আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

অমর মিত্র : অনিকেত নিকেতন

গল্পসংখ্যা ২০২৩

আলোক ফোন করল, তোর কাছে আমি একটু যাব।

আয়, এলে আড্ডা হবে, অনেক দিন আমাদের দেখা হয়নি। সুবীর বলল।

আলোক বলল, আজ সময় হবে ?

না, আগামীকাল কিংবা পরশু।

আর কোনও কথা হলো না। আলোক আসবে। সুবীর বলল সুজাতাকে। সুজাতা জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ যে আলোকদা, সেই আবাসনেই থাকে তো ?

হ্যাঁ, ওখান থেকেই ফোন করেছিল। সুবীর বলল।

তারা দুই বন্ধু। কলেজ থেকে বন্ধুতা। আলোকের কথা আছে। কথা বলতে কি বাড়ি অবধি আসতে হয় এখন ? নাহ, সুবীরের কিছুই মনে হলো না। আলোকের সঙ্গে অনেক দিন কথা হয় না, দেখাও না। সুবীরের মেয়ে বিদেশে, পুত্র অন্য শহরে। আলোকের একটা কাজ সুবীর করে দিয়েছিল। তার কাছে নিজের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে কলকাতার পুরোনো পাড়ায় ফিরে এসেছিল। ফিরে আসার পর আর যায়নি ওখানে। সেই যে অনিকেত নিকেতন, তার নিজের হাতে গড়া কুড়িজনের সমবায়। আলোক আসবে সেই অনিকেত নিকেতন থেকেই। কেন ?  

সুজাতা বলল, তোমাকে অনিকেত নিকেতনে নিয়ে যাবে, তাই।

সুবীর জিজ্ঞেস করল, কী করে বুঝলে ?

মনে হচ্ছে, এইটা ২০২৩ সাল। ১৯৯৯ সালে বাড়িটার ভূমি পুজো হয়েছিল, পঁচিশ বছর হচ্ছে, তা মনে আছে কি ?

সুবীর মাথা নাড়ে, মনে রাখার কোনও কারণ নেই।

কিন্তু মেম্বাররা মনে রেখেছে, আমিও ভুলিনি, ফ্ল্যাট ছেড়ে আসতে আমাদের খুব কষ্ট হয়েছিল।

সুবীর বিড়বিড় করল, চন্দ্রশেখর যেন না আসে।

চন্দ্রশেখর কুণ্ডু ক্যালিফোর্নিয়াতে ছিল। শহরের নাম সান্তা মারিয়া। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। এই তো সাত-আট বছরের আগের কথা। চমৎকার সব ছবি পোস্ট করত ফেসবুকে। এক সন্তান এবং স্বামী-স্ত্রী। তাদের চমৎকার বাড়ি। বাড়ির সামনে দুজনের দুটি গাড়ি। কলকাতায় একবার এল সকলে। তাদের অনিকেত নিকেতন দেখল। চমৎকার বাসস্থান। কতটা জায়গা। পনেরো কাঠা। চারটি টাওয়ার। লিফট, পার্কিং লট। চন্দ্রশেখর ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে বলল, সুবীরদা, আমি কি একটা পাব ?

সকলে মিলে করেছে তো, ফাঁকা নেই, কুড়িজনের সমবায়।

দেখুন না, খুব পছন্দ হয়েছে, কেউ কি সেল করবে না তার শেয়ার ?

নতুন সমবায়, কেন করবে ? সুবীর মাথা নেড়েছিল। কুড়ি ফ্ল্যাটের কুড়ি পরিবার নেই। আসছে একে একে। বাকি সব তালা-চাবি বন্ধ। সুবীর প্রথম ব্যক্তি, যে ওখানে গিয়েছিল। তারপর একজন-দুজন করে। ভরে উঠতে লাগল সমবায়। চারদিকে খোলামেলা, যেমন বাতাস, তেমনি রোদ। মেঘ উঠলে যে কী সুন্দর লাগত সব। প্রথম প্রথম অসুবিধে হতো। বাজার অনেক দূরে। তারপর কাছে এসে গেল। দোকানপাট গড়ে  উঠতে লাগল। সুবীরকে চন্দ্রশেখর আবার বলল, এত মনোরম পরিবেশ কলকাতার এত কাছে আমি দেখিনি, আমাকে এখন দেশে আসতে হবে  অনেকবার, আপনাদের সঙ্গে থাকব।

সুবীর বলল, এদিকে অনেক হাউজিং হচ্ছে, একটা বুক করে ফেলো।

নাহ, এইটা পছন্দ হয়েছে, হাউজিংটাকে আমি আধুনিক করে তুলব, ভালো লাগবে আপনাদের।

সুবীরের খুব পছন্দের মানুষ ছিল চন্দ্রশেখর। আবার কিছুদিন বাদে, বছরের শেষে, হঠাৎ এক সকালে গাড়ি নিয়ে হাজির। বলল, সুবীরদা, আপাতত কলকাতা-দিল্লি করতে হবে, আমি ইউ এস থেকে চলে এসেছি।

ফ্যামিলি সমেত ? 

