বিশ্বজিৎ চৌধুরী : পুনরুদ্ধার সংকেত
গল্পসংখ্যা ২০২৩
‘এই যে সিনেমায় হরহামেশা দেখা যায় বড় দুর্ঘটনায় স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যক্তি আবার কোনও বড় ধরনের আঘাত পেলে স্মৃতি ফিরে পান, এটা কি সম্ভব…, মানে এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে ?’
প্রশ্ন শুনে সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন, ঠোঁটে ঝুলে আছে সামান্য কৌতুক, বোধহয় বুঝতে চাইছেন আমার এ প্রশ্নে কতটা সত্যিকারের জানার আগ্রহ, কতটা বিদ্রƒপ। যখন নিশ্চিত হলেন ঠাট্টা-বিদ্রƒপ নয়, এ আমার নিতান্ত নিরীহ কৌতূহল, তখন পুরো ঘর কাঁপিয়ে হাহ্ হাহ্ করে হেসে উঠলেন।
খ্যাতিমান মনোচিকিৎসক মাঝবয়সী, দেখতে বেশ হৃষ্টপুষ্ট ধরনের, আমার মুখোমুখি টেবিলের ওপাশে একটা রিভলবিং চেয়ারে প্রায় চিৎসাঁতারের ঢঙে বসেছিলেন। হাসির গমকে তাঁর মাঝারি আকারের ভুঁড়ি কেঁপে উঠল থরথর করে। সে-ও এক দেখার দৃশ্য!
হাসির রেশ ফুরানোর আগেই সোজা হয়ে বসলেন, পুরো চেহারাজুড়ে এক আনন্দিত শিশুর অভিব্যক্তি। নিজের মধ্যে এত আনন্দ কী করে যে পুষে রাখেন এই মানুষগুলো, এদের সান্নিধ্যে এলেই যে কারও মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। আমি তাঁর বয়সে বেশ ছোট বটে, কিন্তু স্কুল বয়সী যে নই সেটা তাঁর কতটা মনে আছে কে জানে। অবলীলায় জানতে চাইলেন, ‘দেখতে-শুনতে তো বেশ, মানে যথেষ্ট সুন্দরীই বলতে হয় আপনারে, সিনেমায় নামার চেষ্টা করেন নাই কখনও ?’
আমি যে সুন্দরী এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশ্বের তাবৎ সুন্দরীরা সিনেমায় নামার জন্য মুখিয়ে থাকে এই তথ্য কে দিল তাঁকে! এ রকম একটা প্রশ্ন করা তাঁর উচিত হয়নি। মনোচিকিৎসকেরা নাকি বেশ আত্মবিশ্বাসী হন, রোগীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য হয়তো এটা তাঁদের হতেই হয়। কিন্তু আমি তো জাহান ইয়ার সাহেবের রোগী নই, কোনও মানসিক সমস্যাও নেই আমার, তাঁকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়া, মানে উল্টো তাঁর ওপর চড়াও হওয়ার সুযোগটা তাই হাতছাড়া করলাম না, ‘আপনার স্ত্রী তামান্না ম্যাডামও তো ভীষণ সুন্দরী… এই বয়সেও…, তো যৌবনে সিনেমায় না নেমে উনি মেডিকেলে পড়তে গেলেন কেন ?’
‘ও বাব্বা, আপনি তামান্নারেও চিনেন ? তাহলে তো সাবধানে কথাবার্তা বলতে হয়, কী করে চিনেন ?’
‘গাইনির ডাক্তার, মেয়েদের তো নানা কারণে যেতে হয়।’
‘ও আচ্ছা। যাই হোক আমি আসলে জানতে চাইতেছি বাংলা সিনেমা খুব বেশি দেখা হয় কিনা।’
‘না, স্যার, খুব একটা না, কেন বলছেন ?’
