সমস্ত আইডিয়ার যোগফলের মতো হলো। কারণ ছেলেদের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠেছিল―এটা ইউনিক হলো! জনি লুইসের এক হাতে নোটস থাকে, সেটা দিয়ে তিনি ফুটো বোজান। আবার বিষয়টা এক্কেবারে হবহু এমনও ছিল না। সেই ফাঁকে জিজ্ঞাসা করব জনি কার্টারকে কত দূর পর্যন্ত ঠেকাতে পারা যাবে! তার চেয়েও বড় কথা জনিকে যেসব পাবলিক বিশ্বাস করে তাদের সামলানো যাবে কি না! দলের ছেলেরা বিয়ার খেতে রাজি হবে না। বেবি আর আমি নতুন করে আবার একলা পড়ে রইব। তাকে করা আমার প্রশ্নগুলোও থেমে যাবে। আর এই উপাধি তার প্রাপ্য কি না সেসব বেবিবকে বোঝানোও ঝক্কি। কারণ জনি অসুস্থ এবং তার যাত্রা শেষ হয়ে এসেছে। তার পাঁচ সঙ্গীদের সকলে প্রতিদিন একটু একটু করে আহত হচ্ছে। এদের মধ্যে কেনই-বা কেউ বিস্ফোরিত হবে যেকোনও সময় ? বাল্টিমোরে এমনই হয়েছিল কিংবা সান ফ্রান্সিস্কো বা নিউ ইয়র্কে আরও আধ ডজন বার।

আশপাশের মঞ্চে যারা বাজায় তাদের অনেকে উপস্থিত থাকবে। কেউ কেউ জনির টেবিলেও চলে যাবে। ওকে সম্ভাষণ জানাবে। মুখের অবস্থা বিশ্রীভাবে বোকার মতো করে যেন দূর থেকে তাদের দেখছে এমনভাবে তাকাবে জনি। ভেজা করুণ চোখ। ঠোঁট বেয়ে গড়ানো লালা সামলাতে না পারা দুটো ঠোঁট। তিকা আর বেবিকে কীভাবে সামলাবে সেটা দেখাও দ্বিগুণ মজার কাণ্ড হবে। পুরুষদের ওপর তিকার নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে তিকা তাদের চট করে জনির থেকে দূরে সরাতে চাইবে। বেবি কতখানি জনিকে পছন্দ করে সেকথা আমার কানে কানে বলতে থাকবে। নেশা ছাড়ানোর জন্য স্যানাটোরিয়ামে নিয়ে যাওয়া জনির পক্ষে কতটা ভালো হবে সে কথা বলতে থাকবে। এসব কিছুই বলবে কেননা ও উত্তেজিত হয়ে আছে। জনির সঙ্গে সে রাতেই শুতে চাইছে। না হলে এরকম কথা যে বলা সম্ভব নয় তা তো দেখতেই পারছেন। এটা আমায় দারুণ খুশি করছে। যেদিন থেকে বেবিকে চিনি তারপর থেকে এই প্রথমবার ভাবব ওর থাইয়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে আমার কেমন লাগবে! ওকে এই প্রস্তাব দেবার প্রায় দোড়গোড়ায় পৌঁছে যাব―একসঙ্গে বসে একটু পান করা যায় কোথাও। যেখানে এত গোলমাল নেই। (ও চাইবে না আর মনে মনে আমিও কক্ষনও তা চাইব না। কারণ ওই টেবিল আমাদের আটকে রাখবে অথবা অসুখী করে রাখবে)। হঠাৎ করে কী ঘটতে চলেছে সে ব্যাপারে আগে থেকে কোনও ইঙ্গিতই পাব না। হঠাৎই দেখব জনি ধীরে ধীরে উঠে বসছে। আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। চিনতেও পারছে। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে―বলতে চাইছি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কারণ বেবিকে ও পাত্তা দেয় না। টেবিলের কাছে এসে অবলীলায় সামান্য কিছুটা ঝুঁকে ঠিক প্লেট থেকে চিপস তুলে কেউ যেভাবে খায় ঠিক সেই ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়েছে। দেখব আমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ছে। এত স্বাভাবিকভাবে হাঁটু মুড়ছে, চোখে চোখ রেখে তাকাচ্ছে যে দেখতে পাব ও কাঁদছে। কোনও কথা না বললেও টের পাব জনি কাঁদছে ছোট্ট বির জন্য।

আমার প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিক হবে। জনিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করব। এটা যে অদ্ভুত দেখাবে সেসব আমলই দেব না। শেষ পর্যন্ত এই অদ্ভুত কাজটাই করেছি। কেননা একজন পুরুষমানুষ কষ্ট করে হলেও তার জায়গা থেকে সরতে চাইছে এর চেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। এরকম করলে ও খুব ভালো থাকছে। ও নিজেও টের পাবে ঠিক এ ভঙ্গিতেই দাঁড়াতে চেয়েছিল। সামান্য ব্যাপারে বিচলিত না হয়ে ফ্লোরের প্যারিশ পাদ্রিরা যেভাবে দাঁড়ান, সেভাবে তারা আমার দিকে মৃদু প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকালেন। তাদের অবশ্য বেশির ভাগেরই জানা নেই যে নিগ্রো লোকটা হাঁটু গেড়ে বসে আছে সেই হলো স্বয়ং জনি কার্টার। বেদির উপর চড়ে কেউ যদি যিশু খ্রিস্টের ক্রুশ উপড়াতে চায় তখন সবাই তার দিকে যেভাবে তাকায় ওঁরা ঠিক সেভাবে আমার দিকে তাকালেন। কাজটার জন্য প্রথম যে লোকটা বকুনি দিল সে হলো জনি নিজে। বেশি কিছু করেনি। নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টি আর প্যারিশ পুরোহিতদের নিষেধের মাঝখানে থেকে আমার পক্ষে জনির পাশে বসে পড়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় রইল না। নিজেকে ওর চেয়েও খারাপ মনে হচ্ছিল। হাঁটু গেড়ে বসা জনির সামনে চেয়ারে বসে থাকার চেয়ে অন্য কোনও আসনে গিয়ে বসতে ইচ্ছে করল।

বাকিটা এত খারাপ ছিল না। কেউ কারও জায়গা থেকে নড়েনি―এমন অবস্থায় কত শ বছর কেটে গেছে। জনির চোখ থেকে জল পড়া বন্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছু হয়নি। আগের মতোই স্থির চোখে আমার দিকে চেয়েছিল। একটা চুরুট দিতে চাইলাম। আরেকটা নিজের জন্য ধরালাম। বেবি যে ওখানে ছিল আর বোধহয় দৌড়ে উঠে যেতে বা কাঁদতে চাইছিল―এসব ছাড়া আর কিছু ঘটেনি। বরাবরের মতো তিকাই ব্যাপারটা ম্যানেজ করল। শান্তভাবে আমাদের টেবিলে এল। জনির পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এসে বসল। একটা হাত রাখল কাঁধে। কোনও রকম জোর না করেই রাখল যতক্ষণ না জনি একটু স্বাভাবিক হয়। জনি কিছুটা স্বাভাবিক হলো। মুখেচোখে সেই বীভৎস ভাব কেটে গিয়েছে। বেশ একটা বন্ধুত্বের ভাব। বসে আছে চেয়ারে। হাঁটু গেঁড়ে বসা ভঙ্গির বদলে মাটি থেকে পাছার দূরত্ব তখন কয়েক সেন্টিমিটার উঁচুতে। (বলতে যাচ্ছিলাম ক্রুশ, যাই হোক সত্যি সংক্রামক ভঙ্গি বটে!) চেয়ারে বসার মতো খুব আরামপ্রদ এক ভঙ্গি। লোকজন ততক্ষণে জনির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ক্লান্ত। একটা মানুষ যে কি না সমানে কেঁদে যাচ্ছে আর আমাদের নিজেদের কুকুর বলে ভাবাচ্ছে। দুম করেই ব্যাখ্যা পেলাম যে কেন কিছু কিছু চিত্রকরের কাছে তাদের চেয়ার প্রিয় হয়। ফ্লোরটাও হঠাৎ করেই আমার কাছে পছন্দের বস্তু বলে মনে হতে লাগল। যেন মেঝে নিজেই একটা ফুল, এক সুগন্ধী, শৃঙ্খলা রাখার জন্য এক নিখুঁত যন্ত্র। নিজের শহরের পুরুষের নিজস্ব সম্মান।

