মোহিত কামাল : আমি
গল্পসংখ্যা ২০২৩
সন্ধ্যার ম্লান আলো মিলিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নেমে আসছে নরম আঁধার, হালকা আঁধার। সাজবেলাতে গ্রামের বাড়ির পুকুর পাড়ের বাদামতলায় দাঁড়িয়ে একবার আকাশের দিকে তাকাল অপু। দেখতে লাগল আঁধার আর আলোর মায়াময় জগতের অপূর্ব মিলন-খেলা!
হালকা হতে হতে আলো কীভাবে অন্ধকারে ডুবে যায়, কীভাবে ঘন হতে থাকে আঁধার, দেখতে দেখতে ওর মনে উড়ে এসে জুড়ে বসতে লাগল ঘোরলাগা সন্ধ্যার অন্যরূপ, অন্য আলো। সেই আলো চোখে ভরে নিয়ে সে এবার তাকাল বাদামতলার ছোট্ট কবরস্থানের দিকে। এখানে শুয়ে আছে বংশের শেকড়বিস্তারী পূর্বপ্রজন্মের সব নিকটজন। উত্তরপ্রজন্মের মধ্যে পূর্বপ্রজন্ম কখন যে বিলীন হয়ে যায় কেউ টের পায় না, যেমন পায় না সন্ধ্যার আলো অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার মুহূর্ত।
নতুন দার্শনিক ভাবনায় টলে উঠে অপু এবার তাকাল কবরস্থানের পুবপাশের পুকুরের দিকে। মৌসুমি বায়ুর আদর বুকে নিয়ে পুকুরের জল তুলতুলে ঢেউ তুলে উত্তর দিক থেকে সরে যাচ্ছে দক্ষিণ পানে। এ যাওয়ার কোনও শব্দ নেই। অথচ অপু অনুভব করতে লাগল চলমান নরম নরম ঢেউ নিঃশব্দে ছড়িয়ে দিচ্ছে কুলকুল ধ্বনি।
দু বাহুর মতো ছড়ানো বিশাল বাদামগাছের পাতারা আচমকা দুলতে লাগল। দোলার মতো বাতাসের তেমন তরঙ্গ নেই, গতি নেই। অথচ পাতারা দুলছে। পাতারা কাঁপছে। শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলছে।
মৌসুমি বায়ুর কোমল স্পর্শের মতো আদুরে নয়, অন্যরকম কর্কশ স্বর ছড়িয়ে যেতে লাগল চারপাশে। ক্রমশ ঘন হতে থাকা আঁধারের বুক চিরে কেউ যেন কোনও মেসেজ পাঠাচ্ছে, সংকেত পাঠাচ্ছে শব্দতরঙ্গের ভেলায় ভাসিয়ে।
এই শব্দরথের উৎস কী ?
ভাবতে গিয়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল।
শরীরের গলিপথে আকস্মিক নেমে এল গাঢ় আঁধার। এ আঁধার ফুড়ে বাদামগাছের পাতায় এসে ভর করল এক ছায়ামূর্তি। কান খাড়া হয়ে গেল অপুর, শুনল স্পষ্ট কথা : ‘এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন ?’
‘শহর থেকে এসেছি গ্রাম দেখতে। এসেছি স্বজনদের কবরের পাশে। এসেছি তাঁদের জন্য জিয়ারত করতে!’ ভয় না-পেয়ে দাপটের সঙ্গে জবাব দিল অপু।
উত্তর শুনে প্রবল বেগে কাঁপতে লাগল পুরো বাদামগাছ। গাছের শুকনো পাতারা ঝরে যেতে লাগল ঝর ঝর করে। আর সঙ্গে সঙ্গে গাছ থেকে উড়াল দিল অশরীরী কালো ছায়াটা; উড়ে গেল আকাশের দিকে। মাথা ওপরের দিকে তুলে অপু দেখতে চাইল ছায়াটার গতি-প্রকৃতি। দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে আঁধারে মিলিয়ে গেল ছায়াটা। আর কিছু দেখতে পেল না।
আবার সে তাকাল আকাশ পানে। চোখ বড় বড় করে এবার দেখল ঝলকানো অথচ মায়াময় এক চওড়া আলোর বিম দখিন থেকে ছুটে আসছে কবরস্থানের দিকে। বাদামগাছ বরাবর এসে ছুটন্ত আলোস্তম্ভ আচমকা বেঁকে গেল।
এ কি! আলো তো সরলরেখায় চলে! ওটা সাঁই করে এমন বেঁকে গেল কীভাবে! তবে কি এটা দূর নক্ষত্রের কোনও আলো ?
সূর্যের পাশ দিয়ে পৃথিবীতে আসার সময় দূর নক্ষত্রের আলোর গতিপথ বেঁকে যায়। স্থান-কালের বক্রতার কারণে এমনটি ঘটে যায়। এ কথা জানা আছে অপুর। আর তাই ভাবতে লাগল এই স্থানে কি অদৃশ্য কোনও বক্রতা রয়েছে ? জীবন-মরণের বক্রতা ? বোধের বক্রতা ? ক্রোধ বা হতাশার বক্রতা ? দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বক্রতা ?
কী আছে চোখের আড়ালে ?
আলোর গতি বেঁকে যাওয়ার জন্য সূর্যের উপস্থিতির প্রয়োজন আছে। সাজবেলাতে এখানে সূর্য কোথায় ? এ কবরখানায় সূর্য কোথায় ? বাদাম গাছের পাতায় সূর্য কোথায় ?
তবে কি সূর্য লুকিয়ে থাকতে পারে আঁধারেও ? চোখের বাইরের দৃষ্টিসীমার ধাঁধায় ?
আশ্চর্য! ছুটে আসা আলোর বিমটা কোথায় গেল!
এবার চোখ বন্ধ করে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে। বসে রইল কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ রেখেই উঠে দাঁড়াল আবার। বড় করে একটা শ্বাস টেনে নিল। ভয়কে জয় করতে চাইল।
আকস্মিক অপু আবার দেখল ছায়াটা মাটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। স্থির দাঁড়িয়ে আছে ওর মুখোমুখি আলোর ছায়া হয়ে, ছায়াআলো রূপে। এ আলোছায়া না মানুষের আকৃতির, না পশুর, না পাখির। বুঝতে পারল না সে। কিছুটা ভয় পেলেও তা জয় করে এক পা সামনে বাড়াল।
‘তুমি কে ?’ প্রশ্ন করে আবার এগোল সামনে।
‘এগিয়ো না।’
‘কেন, ভয় পাচ্ছো আমাকে ?’ সাহসের সঙ্গে আবার প্রশ্ন করল অপু।
জবাব না-দিয়ে ছায়াটাটা পিছু হটতে লাগল। অপুও এগোতে লাগল।
খুব কাছাকাছি এসে হাত বাড়াল এবার। অপুর হাতের স্পর্শ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছায়া হালকা হতে হতে ওর ভেতর ঢুকে গেল।
এবার দু পা পিছিয়ে গেল সে।
বড় করে শ্বাস ছেড়ে চমকে উঠে অপু দেখল আলোর ছায়াটা ওর নাক দিয়ে বেরিয়ে ছুট দিয়েছে সামনে।
সময় না-নিয়ে পেছন পেছন ছুটতে লাগল অপুও। ছায়াটাকে ধরতে চাইল। ধরতে পারল না। ছুটছে ছায়া, ছুটছে অপু। ছুটছে ওরা, যেন ছুটছে অনন্তের পানে, যেন ছুটছে শেকড়ের সন্ধানে। মাটির ঘ্রাণ নিয়ে যেন ছুটছে সামনে নয়, পেছনের দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আলোছায়াটা হরিণ হয়ে ছুটতে লাগল। অপুও।
হঠাৎ ও আবিষ্কার করল ছায়াটা সামনে নেই; ডানে নেই, বায়ে নেই, পেছনেও নেই।
ছুটতে ছুটতে সে পড়ে গেল এক গর্তে। ব্ল্যাকহোলের মতো তলাহীন গর্তে ডুবে যেতে যেতে চিৎকার করে অপু প্রশ্ন করল, ‘কোথায় গেলে তুমি ?’
প্রতিধ্বনি থেকে উত্তর উড়ে এল :
‘আমি কোথাও যাইনি। তোমাতেই আমার বাস। আমি তোমারই অস্তিত্ব। তোমারই অণু-পরমাণুর ছায়াস্বপ্নঘেরা ভবিষ্যৎ। তবে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। আমি তোমার বর্তমান। তুমি আমার বর্তমান। আমি তোমাকে নিয়ে এখন ডুবে গেছি তলাহীন গহন কোণে, মহাকালের-মহাকাশের কুয়ায়। তুমি কি টের পাচ্ছো, আমার তুমি, তোমার আমি ?’
সচিত্রকরণ : রজত