‘না, ওই যে স্মৃতিভ্রষ্ট একটি মানুষ… ডুপ্লেক্স বাড়ির সিঁড়ি থেকে হঠাৎ কারও ধাক্কায় বা পা হড়কে পড়ে গেল… গড়াতে গড়াতে একেবারে শেষ ধাপ পর্যন্ত, তারপরই বদলে গেল সবকিছু, ভুলে যাওয়া সব স্মৃতি হুড়মুড় করে ফিরে এল তার মনে…।’
‘এরকম হয় না, না ?’ আমি তাঁর উচ্ছ্বসিত চেহারার দিকে তাকিয়ে মোটামুটি শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম।
‘হলে তো খুব ভালো হতো। এক আঘাতে মেমোরি লস আরেক আঘাতে সুস্থ হওয়ার এই ফর্মুলায় রোগীর চিকিৎসা একেবারেই সহজ অইয়া যাইত। ডাক্তারদের হাতে হাতে থাকত নানা আকারের হাতুড়ি। মাত্রা মেপে মাথায় হাতুড়ি ঠুইকা দিলেই… হা হা হা…।’
তাঁর রসিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমি যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি না মনে হওয়ায় হয়তো ভদ্রলোক এবার গুছিয়ে নিলেন, কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে এই শহরে তার নাম-যশ-খ্যাতির সঙ্গে মানানসই পরিমাণে গাম্ভীর্য ফেরাতে পারলেন না চেহারায়। আসলে এখন আমি নিশ্চিত, আনন্দিত অভিব্যক্তি বলে যেটাকে আমি শনাক্ত করছি, সেটা তার স্বাভাবিক অবয়বেরই একটি অংশ। তিনি এই পৃথিবীর সেই বিরলসংখ্যক মানুষদের একজন, যাঁর স্বাভাবিক চেহারায় একটা খুশির আভা ছাড়িয়ে আছে। তাঁর মুখের ভাষায় আঞ্চলিক আর শুদ্ধ বাংলার মিশেল। প্রথম পরিচয়েই লোকটাকে আমার ভালো লেগে গেল, এমনকি প্রচণ্ড দুঃখ-শোকের সময় ভদ্রলোকের অবয়বে কী ধরনের পরিবর্তন আসে সেটা জানার একটা কৌতূহলও জমা থাকল মনে।
আমরা যে হাসপাতালটিতে বসে কথা বলছি, তাকে ঠিক হাসপাতালের মতো মনে হয় না। হাসপাতাল শব্দটি উচ্চারণমাত্র যে গন্ধটা নাকে এসে লাগে, চারপাশে অসুখী বিমর্ষ চেহারার লোকজনের ভিড় ভেসে ওঠে―মনে এসবের কিছুই নেই। বরং একটা পাঁচতারা হোটেলের সঙ্গে এর তুলনা হতে পারে। জাহান ইয়ার সাহেবের চেম্বারের সামনের অংশ, মানে করিডরের দিকটাতে ঝাপসা কাচ দেওয়া, কিন্তু যে চেয়ারে তিনি বসেছেন, তার পেছনে ফ্লোর টু সিলিং স্বচ্ছ কাচের ভেতর দিয়ে অনেক দূর, মানে সুন্দর করে ছাঁটা সবুজ ঘাসের একটা প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সীমানা দেওয়াল পর্যন্ত দেখা যায়। বাইরে এখন ডিসেম্বরের চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ সকালবেলা। জানালার পাশের গাছগুলোতে এক রকম আর দূরে সীমানা দেয়ালসংলগ্ন গাছের পাতায় অন্যরকম রোদ। এই আলোছায়ার ব্যাপারটা বেশ সময় নিয়ে উপভোগ করার মতো। এই মুহূর্তে অবশ্য এতটা সময় আমার নেই।
‘খুঁজে পেতে আমাকে কেন ডেকে আনলেন বলুন তো ?’ এবার সরাসরি মূল প্রসঙ্গে ঢুকলাম আমি।
ডা. জাহান ইয়ার হাসলেন, একটা বিগলিত ভাব আছে হাসিতে, ‘আপনার একটু সাহায্য চাই সানন্দা… আপনার নামটা ভারী সুন্দর…।’
‘এটা আমার ডাক নাম, সনদপত্রে অন্য একটা নাম আছে।’
‘সেইটা থাক, সনদের প্রয়োজন তো পড়ছে না, সানন্দা নামেই ডাকি… একটা বিশেষ প্রয়োজনে ডাইকা আনতে হলো আপনারে।’
‘সে তো জানি, সাফকাত সাহেব অসুস্থ। রোড অ্যাকসিডেন্টের পর তাঁর মাথায় বোধহয় গোলমাল দেখা দিয়েছে, তাই তো ?’