দীর্ঘকায়, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী চন্দ্রশেখর মাথা নাড়ল, না, ওরা ও দেশে এখন থাকবে।

তুমি একা চলে এলে ? সুবীর অবাক।

আসতে হলো, এখানে কোনও ফ্ল্যাট হবে ?

সুবীর বলল, কী করে হবে ?

আমি হোটেলে রয়েছি, ভাড়ার ফ্ল্যাট হবে না, আমি এখানে থাকতে চাই।

চন্দ্রশেখর ভালো মাসিক ভাড়ায় তাদেরই টাওয়ারের চতুর্থ তলায় এসে উঠল। একা। সান্তা মারিয়াতে তার পরিবার। এসেই একটা পার্টি দিল। এলাহি খরচ করল। যারা পান করেন, তাঁদের জন্য সে ব্যবস্থাও ছিল। সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কি খাইয়ে সকলকে মোহিত করে দিয়েছিল। সুবীর  বলেছিল, ওদের অতদূরে রেখে এসেছো, নিয়ে এসো।

না সুবীরদা, ওরা আসবে না।

তুমিও থাকতে পারতে, ফিরে এলে কেন ?

কোম্পানি ভারতে পাঠিয়ে দিল, আমার আর বিদেশ ভালো লাগছিল না, ওরা ভালো আছে খবর পাচ্ছি।

সুবীর অবাকই হয়েছিল। খবর পাচ্ছে মানে, কে খবর দিচ্ছে ? সে কি যোগাযোগ রাখে না ? কিন্তু এসব একান্ত ব্যক্তিগত কথা। এসব কথা  জিজ্ঞেস করা যায় না। চন্দ্রশেখর আর কিছুদিন বাদে এক ব্যক্তিকে নিয়ে এল। সমরাদিত্য ঝাঁ। বহুদিন ধরে বাঙলায় থেকে বাঙালি হয়েই  গেছেন। বাড়ি কিষেণগঞ্জের ধারে বাঙলার অংশে। নামতে হয় কিষেণগঞ্জেই। সমরাদিত্য একজন ব্যবসায়ী। কিসের ব্যবসা না আইটির। তার নিজস্ব ফার্ম আছে। সমরাদিত্য চায় এখানে থাকতে। সে থাকে কলকাতার দূর দক্ষিণে। এখানে থাকলে তার ব্যবসার সুবিধে হয়। ফার্ম এখান থেকে খুব কাছে, টাটার হাসপাতাল পেরিয়েই। সুবীর ছিল সমবায়ের সেক্রেটারি। কিন্তু সে কী করবে ? সুবীরকে চন্দ্রশেখর বলল, আপনাকে বলা  রইল, সমর ভাড়ায় নেবে, কেউ দেবে ?

এল সমরাদিত্য। একা। তার পরিবার কিষেণগঞ্জ আর কলকাতা করে। কলকাতা মানে জোকা। এখানে আসে না। কিষেণগঞ্জ প্রাইভেট  মেডিকেল কলেজে সমরাদিত্যর মেয়ে পড়ে। সমরাদিত্য খুব মিশুকে। রবিবার ঘরে ঘরে গিয়ে আলাপ করল। যে ফ্ল্যাটেই যায়, দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে। দাদা কেমন আছেন, আমি সমরাদিত্য, সেকেন্ড  টাওয়ারের তিন নম্বরে এসেছি।

সমরাদিত্যর হাতভর্তি আঙটি। সেও বেশ  লম্বা। বলতে লাগল, দোলের দিনে বিকেলে আমি একটু পুজোপাঠ করব, আপনার আসা চাই।

কিসের পুজোপাঠ ?

নতুন ঘরে ঢুকলাম যে।

সে তো ভাড়ায়, তার জন্য আবার পুজো কিসের ? এক সদস্য হেমন্ত জানা জিজ্ঞেস করেছিল।

আমার বসবাসের ফ্ল্যাট তো, আমি থাকব, ঘুমোব, আমাকে সব ঠিক করে নিতে হবে তো, দোষ লাগলে দোষ ক্ষালন করতে হবে তো।

গৃহপ্রবেশ হয় নতুন বাড়িতে, এখানে কেন হবে, আপনি তো নতুন বাড়িতে আসেননি, অন্যের ফ্ল্যাট। বলেছিল সুবীর।

তখন চন্দ্রশেখর বলেছিল, উনি  খুব ধার্মিক মানুষ, তাই।

ফ্ল্যাটের মালিক, তাদের সমবায়ের সদস্য অখিল সাহাকে ফোন করেছিল সুবীর। অখিল বললেন, উনি যদি পুজো-পাঠ করেন, কী বলার আছে ?

গৃহপ্রবেশ ? সুবীর জিজ্ঞেস করেছিল।

অখিলের স্ত্রী অন্নপূর্ণা বললেন, বাড়িতে পুজো-পাঠ, ভালোই তো।

ভাড়াটে কি গৃহপ্রবেশ করে ?

