আর্কাইভধারাবাহিক রচনা

ভাষা-গবেষণা ধারাবাহিক : শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু : মানবর্দ্ধন পাল

তেরোতম পর্ব

[প্রাচীন ভারতীয় আলঙ্কারিকেরা শব্দকে ‘ব্রহ্ম’ জ্ঞান করেছেন―শব্দ যেন ঈশ্বরতুল্য। পাশ্চাত্যের মালার্মেসহ নন্দনতাত্ত্বিক কাব্য-সমালোচকদেরও বিশ্বাস, শব্দই কবিতা। যা-ই হোক, শব্দের মাহাত্ম্য বহুবর্ণিল ও বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষার বৃহদায়তন অভিধানগুলোর পাতায় দৃষ্টি দিলেই তা প্রতিভাত হয়। আগুনের যেমন আছে অসংখ্য গুণ, তেমনই ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দেরও আছে অজস্র অর্থের সম্ভার। কালস্রোতে ও জীবনের প্রয়োজনে জীবন্ত ভাষায় আসে নতুন শব্দ, তা বিবর্তিতও হয়। পুরনো শব্দ অচল মুদ্রার মতো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে মণি-কাঞ্চনরূপে ঠাঁই নেয় অভিধানের সিন্দুকে।

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমুদ্রসম―মধুসূদনের ভাষায় : ‘ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। বৈঠকি মেজাজে, সরস আড্ডার ভঙ্গিতে লেখা এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’। ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক―সবকিছু মিলিয়ে শব্দের ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য-সৌগন্ধ এবং অন্তর্গত আনন্দধারার ছিটেফোঁটা ভাষিক রূপ এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’ ধারাবাহিক।]

তাল

নাচ্ শ্যামা, তালে তালে ॥

রুনু রুনু ঝুনু বাজিছে নূপুর

                     মৃদু মৃদু মধু উঠে গীতসুর,

বলয়ে বলয়ে বাজে ঝিনি ঝিনি

             তালে তালে উঠে করতালিধ্বনি―

নাচ্ শ্যামা, নাচ্ তবে ॥

                         ―রবীন্দ্রনাথ

তালবড়া থালভরা―একদা এমন একটি সমিল বাক্য সচিত্র প্রথম শ্রেণির সরকারি বইয়ে ছিল। শিশুরা লাইনটি সুরে-ছন্দে আবৃত্তি করে খুব আনন্দ পেত। শৈশবে ‘তাল’ শব্দটির সন্ধান পাই তাল নামক ফল দেখে ও তালের পিঠা খেয়ে। কেবল তা-ই নয়, বড় হয়ে বুঝেছি―ওই দুটি সমাসবদ্ধ শব্দের প্রথমটিতে আছে দুটি অল্পপ্রাণ ধ্বনি আর শেষেরটিতে আছে দুটি মহাপ্রাণ ধ্বনি। উচ্চারণ সুস্পষ্টতার জন্যও তা কার্যকর। শিশুকালে বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগেই অভিভাবকদের মুখে শুনে শুনেই মুখস্থ হয়ে গেছে খান মুহম্মদ মঈনুদ্দিনের শিশুতোষ ছড়া তালগাছ। প্রজন্মান্তরেও ছড়াটি শিশুদের কাছে সমান প্রিয় : ওই দেখা যায় তালগাছ/ ওই আমাদের গাঁ।/ ওইখানেতে বাস করে কানা বগির ছা।/ ও বগি তুই খাস্ কী ?/ পান্তাভাত চাস্ কি ?/ পান্তা আমি খাই না/ পুঁটিমাছ পাই না!/ একটা যদি পাই/ অমনি ধরে গাপুসগুপুস খাই।