‘না, না গোলমাল ঠিক নয়, খেই হারিয়ে ফেলা… মানে আপনারা যারে বলেন স্মৃতি-বিস্মৃতির দোলাচল… এই খুঁজে পাওয়া গেল, আবার হারিয়ে গেল… বোঝাতে পারলাম ?’
‘কিছুটা।’
‘আপনার সঙ্গে সাফকাত সাহেবের একটা সম্পর্ক… আই মিন অতীত…’ জাহান ইয়ার সাহেব নিশ্চিত হতে পারছেন না, ঠিক কীভাবে বললে অশোভন হয় না।
আমিই কাজটি সহজ করে দিলাম, ‘সাফকাতের সঙ্গে আমি প্রায় এক বছর লিভ ইন করেছি। এক ঘর, এক বিছানা… মানে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ ছাড়া বাকি সবই।’
‘থ্যাংকস, আমিও সেই রকমই শুনছি। ফলে আপনি আমাদের চিকিৎসাপর্বে একটু সাহায্য করতে পারেন, ইফ ইউ রিয়েলি ওয়ান্ট টু হেল্প মি।’
আমি হাসলাম ‘আমি এখানে কী করতে পারি স্যার, আমার ভূমিকাটা কী ? হারানো সুরের ডাক্তার সুচিত্রা সেন, না, দীপ জ্বেলে যাই-এর নার্স সুচিত্রা সেন ?’
হেসে ফেললেন জাহান ইয়ার সাহেবও, ‘উফ্, আবার সিনেমা, এই মুভিগুলো বাঙালি দর্শকের মাথা এমন নষ্ট করছে, বিজ্ঞান বলেন আর ডাক্তারি বিদ্যা এখানে টোটালি ফেল। আই অ্যাম শিওর, বাঙালি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও জাতিরে এমন তরল ইমোশন গেলানো যাবে না।’
‘সরি স্যার, আপনার সঙ্গে ডিফার করতে হচ্ছে। ইমোশন ব্যাপারটাকে বাঙালির একক সম্পত্তি মনে করার কোনও কারণ নেই। এই যে হারানো সুর ছবিটা, এর গল্প কিন্তু জেমস হিলটনের রেন্ডম হারভেস্ট থেকে নেওয়া, এই কাহিনি নিয়ে ১৯৪২ সালে ছবি হয়েছিল হলিউডে। ওই কাহিনিই একটু এদিক-ওদিক করে আরও পনেরো-ষোলো বছর পর উত্তম-সুচিত্রার ছবিটি হয়েছিল। আর দীপ জ্বেলে যাই তো আলফ্রেড হিচককের স্পেলবাউন্ডের অনুকরণ।’
বিস্ময়ে স্ফীত দুই চোখ ডাক্তার সাহেবের, ‘আপনারে তো ব্যাংকার জানতাম!’
‘ব্যাংকার বুঝি টাকার হিসাব-নিকাশ ছাড়া আর কিছু করতে পারে না ? ছাত্রজীবনে ফিল্ম সোসাইটি করতাম… ভালো-মন্দ প্রচুর ছবিও দেখা হয়েছে তখন।’
‘গুড, ভেরি গুড!’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাহান ইয়ার। সেই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে এল অনুচ্চ উচ্চারণ, ‘কত অজানারে!’
