লেখা একটি ঝরনাধারা, যদি তা না হয়, তাকে ঝরনাধারা বানানোর শিল্পটি লেখককে রপ্ত করতে হয়। দীপেন ভট্টাচার্য তা চমৎকারভাবে করেছেন। তাঁর লেখার অন্তর্নিহিত ঝরনাধারার সুর ও স্বর, বৈভব ও বিত্ত এমনই যে পাঠককে নিজের মেজাজেই টেনে নিয়ে যায়। তিনি কল্পকাহিনি লেখেন কিন্তু তাঁর কাহিনি ও আখ্যানের বর্ণনায় উঠে আসে প্রতিবেশ, দৈনন্দিন দিনের ক্ষুদ্র খণ্ডাংশগুলো এবং আশেপাশের মানুষ, যাদের যাপিত জীবন আমাদের জীবনের খুব কাছাকাছি। ‘পৃথিবীতে কোনও কিছুই নতুন নয়, প্রতিটি সৃজনই পুরাতন কাঁসার থালায় বাস্তবের এক অপূর্ণ প্রতিফলন’ হলেও, সৃষ্টির নতুনত্বই পাঠককে টানে, নতুনত্ব না থাকলে পাঠক তা পড়ে আনন্দ পাবে না।
১৮টি গল্প নিয়ে লেখা তাঁর সর্বশেষ বই শ্যাতোয়ান্ত পড়ে শেষ করলাম। দুটো দিন মগ্ন কাটল। কিছু গল্প আগে পড়েছি, কিছু প্রথম পড়লাম। লেখাগুলোতে নতুনত্ব আছে, ভাষায় লেখকের স্বকীয় কোমলতা ও মমত্ব আছে। যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে লেখককে চেনেন, তাঁরা জানেন তাঁর কণ্ঠস্বর, বাচন ও উচ্চারিত শব্দগুলো মন্ত্রের কাঁথায় মোড়ানো এবং তাঁর লেখাগুলো অবিকল তারই প্রতিচ্ছবি। তাঁর ‘মেইনের বিষণ্ন ঋতুগুলি’, ‘মাউন্ট শাস্তা’, ‘একটি পারুল গাছ’, ‘পদ্মগুলঞ্চ’, ‘মেডুসা’, ‘মা’র সঙ্গেÑট্রেনে’ ‘মনোনকে এক্সপেরিমেন্ট’ ইত্যাদি গল্প পাঠে তন্ময় পাঠক নিজেকে গল্পের থেকে পৃথক করতে পারে না, কথকের উদ্বিগ্নতা পাঠককে সম্মোহনে আবিষ্ট করে রাখে।
শ্যাতোয়ার শব্দটি আমার অপরিচিত, বিদেশি হবে হয়তো, হয়তো কোনও নাম, স্থান বা ব্যক্তি অথবা বস্তু। পৃষ্ঠা উল্টাতেই জানা গেল, মণি-মুক্তা থেকে যে আলো প্রতিফলিত হয়, তার উজ্জ্বলতা মাপা হয় শ্যাতোয়ার দিয়ে। বিড়ালের চোখের দিকে তাকালে এই আলোর ঝলকানি ধরা পড়ে। শব্দটি ফরাসি, তবে ইংরেজিতেও ব্যবহৃত হয়।
বইয়ের নামগল্পের চরিত্রের নাম শ্যাতোয়ান্ত। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উৎফুল্ল আগ্রাসনের প্রাতঃকালে লেখা ভবিষ্যৎ মানবসমাজের এক ভীতিকর চিত্রকল্প এই গল্প। মি. শ্যাতোয়ান্ত বাস করে এমন একটা সময়ে, যখন বর্ণমালা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে, মানুষ আর হাতে লেখে না, কাগজ কলম নেই (এসব ঘরে রাখা বা বিক্রি করাও অবৈধ), এমন কী কি-বোর্ড নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঘনক কথা শুনে কাজ করে, লেখে, গণনা ও জটিল অঙ্কের সমাধান করে। কিন্তু তাও সহজ নয়। ঘনক তর্ক করে, অবাধ্য দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়।
শ্যাতোয়ান্ত বলে, আমি একটা নতুন গল্প লিখব। ঘনক বলে, নতুন গল্প সৃষ্টির পথ কণ্টকময়।
শ্যাতোয়ান্ত অগ্রাহ্য করে, বলে, ‘শুরুর বাক্যটা হবে―পৃথিবী তখন এতই নতুন ছিল যে কোনও বস্তুর নাম ছিল না, আঙুল দিয়ে সেগুলো দেখিয়ে দিতে হতো।’
