আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

পারভেজ হোসেন : ছায়াবৃক্ষ ও এক জলকন্যার গল্প

গল্পসংখ্যা ২০২৩

কবরস্থানের শেষ প্রান্তে বিষখালির ভাঙন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত এক শিলকড়ই। পাঁচজন লোক হাত ধরাধরি করেও এই কড়ইয়ের বেড় পাওয়া যায় না, এমনই অতিকায় সে। পার ভেঙে ভেঙে এমনভাবে শিকড়-বাকড় বের হয়েছে কেউ কেউ বলে এ বর্ষার বেপরোয়া স্রোতেও কোনওভাবে টিকে গেছে, পরের বর্ষায় মুখ থুবড়ে পড়বে নিশ্চিত! ওদের কথায় আস্থা রাখতে পারে না বেশির ভাগ মানুষ। তাদের বিশ্বাস এদিককার ভাঙন ঠেকিয়ে দেবে এই শিলকড়ই।

বাকলে ফাটল ধরে যেভাবে পাথর হয়ে আছে বৃক্ষটি কবেকার তা কেউ আন্দাজ করতে পারে না। চারদিকে ছড়ানো শ্যাওলা জমা মস্ত ডালগুলোও তেমন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নদীর এই নির্জনে এটিকে তো এভাবেই দেখে আসছে সবাই।

সন্ধ্যার অনেকটা আগে থেকেই কড়ইতলার শেকড়ে নাও বেঁধে আশপাশটায় ঘুরঘুর করছে কেরায়া নাওয়ের মাঝি মকবুল। তার দোস্ত খায়রুল আসছে না দেখে ব্যাপক অস্থিরতার মধ্যে আছে সে। খায়রুল আরও দুজনের জন্য অপেক্ষা করে করে বড় রাস্তার দিকে গেছে সেই কখন।

একটু আগেই বড় রাস্তার ওপারের মসজিদে ভাঙা ভাঙা গলায় মাগরিবের আজান দিয়েছেন মুয়াজ্জিন। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর থেকেই কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে জ্বাল দিতে থাকা দুধের ফেনাভাঙা সরের মতোন। ঘুটঘুটে অন্ধকারের চাদর ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছে সব। থমথমে কবরস্থানের কাঁটাঝোপে, খানাখন্দে বিচিত্র স্বরে ডাকতে শুরু করেছে হাজারো পতঙ্গ। শেয়ালগুলো গর্তের বাইরে এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নির্ভয়ে লোকালয়ের দিকে সরে গেছে। থেমে গেছে কড়ইগাছে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য পক্ষীর হল্লা। কেরায়া নাওয়ের মাঝি মকবুল এবং নানকের দুখান নাও ছাড়া এই ঘোর সন্ধ্যায় কড়ইতলার ঘাট এখন বুকে ভয় ধরানোর মতোই বিরান।

শহরের শেষ প্রান্তের এমন বিরানে বিষখালির এই ভাঙা পাড়, জলের দাপটে ভাঙতে ভাঙতে কড়ইতলায় এসে থেমেছে―অতীতে এই ভাঙন কোথায় ছিল, কত দূরে ছিল, সেই ইতিহাস কেউ খুঁজে দেখেনি কোনও দিন। দেখার প্রয়োজনও বোধ করেনি। নানা জনে আনাড়ি আন্দাজে মনগড়া নানা কথা বলে। অপরিচিত যারা প্রথম এদিকে আসে বৃক্ষটির আকার-আয়তন দেখে একেবারে ভিরমি খায়, একটা অনুমান নিয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে―নিদেনপক্ষে সাত-আট শ বছর তো হবেই বয়স!

ভাটি-বাঙ্গালার ভাঙা-গড়ার এই জনপদ চিরকালই এমন ইতিহাসবিমুখ। তবে এখনকার নদীপাড়ের বয়স্ক মানুষজন কখনও যদি বাড়ির দাওয়ায় বসে হুঁকো টানতে টানতে তাদের পূর্বপুরুষের কেচ্ছা তোলে, বলে, ‘বাপ-দাদায় যেই বিষখালির কতা কইত, হেই গাঙ কি আর আছে! এই পাড়ে খাড়াইয়া হেই পাড়ে কিচ্ছু ঠাহর অয় নাই, এমনই হেই গাঙ! আর কী যে সোত, আর কী যে ঢেউ হেই গাঙ্গের!’