সদ্য কৈশোর-পেরুনো তো বটেই, ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের মনেও সেই স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করে। বাংলা সাহিত্যের দুই অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি রবীন্দ্র-নজরুল দুজনেই তালগাছ শিরোনামে দুটি শিশুতোষ কবিতা লিখেছেন। সে-দুটিও কালের ধুলো মাড়িয়ে যুগ যুগ ধরে ছোটদের কাছে সমান সুপ্রিয়। সেখান থেকে দুয়েকটি লাইন পড়ে পুরোনোদের মরচেপড়া স্মৃতিটুকু ঝালিয়ে নিই : তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে।/ মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়/ একেবারে উড়ে যায়; কোথা পাবে পাখা সে ? (রবীন্দ্রনাথ)। কাজী নজরুল তাঁর তালগাছ কবিতায় লিখেছেন : ঝাঁকড়া চুলো তালগাছ/ তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই ?/ আমার মতন পড়া কি তোর মুখস্থ হয় নাই ?… আমার মতন এক পায়ে ভাই,/ দাঁড়িয়ে আছিস কান ধরে ঠায়।/ একটুখানি ঘুমায় না তোর পণ্ডিতমশাই ? তালগাছ নিয়ে এই তিন কবির―রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন―তিনটি শিশুতোষ কবিতা বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে।

তাল শব্দটির অর্থভিন্নতার কারণে বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান-এ সাতটি ভুক্তি আছে। এবার সেই সাতটি ভুক্তির অর্থান্তরের স্বরূপ নির্ণয় করা যাক।

★ তাল : বিশেষ্য পদ। ডালপালাহীন বৃক্ষবিশেষ, বিশেষ ধরনের ফল। এই তালফলকে চমৎকার উপমায় প্রকাশ করেছেন মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাস : তালফল জিনিয়া তোহ্মার পয়োভার। (১৪৫০)। অর্থাৎ রাধিকার স্তনের সৌন্দর্য তাল ফলের সুডৌলতাকেও হার মানিয়েছে।

মালাধর বসুর রচনায় পাওয়া যায় : ধেনুক মারিয়া কৈল তাল ভক্ষণ। (১৫০০)। মঙ্গলকাব্যের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে কালকেতুর খাবার গ্রহণের হাস্যকর বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন : শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিটকাল।/ ছোট গ্রাস তোলে যেন তেয়াটিয়া তাল। (১৬০০)।

★ তাল : বিশেষ্য পদ। অর্থ―বৃহৎ পিণ্ড, বড় দলা, রাশি, স্তূপ ইত্যাদি। ভাবুকের হাতে একতাল কাদা, একখানা পাথর, একটা কাঠ…। (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

★ তাল : বিশেষ্য পদ। সঙ্গীতের সময়ের বিভাগ, সুরের মাত্রাবিন্যাস, উভয় করতলে আঘাত, কোনও বস্তুতে মৃদু চাপড় দেওয়া। বিবিধ সংগীত তাল সব অনুবন্ধে। (মালাধর বসু, ১৫০০)। তাল কাটে অকারণ খেয়ালের খড়গে। (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)।

★ তাল : বিশেষ্য পদ। অর্থ―ধাক্কা, ঝোঁক, ধকল, বেগ, হঠাৎ বিপদ, ঝামেলা। লালন বারো তালে পলো শেষ অবস্থায়। (ঝামেলা অর্থে, লালন শাহ্, ১৮৯০)। গাড়ির ঝাঁকুনির তাল সামলে…। (সৈয়দ মুজতবা আলী, ১৯৪৯)।

★ তাল : বিশেষ্য পদ। অর্থ―এক বিঘত বা অর্ধহস্ত পরিমাণ মাপ। এই অর্থে শব্দটি বর্তমানে অপ্রচলিত। তবে মধ্যযুগে মানিক রাজার গানে পাওয়া যায় : চৌদ্দ তাল জলের মধ্যে ময়না আসন করিল।

