আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

স্বপ্নময় চক্রবর্তী : বোতল দৈত্য

গল্পসংখ্যা ২০২৩

জাল ফেলে মাছ ধরায় বড় আমোদ। জালের তলায় জ্যান্ত মাছগুলোর খলবলানি। আর জলে ফিরে যেতে চায় ওরা। বড় বোকা ওরা। একটু পরেই লাফালাফি বন্ধ হয়ে যায় মাছগুলোর। গাঁয়েও কিছু লোক আছে, এমন খলবল করে। ওদের তো জালের ভিতরে ফেলেই রেখেছে। একশো দিনের কাজ, বেধবা ভাতা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, আবাস যোজনা। বন্ধ করে দেব বললেই খলবলানি বন্ধ।

উকিল হালদার গ্রামপ্রধান। এ নিয়ে তিন দফায় গ্রামপ্রধান। এখন বয়স পঞ্চাশ হলো। পনের-বিশ বছর ধরে পলিটিস করছে। প্রতিবার জিতেছে। প্রথম দিকে দু-দু বারের গ্রামপ্রধান ছিল। প্রধান হয়েছে তো কী ? পুরানো দিন ভোলা যায় ? বাপের সঙ্গে মাছ ধরতে যেত ইছামতীতে। ডিঙ্গি নৌকা ছিল একটা। এখনও আছে, একটা নয়, চারটে। ভাড়ায় খাটে।

গত কদিন ধরে মনটা ভালো নেই। গাড়িটার এসিটা বারবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে, সারাতে হলে নিয়ে যেতে হবে হয় সেই বসিরহাট, সেটা বড় কথা নয়। আতর আলির বড় বাড় বেড়েছে। একটা দল পাকাচ্ছে। দলের মধ্যে দল। সেটাও বড় কথা নয়, যাদের হাতে ধরে গতবার টিকিট সরিয়ে দিয়েছে, সেই দুটো বিট্রে করছে। একা হজম করে নিচ্ছে। প্রধানের ন্যায্য হিস্যাটা দিচ্ছে না। সেটাও বড় কথা নয়, ওর ছোট ভাই ব্যারেস্টারের মেয়েটা লেখাপড়ায় জুয়েল হয়ে গেল। ডাক্তারি পাস দেবে সামনের বার। অথচ ওর বড় ছেলেটার প্রাইমারি ইস্কুলের একটা চাকরি ম্যানেজ হলো, ম্যানেজ মানে খরচপাতি তো কিছু করতেই হইছিল। তাতো করতেই হবে। কিন্তু এক জজসাহেব এমন এক রায় দিয়ে দিল যে ছেলেটার চাকরিটা চলে গেল। আবার গত চার বছর যা মাইনে পত্তর পেয়েছে সব ফেরত দিতে বলেছে। এটা ভাবতে পেরেছিল উকিল, যে এমন হবে! ওর বাপ শখ করে ওর দুই ছেলের নাম রেখেছিল উকিল আর ব্যারেস্টার। ব্যারেস্টার এখনও মাছ ধরে নিজে। মাছ বিক্রিও করে। বাজারে দোকান আছে।

উকিলের জন্যই ব্যারেস্টারের তবু একটা দোকান হয়েছে। ওর মেয়ে ডাক্তার দিদিমনি হবে আর নিজের ছেলে চাকরি হারা। সহ্য হয় প্রাণে ? উকিলের তিন ছেলে। বড়টা সরল সাদা। ওর দ্বারা পলিটিস্ হতো না। তাই ওকেই মাস্টারিটা করে দিয়েছিল। বাকি দুই ছেলের অন্য কিচ্ছু করার দরকার নেই। পলিটিস্টা ঠিকমতো বুদ্ধি খাটিয়ে করলে সঙ্গে আরও অনেক কিছু করা যায়। গাড়ি বিজনেস, জমি-বাড়ির লাইন, কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া, দলিল-পরচা বের করে দেওয়া―এরকম কত কী। উকিল হালদার যেমন টাকিতে ইছামতীর ধারে একটা হোটেল করেছে, নাম দিয়েছে পুবের আলো। একটা ভেড়ি লিজ নিয়েছে। পার্সে-ট্যাংরা সারাবছর হচ্ছে।