জনি রুমাল বের করল। কোনও রকম চেষ্টা না করেই ক্ষমা চেয়ে নিল। তিকা একটা ডবল কাপ কফি নিয়ে এল। ওকে দিল। বেবি চমৎকার মেজাজে রয়েছে। হঠাৎ করেই জনির সঙ্গে কথা বলার সময়ে করা তার সব বোকামি বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যমনস্কভাবে গুনগুন করছিল মামিস ব্লু রেকর্ডের গান। জনি ওকে দেখল। হাসল। মনে হলো তিকা আর আমি একসঙ্গেই ভেবেছি যে বির ইমেজ জনির চোখে একটু একটু করে হারাবে। পরবর্তী পলায়নের আগে আর একবার জনি আমাদের পাশে এসে বসতে রাজি হলো। চিরকাল যেমন হয় সামান্য কিছু সময় নিজেকে আমার কুকুর মনে হতে লাগল। জনির সামনে আমার সুপিরিয়রিটি আমায় অসংযত হতে প্রশ্রয় দিল। সব বিষয়েই আড্ডা দিলাম বটে তবে ব্যক্তিগত এলাকায় একবারও পা দিলাম না। (জনিকে তার চেয়ার থেকে পিছলে পড়ে যেতে দেখা ভয়ংকর হয়েছিল আমার কাছে। আবার করে যদি…) সৌভাগ্যবশত তিকা আর বেবি একেবারে দেবদূতের মতো আচরণ করছিল। ফ্লোরের লোকেরা এক ঘণ্টা ধরে জায়গাটা সাজাচ্ছে। সকালের প্যারিশ পাদ্রিরা যা ঘটেছে তা নিয়ে এমনকি একবারও সন্দেহ করেননি। যদিও ভালো করে ভেবে দেখলে বাস্তবে বিশাল কিছু ঘটেনি। প্রথমে বেবি গেল। (বেবি একজন পড়ুয়া, নটা বাজতেই ফ্রেড ক্যালেন্ডারের সঙ্গে পড়াতে বসে যাবে বিকেলে যাতে রেকর্ডিং করতে পারে)। ততক্ষণে তিকা তার তিন নম্বর পেগ কনিয়াক খেয়ে আমাদের বাড়ি ফেরার প্রস্তাব দিয়ে দিয়েছে। তখন জনি বলেছে, না। ও চাইছে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই যাবে। তিকা দেখল ও বেশ ভালো অবস্থায় আছে। ও চলে গেল। অবশ্য ফেরার খরচা হাতে দেবার আগে যায়নি। মারকেসা ওকে এভাবেই বলে গেছিলেন। জনি আর আমি এক পেগ শারতেরু নিয়ে বসেছি। এটা ধরাই আছে যে বন্ধুদের মধ্যে এসব দুর্বলতা দেখানোর অনুমোদন থাকে। আমরা শঁ জাঁরমা দে পাই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছি। কারণ জনি জোর করল ওর পক্ষে হাঁটা ভালো। আর আমি হলাম সেই ধরনের মানুষ যারা এরকম পরিস্থিতিতে তাদের কমরেডদের ছেড়ে আসে না। রু দেল আবে দিয়ে আমরা নেমে ফুর্স্তেনবার্গ প্লাজা পর্যন্ত গেলাম। জনির হঠাৎই বিপজ্জনকভাবে মনে পড়ে গেল একটা গেমসের থিয়েটার যেটা ওর যখন আট বছর বয়স তখন নাকি ওর ধর্মপিতা ওকে দিয়েছিল। এই মনে করা ওকে বির স্মৃতি অবধি টেনে নিয়ে না যায় সেই ভয়ে রু জেকব পর্যন্ত নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু জনি বলবে যে সে রাত আর বেশি বাকি নেই তাই ওই অধ্যায় সে বন্ধ করে দিয়েছে। শান্ত পায়ে হাঁটছে, কোনও জড়তা নেই কথায়। (অন্য সময় ওকে দেখেছি টলমল পায়ে হাঁটতে। মাতাল বলে নয়। ওর প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় কোনও অসুবিধা ঘটে বলে।) রাতের গরম, পথের নিস্তব্ধতা আমাদের ভালো লাগছিল। গাউলয়েসে সুখটান দিচ্ছিলাম দুজনে। আমরা নদীর দিকে রওনা দিয়েছি। কুয়াই দে কন্তি নদীতীরের বই বিক্রেতাদের পেতলের বাক্সগুলোর সামনে কোনও এক স্মৃতি অথবা কোনও ছাত্রের শিসের আওয়াজ আমাদের মুখে টেনে আনল ভিভালদির একটা সুর। দুজন খুব দরদ দিয়ে উৎসাহে গাইতে লাগলাম। জনি বলল ওর কাছে যদি স্যাক্সোফোন থাকত ও রাতটা ভিভালদি বাজিয়ে কাটিয়ে দিত। আমার কাছে বিষয়টা বাড়াবাড়ি মনে হলো অবশ্য।

শেষে অবশ্য একটু বাখ আর একটু চার্লস ইভসও বাজাতাম―অভিমানী গলায় বলল জনি। জানি না ফরাসিদের কেন চার্লস ইভস পছন্দ নয়। ওনার গান শুনেছিস ? সেই লেপার্ডের গানগুলো। লেপার্ডের গান শুনতেই হবে তোকে। লেপার্ড হলো…   

পাতলা সরু গলায় ও গুনগুন করে লেপার্ডের সুর ভাজতে লাগল। কী আর বলব গানটার অনেক লাইনই ঠিক পুরোপুরি ইভসের লেখা নয়। ব্যাপারটা জনি খেয়াল না করেই গেয়ে যাচ্ছিল। তবে ও নিশ্চিত ছিল ভালোই গাইছে। শেষে আমরা জি লু কা রোডের সামনে একটা নিচু পাঁচিলের ওপর বসলাম দুজনে। আরেকটা চুরুট ধরালাম। কারণ রাতটা বড় মনোরম ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তামাক আমাদের অনুপ্রাণিত করছিল একটা ক্যাফেতে বসে মদ্যপান করতে। আগের থেকে জনি আর আমার ভালো লাগছিল। প্রথমবার যখন ও আমার বইয়ের কথা বলল বোধহয় খেয়ালই করিনি। কারণ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ও চার্লস ইভসের কথাও বলেছিল। বলেছিল ওর ডিস্কগুলোয় কতবার ও চার্লস ইভসের নানা বিষয় উল্লেখ করেছে যদিও কেউই লক্ষ করেনি সে ব্যাপারটা (মনে হয় ইভস নিজেও করেনি)। তবে সে মুহূর্তে আমার বইটার কথাই মনে পড়ল, তাই প্রসঙ্গটা আনার চেষ্টা করছি।

ওহ! আমি কয়েক পাতা পড়েছি―বলল জনি―তিকারা তোর বইয়ের কথা খুব বলছিল, তবে আমি অবশ্য নামটাই খুব একটা বুঝিনি। কাল আর্ট ওটার ইংরেজি সংস্করণ নিয়ে এসেছিল তখন কয়েকটা জিনিস জানতে পারলাম। তোর বইটা বেশ ভালো।

এসব ব্যাপার শুনলে বিনয়ে গদগদ হয়ে আর তার সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট মাপের আগ্রহ মিশিয়ে যেন মনে হয় বক্তার কথাতে আমার এইমাত্র চক্ষু উন্মীলন হলো… এরকম স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেওয়াটা আমি এখন রপ্ত করে ফেলেছি। আমি, মানে বইয়ের যে সত্যিকারের লেখক।

এটা এক ধরনের আয়না―জনি বলল―প্রথমে ভাবতাম কোনও বিষয়ে লোকে যা লেখে তা মোটের ওপর নিজেকে দেখার মতোই একটা বিষয়। সেটা কোনও আয়না নয়। লেখকদের আমি খুবই সম্মান করি। ওঁরা যা লেখেন সেসব অবিশ্বাস্য কাজ। বেবপ মানে আধুনিক জ্যাজের এক নতুন ধারার মূল উৎস সম্পর্কে লেখা বইয়ের গোটা অংশ…

