আর্কাইভইংরেজি অনুবাদ

লিটল ম্যাগ : লোকবৃত্ত : শিক্ষা নিয়ে প্রাজ্ঞ উচ্চারণের সমষ্টি : প্রণবকান্তি দেব

এ কথা শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে, মননশীল মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য বই পড়ার মতো উপকারী অভ্যাস আর দ্বিতীয়টি নেই। যদিও বইপড়ায় মানুষের আগ্রহ কমছে না বাড়ছে―সাম্প্রতিককালে সে বিতর্ক বেশ জমে উঠেছে। কিন্তু এ সত্যটি সবাই স্বীকার করেন যে, বইপড়া ভালো। বইপড়ার ক্ষেত্রে ভালো বই নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যক্তির আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসা, ভালোলাগা এ ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তবে একটু ভিন্নধর্মী পাঠকের কাছে পাঠের ক্ষেত্রে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বিশেষ আগ্রহের। কেননা লিটল ম্যাগাজিন শুধু সাহিত্যের উপকরণকেই ধারণ করে না, ধারণ করে প্রথার বিপরীতধর্মী স্বপ্ন-বাস্তবতাকে। ফলে মনস্বী পাঠক যারা সময়ের স্রোতে না ভেসে সময় থেকে ভাবনায়, চিন্তায় একটু এগিয়ে থাকতে চান, খুঁজে পেতে চান গণ্ডির বাইরে কিছু, তারা বেছে নেন ‘লিটল ম্যাগাজিন’।

লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আলাপ করতে গেলেই অবিচ্ছেদ্যভাবে চলে আসে বাংলাভাষার অন্যতম লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর নামটি। লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে দেশ পত্রিকার ১৯৫৩ সালের মে মাসের সংখ্যায় ‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘এক রকমের পত্রিকা আছে যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই―যদি না কোনও সতর্ক সহযাত্রী সেটি আবার আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বাধিত এবং বিব্রত করেন। আর এক রকমের পত্রিকা আছে যা স্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে চেয়ে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি―জল, পোকা, আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য। যেসব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্গত হতে চায়―কৃতিত্ব যেটুকুই হোক, অন্ততপক্ষে নজরটা যাদের উঁচুর দিকে, তাদের জন্য নতুন একটা নাম বেরিয়েছে মার্কিন দেশে; চলতি কালের ইংরেজি বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে লিটল ম্যাগাজিন।’

সাম্প্রতিক সময়ে স্বপন নাথ সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন লোকবৃত্ত পাঠ শেষে বুদ্ধদেব বসুর উল্লিখিত মন্তব্যটি আবার মনে পড়ে গেল। বিশেষ করে লোকবৃত্তের চলতি সংখ্যার বিষয়বস্তু আমাকে টেনেছে আগ্রহসূচক ব্যঞ্জনায়।

শুধুমাত্র ‘শিক্ষা’ নিয়ে ৩৪২ পৃষ্ঠার কোনও লিটল ম্যাগাজিন পড়ার সৌভাগ্য এর আগে আমার হয়নি। শিক্ষার নানাদিক-সংকট, সম্ভাবনা, বিবর্তন, পরিবর্তন, শিক্ষার সঙ্গে রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির যোগসূত্রতা, বৈষম্য, স্বপ্নরচনা ইত্যাদি বিবিধ বিষয়কে এক মলাটে ধরার এক দুর্দান্ত প্রচেষ্টা দেখি লোকবৃত্তের শিক্ষা সংখ্যায়। সাধারণত শিক্ষা নিয়ে আমরা রাজধানীতে বসবাসকারী ‘মিডিয়া সেলিব্রেটি’দের বক্তব্য শুনতে শুনতেই ক্লান্ত থাকি। হাতেগোনা কয়েকজনেরই চোখেই দেখানো হয় আমাদের শিক্ষার নানা চিত্র। সেই অর্থে, লোকবৃত্ত লিটল ম্যাগাজিনের গৎবাঁধা একটা দেয়ালকে সজোরে আঘাত করল।

শুধু গল্প, কবিতা আর উপন্যাস দিয়ে দিনের পর দিন পরিবেশন করে আসা ‘লিটল ম্যাগাজিনের’ বিষয়বস্তু এবং ভাবনা বিন্যাসে বড় একটা নতুনত্ব নিয়ে এল লোকবৃত্ত।