★ তাল : বিশেষ্য পদ। একজন অপদেবতা, ভূত, পিশাচ বা দেবতা শিবের অনুচরের নাম। বেতাল পঞ্চবিংশতি নামে একটি সংস্কৃত গল্পগ্রন্থে তাল-বেতাল নামক দুই ভাইয়ের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই দুই পিশাচভ্রাতাকে প্রশ্নোত্তরে পরাজিত করে রাজা বিক্রমাদিত্য তাদের আজ্ঞাবহ এবং অনুচর করে রেখেছিলেন। তাল বলে, আজি ঘরে মাতা উপস্থিত। (অন্নদামঙ্গল, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী)।

★ তাল : বিশেষ্য পদ। অর্থ―আঁচ, ধারণা, আন্দাজ, উপলব্ধি। আমি ব্যাপারটা তাল করতে পারিনে। (শওকত ওসমান)।

তাল শব্দটির উৎস বা বুৎপত্তি নিয়ে অভিধানকারদের মধ্যে মতভেদ আছে। তা নিম্নরূপ : সংস্কৃত শব্দ। √তল্ + অ (অণ) বা √তল্ + অ (ঘঞ্)। কেউ কেউ মনে করেন সংস্কৃত শব্দ তালক থেকে এটি এসেছে : তালক > তালা > তাল। তাই প্রাচীনতম বাংলা কাব্যে পাওয়া যায় : সাসু ঘরেঁ ঘালি কোঞ্চা তাল। (তালা অর্থে, ৪ নম্বর চর্যাপদ)। অর্থাৎ শাশুড়ি ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। বুৎপত্তির সেই বিতর্কে আমাদের কাজ নেই। আমরা সাধারণ পাঠক। বরং তার চেয়ে আমরা দেখি, তালকে সমাসবদ্ধ করে খ্যাতিমান লেখকরা কত বৈচিত্র্যময় অর্থে ও ভাবে প্রয়োগ করেছেন।

* ঢাকলো মেঘের খুঞ্চে পোষে তাল―পাটালির থাল। (তাল রস দিয়ে তৈরি পাটালি গুড় অর্থে, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)।

* লিখছে যারা তাল পাতাতে, খাগের কলম বাগিয়ে হাতে। (তালগাছের পাতা অর্থে, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)।

* বাদলা হাওয়ায় তালবন ঐ বাজায় চটুল দাদরা তাল। (তালগাছের বন ও তবলার বোল অর্থে, নজরুল ইসলাম)।

* স্বয়ং তালবৃন্ত সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। (তাল পাতায় তৈরি হাতপাখা অর্থে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)।

* সমের মুখে এসে তাল কেটে গেল। (গানের ছন্দপতন অর্থে, বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান)।

* আমার সংসারের ঘড়ি তালকানা। (হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অর্থে, রবীন্দ্রনাথ)।

* তপন নন্দিনী তীরে তালবনি ভুবন মোহন লাবণী। (তালবনি মানে তালবন। ব্রজবুলি ভাষার শব্দ, গোবিন্দ দাস)।

* দেব-সভা মাঝে নাচ করিবি সম্প্রতি।

তায় হবে তালভঙ্গ তবে যাবি ক্ষিতি। (নৃত্যের ছন্দপতন, ধর্মমঙ্গল, ঘনরাম চক্রবর্তী)।

* এটে সেটে মারে তাল তর্জন গর্জনে। (বাহুতে করতলের আঘাত অর্থে, বাসবদত্তা, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ১২৯৮)।

সাধারণের কাছে তাল শব্দটির সরলার্থ তালফল এবং সংগীতের ছন্দ। তাছাড়া শব্দটি সেকাল থেকে একালে বহু অর্থে কবি-লেখকদের রচনায় প্রয়োগ হয়েছে। তার কিছু নিদর্শন আমরা ওপরে লক্ষ করেছি। শব্দকে পদে পরিণত করতে এবং বাক্যে প্রয়োগ ও অর্থান্তরের জন্য লেখকেরা এর সঙ্গে বিভক্তি, প্রত্যয়, উপসর্গ, অনুসর্গ, সন্ধি, সমাস ইত্যাদি যুক্ত করেন। তার ফলে শব্দ অর্থপ্রকাশে নতুন মাত্রা পায়। তাল শব্দটিও তেমনই। খ্যাতিমান লেখকদের রচনা থেকে তেমন কয়েকটি উদাহরণ :

