আর্কাইভসাক্ষাৎকার

অভিজিৎ মুখার্জির সাক্ষাৎকার : ‘আমাদের সাহিত্যজগতে অবহেলিত সাহিত্য নিয়ে ক্রিটিক্যাল আলোচনা’

বরেণ্য সাহিত্যিকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘লীলা রায় পুরস্কার’প্রাপ্ত অভিজিৎ মুখার্জির সঙ্গে আলাপচারিতায় অলাত এহ্সান

কলকাতায় জাপানি ভাষা ও সাহিত্যের যুগপৎ চর্চার প্রসঙ্গ উঠলে যাঁর নাম প্রথমেই আসবে তিনি অভিজিৎ মুখার্জি। একসময় জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনয়িারিংয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়ে, তারপর কখনও বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে, বারতিনেক প্রখ্যাত জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তি পেয়ে করেছেন হারুকি মুরাকামির গল্প-উপন্যাস ছাড়াও মিশিমা ইউকিও এবং য়োকো ওগাওয়ার উপন্যাস অনুবাদ। পত্র-পত্রিকায় অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন জাপানের খ্যাতনামা সাহিত্যিক এবং জাপানি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত যাঁরা ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত লেখক তাঁদের সাহিত্যকৃতির বিশ্লেষণ নিয়ে তাঁর বহুপঠিত বই, ‘যে ভারতীয়রা ইংরেজিতে লিখছেন’।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, জাপানি ভাষার শিক্ষকতার সূত্রে স্কুল অব ল্যাংগুয়েজের প্রাক্তন জয়েন্ট ডিরেক্টর শ্রী মুখার্জির প্রিয় লেখক ভি এস নাইপল, গ্রাহাম গ্রিন, হারুকি মুরাকামি এবং ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা।]

ভূমিকা : অভিজিৎ মুখার্জি অধ্যাপনা করেন ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। একাধিকবার জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে সে দেশের ভাষার শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ, দেশে ধারাবাহিকভাবে দোভাষী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে তার। ব্যক্তিগত ও পেশাদারি নৈকট্য আর সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তাঁর উৎসাহ ও চর্চার খতিয়ান এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পাঠাভ্যাসের সূত্রে পরিচয়ের বিস্তৃতি হিসেবে তিনি জাপানি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদে নিবিষ্ট হয়েছেন। বাংলা ভাষায় হারুকি মুরাকামির একমাত্র অনুমোদিত অনুবাদক তিনি। মুরাকামির গল্প-উপন্যাস অনুবাদে তার সুখ্যাতি, পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘লীলা রায় পুরস্কার’। লিখিত মাধ্যমে চারবারে তিনি কথা বলেছেন পূর্বপুরুষের দেশ বাংলাদেশ, ভারতীয় লেখক, জাপানি সাহিত্য ও অনুবাদের নানা দিক নিয়ে। অপ্রিয় সত্য কথাও তিনি বলেন সোজাসুজি, কোনও প্রকার ভনিতা ব্যতিরেকে।

অলাত এহ্সান : আপনার অনুবাদ ও তত্ত্বাবধানে হারুকি মুরাকামির ‘হাতিটা উধাও’ গল্প সংকলন প্রকাশ হয়েছে। হারুকি মুরাকামির সঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা বিভাগের চুক্তির শর্তের মধ্যে এটাও ছিল যে, গল্পগুলোর অনুবাদ আপনাকে দিয়ে বা আপনার তত্ত্বাবধানেই হতে হবে। আপনার সঙ্গে একবার কথা বলতে বলতে জেনেছিলাম যে, মুরাকামি প্রায় প্রতিটি গল্পে বুদ্ধদর্শন ও মানবেতিহাসের নিরিখ ব্যবহার করেন। ‘হাতিটা উধাও’ গল্পেও তেমনি, তাই না ?

অভিজিৎ মুখার্জি : মুরাকামির সব লেখাতেই বৌদ্ধ দর্শনের কিছু সূক্ষ্ম অপ্রত্যক্ষ আভাস থেকেই যায়। মানবেতিহাস মানুষকে সৃষ্টির মধ্যে যেভাবে স্থাপিত করে সেটা মুরাকামি সব সময় নিজের মতো করে খেয়াল রাখেন। ‘হাতিটা উধাও’ সংকলনের গল্পগুলোই সরাসরি বা পরোক্ষে ‘অনেকান্ত’ দর্শন বা সহজ করে বললে, জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্রে বহুত্ববাদকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছে। সমাজজীবনের এনট্রপি বাড়িয়ে দেওয়াতেই হিত বলে দাবি করছে।

অলাত এহ্সান : এর আগে দেখেছি, বিভিন্ন সময় হারুকি মুরাকামি তাঁর অনুবাদকদের নিয়ে কর্মশালা করেছেন। সরাসরি লেখকের এই কর্মশালায় আসলে কী বিষয় নিয়ে কথা বলা হয় ?

অভিজিৎ মুখার্জি : সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখেছি বটে যে, ইউরোপীয় কোনও কোনও ভাষায় ওঁর অনুবাদকদের ওয়ার্কশপের আয়োজনে (হারুকি মুরাকামি) উপস্থিত ছিলেন কিন্তু বিশদে সে ব্যাপারে কিছু জানার সুযোগ হয়নি। যদি অনুমান করতে হয় তাহলে আমাদের প্রথমেই মনে রাখতে হবে জাপানি জনমানসে সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় ইস্যুগুলোতে চিন্তাধারা কোন পথে প্রবাহিত হয়, মূল খাতটি কেমন। প্রাথমিক যে দর্শনের ওপর জাপানিদের চিন্তাধারা গড়ে উঠেছে, সেটি বৌদ্ধ দর্শন এবং মূলত জেন অনুসারী। জেন উৎসারিত ঠিক কী কী নীতিশিক্ষার ওপর জাপানি সামাজিক, জাতীয় ও ব্যক্তিগত আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত, তার হদিস মুষ্টিমেয় জ্ঞানী লোক রাখলেও, সাধারণ মানুষ সেগুলো সবসময় ঠিক বৌদ্ধ বা কনফুশিয় উৎসের সঙ্গে যুক্ত বলে জানে না। দৈনন্দিন জীবনযাপনে অর্জিত শিক্ষা হিসেবে সেগুলো কার্যকর থাকে।

আমরা বাঙালিরা সেদিক থেকে এক বিশেষ সুবিধের অধিকারী, রবীন্দ্রসংগীতের মাধ্যমে ওইসব দর্শন ও চিন্তাধারার সঙ্গে পরোক্ষে হলেও আমাদের বেশ খানিকটা করে পরিচয় আছে। কিন্তু ইউরোপের ক্ষেত্রে তো তা নয়, ইউরোপিয়ান অনুবাদককে সেই সংকেতবাহী উপকরণগুলোর সঙ্গে পরিচিত করিয়ে রাখা জরুরি বলে হয়তো ওঁর মনে হয়। কেননা জাপানি হিসেবে বেড়ে ওঠার কারণে ওই সমাজ থেকে আহৃত প্রজ্ঞার মধ্যস্থতায় তিনি বিশ্বজুড়ে পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে চান। দিব্যি পারেনও। বিশ্বমানবের ধারণা, ওঁর নিজস্ব বিশ্ববীক্ষা, এই জগতের বর্তমান পরিস্থিতির ক্রিটিক্যাল (উপযুক্ত বাংলা শব্দ খুঁজে পেলাম না) দিকগুলো, এ নিয়ে তিনি যা যা বলতে চান, পাঠকের থেকে যা যা প্রত্যাশা করেন, নিজের বার্তাটি ঠিকমতো পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে সাফল্য বলতেই বা তিনি নিজে কী বোঝেন সেগুলো অনুবাদকদের ঠিকমতো জানিয়ে রাখলে সার্থক অনুবাদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। অনুমান করছি, এক ধরনের বিশ্বায়ত ভাষাভঙ্গিতে তিনি এসব কাজ ওই সব ওয়ার্কশপে সম্পন্ন করেন। বোস্টনের টাফটস ইউনিভার্সিটিতে নাট্যশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনো করেছিলেন তরুণ বয়েসে, নিজে পশ্চিমের দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, সংগীত বিষয়ে প্রগাঢ় জ্ঞানী, এ কাজ কীভাবে করতে হবে, তা ওঁর কাছে পরিষ্কার।

অলাত এহ্সান : জাপানের সাহিত্যের মধ্যে দুটো মেরুকরণ দেখি। একে মিশিমা ইউকিউ, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, হারুকি মুরাকামি আছেন; আরেকে প্রধান ধরা হয় কেনজাবুরোওয়েকে। এর কারণ কী ? এটা তো ওই দেশে রাজতান্ত্রিক শাসন তর্ক থেকে শুরু হয়, তাই না ?

