আর্কাইভবইকথা

বইকথা : মোজাম্মেল হক নিয়োগীর ট্রিলজি : ফাঁদ, পুষ্পকথা এবং তৃতীয় অধ্যায় উপন্যাসের শিল্পরূপের সন্ধানে : জাকিয়া রহমান

শুদ্ধ শুভ্রচেতনা বা নৈতিকতা বোধের অভাবে কখনও রক্ষকও ভক্ষক হয়ে ওঠে। স্বার্থোদ্ধারে, লালসা চরিতার্থ করার প্রয়াসে প্রতারণার জটিল ফাঁদ বুনতে থাকে। জন্মগত এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণে নারী দুর্বল এবং পরনির্ভরশীল হওয়ায় যুগ যুগ ধরে তারাই ফাঁদে পড়ে ক্ষমতাবানের ভোগের সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। কখনও স্বাবলম্বী নারীও এই প্রতারণার শিকার হয়। চর্যাপদের হরিণ বিলুপ্তির মতো নারীর শরীরও তার জীবনে ঘটে চলা বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। তবে নিম্নবর্গের জীবন-চেতনায় নিকটজনের মাধ্যমে যৌন নির্যাতন বা ফাঁদে ফেলে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা, বিকৃত লালসা চরিতার্থ করার ঘটনা অপেক্ষাকৃত বেশি। যুগ যুগ ধরে পুরুষের ভোগসর্বস্ব ধর্ষকামী মানসচেতনার কাছে নারী অসহায়। নিম্নবর্গের জীবনের নিয়ত চলমান ক্ষুধা, দারিদ্র্যের তীব্রতার সুযোগে মিথ্যা আশ্বাসে, কখনও কর্মসংস্থানের লোভ দেখিয়ে অথবা সংসার করার মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে প্রান্তিক নারীদের জীবন ও স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগীর ট্রিলজি উপন্যাস ফাঁদ, পুষ্পকথা এবং তৃতীয় অধ্যায় যেন সে ঘটনারই অনুবর্তন ঘটায়।

ট্রিলজি উপন্যাস ফাঁদ, পুষ্পকথা, এবং তৃতীয় অধ্যায় তিন খণ্ড একসঙ্গে প্রায় ৮৬৩ পৃষ্ঠার দীর্ঘ কলেবরের উপন্যাস। কাহিনির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পারস্পরিক যোগসূত্রে বিগত শতক ও চলমান শতক মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ বছর সময় এই ট্রিলজিতে ব্যাপ্তিলাভ করেছে। শেষ খণ্ড অর্থাৎ তৃতীয় অধ্যায় উপন্যাসের ভূমিকা অংশে লেখক এ প্রসঙ্গে বলেছেন : ‘তিনটি খণ্ডই ধারণ করেছে সময়কে। গত শতকের শেষ দশক থেকে শুরু করে বর্তমান শতাব্দীর ২১ বছর পর্যন্ত সময়কে ধারণ করেছে এই উপন্যাস।’ এই ট্রিলজি পাঠে উপলব্ধ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিগত ত্রিশ বছরের যাপিত জীবন তথা ব্যক্তির সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের উত্তাল সময়। বাস্তব জীবনকে শিল্পের আঁচড়ে গদ্যভাষায় উপস্থাপনাই উপন্যাস। উপন্যাসের আধুনিকরূপ বাস্তবধর্মিতা ও জীবনবাদিতায় প্রাসঙ্গিকভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে জীবনের অপূর্ণতা, অসামঞ্জস্যতা, অপ্রাপ্তি, ক্রন্দন, প্রত্যাশা, হতাশা এবং পুঞ্জিভূত ক্ষোভের নিমজ্জিত সত্তায় ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা।

ফাঁদ উপন্যাসের কাহিনি পরিক্রমায় দেখা যায় চোখধাঁধানো সুন্দরী কিশোরী পুষ্প দুলাভাই নওয়াব আলিকে বিশ্বাস করে তার বিছানো জালের ফাঁদে পড়েছে। নওয়াব আলির পাতা এ ফাঁদ পুষ্পকে দিয়েছে দেহপসারিনীর পরিচয়। ট্রিলজির কেন্দ্রীয় চরিত্র পুষ্প হওয়ায় ফাঁদ উপন্যাসে মূলত পুষ্পকে ফাঁদে ফেলে ফায়দা হাসিলের কৌশল এবং এ কৌশলে পুষ্পর জীবনলিপিতে এক বিভীষিকাময় অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে, যা উপন্যাসের শেষাংশে এই চরিত্রটিকে করেছে ট্রমা আক্রান্ত। কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর সম্বল উপন্যাসের গীতারানীর গল্প অংশে বৈমাত্রেয় দুলাভাই হারান মৃত শ্বশুরের দ্বিতীয় স্ত্রী বিন্দুবাসিনী ও তার কন্যা গীতারানীকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে পাঠকের চোখে আপন