* তালগাছ : তাল ফলের গাছ = মধ্যপদলোপী কর্মধারয়। পাঁচ-ছয়টা তালগাছ বোবার ইঙ্গিতের মতো আকাশে উঠিয়াছে। (রবীন্দ্রনাথ, ১৯০৭)।

* তালচটা : সংস্কৃত তালচটক। বাবুইপাখি।

সমার্থে তালচাকা বা তালচিকাও বলে। তালগাছে বাসকারী চটা = মধ্যপদলোপী কর্মধারয়। সম্ভবত তালগাছে বাসা বাঁধে বলে বাবুইপাখির এই নাম। গুড়গুড় ভারই ঘটা/ টুনটুনি তালচটা। (মুকুন্দরাম, ১৬০০)।

* তালজঙ্ঘা : তালগাছের মত দীর্ঘ জঙ্ঘা (পা এবং ঊরু) যার। বহুব্রীহি সমাস। পুরাণে বর্ণিত রাক্ষসবিশেষ। অশ্বারোহী দেখ ওই তালবৃক্ষাকৃতি তালজঙ্ঘা। (মধুসূদন, ১৮৬১)। প্রাচীনকালে শব্দটি, তালজঙ্গ, তালজঙ্ঘ ইত্যাদি বানানেও লক্ষ করা যায়। ভারতীয় পুরাণ মতে তালজঙ্ঘ রাজা বৎসর পুত্র।

* তালে ও তালি : ছন্দে ও দুই হাতের সংযোগে করাঘাত। তাল + এ = তালে (সপ্তমি বিভক্তিযুক্ত)। তাল + ই = তালি (প্রত্যয়যুক্ত)। হেসে খলখল গেয়ে কলকল, তালে তালে দিব তালি। (নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ)।

* তালতন্তু : তালগাছের তন্তু (আঁশ) = মধ্যপদলোপী কর্মধারয়। তার গলায় তালতন্তু তৈরি ফাঁস-দড়ি পড়বে। (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ১৯৬৪)।

* তালতরুফল : তালগাছ থেকে জাত ফল = (মধ্যপদলোপী কর্মধারয়)। কঁথা না দেখিল বাঁওন হাতে তালতরুফল পাত্র। (বড়ু চণ্ডীদাস, ১৪৫০)।

* তাল তাল : রাশি-রাশি, প্রচুর। বিশেষণ, দ্বিত্ব প্রয়োগ। বনের ভিতর তাল তাল অন্ধকার বাঁধিয়া আছে। (বঙ্কিমচন্দ্র, ১৮৮৪)।

* তালপত্র : তালগাছের পাতা। তালের পত্র = ষষ্ঠী তৎপুরুষ। তালপত্রে শ্লোক লিখি চালেতে রাখিলা। (কৃষ্ণদাস, ১৫৮০)।

* তালপাকানো : ক্রিয়াপদ। বাকধারা। জড়সড় হয়ে থাকা, জটিল অবস্থা, পিণ্ডাকার। মানুষগুলোকে যেভাবে তাল পাকাইয়া থাকিতে হয়। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯০৫)।

* তালুয়া ডোঙা : বিশেষ্য পদ। তালগাছের ডিঙি। তাল + উয়া (প্রত্যয়) = তালুয়া। লালন কয় তালুয়া ডোঙা কোন ঘড়ি ডুবাই তুফানে। (লালন শাহ্, ১৮৯০)।