অভিজিৎ মুখার্জি : কাওয়াবাতা, মিশিমা, মুরাকামির বিপরীত মেরু তৈরি করার মতো মাপের সাহিত্যিক কেনজাবুরো নন। দেশের মানুষের মধ্যে তেমন সাড়া পাননি, কোনও রকম উত্তরাধিকারও গড়ে ওঠেনি। পশ্চিমের একটা নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা থাকে প্রাচ্যের সভ্যতাকে, সমাজকে অনুদার, নিপীড়নমূলক বলে প্রচার চালিয়ে নিজেদের জন্য এক ধরনের নৈতিক উচ্চভূমি তৈরি করে নেওয়ার। সেই প্রকল্পে কেনজাবুরোকে কাজে লাগাতে বিশাল প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, নোবেল পুরস্কারও দেওয়া হলো কিন্তু কাজটাতে সাফল্য আসেনি। তুমি পড়েছো কেনজাবুরোর লেখা ? বরং কোবো আবের লেখা অনেকটা স্বতন্ত্রভূমির ওপর। খুবই উচ্চ প্রশংসিত লেখক তিনি। কিন্তু তিনি কোনও মেরু সৃষ্টির চেষ্টা করেননি। আসলে জাপানের সাহিত্যজগৎ সৃষ্টিকে নিবিষ্ট হয়ে পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করার ওপর জোর দিয়ে এসেছে বেশি, শত্রু চিহ্নিত করে, তার বিরুদ্ধে সাহিত্য-আশ্রয়ী লড়াই তৃতীয় বিশ্বের অনেক পাঠকের কাছেই আদৃত হয় বটে, জাপানি সাহিত্যে সেই প্রবণতা আনতে চেয়ে কেনজাবুরো সফল হননি।

অলাত এহ্সান : এই যে অনুবাদের ক্ষেত্রে একটা মহাদেশীয় বা দেশ বা লেখককে নির্বাচনের কথা বলা হয়, এটাও তার সঙ্গে যুক্ত, তাই না ?

অভিজিৎ মুখার্জি : আদত কথা, একটা ভাষার অনুবাদক হিসেবে নিজেকে তৈরি করা। স্প্যানিশ জানা থাকলে লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশের সাহিত্য অনুবাদ করা যায়। ভাষা হিসেবে স্প্যানিশ আর লাতিনকে নাকি যমজ ভাষা বলা হয়, কখনও শুনেছিলাম। এতই নাকি মিল! আবার অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রেই একটা কী দুটো ভাষা শিখেই মূল থেকে সে দেশের যাবতীয় সাহিত্য অনুবাদ করা যায়। ভারত অবশ্যই তার বড় ব্যতিক্রম। সে যাই হোক, এ কথা ঠিক যে উঁচুমানের অনুবাদের সূত্র ধরে এমন অনেক উদাহরণই পাওয়া যাবে, যেখানে বড় অনুবাদক মূলত কোনও একজন বড় লেখকের লেখাই অবিচ্ছিন্নভাবে অনুবাদ করে গেছেন। এর প্রথম উদাহরণই হবেন জাপানি লেখক কাওয়াবাতা ইয়াসুনারির ইংরেজি অনুবাদক এডওয়ার্ড সাইডেনস্টিকার। খোদ কাওয়াবাতা বহুসময় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলেছেন, সাইডেনস্টিকার না হলে আমার লেখা কখনওই পশ্চিমের কাছে সেভাবে পৌঁছত না। কিংবা বিবেচনা করা যেতে পারে রাশিয়ান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের ক্ষেত্রে কনস্ট্যান্স গার্নেটের কথা। তিনি বহু লেখকের লেখাই অনুবাদ করেছেন সারা জীবনে কিন্তু ১৯১২ থেকে ১৯২০ সাল টানা শুধু দস্তয়েভস্কির লেখাই মূলত অনুবাদ করে গেছেন।

মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। অনুবাদ প্রসঙ্গে বলা হয়, To understand is to translate, অর্থাৎ হৃদয়ঙ্গম করা জিনিসটা হলো এক অর্থে অনুবাদ করে নেওয়ারই শামিল। একই লেখকের লেখাকে টানা অনুবাদ করে যেতে থাকলে, একাত্মতা জন্মায় এক প্রকার। আর তাতে অনুবাদের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যাপারে নিজ দায়িত্বে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আত্মবিশ্বাস আসে। ধারণাটা আরেকটু বিস্তৃত করে নিয়ে বলা যায়, একটাই ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করে যেতে থাকলে সেই ভাষার সঙ্গে জড়িত সংস্কৃতিটির সঙ্গে অনেকটা ঘনিষ্ঠতা অর্জন করা যায়, অনুবাদ অনেক সম্পূর্ণতা পায় তাতে।

এবারে আসি একেবারে কেন্দ্রীয় প্রসঙ্গটিতে। যেসব সমাজে পুঁজির উপযুক্ত বিকাশ হয়েছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও একটা পর্যায়ের পেশাগত নিশ্চয়তা থাকে, মানুষটির প্রাতিষ্ঠানিক অথবা শখের চর্চার বিভিন্নতা সত্ত্বেও। তাই এমন অনেক বিষয় বা প্রশিক্ষণের পাঠক্রম হয়, যাতে নিজেকে অনেকাংশে নিযুক্ত করে বসলে অনুন্নত সমাজে উপার্জনক্ষম হওয়ার ব্যাপারে বড় ঝুঁকি থেকে যায় কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে আরেকটু প্রাণবন্ত উন্নত সমাজে আদৌ ঝুঁকি থাকে না। সচেতনভাবেই আমি ‘দেশ’ না বলে ‘সমাজ’ বলছি। ভারতের ভেতরেই যেমন, দিল্লি, মুম্বাই, পুনে, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ অঞ্চলে কেউ যদি স্রেফ একটি বিদেশি ভাষা শেখায় নিজের সময় উৎসর্গ করে, নানা সূত্রে তার উপার্জনের সুযোগ যথেষ্ট থাকবে এবং এবার সে সেই ভাষার সাহিত্য সরাসরি অন্য ভাষায় অনুবাদও করতে পারবে, ইচ্ছে হলে। কিন্তু কলকাতার চিত্র মোটেই অতটা উজ্জ্বল নয়। ভাষা কেউ শিখতেই পারে, কিন্তু পাশাপাশি অন্য পেশাদারি দক্ষতা বা যোগ্যতা অর্জন করে না রাখলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।

সম্ভবত এই ধরনের কারণেই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে দেখা যায়, একই ব্যক্তি ইংরেজি অনুবাদের সাহায্য নিয়ে কখনও তুর্কি, কখনও চীনে, কখনও রাশিয়ান, কখনও জাপানি, কখনও লাতিন অ্যামেরিকার সাহিত্য অনুবাদ করে যাচ্ছেন এবং যথারীতি অনুবাদে মূলটির সব মাত্রা বজায় থাকছে না। এটা শিক্ষা, নিষ্ঠা, সাহিত্যের বাজার, এসবের সঙ্গে তত সংশ্লিষ্ট নয়, যতটা ওই সমাজে পুঁজির বিকাশের সঙ্গে।

ইউরোপে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে, জাপানে, চীনে, কোরিয়ায় বা পুঁজির উন্নত বিকাশের অন্যান্য দেশে যদি শোনা যায় যে একজন মানুষ কোরিয়ান সাহিত্য অনুবাদ করছেন, পাঠকেরা স্বপ্নেও ভাববে না যে সরাসরি মূল কোরিয়ান থেকে না করে, তৃতীয় ভাষার সাহায্য নিয়ে করছেন। সেখানে সমীকরণ সহজ, ভাষাটি পরিশ্রম করে শিখে নাও, তারপর পড়ে দেখো সাহিত্য কেমন, এরপর অনুবাদের ইচ্ছে হলে পছন্দমতো লেখা বেছে নাও। এক্ষেত্রে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অভ্রান্ত। অর্থনৈতিক বেজ ও সাংস্কৃতিক সুপার-স্ট্রাকচারের ব্যাপার। ‘ট্র্যান্সলেশন স্টাডিজ’ বিষয়টার ওপর গবেষণা এবং দেশ-বিদেশের সাহিত্যের অনুবাদ, উভয়ের নিরিখেই সবচেয়ে উচ্চমানের কাজ হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলোতে। কারণ একটাই, বিদেশি ভাষা শিক্ষা ও তারপর সেই ভাষা থেকে অনুবাদের ক্ষেত্রটা থেকে অর্থনৈতিক বা পেশাগত অনিশ্চয়তা দূর করেছিল সরকারি উদ্যোগ ও আয়োজন।

চতুর্থ পর্ব

অনুবাদ নিয়ে:

অলাত এহ্সান : লেখকের অনুভূতি নিয়ে অনেক কথা হয়, লেখার সময় তারা একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন। অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনার অনুভূতিটা কেমন ?

অভিজিৎ মুখার্জি : অনুবাদ করার সময় লেখকরা আমাকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেন। লেখাটি থেকে মুগ্ধতা তো থাকেই, পাশাপাশি লেখকদের সম্বন্ধেও গভীরতরভাবে পরিচিত হতে থাকি। একটা ঘোরের মধ্যেই চলে যাই।

অলাত এহ্সান : অনুবাদ তো একটা পরিণত কাজ। আপনার কাছে অনুবাদক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি কী রকম ?

অভিজিৎ মুখার্জি : প্রাথমিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হচ্ছে, নিজের গদ্যকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় করে তোলা। অনুবাদকের নিজের গদ্যভঙ্গি পরিণত মানের না হলে অনুবাদের প্রচেষ্টা শুধু বিফল হয় তা-ই নয়, অনুবাদ পড়ার প্রতি পাঠকের অনীহা তৈরি হয়। এবং ভবিষ্যতের অন্যান্য অনুবাদকের পরিশ্রমও পাঠকের অনীহার কারণে মর্যাদা পায় না, অবহেলিত থাকে। এর বিষময় এবং অনভিপ্রেত ফল আজকের পশ্চিমবঙ্গে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে বলেই আপাতত এটির ওপরেই সার্বিক গুরুত্ব আরোপ করতে চাইছি।

এছাড়া পাঠের চৌহদ্দিকে যথাসম্ভব বিস্তৃত করার নানা সুফল অনুবাদের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয়, তাই সাহিত্য ছাড়াও সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি সমস্ত বিষয়েই নিয়মিত পড়াশোনার অভ্যাস তৈরি করে নেওয়া বেশ জরুরি বলেই মনে করি।

অলাত এহ্সান : অনুবাদকের আদতে কোনও স্বাধীনতা আছে ?