মনোচিকিৎসকের সঙ্গে আমার আলাপের প্রসঙ্গ স্থগিত রেখে এবার বরং সাফকাত সম্পর্কে কিছু বলা যাক। তাকে আমি কলেজে ভর্তির প্রথম দিনেই লক্ষ করেছিলাম। শুধু আমি নই, কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা তো বটেই, প্রিন্সিপাল থেকে পিওন পর্যন্ত সকলেই চিনত তাকে।
সত্যি বলতে কী, এত সুন্দর চেহারার মানুষ ইহজীবনে আমি দেখিনি। একহারা লম্বা শরীর, তামাটে গায়ের রঙ, সুসমঞ্জস চোখ-নাক মিলিয়ে মায়াবী অথচ অন্যমনস্ক একটা চেহারা, এক মাথা আগোছালো চুল, আর প্রায় সর্বক্ষণ ঠোঁটে বোকা বোকা একটা হাসি। পোশাকটাও যেন পরিকল্পিতভাবেই এলোমেলো। তুখোড় ছাত্র, গান গায়, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ বক্তা হয়, আবার কলেজ ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন। সেই বয়সেই উচ্চ মাধ্যমিকের প্রায় সব কটি সুশ্রী মেয়ের সঙ্গে সমানে ফ্ল্যার্ট করে, অথচ ছেলেরা তাকে হিংসা করে না। কলেজের মাস্তান ধরনের ছেলেদের সঙ্গে মাঝেমাঝে লাইব্রেরি ভবনের পেছনে গিয়ে গাঁজাতে টান দেয় বলেও শুনেছি।
যতটা মুগ্ধতা, ঠিক ততটাই আমি দূরত্ব মেপে চলি। আগুনে হাত পোড়ানোর চেয়ে দূরের আলো দেখা ভালো। একই ক্লাসে পড়ি, অথচ কেমন আছো, কেমন চলছে ছাড়িয়ে বিশেষ কিছু কথাবার্তা হয় না। কিন্তু নিজেই এসে একদিন বলল, ‘আলমাসে সানফ্লাওয়ার চলছে সানন্দা, দেখবে ?’
‘সময় করে দেখে নেব।’
‘চলো, আজ এক সঙ্গে দেখি…।’
খুবই সহজ সাদামাটা প্রস্তাব। কিন্তু উদ্দেশ্যটা কী! হঠাৎ আমার মনে কী কৌতুক খেলে গেল কে জানে, ফস করে বললাম, ‘সোনার হরিণ কোন বনেতে থাকো ?’
ভ্যাবাচেকা খেল, ভ্রƒকুঞ্চিত, চোখে-মুখে সবিস্ময় প্রশ্ন, মানে আমার কথাটার মানে বুঝতে পারেনি সে। আমিও কি ছাই বুঝেছি ? এটাকে তাৎক্ষণিক ও অসতর্ক প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে। এর-ওর মুখ থেকে ফিসফাস শুনেছি সাফকাত কখনও দীপার সঙ্গে, কখনও নীহার বা শিরিন সুলতানার সঙ্গে সিনেমা দেখতে, রেস্টুরেন্টে খেতে-টেতে যায়। এদের মধ্যে কাকে চুমু খেয়েছে বা শরীরে কোথায় হাত দিয়েছে এ নিয়ে রসালো গল্প হয় লেডিস কমনরুমে। আমি এসব আলোচনায় কখনও অংশ নিইনি। যার সঙ্গে যা ঘটেছে তা নিয়ে তার আপত্তি-অভিযোগ না থাকলে অন্য কার কী বলার আছে!