আজ ইছামতীর পাড়ে এসেছে খেপলা জাল নিয়ে। সঙ্গে অনুচর―চামচে কাউকে আনেনি। আজ নিজের মতো করে কিছুক্ষণ সময় কাটাবে। গাড়িটা নদীপাড় অবধি যায় না। একটু দূরেই রাখতে হলো। বেশ লাগছে হাঁটতে। কাঁধে জালখানা। যেন কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেবেলাখানা। ফুরফুরে বাতাস, ফিঙেপাখি, মাছরাঙা, একবার ডাক ছাড়তে ইচ্ছে হলো―ওরে কার্তিক, গনশা, আতিক, জল ঝাঁপাবি আয়…। নদীপাড়ে ফুল প্যান্টটা অনেক গুটিয়ে নিল, বাকিটা ভিজুক গে যাক। জাল ছুড়ল। এবার গুটোচ্ছে। পড়েছে মনে হয়। ভারী ভারী লাগছে। জাল উঠাল, কিছু তো খলবলাচ্ছে না। কী তবে ? সে কী ? একটা বোতল। বোতলটা বেশ ভারী। কে জানে ? রঙটা কালো। কী আছে বোতলে ? গুপ্তধন হলে তো কলসিতে থাকে। নাড়িয়ে কোনও ঝুনঝুন আওয়াজ পেল না।

কিন্তু ফাঁপা নয় বোতলটা। ভিতরে ঠাসা কিছু আছে। কী আছে ? বোতলের ছিপিটাও কোনো ধাতুর। বেশ টাইট।

ধুর! মাছধরা পরে হবে। আগে দেখা যাক বোতলের ভিতরে কী আছে।

বেশ টাইট ছিপিটা অনেক কষ্টে খোলা হলো। আর ওমনি বোতলের ভিতর থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল। প্রথমে সাদা ধোঁয়া, তারপর কালো ধোঁয়া, তারপর হলুদ, খয়েরি, নীল, লাল রঙের ধোঁয়া। আর সব ধোঁয়া মিশে মিশে একটা বিরাট মানুষের মতো চেহারা নিল। কিন্তু বিরাট বড়। বড় বড় নীল চোখ, বিরাট মুখ। হাতে বড় বড় নখ।

আরে! এ তো সেই বোতল দৈত্যটা। সর্বনাশ।

ছোটবেলায় বোতল দৈত্যর কথা শুনেছিল। সেই বোতলটা এক জেলের জালেই উঠেছিল। বেরিয়েই বলেছিল তোকে আমি খাব। তোর শেষ ইচ্ছেটা কি আমাকে বল। শেষ ইচ্ছা পূরণ করে দেব। সেই জেলেটার খুব বুদ্ধি ছিল। বলেছিল আমার শেষ ইচ্ছাটা হলো, তুমি কি করে তোমার এত বড় শরীরখানা নিয়ে এই বোতলটার মধ্যে ঢুকে ছিলে সেটা আর একবার দেখাও।

ও আস্ত বলে যেই না আবার ধোঁয়া হয়ে বোতলের ভিতরে ঢুকে গেল, সেই জেলেটা সঙ্গে সঙ্গে বোতলের মুখটা এঁটে দিয়ে আবার জলে ফেলে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

উকিল ভাবল সেটাই করবে। বোতল দৈত্যটা পুরো রূপ ধারণ করে নিয়ে হা হা হা করে হাসল। যেমনটা ওরা করে থাকে আর কি! তারপর নখওয়ালা উকিল হালদারকে নাড়িয়ে বলল :

হে ভদ্দে, যবরহত মা কুরু।

মম নামং বুদবুদেশ^র ভন্তি

তম সাং মুকত করিছ

অহং তং প্রতি বহোত পসন্ন হন্তি

হে ভদ্দে, কহ, কিং পুরস্কারং ইচ্ছন্তি।

কী ভাষায় কথা বলছে ঠিক বুঝতে পারছে না যদিও, তবে মানেটা বুঝতে পারছে। তবে সংস্কিতর মতো। পুরুতদের মন্ত্র ছাড়া সংস্কিত তো তেমন শোনা যায় না।