অভিজিৎ মুখার্জি : অনুবাদক যথেষ্ট সংবেদনশীল ও অভিজ্ঞ হলে তাঁকে যথেচ্ছ স্বাধীনতা দেওয়াই উচিত বলে মনে করি। আমি তো প্রয়োজনে সেই স্বাধীনতা নিই। হাঃ হাঃ! তবে পরিস্থিতি বর্ণনায় একান্তই প্রয়োজন হলে তবেই।

অলাত এহ্সান : একজন অনুবাদকের তৃপ্তি কোথায় ?

অভিজিৎ মুখার্জি : সবার কথা বলতে পারি না, আমার নিজের ক্ষেত্রে যেটা খাটে সেটা হলো, বিদেশি ভাষার একটা নির্দিষ্ট টেক্সটের প্রতি আমার যখন এতটাই পক্ষপাত জন্মায় যে, আমি চাইলাম সকলেই কথাটা জানুক, এভাবেই সেটা পেশ হোক, তখন আমি সেটা অনুবাদ করার ইচ্ছা পোষণ করতে থাকি, সুযোগ হলে করি। অর্থাৎ তাগিদটা এক অর্থে রাজনৈতিক, প্রোপাগ্যান্ডিস্টও বলা যায়! এবার যদি দেখা যায় অনুবাদ পড়ে পাঠক মোটামুটি সেই অর্থেই টেক্সটটাকে অনুধাবন করছে যে অর্থে আমি করেছিলাম, এবং প্রভাবিত হচ্ছে, তবেই তৃপ্তি, তার আগে নয়।

অলাত এহ্সান : কবিতা অনুবাদের দুরূহ দিক নিয়ে যত কথাই হোক, আমার মনে হয়, কবিতা অনুবাদেই সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদক। এটা পারস্য কবি হাফিজের অনুবাদক কৃষ্ণচন্দ্র থেকে শুরু করে শার্ল ব্যোদলেয়ার, হাইনে, মারিয়া রিলকে অনুবাদ বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রেও সত্য। এদিক দিয়ে গদ্য অনুবাদকেরা সবচেয়ে বেশি মূলানুগ থেকেছেন। এটা কি সাহিত্যের মাধ্যমের কারণেই সম্ভব ?

অভিজিৎ মুখার্জি : ঠিক এভাবে আমি ভাবছি না। বুদ্ধদেব বসুর ব্যোদলেয়ারের অনুবাদ নিয়ে ফরাসি ভাষার দক্ষ অনুবাদক ও লেখক অধ্যাপক চিন্ময় গুহ মোটেই তেমন সন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি। বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি এই মত স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছিলেন। সাহিত্য বিষয়ে জ্ঞান, রুচি ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধদেব বসুর স্থান প্রশ্নাতীত তা সত্ত্বেও যদি অনুবাদের মান যথেষ্ট না হয়, সরাসরি ভাষাটি ভালোভাবে জানা না থাকায় তবে কিন্তু সাবধান হতে হবে। কবিতাই হোক, গদ্যই হোক, আক্ষরিক অনুবাদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করে গেছেন জ্ঞানী শ্রেষ্ঠ (হোর্হে লুইস) বোর্হেসের মতো সাহিত্য-আলোচক। কবিতা ঠিক আমার চর্চার বিষয় নয়, তবু কবিতার অনুবাদ বিষয়ে একটি প্রসঙ্গ উঠলেই আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি এবং সেই প্রসঙ্গটি হচ্ছে জীবনানন্দ দাশের কবিতার ক্লিন্টন বি. সিলির করা অনুবাদ যা আমরা সিলি-র আ পোয়েট অ্যাপার্ট বইটাতে পাই। স্রেফ আক্ষরিক অনুবাদ, তাও জীবনানন্দ দাশের মতো কবির, যিনি কি না প্রবলভাবে বঙ্গদেশ সংক্রান্ত নানা অনুষঙ্গের নিয়ত প্রতিনিধিত্ব করিয়েছেন জীবনের সমস্ত পর্যায়ের কবিতায়। অথচ কী অবিশ্বাস্য উচ্চতায় উঠেছে অনুবাদগুলো, পড়ে তৃপ্তিতে এতটুকু খামতি থাকে না, আমাদের একজন রীতিমতো আইকনের কবিতার অনুবাদ হওয়া সত্ত্বেও।

তবে কি না, একটা-দুটো উদাহরণের সহায়তায় তো আর সর্ব অর্থে প্রযোজ্য বলে তাত্ত্বিকভাবে সাব্যস্ত করা যায় না, আমার সেই চেষ্টা করা উচিতও হবে না, কেননা কবিতা ও তার অনুবাদ চর্চায় আমার ততখানি অভিজ্ঞতা নেই। তত্ত্ব নিয়ে তো বিশদে যাওয়ার উপায় নেই। এখানে তবু এটুকু আমি বলব, ইংরেজি তর্জমায় বোর্হেসের বইটি―অন রাইটিং পড়ে দেখুক সকলে―সেখানে Two Ways to Translate নামে প্রবন্ধটির মূল বক্তব্যই হলো: ভাবানুবাদের অনিশ্চিত সার্থকতার যে পরিসর, তার পরিবর্তে, সরে এসে আক্ষরিক অনুবাদের চ্যালেঞ্জটাই গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত। এছাড়াও অনুবাদতত্ত্বের প্রখ্যাত পণ্ডিত পল রিকার (Paul Recoeur) খুব সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন: দেখা গেছে, কোনও কিছু ‘ভিনদেশি’ (আক্ষরিক অনুবাদের ফলে যার উপস্থিতি) হলেই, তাকে মধ্যস্থতা করতে বাধা দেওয়ার, বা তাকে ঠেকিয়ে রাখার অর্থ বা উদ্দেশ্যই হয়ে দাঁড়ায়, তলে তলে নানা ভাষাগত গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতার পুষ্টিসাধন করানো। আর তার চেয়েও যেটা মারাত্মক, উন্নততর সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে অভিভাবকত্বের নানাবিধ ভান।

অনুবাদের প্রসঙ্গে ‘টাওয়ার অব ব্যাবেল’-এর যে মিথ, সেটার কথা ওঠে কখনও কখনও। বহু আগে মানুষেরা নাকি একটা উঁচু টাওয়ার বানাতে শুরু করেছিল, যাতে ওটার মাধ্যমে স্বর্গে চলে যাওয়া যায়। ঈশ্বর মানুষের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে এমন করে দিলেন, যাতে মানুষেরা কেউ কারুর কথা বুঝতে না পারে। সৃষ্টি করলেন নানা ভাষা। তখনকার মতো বিফল হলেও, মানুষ হাল ছাড়ছে না, সে স্বর্গে যাবেই, এবার টাওয়ারটা বানাবার প্রস্তুতি হিসেবে তার একটা অস্ত্র হলো ‘অনুবাদ’। সেটাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে তো আমাদের আন্তরিক চেষ্টা করতে হবে অপর ভাষা ও সংস্কৃতিগুলোকে খুঁটিয়ে জানার। আমি আপাতত যে পর্যায়ে আছি, অন্য ভাষার সবকিছু সেই মাপে ও ছাঁচে রূপান্তরিত করে, অর্থাৎ ‘ভাবানুবাদ’ করে পেশ করলে তো মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই না ?

অলাত এহ্সান : রবার্ট ফ্রস্ট, টি এস এলিয়ট, শার্ল ব্যোদলেয়ার, শাহানামা অনেকে অনুবাদ করেছেন কিন্তু শামসুর রাহমান, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কেউ করতে পারেননি মনে করা হয়। কবিতার অনুবাদ কবি, গল্পের অনুবাদ একজন গল্পকার করলে সেরাটা পাওয়া সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। আপনি কী মনে করেন ?

অভিজিৎ মুখার্জি : বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে মূলের থেকে অনেক বিচ্যুতি নির্দেশ করে অনেকে দেখিয়েছেন কিন্তু তাতে ওঁর অনুবাদের জনপ্রিয়তা কমেনি। কারণ খুব সরল, লেখার প্রসাদগুণ। শামসুর রাহমান, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, সুভাষ মুখোপাধ্যায়―তাঁদের নিজস্ব রুচি ও রচনাভঙ্গি এতই পরিণত যে, তাঁরা কখনও একটা কাঁচা টেক্সট, পাঠককে অত্যাচার করতে, প্রকাশকের হাতে ছাপাবার জন্য তুলে দেবেন না। এটা তো একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক! গল্পকার হওয়ার দরকার নেই, দক্ষ গদ্যলেখক হলেই হবে। কবিতার ক্ষেত্রে অবশ্য অনুবাদক কবি হলেই ভালো হয়, তবে অপ্রধান কবি হলেও ক্ষতি নেই। ক্লিনটন সিলির ইংরেজি অনুবাদ পড়েছো তো জীবনানন্দ দাসের কবিতার ? এককথায় অনবদ্য!

অলাত এহ্সান : অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাবের অনুবাদ তো একটা মৌলিক সমস্যা। আপনি এই সমস্যা দূর করতে কী করেন ?