সাফকাত সপ্রতিভ মানুষ, আমার কথায় প্রথমে একটু বিব্রত হলেও, স্বাভাবিক হতে দু এক মুহূর্ত সময় লাগল মাত্র, বলল, ‘ছবিটা ভালো, তাই বললাম।’
‘জানি, ডি-সিকার, ছবি। সোফিয়া লোরেন আর মার্সেনো মাস্ত্রোয়ানির বিখ্যাত জুটি। খুব ভালো ছবি, সময় করে দেখে নেব।’
‘আমার সঙ্গে যেতে আপত্তি কেন ? খেয়ে ফেলব নাকি ?’
হাসলাম, যাকে বলে পরিমিত হাসি, ‘খাওয়া-দাওয়ার কথা আসছে কেন ? তোমার সঙ্গে এখন যেতে চাই না, আমি আমার সময়মতো ছবিটা দেখে নেব। তা ছাড়া সত্যি বলতে কী, ছবিঘরের অন্ধকারকে আমি একটু ভয়ই পাই।’
খুব অপমান বোধ করেছিল। হাত বাড়ালেই পেতে অভ্যস্ত মানুষদের এই এক সমস্যা, না পেলে তারা পাগল হয়ে ওঠে। কলেজ জীবনের বাকি এক বছর আমার পেছনে প্রায় লেগেই ছিল। কিন্তু যত তার ছল-বল-কৌশলের তীব্রতা ততই শক্ত হয়ে উঠেছে আমার বর্ম!
বিশ্বাস করুন, সেই কম বয়সী মেয়েটাকে, তার মনোবল ও ব্যক্তিত্বকে এখনও সম্মান করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য কী জানেন, আমাদের জীবনটা বোধহয় নিয়তি নির্ধারিত! উচ্চ মাধ্যমিকের পর একটা মফস্সল শহর থেকে গিয়ে ঢাকায় আইবিএ ইনস্টিটিউটে ভর্তির ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়ে গেল একসঙ্গে দুজনেরই। মহাভারতের লক্ষণরেখার গল্পটি তো জানেন, নিয়তির প্ররোচনায় সেই লক্ষণরেখার বাইরে পা গেল আমার, আর ছদ্মবেশী রাবন পুষ্পকরথে তুলে নিয়ে গেল সীতাকে।
‘কী ভাবছেন আপনি ?’ জাহান ইয়ার সাহেব প্রশ্ন করলেন।
একটু চমকে উঠে ফিরে এলাম এই সময়ে। বিব্রতভাবটা কাটাতে উল্টো তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনিই বলে দিন না কী ভাবছিলাম, মানুষের মনের ভাষা তো পড়তে পারেন আপনারা।’
‘না না, মনোচিকিৎসকদের অতল জলের ডুবুরি ভাইবেন না। তবে চারপাশের ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে কিছু তো অনুমান করতে পারি, আপনি সাফকাত সাহেবের কথা ভাবছিলেন, তাঁর সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কথা।’
‘ঠিকই ধরেছেন, চলুন আপনার রোগী দেখে আসি।’
আমার কথায় খুশি হলেন ডাক্তার সাহেব, কারণ আমি বেঁকেও বসতে পারতাম। কবে কখন আমার সঙ্গে একটা বিশেষ সম্পর্ক ছিল সাফকাত সিদ্দিকীর, এর মধ্যে কর্ণফুলীর বহু পানি বঙ্গোপসাগরে গেছে, এই রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে সাহায্য করার কোনও দায় আমার কাঁধে নেই।
তিন তলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চমৎকার একটি কক্ষে ইজিচেয়ারে বসে ইংরেজি ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল সাফকাত। যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য থাকলে হাসপাতালও এ রকম অবকাশ-যাপন কেন্দ্রের মতো হয়ে উঠতে পারে!