উকিল হালদার জিজ্ঞাসা করে―আপন সংস্কৃত ভাষা কহন্তি। আমি ভাষা না বুঝন্তি।

দৈত্য বলে,

ন-ন, ইদ ন

সংস্কিত ইদ পৈশাচি পকিতং।

পৈশাচিক প্রাহুত শব্দটা উকিল হালদার শোনেনি কখনও।

ও বলল, ও ইয়েস ওকে ওকে। কিন্তু স্যার অত কথার দরকার নেই। আমি বুঝেছি আপনি কি বলতে চান। আপনি আমার ইচ্ছা পূরণ করতে চাচ্ছেন। তবে বলেই ফেলেন স্যার। আমার ইচ্ছা, বা পুরস্কার যাই বলুন, যেটা হলো আর একবার দেখা এত বড় দেহটা নিয়ে কী করে এই বোতলটার মধ্যে সেটা একবার নিজেই ঢুকে দেখান।

বলার সময় উকিল হালদার মুখাভিনয় করেও ব্যাপারটা বোঝাচ্ছিল। তাতেই বুঝে নিয়ে বুদবুদেশ্বর দৈত্য আবার অট্টহাস্য দিল। নদীপাড়ের বকেরা সব উড়ে পালাল। বলল―

কিং খুক খুন্তিÍÍ! অম এতাবত মুক্ সং?

নং তাবত সুলভং।

উকিল হালদার মাথা নেড়ে বলল―ন বুঝন্তি, বাংলা, বাংলা।

বুদবুদেশ্বর বলল বাংলা! ঘাড় নাড়াল। বুড়ো আঙুলটা ওপরে উঠাল। মানে ওকে চিহ্ন।

বাংলায় বদামি, চিন্তা মাফুরু।

এবার দৈত্য মাথাটা ভন ভন করে ঘুরিয়ে নিল। তারপর বলল বাংলা আগৈজ্জে। গতবার বহু বচ্ছর আগে আঁজ্ঞি এক চট্টগ্রাইম্যা জাইল্যার জালে ধরা পইচ্ছিলাম। হেই জাইল্যা বাংলা ভাষা কইজ্জ্যে। হেই সময় বাংলা শিখন কইজ্জিলাম। এবল শুন। হেই হালার পো জাইল্যা আয়ারে এক্কারে বোকা বানাত দিয়ে। আঁয়ারে কইয়ে আবার বতলত ডুবাতু। আঁজ্ঞি এক্কারে বোকা বনছি। আঁজ্ঞি কইজ্জে আর বতলত ডুইকতাম না।

এটা কি ভাষা ?

কইছি না চট্টগ্রাইম্যা বাংলা।

বুঝহত পারছি না কিছু। আমি বসিরহাটের লোক। বসিরহাটের বাংলা বলো কিংবা কলকাতার বাংলা। দৈত্য বলল, বাব্বুরে কী ফ্যাচাং!

আবার মাথাটা ঘোরাল। তারপর বলল―বোতলে আর ঢুকছি না। খুব শিঙে হই গেছে। আমারে মুক্তি দেছো, তোমার আমি দেবানে। কী চাও ?

কী চাইবে ? ধনরত্ন ? ইডি সিবিআই যা শুরু করেছে, যদি বলে এইসব বোতল দৈত্য দিয়েছে, ইডি মানবে ?

সোনা দানা বিক্রি করাও ঝামেলা। ক্যাশে নিলে কবে কোন নোট বাতিল হয়ে যায় ঠিক নেই। একটা খুব সুন্দর বউ চাইবে ? দুই সতীনে ঝগড়া মেটানো এক বিরাট হ্যাপা!

একটা বুদ্ধি এল মাথায়। গোলক সাধু ওর পোঁদে লেগেছে বড্ড। ওর পার্টিই করে, পাশের গাঁয়ের গ্রামপ্রধান। ও উকিল হালদারের মতো তেতলা বাড়ি বানাতে পারেনি। চারপাশও নেই। উকিলের বাড়বাড়ন্ত দেখে চোখ টাটাচ্ছে। বিডিত্তর কাছে চিঠি লিখেছে। উকিলে, গাঁয়ে দুশোটা সেগুন গাছ ছিল। ওগুলো বেঁচে দিয়েছে। সেটা নিয়ে ও শালা নালিশ করে দিয়েছে। উকিল বলল পাশের গাঁয়ের গোলক সাধুটার ঘাড় মটকে দাও। দৈত্য দেড় হাত লম্বা জিভ বের করে বড় বড় দাঁত দিয়ে কামড়াল। তারপর নিজের কুলোর মতো কান দুটো ধরে বলল―আর এসব কাজ করি ? এসব করতাম বলেই তো আমাকে ধোঁয়া হতে হয়েছিল। সেটা কিরকম ?