অভিজিৎ মুখার্জি : ভাব তো শুধু দর্শন নয়, ভাবের একটা সাংস্কৃতিক ভিত্তিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে। ভাব নিয়ে সমস্যা আদতে অসম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিচয়েরই ফল। আমি কিন্তু সাংস্কৃতিক বলতে তার মধ্যে রাজনৈতিক ও ইতিহাসগত দিককেও বোঝাচ্ছি। এই সমস্যা কতখানি অনুবাদককে মুশকিলে ফেলবে বা কী করে অনুবাদক সেই সমস্যা থেকে উত্তীর্ণ হবেন সেটা, তা অনুবাদকের অবগতির বিস্তারের ওপর নির্ভর করে। সমস্যা থেকে তাৎক্ষণিক উত্তরণের উপায় সেই কারণেই কম। পাঠাভ্যাস বাড়িয়ে যাওয়া আর বিদেশি ভাষার সেই সমাজ, সেখানকার ভূগোল ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ থাকলে সেই সুযোগ কাজে লাগানোই সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। ভাবের সমস্যা মোচন তাই একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

অলাত এহ্সান : লেখার সঙ্গে, বিশেষত সাহিত্যের সঙ্গে দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি-মিথ ইত্যাদি গভীরভাবে যুক্ত। সে ক্ষেত্রে অনুবাদের জন্য লেখকের দেশ-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা খুবই জরুরি। অনুবাদের দক্ষতা অর্জনের জন্য কোনও একটা দেশ বা মহাদেশ এবং ভাষাকেই বেছে নেবার প্রস্তাব করেন অনেক অনুবাদক।

অভিজিৎ মুখার্জি : সে কথাই আমি এর আগের প্রশ্নের উত্তরে বললাম। তবে মহাদেশ কিন্তু একটা বিরাট ব্যাপার! মহাদেশের একটি-কি দুটি দেশ সম্বন্ধে জানলেই যে অন্যান্য দেশ সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে রাখা যায়, তা তো নয়। এশিয়া মহাদেশের কথাই ভাবো না কেন, মধ্যপ্রাচ্য সম্বন্ধে জানলে কি দূরপ্রাচ্য সম্বন্ধে ধারণায় তেমন আত্মবিশ্বাস আসা সম্ভব ? ইয়োরোপের ফ্রান্স সম্বন্ধে জেনে কি তুরস্ক নিয়ে আলোচনায় তেমন সুবিধে হয় ? অনেক সময় এমনকি দেশটি সম্বন্ধে জানলেও চলে না, বিশেষ জনগোষ্ঠী নিয়েও যথেষ্ট সময় ধরে চর্চা করে নিতে হয়। ভারতের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদের ক্ষেত্রেই তো সে কথা খুবই খাটে।

অলাত এহ্সান : একজন লেখক তো লেখায় মেজাজ-মর্জি-ছন্দ-গতি দিয়ে লেখেন। অনুবাদেও সেই মেজাজ-ছন্দের জন্য সেই লেখকের ওপর প্রস্তুতি দরকার। এজন্য একজন লেখককে নির্বাচন করাই ঠিক মনে করেন অনেক লেখক-অনুবাদক।

অভিজিৎ মুখার্জি : সেটা অবশ্য অনুবাদকের এলেমের ওপর নির্ভর করে অনেকাংশে। প্রত্যেক লেখকের গদ্যভঙ্গির বিশেষত্ব আছে। সেই লেখকের লেখা অনুবাদ করতে গেলে রহস্যটির উদ্ঘাটন করতে হয়, কোথায় লুকিয়ে এই গদ্যভঙ্গির মহিমা। একাগ্র হয়ে নিবিড় চর্চায় অনেক সময়েই পাঠকের অজানিতে একসময় গদ্যভঙ্গির বিশেষত্বটি ধরা দেয়। সেইটাই চাবিকাঠি, লেখাটার একেবারে হৃদয়ে প্রবেশ করার। এবং তারপরেই একমাত্র সার্থক অর্থাৎ উপযুক্ত অর্থ সহকারে অনুবাদ সম্ভব। সেই দিক দিয়ে দেখলে সাধারণ অনুবাদকের ক্ষেত্রে হয়তো একজন লেখকেই নিবিষ্ট থাকা বিধেয়। কিন্তু ব্যতিক্রমী অনুবাদকও আছেন, যাঁরা নিজেরাই হয়তো জগৎ বরেণ্য লেখক, বহুমাত্রিক গদ্য যাঁদের আয়ত্ত। তাঁরা যখন অনুবাদক, তখন একাধিক লেখকের লেখার সার্থক অনুবাদও অসম্ভব নয়। যেমন জাপানের হারুকি মুরাকামি, তাঁর নিজের লেখা কম বেশি পঞ্চাশটি ভাষায় অনূদিত হয়। কিন্তু জাপানের সাধারণ পাঠকের সাহিত্য রুচি গড়ে দিতে তিনি বিপুল অনুবাদও করেছেন এবং একাধিক লেখকের। স্কট ফিটজেরাল্ড, ট্রুম্যান কাপোত, রেমন্ড কার্ভার ইত্যাদি মার্কিন লেখকের লেখা মুরাকামি জাপানিতে অনুবাদ করেছেন।

অলাত এহ্সান : প্রায়ই শোনা যায়, অনুবাদ আসলে সাহিত্য নয়। অনুবাদের সাহিত্য হয়ে ওঠায় অন্তরায়টা কোথায় ? অনুবাদ কীভাবে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে ?

অভিজিৎ মুখার্জি : প্রসঙ্গটা খানিকটা হলেও দর্শনের আওতায় পড়ে! যদি ধরে নিই যে, যেহেতু অনুবাদ হয়ে টেক্সটটা যা দাঁড়াবে সেটা নেহাতই অনুবাদকের ‘ফ্রি উইল’ সঞ্জাত নয় (মূল রচনার লেখককে অনুসরণ করতে হয়েছে), তাই ওটাকে মূল রচনার তুল্যমূল্য গুরুত্ব দেওয়া যাবে না, তাহলে কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে মূল রচনাটি লেখকের ফ্রি উইল কিংবা মুক্ত সৃষ্টিশীলতার ফসল। ঠিক কি না ? কিন্তু কালচারাল স্টাডিজ বলে আধুনিক শাস্ত্রটির চর্চা যাঁরা করেন তাঁরা কি রাজি হবেন এটা মেনে নিতে যে, ইতিহাসে লেখকের সময়, সমাজ, সমাজে লেখকের স্থান, লেখকের পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যক্তিগত পরিস্থিতি, এগুলো মোটেই তাঁর রচনার বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গি, চরিত্র সৃষ্টি ও অন্যান্য উপকরণকে নির্দিষ্ট করে দেয় না ? তাহলে মুক্ত সৃষ্টিশীলতার গৌরবই বা মূল রচনার লেখককে অর্পণ করি কী করে ?

আমার কথা হলো, যদি অনুবাদ না হলে সাহিত্যটাই নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে অনুবাদককে খাটো করে আর মূল রচনাকারকে তুলনায় বড় বলে আমার প্রাপ্তিটুকু কী ? শুনতে হয়তো খারাপ শোনাবে কিন্তু তবু স্বীকার করা ভালো, সাহিত্যসৃষ্টির মানের দিক থেকেও শিল্পোন্নত দেশগুলো যে এগিয়ে। তার একটা প্রধান কারণ হলো আন্তর্জাতিক সাহিত্য, অনুবাদে হলেও, পাঠের সুযোগ সেখানকার মানুষজনের কাছে অনেক বেশি। অনুবাদ জিনিসটা উপযুক্ত সম্মান আর গুরুত্ব সেসব দেশে উন্নত সাহিত্যসৃষ্টির খাতিরেই দেওয়া হয়। সাহিত্যসৃষ্টি আর যথাযোগ্য অনুবাদ, এরা অবিচ্ছেদ্য এক ভূমিকা পালন করছে ওই সব দেশে। গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক প্রতিবেদন ঝুম্পা লাহিড়িকে উদ্ধৃত করে জানাল, Lahiri believes that Ôtranslation is the keyÕ–that it is what has created Ôthe bridge for so many of us to be able to read across our limitation.’  

আর অনুবাদের জগতে কি প্রতিযোগিতার অভাব নাকি ? বিশ্বের সাহিত্য ও সাহিত্যের বাজার নিয়ে অর্থনীতির খবরটা আমাদের মতো উন্নতিশীল দেশের অধিকাংশ সাহিত্যপ্রেমীই রাখেন না। তাই অনুবাদকে কিছুটা হলেও হেলাফেলার প্রবণতা দেখা যায়!

অলাত এহ্সান : আমরা সাধারণত যে অনুবাদগুলো দেখি, সেগুলো মূল ভাষা থেকে নয়, দ্বিতীয় কোনও ভাষা, বিশেষত ইংরেজি থেকে। তাহলে আমরা ‘সূর্যের রশ্মি থেকে তাপ না নিয়ে বালি থেকে তাপ নিচ্ছি’ বলে মনে হয় না ?

অভিজিৎ মুখার্জি : আমি যেসব গল্প বা প্রবন্ধ মূল জাপানি থেকে সরাসরি অনুবাদ করেছি, সেগুলোর অনেকগুলোরই ইংরেজি অনুবাদেও খানিক খানিক চোখ বুলিয়েছি। ইংরেজিতে কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই মারাত্মক স্বাধীনতা নেওয়া হয়, ক্ষেত্র বিশেষে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার মতোই ঝুঁকি নেওয়া হয়েছে বলে দেখেছি! তাই সরাসরি মূল ভাষা থেকে অনুবাদই শ্রেয়। তবে সেই সুযোগ না থাকলে কী আর করা, তখন অগত্যা ইংরেজি থেকেই…

অলাত এহ্সান : অধিকাংশ অনুবাদই বিশ্বের জনপ্রিয় বা বহুল আলোচিত, মানে ‘বেস্ট সেলার’ বইগুলো হয়ে থাকে। এই অনুবাদ দ্বারা একটি দেশের সাহিত্য কতটুকু উপকৃত হতে পারে ?

