আর্কাইভকথাসাহিত্য

সাহিত্য-বিশ্লেষণ : শব্দঘর : গল্পসংখ্যা ২০২৩ সমকালীন গল্পের চিন্তাবৈচিত্র্য : জাকিরুল জাকির

আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিজের গতিপথে যতগুলো মোড় নিয়েছে, তার সব কটিতেই যুক্ত আছে কোনও না কোনও সাহিত্যের কাগজ। শুধু বাংলা সাহিত্য নয় বিশ্বসাহিত্যের সকল শাখায় নবযুগ সৃষ্টির আতুরঘর হিসেবে ভূমিকা রেখেছে সাহিত্যপত্রিকা। আমরা জানি বঙ্গদর্শন, সবুজপত্র, কল্লোল, কালি ও কলমের মতো এমন কিছু পত্রিকা যুগপরম্পরায় সচল থেকেছে, যেগুলো আসলে সমকালকে ধারণ করে নতুন সাহিত্য সৃজনে এগিয়ে থেকেছে; পুষ্ট করেছে বাংলা সাহিত্য এবং নিজে হয়েছে অমর। এরই ধারাবাহিকতায় শব্দঘর নিজের সময়কে সঙ্গে নিয়ে নতুন যুগের দিকপাল হয়ে বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনও ভূমির সন্ধান দেবে, এমন আশাকে দুরাশা জ্ঞান করার যৌক্তিকতা বাস্তবে অল্প। কেননা শব্দঘরকে যদি প্রশ্ন করা যায়,

‘তুমি কি কেবলই ছবি শুধু পটে লিখা ?

ওই যে সুদূর নীহারিকা

যারা করে আছে ভিড়

আকাশের নীড়,

তুমি কি তাদের মত সত্য নও ?’

সরস বচনে শব্দঘর তখন বলবে, যুগশ্রেষ্ঠ মহারথীগণ আমার উপদেষ্টা, দেশ-বিদেশের সফল ব্যক্তিত্বগণ আমার সমন্বয়ক, সম্পাদক স্বয়ং মোহিত কামাল, যার মনোচিন্তনের আশ্রয়ে আমার মানসভূমি সদা বিকাশ-তাৎপর্যে উদ্ভাসিত; ধ্রুবতারার মত প্রোজ্জ্বল ধ্রুব এষ, যার নিপুণ হাতের কারুকাজে আমার শারীরিক সৌন্দর্য নির্মিত; খ্যাতিমান শব্দসৈনিকগণ জোগান দেন আমার গর্ভাংশ; তাহলে আমি কি করে শুধু পটে লেখা ছবি হতে পারি ?

বিশ শতকের প্রথম ভাগে অনেক সম্ভাবনাময় সাহিত্যপত্রিকা যেখানে নিজেকে দু-চার বছরের বেশি জীবন্ত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে শব্দঘর প্রকাশ করেছে নিজের দশম বর্ষের দশম সংখ্যা, যা ইঙ্গিত দেয় স্বপ্নজয়ী হওয়ার। এবারের শব্দঘর মোট বাইশটি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের গল্প নিয়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক উপস্থিতি জারি রেখেছে। প্রচ্ছদরচনা : গল্পসংখ্যা ২০২৩ শিরোনামে সংকলিত হয়েছে এগারোটি গল্প। আত্মহত্যাবিরোধী বিশেষ তিনটি গল্প, যা এ সংখ্যার বিশেষত্ব। এছাড়া বিশ^সাহিত্যের বিশাল ক্ষেত্র থেকে তুলে আনা অনূদিত পাঁচটি গল্প সংখ্যাটির তাৎপর্য বৃদ্ধি করেছে। সেই সঙ্গে আমাদের বাংলা সাহিত্যকে অনুবাদের মাধ্যমে বিশ^সাহিত্যের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার যে দায়িত্ব পত্রিকাটি পালন করে চলেছে তা নিঃসন্দেহে অপরাপর সাহিত্য পত্রিকা থেকে শব্দঘরকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পৃথক মর্যাদায় চিহ্নিত করবে বলে আশা করা বাহুল্য কিছু নয়।