সে অনেক কথা। এত কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন। এই নদীটা, এই বক, কড়িং মেঘ, সব কিছু মিলায় কী ভালোই যে লাগতিছে। কতদিন পর এই পিরথিবীটার আলো দেখলাম। এই সোন্দর পিরথিবী ছেড়ে বোতলে যাব না আর। যাবো না, যাবো না আহা, কী দিন কাটায়েছি, জঙ্গলে জঙ্গলে দাপায়েছি। আহা কাঁডাল ফল। কী ঘেরান, কী সোয়াদ, গোটা একছড়া কলা মুখে পুরি নেতাম। তুমি আমাকে মুক্তি দেছো। তাড়াতাড়ি কয়ে দাও কী পুরস্কার তুমি চাও ? তবে কাউরে মারতি পারব না, সেটা কিন্তু কয়ে দিলাম।

উকিল হালদার জানত―এই দৈত্যটাই বোতল থেকে বেরিয়ে সে জেলেটাকে বলেছিল তোকে আমি খাব। জেলেটা বুদ্ধি করে বলেছিল খাবে যদি খাও, তবে তার আগে আমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে দাও। তখনই তো বোতলে ঢুকে যেতে বলেছিল। সে এত সাধু হয়ে গেল কি করে ?

ও কাউকে মারতে যখন পারবেই না একটা কাজ তো করতে পারে। গোলক সাধু ওর গাঁয়ে কতগুলো টিপকল বসিয়েছে। ওগুলোকে উপড়ে দেওয়াতে পারে। সেটাই বলল। দৈত্য বলল টিপকলগুলো তুলি ফালাবা ? মানুষ জল পাবে কোত্থে ? তা তুমি টিপকল গেঁড়ে দিতি না কয়ে উঠোতি কচ্চো কেন ?

উকিল হালদার বলল, পাশের গাঁয়ের প্রধান গোলক আমার পোঁ পোঁ পোঙায় লেগেছে খুব। ওকে টাইট দেবার দরকার। টিপকল… মানে টিবুলগুলো উঠায়ে দিলে পাব্লিক ক্ষেপে যাবে, ও শালা খুব জব্দ হবে।

দৈত্য দু ধারে মাথা নাড়াতে লাগল। ওর মাথা নাড়ানোয় সাঁই সাঁই শব্দ হলো। ও ছি ছি ছি করতে লাগল। মুখ থেকে থুথু ছিটকে যাচ্ছিল। এমন যে বৃষ্টি মনে হচ্ছিল। থুথুর বৃষ্টি। সেই থুথুতে এই গ্রামপ্রধানও ভিজল।

উকিল হালদার ভাবল কী কুক্ষনেই না মাছ ধরার কথা মনে হয়েছিল। মাছ তো পেলোই না, কালো রঙের বোতলটা পেলো, ফেলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত। এই দৈত্যকে দিয়ে কী হবে তবে ?

দৈত্য বলল―পাশের গ্রামের মানুষদের ক্ষতি করতে চাও কেন ?

উকিল বলল, না স্যার, মানুষের ক্ষতি চাই না। শুধু গোলক গোলক সাধুকে একটু টাইট দিতে চাই। আর কিছু না। ওই লোকটা বড় বদ। আচ্ছা। উপকার করতে চান যখন, আমার গাঁয়ের নালাটার ওপর একটা শক্তপোক্ত লোহার বিরিজ বানিয়ে দিন।

দৈত্য বলল―এক্ষুনি এক্ষুনি হয়ে যাবে। কোথায় করতে হবে খালি দেখিয়ে দাও।

বলেই ফ্যাসাদে পড়ল। দু বছরও হয়নি একটা বাঁশ-কাঠ তার দিয়ে লোক চলাচলের মতো একটা পুল বানিয়েছে পঞ্চায়েতের টাকায়। ওটা থাকতে আবার একটা ? স্যাংশন লাগবে। তাছাড়া রাতারাতি ওটা তৈরি হয়ে গেলে ওর কী লাভ ? টেন্ডার নেই, কন্ট্রাক্টার নেই, কন্ট্রাক্টাররা আসবে সব মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে, খাম নিয়ে। তারপর খাম থেকে বের করে নিয়ে আঙুলে জিভে ঠেকিয়ে টাকা গোনা―কী সুখ। রাতারাতি একটা পোক্ত সেতু হয়ে গেলে উকিল হালদারের কী লাভ ?