অন্নপূর্ণা বললেন, করলে ক্ষতি কী, অনেকের অনেক রকম সংস্কার থাকে, বাস করতে এসেছে তো।

সুবীর চুপ করে গেলেন। অখিল যখন বলছেন, অসুবিধে কী, সত্যিই তো, এটি ভাড়াটে আর মালিকের ব্যাপার। ঘটা করে পুজো হলো। সকলের জন্য আহারের ব্যবস্থা করা হলো। পুজোর পর পান এবং আহারের ব্যবস্থাও ছিল। কেউ কেউ গিয়েছিল। সকলে নয়। এমনিতে চার টাওয়ারের এই সমবায় আবাসন নিঝুমই। ফ্ল্যাটবাসী মানুষ কোলাহলমুক্ত পরিবেশই পছন্দ করে, অথবা ফ্ল্যাট মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। নিঝুম দ্বীপের মতো পড়ে থাকে একটির পর একটি আবাসন। এই নতুন গড়ে উঠতে থাকা শহর এমনিতে নিঝুম নগর। সুবীর সেই নাম দিয়েছিল।  জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যেত, গাড়ি বেরোচ্ছে, গাড়ি ঢুকছে। কেউ গেল। কেউ এল। সব গাড়িই নতুনের মতো। দ্রুতগামী। স্টার্ট দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যায়। কত রাস্তা সেই নগরের। কত দিক থেকে আসা যায়। কিন্তু সব কিছু গড়ে ওঠেনি বলে আবাসনের অনেক ফ্ল্যাটই ফাঁকা ছিল। একদিন আর এক ফ্ল্যাটে এক পরিবার এল। ভাড়া নিয়েছে মালিক অভিরূপ বসুর কাছ থেকে। চন্দ্রশেখর ছিল মাধ্যম। চন্দ্রশেখর বলল, বাড়িটার ঘরে ঘরে লোক থাকলে তো ভালো, তারাও কন্ট্রিবিউট করবে মেইন্টেনান্স, সেও তার ফ্ল্যাটে গৃহপ্রবেশ করবে।

গৃহপ্রবেশ কেন ?

থাকতে এসেছি তাই। চন্দ্রশেখর মৃদু হেসে বলেছিল।

অজিতেশ রায়, চন্দ্রশেখরের ফ্ল্যাটের মালিক বলেছিল, না, তা হবে না, ফ্ল্যাট আমার।

চন্দ্রশেখর বলেছিল, আমি বাস করি, আমার কল্যাণের জন্য এইটি করতে হবে।

করেছিল চন্দ্রশেখর। অজিতেশ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু আটকাতে পারেননি। তখন বললেন, ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে। চন্দ্রশেখর বলেছিল, ভেবে  দেখবে।

ভাড়াটেদের মাসিক মেইন্টেন্যান্স দেওয়ার ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিল ফ্ল্যাটের সেই সব মালিক যারা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছিল, শুধু অজিতেশ মানেননি। অজিতেশ দিতেন। চন্দ্রশেখরও দিত। তাকে প্রত্যাখ্যান করার কথা বলেছিলেন সুবীর, সমবায়ের ক্যাশিয়ার হেসে বলেছিল, দিচ্ছে দিক, আমাদের ফান্ডে টাকা বাড়ুক, ওকে বলেছি কিছু কন্ট্রিবিউট করতে, আমাদের বাড়ি সারাতে হবে।

সুবীর বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছিল। মাসে দেড় হাজার টাকা বেঁচে গেল ফ্ল্যাটের সেই সব মালিকদের যারা ভাড়া দিয়েছিল। তারা খুব খুশি। চন্দ্রশেখর ক্রমশ যেন সব কিছু অধিকার করে নিতে লাগল। চন্দ্রশেখর মাঝে মাঝে ট্যুরে যায়, দিল্লি, মুম্বই। চন্দ্রশেখর আর আমেরিকা যায় না। মাঝখানে তারা, চন্দ্রশেখর, সমরাদিত্য গেল মালদ্বীপ। ঘুরে এল। অনেক ছবি ফেসবুকে পোস্ট করল। একবার চন্দ্রশেখর সমরাদিত্য প্রস্তাব দিল, পিকনিকের। সকলে গেল বাস বোঝাই করে। যাঁরা সমবায়ের সদস্য, কিন্তু থাকেন না, তারাও গেল। কিন্তু কেমন যেন দূরে দূরে লাগল অজিতেশকে। অজিতেশ তাকে বললেন, এবার তোমার চন্দ্রশেখরকে ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে বলো।

আপনার ফ্ল্যাট, আপনি বলুন। সুবীর বলেছিল।

আমি বলেছিলাম, ও বলছে, জায়গা আর পরিবেশ ভালো লেগেছে, ছাড়তে পারবে না। 

আপনি কি আসতে চান ? সুবীর জিজ্ঞেস করেছিল।

হ্যাঁ, নিজের তৈরি করা ফ্ল্যাট, আমি আর কবে থাকব সেখানে ?

তাহলে ভাড়া দিয়েছিলেন কেন ?