দিনপঞ্জির হিসেবে শরতের শুরু ভাদ্রমাসে। এই ঋতুতেই তালফল পাকে―গন্ধে মউমউ করে গ্রামবাংলার হেঁসেল। বোশেখে কাঁঠালপাকা গরম যেমন আছে, তেমনই ভাদ্রে থাকে তালপাকানো রোদ্দুর। চৌকস বাঙালি গৃহিণীরা তালরস দিয়ে রসনা পরিতৃপ্তিকর হরেক রকম পিঠা তৈরি করেন। তালবড়া, তালফুলুরি, তালকেক, তালক্ষীর―আরও কত কি! তালের রস দিয়ে সুস্বাদু গুড় হয়―বলে তাল পাটালি। স্ফটিকশুভ্র তালমিস্রিও হয় তালরস থেকে। আমসত্ত্বের মত তালসত্ত্ব হয় কিনা জানি না, তবে কচি তালের নরম শাঁস গ্রীষ্মের দাবদাহে আমাদের প্রাণ শীতল করে। জীবনানন্দ উল্লেখ করেছেন চিনি আর শাদা তালশাঁস-এর কথা (১৯৩২)। দেহমন শীতল করতে আছে দুটো উপায় : কখনও তালবৃন্ত ব্যজন এবং কখনও বা পদ্মহস্ত দ্বারা গাত্রদাহ নিবারণ। এসবই বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব ঘরানা।

তাল নিয়ে পৌরাণিক কাহিনিও কম নেই! ভাদ্র মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে বাঙালি সনাতনধর্মীরা বিষ্ণুদেবতার উদ্দেশ্যে তালফল দিয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করে। এই ব্রতকে বলা হয় তালনবমী। অনেকে সেদিন ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জন্মদিন হিসেবেও পালন করে। তাছাড়া পুরাণে বর্ণিত আছে, শনি নামক গ্রহটি নয়টি গ্রহের রাজা―শনিদেব। এই শনি অশুভ এবং অমঙ্গলের দেবতা। স্কন্ধ পুরাণে উল্লেখ আছে, শনির জন্ম ভাদ্র মাসের অমাবস্যা তিথিতে। তাই সেদিন সংসার থেকে অশুভ-অমঙ্গল দূর করে সুখ-সমৃদ্ধির লক্ষ্যে তালফল দিয়ে শনির পূজা করা হয়। তার প্রিয় ফল নাকি তাল। তাই প্রবাদ আছে, ভাদ্রে না-খাইলে তাল/ না-যায় শনির কাল।

তাল যখন সংগীতের অপরিহার্য ও একান্ত সহচর হয় তখন শ্রোতার কাছে তালকাটার মতো বিরক্তিকর অবসাদ আর নেই। তালের আছে ত্রিমাত্রিক লয়―বিলম্বিত লয়, মধ্যম লয় এবং দ্রুত লয়। সে-দরোজায় কড়া নাড়লে আমার মত অ-সুরের মহাবিপদ। তবে ছন্দ ও মাত্রাজ্ঞানহীন অকবি এবং তালকাটা বাদক যেমন আছে, তেমনই তালকানা লোকেরও অভাব নেই। তালফেরতা গান যতই শ্রুতিমধুর হোক তালকানা হলে তাতে বারবার তাল কাটে। কাব্য এবং সংগীতে তেমন মাত্রাজ্ঞান ও তালজ্ঞানহীন শিল্পীযশোপ্রার্থী মাত্রেই আবর্জনা। তাল দিয়ে এবং তাল ঠুকে তালগোল পাকানো লোকের অভাব নেই আমাদের সমাজে। তাল অনেকের পিঠেও পড়ে। আবার সত্যি ঘটনার যথার্থ কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে না-পারলে আমরা বলি, কাকতালীয় ঘটনা!

তালপাতার সেপাইরা অপদার্থ বাক্যনবাব হলেও তাল দিতে ওস্তাদ―তিলকে তাল বানিয়ে তাল পাকাতে পারঙ্গম। কানা ছেলের নাম যেমন পদ্মলোচন হয়, তেমনই যে-পুকুরে ঘটি ডোবে না তার নামও হয় তালপুকুর। এসব কথায় আপনারা কেউ ভাববেন না যে, আমি তালগাছের আড়াই হাত দেখাচ্ছি! এগুলো সবই বাংলা ভাষার মাধুর্যময় বাগধারা। আমরা কথার লক্ষ্যার্থ প্রকাশে সবাই কমবেশি সেগুলো ব্যবহার করি। তালতত্ত্ব নিয়ে আর বেশি বাকবিস্তার করলে আমার পিঠেই তাল পড়ার আশঙ্কা বোধ করি। তাই সাঙ্গ করি তালতামামি। লেখাটি শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের একটি গান দিয়ে। তাই শেষও করি তাঁর গানের চরণ স্মরণ করে :