এই সংখ্যায় উপস্থাপিত গল্পগুলো সমকালীন সাহিত্যে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কেননা এতে রয়েছে সমকালীন রাজনৈতিক চিন্তন, ব্যক্তি-মনস্তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত তথা সমাজমনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা; আত্মহত্যার মতো সামাজিক ব্যাধি নিরাময়ের প্রচেষ্টা এবং বিশ^সাহিত্যের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আকাক্সক্ষা। এমন বৈচিত্র্যময় চিন্তাসমষ্টির উপস্থাপন অবশ্যই শব্দঘরকে কালজয়ী করে তুলবে। প্রচ্ছদ রচনার এগারো গল্পকারের মধ্যে স্থান পেয়েছেন অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, নলিনী বেরা, মোহিত কামাল, বিশ^জিৎ চৌধুরী, পারভেজ হোসেন, জাকির তালুকদার, ইমতিয়ার শামীম, শিমুল মাহমুদ, আফসানা বেগম, ফজলুল কবিরী। আত্মহত্যাবিরোধী বিশেষ গল্প লিখেছেন দীপু মাহমুদ, আশরাফ জুয়েল এবং স্বকৃত নোমান। আত্মহত্যাবিষয়ক প্রজেক্ট ধরে এগোনো এই তিনটি গল্প গতানুগতিক ধারায় নির্মিত যা এই বিশেষ গল্পসংখ্যাটির আলাদা ইমেজ তৈরি করেছে। ব্রুনো শুলজ-এর গল্প অনুবাদ করেছেন রঞ্জনা ব্যানার্জী; উৎপল দাশগুপ্ত অনুবাদ করেছেন ইতালো ক্যালভিনোর গল্প; জয়েস ক্যারল ওটস-এর গল্প অনুবাদ করেছেন ফারহানা আনন্দময়ী; মিলটন রহমান অনুবাদ করেছেন হারুকি মুরাকামির গল্প এবং ঝুম্পা লাহিড়ির গল্প অনুবাদ করেছেন উৎপল দাশগুপ্ত। অপরদিকে বাংলা সাহিত্য থেকে ইংরেজি ভাষায় শাহীন আখতারের গল্প অনুবাদ করেছেন তাসনিম সুলতানা ডেইজি; মামুন হুসাইনের গল্প অনুবাদ করেছেন ফাহমিদা শারমিন এবং আনিসুল হকের গল্প অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম।

কার্ল মার্কস তাঁর পুঁজির উদ্ভব গ্রন্থে পুঁজিপতিদের কলাকৌশল বর্ণনা করতে গিয়ে গল জাতির ইতিহাসের যে নির্মম বাস্তবতা বর্ণনা করেছেন তাতে দেখা যায় ১৮২৫ সালের কিছু আগেও যে গলদের ছিল নিজস্ব আবাস, আবাদি জমি; ১৮২৫ সালের পরে তাদের সে স্থান অধিকার করে নেয় কোম মহাশয়দের মেষ খামার। গলরা নিজেদের বাস্তু থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় নোনাপানির সমুদ্রতীরে; যেখানে তাদের যাপন করতে হতো উভচর জীবন। শেষ পর্যন্ত কোম অভিজাতদের লোলুপ দৃষ্টির কারণে গলদের হারাতে হয়েছিল সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলও। পুঁজি বিকাশের এমন পাশবিক অত্যাচার, উপনিবেশবাদ তথা উত্তরাধুনিকতার অনিবার্য পরিণতিকে আশ্রয় করে এ সংখ্যার প্রথম গল্প রচনা করেছেন অমর মিত্র, যাকে পৃথকভাবে বাংলা নবনাট্য আন্দোলনের বাহক মনোজ মিত্রের সহোদর বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না; কেননা তিনি নিজেই ধ্রুবপুত্র-এর জনক।