ঘনকের কণ্ঠ শ্লেষপূর্ণ, ‘তুমি ঠাট্টা করছ, এই বাক্যটি তো লেখা যাবে না, কারণ এরই মতই একটি বাক্য গাব্রিয়েল মার্কেজ তাঁর নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ বইটিতে ব্যবহার করেছেন।’ শ্যাতোয়ান্ত তখন অন্য একটি বাক্য বলে এবং ঘনক উত্তর দেয়, ‘তোমাকে এর জন্য দোষ দেব না, তুমি এনার লেখার সঙ্গে পরিচিত নও। এ রকম একটি বাক্য পাওয়া যাবে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক বইতে।’
এভাবে ঘনক পৃথিবীর তাবৎ লিখিত সম্পদকে মুহূর্তের মধ্যে দেখে নিতে পারে এবং সরকারি নিষেধাজ্ঞা মেনে অতীতে সৃষ্ট সাহিত্যের কোনও বাক্যের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক বা ভাবের সঙ্গে মিল থাকলে তা নকল বা চৌর্যবৃত্তি হিসেবে গণ্য করে তা রেকর্ড করে না। ফলে বছরের পর বছর যায়, মৌলিক কোনও সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। এই গল্প পড়তে পড়তে আমরা এমন একটি সমাজে চলে যাই যেখানে রাষ্ট্র সর্বক্ষমতাধর, মানুষের স্বাধীন চিন্তা বা স্বাধীন চেতনাকে রাষ্ট্র ভয় পায় ও অবদমন করে এবং আহত মৃত্যুমুখী শ্যাতোয়ান্তকে বিড়বিড় করতে শোনা যায়, ‘এক ডগমা বদলে আর এক ডগমা আসবে। এতে নতুনত্বের কী আছে ?’
লেখক ও আমি অধুনালুপ্ত এমনি একটি সর্বক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও সমাজে বাস করেছি বেশ কিছুদিন এবং তার শাসনের যে অপরিশীলিত, স্থল ও নগ্ন দিকটা ছিল এই গল্পে যেন তারই একটি প্রতিচ্ছায়া রয়েছে। এবং সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো, বর্তমানে আমরা উভয়েই বাস করছি যে সমাজে, সেখানে প্রায় একই সর্বক্ষমতাধর, সর্ববীক্ষণকারী ও সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রযন্ত্র উপস্থিত থাকলেও তার সূক্ষ্মতা, পরিশীলতা, পরিমিতি ও পরিবেশনের শৌথিল্যের কারণে আমাদের তার কথা চট করে মনে আসে না। ‘ঞযব নবংঃ ধিু ঃড় শববঢ় ধ ঢ়ৎরংড়হবৎ ভৎড়স বংপধঢ়রহম ঃযব ঢ়ৎরংড়হ রং ঃড় সধশব ংঁৎব যব হবাবৎ শহড়ি যব’ং রহ ঢ়ৎরংড়হ.’―দস্তয়েভস্কির কথাটি মনে পড়ল। তবে এই গল্পের সঙ্গে, এই কথার নৈকট্য বা দূরত্ব এক বাঁও না হাজার বাঁও আমার জানা নেই।
‘বেলা ও রেশমি’ গল্পে ঘোড়ায় চড়ে আসে বেলা, ‘বয়েস চল্লিশ হতে পারে, কালো চুল কাঁধের দু’পাশে ছড়ানো, এতদূর থেকেও তীক্ষè নাকের দু-পাশে উজ্জ্বল কালো চোখের মণি দৃষ্টি এড়াল না। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ছড়ানো একটা স্কার্ট, সেই সাদা স্কার্ট লাল-নীল ফুলের নকশায় ভরা।’ তার বাঁ হাতের অনামিকায় একটা নীল পাথরের আংটি। রোদ না থাকলেও সেটি ঝলকায়…
কিন্তু বেলার বয়েস ৪০ নয়, একটু বেশি, পাঁচশ। কমান্ডার অ.কে ঘুম পাড়িয়ে ২৫০১ সনে মিউনিথে ক্রাইওজেনিক আধারে সংরক্ষণ করা হয়েছিল, ৫০০ বছর পরে জেগে ওঠার কথা। কিন্তু ৪৫ হাজার বছর কেটে গেছে। আগের পৃথিবী নেই, মানুষ নিজেই ধ্বংস করে দিয়েছে। কিছু বৈজ্ঞানিক, শিল্পী, দার্শনিক ধ্বংসলীলার আগে তার ক্রাইওজেনিক কফিন সঙ্গে নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেছিল। পঁচিশ হাজার বছর ভ্রমণ করেছে তারা, তারপরে বুড়ো পৃথিবী থেকে ১০ আলোকবর্ষ দূরে ‘এপসিলন এরিদানি’ নক্ষত্রে বসতি স্থাপন করে। জাগিয়ে তোলার পরিস্থিতি না হবার কারণে বংশ থেকে বংশান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তারা তাকে সুরক্ষা করে, কারণ অতীতের সঙ্গে সেই একমাত্র যোগসূত্র।