হাসি-কান্না হীরা-পান্না দোলে ভালে,

কাঁপে ছন্দে ভালো-মন্দ তালে তালে।

তারা

তুমি কোন্ কাননের ফুল,

কোন্ গগনের তারা।

তোমায় কোথায় দেখেছি যেন

কোন্ স্বপনের পারা।

                      ―রবীন্দ্রনাথ

তারা শব্দটি আমরা খুব সহজ-সরল বলেই মনে করি। কিন্তু যত সহজ ভাবি ততটা নয়!

এর বানানটি সরল ও শিশুবোধ্য হলেও অর্থের বিচারে মোটেই জলবৎ তরল নয়। রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃত গানটিতে যখন তারা শব্দটি পাই তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ এর আগে গগনের শব্দটি আছে। তাই নিমেষেই বুঝে ফেলি তা আকাশের তারকা। কিন্তু কবিগুরুর গানেই যখন পাই : সুন্দর তব বটে অঙ্গদখানি তারায় তারায় খচিত কিংবা রামপ্রসাদী শ্যামাসংগীতে যখন শুনি : বল্ মা তারা দাঁড়াই কোথা―তখন ধন্ধে পড়ে যাই! আবার যখন রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গানের মধ্য চরণে দেখি :

আমার বলে ছিল যারা আর তো তারা দেয় না সাড়া―

কোথায় তারা, কোথায় তারা, কেঁদে কেঁদে তারে ডাকি।―তখন পলকেই বুঝে যাই, এই তারা সেই তারা নয়। এখানেও অর্থভেদ আছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, পাঠশালা ও পাঁচশালা যেমন এক নয়, তেমনই সব তারাও এক তারা নয়।

বৃহদাকার অভিধানে তারা শব্দটির জানা অজানা ও অল্পজানা অনেক অর্থ পাওয়া যায়। সেগুলো জেনে নেওয়া যাক : ১) তারকা, নক্ষত্র, জ্যোতিষ্ক, সিতারা (ফারসি), ২) চোখের মণি, ৩) মুক্তা, ৪) পুরাণ মতে, দেবরাজ বৃহস্পতির স্ত্রী, ৫) রামায়ণে বর্ণিত সুষেণ রাজার কন্যা ও বানররাজ বালির পত্নী, ৬) দশ মহাবিদ্যার দ্বিতীয় মহাবিদ্যা, ৭) বৌদ্ধদেবী বিশেষ, ৮) মহাদেবের পত্নী উমা, ৯) উচ্চ স্বরসপ্তক, ১০) পরিত্রাণ বা উদ্ধার করা, ১১) আন্তর্জাতিক হোটেলের মাননির্দেশক চিহ্ন ইত্যাদি।

অর্থভেদে তারা শব্দটির সাতটি ভুক্তি আছে। এগুলো নিম্নরূপ :

★ তারা : ত্রাণ করা। এই অর্থে, তারি (ত্রাণ করি), তার (উচ্চারণ ‘তারো’, তারণ কর), তারে (তারণ করে), তারিতে (তারণ করতে), তারিয়া (তারণ করে)। যেমন, দুতরে তারিবোঁ তোক না করিহ ডর। (বড়ু চণ্ডীদাস, ১৪৫০)। কৃষ্ণ অবতারি যেহোঁ তারিল ভুবন। (কৃষ্ণদাস, ১৫৮০)। ভুবন তারিতে ভক্তরূপী ভগবান। (শিবায়ণ, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, ১৭৫০)। ত্রিগুণা ত্রিপুরী তারা ইতিন নয়নী। (স্ত্রীলিঙ্গার্থে ত্রাণকারী, কৃষ্ণদাস, ১৭২০)।