দুলাভাই নওয়াব আলি এবং বৈমাত্রেয় দুলাভাই হারান এই দুই চরিত্রের একটাই প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। বৈমাত্রেয় শ্যালিকা গীতারানী এবং বিধবা যুবতী শাশুড়ি বিন্দুবাসিনীর শরীর এবং সম্পদসকল গ্রাস করার মানসে হারান মিথ্যা আশ্বাসে তাদেরকে ঢাকার পথে নিয়ে চলেছে। একই উদ্দেশ্যে পুষ্প, গীতারানী, বিন্দুবাসিনী একজন পরমাত্মীয় পুরুষকে বিশ্বাস করে ঢাকার পথে যাত্রা এবং দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের পথে হারান ও নওয়াব আলি চরিত্র যেন মিলে মিশে একাকার হয়েছে। হারান চরিত্রটি এতটাই নিকৃষ্ট যে সে একই সঙ্গে মা এবং মেয়ে উভয়ের প্রতি কামাসক্ত হয়েছে।

সম্বল উপন্যাসের ফুলবানুর গল্প অংশে দেখা যায়, শুধু ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে ফুলবানু বৃদ্ধ আলাউদ্দিন মুন্সির সঙ্গে তার মহাজনের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে চাকুরির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছে। গোলাম আলাউদ্দিন মুন্সির স্ত্রী নুরবানুও মহাজনের লালসার শিকার হয়েছে। ওই বাড়ির সকল বয়সী গৃহকর্মীকে মহাজনের ঘরে রাত কাটাতে বাধ্য করা হয়। কিশোরী ফুলবানুর একটিই চাহিদা, পেট ভরে খাবার। এমন কি শুধু খাবারের দায়িত্ব নিলে কিশোরী এই বৃদ্ধ আলাউদ্দিনকে বিয়ে করতেও সম্মত হয়। সম্বল উপন্যাসের ফুলবানু, ফাঁদ উপন্যাসের পুষ্প অভাব-দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিষ্পেষিত হয়ে কাজের সন্ধানে বাড়ির বাইরে পা বাড়িয়েছে। যে অভাব এবং দারিদ্র্যের ভয়াল ছাপ ফাঁদ উপন্যাসের নারীচরিত্রের পতিতা পেশা অবলম্বনের প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। তবে এ উপন্যাসে একবিংশ শতকের জীবনবাস্তবতার এক নগ্নরূপ ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। নিছক পেটের ক্ষুধা নয়, পেটের ক্ষুধার সঙ্গে কোনও কোনও নারী শরীরের ক্ষুধা মেটাতেও পতিতাবৃত্তির পথ অবলম্বন করেছে। সাবরিনার বর্ণনায় বোঝা যায় উচ্চবিত্ত সমাজে লালসা চরিতার্থ করার এ বিষয়টি খুব স্বাভাবিক। যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে নৈতিকতার অবক্ষয়ে ধীর পদক্ষেপে সভ্য সমাজের শিকড়ে পচন ধরেছে। যে পচনের স্বরূপ উন্মোচনে মোজাম্মেল হক নিয়োগী তার ফাঁদ উপন্যাসে গৃহিণী থেকে শুরু করে সুপার শপের বিক্রেতা, ছাত্রীসহ কেবল দৈহিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজনে অভিজাত শ্রেণিতেও পতিতাবৃত্তি পেশার বিস্তৃত দেখিয়েছেন। এই উপন্যাসের যথাক্রমে ১১৮, ১১৯, ১২০ নম্বর পৃষ্ঠায় তার বর্ণনা রয়েছে। ফাঁদ উপন্যাস পর্যালোচনায় পর্যায়ক্রমে যে কয়েকটি নারী চরিত্র পাওয়া যায় তাদের প্রায় সকলেই নৈতিকতা বিবর্জিত জীবন পথের পথিক। সাবরিনার সঙ্গে কয়েকজন নারীর দেখা করার বর্ণনা এমন, ‘সে ইশারায় সাবরিনাকে রুম থেকে বাইরে ডেকে নিয়ে একটা কাগজে তার ফোন নম্বর দিয়ে বলল, আপা সময় সময় ডাকবেন ভালো কাস্টমার পাইলে। সংসারে একটু টানাটানি আছে। আমার লেখাপড়ার খরচটা যদি নিজে ম্যানেজ করতে পারি তাহলে খুব ভালো হয়।… কাস্টমার যেমন বাড়ছে ঠিক মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক হাউস ওয়াইফ এখন সংসারের দায়দেনার জন্য এই পথে নেমেছে। ঢাকার জীবন বড়ই কঠিন। শুধু দায়দেনাও না, স্বামী-স্ত্রীতে মিল মহব্বত নেই এমন মানুষগুলোও এখন এসব করে বেড়ায়।