কিন্তু ৪৫ হাজার বছরে মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে বদলে গেছে, সুতরাং বেলা ও তার ঘোড়া রেশমি অবিকল পৃথিবীর প্রাণির মতো দেখতে হলেও, তারা তা নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘আমি রেশমির বেগুনি লোমের ত্বকে হাত বুলাই, সেই ত্বকের নিচে অজৈব যৌগ!’ ‘এসসিলন এরিদানির উদীয়মান আলোয় বেলার শরীরের ভেতর থেকে একটা লাল আভা বের হচ্ছে।’
ভাষার প্রবাহ পাঠককে নিয়ে যায় সুদূর কোনও নক্ষত্রে, যেখানে মানুষ টিকে আছে কিন্তু মানুষ হিসেবে নয়। যে পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য পৃথিবী এমন উঠে-পড়ে লেগেছে, তার প্রতি মমত্বের এক অপূর্ব স্থাপত্য এই গল্প এবং সময়কে থামিয়ে দিয়েছিল কোনও এক বাজিকর, মিশরের মন্দির-লেখক আমেনহোতেপের ঘরে, কারণ সে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল তার ৫ বছরের মিষ্টি মেয়েটি যাতে বড় না হয়। অজ্ঞাত বাজিকর শুনে বলেছিল ‘বাহ, বেশ তো, এ রকম একটা এক্সপেরিমেন্ট হলে মন্দ কী ?’
এবং এরপরেই শুরু হয় ভেল্কির খেলা, মেয়ের বেড়ে ওঠা থেমে যায়, ৮ মাসের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ক্লান্ত কিন্তু তার গর্ভাবস্থার পরিবর্তন হয় না, যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের বেদনার উপশম নিয়ে স্পর্শ করে না মৃত্যুর কোমল হাত। কানাঘুষা, ফিসফিস চলে চারিদিকে, সাবধান, সাবধান আমেনহোতেপের ঘরে অপদেবতা অ্যাপোফিস ভর করেছে। কেউ কাছে আসে না, কথা বলে না, সমস্ত গ্রাম ত্যাগ করে তাদের, বাজারে দোকানিরা পণ্য বিক্রি করা বন্ধ করে দেয়। সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলে, খোলা দরজার অনুসন্ধান করতেই হয়। বন্ধু আমেনাথতের সঙ্গে নৌকায় চড়ে বসে সে বৃদ্ধ বাজিকরের খোঁজে।
‘তীরের কাছে নলখাগড়া আর প্যাপিরাস, আর রুক্ষ বাদামি-হলুদ পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে খেজুর, বাবলা ও পারসিয়া গাছ, হঠাৎ করে দু-একটি পিরামিড, দেবী হাথোরের মন্দির দেখতে দেখতে…’ নৌকা চলছে। এবং আমেনহোতেপ নয়, আরও অন্য কেউ, বই খুলে বসে আছে নীল নদের নৌকায়।
লেখকের ভাষার সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রতিটি গল্পে, এবং বইয়ের প্রথম গল্প ‘ইসাবেল সিমোনের সাক্ষাৎকার পাঠ করার শুরু থেকেই আমরা বন্দি হয়ে যাই।’ ‘বাড়িগুলোর বয়স একশ বছরের কাছাকাছি হবে, দেয়ালে ফুল ও লতার ফ্রেস্কো, উপরে নীল-সবুজ রঙের তামার গম্বুজ কি চুড়ো। এককালে এই তামার রং লাল ছিল, বায়ুর সঙ্গে বিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে এই মোলায়েম শান্ত রংটি ধারণ করেছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। লাল, গাঢ়লাল, রক্তিম লাল, বেগুনি, ল্যাভেন্ডার, আর গোলাপি মেঘের পেছনে। ল্যাভেন্ডার ফুলে ভরা এক মাঠের স্বপ্ন দেখি আমি, বৃষ্টিস্নাত হেমন্তের বিকেলে আমার কল্পনায়। ল্যাভেন্ডারের গন্ধ আমাকে শান্তি দেয়। ল্যাভেন্ডার, নাকি লাইলাক ? কোনও একদিন এক কবিকে আমি পড়েছিলাম, তার হৃদয় ছিল লাইলাক রঙের।’