অভিজিৎ মুখার্জি : যথেষ্টই উপকৃত হতে পারে। বেস্ট সেলার মানে কিন্তু যাঁরা বই কেনেন, বিশ্বজুড়ে তাঁদের কাছে সমাদর পেয়েছে যেসব বই। নিয়মিত বই যাঁরা কেনেন তাঁরা খুব রুচিহীন, বুদ্ধিহীন হওয়ার কথা নয়, আর বেস্ট সেলারও তাই একেবারে অকিঞ্চিৎকর বইয়ের পক্ষে হয়ে ওঠা কঠিন। বিশ্বজুড়ে বেশির ভাগ লোক যা পড়ছে তা আমার দেশের মানুষও পড়তে চাইলে দোষের তো কিছু নেই।

অনুবাদেরও একটা অর্থনীতি আছে, বেস্ট সেলার হওয়ার সুবাদে যে বইটির বাজার তৈরি হয়েই আছে, সেটির অনুবাদ প্রকাশ করলে প্রকাশকের আর্থিক ঝুঁকি কম। ফলে বেস্ট সেলারের অনুবাদ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হবেই। এই মুহূর্তে যেসব লেখকের বই বেশি বিক্রি হয়। যেমন―গার্সিয়া মার্কেজ, ভি এস নাইপল, মিলান কুন্দেরা, উমবের্তো একো, হারুকি মুরাকামি, মার্গারেট অ্যাটউড, ফিলিপ রথ, সালমান রুশদি, কজু ইশিগুরো, ওরহান পামুক প্রমুখ। এঁদের বই পড়ার ভালো বৈ কোনও খারাপ দিক তো নেই। বেস্ট সেলার হওয়ার সূত্রে লোকে বেশি করে এঁদের বই পড়লে ক্ষতি নেই বলেই আমার মনে হয়।

অলাত এহ্সান : বিশ্বের অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ আছে যেগুলো ভালো কিন্তু বহুল আলোচিত নয়, সেখানে প্রকাশকরাও বিনিয়োগ করতে চান না। সেক্ষেত্রে মানসম্মত সাহিত্য অনুবাদ কী করে পেতে পারি ?

অভিজিৎ মুখার্জি : অনেক ভেবে দেখলাম, এর কোনও মোক্ষম ব্যবস্থা করে ওঠা মুশকিল। বাজার নিয়ে হোক বা রাজনৈতিক প্রাধান্যের প্রশ্নে হোক, বইয়ে বইয়ে প্রতিযোগিতা থাকবেই, একটাকে তুলে ধরে অন্যটাকে আড়াল করার চেষ্টা থাকবেই। আর যেহেতু ভালো বই উপযুক্ত আলোচনা পেল না, এ রকম ক্ষোভের পূর্ণ প্রশমন অসম্ভব। আন্তর্জাতিক স্তরে সমমনস্ক পড়ুয়া লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে চললে (সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইডের মাধ্যমেই হোক না কেন) বহু ভালো বইয়ের খবর সেই সূত্রে পাওয়া যায়, পত্রপত্রিকায় আলোচনা ব্যতিরেকেই। তবে অনুবাদ হওয়ার জন্য বাজারের দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, নইলে রাজনৈতিক প্রচারধর্মী ম্যাটেরিয়াল হিসেবে সেই বইয়ের তাৎপর্য। আমার নিজের অবশ্য সমস্যা হলো, যত ভালো বইয়ের খবর আসে তার অধিকাংশই পড়ে ওঠার সময় করতে পারি না, অপঠিত রয়ে যায়।

অলাত এহ্সান : একটি দেশ উপনিবেশ মুক্ত হওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বিশ্বের সেরা সাহিত্য, জ্ঞানগর্ভ-মননশীল বইগুলো ব্যাপকভাবে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই, দেশি ভাষায় অনুবাদ করা। আমাদের দেশে তা হয়নি। এটা কি সাহিত্যের অগ্রগতিতে প্রভাব ফেলেছে মনে করেন ?

অভিজিৎ মুখার্জি : শিল্প বা সাহিত্যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের কথা চিন্তায়ও আনবে না, উচ্চারণেও আনবে না। শিল্প ও সাহিত্যকে আমাদের মতো হাভাতেদের দেশে একেবারে সমূলে বিনষ্টিকরণের শ্রেষ্ঠ উপায় হলো জিনিসগুলোকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের আওতায় আনা।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি : আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বই বিক্রির হিসাব নিয়ে নানা আস্ফালন বইমেলা ইত্যাদির পরেপরেই শোনা যায় বটে, আদতে বই মোটেই বিক্রি হয় না। প্রকাশকদের ব্যবসায়ে টিকে থাকার খাতিরে যা যা করতে হয় তা ফাঁস হলে যে পরিবারে কখনও কেউ প্রকাশক ছিল সেই পরিবারে কেউ আর মেয়ের বিয়ে দেবেন না! তখন একমাত্র উপায় হচ্ছে সরকারি সিলেকশন প্যানেলকে খুশি করে কিংবা সরকারে আসীন দলের দাদা ধরে একেকটি বইয়ের বেশ কিছু কপি সরকারি রামমোহন ফাউন্ডেশনের কাছে অথবা অন্য লাইব্রেরি-চেইনে (সরকারি অনুদান গ্রাহক) গছিয়ে দেওয়া। এটি জনগণকে পুস্তক পাঠে সহায়তা করার অছিলায় ট্যাক্সপেয়ারের পয়সায় যত রাজ্যের হাবিজাবি বই কিনে প্রকাশকদের উদ্ধার করে। একদিকে বইয়ের বিক্রি নেই এবং সেই সূত্রে পাঠকের বিচারের তোয়াক্কা করে লাভ নেই; অপরদিকে সরকার সংগ্রহ না করলে ধনে-প্রাণে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা―প্রকাশকরা হন্যে হয়ে ছুটছে সরকারের নেকনজরে থাকা করিৎকর্মা লেখকদের পেছনে। সহজেই আন্দাজ করতে পারছো, তারা কেমন কিসিমের লেখক! জগতের কোনও খবরই তাদের কাছে নেই, মুখ্যত সমাজের সবচেয়ে সম্ভাবনাহীন অংশ নতুবা নিষ্কর্মা সরকারি অফিসারবর্গ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (সেকালে এর চেয়ে উঁচু পদে কোনও দেশীয় উঠতে পারত না), ঠাকুরবাড়িতে রোজ এসে খানাপিনা করত সারা বিশ্বের নানা কোণ থেকে আসা সাহেব-সুবোরা। এদের দিয়ে বাংলার আধুনিক সাহিত্যের শুরু আর এখন… থাক, সেসব কথা! বেকার যুবকদের অনেকেরই দিন গুজরান হয় টিউশনি করে, আমাদের সাহিত্যিকদের কাছে কেউ ভরসা করে টিউশন নিতেও পাঠাবে না বাচ্চাদের, এমনই তাদের এলেম! এই সব সরকারের ধামাধরা, সরকারি দলের নির্দেশে চলা লেখকদের ভাবমূর্তি ও মুরোদ বোঝা গিয়েছে, তাই এখন এ বাংলায় বুদ্ধিজীবী বলতে বোঝায় মঞ্চাভিনেতা, সিনেমাভিনেতা, গায়ক ইত্যাদি কিন্তু সাহিত্যিকরা বাদ!

লোকের বই পড়ার ইচ্ছে থাকলে, যেমন রেস্তোরাঁয় গিয়ে, পোশাক কিংবা শাড়ি কিনে, নিত্য নানা ইলেকট্রনিক গ্যাজেট কিনে, বেড়িয়ে-টেড়িয়ে পয়সা খরচ করে, তেমনই পয়সা ব্যয় করে বই কিনুক। যদি কোনও সমাজে সে রকম লোকের সংখ্যা বা সাধ্য এতই কমে যায় যে, ওতে বইয়ের ব্যবসার প্রসার ঘটে না। তবে কদিন অপেক্ষা করাই শ্রেয়। তাতে আর যাই হোক সাহিত্য ধ্বংস হবে না, সীমাবদ্ধ থাকবে। এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, অর্থনীতির সঙ্গে অন্যান্য উন্নতির যোগ খুব ঘনিষ্ঠ। কিন্তু একবার রাষ্ট্র এসেছে কি সাহিত্য শেষ, যেমন পশ্চিম বাংলায়। বাংলা সাহিত্য এবং তার চেয়ে বেশি করে সাহিত্যিকরা, এখানে হাসাহাসির জিনিস! খবরদার ও পথে যাবে না!

অলাত এহ্সান : টেকনিক্যাল শব্দগুলো ছাড়াও অন্য ভাষার সাহিত্য অনুবাদে সংকট হলো যথাযথ পরিভাষার অভাব। আমাদের দেশে পরিভাষা তৈরির তেমন কোনও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয় ?

অভিজিৎ মুখার্জি : আমি সংস্কৃত জানি না, কিন্তু যাঁদের পণ্ডিত বলে মানি তাঁদের মুখে শুনে এ রকম ধারণা হয়েছে যে, নব্যন্যায় অনুসরণ করলে পরিভাষা তৈরির কাজটা বিনা ঝঞ্ঝাটে অল্প সময়ে সারা যায়। কিন্তু সেটাও তো দু-একজন লোকের কাজ নয়। সমাজের মানী লোকেদের আহ্বানে যদি সাধারণ মানুষ অর্থসাহায্য করে, কয়েকজন দায়িত্বশীল মানুষ যদি দু-এক বছরের জন্য হিসেব নিকেশ ও ব্যবস্থাপনার অন্যান্য দায়িত্ব নিতে রাজি হন তবে ট্রাস্ট গঠন করে কাজটা করে ফেলা যায়। কিন্তু প্রশ্নটা আসলে জাতীয় চরিত্রের। পরিস্থিতি যে কী সে তো আমিও জানি, তুমিও জানো!