তখনকার বিষখালিতে যেই স্রোত থাকত, যেরকম ঢেউই উঠত আজ আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবু আজকের বিষখালি এখনও বিষখালিই।

জলের স্রোতে নদীটার ভাঙা পাড়ের এঁটেল মাটি ভাঙতে ভাঙতে প্রাচীন এই শিলকড়ইয়ের কয়েকটি বিকট শিকড় আর ওই শিকড়ের বিস্তর ডালপালা বার করে দিয়েছে। বাতাস বেড়ে গেলে, বিশেষ করে বর্ষায় নদীর জলের উল্লাস এসে আছড়ে পড়ে ভাঙা পাড়ের খাড়িতে, গাছটার শিকড়ে। কিন্তু এই পার এখন আর ভাঙে না। কিছু মানুষের বিশ্বাস শিলকড়ই বৃক্ষই থামিয়ে দিয়েছে এদিককার ভয়াবহ ভাঙন।

আচ্ছা, শিলকড়ই কি আছড়ে পড়া জলের ওই উল্লাস অনুভব করে ? সে কি আমোদিত হয় কিংবা ব্যথিত ? তার শিকড় থেকে দড়ির বাঁধন খুলে কে কখন কোন উদ্দেশ্যে কোন দিকে নাও ভাসায় বা নাও এনে বাঁধে―কারা এসে তার ছায়ায় বসে, সময় ফুরিয়ে গেলে আবার চলেও যায়―সবার মনের খবর কি সে রাখে ? কিছু মানুষের বিশ্বাস শিলকড়ই সব খবরই রাখে। শত বছরের শত লক্ষ সাক্ষ্য নিয়ে নীলকণ্ঠ সে― সময়ের ছবির মতোই সুস্থির এক ছায়াবৃক্ষ।

কড়ইতলার এই ঘাট কোনও প্রতিষ্ঠিত ঘাট নয়। কবরস্থানের দেয়াল ঘেঁষে পায়ে দলা একটা ক্ষীণ পথ জেগে উঠেছে। সেই পথ ধরে আসা নদীপাড়ের হাওয়া খোঁজা মানুষের বিরামের একটা নির্জন জায়গা কোনও এক কালে নাওঘাটে রূপান্তরিত হয়েছে। আসল ঘাট এখান থেকে পোয়া মাইল উত্তরে। ঘন গাছপালার ওধারে। সেখানে ভেড়ানো আছে বিরাট দুটি জেটি। তার একটা অন্যটার চেয়ে কিছুটা ছোট। জেটির পাশেই অসংখ্য সিঁড়িযুক্ত শানবাঁধানো পাকা ঘাট―নানা পদের মানুষের আড্ডা সেখানে। গোসল করা, কাপড় কাচা, যাবতীয় ধোয়াধুয়ির হুল্লোড়ে, ঠেলাঠেলিতে সব সময় অস্থির হয়ে থাকে।

বড় জেটিটায় স্টিমার ছাড়া আর কিছু ভেড়ে না। ছোটটায় ভেড়ে লঞ্চ আর ট্রলার। কেরায়া আর ডিঙ্গি নাওগুলো নিয়ে মাঝিরা জেটির কাছাকাছি প্রায় দশ-বিশ হাত জলের তলায় লগি কুপে ভেসে থাকে। লঞ্চ, স্টিমার কিংবা কোনও ট্রলার এলেই লগি তুলে ঢেউ ওঠা জলে মোচার খোলের মতো দোল খেতে খেতে ওগুলোর গায়ে গিয়ে ভেড়ে। তখন কে কোন যাত্রী থুয়ে কোন যাত্রীর মালসামান ধরবে, তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় হাঁকডাক আর দরাদরি।

কিন্তু কড়ইতলার এই ঘাটে ওসবের বালাই নেই। শান্ত, নিভৃত, প্রায় জনমনুষ্যহীন নদীর কাঁধারে এই কড়ইয়ের ছড়ানো শিকড়ে দড়ি বেঁধে গুটিকয় নাও যদিবা থাকে, তাদের কারও কারও উদ্দেশ্য সমাজলগ্ন নয়। যারা জানার, তারা এসব জেনেও শর্টকাট রাস্তা ধরতে নাও নিয়ে ঘাটে ভেড়ে। আবার নাও ছেড়ে চলে যায়। কেউ কেউ এসে নদীর হিমেল হাওয়ায় কড়ইয়ের ছায়ায় নিরিবিলিতে কাটিয়ে যায় কিছুক্ষণ।