ইয়ে আমি তো বাল্টিমোরে তুমি যা বলেছিলে সেটা স্রেফ পুনর্লিখন ছাড়া আর কিছুই করিনি।―নিজেকে বাঁচাতে কথাগুলো বললাম ঠিকই, তবে জানি না কী থেকে বাঁচাচ্ছিলাম।

হ্যাঁ, এটাই সবটা। কিন্তু বাস্তবে এটা আসলে একটা আয়নার মতো ।―জেদি গলায় জনি কথাটা বলল।

আর কী চাও তুমি ? আয়নারা তো বিশ্বস্ত হয়ে থাকে।

অনেক কিছু কম পড়ে যায়, ব্রুনো―জনি বলে―আমার চেয়ে এ ব্যাপারে তুই অনেক বেশি জানিস। তবে আমার মনে হয় বহু জিনিস বাদ পড়ে যায়।

যেসব কথা তুমি বলতে ভুলে যাবে সেসব খোঁচা মেরে উত্তর দিলাম। এই বুনো বাঁদরের পক্ষে―(দেলাউনাই-এর সঙ্গে আমাদের কথা বলতে হবে। কোনও চিন্তাশীল স্বাস্থ্যকর প্রচেষ্টা নিয়ে একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য যদি ছুড়ে দেয় সেটা খুব দুঃখজনক ব্যাপার হবে… এই যেমন লানের পরনে যে লাল পোশাক রয়েছে―জনি বলে যাচ্ছে―এরকম সব পরিস্থিতিতে দর্শক বা শ্রোতার সামনে যদি ওদের মেলে ধরার জন্য এই কোনও নতুনত্ব পাওয়া যায় তবে তার সুযোগ নেওয়া উচিত। সেটা তো মন্দ হবে না। আমি কুকুরের গন্ধ পাচ্ছিলাম―জনি একটা সুর ভাজতে থাকে গুনগুন করে।―এই ডিস্কে একমাত্র গানটার সুরই ভালো। হ্যাঁ, মন দিয়ে শোনা আর দ্রুত এগোনো, কারণ অন্য লোকদের হাতে এসব কাজ কোনও স্বীকৃতি পায় না। ফলে খারাপ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ‘পথের ফুলদানি, সবচেয়ে বড় ছিল যা, নীল নীল ধুলো ভরা প্রায়―জনি বলে চলেছে―বারুদের মতো এত চেনা/ আমার বোনের কাছেও সে ছিল যে’। তখনও তার হ্যালুসিনেশনগুলো চলে যায়নি। সবচেয়ে খারাপ হবে এর পেছনের ইতিহাস যদি ও অস্বীকার করে। এই নান্দনিক পদ্ধতি নিয়ে কত শত প্রশংসা করেছে মানুষ… তাছাড়া দুম করে ‘কুল’ ব্যাপারটা নিয়েও তো তুই লিখিসনি―জনি বলে চলে। একদম সচেতন এখন ও।)

লিখিনি কী রকম ? জনি, এটা তো ঠিকই জিনিস বদলে যায়। তবে ছয় মাস আগেই তুমি…

ছয় মাস আগেই কী―নিচু পাঁচিল থেকে নেমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে জনি। দুই হাতের মাঝখানে মাথা রেখে বিশ্রাম নিতে যায়―ছয় মাস আগে। ষষ্ঠ মাস পূর্বে… আহ ব্রুনো। আমার কাছে ছেলেরা থাকলে এখনই আমি যা বাজাতে পারতাম… আর বিশেষ করে স্যাক্সোফোন নিয়ে তুই যা লিখেছিস সেটা খুব চালাকি হয়েছে। স্যাক্সো―ষষ্ঠ… খুব ভালো শব্দের খেলা। ষষ্ঠ মাস পূর্বে, ষষ্ঠ, স্যাক্সো, স্যাক্সো। সত্যি দুর্দান্ত হয়েছে। গোল্লায় যাক সব ব্রুনো।

আমি এটা বলতে যাব না যে ওর মানসিক অবস্থা ওকে বুঝতে দেবে না যে ঐ নির্মল শব্দের খেলা যথেষ্ট গভীর ভাবনার আইডিয়ার সিস্টেমকে লুকিয়ে ফেলবে। (লেওনার্দো ফেদারেরও এমনটাই মনে হয়েছিল যখন নিউ ইয়র্কে ওকে জিনিসগুলো ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছিলাম। ওয়াশবোর্ড যেদিন থেকে যোগ করা হয়েছে সেদিন থেকে জ্যাজে প্যারা ইরোটিজম সৃষ্টি করা যাচ্ছে। এটা বরাবর হয়। দ্রুত ভেবে ভালো লাগতে শুরু করল যে সমালোচকদের এসব শোনা আরও বেশি করে প্রয়োজন। আমি এটা স্বীকার করতে রাজি (ব্যক্তিগতভাবে, এই যে আমি লিখি সেভাবে) সৃষ্টিশীলেরা, সংগীত যবে থেকে উদ্ভব হয়েছে সেদিন থেকে জনি এই যে বাজিয়ে চলেছে সমস্ত সুর তাদের যতই নিন্দা করা হোক। তাদের ক্ষমতা নেই ওর কীর্তির দ্বান্দ্বিক পরিণতি নিষ্কাশন করে আনা। এসব যা লিখছে তার ভিত্তি আর তাৎপর্য অনুমান করা অথবা উন্নতি ঘটানোই তাদের কাজ। অবসাদের সময় এসব কথা তাদের মনে করতে হবে। লোকে যখন বলে ‘সময়’কে আমার খারাপ লাগে তারা স্রেফ সমালোচক ছাড়া আর কিছুই হয় না। ‘নক্ষত্রের নাম আখেনখো’… জনি বলে যাচ্ছে―হঠাৎ আবার ওর গলা কানে এল। সেই গলা যখন… কী করে বলি এটা ? যখন ওর পাশে বসে থাকি ওকে তখন কীভাবে ব্যাখ্যা করি ? আবারও ও একলা, আবারও ও বেরিয়ে গেছে পরিস্থিতি থেকে। অস্থির হয়ে আমি পাঁচিল থেকে নেমে পড়ি। ওকে কাছ থেকে চেয়ে দেখি। নক্ষত্রের নাম আখেনখো। ওর কিছু করার নেই।

নক্ষত্রের নাম আখেনখো―জনি বলল, দুই হাত নেড়ে কথা বলছে।

আর ওর শরীর বিরাট শহরের চৌমাথায় পড়ে থাকবে। ছয় মাস ধরে।

আমাকে যদিও কেউ দেখছে না। কেউ জানবে না, আমার কাঁধ জুড়ে রাগ হয়ে উঠল নক্ষত্রদের জন্য। (নক্ষত্রের নাম আখেনখো)। বরাবরের মতোই আমরা ফিরে এলাম। ‘এটা আমি কাল বাজাচ্ছি’। নক্ষত্রের নাম আখেনখো আর তাদের শরীর ছয় মাস শহরের পথেঘাটে ছড়িয়ে থাকবে। বড় শহরের চৌমাথায়। বের হয়ে গেছে। অনেক দূরে। আর আমি চোখে রক্ত নিয়ে স্রেফ, কারণ আমি নিজেকে এ বই সম্বন্ধে বেশি কিছু বলতে চাইনি। বাস্তবে আমি জেনে উঠতে পারিনি এত হাজার ফ্যান যারা বইটা দুটো ভাষায় পড়েছে তারা এ বই সম্বন্ধে কী ভাবছে। (খুব শিগগিরই বইটার তৃতীয় ভাষায় অনুবাদ হয়ে বেরোবে। স্প্যানিশ সংস্করণের সম্বন্ধে কথা চলছে। মনে হচ্ছে কেবল বুয়েনেস আইরেসেই লোকে ট্যাঙ্গো বাজায় না)।

পোশাকটা দুর্দান্ত ছিল―জনি বলে―লানকে ওটা পরে কেমন লাগছিল সেটা জানতে চাস না। কিন্তু আমি যদি এক পেগ হুইস্কি সামনে নিয়ে সে কথাগুলো বলি তাহলে ব্যাপারটা আরও ভালো লাগবে। তোর যদি টাকা থাকে তবেই তা হবে। কারণ দেদে আমায় তিনশ ফ্রাংক মাত্র দিয়েছে।