… কল্যাণপুরের এক বাসায় এক নারী আসে যার ঢাকা শহরে বাড়ি আছে। গাড়ি আছে। বড় ধরনের ব্যবসা আছে। স্বামী নেই বলে সে নিজের পছন্দমতো লোক নিয়ে চলে আসে গাড়িতে করে। (পৃ. ১১৮, ১১৯ এবং ১২০) নারী পুরুষের শারীরিক সম্পর্কের রসায়ন এখানে কখনও স্বার্থের মাপকাঠিতে বা কখনও অর্থের মাপকাঠিতে বিবেচ্য হয়েছে। যেন মনে হয় এ এক নষ্ট সমাজের আখ্যান। প্রকৃতপক্ষে মানুষ তার সম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সংগত কারণেই লেখক এখানে বড্ড অসহায়। কেননা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পুষ্প হলেও এই পুষ্পকে বিকশিত করতে লেখক সাবরিনা নামক পতিতার আশ্রয় নিয়েছেন। পতিতার চারপাশের পরিবেশ এবং তার চেনা মানুষগুলো একই আদর্শের হবে এটাই স্বাভাবিক। সাবিনার হাত ধরে উপন্যাসে বর্ণিত অন্ধকার নিষিদ্ধ জগতের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে বিস্মিত হতে হয়। মনে হয় যেন লেখক সচেতনভাবে মুখোশ পরিহিতা পতিতাদের মুখোশ উন্মোচন এবং সামাজিক ক্ষত পরিদৃশ্যমান করতে সে দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর পিঙ্গল আকাশ উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র মঞ্জু ব্যতীত সকল নারীচরিত্র সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায় পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। নৈতিকতাবোধ লুপ্ত বিবাহবহির্ভূত পারস্পরিক সম্পর্ক যেন এখানে শুধুই প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত সমাজের নাগরিক জীবন সংকটের একটি ভয়াবহ চিত্র পিঙ্গল আকাশ উপন্যাসে উঠে এসেছে। ফাঁদ এবং পিঙ্গল আকাশ উপন্যাসে পঙ্কিল নারীচরিত্রের আধিক্য থাকলেও কেন্দ্রীয় চরিত্র পুষ্প এবং মঞ্জু চরিত্রের চারিত্রিক দৃঢ়তায় কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পুষ্প অনিচ্ছায় হলেও অভাব দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটে পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফোটাতে অর্থের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মঞ্জু তার চারপাশের পঙ্কিলতার মাঝে এক পদ্মফুল স্বরূপ। কলুষিত জীবনের সঙ্গে আপস করেনি। চরম মুহূর্তে শুদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রাখতে আত্মহননের প্রত্যয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের টোপ উপন্যাসটি একই ধারার রচনা। এই উপন্যাসেও গ্রাম্য কিশোরী শবমেহেরকে কাজ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে নারায়ণগঞ্জের পতিতা পল্লীতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে নারাজ থাকলে তার ওপরে নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর উপন্যাসে লেখক অত্যন্ত সযত্নে নিম্নবিত্তের নারীদের জীবন-বেদনাকে উপস্থাপন করেছেন। নিম্নবর্গের নারীদের টার্গেট করে ফাঁদে ফেলা সহজ বলেই দালাল শ্রেণি বিনা পুঁজিতে তাদের ব্যবহার করে স্বার্থসিদ্ধির সুযোগ পায়। ফাঁদ উপন্যাসের নওয়াব আলি চরিত্র সেই ধূর্ত দালাল শ্রেণির প্রতিনিধি।

পুষ্প চরিত্রটি পুষ্পের মত পবিত্র সত্তার প্রতীকরূপে উপস্থাপিত হলেও তা ঘটনাচক্রে পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হয়েছে। নওয়াব আলি এবং সাবরিনার বিছানো জটিল ফাঁদের আষ্টেপৃষ্ঠে পুষ্পর নারীত্ব রক্ষা করা অসম্ভব ছিল। এই চরিত্রটিকে মোহগ্রস্ত করে শয্যাসঙ্গিনী করতে প্রথম খদ্দের নাসের উকিলের যে কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল বা বেগ পেতে হয়েছিল, পরবর্তী খদ্দেরকে সে বেগ পেতে হয়নি। সে বিনাক্লেশে পুষ্পর সান্নিধ্য লাভ করেছে। এখানে বোদ্ধা পাঠকের মনে প্রশ্ন ওঠে, ক্ষণিক সময়ের অশ্রু বিসর্জনের মধ্যেই কি পুষ্প পতিতাবৃত্তিকে এত সহজেই মেনে নিল ? কেননা পরবর্তী খদ্দেরদের শয্যাশায়িনী হতে পুষ্প আপত্তি প্রকাশ করেছে, এমন