ঔপনিবেশিক কলাকৌশল এমন কিছু চিন্তাবীজ বপন করে কলোনিবাসিন্দাদের মাঝে, যার ফলভারে উত্তর-ঔপনিবেশিক কালেও কলোনিবাসিন্দারা ভুলে থাকে নিজ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্বদেশ তথা নিজ বাসস্থানকে। এমন এক পরিস্থিতির বর্ণনা করেছেন লেখক ‘অনিকেত নিকেতন’ গল্পটিতে। চন্দ্রশেখর এমন এক পুঁজিবাদী কলোনিয়াল খাটাশ যে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর থেকে এসে ধীরে ধীরে নিজের শেকড় বিস্তার করেছে সুবির-অখিলের স্বপ্ননির্মিত ফ্লাটে, ‘এইটা পছন্দ হয়েছে, হাউজিংটাকে আমি আধুনিক করে তুলব, ভালো লাগবে আপনাদের।’ চন্দ্রশেখরের এই উক্তিতে স্মরণ হয় সেই তথাকথিত সভ্য সাদা চামড়ার প্রতিনিধি দলের কথা; যারা সভ্যতার বুলি আওড়ে লুট করে কলোনির ভবিষ্যৎ। যারা বলে, তোমরা অসভ্য, বর্বর, তোমরা বন্য; তোমাদেরকে সভ্য, আধুনিক করার মহান দায়িত্ব নিয়ে আমরা তোমাদের কাছে এসেছি, গ্রহণ করো আমাদের মহাগ্রন্থের বাণী। এমন চারুবচনে যেভাবে লুট হয়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলসহ পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকা, যেভাবে গলদের স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল তাদের আবাসভূমি ঠিক একই নিয়মে বিস্মৃত হয় সুবির-অখিলের সেই ‘অনিকেত নিকেতন’। শৃঙ্খলকে অলংকার জ্ঞান করলে তা ভাঙা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। শৃঙ্খল ভাঙার আগে কী, কোথায়, কীভাবে শৃঙ্খল হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা জানা জরুরি। শৃঙ্খল ভাঙনের বিজ্ঞান যাতে লাঞ্ছিত না হয় তাই যথাযথ ব্যাকরণ মেনেই সেই শৃঙ্খল ভাঙতে হয়। ‘অনিকেত নিকেতন’ পাঠকদের এই শৃঙ্খল ভাঙার ইশারা দেয় কিনা এটি আমাদের ভাবনায় ফেলে। পাশাপাশি নব্যউপনিবেশবাদের অনিবার্য দম-আটকানো সংকটের রহস্যও একীভূত হতে থাকে।

‘ব্রেস্ট ক্যানসার’ এ সংখ্যার নবম গল্প; যার কথাকার শিমুল মাহমুদ। অতীত থেকে মূলধন সংগ্রহ করে বর্তমানের বুকে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ পরিক্রমা বর্ণনাকারী কবি, ক্রিটিক ও কথাসাহিত্যিক শিমুল মাহমুদ; যার রচনামাত্রই মুক্তচিন্তার বাহন। শিমুল মাহমুদের এই গল্পটিতে মুক্তচিন্তার পথ ধরে দর্শনচিন্তার অবকাশ পরিলক্ষিত হয়। অথচ আমরা জানি সৃজনশীল লেখায় তত্ত্ব ও দর্শন ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় সম্ভাবনাময়ী হাজারো লেখা কীভাবে ব্যর্থ হয়ে গেছে। এই ব্যর্থতার দায়ভার স্বীকার করে নিয়ে কীভাবে ছোটগল্পকে শিল্পে উন্নীত করা সম্ভব সেই স্পর্ধা দেখিয়েছেন তিনি এই গল্পে। এই গল্পে লেখক সময়কে যেভাবে ভেঙেছেন ঠিক সেভাবেই চরিত্র, আখ্যান, পরিপ্রেক্ষিত ও গল্পের ম্যাসেজকে ভেঙে বিনির্মাণ করেছেন প্রকৃতি, মানুষ এবং মানুষের অনিবার্য মৃত্যুকে; আমরা হতবাক হই; থমকে যাই অনিবার্য চিন্তার জগতে। হোঁচট খেতে খেতে বুঝতে থাকি কীভাবে সাহিত্যের গতানুগতিক ধারাকে পাশ কাটিয়ে তিনি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করে নিতে শুরু করেছেন। সকল সংস্কার, ট্যাবু চূর্ণ করে সমাজ-রাষ্ট্র-দর্শনের এক অসাধারণ মেলবন্ধন তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন তাঁর সাহিত্যে। শব্দঘর-এ তাঁর অংশগ্রহণ অবশ্যই পাঠকসমাজের চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করবে।