ভাবসাব দেখে ঠাট্টার সুরে হেসে উঠলাম। যেন ও সত্যিই জানে না কী করে পানীয় কিংবা মারিজুয়ানা টেবিলে আনানো যায়। ও ব্যাখ্যা করে বলতে শুরু করল দেদে আসলে খুবই ভালো মেয়ে (বই সম্পর্কে কিছুই বলল না)। আর এসব ও করে স্রেফ তাদের মধ্যকার বন্ধনের জন্যই। তবে সৌভাগ্যবশত তার সঙ্গী ব্রুনো (যে কি না ওকে নিয়ে একটা বই লিখেছে, ব্যস আর কিছু না)। আর ভালো হয় যদি আরবি পাড়ায় গিয়ে কোনও এক ক্যাফেতে বসে মদ্যপান করা যায়। ওখানে লোকে মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেয়। সে জায়গাটা এক ছোটখাট নক্ষত্রের মালিকানায় রয়েছে, যার নাম আখেনখো। (এটা আমি ভাবি। আমরা এখন শঁ সিভরঁ চার্চের পাশ দিয়ে ঢুকছি। রাত দুটো বাজে। এই সময় আমার বৌ সবসময় জেগে যায়। আর সেসব জিনিস দেখাতে থাকে যা দুধ কফি নিয়ে বসলেও দিব্যি দেখাতে পারে।) জনির সঙ্গেও এমনই ঘটে। এমনি করে একটা জঘন্য কনিয়াক পান করলাম আমরা দুজন। এভাবে ডোজটাও দ্বিগুণ করে দিলাম। আমাদের এত সুখী সুখী লাগছিল। কিন্তু বইটা সম্বন্ধে কিচ্ছু না। স্রেফ প্রচ্ছদ রাজহাঁসের মতো ধুলোভরা―এটুকু মন্তব্য ছাড়া কিছু না। নক্ষত্র, টুকরো টুকরো জিনিস, টুকরো টুকরো বাক্যের মধ্যে, খণ্ড খণ্ড চাহনির মধ্যে, টুকটাক হাসির মধ্যে দিয়ে শোনা যাচ্ছিল, টেবিলের ওপর পড়া কয়েক ফোঁটা লালা, ফুলদানির কিনারায় লেগে থাকা ফোঁটা (জনির ফুলদানি) তার মধ্যে দিয়ে যতটুকু প্রকাশ, সেটুকু ছাড়া আর কিচ্ছু না। হ্যাঁ, এমন কিছু মুহূর্ত থাকে যখন ইচ্ছে করে আমি মরে যাই। মনে হয় আমার জায়গায় থাকলে বহু মানুষেরই এমন ইচ্ছে করে থাকে। কিন্তু এটা কী করে মেনে নেওয়া যায় আজ রাতে যেসব কথা বলতে চাইছে না সেগুলো সে বয়ে আনতে আনতে মরে গেছে! মৃত্যুর পর থেকে শিকার করেই চলেছে। বেরিয়ে যাওয়া চালিয়ে যাচ্ছে। (আমি তো জানি না এরকম কথা কীভাবে লিখতে হয়) সমাপ্তি পর্বও যথেষ্ট সুষ্ঠু নেতৃত্বের মাধ্যমে ঘটেছে।

টেবিলের ওপরে তাল ঠুকতে ঠুকতে মাঝেসাঝে কখনও জনি থেমে গেছে অল্প সময়ের জন্য। আমার দিকে তাকিয়েছে, অবোধ্য একটা ভঙ্গি করেছে, তারপর ফের বাজাতে শুরু করেছে। ক্যাফের মালিক আমাদের চেনেন। যে সময় আমরা একজন আরবি গিটারিস্টকে সঙ্গে করে আসতাম ক্যাফেতে। তখনকার দিন থেকেই তিনি আমাদের চেনেন। কয়েক মিনিট আগেই বেন আইফা ঘুমাতে যেতে চাইছিল। ঐ অন্ধকার ক্যাফেতে আমরা দুজনেই মাত্র ছিলাম। চারপাশে বিশ্রী গন্ধ আর চ্যাটচ্যাটে পেস্ট্রির দাগ। আমিও স্বপ্ন থেকে ধপ করে মাটিতে পড়েছি, কারণ রাগ আমায় গ্রাস করেছে। একটা ভোঁতা রাগ তবে সেটা জনির বিরুদ্ধে নয়। আরও ভালো ব্যাপার হলো বিকেলটা জুড়ে স্রেফ ভালোবাসাবাসি করেছে। তারপর ওর একটা স্নানের প্রয়োজন হয়েছে। বাকিরা জল সাবান নিয়ে এসেছিল, সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জনি প্রথমেই যা দেখাতে চেয়েছিল তা ফের অনেক বেশি পরিষ্কার করে দেখানো গেল … আসলে জনি টেবিলে বসে একটা জেদি ছন্দ স্থির করে দিল। কখনও কখনও বিড়বিড় করে গাইছেও। আমার দিকে প্রায় না তাকিয়েই গাইছে। জিনিসপত্র সব এদিক থেকে ওদিক সরানো… আগামীকাল আবার অন্য আরেক নারী। অন্য আরেক চ্যালেঞ্জ। একটা যাত্রা। ভাবছি সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে গোপনে ইংরিজি সংস্করণটা সরিয়ে নিলে। সে কারণেই দেদের সঙ্গে কথা বলা, অন্যান্য জিনিসে বদল আনবার অনুরোধ করা। এই অস্থিরতা একটা অসম্ভব ব্যাপার। জনি প্রায় রেগে আছে। ওর দিক থেকে ছিটেফোঁটা উদ্যমও আর বেঁচে নেই। আমার তো একবারও  মনে হয়নি আসলেই ওর বইটা পড়তে কোনও রকম ইচ্ছে ছিল। আমি তো ভালো করে জানি বইটায় জনি সম্পর্কে সত্যি কথা লেখা হয়নি। (মিথ্যেও নয়)। চিকিৎসার বাইরে থাকা ওর স্কিজোফ্রেনিয়ায় উলঙ্গ হয়ে থাকাটাই স্রেফ দেখানো হয়েছে বইতে। ড্রাগের ভোঁতা পটভূমিতে জীবনের এই অশ্লীলতাকে করুণা করতে হয়। জরুরি কিছু লাইনও আমি রেখেছি। যেখানে সত্যিকারের দরকার সেখানে জোর দিয়েছি―জনির অতুলনীয় শিল্প। আর কীই-বা বলতে পারতাম ? তবে যেভাবে কেউ সারা জীবন লুকিয়ে অপেক্ষা করে কোনও কিছুর ওপর অলক্ষ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে যাতে লক্ষ্যবস্তুটি আহত হয়, ঠিক সেভাবেই ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে। বলবার মতো তো সংক্ষেপে এটুকুই। সমস্ত নান্দনিক মূলের ওপরে জনির সংগীতের শেষ যুক্তি। ওর বাজনায় সমসাময়িক জ্যাজের মহান তত্ত্ব ফুটে ওঠে, যেটা সম্পর্কে সব মহান তাত্ত্বিকেরা প্রশংসা করেছে সর্বত্র।

সৎভাবে বলতে গেলে ওর জীবন আমার কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ ? একটা জিনিসই আমায় অস্থির করে তোলে, ওর ঐ আচরণ। ওই আচরণ আমায় ব্যাকুল করে তোলে। আমার এত ক্ষমতা নেই যে তা অনুসরণ করতে পারি (বলতে চাইছি আমি তা অনুসরণ করতেও চাই না)। বইয়ে যা সিদ্ধান্ত দেওয়া আছে এমন ব্যবহার তাকেই তো মিথ্যে প্রমাণ করে দেয়। আমার সিদ্ধান্তগুলো যে মিথ্যে তাহলে তা ওখানেই প্রকাশ করে দেওয়া যাক। বলে দিই না কেন যে ওর সংগীত হলো একেবারে অন্য জিনিস।

জনি শুনতে পাচ্ছ, একটু আগেই বলছিলে আমার বইটায় অনেক কিছু নেই।

(এখন, সচকিত)