ভুল হয়ে গিয়েছিল, আসলে তোমার লোক, আমি ভেবেছিলাম তোমার কথায় ও ছেড়ে দেবে, ইউ এস ফিরে যাবে, তখন তোমার সঙ্গে এসেছিল বলে ভাড়া দিয়েছিলাম, এখন বলছে ছাড়বে না, আইনত তারই নাকি বসবাসের অধিকার।  

নোটিস দিন। সুবীর পরামর্শ দিয়েছিল। 

দিয়েছিলাম, উত্তর দেয়নি, বলছে ওকে বিক্রি করে দিতে। বিপন্ন মুখে বলেছিলেন অজিতেশ।

আরও ছজন ভাড়াটে এনেছিল চন্দ্রশেখর। সকলেই ওর চেনা মানুষ। ছেলেবেলার বন্ধু, বন্ধুর বন্ধু, তার বন্ধু, আমেরিকা ফেরত, ভিসার কারণে বিতাড়িত ইত্যাদি। এরা সকলেই সুচাকুরে। কিন্তু দুজন ব্যতীত কেউ পরিবার আনেনি। বাকি তেরজনের পাঁচ-ছজন চন্দ্রশেখর, সমরাদিত্যদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তাদের ঘরে গিয়ে আড্ডা দেয়। পান করে। সমবায়ের মিটিংয়ে চন্দ্রশেখর সমরাদিত্যরা আসে। তাদের নোটিস না করলেও আসে। খবর পেয়ে যায়। বলে, আমরা বাস করি, আমাদের তো সব জানতে হবে।

চন্দ্রশেখরের ঘনিষ্ঠরা বলে, থাকুন, থাকলে দোষ কী।

সুবীর প্রস্তাব নেবেন ভেবেছিলেন, কয়েকজন সিনিয়র মেম্বার চলে আসতে চান, তাঁদের স্বাগত জানানো হচ্ছে। সমবায় তার নিজস্ব সদস্য ব্যতীত আর কাউকে এখানে বসবাসের অধিকার দেবে না।

তাহলে ভাড়াটেদের কী হবে ? তাঁরা তো আমাদের সঙ্গেই আছেন মূল মালিকের প্রতিনিধির মতো। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করল সমবায়ের সদস্যরা। বলল, ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার খর্ব হচ্ছে। ফ্ল্যাটের মালিক তাঁর ফ্ল্যাটে যাকে খুশি রাখতে পারেন।

সুবীর বললেন, অজিতেশ রায় ফিরতে পারছেন না, তিনি চাইছেন তাঁর ফ্ল্যাটে এসে থাকতে।

ভাড়াটেকে বললেই উঠতে পারে ? বলল এক সদস্য, এসব আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।

মিটিং থেকে সুবীর মন খারাপ নিয়ে ফিরলেন। আসলে তিনিই তো রেকমেন্ড করেছিলেন। চিনতে পারেননি চন্দ্রশেখরকে। একদিন চন্দ্রশেখর বলল, সে চায় এই ফ্ল্যাটে থেকে যেতে, উনি যদি  বিক্রি  করে দেন, সে কিনে নেবে।

তা হয় নাকি। অজিতেশবাবু তো আসতে চান।

এসে কী করবেন, ওঁর অনেক বয়স, এখন এখেনে এসে নতুন মস্তি কী হবে, যেখেনে আছেন, থাকুন, ওখান থেকে হাসপাতাল কাছে, নার্সিং হোম কাছে, এই বয়সে তো ওটাই আসল থাকার জায়গা।

কী সব কথা বলছো ? ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সুবীর, বলেছিলেন, উনি আসতে চান নিজের জায়গায়।

আমিও তো পুজোপাঠ করেই ঢুকেছি, এইটা আমার নিজেরই মনে হয়, উনি আমাকে সেল করে দিন।

বাধ্য করবে ? ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিলেন সুবীর।

না বাধ্য করব কেন, আমার প্রস্তাব আমি দিলাম, উনি মানবেন কি মানবেন না, তা ওঁর ব্যাপার।

খুব খারাপ লেগেছিল সুবীরের। তখন চন্দ্রশেখর বলেছিল, ওঁকে ওখানেই থাকতে বলুন, দুজন মানুষ, থ্রি বি এইচ কে, এত সব নিয়ে কী করবেন, কদিন বাদে তো বিছানায় থাকবেন।

তুমি তো খুব নিষ্ঠুর মানুষ, জানতাম না এত, সুবীর রেগে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন, তুমি আমাদের সমবায়ের সদস্য নও, তুমি এভাবে জোর  করে থাকতে পারো না।

মৃদু হেসে চন্দ্রশেখর বলেছিল, আপনি অহেতুক রাগ করছেন, ভাড়া দিয়েছেন উনি, ভাড়াটে আর ফ্ল্যাট ওনারা বুঝে নেবে সব, আপনারা আমাদের সদস্য করে নিন, বাড়ি নতুন করে রঙ করতে হবে, আমি যোগাযোগ করছি পেন্ট-কোম্পানির সঙ্গে।

সুবীর বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল নানা রকম কথায়। সুবীর বলেছিল, এসব তোমাকে ভাবতে হবে না। চন্দ্রশেখর তুমি ওঁর ফ্ল্যাট ছেড়ে দাও, উনি আসতে চান, তখন দরকার পড়েছিল, চুক্তি করে এগারো মাসের জন্য ভাড়া দিয়েছিলেন।

