আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

নলিনী বেরা : দুই রাত্রি

গল্পসংখ্যা ২০২৩

আমাদের গ্রামের ভিতর দিয়েই আরও দক্ষিণে ওড়িশা মুলুকে যাওয়া যায়।

কার্তিক-অঘ্রানে যখন কার্তিকছোলা রাঙাশাল জামাইনাড়ু কালোজিরে, এমন কী জলকলস ধানও উঠে গিয়ে তামাম মাঠ-বিল-জমিন ন্যাড়া, ফাঁকা ফৈ-ফিক্কির হয়ে ওঠে, রাত না পোহাতেই ফাঁকা ধান নাড়ার ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমে আর সে শিশিরে সূর্যের আলো পড়ে যখন মাঠময় নাকছাবির মতো ঝিলিক দেয়, যখন চাষাভুষো মানুষ হাল-লাঙল মাচায় তুলে রেখে হাত পা ঝেড়ে ঘরের দাওয়ায় কী হরিবাসরে বসে মনে মনে ভাবতে শুরু করে দেয়―যাক কাজকাম তো সারা হলো, এবার একটু আয়েশ করা যাক―ঠিক তখনই কীর্তনীয়ার দল, বালকসঙ্গীতের দল, কী ছোটখাটো সার্কাস পার্টি  আমাদের গ্রামের  ভিতর দিয়ে পাস করে। তারা আরও দূর দক্ষিণে যায়। এক কি দেড় মাসের মাথায় যখন ডিগি-তবলা- হারমোনিয়াম-ফুলেট বাঁশি কাপড়ে মোড়া মৃদঙ্গ কাঁধে তিলক আঁকা কপাল চন্দনচর্চিত গল-কপোল নিয়ে গাওনা সেরে হেলতে দুলতে ফিরে আসে, বাড়ি যাওয়ার তেমন তরা করে না―তখন আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েৎ কী সরকার তাদের ধরে বসে―আমাদের গেরামের ভিতর দিয়েই তো  যাওয়া-আসা হয় অধিকারী মোশাই, মোশাইয়ের নিকট সবিনয় নিবেদং মিদং―হোক, ভাঙা ছাঁদে একটা নাইট হয়ে যাক! দিতে থুতে কিছু পারব না মোশাই, খালি দু-বেলা পেটপুরে খাওয়া―

কাঁধের মৃদঙ্গ হারমোনিয়াম সাজবাক্স নামিয়ে রেখে কীর্তন কি যাত্রাপার্টির দল পায়ের ওপর পা দিয়ে আয়েশ করে বসে যায়। কোমরে বাঁধা এক্সট্রা গামছা খুলে বিঁচে বিঁচে হাওয়া খায়, যারা রাজা কী সেনাপতি সাজে, রাম কী কৃষ্ণ সাজে তারা সিগারেট খায়, রাধা-বিন্দে-দূতীর দল বাসিচুল খুলে ফের বাঁধতে বসে, রুপোর চুলচিপুনী কাঁটা আর বাসতেলের মহকে জায়গাটা ম ম করে, বাসসাবানের মোড়ক হাওয়ায় উড়ে যাবার মতো দু-চাট্টা গানের কলিও উড়ে আসে―

‘সাজায়ে রেখ গো, ভালো করে কুঞ্জ তোমার সাজায়ে রেখ গো―’

আমরা ছেলেছোকরারা সেই গানের কলি আওড়াতে আওড়াতে রাধা কী বিন্দে-দূতীর নেলপালিশ রাঙানো লম্বা লম্বা নখের কারুকাজ দেখে বিভোর হয়ে গ্রামের ঘরপ্রতি চাঁদা তুলতে বেরিয়ে পড়ি। কারও গাছের এককাঁদি কলা,  ক্ষেতের বেগুন, মুগ-মুসুরের ডাল, খেপলা কী চারগোড়িয়া জাল ফেলে কারও পুকুরের মাছ, গোলআলু,  তেজপাতা, এক মণ কী আধ মণ চাল মুহূর্তেই জোগাড় হয়ে যায়। মাটি খুঁড়ে উনুন বানিয়ে রান্না চড়িয়ে দেয় কীর্তন পার্টির রঁসুইঠাকুর।

হ্যাজাকগুলোয় ফ্রি-তে তেল ভরে দেয় হীরালাল মুদি। পরিবর্তে সে আব্দার করে―তার ঘরের বউ-ঝি-ঝিউড়িদের বসতে দিতে হবে আসরের একেবারে সামনের দিকে। হ্যাজাকগুলোয় ম্যান্থেল না থাকে যদি তো তখন দৌড়োও নদী-সেপারে রোহিণী বাজারে তিমির বারিকের ‘রকমারি শপ’-এ।