কী নেই ব্রুনো ? আহ, হ্যাঁ তোকে বলেছি যে অনেক কিছু নেই ওখানে। দেখ, এটা শুধু লানের লাল পোশাক নয়। এরা… ওগুলো কি সত্যি সত্যিই ফুলদানি, ব্রুনো ? কাল রাতে আবার দেখলাম। একটা বিশাল মাঠ। তার ভেতর ফুলদানিগুলো। তবে তখন আর এতটা আটকে পড়া নয়। কারও গায়ে নানা ছবি, লেখা খোদাই করা। সিনেমায় যেমন দেখায় ঠিক সেরকম বিশালাকৃতি বর্ম পরা দৈত্যের মতো দেখাচ্ছিল। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। ফুলদানিগুলোর মাঝখান দিয়ে হাঁটা ভয়ংকর, যখন জানা যে সেখানে আর কিচ্ছু নেই। আমি একা তাদের মাঝখান দিয়ে হাঁটছি। দুঃখ করিস না, ব্রুনো। তুই যে এসব লিখেছিস সেসব তুই ভুলে গেছিস কি না তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু ব্রুনো―আমার একটা আঙুল তোল তো দেখি যেটা কাঁপছে না।―ভুলে গেছিস ওটা আমার আঙুল।

জনি, চলো ওঠা যাক।

আমার আঙুল, ব্রুনো, আমার আঙুল। আমার পক্ষে যা কখনও বাজানো সম্ভব হয়নি তা নিয়ে তুই যে লিখিসনি সে তোর দোষ নয়। সেখানে যখন তুই বলিস যে আমার আসল আত্মজীবনী আছে ওই ডিস্কগুলোতে। আমি জানি তুই সত্যতে বিশ্বাস রাখিস। তাছাড়া কথাটা শুনতেও ভালো লাগে। কিন্তু আসলে তো তা নয়। আমি নিজে তো জেনেছি যা বাজানো দরকার তা পারি না, যা সত্যি তাই বাজাই… দেখছিসই তো তুই তো আর কোনও জাদু আশা করতে পারিস না, ব্রুনো। এখানে ভেতরে খুব গরম, চল বাইরে যাই আমরা।

রাস্তায় বেরিয়ে ওর পিছু পিছু হাঁটছিলাম। কয়েক মিটার হাঁটতে হাঁটতেই একটা অন্ধগলির ভেতরে একটা সাদা বিড়াল আমাদের সামনে এসে গেল। জনি অনেকক্ষণ ধরে ওটাকে আদর করতে লাগল। ইয়ে যথেষ্ট হয়েছে। শঁ মিশেল প্লাজাতে ট্যাক্সি পাব, ওটায় করে ওকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে নিজে বাড়ি পৌঁছতে পারব। এতসব কিছুর পরে আর তেমন ভয়ংকর লাগছে না। এক মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়েছিলাম জনি বুঝি বইটার একটা বিরোধী তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে বলবে। সেসব নিয়ে বলবে যা কি না প্রকাশ করার আগেই যথেষ্ট ঢাকাঢুকি দিয়েছি। বেচারা জনি সাদা বিড়ালটা আদর করে যাচ্ছে। ভেতরে যে একমাত্র কথা আমি বলেছি তাহলো কেউ কোনও কিছু সম্বন্ধে কিচ্ছু জানে না। আর আমিও তার নতুন কোনও ব্যতিক্রম নই। ওই জীবনীগ্রন্থ নিশ্চিত এগিয়ে যাবে। কী শয়তানি কারবার এসব! চল, জনি, ওঠা যাক। বাড়ি যাই দেরি হয়ে গেছে।

তুই বিশ্বাস করিস না স্রেফ ওটাই হয়―সপাটে বলল জনি যেন ও জানতে পেরেছিল আমি কী নিয়ে ভাবছি। ―ভগবান আছে, ডিয়ার। আমি জানি তুই কিছু আটকে দিসনি।

চলো জনি আমরা উঠি, বাড়ি যাই। দেরি হয়ে গেছে।

এটা তুই আর ঐ ওরা যারা আমার সঙ্গে থাকে ব্রুনো, তারা ঈশ্বরকে ডাকে। সকালবেলার টুথপেস্ট টিউব, ওরা তাকে ঈশ্বর বলে ডাকে। নোংরা ফেলার বালতি―ওটাকে ওরা ঈশ্বর বলে ডাকে। ফেটে পড়বার ভয়―ওটাকে ওরা ঈশ্বর বলে ডাকে। এসব নোংরার সঙ্গে আমাকে মিশিয়ে দিতে তোর লজ্জা করেছে। তুই লিখেছিস আমার শৈশব, আমার পরিবার সম্বন্ধে। জানি না আমার কোনও পারিবারিক ঐতিহ্য আছে… এক পাহাড় পচা ডিম, আর তুই তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গর্ত খুঁড়ছিস। তোর ঈশ্বরকে নিয়ে বেজায় সন্তুষ্ট। তোর ঈশ্বরকে আমি ভালোবাসি না। সে কখনও আমার হয়নি।

আমি একমাত্র যা বলেছি তা হলো কালো সংগীত…

তোর ঈশ্বরকে ভালোবাসি না―জনি আবার বলল―তোর বইতে তাঁকে গ্রহণ করতে বলিস কেন আমাকে ? জানি না ঈশ্বর বলে কেউ আছে কি না। আমি আমার বাজনা বাজাই। আমি আমার ঈশ্বর সেবা করি। তোদের আবিষ্কারের কোনও দরকার নেই আমার। ওসব ঐ গসপেল গাইয়ে মাহালিয়া জ্যাকসন বা পাপা ওদের জন্য রেখে দে। তোর বই থেকে এখনই অংশটা বাদ দিয়ে দে।

তুমি যদি জোর করো তাহলে কিছু একটা বলবার জন্যই কথাটা বললাম।―পরের সংস্করণে বাদ দেব।

বিড়ালটার মতো আমি এত একা। ঢের বেশিই একা। কারণ আমি জানি আমি একা, ও তা জানে না। শাস্তিপ্রাপ্ত। আমার হাতে ওর নখ বসিয়ে দিচ্ছে। ব্রুনো, জ্যাজ স্রেফ সংগীত নয়, আমিও শুধু জনি কার্টার নই।

ঠিক যেমন বলতে চাইছো আমি তো ঠিক তাই লিখেছি যে মাঝেমাঝে তুমি ঠিক…

যেন আমার পাছায় বৃষ্টি পড়ে―জনি বলল―আজকের রাতে এই প্রথম রেগে যাবার জন্য আমি দুঃখিত, আর কিছু বলা সম্ভব নয়। সঙ্গে সঙ্গে তোর নোংরা ভাষায় তুই অনুবাদ করে দিবি। যখন বাজাই তুই দেবদূতদের দেখতে পাস। সে তো আমার দোষ নয়। অন্যরা যদি মুখ খোলে আর বলে আমি নিখুঁততায় পৌঁছে গেছি সে তো আমার দোষ নয়। এটা তো আরও খারাপ। তোর বইতে যেটা তুই সত্যি ভুলেছিস বলতে ব্রুনো, সেটা হলো আমার কোনও মূল্য নেই। যা বাজাই তা শুনে লোকে যে হাততালি দেয় তার কোনও দাম নেই। সত্যিই কোনও মূল্য নেই।

বিরল বিনয়, সত্যিকারের। রাতের এই প্রহরে। এই জনি…

কেমন করে ব্যাখ্যা করি ?―আমার কাঁধে হাত রেখে ডান থেকে বাঁ দিকে নাড়াতে নাড়াতে জনি চিৎকার করছিল। (প্যাঁ! শান্তি! কোনও একটা জানলা থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলল)―এটা বেশি সংগীত বা কম সংগীতের ব্যাপারই না। এ অন্য জিনিস… যেমন ধর বি মরে গেছে আর বি বেঁচে আছে―দুটো বিষয়ের মধ্যে যতখানি ফারাক এদের মধ্যেও ঠিক ততটাই ফারাক। আমি যা বাজাই তাহলো বি মরে গেছে। জানিস, এই ফাঁকে আমি ভালোবাসতে থাকি, ভালোবাসতেই থাকি… ওই জন্যই মাঝে মাঝে স্যাক্সোটা মাড়াই। লোকে ভাবে আমি মদের দখলে চলে গেছি। হ্যাঁ, এটা ঠিকই। বাস্তবে এসব যখন করি তখন সবসময় মাতাল থাকি। কারণে শেষে সব মিটে গেলে স্যাক্সোর জন্য অনেক টাকা লাগে।