কোনও পরিস্থিতিও লেখক উপস্থাপন করেননি। অর্থের বিনিময়ে দেহ বিকিয়ে দেওয়াতে একটি দীর্ঘশ্বাস পড়লেও, নারীত্ব হারানোর বেদনা সদ্যযৌবনা পুষ্প চরিত্রে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠেনি। সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষা সংস্কার বিশ্বাস মতে নারী-সত্তার বিপর্যয়ের চরমতম সময়ে এ চরিত্রে ন্যায়-অন্যায় বোধের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত বা টানাপোড়েন লেখক উপস্থাপন করেননি। উপন্যাসের শেষাংশে পুষ্পর ট্রমা আক্রান্ত হওয়ার জন্য পতিতাবৃত্তি কেন্দ্রিক মনস্তাত্ত্বিক রক্তক্ষরণকে দায়ী করা যায় না। কেননা এই দুই ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ে পুষ্প খুব স্বাভাবিকভাবে তার পতিতা পেশাকে মেনে নিয়েছিল। চারজন সন্ত্রাসী কর্তৃক অপহৃত হওয়া, রাতভর পালাক্রমে গণধর্ষণের শিকার রক্তাক্ত আহত পুষ্পের মনে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির ভয় কাজ করে তাকে ট্রমা আক্রান্ত করেছে। ঘৃণ্য পেশা হলেও এ কাজের উপার্জিত অর্থে পুষ্প তার পরিবারের দায়িত্ব নিতে পেরেছে। উপরন্তু ঢাকা শহরের পরিবেশে পরিচ্ছন্ন আভিজাত্যময় জীবনযাপন করতে পেরেছে। অভাব দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত পুষ্প প্রথমাবস্থায় ফাঁদে পড়ে শরীর বিকিয়ে দিলেও পরবর্তীকালে সে এই পরিণতিকে মেনে নিয়েছিল। ভেবেছিল তার জীবন এভাবেই অতিবাহিত হবে। হঠাৎ সন্ত্রাসীর অপ্রত্যাশিত আক্রমণ পুষ্পকে করেছে উন্মূল, দিশেহারা এবং ট্রমা আক্রান্ত। পরবর্তী জীবনে অথবা ট্রিলজি উপন্যাসের পরবর্তী খণ্ডে পুষ্পর এ মানসিক বিপর্যয় প্রভাব বিস্তার করেছে।

নওয়াব আলি চরিত্রটি খলচরিত্র হওয়ায় যাবতীয় নেতিবাচক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এক্ষেত্রে শঠতা, নিচুতা, স্বার্থপরতার চরম প্রকাশ চরিত্রটিকে খলচরিত্রের সার্থকতা দিয়েছে। তবে নওয়াব আলির আকস্মিকভাবে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করার বিষয়টি পাঠকমনে প্রশ্ন রেখে যায়। উপন্যাসের কাহিনিতে এ চরিত্রের জীবনচিত্রের আলোকে বর্ণিত বাসস্থান, রোজগার, খাদ্যসংস্থানসহ সকলই তার অনিশ্চিত, অস্থির, অগোছালো জীবনপ্রবাহের নির্দেশনা দেয়। নিম্নশ্রেণির ক্লেদাক্ত জীবনের সে এক দক্ষ খেলোয়াড়। নিজেকে ছাড়া সে কাউকে চেনে না, মানেও না। অনায়াসে সুন্দরী শ্যালিকা পুষ্পকে সাবরিনার মতো দেহপসারিনীর হাতে তুলে দেয়। কোনও একদিন বহুল কাক্সিক্ষত পুষ্পের শরীরকে সে নিজেও ভোগ করে। নৈতিকতা বিবর্জিত এমনই এক অসভ্য, বিকৃত মানসিকতার মানুষ সে। এমনকি নিজের ঔরসজাত পুত্রসন্তানের প্রতিও তার কোনও আকর্ষণ বা দায়বদ্ধতা নেই। স্ত্রী পুত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলেও উপন্যাসে একটি ঘটনায় মা এবং বোনের প্রতি নওয়াব আলির সচেতন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বোন কুসুমের থাকার জন্য পুষ্প নওয়াব আলিকে গ্রামের বাড়িতে ঘর উঠানোর টাকা দেয়। নওয়াব আলি নতুন ঘর তুলে স্বপ্ন দেখে এই ঘরে তার মা আর বোন থাকবে। স্ত্রী কুসুম থাকবে তার মায়ের পুরানো ঘরে। নওয়াব আলির এই স্বপ্ন একদিকে মা এবং বোনের প্রতি তার মনের দুর্বলতা বা ভালোবাসা প্রকাশ করে, অন্যদিকে তার নীতিহীন চরম স্বার্থপর রূপের প্রকাশ ঘটায়। কেননা এক্ষেত্রে মা এবং বোন তার নিজের আপন হয়েছে কিন্তু স্ত্রী, পুত্র এবং শ্যালিকা পুষ্পকে সে আপন ভাবতে পারেনি। ট্রমা আক্রান্ত পুষ্প প্রবল প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। নওয়াব আলিকে পাল্টা ক্ষতবিক্ষত করার উপায় খুঁজতে থাকে। প্রতিশোধপরায়ণ পুষ্প কৌশলে নাওয়াব আলির বোন টুনিকে চাকরি দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সাবরিনার বাসায় নিয়ে আসে। নির্দিষ্ট দিনে নওয়াব আলিকে টুনির ঘরে যেতে বললে, সে মুখ না দেখেই বলে, ‘ওদিকে মুখ ফিরাইয়া রাখছ ক্যা ? কাছে আসো।’ (পৃ. ১৯৩) টুনিকে দেখামাত্রই নওয়াব আলি পুষ্পর প্রতিশোধ অনুধাবন করে। প্রশ্ন থাকে সাবরিনার বাসায় বোন টুনিকে দেখে পুষ্পর প্রতিশোধের পন্থা উপলব্ধিতেই নওয়াব আলি আত্মহত্যা করতে ছুটে যাবে কেন ? তার মত ধূর্ত মানুষ বোন টুনিকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার কথা না ভেবে আত্মহত্যা কেন করল ? নিশ্চিতভাবে বলা যায় শ্যালিকা পুষ্পর স্থানে টুনিকে দেখে তার আত্মঅনুশোচনা বোধও জাগ্রত হয়নি। কেননা টুনিকে দেখার পরে ধারালো বটি হাতে সে পুষ্পকে আঘাত করার চেষ্টা করেছে। যদি আত্মঅনুশোচনা বোধ জাগ্রত হতো তাহলে সে পুষ্পর ওপরে প্রচণ্ড আক্রোশে ধারালো বঁটি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। হয়তো লেখক নওয়াব আলির জীবন অধ্যায়ের সমাপ্তি টানতে চান। হয়ত লেখক পুষ্পকে জেল খাটিয়ে, কিছুটা শাস্তি ভোগ করিয়ে তার পতিতা জীবনের সমাপ্তি টানতে চেয়েছেন। সুস্থ-সামাজিক সাংসারিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনেই লেখক নওয়াব আলিকে মেরে ফেলাই যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন।

ফাঁদ উপন্যাসে ট্রিলজির অপর কেন্দ্রীয় চরিত্র কাদেরের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় হলেও এ চরিত্রের সমূহ গুণের পরিচয় পাওয়া যায় দ্বিতীয় খণ্ড পুষ্পকথা উপন্যাসে। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মোহিনীর বিয়ে উপন্যাসে একজন পতিতার কন্যা পরিচয়ের ট্যাগ মোহিনীকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেয় না। যদিও মোহিনী শিশুকাল থেকে পালক পিতা-মাতার আশ্রয়ে ভদ্রসমাজে মানুষ হয়েছে। তবে শুধু পতিতার সন্তান পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও সে একটি ভালো চাকরি পায় না। মোহিনীর বিয়ের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়লে একজন ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রেমিক পুরুষটি ভালোবাসার কথা বলে ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শহর থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে তার স্বরূপ প্রকাশ করে। স্পষ্টভাবে জানায় পতিতার মেয়েকে ভোগ করা যায় কিন্তু তাকে বিয়ে করে সংসার করা যায় না। মোহিনীকে তার সহযোগীসহ ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়। শুদ্ধ, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাওয়া মোহিনীকে শুধু পতিতার সন্তান হওয়ার অপরাধে গণধর্ষণের মাধ্যমে কলঙ্কিত করে আবারও তাকে পতিতাবৃত্তির দিকেই ছুড়ে ফেলা হয়। অন্যদিকে পুষ্পকথা উপন্যাসের পুষ্প সৌভাগ্যবতী। পতিতা হয়েও সে কাদেরের মতো একজন সর্বগুণে গুণান্বিত সৎ মেধাবী মানুষকে স্বামী হিসেবে তার পাশে পেয়েছে। কাদেরের আদর, যত্ন, সেবা, শুশ্রƒষা পুষ্পর জীবনের এক পরম প্রাপ্তি।