এখান থেকে দক্ষিণে, ওই যে দেখা যায় ভাঙন শেষ হয়ে চর পড়েছে যেখানটায়, তার থেকে একটু এগিয়ে কৈবর্তপাড়া। ধীবরদের গ্রাম। ওটাকে গ্রাম বলাটাও অন্যায়। কারণ, নদীর জল ছুঁয়ে বাঁশ পুঁতে কিছুটা উঁচুতে ঘর তুলে আদিম অকৃত্রিম ভঙ্গিতে অনেককাল ধরেই তারা ওখানটায় বসবাস করছে। বংশপরম্পরায় মাছ ধরে আর মাছ বেচে নিজেদের কর্মপরম্পরা বজায় রেখে চলেছে। তাই তাদের ছোট্ট পাড়াটাকে আর যা-ই হোক, কেউ গ্রাম বলতে চায় না।

ওই পাড়ার নীলরতনের বিধবা মেয়ে কুসুমকুমারী। ছেলেবেলায় সাহায্য সংস্থার স্কুলে প্রাথমিক শেষ করেছিল সে। গায়ের রঙটা একটু কালো হলেও ভয়ানক সুশ্রী কুসুম। ছিপছিপে বাঁশের মতো টনটনা তার শরীর। মাথাভরা দীর্ঘ ঘন চুল। চোখ দুটোও যেমন তীক্ষè, তেমনি তার চটক। যখন সে মাথার ওপর মস্ত খোপা বেঁধে, কপালে একটা টিপ লাগিয়ে ওই চোখের পাপড়িতে কাজলের রেখা টানে―যেদিকে তাকায়, বুঝি-বা বিদ্ধ করে ফেলে।

এই ঘোর সন্ধ্যায় একজনকে সঙ্গে নিয়ে এদিকেই পথের ধারে ছায়া হয়ে সেই কখন থেকে অপেক্ষায় আছে খায়রুল। বড় রাস্তা পেছনে ফেলে কবরস্থানের বাঁ-দিক থেকে কুতকুতে ঘনায়মান আঁধার ঠেলে কড়ইতলার ঘাটের দিকে হনহনিয়ে আসতে দেখে সে কুসুমকে। ওকে লক্ষ করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় দুজন। মুখোমুখি হতেই নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তার পর কবরস্থানের পথটুকু নীরবে পার হয়ে গাঙের পারে আসে তারা। শিলকড়ইয়ের শিকড় ধরে সাবধানে অপরিচিত লোকটাকে নিয়ে বরাবরের মতোন মকবুলের কেরায়া নাওখানায় গিয়ে ওঠে কুসুম।

হারিকেন ধরিয়ে দিয়ে মকবুল নাও থেকে নামতেই দড়ি খুলে পাকা মাঝির মতো বৈঠা বেয়ে নিস্তরঙ্গ মাঝগাঙের দিকে এগিয়ে চলে কুসুমকুমারী। কাঁধার থেকে ওই দূরে অন্ধকারে ভেসে চলা নাওখানাকে একটা আলোর ফুটকির মতো লাগে। আঁধারে এমন গাঙে নাও বাওয়া সোজা কথা নয়। কিন্তু নারী হোক কী পুরুষ কৈবর্তপাড়ার কিংবা এদিককার যে কেউই এইটুকু বাওয়া-বাওয়িতে অভ্যস্ত। অন্য নাওখানা তখনও ঘাটে বাঁধা। ওই নাওয়ের মাঝি নানকও খদ্দেরের অপেক্ষায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আশপাশে কোথাও।

এতক্ষণে মাঝগাঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নাওয়ে এবং কৈবর্তপাড়ার ঘরে ঘরে, যদি ওগুলোকে ঘর বলি, কুপি আর হারিকেনের আলো পিটপিট করতে শুরু করেছে। বৈদ্যুতিক বাতির যত রোশনাই জ্বলজ্বল করছে উত্তরের ওই জাহাজঘাটে। ঘাটের ওপরে টাউনে।