থাক। দরকার নেই। বরং আগে ভাবুক তো। তারপর দেখা যাবে। ও বলল লতুন বিরিজটা বানানোর আগে পুরোনটা ভেঙে দেন স্যার। খুব একটা ঝড় তুলে দিয়ে…।

দৈত্য বলল―তা কেন! থাকুক না ওটা। আর একটা নয় করে দিচ্ছি। উকিল দেখল কী বিপদ।

বলল―একটা বন্যা করে দিতে পারেন, বেশ জুত করে, আর একটা আয়লা আমফান…

দৈত্য বলল, তোমার কী হলো বলদিনি ? কেবল লোকের ক্ষেতি চাইছো!

উকিল হালদারকে বলল―দেখো, তোমরা আমায় দৈত্য বলো, মুসলমানরা বলে জিন। আমার জিনেটিক চেইঞ্জ হয়ি গিয়েচে। বজলে ?

আমার এখন আর মাংস খাতি ইচ্ছা নাই। যখন আমরা অনেক ভাই ছিলাম। তাদের আর হদিশ নাই। কেউ হয়তো কয়লা-প্যাট্রালে মিশি গেছে, কেউ পেলাস্টিক হয়েচে, কেউ মাটিতে মিশিচে।

আমি তো বোতলবন্দি হয়ে জীবন কাটায়ে দিলাম। এতদিন পরে আমারে মুক্ত করিচো। আর আমিও বোজতে পাচ্চি আমি চেঞ্জ হয়ি গেছি। কী পুরস্কার নেবে বলি ফ্যালো। আমি কিন্তু রেগে যাচ্চি বলে প্রথমেই ওই ধাতুর শক্ত বোতলটা রুপো কিনা কে জানে… ওটা কে দুমড়ে নদীতে ফেলে দিল।

উকিল হালদার এতদিনের রাজনীতি করা লোক। ওর বুদ্ধি এল মাথায়। একটা ছোটখাটো পুরস্কার চেয়ে নিলেই হয়। দৈত্য বলেই বড় পুরস্কার নিতে হবে তার কি মানে আছে। ও বলল আমার বাড়ির উঠানে শ্যাওলা হয়েছে খুব, আর বাগানে আগাছা হয়েছে। ওগুলো সব পরিষ্কার করে দাও।

ব্যস ? আর কিছু না ?

না। আমি অল্পতেই সন্তুষ্ট।

দৈত্য বলল―আচ্ছা। তাই হবে।

দৈত্য আবার ধোঁয়া হয়ে গেল।

বাব্বা! বাঁচা গেল।

উকিল হালদার বাড়ি ফিরল। বাড়িটা চিনতেই পারে না। কোনও আগাছা নেই মাঠে, গাছে গাছে ফুল ফুটে আছে। টগর, করবি, মালতী। ও তো কুঁড়িও দেখেনি এত। এত ফুল! সব ঝকঝক তকতক করছে।

আহা! কী সারভিস! দশজন লেবারের কাজ করে দিয়েছে এক ঘণ্টায়। কিন্তু গাছে গাছে ফুল ? এসব লেবার টেবার কেন! মন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী―প্রধানমন্ত্রীরও সাধ্য ছিল না।

উকিল হালদারের খুব ইচ্ছে হলো এই দৈত্যটাকে পোষে। কত কাজ করিয়ে নেয়া যায়। যাদের একশো দিনের কাজের জব কার্ড আছে, ওদের বলা যেত ঘরে বসে মদ খেয়ে ঘুমো, যা পাবি হাফ হাফ! কম আমদানি ? শুধু তা কেন ? বড় বড় কন্ট্রাক্টারি নিয়ে কাজটা করিয়ে দেওয়া যায়। অফিসারগুলোকে বলে দেওয়া, কি করে কী হচ্ছে, ক’টা লেবার খাটছে, ওসব দেখার দরকার নেই। চোখ বুজে থাকো। কাজ হলে বিল পাস করো, বিশের জায়গায় চল্লিশ পার্সেন্ট কাটমানি।

এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে গেল। গিয়ে দেখে সারা ঘরজুড়ে দৈত্য বুদবুদেশ^র অধিষ্ঠান করছে। দেখেই বুক টিপটিপ। এত বড় একটা দৈত্যকে কি পোষা যায় ?