এখান থেকে চলো। তোমাকে ট্যাক্সি করে পৌঁছে দেই।

তুই ভালোর সমুদ্র, ব্রুনো।―ঠাট্টা করল জনি―এই আমার চ্যালা ব্রুনো কেউ যখন কিছু বলে একটা নোটবইতে টুকে নেয় সব। শুধু দরকারি জিনিসগুলো ছাড়া। যত দিন না আর্ট বইটা আমার হাতে দিল তার আগে কখনও ভাবিনি তুই এত কিছু বাদ দিতে পারবি। প্রথমটায় ভেবেছিলাম তুই হয়তো রিনি বা মারসেল অন্য কারও সম্বন্ধে এসব লিখেছিস। তারপর দেখলাম এখানকার জনির সম্বন্ধে লেখা। তারপর ভাবলাম হয়তো অন্য কোথাকার জনির ব্যাপারে লেখা। কিন্তু এটা বলা যে আমার সম্পর্কে লেখা। নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু এই কি আমি ? আমার সঙ্গে বাল্টিমোরে কিংবা বার্ডল্যান্ডে চল, এটাই আমার স্টাইল, শোন―প্রায় শীতল গলায় জনি আরও যোগ করল―তুই পাবলিকের মন রাখার জন্য বই লিখেছিস, সেটা যে আমি খেয়াল করিনি তা নয়। সে ভালো। আমার বাজানোর স্টাইল নিয়ে তুই যা যা বলেছিস, জ্যাজ সম্বন্ধে যা যা ভাবি সেসব নিয়ে তুই যা যা বলেছিস সেসব নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। ওগুলো ঠিক আছে। আচ্ছা, এ বই নিয়ে আমরা কথা বলা চালিয়ে যাচ্ছি কেন ? শ্যেন নদীর বুকে এক টুকরো নোংরা। জেটির ধার ঘেঁষে ঘেঁষে চলা খড়বিচালির মতো তোর ঐ বই। আর আমি নিজেও আরেক রকম খড়বিচালি। তুই বোতলটা পুরো গলায় ঢেলে দে, আমরা তো নেশা করছি। ব্রুনো, আমি দেখা না করেই মরে যাব… না করেই…

বগলের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে সোজা করে ওকে সামলালাম। জেটির পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করালাম।

দেখা না করেই―ফের বলল―দেখা না করেই…

কী দেখা করতে চেয়েছিলে, ভাই―ওকে বললাম―অসম্ভব জিনিস চেও না। তুমি যা দেখেছো সেসব যথেষ্টর চেয়েও বেশি…

সে তোর কাছে তাই। আমি জানি।―তেতো গলায় বলে জনি।―আর্টের জন্য, দেদের জন্য, লানের জন্য… তুই জানিস না কীভাবে… হ্যাঁ, মাঝে মাঝে দরজা খুলতে শুরু করেছে… ঐ দুই খড়বিচালির দিকে তাকিয়ে দেখ, ওরা দেখেছে। ওরা একে অন্যের সামনে নাচছে… এটা সুন্দর, অ্যাঁ… খুলতে শুরু করেছে… সময়… তোকে বলেছি না যে মনে হয় এটা সময়ের ব্যাপার। ব্রুনো, সমস্ত জীবন আমি খুঁজেছি আমার সংগীতে এই দরজা যাতে খোলে। একজন মানুষ কেউ না, এক টুকরো খড়বিচালি স্রেফ… মনে পড়ে নিউ ইয়র্কে এক রাত। একটা লাল পোশাক। হ্যাঁ লাল, দেখাচ্ছিল অপূর্ব। ইয়ে, সেদিন রাতে আমি মিলেস আর হালের সঙ্গে ছিলাম… মনে পড়ে এক ঘণ্টা একলা ছিলাম, একা একা, এত সুখী… মিলেস কিছু একটা বাজিয়েছিল এত সুন্দর যে আমি চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলাম। তারপর শুয়ে পড়লাম। চোখ দুটো বুজে, প্রায় উড়ছিলাম। ব্রুনো, তোকে দিব্যি কেটে বলছি আমি উড়ছিলাম… মনে হচ্ছিল যেন অনেক দূরের কোনও জায়গা থেকে সে বাজনা শুনছিলাম, তবে সে জায়গাও আমার ভেতরেই। কেউ একজন দাঁড়িয়েছিল… না আসলে ঠিক অন্য আরেকজনই ছিল তা নয়… বোতলটাকে দেখ। কীভাবে মাথা দোলাচ্ছে দেখ, অবিশ্বাস্য… ওটা কেউ একজন ছিল না। লোকে তুলনা খুঁজতে চায়। ওটা ছিল নিশ্চয়তা। একটি সাক্ষাৎ বিশেষ। কোনও কোনও স্বপ্নে যেমন হয়। তোর মনে হয় না ? যখন সবকিছু স্থির প্রত্যয়, তখন লান আর অন্য মেয়েরা টার্কির মাংস রান্না করে তোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। বাসে উঠতে গেলে কোনও লাল রঙ অবশ্য তোকে আটকে দেয় না। সবকিছু কেমন বিলিয়ার্ড বলের মতো মিষ্টি। পাশে যা ছিল সে তো আমি কোনও জায়গা দখল করিনি। নিউ ইয়র্কে ছিলাম না। সবচেয়ে বড় কথা কালহীন এই থাকা… যতক্ষণ না পরে… যতক্ষণে হলেও হতে পারত পরে… এক মুহূর্তের হয়ে উঠত অনন্ত, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়… আসলে জানতাম না ওটা মিথ্যা ছিল। ওটা ঘটেছিল কারণ আমি সংগীতের ভিতর হারিয়ে গিয়েছিলাম। বাজানো শেষ করতে চলেছিলাম। তাছাড়া কারণ যাই হোক না কেন একবার মন থেকে পিয়ানো বাজানোর ইচ্ছেটা সরিয়ে দিতে হয়েছিল। সে সময় নিজেই নিজের মধ্যে হঠকারিভাবে পড়ে গিয়েছিলাম।

জনি মিষ্টি করে কাঁদছিল। নোংরা হাত দিয়ে চোখ ঘষল। তখনও জানি না কী করব। এত রাত হয়ে গেছে। নদী থেকে ধোঁয়া উঠছে। আমাদের দুজনেরই ঠান্ডা লেগে যাবে এবার।

মনে হয় হয় জল ছাড়া কিছুই ভালোবাসিনি―জনি বিড়বিড় করে বলল―মনে হয় লানের লাল পোশাকটা পেতে ইচ্ছে করেছে তবে লানকে নয়। আর বি তো মরেই গেছে, ব্রুনো। মনে হয় তুই ঠিক বলছিস। তোর বইটা সত্যিই খুব ভালো।

জনি, চলো। তোমার বাজে লেগেছে সেটা দেখে খারাপ লাগুক চাই না।

তা নয়। তোর বইটা ভালো কারণ… কারণ ওটার মধ্যে ফুলদানি নেই, ব্রুনো। এটা অনেকটা সাচমো যেমন করে ট্রাম্পেট বাজায় সেরকম, এত পরিষ্কার বাজনা, এত শুদ্ধ। তোর মনে হয় না সাচমো যা বাজায় তা অনেকটা জন্মদিনের মতো কিংবা কোনও ভালো ঘটনার মতো ? আমরা… শোন, আমি জল ছাড়া স্নান করতে ভালো বেসেছি। মনে হতো… একটু বোকা হওয়া দরকার… মনে হতো কোনও এক দিন অন্য কিছুর সঙ্গে আমার পরিচয় হবে। সন্তুষ্ট ছিলাম না। ভালো ভালো জিনিসের কথা ভাবতাম, লানের লাল পোশাকের কথা মনে পড়ত, এমনকি বিকেও মনে পড়ত। সেসব যেন ইঁদুরের কল। নিজেকে অন্য কোনওভাবে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না। এ এক ধরনের ফাঁদ, মানুষ যা মেনে চলে। লোকে যাতে প্রশংসা করে বলে খুব ভালো। ব্রুনো, আমি লান আর জ্যাজ দুয়েই বিশ্বাস করি। জ্যাজেও, হ্যাঁ এমনকি জ্যাজেও বিশ্বাস করি। এসব যেন সংবাদপত্রে বেরোনো বিজ্ঞপ্তির মতো। ভালো ভালো জিনিস নিয়ে আমি মেতে থাকি, তুইও যেমন থাকিস। কারণ তোর কাছে প্যারিস আছে, তোর বৌ আছে, তোর কাজ আছে… আমার আছে স্যাক্সো… আমার আছে সেক্স… বইটাতে যেভাবে লেখা। যা যা সব লেখা নেই। ফাঁদ, ডিয়ার… কারণ অন্য কিছু হতে পারে না। আমরা এতখানি কাছে তা হতে পারে না, দরজার ঠিক উলটো দিকেই―এমনটা হতেই পারে না…