দূরদূরান্তে ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত লঞ্চগুলোর সার্চলাইটও একটু পরপর জ্বলছে আর নিভছে। কুসুমের নৌকা উত্তর দিকে গিয়েছে বলে মনে হয় না। মাঝগাঙের দিকে গিয়ে নোঙর ফেলে অন্য নাওয়ের আলোর ভিড়ে হারিয়ে গেছে। চারিদিকে মিশমিশে অন্ধকার। এমন অন্ধকারে কিংবা চাঁদ উঠলে তার ফকফকা জোছনায় শিলকড়ইয়ের ঘাট থেকে এমন নৌযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক, প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা।

ঘণ্টা দুয়েক পর কুসুমের নাও যখন ফিরে আসে, তখন কৈবর্তপাড়ার অনেক আলোই নিভে গেছে। আসলে সন্ধ্যার পর কাজকর্ম সেরে রাতের আহারের পর থালাবাটি গোছানো হলে এরা যখন শুতে যায়, মা যখন দুধের বোঁটা মুখে পুরে দিয়ে শিশুকে ঘুম পাড়ায় কিংবা আলোর শিখাটি নিভিয়ে স্বামীর সঙ্গে সহবাস শেষে ক্লান্ত রমণী শিথানের বালিশে চোখ বোজার চেষ্টা করে, তখন কতই-বা আর রাত!

তা রাত যা-ই হোক, নাওখানা শেকড়ে বেঁধে হারিকেনের মøান আলোয় টাকাগুলো গুনে নিয়ে সঙ্গীটিকে ছেড়ে দেয় কুসুম। আলো নিভিয়ে নিজেও ধীরে ধীরে উঠে আসে নদীর জল-হাওয়া আর গাঢ় অন্ধকার গায়ে জড়িয়ে। ওদিকে কবরস্থানের দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকছিল খায়রুল আর মকবুল। তাদের একজন আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটে শেষ দু টান দিয়ে মুথাটা ছুড়ে ফেলে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে ঘাটের দিকে। কুসুম এই অন্ধকারেও বুঝতে পারে ছায়াছায়া ও আর কেউ নয়, মাঝি মকবুল। ওকে নাওয়ের ভাড়াটা বুঝিয়ে দেয় সে। ঘাটের অন্য নাওটি এখন আর ঘাটে নেই। ওই নাওয়ের মাঝি নানক আছে হয়তো আশপাশেই।

মকবুল যখন এগিয়ে এসেছে তার সঙ্গী খায়রুল খদ্দেরটিকে বিদায় করে গোরস্থানের দেয়ালের ওদিকে দাঁড়িয়ে এখনও সিগারেট টানছে। এইটুকু দূর থেকে ওকে চেনার উপায় না থাকলেও কুসুম জানে ওখানে আছে খায়রুল।

বছর দেড়েক আগের এক ঘূর্ণিঝড়ে কোথা থেকে উড়ে আসা কোনও একটা চালের টিনে গলাটা দু ভাগ হয়ে গেলে কৈবর্তপাড়ার তাগড়া জোয়ান সোমেন তখনই প্রাণ হারায়। সেই ঝড় তো থেমেছে কিন্তু ছয় মাসের শিশুটিকে নিয়ে সদ্য রাঁড়ি হওয়া কুসুম কী করবে তখন ? দিন আর চলছিল না তার। বাবার ঘরেই উঠতে হয়েছে শেষে। বুড়ো বাবা নীলরতন প্রতিদিন যেটুকু মাছ ধরে আনে, তাই নিয়ে খুব ভোরে বাজারে গিয়ে এক বেলা মাছ বেচে আসে কুসুম। এতে বুড়ার সময় যেমন বাঁচে, জানও বাঁচে। খায়রুলের সঙ্গে ওই মাছের বাজারেই পরিচয় কুসুমের।