পুষ্পসহ নওয়াব আলির সাবরিনার ফ্ল্যাটে প্রবেশ মুহূর্তে কাদের ওই বাসার দারোয়ানের চাকরিতে নিয়োজিত ছিল। প্রতিনিয়ত সাবরিনার ফ্ল্যাটে নতুন নতুন নারী-পুরুষের আনাগোনা কাদেরের মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফলে এই বাসায় চলতে থাকা অনৈতিক কার্যকলাপের বিষয়টি কাদেরের ধারণায় ছিল। প্রবেশ মুহূর্তে কিশোরী পুষ্পের নিষ্পাপ অপূর্ব সুন্দর মুখ দেখে শিক্ষিত মেধাবী কাদের পুষ্পের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে বা তাকে ফাঁদে ফেলার বিষয়টি বুঝতে পারে। এই পরিস্থিতিতে অসহায় পুষ্পের প্রতি কাদেরের হৃদয়ে মায়ার সৃষ্টি হয়। এই মায়া পুষ্পর সঙ্গে নিত্য আলাপে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। পুষ্প যেহেতু স্বেচ্ছায় এ পেশায় আসেনি, সঙ্গত কারণেই কাদের তার পাশে শক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে একটি শুদ্ধ সম্মানজনক জীবন উপহার দিতে চেয়েছে। কাহিনির গতিশীলতায় দেখা যায় কাদের তার দেওয়া কথা রেখেছে। ফাঁদ উপন্যাসের শেষাংশে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে পুষ্প এবং কাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কাদের এবং পুষ্পর সংসারজীবন বর্ণনার মধ্য দিয়ে ট্রিলজির দ্বিতীয় খণ্ড পুষ্পকথা উপন্যাসের সূচনা হয়। এ খণ্ডে তাদের নতুন সংসারের অভাব-অনটন, সংকট, পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, বিশ্বাস তথা দাম্পত্য জীবনের উত্থান পতন উঠে এসেছে। কাদের চরিত্রে আরোপিত বিশেষ ব্যক্তিত্ব, তার মহানুভবতা, সততা, সহনশীল মনোভাব, দায়িত্ব কর্তব্যের প্রতি একাগ্রতা তাকে একটি বিশেষ চরিত্রে পরিণত করেছে। কাদের প্রসঙ্গে পুষ্পকথা উপন্যাসের অপ্রধান চরিত্র আনোয়ার বলেছে : ‘আপনার সামনে বলা ঠিক না স্যার, আমরা তিনজনই আলাপ করি। আপনার মত ভালো মানুষ কখনও দেখিনি।’ (পৃ.২১৪) আনোয়ারের সুরে সুর মিলিয়ে এই ট্রিলজির সকল পাঠক নির্দ্বিধায় একই কথা বলে উঠবেন। সততা এবং শ্রমকে বিনিয়োগ করে একজন মানুষ সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পারে কাদের চরিত্রটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ট্রমা আক্রান্ত পুষ্প বিয়ের পরে অধিকাংশ সময়ে অসুস্থ থাকলে কাদের তার প্রতি কখনো বিরক্তিও প্রকাশ করেনি। বরঞ্চ পুষ্পকে সুস্থ করে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। দিনের পর দিন মানসিকভাবে অসুস্থ পুষ্পকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে সংসারের রান্নাসহ সকল কাজ করে অফিস করেছে। অফিস থেকে এসে আবারও রান্নাসহ সংসারের যাবতীয় কাজ করেছে। যেখানে কাজ সেরে বাড়ি এসে প্রস্তুত এক থালা ভাত না পেয়ে বাঙালি পুরুষ স্ত্রীর মাথায় দায়ের কোপ বসিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না (রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্প)। সেখানে কাদেরের মহত্ত্ব পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায় না। লেখক যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে কাদের চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন। এই চরিত্রের দোষত্রুটি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এমন চরিত্র জগতে বিরল। বাঙালি পুরুষ হয়েও কাদের চরিত্রটি স্ত্রী পুষ্পের জন্য দিনের পর দিন যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, যে শ্রম বিনিয়োগ করেছে তা সচরাচর দেখা যায় না। উপন্যাসের কোনও এক সকালে পুষ্পকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে কাদের সংসারের কোনও কাজে হাত না লাগিয়ে হোটেলে নাস্তা করে অফিসে চলে যায়। ঘুম থেকে উঠে টেবিলভর্তি নোংরা, এঁটো থালাবাসন দেখে পুষ্প গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। পাঠক মনে বিভ্রান্তি জাগে। প্রথমে মনে হয় সব কাজ তাকে করতে হবে জেনেই সে গম্ভীর হয়ে আছে। মনে হয় বাড়ির কাজের লোকটি কাজ না করে ফাঁকি দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কাদেরের এই পরিবর্তন পুষ্পকে অসুস্থতাজনিত কারণে তার সংসারের