অলাত এহ্সান : কেউ কেউ মনে করেন, অনুবাদের মান রক্ষার জন্য দেশে রেগুলেটরি বডি স্থাপন করা দরকার। আপনার কী মনে হয়, আমরা কীভাবে মানসম্মত অনুবাদ পেতে পারি ?

অভিজিৎ মুখার্জি : এখন ও নিয়ে ভাবার সময় আসেনি। আপাতদৃষ্টিতে মান বজায় রাখার কাজটা কোনও সংস্থার হলেও, প্রকৃতপক্ষে পাঠকের শিক্ষার মানের ওপর নির্ভর করে বাঞ্ছিত মান নির্ধারিত হওয়াটা। বিতর্ক উঠবে প্রতিটি পদে, তখন নিরসন করবে কে ? কার কথা সর্বজনগ্রাহ্য হবে ? সেই বা এ কাজে সময় দেবে কেন মান যাচাইয়ের নিয়ম বারবার লঙ্ঘিত হলে ? আর, যেখানে নিয়ম লঙ্ঘনের উপায় নেই, অচিরেই সেই সংস্থা অকেজো করে দেওয়া হবে। মোটের ওপর পাঠক অবোধ শিশু হয়ে থাকলে কিছুই হবে না, তার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। দেশের শিক্ষার প্রসার আর শিক্ষার মান এটাই অনুবাদের মানকেও সরাসরি প্রভাবিত করে এবং সেটা পাঠকের দিক দিয়ে।

অলাত এহ্সান : অনুবাদ তো দুইভাবেই হতে পারে। বিদেশি সাহিত্য দেশি ভাষায়, দেশি সাহিত্য বিদেশি ভাষায়। আমরা কিন্তু তা দেখছি না।

অভিজিৎ মুখার্জি : অর্থনৈতিক সুযোগ একটা পর্যায়ে না পৌঁছলে বিদেশি ভাষা নিষ্ঠা নিয়ে শেখার চল কমে যায় সমাজে। উদ্বৃত্ত অর্থ না থাকলে শিক্ষিত লোকেরা সেই অবসরটুকু পান না, যার প্রসাদে খেয়ালখুশি মতো দীর্ঘদিনের অধ্যয়নে বিদেশি ভাষা উপযুক্ত রকম শিখে নিয়ে দেশি টেক্সট বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করতে প্রয়াস পান। রবীন্দ্রনাথের প্রজন্মে ঠাকুরবাড়ির লোকেরা এ রকম বহু অনুবাদ করেছিলেন। দারাশুকোর উপনিষদ অনুবাদ তো একটা মাইলস্টোন অবদান হয়ে আছে! সুফি আন্দোলনে ওঁর এই অনুবাদের অবদান ইতিহাসকেই পালটে দিয়েছে, Richard Eaton-Gi Rise of Islam and the Bengal Frontier, ১২০৪-১৭৬০ বইতে পড়েছি। একটা ইংরেজি কথা আছে না, ‘It is the economy stupid!’ সেদিকটা অতিক্রম করে কিছু করে ওঠা মুশকিল।

অলাত এহ্সান : অনুবাদ আমাদের সাহিত্যে কী অবদান রাখছে ?

অভিজিৎ মুখার্জি : আমাদের সাহিত্যে দুর্ভাগ্যবশত তেমন চোখে পড়ার মতো অবদান রাখতে পারছে না। কারণ আমাদের সাহিত্যের জগতে অনুবাদ যেমন অবহেলিত―তেমনই অবহেলিত সাহিত্য বিচার, সাহিত্য নিয়ে ক্রিটিক্যাল আলোচনা। এর ফল হচ্ছে যে অমিতাভ ঘোষ কেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চেয়ে অনেক অনেক বড় লেখক―সেটুকুও অধিকাংশ পাঠক অনুধাবন করে উঠতে পারেন না। অনুবাদের থেকে সুফল নিতে গেলে তো অনূদিত সাহিত্যকৃতিটির বিশেষত্ব কী সেটা অনুধাবন করতে হবে। সেই আলোচনাও যে তেমন হয় না, অনুবাদের ওপরেও যে তেমন জোর নেই, এসবই কিন্তু স্থানীয় লেখালেখির বাজারটা ধরে রাখতে মাতব্বরদের কায়েমি স্বার্থ। সাহিত্যটা প্যাশন হয়ে ওঠার বদলে হাভাতেদের করে খাওয়ার জায়গা হয়ে গেলে এ রকমই হয়। বুর্জোয়া ডেভেলপমেন্ট বলে যে কথাটা আছে, সেটির অভাব সাহিত্যের সর্বস্তরে লক্ষ করা যায়।

আমার খুব প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম―দস্তয়েভস্কিই যে ওঁর কাছে অন্যদের থেকেও একটু বিশেষ স্থান পাওয়া লেখক। ওঁর লেখনশৈলীতে মোটেই দস্তয়েভস্কি তেমন প্রত্যক্ষভাবে ফুটে ওঠেন না, কিন্তু কিছু কিছু ইস্যু যেভাবে ওই রুশ স্রষ্টা তাঁর লেখায় এনেছেন, নিজের চিন্তাকে যেভাবে অভিব্যক্তি দিয়েছেন, তার থেকে গভীর অভিনিবেশে নিজের মতো করে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিছু আহরণ করেছেন নিশ্চয়ই। অনুবাদ যত দিন না যথেষ্ট অবদান রাখতে পারার মতো পরিস্থিতি পাচ্ছে, স্থানীয় সাহিত্যের মান তত দিনই অকিঞ্চিৎকর হয়েই থাকবে।

অলাত এহ্সান : অন্য একটি ভাষায় লেখা অনুবাদ হচ্ছে অথচ লেখক জানছেন না, রয়েলটি পাচ্ছেন না। মূলানুগ অনুবাদের জন্যও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে না।

অভিজিৎ মুখার্জি : সৌভাগ্যের বিষয় হলো, অনুবাদ যাঁরা করাচ্ছেন আর মূল রচনাটি যাঁদের প্রকাশনার এবং মূল রচনার লেখক, এই তিন পক্ষই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষয়টা একই চোখে দেখে! বাংলা বইয়ের বাজার যে সীমিত―খবরটা বিদেশি প্রকাশকরা জানেন, লেখকরাও জানেন। আর তাই তাঁদের অনুমতি না নিয়েই যে অনুবাদ বাজারে ছাড়া হচ্ছে, এটা সরাসরি অনুমোদন না করলেও ঝামেলা সাধারণত করেন না। যেটা খেদের দিক সেটা হলো, যদি কোনও প্রকাশক সৎভাবে যথোপযুক্ত অনুমতি নিয়ে রয়্যালটি দিয়ে বা লাইসেন্স ফি দিয়ে অনুবাদটি প্রকাশ করার প্রকল্প নেন, তখন বারবার সেই মর্মে আবেদন করেও মূলের প্রকাশকের ও লেখকের থেকে কোনও রকম সাড়া পাওয়াই দুষ্কর হয়ে ওঠে, প্রতীক্ষা করতে হয় অনন্তকাল। তারপর হয়তো কোনও এক সময় গড়িমসি করে তাঁরা সাড়া দেন, কাগজপত্রে সই-সাবুদ হয় কিন্তু এর মধ্যে কেটে যায় দেড় কি দু বছর! প্রকৃত পরিস্থিতি হলো, প্রকাশকরা স্থানীয় সীমিত সামর্থ্যরে লেখককেই যেখানে প্রাপ্য টাকা না দিয়ে পার পেয়ে যান, সেখানে শত শত কোটি টাকার মালিক বিদেশি লেখককে রয়্যালটির টাকা দেবে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, এ প্রত্যাশাই করা যায় না। জাতিগতভাবে আমাদের চরিত্রে বড় খামতি, ন্যায়ের কোনও আসন নেই, তাই উন্নতিও হয় না।

অলাত এহ্সান : নতুন লেখক তৈরির ক্ষেত্রে লিটলম্যাগ গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। আজকের দিনে অনেকের মধ্যে অনুবাদক হওয়ার চিন্তাও দেখা যায়। অনুবাদক তৈরির ক্ষেত্রে কোন মাধ্যমটি আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন ? মানে, আদৌ কি তেমন কোনও মাধ্যম আছে ?