কৈবর্তপাড়ার বা আশপাশের ছেলে নয় খায়রুল-মকবুল। টাউনের কাছের বাজারের ছেলে। খদ্দের ভজিয়ে নিরাপদে এনজয় দেওয়ার যেটুকু ব্যবস্থা দরকার, সব করে দিয়ে দু পয়সা রোজগারের আশায় অভাবে পড়া যুবতী মেয়েগুলোকে হাত করাই ওদের ধান্দা। এতে যার যার দিক থেকে লাভ তিন পক্ষেরই। এই লাভের মোহে সমাজের ভয়, পুলিশের ভয় বাঁচিয়ে, আগ-পিছ না ভেবে কেউ পেটের দায়ে, কেউ শরীরের টানে এমন অভিনব পন্থায় নেমে পড়েছে।

কলার ঝোপটা পেছনে ফেলে কবরস্থানের ছাতলা পড়া দেয়াল ধরে খায়রুলের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় কুসুম, ‘ওই বদ ব্যাডারে আর আনবা না কইলাম। মাইয়ামানুষ পাইলেই অইছে! শুয়ারের বাচ্চা একখান। হারামির হারামি, বজ্জাত ব্যাডা!’ বলেই আঁধার ধরে হনহন করে বেসামাল হাঁটতে থাকে সে।

‘ক্যান ক্যান, হ্যায় কী হরছে ? কঅ না মোরে।’ তড়ড়িয়ে এ কথা বললেও অকস্মাৎ কুসুমের ঝামটা খেয়ে থতমত খায়রুল। কী বলবে বুঝতে না পেরে মেয়েটার পিছু ধরে। বলে, ‘অরে শ্যাতাইয়া রাখমুআনে। অসুবিধা নাই, বুঝামুআনে।’

অন্ধকারে লতাপাতা সরিয়ে পায়ে দলা পথ পার হয়ে বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে বড় রাস্তায় উঠে আসে দুজনে। হাঁটতে হাঁটতেই খায়রুল মিনমিনিয়ে বলে, ‘তোর বাসনায় তো ব্যাডায় এক্কেরে পাগল অইছে রে, কুসুম। কাইল না অইলে পশশু আবার আইতে চায়, কমু ?’

চলতে চলতেই আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে কাজলটানা চোখ দুটো তুলে কটমট করে তাকায় কুসুম। এই আঁধারে কথা ছাড়া আর কিছুই তো ফোটে না চোখে। ফুটলে খায়রুল বুঝত কী ছিল ওই চাউনিতে। সে নিরুপায়ের মতো আবারও জিজ্ঞেস করে, ‘কী, কমু ?’

‘না, কওনের কাম নাই। পোলাডার গা-খান গরম দেইখ্যা আইছি আইজ। আমি যাই।’

কুসুমের চলার গতি ক্ষিপ্র হলেও পিছু ছাড়ে না খায়রুল। সে-ও পা চালিয়ে পিচঢালা বড় রাস্তায় উঠে এসে পথ আগলায়, ‘টাহা তো কম দেয় নাই ত-রে, কথায়-কামে ফারাক তো করে নাই মান্নানে। না করিস না কুসুম।’

‘ধোয়া তুলসী অউক, অর লগে হুমু না।’

‘টাহা বাড়াইয়া দিতে কমুআনে। তা-ও চেতিছ না তুই।’

কিছুতেই বিষয়টা পরিষ্কার হয় না খায়রুলের কাছে। দ্রুত পা ফেলে ছোড়ভঙ্গ হয়ে চলে যায় কুসুম। ওর যাওয়ার পথে বেকুবের মতো হাঁ করে যে তাকিয়ে থাকবে, সে উপায়ও তো নেই, এখন এতই অন্ধকার।

এরই মধ্যে মকবুল এসে খুঁজে পায় খায়রুলকে। গাঙের কাঁধারে ফুরফুরে হাওয়ায় কিছুটা সময় জিরিয়ে নিতে চায় তারা। কড়ইয়ের একটা শিকড়ে গিয়ে বসে সিগারেট ধরাতে চায়।

বড্ড শান্ত গাঙ। ঝিরঝিরে হিমেল হাওয়া জলের ওপর ঝালর মেলে উড়ে উড়ে আসছে। গাঙজুড়ে অসংখ্য নাওয়ের বাতি জ্বলছে আকাশের তারার মতো পিটপিট করে। সবই এদিককার ধীবরদের নাও, দিনে তো ধরেই, রাত জেগেও মাছ ধরে ওরা।