প্রতি উদাসীনতার বিষয় সম্পর্কে জানান দিয়েছে। হয়ত অনুধাবন সাপেক্ষে সে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছে। এ কথাও সত্য পুষ্প চরিত্রের অতীত ইতিহাস বাদ দিলেও বাঙালি স্বামী এরূপ উদাসীন স্ত্রীকে বেশি দিন সহ্য করে না। এখানেই কাদের চরিত্রটি আর সবার থেকে আলাদা। পুষ্পকথা অংশে কাদের এবং পুষ্পের দাম্পত্য জীবনে পুষ্পকে সংসারী নারীরূপে আমরা পাই না। পুষ্পের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়েছে তৃতীয় অধ্যায় অংশে অর্থাৎ কাদেরের মৃত্যুর পরে। অথই সাগরে ডুবতে থাকা মানুষ যেমন সর্বস্ব^ দিয়ে জীবন রক্ষার চেষ্টারত থাকে, কাদেরের মৃত্যুর পরে পুষ্প তেমনিই অনাথ দুই সন্তান নিয়ে তার সর্বস্ব দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে।

পুষ্পকথা উপন্যাসের শেষাংশে এই দম্পতির ঘরে আলোক এবং রশ্মি নামক দুই যমজ সন্তানের জন্ম হয়। আলোক, রশ্মির শিশু বয়সেই কাদের এলাকার মাস্তান চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কোম্পানির বসের নির্দেশে থানায় মামলা করলে তাদের আক্রোশের শিকার হয়। সন্ত্রাসীরা কাদেরের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। কাদেরের হত্যার মধ্য দিয়ে পুষ্পকথা উপন্যাসের সমাপ্তি এবং তৃতীয় খণ্ড তৃতীয় অধ্যায় উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়েছে। কাদেরের এই মৃত্যুর পরে শুরু হয় পুষ্পর জীবনযুদ্ধ। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় শখের বসে দুই একটি পুতুল বানিয়ে পুষ্প চরিত্রে স্বাবলম্বী হওয়ার যে ধীর প্রচেষ্টা তা কাদেরের মৃত্যুর পরে জোরালো হয়ে ওঠে। জীবিকার প্রয়োজনে পুষ্পকে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজও করতে হয়েছে। কিন্তু পুষ্পর চোখধাঁধানো রূপই তার কাল হয়ে উঠলে সে অন্য উপায় ভেবেছে। পিতৃহারা আলোক এবং রশ্মি নামক নাবালক দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করেছে। একাকী জীবনের এই বন্ধুর পথ চলায় আলোক, রশ্মির স্কুলের শিক্ষক আফজাল হোসেন এবং অধ্যাপক প্রীতিশ কুমার মণ্ডলের মানবিক সহযোগিতার হাত পুষ্পর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সহায়ক হয়ে উঠেছিল। ট্রিলজি উপন্যাসের তিনটি খণ্ডেই পুষ্পর জীবন তিন দিকে বাঁক নিয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ের শেষাংশে আলোক এবং রশ্মিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে ট্রিলজির উপন্যাসের কাহিনির সমাপ্তি ঘটেছে। পুষ্পকথা অংশের সংসারজীবনে পুষ্প চরিত্রটি  উদাসীন, অসুস্থ, নাজুক রূপে প্রশ্নবিদ্ধ, তৃতীয় অধ্যায় অংশে সেই পুষ্পই পরিণত, দায়িত্বশীল, পরিপূর্ণ বাঙালি মায়ের ভূমিকায় উত্তীর্ণ। উপন্যাসের শেষাংশে আলোক এবং রশ্মির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনার মাধ্যমে তাদের যথার্থভাবে মানুষ করে গড়ে তোলাই তার প্রমাণ উপস্থাপন করে। লেখক অতি যত্নে ধীর পদক্ষেপে কিশোরী পুষ্পকে পরিণত করে তুলেছেন। এই ট্রিলজিতে গতিশীল কাহিনির সঙ্গে চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ তথা সময়কে ধারণ করার প্রয়োজনে প্রাসঙ্গিকভাবে দেশ-বিদেশে সংঘটিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুর উত্তাল মূহূর্ত উঠে এসেছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রসঙ্গে বিরোধী দলের দাবি না মানা, পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে সংঘটিত নৃশংস বোমা হামলা, টুইন টাওয়ার ধ্বংস, ইরাক যুদ্ধ, শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা, আলোচিত দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, করোনা মহামারীর ভয়াবহতা, আকস্মিক লকডাউন, অস্থির পরিবেশে করণীয় নির্দেশনা, ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং ভ্যাকসিন গ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি অমানিশাকে বিদায় জানানো, সৃষ্ট বিক্ষুব্ধ পরিবেশ কাটিয়ে কালিমামুক্ত একটি নতুন সকালে নতুনভাবে জেগে ওঠার বর্ণনা সংযোজিত হয়েছে।