অভিজিৎ মুখার্জি : মূল লেখককে রয়্যালটি দেওয়া হচ্ছে না, এই দিকটার থেকে যদি আপাতত একটু চোখ সরিয়ে রাখি তাহলে আমাদের চাহিদা হওয়া উচিত যত ব্যাপকভাবে সম্ভব অনুবাদ হওয়া। তথাকথিত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা নিজেদের মতো করে নানা ক্যালকুলেশন করে ঠিক করে কোন ধরনের লেখাকে কতটা জায়গা দেওয়া হবে। সেখানে যথেচ্ছ অনুবাদ ছাপানোর সুযোগ হওয়া মুশকিল। সে ক্ষেত্রে রইল লিটল ম্যাগাজিন। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের রাজনীতিও বহুক্ষত্রেই একপেশে, এক ধরনের গোঁয়ার-গোবিন্দ নির্বোধ নীতিতে পর্যবসিত হয়! তখন সাহিত্যমূল্য বা অন্যান্য নিরিখের তুলনায় রাজনৈতিক মত প্রচারে তাৎক্ষণিক উপযোগিতাই অনূদিত হওয়ার জন্য অগ্রাধিকার পেতে থাকে। সেই প্রবণতা এড়াতে পারলে লিটল ম্যাগাজিন ভালো অনুবাদক তৈরি হওয়ার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠতে পারে।

অলাত এহ্সান : লেখালেখির ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের কথা প্রায়ই শোনা যায়। দেশে অনুবাদের তেমন পেশাদারি দেখছি না।

অভিজিৎ মুখার্জি : পেশাদারির প্রসঙ্গ তখনই ওঠে যখন একটা আইন মোতাবেক অর্থনৈতিক উদ্যোগের পরিবেশ তৈরি হয়। উঞ্ছবৃত্তিই যেখানে একেবারে স্বাভাবিক মূলস্রোত বলে গ্রাহ্য, সেখানে পেশাদারির কথা আসে না। আমি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি, বাংলাদেশ সম্বন্ধে মন্তব্য করার মতো যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নই।

অলাত এহ্সান : অনুবাদের জন্য পাশ্চিমবঙ্গ ও ঢাকায় রাষ্ট্রীয় পদকও দেওয়া হচ্ছে। এটা মানসম্মত অনুবাদের ক্ষেত্রে কি কোনও ভূমিকা রাখছে ?

অভিজিৎ মুখার্জি : এই ব্যাপারে মন্তব্য করার মতো আমি অবহিত নই পরিস্থিতি সম্পর্কে। তবে পদক-টদকের ওপর খুব গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো। আত্মসম্মানজ্ঞানহীন নিম্ন রুচির লোকেরা মরিয়া হয়ে পদক জোটাতে উঠেপড়ে লাগে, খোসামুদির বান ডেকে যায়, খুব ছোট মাপের মানুষেরা সব নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, আর প্রকৃত যোগ্য লোক সাহিত্যের অঙ্গন এড়িয়ে চলে।

অলাত এহ্সান : ঢাকার উজান প্রকাশন থেকে আপনার একটা অনুবাদ গল্প সংকলন প্রকাশ হয়েছে বিগ্রহ ও নিরাকার নামে। এগুলো ধর্ম আশ্রিত গল্পের সংগ্রহ। ইংরেজির কথা জানি না, তবে এই ধরনের গল্প সংকলন সম্ভবত বাংলা ভাষায় দেখিনি। এর উৎসাহ কোথায় ? এ প্রসঙ্গে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল, আপনার প্রিয় লেখক (এক লেখায় বলেছিলেন) গ্রাহাম গ্রিনের দ্য পাওয়ার অ্যান্ড গ্লোরি উপন্যাসের কথা। সেখানে মূল চরিত্র ‘হুইস্কি প্রিস্টের’ যে প্রেরণা―দুর্বলের সেবায় নিজেকে উৎসাহ করার যে উৎসাহ ―তেমন উৎসাহ কি আপনার মধ্যে কাজ করেছে ?

অভিজিৎ মুখার্জি : সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে ধর্মবোধের বিবর্তন হতে হবে। কোনও একটা পর্যায়ের ধর্মবোধকে আঁকড়ে থেকে গোঁয়ার্তুমি করাকে পবিত্রতা বলে চালানোর চেষ্টা করলে ধর্মবোধ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, সভ্যতার বড় ক্ষতি তো হবেই, টিকবেই না সম্ভবত। অথচ ধর্মবোধ লাগবে, ঈশ্বরচেতনা লাগবে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৈনন্দিন জীবনকে খোলা চোখে দেখতে যে প্রস্তুতি, তার ভিত্তিতেই থাকে জ্ঞাতসারে বা অজানিতে ঈশ্বরচেতনা। গ্রাহাম গ্রিনের দ্য পাওয়ার অ্যান্ড দ্য গ্লোরি আমাকে খুব জোরালোভাবে নাড়া দিয়েছিল। উপন্যাসটার প্রভাব আমার চিন্তাধারার ওপর স্থায়ীভাবে থাকবে বলেই মনে হয়।

অলাত এহ্সান : ঈশ্বরচেতনা প্রসঙ্গ থেকে আরেকটি বিষয় মনে হলো, করোনার শুরুর পরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ভিডিও মাধ্যমে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে পাল্টাপাল্টি তর্ক দেখলাম। আপনি বিজ্ঞানের অধ্যাপক, ধর্ম নিয়েও পর্যবেক্ষণ আছে―এ নিয়ে আপনার কি বক্তব্য ? বলে রাখি, ধর্মবিরোধিতা বা নাস্তিকতার অজুহাতে দুই দেশেই সাম্প্রতিক সময়ে ‘মুক্তমতের’ মানুষ হত্যার নজির আছে।

অভিজিৎ মুখার্জি : ধর্মবিরোধী, যাদের ‘মুক্তমনা’ বলার রেওয়াজ হয়েছে, এমন মানুষদের হাতে অজস্র ধর্মবিশ্বাসী লোকেদের মৃত্যুর কথাও ভুলে যেও না। চীনে, কম্বোডিয়ায়, সোভিয়েত দেশে, মেক্সিকোতে কি ধর্মবিশ্বাসীরা নির্যাতিত হননি, বা প্রাণ হারাননি ? সেটা খুব জটিল প্রসঙ্গ নয়, কোনও ক্ষেত্রেই হত্যা, নিপীড়ন ইত্যাদি কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু আমি যেখানে যেখানে দেখেছি, ধর্ম আর বিজ্ঞানকে পরস্পরবিরুদ্ধ বলে প্রচারের চেষ্টা চলেছে, সেখানেই মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি অবস্থানগুলোর চরিত্রটা কী ? সর্বত্রই দেখেছি, হয় কুসংস্কারকে ধর্মবিশ্বাস বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে, ঈশ্বরচেতনার ইতিহাস, ঈশ্বরচেতনাকে ভিত্তি করে সৃষ্টিশীলতার ইতিহাস সম্বন্ধে করুণ অজ্ঞতা দেখেছি সেখানেই। নতুবা দেখেছি, মানুষের প্রতি ভালোবাসার এবং দায়বদ্ধতার অভাবে বিজ্ঞানের নারকীয় অপব্যবহারের ইতিহাস সম্বন্ধে চরম অজ্ঞতা।

মনে রেখো, অ্যামেরিকার কোনও মিলিটারি জেনারেল প্রথমে হিরোশিমায় পরমাণু বোমাটি ফেলতে রাজি হননি, জায়গাটা নেহাতই নিরীহ সিভিলিয়ানদের বসতি বলে। বোমাটা ফেলা হয়েছিল কেবল বিজ্ঞানীদের পীড়াপীড়িতে। তারা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিল ঘন জনবসতিতে বিধ্বংসী প্রভাব কত দূর ছড়াতে পারে। আশীষ নন্দীর দ্য টির‌্যানি অব সায়েন্স বইটা পড়ে দেখো। এছাড়াও জগদীশ চন্দ্র বসু, সি. ভি. রামন, হাইজেনবার্গ, এঁদের লেখা পড়লেও উপকার হবে। পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন বিশদে বুঝিয়েছিলেন, কেন ধর্মবোধ বিচ্যুত মানুষ পুঁজিবাদের কাছে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত নাগরিক, পুঁজির স্ফীতিতে কেন তারাই শ্রেষ্ঠ ইন্ধন।

সংগঠিত পুঁজির সহায়তা পেতে অনেক বিজ্ঞানী অনেক সময় ধর্মবোধহীনতার পক্ষে সওয়াল করেন বটে, একটু হাঁড়ির খবর নিলেই জানা যায়, সেই এনলাইটেনমেন্টের মূলে কোনও স্বার্থ কাজ করছে।

টীকা :

* সলিল চৌধুরী (নভেম্বর ১৯, ১৯২৫―সেপ্টেম্বর ৫, ১৯৯৫): ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক। বাংলা, হিন্দি ও মালয়ালম চলচ্চিত্রে সঙ্গীতে তাঁর অবদান স্বীকৃত। তাঁর গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ পুরস্কৃত হয়েছে। পশ্চিমা ও ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের সমন্বয়ের জন্য তাঁকে বিশিষ্ট মনে করেন সংগীতজ্ঞরা। গণসংগীতের জন্য তিনি বিখ্যাত।

* থমাস হার্ডি (Thomas Hardy, ২ জুন ১৮৪০―১১ জানুয়ারি ১৯২৮): ইংরেজ সাহিত্যিক ও কবি। অল্প বয়সে লিখতে শুরু করলেও ত্রিশ বছর বয়সের আগে কোনও লেখা প্রকাশিত হয়নি। উপন্যাস ও গল্পে খ্যাতির তুঙ্গে থাকা দিনে লেখা বন্ধ করে দেন। পরে তিন দশক শুধু কবিতাই লেখেন।

* হারুকি মুরাকামি (Haruki Marukami, ১২ জানুয়ারি ১৯৪৯): বেশ কয়েক বছর যাবৎ সাহিত্যে নোবেল ঘোষণার সময় তাঁকে নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে ওঠে। বিশ্বের অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। দি গার্ডিয়ানের মতে, ‘মুরাকামি তার কর্ম ও অর্জনে পৃথিবীর জীবিত সেরা ঔপন্যাসিকদের একজন।’ জাপানি লেখক। তবে বাংলাসহ অর্ধশতাধিক ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে। তিনি রেমন্ড কার্ভার এবং জে ডি স্যালিংগারে লেখা জাপানিতে অনুবাদ করেছেন। পাশ্চাত্য সাহিত্য ও তত্ত্ব দিয়ে অনুপ্রাণিত লেখক মনে করা হলেও তাঁর লেখায় বৌদ্ধদর্শনের বিস্তার অনেক।