গাঙের অপর পারে, শিয়ালকাঠির গ্রামগুলোর পেছনে গাছপালার মাথায় একটু পরই আকাশ আলো করে মাখনের মতো আলতো হলদে রঙের চাঁদ উঠবে। তখনও কি শিলকড়ইয়ের শিকড়ে পাছা ঠেকিয়ে বসে থাকবে দুজনে ? এভাবে বসে থাকলে বোচা ব্যাপারির আখড়ার ঝাঁপ আটকানোর সময় হয়ে যাবে যে! তার চেয়ে ওর ওখানে গিয়ে কোকা-কোলা মিশিয়ে দু-চার পাত্র বাংলা-জল গলায় ঢালুক না গিয়ে। গলা না ভিজিয়ে এই অবেলায় বাড়ি ফিরলে মাগির দালালের কি জাত থাকে!

মকবুলের মতো খায়রুলের মাথায় কিন্তু ওসব খেলছে না এখন। বরং সে সিগারেটে একটা জোর টান দিয়ে কুসুমের ব্যাপারটা নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে থাকে। মনে মনে বলে, ‘ও মোর খোদা, পুরা পেলানডা গোছাইয়া আনার আগেই কেমন একখান প্যাঁচ লাগাইয়া গ্যালে মাগি! এহন উপায় ?’ মকবুলকেও তো এখনও তার প্ল্যানের কিছুই খুলে বলেনি সে। তবে বলবে, সময়মতো সবই গুছিয়ে বলবে। খালেক চেয়ারম্যানের পোলা মান্নানের কাঁচা মাংস খাওয়ার হাউসখান এইবার জানভরেই মেটাবে।

বোচা ব্যাপারির আখড়ায় বাংলা মদ খেয়ে নেশাটা আজ বেজায় বেসামাল হয়েছে ওদের। ঢ্যাংঢ্যাঙা মকবুলেরও নিত্য যা হয়, বাঁশের কঞ্চির মতো লকলক করছে সে। পা দুটোকে কোনওমতেই সামাল দিতে না পেরে হোঁচট খাচ্ছে আর মা-বাপ তুলে গালি দিচ্ছে সে। কার মা-বাপকে যে গালি দিচ্ছে তা সে-ই জানে। অকথ্য, অশ্লীল সে ভাষা, বিশ্রী তার বয়নভঙ্গি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হিক্কা উঠছে। প্রতিটি হিক্কায় বাংলা মদের সঙ্গে খাওয়া ঝাল মেশানো কাঁচা ছোলার চিবানো দানা গলার কাছে উঁকি মারছে। 

খায়রুলের তেমন কিছু হচ্ছে না। সে গুম হয়ে হাঁটতে থাকে। মোষের মতো গাঁট্টা-গোট্টা শরীর। খাটো ঘাড়ের ওপর মস্ত একটা মাথা তার। এমন শরীরে ভালো-মন্দ সবই সয়। কিন্তু বেসামাল নেশা হলেও আজ কেমন থম ধরে আছে সে। যেন ভেতরটাজুড়ে ঝড় উঠবে একটা, এ তারই পূর্বাভাস।

চান্দের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে ওরা মান্দার খালের পুলের ওপর এসে দাঁড়ায়। পুলের নিচে কুলকুল করে ভাটার জল নামছে এখন। পুল পার হয়ে আর একটু এগোলেই চৌরাস্তার চক্করের পর খায়রুলদের বাড়ি, তার কিছু দূরেই মকবুলদের। এতক্ষণে মকবুল নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে বলে মনে হয়। যতই পান করুক না কেন, বাড়ির কাছাকাছি এলে প্রতিদিনই ও নিজেকে কীভাবে যেন সামলে নেয়। এ এক অদ্ভুত ম্যাজিক মকবুলের। সেই ম্যাজিকের জোরে ও এখন নিজের পায়ের ওপর অনায়াসেই দাঁড়াতে পারছে। খায়রুল একটা সিগারেট ধরিয়ে মকবুলকে দেয়। বলে, ‘একখান পেলানের কতা কিন্তু তোমারে কই নাই দোস্ত। অহন কমু, মন দিয়া হোনবা।’

মকবুল সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলে, ‘কও দোস্ত, হুনি তোমার পেলান।’

শরীরজুড়ানো জোর হাওয়া দিচ্ছে এখন। সেই হাওয়ায় কান পেতে থাকে মকবুল। খায়রুল বলে, ‘মান্নানরে খতম করতে অইবে। ডরাইও না, কোনও রক্তারক্তির মধ্যে যামু না।’

বুকের ভেতরে বুঝি একটা গজাল ঠুকে দিল খায়রুল! ঘাই খেয়ে আঁতকে ওঠে মাঝি মকবুল, ‘কও কী মেয়া!’