‘ব্রেস্ট ক্যানসার’ গল্পে আমরা উপলব্ধি করি, সময় সংখ্যামাত্র; বস্তুত সময় অবাস্তব ধারণা। গল্পটিতে সময়ের এই পারসোনা বা মুখোশ উন্মোচনের গতিপথ তৈরির প্রয়াস লক্ষণীয়। বর্তমানকে অতীতের মুখে দাঁড় করিয়ে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনের এক ধরনের প্যারাডক্সিক্যাল গহ্বর তৈরি করেছেন তিনি; যে গহ্বরের বাস্তবতা ব্যাখ্যা করা তন্বিষ্ঠ পাঠক ব্যতীত কষ্টসাধ্য। পাশাপাশি ইকোক্রিটিসিজমের পরিপ্রেক্ষিতে গল্পটি একটি চমকপ্রদ উপাদান। প্রকৃতি মানেই এক অভেদ্য রহস্যজাল, অথচ প্রকৃতির অংশ হয়েও মানুষ সর্বদা জয় করতে চাইছে প্রকৃতিকে; প্রকৃত বাস্তবতায় যা অসম্ভব। প্রকৃতিকে জয় করা মানে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা; পক্ষান্তরে নিজেকেই বিনাশ করা। মানবজাতির ইতিহাস এটা প্রমাণ করে যে যারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিকে বশ করার চেষ্টা করেছিল তারা হারিয়ে গিয়েছে। তারাই টিকে রয়েছে যারা প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজিত করতে সক্ষম হয়েছিল নিজেকে। ‘ব্রেস্ট ক্যানসার’ গল্পের সাঁচচুয়ানা ও যুবতীর কথোপকথন তারই ইঙ্গিত বহন করে। মানবজাতির সহজাত বৈশিষ্ট্য নিজের প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা, যেটা ধারণ করে শাসক তথা পুরুষশ্রেণি। লেখকের ভাষায় এই প্রচেষ্টাই পক্ষান্তরে শক্তি বা বিজয়। মিশেল ফুকোর মতে রাষ্ট্রের নিকট জনগণ একটা সংখ্যা এবং বর্ধিষ্ণু উপাদানমাত্র। এ সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার মাঝেই রাষ্ট্রের কৃতিত্ব। জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার হাতিয়ার হলো যৌনতা; ফলে রাষ্ট্র অবাধ যৌনতা অবদমন করে বৈবাহিক সম্পর্কের দ্বারা একে করেছে গৃহবন্দি। মিশেল ফুকো মনে করেন, একসময় রক্তশক্তির দ্বারা মানুষের সার্বভৌমত্ব কন্ট্রোল করা হতো আর এখন তা নিয়ন্ত্রণ করা হয় যৌনতার দ্বারা। ফুকো যেমন মানুষের সার্বভৌমত্ব নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খলকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি ‘ব্রেস্ট ক্যানসার’ গল্পের লেখকও সাঁচচুয়ানার কণ্ঠে বলার চেষ্টা করেছেন, ‘তারপরও আমি কিবাত নগরীর মুক্তি চাইছি, পক্ষান্তরে চাইছি মানবপ্রজন্মের বংশক্রম বৃদ্ধি, যা কিনা যৌনতার পরাক্রম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।’ 

মোহিত কামালের মনোবৈজ্ঞানিক গল্প ‘আমি’। গল্পটি বিশেষভাবে চিন্তা আকর্ষক। অথচ এটি একটি আখ্যানবিহীন গল্প, গল্পহীনতার গল্প। আমরা প্রতিদিন নিজেই নিজের পিছনে ছুটছি। অথচ কখনই পৌঁছাতে পারছি না নিজের কাছে। গল্পের অপু চরিত্রটিও নিজের কোনও তল পায় না। প্রকৃত বাস্তবতায় অপু চরিত্রটি পাঠকের ভিতরে এমন এক স্পেসের জন্ম দেয় যা মাত্রাহীন বাস্তবতায় টইটম্বুর; যা কিনা অথৈ গহ্বরে আবর্তিত। একজন মানুষের ভেতরে কতগুলো মানুষ থাকতে পারে ? মানুষটির ভেতরে কতগুলো স্তর, কতটুকু বাস্তবতা আর কতটুকুই বা স্বপ্ন ? যেই স্বপ্নগুলো প্রাত্যহিক আকাক্সক্ষার বাস্তবতায় নির্মিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই হচ্ছে অপু, যে কিনা নিজের ‘ছায়াটাকে ধরতে চাইল। ধরতে পারল না। ছুটছে ছায়া ছুটছে অপু।’ এই যে ছোটাছুটি এই ছোটাছুটির ভেতরেই নিজের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত আমি; এবং আমার দ্বৈত-আমিকে সহসা মিশে যেতে হচ্ছে মহাকালের তলাহীন কুয়ায়। মোহিত কামালের গল্পটি আমাদেরকে আমাদের ভেতরের অব্যক্ত বাস্তবতার ইশারায় দোলাতে থাকে। গল্পহীনতার গল্পের মধ্য দিয়ে এই যে দোলা জাগানিয়া কম্পনবোধ, চিন্তনের এই কম্পনবোধই গল্পটিকে পৃথক মাত্রায় উন্নীত করেছে।