★ তারা : জ্যোতিষ্ক, নক্ষত্র। বিশেষ্য পদ। সংস্কৃত তারকা থেকে তারা। পহু সঙ্গ কামিনী বহুত সোহাগিনী চন্দ্র নিকট জইসে তারা। (বিদ্যপতি, ১৪৬০)। উঠল তারা আকাশভরা করছে ঝিকিমিকি। (প্রাচীন পদ্য)।

★ তারা : রত্ন, মূল্যবান পাথর। বিশেষ্য পদ। সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি তারায় তারায় খচিত। (রবীন্দ্রনাথ, ১৯১০)।

★ তারা : চোখের মণি। বিশেষ্য পদ। অক্ষিগোলকের সম্মুখভাগে যে গোলাকৃতি অংশ কৃষ্ণবর্ণ দেখায়, ঐ অংশকে চক্ষুর তারা বলে। (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৫১)। তোমারি আঁখির মতো আকাশের দুটি তারা। (নজরুল, ১৯৩৮)।

★ তারা : দশভুজা দুর্গার ভিন্নরূপ। পুরাণে বর্ণিত দশ মহাবিদ্যার মধ্যে দ্বিতীয় বিদ্যা। সতী পিতার দক্ষযজ্ঞে যাওয়ার জন্য পতি মহাদেবের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে ব্যর্থ হয়ে তিনি এই মহাবিদ্যা রূপ ধারণ করেন। এ রূপের বর্ণনায় অন্নদামঙ্গল-এ ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বলেন : নীলবর্ণা লোল জিহ্ব করাল বদনা।/ সর্পবান্ধা উর্দ্ধ এক জটা বিভূষণা।/ অর্দ্ধচন্দ্র পাঁচখানি শোভিত কপাল।/ ত্রিনয়না লম্বোদরা পরা বাঘ ছাল।

এই তারাকে ভিন্ন রূপে পাওয়া যায় ভক্ত রামপ্রসাদের গানে : এমন দিন কি হবে তারা, যবে তারা তারা তারা বলে তারা ঝরে পড়বে ধারা। আবার বিষ্ণুপুরাণ মতে, তারা দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী। চন্দ্র তাকে হরণ করে। দেবদেবীরা তারাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেও চন্দ্র অস্বীকার করে। পরে ব্রহ্মা তারাকে বৃহস্পতির হাতে তুলে দেয়। তারার গর্ভে চন্দ্রের যে পুত্র হয় তার নাম বুধ। সে চন্দ্রবংশের আদি পুরুষ। মহাকাব্য রামায়ণের ঘটনা থেকে জানা যায়, তারা কিষ্কিন্ধ্যার বানররাজা বালির স্ত্রী। সে সুষেণ নামক বানররাজের কন্যা ও অঙ্গদের মা। বালি রামচন্দ্রের হাতে নিহত হলে রামের আদেশে তারা দেবর সুগ্রীবকে বিয়ে করেন। ভারতীয় পুরাণমতে তারা প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার অন্যতম।

★ তারা : সংগীতে সুর প্রক্ষেপণের তিনটি স্তর―উদারা, মুদারা ও তারা। তারা সর্বোচ্চ স্তর। ওড়ব খাড়ব প্রণব নাদ উদারা তারা লইয়া তর্ক। (রবীন্দ্রনাথ, ১৮৮৬)।

★ তারা : বহুবচনে নামপুরুষে সর্বনাম পদ। সংক্ষেপে তাহারা থেকে তারা। সাধু ভাষা থেকে প্রমথ চৌধুরীকৃত সর্বমান্য চলিত রূপ। সম্ভ্রামার্থে তাঁরা। যাদের চাহিতে তোমারে ভুলেছি তারা ত চাহে না আমারে। (রবীন্দ্রনাথ)। তারা দেখেও দেখে না, বুঝেও বোঝে না, তারা ফিরেও না চায়…। (রবীন্দ্রনাথ)। তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়…। (রবীন্দ্রনাথ)।