কোথায় থাকবে ? কী খাবে ? কত খাবে! তাছাড়া লোকে যদি জেনেই যায় এই উকিল হালদার দৈত্যকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিচ্ছে তাতে তো ওর কোনও ফায়দা নেই। তবে একে বিদেয় না করে হাতে রাখা ভালো। কিন্তু দৈত্য কি পোষ মানবে ? দৈত্যটা নিজেকে একটু ছোট করে নিয়েছে। ওর মাথাটা সিলিং এ গিয়ে ঠেকেছে। নদীপাড়ে আরও অনেক বড় ছিল।

উকিল হালদার দৈত্যকে বলল, আমার পুরস্কার তো আপনি দিয়েই দিলেন। আপনার কাজ হয়ে গেছে। এবার কী করবেন স্যার ? দৈত্য বলল―এবার আমি এই পিরথিবীটা ঘুরে ঘুরে দেখব। বাংলার মাটি বাংলার জল। দেখিব বাতাবি লেবুর ফুল। দেখিব সুপারির সারি বেয়ে সন্ধ্যা নামা। দেখিব ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু। দেখিব কাঁঠাল পাতা, মুথা ঘাস, ফুলে ভরা ফাল্গুন মাস! নক্ষত্রের রাত দেখিব আবার।

কী যে হচ্ছে কিছুই তো বুঝতে পারছে না উকিল হায়দার।

কী সব হেঁয়ালি হেঁয়ালি খামখেয়ালি কথা বলছে। দৈত্য কখনও এমন কথা বলে নাকি ? ও কি জানে ওর এই বিশাল বপু নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে কী কেলেঙ্কারি হবে ? ডি.এম. সাহেবকে জানাতে হবে। দমকল চলে আসবে। পুলিশ চলে আসবে। কে জানে মিলিটারি চলে আসতে পারে। সাংবাদিক ব্যাটারা চলে আসবে। গ্রামে বেশ করে কম্মে খাচ্ছিল, সাংবাদিকগুলো চলে এলে―ওরা খুঁটে খুঁটে ওদের খাবে। কী করে বাড়ি হলো, গাড়ি হলো, গাছগুলো কোথায় গেল, কটা পুকুর কাটা হলো―সব ফ্যাকড়া বের করবে।

উকিল হালদার বলল, দৈত্যবাবু স্যার, আপনি যখন বাইরে ঘুরে বেড়াতেন তখন হয়তো সত্যযুগ ছিল। তখন স্যার সব আলাদা ব্যাপার। তখন মিলিটারি ছিল না, কাঁদানে গ্যাস ছিল না, এখন আপনাকে দেখলেই কলিযুগের মানুষ আপনাকে জ্বালাতন করবে, জলকামান ছুড়বে, কাঁদানে গ্যাস, গুলি… কী করবে কিচ্ছু বলা যায় না। আপনি কয়েছিলেন কারওর ক্ষেতি চলে না, কারওর অসুবিধা চলে না। আপনার দিকি কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, গুলি এসব ছুড়লে আপনার কিচ্ছুটি হবে না, কিন্তু আমাদের সবার খুব অসুবিধে হবানে। তাই বলি, আপনি আবার ধোঁয়া রূপ নিয়ে ন্যান।