চন্দ্রশেখর বলেছিল, ভুল সুবীরদা, উনি প্রথমে এগার মাসের করেছিলেন, তারপরে সতের মাসের, এখন আইনত আমি না উঠলে উনি ওঠাতে পারবেন না, মামলা করতে বলুন।

সুবীর বুঝতে পেরেছিল চন্দ্রশেখর সূক্ষ্ম জালিয়াতি করেছে। অজিতেশের বাড়িতে গিয়ে কী সই করিয়ে এনেছে, অজিতেশ জানেন না। চন্দ্রশেখর মিষ্টির হাড়ি নিয়ে যেত। ফ্ল্যাটে কোনও অনুষ্ঠান হলে অজিতেশকে নেমতন্ন করতে যেত চন্দ্রশেখর। তুচ্ছ কারণে অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। ঘটনা প্রকাশ হয়ে যেতে সুবীর সমবায়ের মিটিং ডেকেছিল। কিন্তু সমবায়ের মিটিংয়ে অন্তত পাঁচজন বলল, এইটি ওঁদের ব্যক্তিগত সমস্যা, ভাড়া দেওয়ার আগে সমবায়ের অনুমতি নেওয়া হয়নি।

এরপর সমরাদিত্য এবং অন্য পাঁচজনের ঘটনাও তেমন হলো। কেউই বাড়ি ছাড়তে রাজি নন। নিয়মিত ভাড়ার টাকা দেন মানি অর্ডার করে। কেউ কেউ সেই টাকা প্রত্যাখ্যান করায় রেন্ট কন্ট্রোলে ভাড়া জমা পড়তে লাগল। অজিতেশ কদিন ঘুরে ঘুরে মারা গেলেন আচমকা। উদ্বেগই তাঁর কাল হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী সুবীরের ফ্ল্যাটে এসে বসে থাকতেন। কী হতাশ আর বিমর্ষ মুখ, পরাজিত মানুষের গ্লানি তাঁকে ঘিরে ধরছিল ক্রমশ। মৃত্যুসংবাদে ছুটে গিয়েছিল সুবীর। অজিতেশের স্ত্রী তাঁকে দোষারোপ করেছিল। চন্দ্রশেখরকে তিনিই এনেছিলেন। চন্দ্রশেখরের মাধ্যমে বাকি ছজন এসেছিল। সকলের দায় যেন তাঁর উপর পড়ল। মিটিংয়ে চন্দ্রশেখর হাজির হয়। নিজের প্রস্তাব অন্যদের দিয়ে পাস করিয়ে নেয়। সুবীর অবাক হয়ে থাকে। বুঝতে পারছিল তার ভুল হয়ে গেছে। সে চন্দ্রশেখরকে একদিন তার ফ্ল্যাটে ডেকে বলল, সে যেন এবার চলে যায়।

কেন, চলে যাব কেন ? চন্দ্রশেখর রুখে গিয়েছিল প্রায়। বলেছিল, সুবীরদা আপনি শুধু শুধু টেন্সড হচ্ছেন, ফ্ল্যাটটা আমার, আমি থাকি, আমি উঠব কি উঠব না তা বলার আপনি কে ?

আমি তোমাকে এনেছিলাম, তুমি আমার কথাটা রাখো, তুমি গেলেই আর সকলে যাবে। ঈষৎ নরম গলায় বলেছিলেন সুবীর, তুমি বাকিদের এনেছো। চন্দ্রশেখর বলল, কেউই যাবে না সুবীরদা, দরকারে কোর্টে যান ওঁরা, আমরা বুঝে নেব, এই পাঁচ বছরে ওঁরা তো ভালো টাকাই পেয়েছেন।

এইসব কথা যখন হচ্ছিল কলেজের বন্ধু আলোক এসেছিল তার ফ্ল্যাটে। সুবীর সরাসরি আলোককে প্রস্তাব দিয়েছিল, আলোক তুই ফ্ল্যাট কিনবি ?

কোথায় ফ্ল্যাট, এই কমপ্লেক্সে কেউ সেল করবে ?

সুবীর বলেছিল, করবে, তুই কত দিতে পারবি ?

কতো বিক্রি হবে বল, কোন ফ্ল্যাট ?

সুবীর বলেছিল, এই ফ্ল্যাট, আমি থাকব না।

আলোক অবাক হয়েছিল। সুবীরের বার বার মনে হচ্ছিল অজিতেশের মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী। তাঁরা খুব একা হয়ে গিয়েছিলেন ছেলে বিদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ায়। ছেলে পাকাপাকি দেশ ত্যাগ করল যেন। ফ্ল্যাট নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় তাঁর ছেলে বলেছিল, সেল করে দিতে। অজিতেশ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে সমবায়ের এই আশ্রয়টি করেছিলেন। শেষের দিকে বলতেন, আর ভাড়াবাড়িতে থাকব না, নিজের বাড়িতে ঘুম ভালো হবে সুবীর।

সুবীর ও সুজাতা ভাবছিলেন অনিকেত নিকেতনের পরিবেশ ক্লেদাক্ত হয়ে গেল। সবচেয়ে খারাপ হলো অজিতেশবাবুর স্মরণ সভা করল না সমবায়। তাঁর প্রস্তাবে বিপক্ষ না করেছিল। উনি থাকতেন না। ওঁর স্মরণ সভা হবে কেন ? পেছনে চন্দ্রশেখর ছিল।

