আর্কাইভকথাসাহিত্য

একটি দরজার গোপন ইতিহাস : মূল : বেন ওকরি : বাংলা অনুবাদ :  রঞ্জনা ব্যানার্জী

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

[বেন ওকরি নাইজেরিয়ার মিন্না শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা দিয়ে তাঁর সাহিত্যজগতে প্রকাশ ঘটলেও ক্রমে একাধারে একজন সফল ঔপন্যসিক, গল্পকার, নাট্যকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

তাঁর সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাসটির নাম The Famished Road। এই উপন্যাসের জন্য তাঁকে ১৯৯১ সনে ম্যান বুকার পুরস্কারে

ভূষিত করা হয়।] 

উগেইট কারাগার গুঁড়িয়ে দেওয়া হলে এর ইট এবং ধাতুর টুকরা লন্ডনের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছিল। যে মঞ্চে লোকজনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হতো সেটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জনশ্রুতি আছে―সেই রক্তভেজা কাঠ ফাটার সময় ধোঁয়ার ভেতর থেকে নির্দোষ আসামিদের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। 

এই কুখ্যাত জেলখানার সবচেয়ে অদ্ভুত বস্তুটিকে নিয়ে কী করা যায় কেউ ভেবে পাচ্ছিল না। এটি একটি দরজা। দরজাটি ছিল নিরেট লোহার তৈরি, দুর্ভেদ্য। ছোট জানালার মতো চৌকো গর্ত তাতে। এবং সারা গা জুড়ে লোহার পেরেক আর অতিকায় এক হুড়কো আঁটা। 

বলা হতো, এই দরজাটি দৃষ্টিসীমায় আসার আগ পর্যন্ত কারাগারে আনা আসামিদের ঠাটবাট অটুট থাকত। এছাড়া লোকে বিশ্বাস করত যে, এই অভিশপ্ত দরজাটি মন্দলোকের হৃদয়কে অনুভূতিহীন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। 

অন্যদিকে দরজাটির সামনে এলে নিরপরাধ ব্যক্তিরা এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করত, এবং ভেতরে প্রবেশের পরে পেছনের হুড়কা টানার ধাতব আওয়াজটি তাদের কাছে সাদর অভ্যর্থনা, এককথায়, ঐশীধ্বনির মতো শোনাতো।   

কিন্তু খুনি, শিশু-নিপীড়ক এবং দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের কাছে এই দরজা ছিল নরকের প্রতীক। দরজাটির হুড়কা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের জীবনে অন্ধকার চেপে বসত। 

একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দরজাটি পুরুষ এবং স্ত্রীজাতির যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করেছিল। মানুষের অন্তর থেকে উদ্ভূত অপচিন্তার সম্ভাব্য সকল বিন্যাস এবং আক্রান্ত অন্তরটির পচনের প্রক্রিয়া সে আত্মস্থ করেছিল। অতঃপর দরজাটি ক্রমশ পাপে কঠিন, শোকে মূক, এবং অনাচারে ভারী হয়ে উঠেছিল ।

আধ্যাত্মিক সাধকেরা বিশ্বাস করেন, জড়বস্তু তার নিকটস্থ প্রাণসমূহের সকল আবেগ শুষে নিতে সক্ষম। এই দরজাটি যা কিনা পোড়ানো কিংবা ভাঙা সম্ভব হয়নি, সেটি মানব প্রজাতির মনের গভীরতম তলটির ভয়ঙ্কর সাক্ষী বনে গিয়েছিল। যখন নিউগেইট কারাগার ধ্বংস করা হয়েছিল তখন কারাগারের হৃৎপিণ্ড সেই বিশাল ধাতব দরজাটির নিয়তি কী হতে পারে কারও জানা ছিল না।

দরজাটি একসময় বিস্মৃত হয়ে শহরের কোনওখানে আবর্জনার গাদায় ঠাঁই পেয়েছিল। যেখানে এটি ছিল সেই জায়গায় অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটত। এটি দণ্ডিত অপরাধীদের আত্মার প্রবেশদ্বার হয়ে উঠেছিল, যা দিয়ে তারা একবারের জন্য সেই পৃথিবীতে ফিরতে সক্ষম হতো, যে পৃথিবী তাদের চিরতরে পরিত্যাগ করেছিল। প্রতিশোধ-স্পৃহা বুকে নিয়ে তারা শহরময় ঘুরে বেড়াত।

ইতিহাসবিদদের মতে প্রাচীন মিশরীয় কবরগুলোতে আলগা দরজা আছে যা দিয়ে মৃতদের আত্মা জীবিত পরিজনদের নিবেদন করা ভোজ গ্রহণ করতে পারে। নিউগেইট কারাগারের এই পরিত্যক্ত দরজাটি মৃত অপরাধীদের প্রবেশদ্বার হয়ে উঠেছিল।  

নিশুতি রাতে মহাসড়কের কুখ্যাত ডাকাত, খুনি, ধর্ষক এবং অগ্নিসংযোগকারীদের আত্মা এই পরিত্যক্ত দরজা দিয়ে শহরে ঢোকার রাস্তা পেয়ে যেত এবং তাদের অপরাধ-চিন্তার ঢেউ সংশয়হীন শহরটির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিত। প্রাচীন-প্রথার অপরাধের হঠাৎ উত্থানে পুলিশবাহিনী হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন অপরাধী-দলগুলো তাদের সুদূর―বিস্মৃত পূর্বসূরি ভ্রাতৃসঙ্ঘের কাছ থেকে অভূতপূর্ব প্রণোদনায় প্লাবিত হচ্ছে। পুলিশের কাছে এমনও মনে হতো যে, গুপ্ত আস্তানায় ঘাপটি মেরে থাকা অতীতের অপরাধী সংগঠনগুলো পুনর্জীবনপ্রাপ্ত হয়েছে।  