ভেবে দেখুন, আমাদের সামগ্রিক জীবনে বিষয়-ভাবনার যে মানচিত্র থাকে তার বড় অংশ জুড়েই থাকে শিক্ষা। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিগত কয়েক দশক ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটেছে নানাবিধ পরিবর্তন। তুমুুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার শাখা-প্রশাখাগুলো। সেদিক বিবেচনায় লোকবৃত্তের বর্তমান সংখ্যার বিষয় নির্বাচন অত্যন্ত সময়োপযোগী বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। আবার আরেকটি বিষয় আমাকে আনন্দিত করেছে যে, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত উপজেলা থেকে শুরু করে রাজধানীতে বসবাসকারী প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সুচিন্তিত ভাবনা ও পর্যবেক্ষণ এতে স্থান পেয়েছে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার বাঁক পরিবর্তন নিয়ে নানামুখী চিন্তার সঙ্গে পাঠকের যোগসাজশ তৈরির একটা সুযোগ করে দিয়েছে  লোকবৃত্ত।

মোট বত্রিশটি প্রবন্ধে সমৃদ্ধ এ প্রকাশনায় শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিচিত্র ভাবনা স্থান পেয়েছে। শিক্ষার সঙ্গে দরিদ্রতা, উন্নয়ন, ক্ষমতা, সিনেমা, বিজ্ঞান, অগ্রগতি প্রভৃতি বিষয়ের পারস্পরিক যোগসূত্রতাকে নানামাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন লেখকেরা। একইভাবে শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও গুরুচাঁদের শিক্ষাভাবনা ও সংস্কার, শিক্ষার্থীবান্ধব, আনন্দময়, স্বপ্নের স্কুল-কলেজ ইত্যাদি নানা স্বাদের চিন্তার অপূর্ব এক সম্মিলন ঘটেছে লোকবৃত্তের পাতায় পাতায়। আবার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা সংগ্রাম এবং শিক্ষার্থী কল্যাণ ভাবনাও স্থান পেয়েছে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে।

লেখক আহমেদ মাওলা তার ‘শিক্ষা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ ও শিক্ষক সমাজের মর্যাদা’ শীর্ষক প্রবন্ধে যখন বলেন, ‘কোচিংয়ের ভাইয়াদের কাছে পড়তে গিয়ে একটা ভাইয়া কালচার তৈরি হয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ছাত্রছাত্রীরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে শ্রদ্ধা-সম্মানের আসনে আর মেনে নিতে পারছেন না। প্রজন্মের মনোজাগতিক সংকট এখানেই। কারণ, একজন সত্যিকারের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কেবল পুঁথিগত বিদ্যা শেখান না, শিক্ষার্থীকে আচরণ, পোশাক-ভাষা-সামাজিক মূল্যবোধেরও তালিম দেন। এতে করে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রত্যাশিত ভবিষ্যৎ নাগরিক হয়ে ওঠে। কিন্তু কোচিংয়ের ভাইয়াদের কাছে জিপিএ ফাইভ পাওয়ার সহজ কৌশল রপ্ত করতে পারলেও শিক্ষার মূল যে উদ্দেশ্য মানুষের চরিত্রের প্রত্যাশিত পরিবর্তন তা অসম্পূর্ণই থেকে যায়।’ তখন বর্তমান সময়ের এক ক্ষয়িষ্ণু চিত্রই আমাদের সামনে উঠে আসে।