সেবার ওড়িশার বারিপদায় গাওনা সেরে ফিরছিল গিরিবালার দল। গিরিবালা বালকসঙ্গীত, ঢপযাত্রা গাওনা করে। গিরিবালার নিজের বাড়ি আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামে হলেও গোটা দলটার নিবাস আমাদের গ্রাম থেকে পঁচিশ-তিরিশ মাইল দূরে খাকুড়দা না অমরদায়―

সে যা হোক, বারিপদা ফেরত গিরিবালার দলটিকে আটকে দিল আমাদের গ্রামের আমুদে মাতব্বররা।

বলল―তাও কী হয় অধিকারী মোশাই ? গিরিবালা আমাদের গ্রামের মেয়ে, এখানেই ছোট থেকে বড় হলো, তা বাদে আপনার কৃপায় গান শিখে আজ দলের ও দেশের মন হরণ করল―সেই গিরি আজ আমাদের গ্রামের ভিতর দিয়ে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে আর আমরা তার আপনার জন হয়েও দু ছাঁদ শুনতে পাব না, বলেন কী ? অকাট্য যুক্তি, বলার কিছু ছিল না অধিকারী মোশাইয়ের। অগত্যা বোঁচকা বুঁচকি নামাতে বলে নিজে ছুটলেন নদীর ধারে, আখশালে কাঁচা লঙ্কা লেবুর রস সহযোগে আখের রস সেবন করতে। লাটকে লাট আখের ক্ষেত শেষ, জ্বাল দিয়ে গুড় বানিয়ে এতদিনে চালান হয়ে গেল কলকাতার বড়বাজারে, যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাই মাড়াই করতে এখনও আখশাল চলছে।

অধিকারীর দেখাদেখি গিরিবালাও যেতে চেয়েছিল আখশালে, তাকে থামিয়ে দিলেন অধিকারী―আসিস নে গিরি, কাঁচা পানা খেলে তোর গলা যদি ধরে যায়!

কাঁচা পানা অর্থাৎ কাঁচা আখের রস। গিরিবালা এমনিতেই গলায় মাফলার জড়িয়ে বসেছিল। অধিকারীর নিষেধে আরও বিমর্ষ হয়ে গলা থেকে মাফলার খুলে আরও ভালোভাবে জড়িয়ে নিল। তাই তো, সে-ই তো মূল গায়েন ―তার গলা ধরে গেলে চলে ?

গিরিবালা গুন গুন করে গাইতে লাগল―

‘আমি জ্বলে মল্লেম গো, ওগো ওগো প্রাণসখি, আমি জ্বলে মল্লেম গো’

আমরাও সে গান বিড়বিড় করে গাইতে গাইতে চাল-ডাল, তেল-নুন, তরি-তরকারির সংগ্রহে বেরিয়ে পড়লাম।

হ্যাজাকগুলোয় বিনি-মাগনার তেল ভরে দিল হীরালাল। এ-গ্রাম সে-গ্রাম ঢুঁড়ে দর্শকদের বসবার জন্য বড় বড় ধুলামলিন শতরঞ্জি বয়ে আনলাম ঘাড়ে করে। আমাদের পরিশ্রম দেখে কীর্তনদলের রঁসুইঠাকুর আদা-তেজপাতা দিয়ে তৈরি চা খাওয়াল। বলল―

খুব খাটছো বাবাসকল, চা খাও। আর, গলা যদি ঠিক থাকে তবে গিরি তোমাদের ওবেলা ভিজিয়ে দেবে।

আমি, সুনীল আর নির্মল-তিনজনে খুব কাছ থেকে গিরিবালাকে দেখলাম। দুধে-আলতা গায়ের রঙ,পানপাতার মতো মুখ, দু ভুরুর মাঝখান থেকে নাকের ডগা পর্যন্ত রসকলি আঁকা, গলায় কণ্ঠীমালা―গিরিবালা রাধা সাজে! আমাদের পাশের গ্রামের মেয়ে হলেও বয়সে কিঞ্চিৎ বড় বলে আর প্রায় সময় যাযাবরের মতো অধিকারীর  দলে কাঁহা কাঁহা মুলুক গাওনা করে বেড়ায় বলে গিরির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। আমরা কে কার ছেলে, কে কার ভাই―তাও তার জানা ছিল না।

ফলে সে আমাদের উপস্থিতিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বিন্দেদূতী সাজা কালো মেয়েটিকে কাছে ডেকে বলল―

পায়ে আমার ব্যথা, পা টিপে দে তো সুরো!