চেহারাটা মলিন, রোগা ও বয়স্ক দেখাচ্ছে, চোয়ালের নিচেই বোধহয় গুরুতর আঘাত পেয়েছিল, একটু বেঁকে গেছে। আয়নার এই চেহারা সহ্য করা সাফকাতের পক্ষে কতটা দুঃসহ আমি অনায়াসে অনুমান করতে পারি। কিন্তু আমার ধারণা, এসবের আড়ালেও তার সুন্দর মুখশ্রী হারিয়ে যায়নি, দু বার তাকাতেই হবে। কী জানি, ভালোবেসেছিলাম বলেই এরকম মনে হচ্ছে কি না।
ডাক্তার সাহেব খুবই আন্তরিক গলায় হাঁক দিলেন, ‘কেমন আছেন সাফকাত সাহেব ?’
‘আরে, ডাক্তার সাহেব, আসেন। খুব ভালো আছি।’ কুশল বিনিময়ের সময় ‘ভালো আছি’র সঙ্গে ‘খুব’ শব্দটি যুক্ত করা সাফকাতের পুরনো অভ্যাস।
সোফায় বসে আছেন সাফকাতের আম্মা, তিনি এই ঘরে হঠাৎ আমাকে দেখবেন আশা করেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু তাঁর চেহারায় প্রসন্ন একটা ভাব ফুটল।
‘দ্যাখেন কারে নিয়া আসছি…।’
ডাক্তার সাহেব ম্যাজিক বাক্সের ওপর থেকে লাল কাপড়টা সরিয়ে নিয়ে সাফকাতের ভাবান্তর দেখতে চেয়েছিলেন হয়তো। কিন্তু সাফকাতের চেহারায় বিস্ময় নেই, আমার দিকে তাকিয়ে হাসল সে। হাসিতে সেই রমণীনিধন তীব্রতা নেই, শিশুসুলভ মায়াভরা হাসি।
‘চিনতে পারলেন ? বলেন তো কে ?’
‘চিনি তো, আগেও এসেছেন, এই হাসপাতালের ডাক্তার, নামটা মনে পড়ছে না।’
অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করলেও হতাশা দেখা গেল জাহান ইয়ারের চেহারায়। বুঝলাম, তিনি যতটা বলেছিলেন সাফকাতের অবস্থা তার চেয়ে অনেক খারাপ। সাফকাতের আম্মা মিসেস আয়েশা সিদ্দিকী আমার অনেকটা কাছে এসে নিম্নকণ্ঠে বললেন, ‘কী বলব মা, আমাকেই তো চিনতে পারছে না।’
আয়েশা ম্যাডামের মুখে ‘মা’ শব্দটি শুনে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হলো আমার। এই ভদ্রমহিলা সাফকাতের অনুপস্থিতিতে আমাদের ফ্ল্যাটে এসে আমাকে ‘বেশ্যা’ ডাকতে পর্যন্ত দ্বিধা করেননি। এখন তার অসহায় করুণ চেহারাটা রীতিমতো উপভোগ্য মনে হলো।
ওই কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার পর করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ডাক্তার সাহেবকে বললাম, ‘যাক, এবার তো আপনি শিওর হলেন যে আমাকে দিয়ে আপনার চিকিৎসাপর্বের কোনও উপকার হবে না…।’
‘এসব ক্ষেত্রে ঠিক শিওর হওয়া যায় না বুঝলেন, কয়েকবার দেখার পর হঠাৎ যে কোনও একটা স্মৃতিসূত্রে আপনারে তার মনে পড়ে যেতে পারে এবং সেই সূত্র ধইরা…। এটাকে আমরা বলি রিট্রাইভাল কিউ… পুনরুদ্ধার সূত্র বা সংকেত…। যেমন ধরেন আপনার একটা জামা আপনি খুঁজে পাচ্ছেন না, অনেক খোঁজাখুজি হলো…, হঠাৎ একদিন পুরোনো কাগজপত্রের মধ্যে পুরনো একটি লন্ড্রির সিøপ দেখে আপনার মনে পড়ে গেল, আরে এই জামাটাও তো ধুতে দেওয়া হইসিল লন্ড্রিতে… এই রকম আর কী।’
‘তার মানে আপনি চান আমি দিনের পর দিন আসব, আপনার রোগীর সামনে ঘুরঘুর করব, কখন তাঁর মনে রিট্রাইভাল কিউ… কী যেন বললেন, ও হ্যাঁ পুনরুদ্ধার সংকেত…, পুনরুদ্ধার সংকেত চাড়া দিয়ে ওঠে সেই অপেক্ষায় থাকব ?’