দৈত্য হেঁকে উঠল না-না-না। সে হবে না। আবার বন্দি করার ফন্দি ? উকিল হালদার দেখল ওর বাচ্চা পাঁঠাটা উঠানে লাফাচ্ছে। উকিল হালদার বলল―স্যার, একটা ভালো বুদ্ধি খেলল মাথায়। আপনি এক কাজ করুন। ধোঁয়া হয়ে ওই পাঁঠাটার নাক-মুখের ভিতর দিয়ে ওর পেটে সেঁধিয়ে যান। ওর চোখ দিয়ে পিরথিবীর সব কিছু দেকতি পাবেন। আমার পাঁঠাটা ক্যাঁটাল পাতা খাতি খুব ভালোবাসে। অনেক ক্যাঁটাল পাতা দেকতি পাবেন, ঘাস দেকতি পাবেন, ঝা-ঝা―কয়েছিলেন সব দেকতি পাবেন, খাতি পাবেন। আবার ইচ্ছে হলিই আবার নাক, মুখ, পোঁদ যিখান দে ইচ্ছে বেরোয়ি আসতি পারবেন। দৈত্য একটু চুপ করল। বোধ হয় ভাবল। তারপর বলল, সেটা মন্দ বলোনি। তবে তাই করি। ওংস্বাস্তা, বলেই ধোঁয়া হয়ে গেল, এবং সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী নিচে নেমে ওই কালো পাঁঠাটার সব জায়গা দিয়েই ঢুকে গেল, আর পাঁঠাটার লম্ফঝম্প তুমুল বেড়ে গেল। পাঁঠাটা কারওর তোয়াক্কা করে না, যখন খুশি, যেখানে খুশি বেরিয়ে যায়। নদীতে সাঁতার কাটে, মাঝে-মাঝে নদীর ধারে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।

এদিকে উকিল বাবুর পার্টির লোকেরা বলে―পাঁঠাটা তো বেশ গায়-গতরে হয়েছে। একদিন ফিস্টি লাগাও।

উকিল হালদার বলে―এমন কথা কেউ মুখেও এনো না। ওটা আমার পেয়ারের ধন। ওকে আমি সারাজীবন কাছে রাখব।

বন্ধুরা বলে বুঝেছি। এঁটা তোমার প্রিয় পাঁঠা।

উকিল বাবু বলে―পয়া টয়া বুঝি না। স্বপ্নে দেখেছি আমার স্বর্গীয় গুরুদেব বলছেন তোর পাঁঠাটার মধ্যেই আমি আছি। পাঁঠা হত্যা মানে গুরু হত্যা।

আসলে উকিল হালদারের মনে ভয় ছিল পাঁঠাটা কাটলেই দৈত্যটা ধোঁয়া হয়ে বেরিয়ে পড়বে।

আরও কিছুদিন কেটে গেল। পাড়ায় ভোট এসে গেল।

এবার হাওয়া বেশ খারাপ। বড় বড় সব নেতা-নেত্রীরা যা খুশি তাই করেছে। কোর্টের জজরা পর্যন্ত যা-তা বলছে। কত নেতা মন্ত্রী জেল-হাজতে। কিন্তু বক্তৃতা তো দিতে হবে। এটা করে দেব সেটা করে দেব বলতে হবে। কিন্তু এবার আর বলা যাবে না। নতুন কায়দা নিতে হবে। মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে প্রচারে যাবে। তার আগে একটা গল্প চাউর করে দিতে হয়―রাত্তিরে বিরোধী দলের গুণ্ডারা খুন করতে এসেছিল, দু-একটা লাঠির বাড়ি পড়েছে মাথায়, বুদ্ধিবলে বেঁচে গেছে। পায়েও প্লাস্টার করানো যায়। কিন্তু এতে কি কাজ হবে ?

ওর দলের একজন শিক্ষক নেতা ছিল, সে আবার গল্পের বইটইও একটু পড়ে টড়ে। ও বলল―কী যেন মিশ্র―ভগীরথ বোধ হয়―একটা গপ্পো লিখেছিল একটা নির্বাচনী বক্তৃতার কথা ছিল―সেটা করতে পারেন এবার। খুব ভালো। লোকে খেয়ে নেবে। খুব সৎভাবে বলবেন এবার আমি তৃতীয়বারের জন্য লড়ছি। সত্যিকথা বলছি―প্রথমবার স্বীকার করছি। জিতে আমি, নিজের জন্য করেছি। নিজেরটা গুছিয়ে নিয়েছি। দ্বিতীয়বার জিতে আমার আত্মীয়স¦জন, বন্ধু-বান্ধব, আমার দলের লোকজনের জন্য করেছি। এবার তৃতীয়বার জিতলেই আপনাদের জন্য করব। দলের লোক দেখব না। যাকে বলে জনগণের কাজ সেটাই করব। যদি বিরোধী দলের কাউকে জেতান, সে প্রথমবারে কেবল নিজের জন্যই তো করবে…। সুতরাং গ্রামের উন্নতি চাইলে আমাকেই জেতান। আপনাদের এতেই ভালো হবে। প্রথমবারের জন্য কাউকে জেতাবেন না…।