অন্যদিকে, দীপংকর মোহান্তের ‘পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার বহুমুখী অগ্রযাত্রা’ প্রবন্ধটি আমাদের সামনে শিক্ষা-সংগ্রামের এক জ্বলজ্বলে ইতিহাস উন্মোচন করে দেয়। নিবিষ্ট পাঠক অতীতের আলোয় বর্তমান ও ভবিষ্যতের একটি ছায়াচিত্র খুঁজে পাবেন এ প্রবন্ধে। একইভাবে নানাবিধ ভাবনার দুয়ার খুলে দেয় অসীম কুমার পালের ‘মূল্যায়ন, অগ্রগতি ও শিক্ষার্থী কল্যাণ’, মাসুদ রানার ‘শিক্ষায় ব্লান্ডেড পদ্ধতি’, সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের ‘সৃষ্টিশীল শিক্ষা: শিক্ষাব্যবস্থার দায় ও শিক্ষার্থীর সম্ভাবনা’, এম এম আকাশের ‘দারিদ্র্য দূর করার জন্য শিক্ষাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ’ ইত্যাদি প্রবন্ধগুলো। তাছাড়া অন্য প্রবন্ধগুলোও তথ্য ও তত্ত্বের বুননে ঠাসা। মোটকথা, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটা সামগ্রিক চিত্র উঠে এসেছে এক মলাটে। অনুসন্ধিৎসু পাঠক নিমগ্ন চিত্তে ডুব দিতে পারেন চলতি সংখ্যার লোকবৃত্তে।

তবে ব্যক্তিগত পাঠে আমার মনে হয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রম, মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষার গুণগত মান ইত্যাদি নিয়ে সুচিন্তিত, অভিজ্ঞতাপ্রসূত আরও কিছু লেখা যুক্ত হলে পাঠকের আরও উপকার হতো। তাছাড়া উচ্চশিক্ষার নানা সংকট, গবেষণার অপ্রতুলতা, শিক্ষা বাজেট, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কিছু আয়োজন লোকবৃত্তকে দিয়েছে আরও সমৃদ্ধির সৌরভ। অন্যদিকে, অন্যান্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনামূলক কিছু রচনা থাকলে পাঠকের ভাবনাবিশ্ব আরও একটু সম্প্রসারিত হতো। তাছাড়া শিক্ষার ভবিষ্যৎ গতি প্রকৃতি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সীসহ নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রভাব―এসব বিষয়ে খুব একটা পাঠের সুযোগ নেই লোকবৃত্তের বর্তমান সংখ্যায়। তবে, আগামীতে এগুলো সংযোজনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

শেষে এসে বলি, একটা দুঃসাহসিক কাজ করেছেন স্বপন নাথ। লিটল ম্যাগাজিনের চেনা বিষয়বস্তুর বাইরে এসে সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে এত লেখকের সম্মিলন ঘটানো সহজ কাজ নয়। একদিকে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার নানা সংকট; অবকাঠামো, পাঠদান, সিলেবাস, মূল্যায়ন থেকে আদর্শ-মূল্যবোধের সংকটের চিত্র, অন্যদিকে প্রিয় শিক্ষক এবং প্রিয় বিদ্যাপীঠের আবেগতাড়িত বর্ণনা শিক্ষাবিষয়ক পাঠকের মনকে উসকে দেয়। যারা শিক্ষা নিয়ে ভাবেন তাদের চিন্তায় নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে লেখাগুলো। এ প্রসঙ্গে সম্পাদকের একটি বক্তব্য উল্লেখ করার মতো। সম্পাদন-কথায় তিনি বলেছেন, ‘লেখা সংকলনের ক্ষেত্রে দুটো আপাত বিভাজন আমরা রেখেছি। প্রথম অংশে আছে তত্ত্ব ও অভিমত সংশ্লিষ্ট লেখা আর দ্বিতীয় অংশে রয়েছে অভিজ্ঞতা, রূপান্তরের সংগ্রাম এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের কয়েকটি প্রসঙ্গ।’ শেষ কথাটি খুবই তাৎপর্যময়―‘বস্তুত শিক্ষা প্রসঙ্গে ভাবছেন সকলে, এটাই আনন্দের।’ আমিও বলি, শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রতিদিনের ভাবনা, দুর্ভাবনাগুলোকে যেভাবে লোকবৃত্ত তুলে এনেছে, তাতে বার বার পড়েও আশ মেটে না। তবে ভাবনাগুলো আমাদের ভাবায়―এটাই সত্যি।

আমি সানন্দে আগ্রহী পাঠকদের লোকবৃত্ত পাঠের আমন্ত্রণ জানাই। অনলাইনের পাশাপাশি দেশের যে কোনও বই বিপণী প্রতিষ্ঠান থেকে এটি সংগ্রহ করা যাবে।

লেখক : সংগঠক, সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button