‘মানে, একটা চেষ্টা করে দেখা আর কী…।’
‘সরি স্যার। আমাকে দ্বীপ জ্বেলে যাই-এর নায়িকা ভাববেন না। আপনি নিজেই বলেছেন এইসব ইমোশনাল গল্পের সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া আমি একজন চাকরিজীবী মহিলা, সাফকাত সিদ্দিকীর মনে হারানো সুর জাগানোর মতো যথেষ্ট সময় নেই আমার।’
‘আপনাদের একটা সম্পর্ক ছিল…।’
‘হ্যাঁ এক বছর একসঙ্গে ছিলাম, তারপর আরও চার বছর পার হয়ে গেছে, সময়মতো বিয়ে করলে আমার দুটি বাচ্চা থাকত। এনাফ, ওই এক বছরের সম্পর্কের খেসারত আর দিতে চাই না।’
‘এখনও ভালোবাসেন তাঁকে ?’
‘প্রশ্নই ওঠে না, আই র্যাদার হেইট হিম।’
ডা. জাহান ইয়ার হাসলেন, হাসতে হয় না, তাঁর মুখটাই সবসময় হাসিখুশি। বললেন, ‘ওকে, ভালো থাইকেন, আমার দরজাটা খোলা থাকল।’
‘দরজাটা বন্ধ করে দেন স্যার।’ বলে সেদিন বেরিয়ে এসেছিলাম আমি।
কিন্তু ওই যে তাঁকে বলেছিলাম, ঘৃণা… ওই ঘৃণা থেকেই বোধহয় একটা তীব্র রাগ ও ক্ষোভ কিছুতেই ছাড়ছিল না আমাকে। বার বার মনে হচ্ছিল, সাফকাত সিদ্দিকীর সুস্থ হওয়া দরকার। এখন যাবতীয় বোধ-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে শিশুর আনন্দে দিন কাটছে তার। সুস্থ হয়ে উঠলেই দেখতে পাবে, কতটা অসহায়, কতটা নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ সে!
জানি, আপনারা গল্পটার পরিণতি টের পেয়ে গেছেন। তবু শেষ পর্যন্ত টেনে নেওয়ার একটা দায় আছে আমার। অফিস ছুটির পর নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলাম ইউনিভার্সাল হসপিটালে। সাফকাতের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করি। চেনা মানুষ, তার পছন্দ-অপছন্দ সব আমার জানা, অথচ সে আমাকে চিনতে পারছে না, আলাপ করে সত্যি খুব মজা পাচ্ছিলাম। একদিন সন্ধ্যায় এরকম আলাপ চলছিল, কক্ষে ডাক্তার নার্স বা সাফকাতের পরিবারের কেউ ছিল না, শুধুই আমরা দুজন। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বলল, ‘আপনাকে খুব মায়া লাগে, একটা চুমু খেতে ইচ্ছা করছে।’
আমি নিজের প্রতিক্রিয়া গোপন করে বললাম, ‘ইচ্ছা করলেই তো হয় না, এটাতে উভয় পক্ষের সম্মতি লাগে।’
‘আপনার সম্মতি নাই ?’