পরের সভায় আলোককে হাজির করে সুবীর। বলল, সে আলোকময় পালকে তার ফ্ল্যাট বিক্রি করবে মনস্থ করেছে, সভাপতির কাছে নিজের আর্জি জানাল।

মিটিংয়ে উপস্থিত চন্দ্রশেখর বলল, সে কিনতে চায়, সে কিনবে।

সুবীর না করতে চন্দ্রশেখর বেশ কয়েকবার তার ফ্ল্যাটে আসে। নানা কথা বোঝায়। আলোক যে দাম দেবে তার চেয়ে পাঁচ লাখ বেশি দেবে বলতে থাকে। কত রকম কথা বলে, সুবীরকে নিয়ে বাংলাদেশ যাবে বলে। বরিশালে সুবীরের পিতৃপুরুষের গ্রাম দেখিয়ে আনবে। সুবীর চলুক। নিজের গাড়ি নিয়ে পুরী যাচ্ছে চন্দ্রশেখর, সুবীর কি যাবে ? সস্ত্রীক চলুন তাঁরা। চন্দ্রশেখর এক রাত্রে ফোন করে সেই জগন্নাথধাম থেকে। চন্দ্রশেখর বলে, ফ্ল্যাটটা তারই চাই, সে কিনবে নিজের দিদির নামে।

সম্ভব না। সুবীরের স্পষ্ট জবাব।

সম্ভব করতে হবে সুবীরদা, আমি ভাড়ার ফ্ল্যাট কবে কিনতে পারব জানি না, তবে ওঁরাও পাবেন না, অজিতেশ রায় কী করতেন এখানে এসে, মরেই যেতেন, যার যত আয়ু তার বেশি কি বাঁচে, ওঁর স্ত্রীকে বলেছি সেল করে দিতে, কী করবেন ফ্ল্যাট নিয়ে ?  

বাজে কথা বলো না চন্দ্রশেখর, তোমার ভিতরে কোনও মায়াদয়া নেই।

চন্দ্রশেখর বলে, নেই, সত্যিই নেই, দেখুন দাদা, আমাকে সেল করলে আপনার ক্ষতি নেই, আপনি আমাকে দিন, আমি বেশি দেব।

এক সমবায়ে কি একজনের দুটো ফ্ল্যাট থাকতে পারে ?

অন্য নামে থাকবে সুবীরদা, আমার দিদি নেবে, আপনি রাজি হয়ে যান।

সম্ভব না, আমার বন্ধু নেবে।

আমার অধিকার আগে, জায়গাটাকে আমি পছন্দ করেছি আগে।

তুমি পছন্দ করলে কীভাবে, তৈরি বাড়িতে এলে ? সুবীর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

যখন আপনারা জমিতে বাড়ি তুলতে আরম্ভ করেননি, সেই জমি আমি কলকাতায় এসে দেখেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, দেশে ফিরলে ওখানেই উঠব, আপনি আমাকে আপনাদের জমি দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন, মনে নেই ?

সে কবে, আমি তো মনে করতে পারছি না।

মনে করুন মনে করুন, আমি বলেছিলাম আমাকে মেম্বার করে নিন, আপনি বলেছিলাম সব ফিল্ড আপ, তখনই আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমি একটি অংশ নেবই নেব।

আমি তো এতটা বুঝতে পারিনি।

খুব পেরেছিলেন, আমি মিটিংয়ে বলব, আপনি কথা দিয়েছিলেন একটি শেয়ার দেবেন, কথাটা রাখুন।

আমি এমন কথা বলিনি।

বলেছেন, এখন অস্বীকার করলে হবে, সমবায়ে প্রস্তাব নেব, বাইরের লোকের কাছে ট্রান্সফার করা যাবে না।

সুবীর বলেছিলেন, তা হয় না, ওসবের কোনও লিগ্যাল ভ্যালিডিটি নেই।

সে তো কোর্ট বলবে, আপনি আমাকে সেল করে দিন, বেশি পাবেন, দেবেন না কেন ?