ভাষার প্রশ্নে লেখক ট্রিলজির প্রথম খণ্ড ফাঁদ উপন্যাসের প্রথমাংশে সবচেয়ে বেশি আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ করেছেন। ফাঁদ উপন্যাসের প্রসঙ্গকথা অংশে লেখক ভাষার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘চরিত্রের প্রয়োজনে বরিশালের স্থানীয় ভাষার সংলাপ স্বভাবতই বিধৃত হয়েছে।’ তবে পুষ্প শহরমুখী হওয়ার পরে এই ভাষার ব্যবহার কমেছে। অর্থাৎ পরবর্তীকালে মাত্র দুই এক স্থানে এই আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বরিশালের স্থানীয় ভাষার সংলাপ ব্যবহারের দাবি থাকলেও তা কোথাও কোথাও বরিশালের ভাষা হয়ে ওঠেনি। তবে এই উপন্যাসে নওয়াব আলির ভাষায় সংমিশ্রণ গ্রহণযোগ্য। কেননা নওয়াব আলি দীর্ঘদিন থেকে শহরে বসবাস করছে বিধায় আঞ্চলিক এবং শহুরে উভয় ভাষাতেই তার দক্ষতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। নওয়াব আলি চরিত্রকে বাদ দিয়ে অন্য চরিত্রের কিছু ভাষার নমুনায় এই অসংগতি কিছুটা উপলব্ধ হয়ে ওঠে, ‘দেখ তোর বাপে আইছে।’ (পৃ. ১২)

পরবর্তী সংস্করণে এরূপ সামান্য কিছু শব্দকে বরিশালের আঞ্চলিক রূপে পরিবর্তন করলে এই উপন্যাসে বরিশালের ভাষা ত্রুটিমুক্ত হবে বলা যায়। বরিশালের ভাষা ছাড়াও নিম্নশ্রেণির চরিত্রের মুখে বিভিন্ন উপভাষার প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। ভাষার আঞ্চলিক রূপের বাইরে এই ট্রিলজিতে শহরকেন্দ্রিক যাপিত জীবনে শুদ্ধ চলিত ভাষাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই ট্রিলজির ভাষা সহজবোধ্য ও গতিশীল।

সময়কে ধারণ করে কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন গায়ত্রী সন্ধ্যা নামক তিন খণ্ডের এক বৃহৎ কলেবরের ট্রিলজি উপন্যাস রচনা করেছেন। এই উপন্যাসে দেশভাগ থেকে অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আটাশ বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পটভূমি উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সুদীর্ঘ সময় এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সংগত কারণেই এই উপন্যাসে অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে এবং অধিকাংশ চরিত্রই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূখণ্ডের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধবিগ্রহে সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করেছে। মোজাম্মেল হক নিয়োগী রচিত ফাঁদ, পুষ্পকথা, তৃতীয় অধ্যায় শীর্ষক ট্রিলজি উপন্যাসে নির্দিষ্ট সময় এবং ঘটনাকে লেখক চরিত্রগুলোর নিত্য জীবনপ্রবাহে সংযোজিত করেছেন। করোনা মহামারী ব্যতীত অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের দীর্ঘ বর্ণনা বা প্রভাব না থাকলেও ছোটো ছোটো ঘটনায় কাহিনির গতিশীলতায় তা শিল্পিতভাবে উঠে এসেছে। এই সংযোজন কাহিনির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তা সময়ের দলিলরূপে সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে বলেই বিশ্বাস।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী কোর্ট কলেজ, রাজশাহী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button