একমাত্র একটা বস্তুরই শেষমেষ মূল্য থাকে, তাহলো দান করা। মানে দান করা যদি সম্ভব হয়, তাহলেই―বোকা পাঁঠার মতো বললাম।            

আর ডাউন বিট গানের পত্রিকা প্রত্যেক বছর যে গণভোট নেয় তাতে জয়লাভ করা, ঠিক ঠিক―জনি সমর্থন করল―হ্যাঁ নিশ্চয়ই, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

আস্তে আস্তে ওকে প্লাজা পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। ভাগ্য ভালো কর্নারে একটা ট্যাক্সি ছিল।

সবচেয়ে বড় কথা তোর ঈশ্বরকে আমি স্বীকার করব না―জনি বিড়বিড় করে বলল। ওসব নিয়ে আমার কাছে আসবি না। অনুমতি দেব না। সত্যিই যদি দরজার ওপাশে থেকে থাকিস, আর তাতে আমার কিস্যু যদি এসেও যায় তবু তা নিপাত যাক। ওপাশে যাবার মতো কোনও বুদ্ধিই তোর ঈশ্বরের নেই। কারণ তোকে ও দরজা খুলে দেয়। লাথি মেরে ওর মুখোশ খুলে দেওয়া উচিত। ওটাই দরকার। এক ঘুষিতে ওকে ভেঙে ফেলা। দরজার গায়ে বীর্যপাত করা। একটা গোটা দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দরজায় পেচ্ছাপ করা। সেবার নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠানে গিয়ে বোধহয় আমি বাজনা দিয়ে দরজাটা খুলে দিয়েছিলাম। বাজানো থামাচ্ছিলাম না বলে ও বদ আমার মুখের ওপর বন্ধ করে দিল। ব্যস। কারণ আমি তো কখনও অনুরোধ করিনি। কারণ কোনও দিন অনুরোধ করতেও যাব না। কারণ ঐ চাপরাশির কাছে আমি কিছু জানতেও চাই না। সামান্য ঘুষের বিনিময়ে লোকটা দরজা খুলে দেয়, ঐ লোক…

বেচারা জনি! এর পরেই আমায় অনুরোধ করল বইতে যেন এসব না যায়। ভোর তখন তিনটে। ঈশ্বর!

তিকা নিউ ইয়র্কে ফিরে এসেছে। জনি নিউ ইয়র্কে ফিরে গেছে (দেদেকে ছাড়াই। কারণ ও লুইস পেরনের বাড়িতে ভালো রকমই জাঁকিয়ে বসেছে। লুইস একজন প্রতিশ্রুতিবান ট্রোম্বোন বাজিয়ে।) বেবি লেনক্স নিউ ইয়র্কে ফিরে এসেছে। প্যারিসে ঋতুটা বিরাট কোনও বিষয় নয়। আমার বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ছিল। জনিকে নিয়ে লেখা আমার বইটা সব জায়গায় খুব ভালো বিক্রি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই স্যামুয়েল প্রেতসেলের সঙ্গে হলিউডে বইটা নিয়ে একট আসিনেমার ব্যাপারে সম্ভাব্য অ্যাডাপ্টেশন নিয়ে কথা চলছে। ফ্রাংক আর ডলারের মূল্যমানের কথা ভাবলে বরাবর বিষয়টা আগ্রহজনক। বেবি লেনক্সের সঙ্গে আমার পুরনো ইতিহাসের কথা জানে বলে বৌ রেগে থাকবে যদিও। বাকিদের জন্য দারুণ কোনও বিপদ নয়। সর্বোপরি বেবি বেশ চোখে পড়ার মতো অশ্লীল মেয়ে। যেকোনও বুদ্ধিমতী মেয়েই ঠিক বুঝতে পারবে যে এসব জিনিস দাম্পত্য সমতার মধ্যে কোনও বিপদে আনে না। একটাই ব্যাপার জনির সঙ্গে বেবি নিউ ইয়র্কে ফিরে গেছে। একদম শেষ মুহূর্তে চাইল জনির সঙ্গে এক জাহাজে জনির সঙ্গে চলে যাবে। আমোরোউস ডিস্কটা প্যারিস থেকে বেরিয়ে গেছে। ঠিক তখন আমার বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণও প্রেসে চলে গিয়েছে। ওটা জার্মানে অনুবাদের কথা বলছে। আমি ভেবে ফেলেছি দ্বিতীয় সংস্করণে কী কী সংশোধন করব। আমার পেশা আমায় যেভাবে কাজটা করতে দিয়েছে তাতে আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল জীবনী বইটির মানুষটির অন্য কোনও নতুন দিকে আলো ফেলা দরকার আছে কি না। দেলাউনাই আর ওদেইর সঙ্গে বহুবার আলোচনা করেছি। ওরা সত্যি সত্যি জানত না আমায় কী উপদেশ দেবে। কিন্তু দেখল বইটা দুর্দান্ত আর লোকজন এভাবে পড়তেই খুশি হচ্ছে। মনে হলো জ্ঞান দিই কেন ওদের ভয় হচ্ছে বইয়ে শেষমেশ সাহিত্য ঢুকে সংক্রামিত করবে কি না। শেষ পর্যন্ত সামান্য কিছু সংশোধন করলাম বটে, তবে তার সঙ্গে জনির সংগীতের কোনও সম্পর্ক নেই। অন্তত আমরা সবাই তেমনটাই বুঝলাম। মনে হলো যারা ভারপ্রাপ্ত লোক তাদের মত (আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এই যে এই উচ্চতায় ব্যাপারটা অস্বীকার করা বোকামি) ছিল যে, এ অবস্থায় দ্বিতীয় সংস্করণটা বের করাটাই সঠিক। ইউনাইটেড স্টেটসের বিশেষ ম্যাগাজিনগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া (জনিকে নতুন করে চারজন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছে ওর আত্মহত্যা করার প্রবণতা বিষয়ে। এ দফায় সামান্য টিংচার আয়োডিন লাগিয়ে সংবাদটা পরিবেশন করেছে। গ্যাস্ট্রিক টিউব আর হাসপাতালে থাকা তিন মাস, নতুন করে ফের বাল্টিমোর প্রসঙ্গ যেন কোনও ব্যাপারই নয়) আমাকে যথেষ্ট ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। নতুন করে মনে যন্ত্রণা চাগিয়ে দিয়েছিল―এছাড়া আর কিছু হয়নি। বই সম্পর্কে জনি একটাও আপসকামী কথা বলেনি। যেমন (স্টম্পিং অ্যারাউন্ড, শিকাগোর একটা সংগীত বিষয়ক ম্যাগাজিন। ওখানে জনিকে নেওয়া টেডি রজার্সের সাক্ষাৎকার) ‘পড়েছিস ব্রুনো কী লিখেছে …প্যারিসে তোর সঙ্গে কী হয়েছিল ?’ ‘হ্যাঁ, ভালো’ ‘বইটা নিয়ে তোর কিছু বলার নেই ?’ ‘ছাড়া আর কিছু ভালো বই―এছাড়া বলার কিছু নেই।―ব্রুনো খুব ভালো ছেলে।’ জনি মাতাল হলে কিংবা ড্রাগে নেশাসক্ত হয়ে যখন হাঁটবে তখন কী বলতে পারবে সেটা জানতে কৌতূহল ছিল, তাই রয়ে গিয়েছিলাম। তবে ওর তরফ থেকে অন্তত কোনও অস্বীকারের কথা শুনিনি। ঠিক করলাম দ্বিতীয় সংস্করণ বের করার সময় ও বই ছোঁব না। মনের গভীরে জনি যেমন ওকে সেভাবেই উপস্থাপনা করে যাব। বেচারা বুদ্ধিমান শয়তান, মিডিওকার তো কোনওভাবেই নয়। বরং যেমন সংগীতময় তেমনই প্রতিভাবান। আবার তেমনই দাবাড়ু। এমন কবিত্বময় মানুষ যে কি না অসাধারণ সব জিনিস সৃষ্টি করে, অথচ নিজের সৃষ্টির বহুমুখী দিক সম্পর্কে একেবারেই সচেতন নয়। (এক কথায় এমন একজন বক্সার যিনি নিজের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন নন)। আমার মনে জনির ছবি এঁকে দিয়েছে এসব বিষয়ই। জ্যাজপ্রেমী পাবলিক তাকে ভালোবাসে অথচ তার সাংগীতিক বা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ জানে না… এ ধরনের কিছু বক্তব্য রেখে জটিলতা সৃষ্টি করতে চাই না। এটা করলে মুহূর্তের জন্য তৃপ্তি যে হয় না কিংবা লেখা ভালো রকমের ছাঁটকাট করা হয় না তা নয়। আসলে হাতেরা ছন্দ লেখে। মুখ তখন প্রস্ফুটিত সুন্দর হয়ে ওঠে। ত্বক দিয়ে সংগীত চলাচল করে। শ্বাস রক্তে মিশে যায় সে সংগীত। ব্যস ওটুকুই যথেষ্ট। অন্য কোনও গভীর কারণ লাগে না।