‘এটিই দেশের নিকৃষ্টতম অশুভ দরজা’, এক ধর্মযাজক রায় দিয়েছিলেন।

‘দেশের সবচেয়ে বেদনার্ত দরজা এটি’, আত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগে সক্ষম এক বিখ্যাত ‘মাধ্যম’ ঘোষণা দিয়েছিলেন।  

দরজাটির আশেপাশের বাসিন্দারা দাবি করেছিল, রাতে দরজার ভেতর থেকে নরকে আটক আত্মাদের কান্নার শব্দ শুনতে পায় তারা। হুড়কা খোলা এবং বাঁধার ধাতব আওয়াজ তাদের রাতের প্রহরগুলিকে তটস্থ করে তোলে। শহরের পুবপ্রান্তের জনপদের রাতগুলি শিরñেদের আর্তনাদে বিদীর্ণ হচ্ছিল। 

দরজাটি চিত্রশিল্পীদের আকৃষ্ট করেছিল। এর নিরেট বিমূর্ত আকার, জাফরির নকশা, কালচে সবুজ রঙ, এবং অজস্র পেরেকের সমাবেশ তাদের ক্যানভাসে অপ্রত্যাশিত চিত্রকল্পের প্রণোদনা দিয়েছে। শিল্পীরা তাদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিত্রটি এই দরজার প্রভাবেই সৃজন করেছিলেন। তাঁরা দাবি করেছিলেন ছবি আঁকার সময় তাঁদের হাতটি যেন অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করছিল। এই দরজার ছবি যাঁরা এঁকেছিলেন তাদের দুই-একজন আর কখনওই রঙতুলি হাতে তোলেননি।   

কবিরা এই দরজায় এক দুষ্ট আত্মার রোমান্টিক দৃশ্যকল্প খুঁজে পেয়েছিলেন। প্রতিবন্ধকতার অসহনীয় দুর্দশা আর অবাধ স্বাধীনতার স্বপ্ন  এবং অন্ধকার দুনিয়ার অজানা দুয়ারকে বিষয় করে কবিরা বায়রনীয় কায়দায় দীর্ঘ কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। এই দরজাকে কেন্দ্র করে যারা কবিতা লিখেছিলেন তাদের দুই-একজন প্রাণঘাতী মাদকে আসক্ত হয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ জীবনটি থেকে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিলেন। একজন বেছে নিয়েছিলেন মহাসড়কের জীবন এবং রাতের আঁধারে উত্তেজিত পুলিশবাহিনীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আর যে কবির ঘটনাটি সংবাদ মাধ্যম ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল, তিনি দরজাটিকে নিয়ে একটানা বাহাত্তর ঘণ্টা বিরতিহীন এক মহাকাব্য লিখেছিলেন, বাথরোব পরিহিত অবস্থায় অ্যাবসিন্থের (কড়া সবুজাভ মদ) খালি বোতলসহ তাঁর মৃতদেহ টেবিলের পায়ের কাছে পড়ে ছিল। কবির বিধবা স্ত্রী সেই কবিতাটি ধ্বংস করে ফেলেছিলেন। কবিদের কেউ কেউ যাঁরা এই দরজা নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন তাঁরা আর কখনওই কবিতার ধারেকাছে যাননি, বরং বিজ্ঞাপন সংস্থার চাকরিতে মনোনিবেশ করেছিলেন।

যারাই এই দরজার সান্নিধ্যে এসেছিল তাদের সকলেই একমত হয়েছিল যে, এই দরজার মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে। এর আশেপাশের সব কিছুতেই এর অপশক্তির স্পর্শ লেগে যায়। এর পরিধির মধ্যে থাকা নির্দোষ সমস্ত বস্তুই দুষ্টদশা প্রাপ্ত হয়। অতিপ্রাকৃত কিছু একটা এর চারপাশে চরে বেড়ায়।  

অবশেষে একদিন এমন কিছু ঘটেছিল যা এই দরজাটির নিয়তি আমূল পালটে দিয়েছিল।

সেই বিশেষ দিনটিতে এর ধারেকাছেই কোথাও শিশুরা খেলায় মেতেছিল। ওরা খেলছিল যুদ্ধ-যুদ্ধ, চোর-পুলিশ, এবং লুকোচুরি খেলা। বালকদের একজন খেলাচ্ছলে সেই দরজাটির নিচে লুকোতে গিয়েছিল এবং তাকে আর কখনওই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে ছিল তীক্ষèধীসম্পন্ন বিশেষ বালক। গণিতে তুখোড় এবং আহত পশুপাখিকে নিরাময় করবার অলৌকিক গুণ ছিল তার। বালকটি নিখোঁজ হওয়ার পরেই অপরাধীদের কবলে পড়ার শঙ্কা এবং সেই পুরানো প্রথায় অপরাধের জোয়ারটি ক্রমশ কমতে কমতে থেমে গিয়েছিল।

কানাডা থেকে

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button