তার নেশা এবার পুরোপুরি ছুটে যেতে চায়। চোখ কচলাতে কচলাতে বলে, ‘ক্যান, হালার পো হালায় হরছেডা কী ?’

‘তোমারে আমারে কিচ্ছু করে নাই, দোস্ত। তয় যারে করোনের, তারে করছে। অনেক ওপরের ইশারায় অইতে আছে এই কাম। বোঝঝো ?’

অনেক ওপরের ইশারার মানে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারে মকবুল। ফকফকে জোছনার ছটায় মুখখান বেজার রেখেই প্ল্যানের গভীরে কী আছে বোঝার আগ্রহ দেখায় সে। বলে, ‘তোমার লগে মান্নানের এত পিরিত! খাতির-যত্ন কইর‌্যা আইজ কুসুমের লগে হোয়াইলা ?’

‘হঅ, হোয়াইছি, কুসুমের রক্ত খাওয়াইছি। এইডাও অইছে ওই পেলান। মাগনা তো আর না। তা ছাড়া খাতির যেটুক আছে, তা তো আছেই, তাতেই-বা কী ? মোগো কাম মোরা করমু। হ্যায় কি মোর মায়ের প্যাডের ভাই, নাকি তোমার নাহান জানি দোস্তো, অ্যাঁ ?’ বলেই শার্টের ভেতর দিকের চোরা পকেট থেকে রবারে প্যাঁচানো পাঁচ শ টাকার অনেকগুলো নোট বের করে মকবুলের হাতে ধরিয়ে দেয় খায়রুল। বলে, ‘মোর পেলানমতো খালি কামডা সাজাইবা দোস্তো, ব্যাস। তোমার নাওয়ের দামসহ আরও পাইবা।’

খায়রুলের এমন অবিশ্বাস্য-আজগুবি-ভাওছাড়া কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিতে থাকে মকবুলের। তারপরও এই পরিমাণের টাকার গন্ধ এবং বিগত দিনে দেখা বন্ধুর নিষ্ঠুর চরিত্রের নানা কীর্তি মনে করে নীরবে সায় দিয়ে মাথা নাড়ায় সে। বলে, ‘আইচ্ছা, তুমি য্যামনে কইবা।’

কেননা, একবার যখন মুখ ফুটে এমন কথা বলেই ফেলেছে খায়রুল, তাকে জড়িয়ে প্ল্যান করেই ফেলেছে, রাজি না হয়ে এমন একটা বিষয় থেকে সরে দাঁড়ানোর কোনও উপায় নেই তার। তবু একটা হিজিবিজি পরিস্থিতির মুখে পড়ে অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে জানতে চায় মকবুল, ‘কিন্তু ব্যাপারখান যে বুঝলাম না, খুইল্যা কবা তো, না-কি ?’

ওর পিঠে ঠান্ডা হাত রাখে খায়রুল। শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘এত অধৈর্য অইও না, দোস্তো।’ একটু সময় নিয়ে আবার বলে, ‘তোমার নাওয়ের পাটাতনের নিচে খান বিশেক ইট রাখবা, বোঝঝো ? দুই-চাইরখান বেশিও রাখতে পারো। আর নাওয়ের তলায় একখান ফুডা বানাইয়া সোলা হান্দাইয়া থোবা। কাকপক্ষীও য্যান ট্যার না পায়। কুসুম নাও ছাড়ার আগে কায়দা কইর‌্যা সময় বুইঝঝা সোলাখান খালি তুইল্যা নিবা তুমি, ব্যস। হাঁতার জানে না তো মান্নানে। হালায় তো কুসুমের গন্ধে আউলাইয়া থাকপে। আধা ঘণ্টাও লাগবে না। যারে কয় সলিলসমাধি।’

বলে কী ? খায়রুলের প্ল্যান শুনে তব্দা ধরে যায় মকবুলের দেমাগে। সে ওর দিকে বেকুবের মতোন হাঁ করে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘আর কুসুম ?’