গাঁয়ের মিটিং-এ এই কথাগুলিই বলছিল উকিল হালদার।

অমনি কোত্থেকে ওই পাঁঠাটা ছুটে এসে মাথায় ঢুঁ মেরে মাইকটা ফেলে দিল। লম্ফ-ঝম্ফ করে তারগুলো জট পাকিয়ে দিল। একে তাকে গুঁতাতে লাগল। গেল মিটিং ভেস্তে।

দু দিন পরে বেশ শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হলো। তারপর মিটিং। দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে ঠিক একই কাণ্ড করল পাঁঠা। এর কদিন পরে কটা বোম বাঁধবে বলে মশলা সাজিয়ে রেখে ছিল ওর দলের লোক। পাঁঠাটা গিয়ে মশলাগুলোর উপরে হিসি করে দিল, মশলা গেল ভিজে। তারপর বোম বাঁধার দড়িগুলোকে চিবিয়ে ছিবড়ে করে দিল।

দলের লোকেরা বলল―তোমার পাঁঠাটা তো বড্ড উপদ্রব করছে। কিছু একটা বিহিত কর।

গভীর চিন্তায় বসল উকিল হালদার। বলা যায় ধ্যানে বসল।

কিছু একটা উপায় চাই। বলল ধ্যানে গুরুদেবকে ডাকছেন।

তিন ঘণ্টা পর ধ্যান ভঙ্গ হলো।

চেলা চামুন্ডাদের বললেন গুরুদেব উপায় বলেছেন। একটা আড়াই হাত লম্বা এক হাত চওড়া আর দুই হাত গভীর গর্ত করা। রাজমিস্ত্রিদের বলল, তিন হাত লম্বা, দুই হাত চওড়া আর বিঘৎ খানেক উঁচু একটা কংক্রিটের চাঙড় তৈরি করো, আর কিছু সিমেন্ট বালি মেখে রাখো।

চেলাচামুণ্ডাদের বলল বেশ কিছু কাঁঠাল পাতা কেটে গর্তে ফেলে দাও। চাঙড়টা জমে গেলে গর্তের মুখে খাড়া করে রাখো।

সব প্রস্তুত হয়ে গেলে উকিল হালদার বললেন পাঁঠারূপী গুরুদেব সমাধি চেয়েছেন। গর্তের কাঁঠালপাতা খাবার জন্য যেই না গুরুদেব গর্তের মধ্যে নামলেন, সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন মিলে চাঙড়টাকে ফেলে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিল এবং মেখে রাখা সিমেন্ট বালি দিয়ে জয় বাংলা এবং হরিবোল ধ্বনিসহ চারদিক ভালো করে এঁটে দিল। তক্ষুনি চারদিক ইট দিয়ে ঘিরে একটা বেদি তৈরি করে দেওয়া হলো।

উকিল হালদারের বুক অনেকক্ষণ ধরেই প্রবল ঢিপঢিপ করেছে। এই বুঝি বেদি ফুঁড়ে ধোঁয়া… ধোঁয়া থেকে দৈত্য…

কিন্তু না। কী আশ্চর্য। কাঁচা সিমেন্ট শুকিয়ে গেল। ধোঁয়া বের হলো না।

উকিল হালদার মনে মনে ভাবল মানুষের বুদ্ধির সঙ্গে দৈত্য পেরে উঠবে কেন, সেই মানুষ যদি বিশ বছর ধরে রাজনীতি করে। দু-দু বারের গ্রামপ্রধান হয়। ধোঁয়া দৈত্য মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে ঠিকই, কিন্তু বুক ধুকধুকানিটা কিছুতেই কমছে না। ডাক্তার বদ্যি দেখানো হয়েছে। ধুকধুকি বাড়ছে কেবল।

কে জানে কখন মাটি ফুঁড়ে বেদি ভেঙে দৈত্যটা বেরিয়ে পড়বে…। বেরুতেও তো পারে।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button