বলেই পা ছড়িয়ে বসে হাঁটুর উপর কাপড় টেনে দিল গিরিবালা। রাধার পা টিপতে বসল বিন্দেদূতী। আমরা  দলটার ভিতর হিরোইনের দাপট দেখে স্তম্ভিত হলাম। বলতে কী, রাগই হয়েছিল আমাদের―গিরির গান আগে কখনও শুনিনি, না হয় গান একটু ভালোই গায় গিরিবালা, তা বলে এতদূর―

আট ঘটিকায় ‘শ্রীরাধার মানভঞ্জন’। আমাদের হরিমন্দির প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য। আমাদের গ্রামের লোকজন তো এলই-পাশের গ্রাম তস্য পাশের গ্রাম উজাড় করে লোক এল গিরিবালার মানভঞ্জন দেখতে। সঙ্গে নিয়ে এল খেজুরপাতার চাটাই। আমাদের বিছানো শতরঞ্জির উপর জায়গা না পায় যদি তো নিজেদের আনা চাটাই পেতেই বসবে। ঘরপ্রতি একেকটা হেরিকেন। এখন না হয় হ্যাজাকের আলোয় হরিমণ্ডপ দিনের মতোই আলোময়, কিন্তু যাত্রা শেষে অন্ধকার আলরাস্তায় হেরিকেন ছাড়া হাঁটবে কী করে তন্দ্রালস বউড়ি-ঝিউড়িরা ? হ্যাজাকের ঘন আলোয় নিষ্প্রয়োজন হেরিকেন এখন মিচকে রাখলেই হয়!

লোকে লোকারণ্য! কচিকাঁচা, আবালবৃদ্ধবণিতার কোলাহল, কোলের শিশু ভ্যা করে কেঁদে উঠলে মা তার পিঠে থাপা দিয়ে বলছে―চুপ কর বাবা চুপ কর। এখনই আমাদের গিরি কিষ্টোলীলা শোনাবে।

কিষ্টোলীলার মাহাত্ম্য ওইটুকু ছেলে বুঝবে কেন, অবুঝ আড়বুঝ শিশু হয়তো বলে বসল―গিরি কে মা ?

এক মুহূর্তও দেরি না করে মাদল উত্তর দিলু গিরি―গিরিবালা আমাদের মেয়ে, তোর দিদি রে!

এতদ অঞ্চলের বড় আপনার জন গিরিবালার মানভঞ্জন বালকসঙ্গীত বা ঢপযাত্রা শুরু হলো। আমি, সুনীল আর নির্মল―এতক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে লোকজন কে কোথায় বসবে সামাল দিচ্ছিলাম। ঘণ্টা পিটিয়ে কনসার্ট শুরু হতেই আমরাও জায়গা খুঁজে বসে পড়লাম।

প্রথম প্রথম আমরা তিন বন্ধুতে এর-ওর গায়ে চিমটি কেটে ললিতা-চন্দ্রা-বিশাখার খুঁত ধরছিলাম। চন্দ্রার চোখদুটো ট্যারা নয় সুনীল ? ললিতাটা কাঠের সখী। যশোদা কি হিজড়ে নির্মল ? কিন্তু আসরে যখন, যতবারই প্রবেশ ঘটছিল রাধিকা আর বিন্দেদূতীর―আমরা বিমোহিত হয়ে গান শুনছিলাম। দর্শকরা পুনঃ পুনঃ হাততালি মেরে এনকোর দিচ্ছিল―এনকোর! এনকোর!! এনকোর―তার মানে দৃশ্যটা আবার হোক!

‘বৃন্দা ॥ বলি ও বিনোদিনী, তুই বুঝি আর কালো রূপ হেরবি না ?―

(গীত) তমাল কালো কোকিল কালো, কালো মাথার বেণী

কালো যে যমুনার জল, কালো চোখের মণি―

এসব যে তোর দেহে বিরাজ করছে, এসব নিয়ে

তুই তবে কী করবি ?

রাধা ॥ বিন্দে গো, আমি কালো দেখব না, কালো

জলেও যাব না।

বৃন্দা ॥ আর কোকিল, তমাল―কী করবি ?

রাধা ॥ তমাল গাছকে শ্বেতচন্দন লেপে সাদা করব,

কুঞ্জ হতে কোকিলকে তাড়ায়ে দিব, মাথার চুল মুড়ায়ে ফেলব।

বৃন্দা ॥ চক্ষের মণি কী করবি ?

রাধা ॥ (গীত) উঠায়ে ফেলব, চক্ষের মণি উঠায়ে ফেলব।

বৃন্দা ॥ তবে যে তুই কানা হবি ?

রাধা ॥ আমার কানা-ই ভালো―

বৃন্দা ॥ আমিও তো বলি―কানাই ভালো, তোর

কানাই ভালো। (গীত) বেশ তো হলো।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button