‘খ্যামতা থাকলে হাঁতরাইয়া উঠবে, না অইলে আরও একটা সলিলসমাধি।’ খুব নির্বিকারভাবে বলে খায়রুল।

দু দিনের মধ্যেই কুসুমকে ভজিয়ে ফেলে ছেলেটা। মান্নানকেও পইপই করে স্যাঁতিয়েছে, যাতে কুসুমের অবাধ্য সে না হয়। নায়ে ওঠার আগেও খায়রুল বলে, ‘কুসুম কিন্তু মোর দিদি, কতাডা মাতায় রাইখ্যেন, মান্নান ভাই।’

শিলকড়ইয়ে আশ্রয় নেওয়া পক্ষীকুলের হল্লা থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। এখন কেবল টাপুর টুপুর বিষ্ঠা ঝরছে। কবরস্থানের ওদিকটায় কথা বলতে বলতে কারা যেন এদিকে আসছে। আঠালো অন্ধকারে আজ নিজের হাতে নাওয়ের দড়ি খুলে দেয় মকবুল। হাঁটুজলে নেমে অন্য দিনের তুলনায় কিছুটা ভারী নাওখানাকে ধাক্কা দিয়ে গাঙের মধ্যে ঠেলে দেয়। জলের ভেতর পেট ডুবিয়ে নাওখানা কড়ইয়ের শেকড়বাকড় ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে মাঝ গাঙের দিকে সরে যেতে থাকে।

বিষখালির ওপারে শিয়ালকাঠির গ্রামগুলোর গাছপালার পেছনে চাঁদ উঠতে এখনও অনেক দেরি। বইঠা ধরার আগে দেশলাইয়ের কাঠি ঠুকে এখন হারিকেনটা জ্বালিয়ে নেবে কুসুম।

কেমন করে যে একটা সপ্তাহ কেটে গেল! পাঁচ দিন আগে নতুন একখানা নাও কিনেছে মকবুল। নাও কেনার পর থেকে খায়রুলের আর কোনও খোঁজ নেই। কড়ইতলায় এসে খদ্দের ধরবার জন্য একা একা ঘুরঘুর করে মকবুল। তা ছাড়া আবহাওয়া খারাপ থাকায় গত দু দিন তো এদিকে আসেনি সে।

বুকের ভিতর একটা অস্থিরতা নিয়ে নদীর কাঁধারে কড়ইয়ের শিকড়ে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে একখান সিগারেট ধরায় মকবুল―খায়রুল কি তবে গা-ঢাকাই দিয়েছে ? তা তো হবার কথা নয়। তেমন কিছু হলে তাকে একখান ইশারা না দিয়ে ভাগবে, এমন ভোদাই ছেলে নয় খায়রুল। ব্যাপারখানা তবে কী ? ভ্যাজালখানা কোথায় ?

খায়রুলের কোনও খোঁজ না পেয়ে কয়েক দিন ধরে ভয়ে ভয়ে এমন উল্টাপাল্টা অনেক কিছুই ভেবে যাচ্ছে মকবুল। আজ এখন তেমন করে ভাবতে ভাবতেই গাঙের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে আকাশ কালো করে চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, হুঁশেই আসেনি তার―‘আইজও কি বিষ্টি নামবে ? বালের কার্তিক-অঘ্রানে আসমানের এই ভাবগতিক কারই-বা ভালো লাগে!’ মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে সিগারেটের মোথাটা গাঙের জলে যেই ছুড়ে ফেলবে, ঠিক তখনই কাঁধের ওপর কাচের চুড়ি পরা মেয়েমানুষের একখানা হাতের স্পর্শে আঁৎকে উঠে পেছন ফেরে মকবুল। ফিরে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায় সে। বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠতেই একটা দুঃস্বপ্নের মতো দেখে, খায়রুলকে ছাড়াই কৈবর্তপাড়ার মেয়ে কুসুমকুমারী এসেছে একখানা নতুন শাড়ি পরে। তার চোখে কাজল, কপালে টিপ। চেয়ারম্যানের পোলা মান্নানও এসেছে সঙ্গে। তারা নাও ভাড়া করবে।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button