* নকশাল আন্দোলন: বিশ শতকের সপ্তম দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি গ্রামে শুরু হওয়া সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন। চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বলয়ের বিভেদে মাও জে দংয়ের মতাদর্শের কট্টর অনুসরণ করে গঠিত পার্টি দুই বাংলার বাইরেও বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। মতাদর্শিক বিভেদ, আন্তঃকোন্দল ও শ্রেণি হত্যাকাণ্ডের জন্য সমালোচিত। কৃষক-শ্রমিকের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের নীতিতে বহু তরুণ এতে যুক্ত হয়েছিল। পরে রাষ্ট্রের নৃশংস দমনের শিকার। এ নিয়ে এখনও অনেক আলোচনা-সাহিত্য-চলচ্চিত্র হচ্ছে।

* ভি এস নাইপল (Sir Vidiadhar Surajprasad Naipaul, ১৭ আগস্ট ১৯৩২-১১ আগস্ট ২০১৮) : ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাহিত্যিক। উপন্যাস-প্রবন্ধ ছাড়াও ভ্রমণকাহিনিতে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তিনি সমাদৃত ও সমালোচিত। সমালোচনার ভেতর দিয়ে আত্মোপলব্ধিতে পৌঁছানোয় গুরুত্ব দিয়েছেন সাহিত্যে। ‘আ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ উপন্যাসের অনন্য গদ্যশৈলীতে ইংরেজি ভাষাকে অনন্য উচ্চতায় তুলেছেন। ১৯৭১ সালে বুকার পুরস্কার ও ২০০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয় করেন। ক্যারিবীয় দ্বীপ ত্রিনিদাদে জন্ম নেওয়া নাইপল স্কলারশিপ পেয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তাঁর জীবনের বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে।

* অমিতাভ ঘোষ (Amitav Ghosh, ১১ জুলাই ১৯৫৬): ঢাকায় ষাটের দশকের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা নিয়ে লেখেন ‘দ্য শ্যাডো লাইন’। উপন্যাসটি পড়ে খুশবন্ত সিং বলেছেন, This is how language should be used. This is how a novel should be written. পূর্বপুরুষ বাংলাদেশি, তাঁর জন্ম কলকাতায়। সমসাময়িক বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ লেখক। সাহিত্যে ইতিহাস ও জলবায়ু ইস্যুকে ব্যবহার করেছেন। ভারতে সাহিত্যের সর্বোচ্চ ‘জ্ঞানপীঠ’ পদকসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর সাহিত্যে বাংলাদেশ ও সুন্দরবনের বিষয় বারবার এসেছে। নন-ফিকশন ছাড়াও ‘দ্য আইবিস ট্রিলজি’ তাঁর বিখ্যাত কাজ। একাধিক উপন্যাস বাংলায় অনূদিত হয়েছে।

* সালমান রুশদি (Salman Rushdie, ১৯ জুন ১৯৪৭): তাঁর ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ উপন্যাসটি ১৯৯৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ২৫ বছরে সেরা উপন্যাস হিসেবে ‘বুকার অফ বুকারস’ জয় করে। বিশ্বের শীর্ষ সব সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-আমেরিকান সাহিত্যিক। দ্য টাইমস পত্রিকার হিসেবে ১৯৪৫ সালের পর থেকে যুক্তরাজ্যের সেরা ৫০ জন সাহিত্যিকের তালিকায় তাঁর স্থান ১৩তম উল্লেখ করে। তাঁর প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনি অনন্য। জাদুবাস্তবতার সঙ্গে ঐতিহাসিক কল্পকাহিনি মিশেলে লেখেন। কাহিনির অনেকটা অংশ জুড়েই থাকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস। ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ ঘিরে তর্কের পর মৃত্যুর ফতোয়া মাথায় নিয়ে দেশ ছাড়তে হয়। বহুবার আততায়ীর আক্রমণের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে আক্রান্ত হন।

* মিশিমা ইউকিউ (Mishima Yukio, ১৪ জানুয়ারি ১৯২৫―২৫ নভেম্বর ১৯৭০): ১৯৬৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য যখন মিশিমার নাম চূড়ায় উঠে, সেই বছর তাঁর স্বদেশি সুহৃদ কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি পুরস্কারটি পান। তাঁর সাহিত্যের আধুনিক পাঠ ও বিশ্লেষণ বেড়েই চলছে। দেশপ্রেম আর দর্শনের মিশেলে তাঁর সাহিত্য সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার ও রূপকের জন্য অধিক খ্যাত। কবি, নাট্যকার, অভিনেতা ছিলেন। জাপানের বিখ্যাত সামুরাই বংশে জন্ম। ঐতিহ্যবাহী রাজপ্রথায় ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর সম্মানসূচক আত্মহনন করেন। তাঁর বিখ্যাত কাজ ‘স্বর্ণমন্দির’ বাংলায় অনূদিত হয়েছে।

* ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (Yasunari Kawabata, ১১ জুন ১৮৯৯―১৬ এপ্রিল ১৯৭২) : নোবেলজয়ী প্রথম জাপানি সাহিত্যিক (১৯৬৪)। দারুণ কাব্যিক লেখা তাঁর রচনা এখনও বিশ্বে জনপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অণুপ্রেরণা মনে করতেন, আর তাঁর থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন স্বদেশি সাহিত্যিক মিশিমা ইউকিও। জাপানের প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার দ্বন্দ্ব, সৎ জীবন ও যৌনতার বিষয় অসামান্য কল্প কুশলে এসেছে তাঁর সাহিত্যে। তিনি বলেন, ‘অনেক লেখক কবিতা দিয়ে তাঁদের লেখক জীবন শুরু করেন। আমি নিজে কবিতার বদলে লিখে গেছি ছোট ছোট গল্প।’ ১৯৭২ সালে অনেকের মতো সম্মানসূচক আত্মহনন বেছে নেন কাওয়াবাতা।

* কেনজাবুরো ওয়ে (৩১ জানুয়ারি ১৯৩৫) : প্রথম উপন্যাসিকার জন্যই পেয়েছিলেন জাপানের সম্মানজনক আকুতাগাওয়া পুরস্কার। জাপানি সমসাময়িক সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখেছেন। জাপানি ইতিহাস ও কিংবদন্তিকে সমসাময়িক ইতিহাসের আলোকে উপস্থাপনে সিদ্ধহস্ত। দ্বিতীয় জাপানিজ হিসেবে ১৯৯৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পান। সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে পৃথিবীকে রক্ষায় উচ্চকণ্ঠ। তাঁর সাহিত্য ও রাজনৈতিক মতাদর্শে ফ্রান্স ও মার্কিন আমেরিকা প্রভাবিত বলে তর্ক আছে।

* রিচার্ড ইটন (Richard Maxwell Eaton, ১৯৪০) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসবিদ, ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার অধ্যাপক। ১৮০০-পূর্ব ভারতে ইতিহাস গবেষণার জন্য তিনি আলোচিত। দক্ষিণী ভারতের দেক্কান, বাংলা সীমান্ত, ভারতে ইসলাম ও পারস্য সময়ে ভারত, মধ্যযুগ থেকে ব্রিটিশ আগমন পর্যন্ত সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে তাঁর মূল কাজ। তাঁর ‘দ্য রাইস অফ ইসলাম অ্যান্ড দ্যা বেঙ্গল ফ্রন্টায়ার, ১২০৪-১৭৬০’ বইয়ে বাংলায় ইসলামের আগমন ও মুসলিমদের বিস্তার নিয়ে গবেষণা বিস্তর তর্কের জন্ম দিয়েছে।

* গ্রাহাম গ্রিন (Henry Graham Greene, ২ অক্টোবর ১৯০৪―৩ এপ্রিল ১৯৯১) : বিশ শতকের অন্যতম ইংরেজ ঔপন্যাসিক। একাধিকবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ক্ষুদ্র তালিকায় ছিলেন। শেক্সপিয়ার, জেরুজালেম পুরস্কারসহ বহু সম্মানে ভূষিত। জনপ্রিয় ধারার থ্রিলার, স্পাই উপন্যাস লেখেন বিস্তর। তবে ৬৭ বছরের লেখক জীবনে উপন্যাস ২৫ টি। ক্যাথলিক ধর্মীয় বিষয়বস্তু নিয়ে দ্য পাওয়ার অ্যান্ড দ্য গ্লোরিসহ অনেক গম্ভীর ক্যাথলিক উপন্যাসের প্রধান সারির লেখক। তিনি নিজেকে রোমান ক্যাথলিক ঔপন্যাসিক বলার চেয়ে ঔপন্যাসিক যিনি ক্যাথলিক বলার দাবি করেছিলেন।

* সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন (Sarvepalli Radhakrishnan, ৫ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮―১৭ এপ্রিল ১৯৭৫): প্রখ্যাত দার্শনিক ও অধ্যাপক। ভারতের তামিলনাড়ুর তিরুট্টানিতে হতদরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম। রাধাকৃষ্ণনের আগ্রহ অনুযায়ী, তাঁর জন্মদিনে ভারতে শিক্ষক দিবস পালিত হয়। স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ব্রিটিশ নাইটহুড, ভারতরত্ন উপাধি পান। বেদান্ত দর্শন নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তবে ১৯২৯ সালে বাঙালি দার্শনিক অধ্যাপক যদুনাথ সিংহের সঙ্গে থিসিস নিয়ে তাঁর মোকদ্দমা হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button