টেলিগ্রামগুলো এসে পৌঁছল আগেই (দেলাউনাইকে, আমাকে, বিকেলের দিকে বেরল সেসব। সঙ্গে রইল বোকা বোকা সব মন্তব্য); বেবি লেনক্সের চিঠি আসার কুড়ি দিন পরেও আমাকে ও ভুলে যায়নি। ‘বেলভিউতে ওরা দুর্দান্ত চেষ্টা করেছে আর আমি খুঁজতে বেরিয়েছি বইটা কখন বের হলো’। মাইক রুসোল্লোর ডিপার্টমেন্টে ছিলাম আমরা। মাইক নরওয়ে ভ্রমণ করে ফিরে এসেছিল সদ্য। জনি তখন খুব ভালো ছিল। যদিও পাব্লিক পারফরম্যান্স করতে চাইছিল না। ২৮ নম্বর ক্লাবের সঙ্গে ডিস্ক রেকর্ড করতে চাইল। তোমাকে বলতে পারি আসলে শারীরিকভাবে তখন খুব দুর্বল ছিল। (প্যারিসে আমাদের অভিযানের পরে কল্পনা করছি বেবি এটা নিয়ে কী বোঝাতে চাইবে)। রাতে ও যেভাবে শ্বাস নিত আমার ভয় করত। বারবার শরীর নিয়ে অভিযোগ করত। আমাকে একমাত্র যা সান্ত্বনা দিল―বেবি লোভনীয়ভাবে যোগ দিল―জনি সুখে মরেছিল, এবং মরবে যে সে কথা না জেনেই মরেছিল। এক দিন টিভি দেখছিল, তারপর দুম করে মেঝেয় পড়ে গেল। ওরা বলেছিল ঘটনাটা নাকি একদম সঙ্গে সঙ্গে হয়েছিল। কোথা থেকে ওরা আন্দাজ করেছিল যে বেবি ওখানে উপস্থিত ছিলই না। কেননা পরে আমরা জানতে পেরেছিলাম জনি তখন তিকার বাড়িতে থাকছিল। তিকার সঙ্গে পাঁচদিন ছিল। উৎকণ্ঠিত আর মনমরা হয়ে থাকতে গিয়ে কী ঘটেছিল ঐ পাঁচ দিন জানি না। জ্যাজ ছেড়ে দেবে, মেক্সিকো চলে যাবে, মাঠে কাজ করবে এমন সব কথা নাকি বলেছিল। (ওর জীবনে কোনও না কোনও সময় এরা সবাই এসেছিল। এটা প্রায় বোরিং)। তিকা ওকে চোখে চোখে রাখত, এমনকি ঘুম পাড়ানোর দরকার হলে সেটাও করত। বা ভবিষ্যতের কথা ভাবতে বাধ্য করত। (এসব কথা তিকা পরে বলেছিল। যেন জনি বা ওর কারওরই ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণাও ছিল না।) একটা টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাঝপথে সেখানে জনির খুব প্রশংসা করা হচ্ছিল, জনি সেখানে কাশতে শুরু করে। হঠাৎ করে নাকি নুয়ে পড়ে। তিকা পুলিশের কাছে সব বলেছিল। ওর মৃত্যু নিয়ে যা যা বলেছিল তা সবই সত্যি কি না আমি নিশ্চিত নই। (জনি মারা যাবার ফলে ওর ডিপার্টমেন্টে যে গোলমাল শুরু হয়েছিল সেটা এড়াতে চেষ্টা করেছিল। হাতের সামনেই ছিল মারিজুয়ানা। বেচারা তিকার আগের কিছু সমস্যা… জনির অটোপ্সি রিপোর্টে খুব বিশ্বাসযোগ্য কিছু পাওয়া যায়নি। ওর লিভার আর ফুসফুসে ডাক্তার কী কী পেয়েছিলেন সে তুমি আন্দাজ করেই নিতে পারো।) ‘জানতে চেও না ওর মৃত্যু আমায় কতখানি যন্ত্রণা দিয়েছে। আমি অবশ্য আরও কিছু বলতে পারব।―গলায় মধু ঢেলে বেবি মিষ্টি করে যোগ করল তবু কখনও মন আরেকটু ভালো হয় যদি, তোমাকে সব লিখব বা বলব (মনে হচ্ছে রজার্স প্যারিস আর বার্লিনের জন্য আমাকে ভাড়া করতে চায়) যা কিছু প্রয়োজন তুমি নিশ্চয়ই জানো, জনির তুমিই ছিলে সবচেয়ে কাছের বন্ধু।’ তারপর তিকার জন্য পুরো মাথা ঢাকা দেওয়া কস্ট্যিয়ুম অপমানসূচকও বটে। তাছাড়া আর জনির মৃত্যুর জন্য ওঁকেই দায়ী করা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিকা দায়ী নয়। তাই যদি হয় তাহলে সে পার্ল হারবারের আক্রমণের জন্য কিংবা ব্ল্যাক ডেথের জন্যও দায়ী। বেবি এই বলে কথা শেষ করল ‘বেলভিউতে থাকার সময় এক দিন ও খুব জিজ্ঞাসা করছিল তোমার ব্যাপারে।’ সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলত ও। ভাবছিল তুমি নিউ ইয়র্কে আছ। ওকে দেখতে যেতে চাও না। সবসময় গল্প করত একটা মাঠের কথা, কী দিয়ে যেন সে মাঠ ভরা। তারপর তোমায় ডাকত। এমনকি তোমার কথাগুলোও নিজেই বলত। বেচারা। তুমি জানো ওর জ্বর হতো। বব ক্যারেকে তিকা বলেছিল জনির শেষ কথাগুলো অনেকটা এরকম ছিল ‘ওহ আমায় কাজল পরিয়ে দাও’। কল্পনা করতে পারছো মুহূর্তটা… আহ আমি যদি তা কল্পনা করতেই পারতাম। ‘ও খুব মোটা হয়ে গিয়েছিল’। চিঠির শেষে বেবি আরও একটু যোগ করল ‘হাঁটতে গেলে হাঁপাত’। ওইসব অনুপুঙ্খ বিবরণ বেবি লেনক্সের মতো সংবেদনশীল মানুষের জন্যই সবচেয়ে খাপে খাপ হয়।

আমার বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ বের হওয়ার সময় এসব ঘটনা একসঙ্গে ঘটে। আর তাই সৌভাগ্যবশত আমিও এই সংস্করণে সাজানো গোছানো মৃত্যুবিষয়ক বার্তা যোগ করে দিতে পারি। আর কবর দেবার সময়কার একখানা ফটো। সেখানে বহু বিখ্যাত জ্যাজশিল্পীদের দেখা যাচ্ছে। এভাবেই জীবনীটা দাঁড়িয়েছিল। এভাবেই বলতে, এই সম্পূর্ণ কাহিনি। এভাবে বলাটা বোধহয় ভালো শোনাল না। কিন্তু বক্তব্য স্বাভাবিক বলে সেটা আবার পুরো নান্দনিক এক স্তরে বসিয়ে দিল। এখন আরও একটা নতুন অনুবাদ সম্বন্ধে কথা চলছে। মনে হয় সুইডিশ বা নরওয়েজিয়ান ভাষায় হবে সেটা। আমার বউ খবরটা জেনে খুব খুশি।

কলকাতা থেকে

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button