সুবীর বলেছিলেন, তোমার হাতে দেব না, তোমার জন্যই আমি থাকতে পারছি না।

হাসালেন দাদা, আপনি থাকুন কোনও ব্যাপার না, না থাকলে আমাকে দিন, আমি সমবায়ে আছি।

সুবীরের মনে পড়ছিল চন্দ্রশেখরের আসা এবং ক্রমশ সমবায়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা। সুবীর মনে করতে পারে না সে কোনও দিন চন্দ্রশেখরকে জমি দেখাতে নিয়ে এসেছিল কি না। একদম প্রাথমিক অবস্থায়। তখন প্ল্যান পাসের জন্য জমা দেওয়া হয়েছিল। তারা বারবার জমি দেখতে আসত। কিন্তু চন্দ্রশেখরকে নিয়ে এসেছেন বলে কিছু মনে করতেই পারলেন না। তখন আলাপই হয়নি। ফেসবুকে আলাপের পরই তো এল যখন তখন ফ্ল্যাট উঠে গেছে। কথাটা বানিয়েছে ও। কথা বানাতে পারে খুব। সুবীরের ভয় করতে থাকে। সে দ্রুত আলোককে বিক্রি করে ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে সেই অনিকেত নিকেতন ত্যাগ করে। আলোক নিজের ফ্ল্যাটের দখল পেয়ে সপরিবারে সেখানে চলে যায়। তারপরও বছর দশেক কেটে গেছে। সুবীরের বয়স বেড়েছে। সুবীর আর কোনও দিন অনিকেত নিকেতনে পা দেয়নি। আলোক আছে। আলোককে সব বলে দিয়েছিলেন সুবীর। আলোক মাঝে মাঝে ফোন করে যেতে বলত। সুবীর যায়নি। ফোন তারপর অনিয়মিত হয়ে যায়। এত বছর বাদে আলোক তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, অনিকেত নিকেতনের পঁচিশ হচ্ছে। সকলে বলছে সুবীর হালদার আসুন। তিনি এই নিকেতনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এর নামকরণও তাঁর। তিনি না এলে পঁচিশ বছরের ইতিহাস অন্ধকারেই থেকে যাবে। সব জানেন তিনি।

সুবীর বলল, সে যাবে না। সে প্রতারিত হয়ে তার বাসস্থান বিক্রি করে চলে এসেছিল। আর যাবে না। কিন্তু সুবীরের কাছে আলোক এল চন্দ্রশেখরকে নিয়ে। সেই চন্দ্রশেখর, বয়সের ছাপ পড়েছে তার মুখের উপর। গায়ে মাংস জমেছে অনেক। সেই হাসি। কোনও কথাতেই রাগে না। খুব ঠান্ডা মাথা। চন্দ্রশেখর বলল, আপনাকে যেতেই হবে সুবীরদা, আপনি আমাকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন, না হলে আমি কি অনিকেত নিকেতনে থাকতে পারতাম, আপনার কথামতো আমি যা কিছু করেছি।

আমার কথামতো ? সুবীর যেন তীরবিদ্ধ হলেন। কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। হাজার হোক তার বাড়িতে এসেছে চন্দ্রশেখর। চন্দ্রশেখর বলল, আপনার পরামর্শ মতো, না চললে কি ফ্ল্যাটটা পেতাম, অজিতেশবাবুর স্ত্রী আমাকে সেল করে মেয়ের কাছে চলে গেলেন, আপনি যা স্পেকুলেট করেছিলেন, তাই হয়েছে।       

তুমি ঠিক বলছো না, ডাহা মিথ্যে। 

ঠিকই বলছি সুবীরদা, বয়স হয়েছে,  ভুলে যাচ্ছেন মনে হয়, তবে শেষে অনুতাপ হয়েছিল তাই চলে এলেন, অনুতাপের কোনও কারণ নেই,  পৃথিবীতে একজনের খারাপ হলে অন্যজনের ভালো হয়, সারভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্ট, আমি টিকে গেছি।  

প্লিজ তুমি কথা বলো না, তুমি সব মিথ্যে বলছো।

মিথ্যে বলে আমার লাভ, আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ সুবীরদা, আপনিই আমার মেন্টর ছিলেন, আপনি না হলে ছ ছটি ফ্ল্যাট হতো না আমাদের। শুধু সমরাদিত্য আচমকা হার্ট স্ট্রোকে মারা গেল, না হলে সাতটিই আমাদের হত।

মারা গেল ?

হুঁ, সেই ফ্ল্যাটের মালিক অন্নপূর্ণা সাহাও নেই। তাঁর ছেলে মুম্বই থাকে। আপনি ফিরতে চাইলে ফিরতে পারেন, সে ফ্ল্যাট রাখবে না, আমাকে বলেছে খদ্দের দেখতে।

সুবীর মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার ঘেন্না করছিল। কেমন নির্বিকার মুখে চন্দ্রশেখর বলে যাচ্ছে মিথ্যে কথা। আলোক শুনছে। আলোক হয়তো বিশ্বাস করছে। তার কথার সারমর্ম, সুবীরের পরিকল্পনামতো এগিয়েই ফ্ল্যাটগুলো পাওয়া গেছে। আলোকের আগেই চন্দ্রশেখর নিষ্ক্রান্ত হলো। আলোক চুপ করে বসে থাকল। একটু বাদে বলল, সুবীর তুই আসবি সমরাদিত্যর ফ্ল্যাটে ?

কত অভিসম্পাত দিয়েছেন মালিকরা, তুই কি বিশ্বাস করলি ওর কথা ?

চন্দ্রশেখরই তোর নাম প্রস্তাব করেছে, সে বলছে তোকে ঢুকিয়ে দেবে। আলোক প্রশ্ন এড়িয়ে গেল।

তুই ভেবেছিস আমি আর যাব ওখানে ?