এবং পর্দায় যে নারীর ‘উচ্চারণ, চোখের মণি, ভুরু, কান্না, গালের টোল, বাহুর কোমলতা, স্তনযুগলের ভাঁজ, ঊরুর বক্রতা’ আবু মাসারকে সম্মোহিত করে রেখেছিল, সাক্ষাতে মনে হয়, ‘তার হাসি ছিল গিটারের তারের মৃদু কম্পন, তার বেয়ে সেই কম্পন বায়ুতে উছলে উঠে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।’
গল্পটি প্রেমের নয়, প্রেমানুভূতির, প্রকৃতপক্ষে প্রেমানুভূতিরও নয়, এর মোচড়টি অন্য জায়গায়, অন্য সমান্তরালে, যা আমাদের আনন্দিত করার চেয়ে উৎকণ্ঠিত করে বেশি।
শাস্তা পাহাড়ে হাইকিং করতে গিয়েছিল অমল এবং পাওলো, সেখানে এমন কিছু রহস্যজনক ঘটনা ঘটে, যার সহজ কোনও ব্যাখ্যা নেই। সময় হঠাৎ করে সামনের দিকে নয়, পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। ‘আমার ভবিষ্যৎ হলো আমার অতীত’ অমল উপলব্ধি করে এবং সময়ের উল্টোচক্রে হারিয়ে যায়, কিন্তু উদ্ধার হয় তার ডায়েরিটি। সেই ডায়েরিতে অমলের শেষ এন্ট্রিতে পাওয়া যায় তার দেখা, উল্টোদিকে হাঁটা অমলের প্রতিচ্ছবি একজন দ্বিতীয় অমল, কুয়াশা, গুহা, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ও লাভাকুণ্ডের বর্ণনা, যা পাওলো দেখেনি। দেখেনি কারণ ওসব কিছুই সেখানে ছিল না। অমল অন্য কোনও স্থান ও সময়ে চলে গিয়েছে।
‘সে অন্য একটি সময়ের স্রোতে ঢুকেছে, যে স্রোত আমাদের বিপরীত দিকে বইছে, সেই স্রোত তাকে নিয়ে যাবে আর একটি দেশকালে, যার সঙ্গে আমার দেশকালের ছেদ হবে না কোনওদিন।’ তার মানে অতীতে যেখানে যেখানে তাদের দেখা হয়েছিল, তাত্ত্বিকভাবে সেখানে তাদের আবার দেখা হওয়া সম্ভব! তাকে খুঁজতে খুঁজতে পাওলো সুইজারল্যান্ড থেকে উপস্থিত হয় নিউ হ্যাম্পশায়ারের বনের একটি কেবিনে, যেখানে অমল থাকতো ১৬ বছর আগে এবং পাওলো বেড়াতে গিয়েছিল দুদিনের জন্য। এখানে এসে পাওলো ঠিকই অমলের দেখা পায় এবং সেও সময়ের উল্টাস্রোতে প্রবেশ করে নিখোঁজ হয়ে হয়ে যায়। তাকে খুঁজতে আসে তার স্ত্রী এমা। কেবিনের টেবিলের ওপরে পায় অমলের ডায়েটি, যাতে লেখা ছিল পাওলোর শেষ দিনের অভিজ্ঞতা।
এবং সেই ডায়েরিতেই পাওয়া যায় এমার শেষ দিনের কথাগুলো। ‘পাওলোর বয়েস যত কমবে, আমার বয়েস তত বাড়বে। তারপর হয়তো পাওলোর মতোই আমি প্রবেশ করব আমার অতীতমুখী সময়ে। এ যেন একটা ছোঁয়াচে ব্যাপার। সেই অতীতমুখী মহাবিশ্ব আমাদের মহাবিশ্ব থেকে একটি একটি করে জীবন, বস্তু, স্থানকালের রেখাকে হরণ করে তার মহাবিশ্ব গড়ছে। শেষাবধি এই মহাবিশ্বের প্রতিটি পরমাণু, মৌলিক কণা সেই অতীত যাত্রার সঙ্গী হবে।’ ঘোরতর ঘোরলাগা গল্প! কোন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত এখানে ?