‘না।’
বিমর্ষ হয়ে গেল। যত যা-ই হোক, চিরকাল মেঘ চাইলে বৃষ্টি পেয়েছে, খারাপ তো একটু লাগবেই। এই মুহূর্তগুলোকে খুব উপভোগ করেছিলাম। এরপর আরও কয়েকবার তার শিশুসুলভ আবদার প্রত্যাখ্যান করেছি।
প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে যাওয়ার সময় ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে যেতাম, নানা বিষয়ে কথা হতো। কী আশ্চর্য, কেন যেন তাঁকে সাফকাতের এই বাড়তি আবেগগুলো সম্পর্কে জানাতাম না। আপনারা বলবেন, জানালে ভালো করতাম। ঠিক। একদিন কিছু মানল না। সবে চা শেষ করেছি, জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছিলাম। ডিসেম্বরে বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে যায়, হাসপাতালের আঙিনায় ল্যাম্পোস্টে জ্বলে উঠছে আলো। সাফকাত এসব কিছু দেখছে না, তার দিকে না তাকিয়েও আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম সে দেখছে আমাকে। হঠাৎ চড়াও হলো! সোজা মুখোমুখি এগিয়ে এসে পেছনে শক্ত হাতের বেড়ি দিয়ে সামনে টেনে নিল আমাকে। চুমু খেল। একটানে ব্লাউজের সব কটি বোতাম খুলল, বাম কাঁধ থেকে ব্রার স্ট্রাইপটা টেনে খুলে খামচে ধরল স্তন। আমি চিৎকার করার শক্তি হারিয়েছিলাম, নাকি আদৌ চিৎকার করতে চাইনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। হঠাৎ তার চোখ পড়ল দুই স্তনের মাঝখানে লাল জরুলটায়। মুহূর্তেই শিথিল হয়ে গেল হাতের মুঠো। তাকিয়ে রইল, নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। জলাশয়ে ডুব দিয়ে ওঠার পর মানুষ যেমন নতুন করে তাকায় পৃথিবীর দিকে, অনেকটা সে রকমই যেন ফিরে এল গভীর বিস্মরণ থেকে, বলল, ‘তুমি সানন্দা, তুমি তো সানন্দা…!’
আমি এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিলাম। ছুটে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম দ্রুত। পানির ঝাপটা দিলাম চোখে-মুখে। বেসিনের আয়নাটায় নিজের ক্রোধোন্মত্ত চেহারা দেখলাম। কাপড়-চোপড় ঠিক করে বেরিয়ে আসার পর করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি সানন্দা।’
আপাদমস্তক কেঁপে উঠেছিলাম। কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার আগেই দ্রুত বেরিয়ে এসেছি কক্ষ থেকে। একতলায় নেমে ডা. জাহান ইয়ারের চেম্বারে ঢুকে পড়লাম অনুমতি না নিয়েই। তাঁর মুখোমুখি চেয়ারে তখন বসে আছেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। দরজার কাছে আমাকে দেখে কিছু একটা অনুমান করলেন বোধহয়, নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। দরজার বাইরে এলে আমি তাঁকে বললাম, ‘কনগ্র্যাচুলেশনস স্যার, আপনার রোগী রিট্রাইভাল কিউ পেয়ে গেছে।’
সবিস্ময়ে তাকালেন আমার দিকে। আমার অভিব্যক্তিতে সম্ভবত দেখতে পেলেন আমার কথার পুনরাবৃত্তি। বললেন, ‘চলেন তো, একবার গিয়ে দেখে আসি।’
‘আপনি যান,’ আমি বললাম, ‘গল্পটা এমনিতেই পুরনো দিনের বাংলা সিনেমার মতো হয়ে পড়েছে, আমাকে সাফকাতের সামনে দাঁড় করিয়ে শেষ দৃশ্য তৈরি করার দরকার নেই।’
ডাক্তার তাকিয়ে আছেন, আমি একবারও পেছনে না তাকিয়ে করিডর ধরে এগোলাম।
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