ফ্রয়েড তাঁর মনোসমীক্ষণতত্ত্বে মানবমনের চেতনা-সংগঠনের তিনটি স্তরের কথা বলেছেন। যেমন, চেতন স্তর, প্রাকচেতন স্তর এবং অবচেতন স্তর। মানবশিশু জন্মগ্রহণের সময় শুধু তার চেতন স্তর ক্রিয়াশীল থাকে। পরবর্তী সময়ে আমাদের নিত্যদিনের অতৃপ্ত কামনা, বাসনা, আকাক্সক্ষাগুলো চেতন মন থেকে অবচেতনে আশ্রয় নেয়। ফ্রয়েড যাকে বলেছেন জবঢ়ৎবংংরড়হ ঢ়ৎড়পবংং বা অবদমন প্রক্রিয়া। চেতন স্তরের উপর মানুষের নীতি-নৈতিকতা বা ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ থাকলেও অবচেতনে থাকে না কোনও নিয়ন্ত্রণ। তাই অবচেতনে জমা হওয়া অবদমিত ঘটনাগুলো ইচ্ছে করলেই ডিলিট করা বা মুছে ফেলা যায় না। আর এ কারণেই কোনও শিশু চোখের সামনে মার্বেল নিয়ে দৌড় দিলে আমাদের কাছে ভেসে আসে আমাদের শৈশব। বিশ^জিৎ চৌধুরী তাঁর ‘পুনরুদ্ধার সংকেত’ গল্পে ঠিক এমনই এক মনোজাগতিক  ইশারা দিয়েছেন। গল্পে সাফকাত সাহেব চেতন স্তরের সমস্ত স্মৃতি ভুলে যেতে সক্ষম হলেও ভুলতে পারেননি কথক সানন্দার দুই স্তনের মাঝখানের লাল জরুলটার কথা; যা কিনা তার পুরোনো স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ‘পুতুলনাচের সারিন্দা’, ‘বোতল দৈত্য’ গল্প দুটোর লেখকদ্বয় তাদের লেখায় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন ক্ষমতার বিকৃত ব্যবহার। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিকৃত ক্ষমতার প্রয়োগ জলজীবী উভচরীদের করেছে রাজনীতিজীবী এবং শান্তিপ্রিয় দৈত্যদের করেছে বোতলবন্দি। রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন অসঙ্গতি থেকে মুক্তি মিলবে সেদিন যেদিন অর্জুনের গাণ্ডীবের টঙ্কার পুনরায় আর্যাবর্তের বাতাসে ধ্বনিত হবে; যেদিন শুদ্ধ শব্দের নান্দনিক গৃহের মতো শব্দঘর-এর এই আয়োজন পাঠকের মনে নির্মাণ করবে শুদ্ধ রাষ্ট্রচিন্তার ধারণা।

স্বর্গ ও নরকের দ্বৈরথ ফলাফল আমাদের পৃথিবী। এই পৃথিবীতে সফল হতে হলে আস্বাদন করতে হয় ব্যর্থতার আঘাত। এই চরম সত্যকে অস্বীকার করে যারা ব্যর্থতার অঞ্জলিকে বরণ করতে চায় না তাদের জন্য রয়েছে এই সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ ‘আত্মহত্যাবিরোধী বিশেষ গল্প’। এ পর্বে দীপু মাহমুদের ‘বেঁচে থাকার গল্প’তে উপস্থাপিত হয়েছে মুস্তফা সাহেবের মতো এমন একজন মানুষ যিনি পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনের দুর্বিষহ আঘাত সহ্য করতে না পেরে তিন তিনবার বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। শেষ পর্যন্ত যিনি আনন্দ গ্রামে থিতু হয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন বেঁচে থাকা জীবনের জ্বালানি। একইভাবে আশরাফ জুয়েলের ‘নাওয়াল’ গল্পেও দেখা যায় পিতৃবিচ্ছিন্ন মা হারা নাওয়াল খুঁজে পেয়েছে জীবনের তাৎপর্য। আত্মহত্যা কোনও সমাধান নয়। বলা বাহুল্য এই ম্যাসেজটি ছড়িয়ে দেওয়ার যে প্রচেষ্টা শব্দঘর জারি রেখেছে তা পৃথকভাবে মূল্যায়নযোগ্য। সবশেষে বলতে হচ্ছে শব্দঘর-এর এই বিশেষ সংখ্যাটিও অন্যান্য বিশেষ সংখ্যার মতো পৃথক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছে। সম্পাদক মহোদয় এবং শব্দঘর পরিবারের প্রতি শুভকামনা রইলো।

 লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button