পঁচিশ বছরটা বড় করে…। আলোক কথা শেষ করল না। সুবীর তার কথার ভিতরেই বলল, তুই ওকে নিয়ে এলি কেন, ওর জন্যই আমি ছেড়ে এসেছিলাম তা জানিস তো।

আলোক হাসল না, বরং অন্য কথা বলেছিল ও, অনুতাপের কোনও কারণ নেই, তুই আয়, কম দামে পেয়ে যাবি ফ্ল্যাটটা, চন্দ্রশেখর খুব করিতকর্মা, হেল্পফুল।

কী রকম হেল্পফুল ?

সমরাদিত্যকে বাঁচাতে পারেনি, কিন্তু অচিন্ত্য সমাদ্দারকে বাঁচিয়ে দিয়েছে সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে, ওর গাড়ি খুব সাহায্য করেছিল।

অচিন্ত্য সমাদ্দার কেমন আছেন এখন ?

খুব ভালো, তিনি তো চন্দ্রশেখরে মুগ্ধ।

সব দখল করে নেবে, বিশ্বাস করতে বারণ করিস।

আলোক মৃদু গলায় বলল, জানি না, শুনেছি সমরাদিত্য ছটফট করছে বুকের ব্যথায়, ও জ্যামে ঢুকিয়ে দিয়েছিল গাড়ি, জিপিএস দেখাচ্ছিল অন্য পথ।

দম আটকে আসছিল সুবীরের।

আলোক বলছিল, ফ্ল্যাটের একজন ছিল সেই গাড়িতে। লোকটাকে মেরেই ফেলল ইচ্ছে করে ভুল রাস্তায় ঢুকিয়ে, ঘণ্টা দেড় জ্যামে আটকে থেকে অনেক দূরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে।

উদ্বিগ্ন সুবীর জল খায়। বুকে হাত রাখে। আলোক থামে। তারা কেউ কথা বলছিল না। আলোক একটু বাদে বিবরণ দিল সমরাদিত্যর মৃত্যুর। সে খুব করুণ। হাসপাতাল আর পৌঁছানোই হয় না। সমরাদিত্য বলে যাচ্ছে, চাঁদু, তুই আমাকে বাঁচা, প্লিজ, আর কত দূর ?

গাড়িটা ঢিমে তালে চলছিল। ফ্ল্যাটের সেই যুবক কাঠ হয়ে সমরাদিত্যর মাথা কোলে করে বসে ছিল। সমরাদিত্যর মেয়ে, বউ কেউ তার মৃত্যু সংবাদ পেয়েও আসেনি।

উঠে পাখা চালিয়ে দিল সুবীর। ঘাম হচ্ছিল। 

আলোক বলছিল, চন্দ্রশেখর শুধু বলছে সুবীরের কথা, সুবীরদা ভালো অ্যাডভাইসার, সুবীর হালদার না এলে উৎসব কীভাবে হবে, তার জীবনে সুবীর হালদারের ভূমিকা অনেক, সুবীরের কথায় সে ইউ এস ছেড়ে এই আবাসনে এসে উঠেছিল।

সুবীর বুকের বোতাম খুলে ফু দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সমরাদিত্যকে মেরে দিল কেন ?

ওর থেকে অনেক টাকা ধার করেছিল মনে হয়, সবই শোনা কথা, আমি আর কিছু বলতে পারব না, ভয় করে।

সুবীরের ভিতরে কাঁপুনি এল যেন।

চন্দ্রশেখরকে ভয় করে, আমি বাধ্য হয়ে ওকে নিয়ে এলাম। আলোক ফিসফিস করে বলল, ওর কথাই আবাসনে শেষ কথা, আমিও ভালো নেই।

সুবীর অনেক রাতে একা একা তার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসেছিল। একটু আগে চন্দ্রশেখর ফোন ছেড়েছে। সুবীরকে চায়। হাজির করতে পারলেই তার সম্বন্ধে লোকের ধারণা বদলে যাবে। সেই কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারলেই সকলে জানবে প্রতিষ্ঠাতা সুবীর হালদারের পরিকল্পনা মতো সব হয়েছে। চন্দ্রশেখর বলছে, কী চাই আপনার বলুন।

তুমি ওই আবাসন ছেড়ে চলে যাও।

কী যে বলেন দাদা, আপনার কথায় ইউ এস ছেড়ে এলাম, আপনিই বললেন কীভাবে কী হতে পারে, কারও মঙ্গল করাও পুণ্য, আমার মঙ্গল করেছেন, আপনার পুণ্য হবে, আসলে পাপ পুণ্যে সব কাটাকুটি হয়ে যায়।

ঘুমঘুম অন্ধকারে সুবীরের মনে পড়ছিল অজিতেশের মুখ। তাদের সেই জমি। তাদের সেই আবাসন। প্রচুর হাওয়া, প্রচুর রোদ্দুর, প্রচুর বৃষ্টি। প্রচুর অক্সিজেন। অজিতেশ বলতেন, ওখানে অনেক দিন বাঁচব সুবীর, আয়ু বেড়ে যাবে, তুমি বলছো যখন থাকুক কমাস, ক দিন বাদে ইউ এস ফিরে যাবে তো। সেই সুবীর হালদার কে যে অজিতেশের বাড়ি গিয়েছিল ? চন্দ্রশেখর সকলকে ফেলে ইউ এস থেকে পাকাপাকি চলে এসেছে তা কি তার জানা ছিল না ?

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button