তারার সঙ্গে সমাসবদ্ধরূপে অন্য শব্দ যুক্ত করে বিচিত্রবিধ ভাবপ্রকাশক নতুন শব্দ তৈরি হতে পারে। অজানা ও অল্পজানা তা তেমন কয়েকটি শব্দ উদাহরণসহ উল্লেখ করা হলো :

* তারাকারা ফুলমালা; কবরী বন্ধনে। (তৎসম শব্দ, বিশেষণ, তারার আকৃতিবিশিষ্ট, ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস, মাইকেল মধুসূদন, ১৮৬১)।

* নীল তারাকীর্ণ আকাশ ভেসে চলেছে। (তৎসম শব্দ, বিশেষণ, তারা দ্বারা আকীর্ণ বা তারায় আকীর্ণ, তৃতীয়া বা সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস, মাহে নও, ১৯৪৯)।

* তাকাও যখন তারাখচা মহাকাশে। (তৎসম + তদ্ভব শব্দ, বিশেষণ, তারা দ্বারা খচা বা তারায় খচা, তৃতীয়া বা সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ১৯৩৩)।

* বছরে দুবার আকাশে তারাখসার মরশুম আসে। (তৎসম + তদ্ভব শব্দ, বিশেষণ পদ, উল্কাপাত অর্থে, তারা যখন খসে, মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৩৫)।

* ধাইল তারাজুলি গুস্কারা কুতূহলী রত্না চলিল সঙ্গে। (বিশেষ্য পদ, নদীবিশেষ, তারার জুলি, ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ১৬০০)।

* বিলিতি নাম মনে থাকে না, নাম দিয়েছি তারাঝরা। (সংস্কৃত শব্দ, ফুলবিশেষ, বিশেষ্য পদ, তারা ঝরায় যে, উপপদ তৎপুরুষ সমাস। (রবীন্দ্রনাথ, ১৯৩৬)।

*… তারাপতি এখনও স্বস্থানে চলিয়া যান নাই। (তৎসম শব্দ, বিশেষ্য পদ, চাঁদ অর্থে, তারাদের পতি যিনি, বহুব্রীহি সমাস। মীর মশাররফ হোসেন, ১৮৯০)।

* এস রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল। (বিশেষ্য পদ, তারার ফুল, অলুক তৎপুরুষ সমাস। (নজরুল, ১৯৩৫)।

* তারানাথ নাম কে তোমারে দিল। (সংস্কৃত শব্দ, বিশেষ্য পদ, তারার নাথ, তারার নাথ যিনি, ষষ্ঠী তৎপুরুষ বা বহুব্রীহি সমাস। চাঁদ বা দেবী দুর্গার পতি অর্থে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বীরাঙ্গনা কাব্য)।

তারা নিয়ে কথালতা আরও বাড়ানো যায়।

কথাও লতার মতো―আশ্রয় পেলে লিকলিকিয়ে বেড়ে ওঠে। তারানন্দন ও তারানন্দিনীর কথা তো বলাই হলো না! দেবী দুর্গার সন্তান হিসেবে এরা পৌরাণিক চরিত্র : কার্তিক-গণেশ ও লক্ষ্মী-সরস্বতী। সামুদ্রিক তারামাছ ঔজ্জ্বল্যের প্রতীক।

চিত্রল হরিণের মধ্যে একটি দুর্লভ প্রজাতির নাম তারামৃগ। ওদের নাভিতেই নাকি থাকে পাগলকরা সুগন্ধের খনি। আর তিনতারা থেকে পাঁচতারা হোটেল তো বিত্তবান ও ক্ষমতাবানদের ভোগবিলাসিতা, বিনোদন এবং মর্ত্যসুখের আকর। আমাদের মতো কপর্দকহীন মানুষের সেসবের সংবাদ নিয়ে লাভ কি ?

[চলবে]

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button