আমি সময়ের সরল পথ ধরে হাঁটতে চাই, যেখানে কলমির শাকে কুয়াশার বিন্দু চিক চিক করে, যেখানে মানুষ মানুষের ক্ষতি করেও মানুষের প্রতিবেশী, যেখানে প্রত্যুষের জনশূন্য পথে পাগলা মেহের আলির চিৎকার শোনা যায়, ‘তফাত যাও’, ‘তফাত যাও’…
সময় লাগে এই গল্পের আচ্ছন্নতা থেকে বের হয়ে আসতে।
অঢ়ৎরষ রং ঃযব পৎঁবষবংঃ সড়হঃয টি এস এলিয়টের ডধংঃব খধহফ শুরু হয়েছে এই বাক্যটি দিয়ে। কেন এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস ?
কারণ অনেক, কিন্তু একটি মূল কারণ হলো প্রাচীনকাল থেকেই ইওরোপে শীতকালে বরফঢাকা পৃথিবী যখন জমে যায়, মাটি হয়ে যায় পাথরের মতো শক্ত, তখন কবর খোদা যায় না এবং এ সময়ে যখন মানুষজন মারা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বরফের নিচে ঢেকে রাখা হয়। যখন বসন্ত আসে, বরফ গলতে শুরু করে, এই মৃতদেহেরা বের হয়ে আসে, নতুন অশ্রু, ক্রন্দন ও হাহাকার নিয়ে। মাটি নরম হয় এ সময়ে এবং শুরু হয় সৎকারের কাল। এপ্রিল হলো এই মাস। ‘মেইনের বিষণ্ন দিনগুলি’ গল্পের পরিণতির শুরু হয়েছে এভাবে : ‘এপ্রিল হলো নিষ্ঠুরতম মাস নিষ্প্রাণ ভূমি থেকে লাইলাককে জন্ম দিয়ে, স্মৃতি ও বাসনাকে মিশ্রিত করে, বসন্তের বৃষ্টি দিয়ে মলিন তৃণমূলকে জাগরিত করে।’ এই বইয়ের অন্যতম সুন্দর, বিষণ্ন গল্পের শেষে আমরা দেখি, একটি লাশ বের হয়ে এসেছে বরফের নিচ থেকে। খালি হাতে আসেনি, এসেছে গল্পের রহস্যঘন কাহিনির উন্মোচনের সূত্র ও পরিণতি নিয়ে।
বিদ্যাপ্রকাশ থেকে বের হওয়া বইটি আমাকে ধরে রেখেছে, পাঠের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হইনি। তবে সারা বইটিতে আমার মনে হয়েছে অন্তর্লীন হয়ে আছে একটি বিষণ্নতা, হাহাকার বা ফাটালিজমের সুর। সভ্যতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে ? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আমাদের আত্মাকে খেয়ে ফেলবে ? কী হবে আমাদের পৃথিবীর ? এই ফুল, পাখি, তৃণ, গুল্ম, বুদ্ধ, পাহাড়, প্রকৃতি ও মানুষের ?
‘আমি আবার মহাশূন্যে ফিরে যাচ্ছি’ বলে ত্রিশ। ‘কী বলছিস তুই ? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে ?’
‘নারে’, উত্তর দেয় ত্রিশ, ‘আমি এখন সময়ে ভ্রমণ করা মানুষ, অতীত থেকে ভবিষ্যতে এসে পড়েছি, এই সময়টা আমার নয়। আমি এক অন্য প্রজাতির প্রাণী, পৃথিবী আর আমার জন্য নয়।’
‘পৃথিবী আর আমার জন্য নয়।’―না, না, না। আমি এই পৃথিবীর জন্য কাঁদতে কাঁদতে মরে যাবো, কোথাও যাব না।
লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক