আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

জাকির তালুকদার : এক ঘণ্টার ভারততত্ত্ব

গল্পসংখ্যা ২০২৩

বইমেলা থেকে বেরিয়ে তারা তিনজন খুচরাখাচরা কথা বলতে বলতে রাজু ভাস্কর্য, ঘামতে থাকা র‌্যাব-পুলিশ-আনসার, রিকশা আর সিএনজি, ফুলের ব্যান্ড বিক্রি করা মেয়েদের দল, সিগারেটের হকার, চায়ের দোকানগুলো ঘিরে থিকথিকে লোকের ভিড়, আর্ট ইনস্টিটিউট, শাহবাগ থানা, মিউজিয়াম, শাহবাগ মোড়ের ভিড়ের ভেতর দিয়ে বাউলি কেটে কেটে হেঁটে অবশেষে আজিজ মার্কেটের পশ্চিম কোনায় বুবুর চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে ঠ্যাং মেলে বসে কয়েক দিন ধরে চলে আসা বিতর্কটি নিয়ে কথা বলতে থাকে।

পুরনো বিতর্কটি নতুন করে চাগিয়ে উঠেছে।

আসলে যার কোনও স্থায়ী সমাধান হয়নি, কোনও রকমে চেপেচুপে রেখে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেটি তো মাঝে মাঝে চাগিয়ে উঠবেই। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তুলবে, কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে তুলবে, আবার কোনও ঘটনার সূত্র ধরে উঠে আসবে। এখন যেমন উঠেছে। বাংলাদেশের লেখকেরা প্রতিযোগিতায় পারবে না, সেই ভয়ে নাকি বইমেলায় ইন্ডিয়ান বই ঢুকতে দিতে চায় না।

লম্বায় খাটো যুবক সবচেয়ে লম্বাজনকে উদ্দেশ্য করে বলল―তুই তো আহমদ ছফার সঙ্গে বুকে পোস্টার সেঁটে বইমেলায় ভারতীয় বই ঢোকার বিরুদ্ধের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলি। তখন কী ছিল তোদের উদ্দেশ্য ?

তখন আমরা পিচ্চি। ভার্সিটিতে কেবল ভর্তি হয়েছি। ছফা ভাই শওকত ওসমানকে ডেকে নিয়ে ঢাকার বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরেছিলেন। দেখিয়ে বলেছিলেন যে দ্যাখেন, সব কলকাতার বই। যেসব লেখকের বই দেখছেন, তারা কেউ আপনার মানের লেখক নয়। অথচ আপনার কোনও বই কোনও দোকানের র‌্যাকে নেই। দেশটাকে কি আমরা … ছিঁড়তে স্বাধীন করেছি ?

পরে ছফা ভাই একদিন টিএসসির সামনে কিছু লোক নিয়ে মিটিং করলেন। আমিও গেছিলাম। ছফা ভাই বললেন―বড় পুঁজি ছোট পুঁজিকে গিলে খায়। কলকাতার প্রকাশকদের বড় পুঁজি বাংলাদেশের ছোট্ট… কতখানি ছোট… এই ধরেন কিশোরী মেয়ের বুকে কেবল বুনি দেখা দিচ্ছে… এইরকম ছোট্ট মেয়েকে ধর্ষণ…। আমরা কি সেটি ঘটতে দিব ?

ছোট পুঁজির উপমা শুনে তিনজনেই হো হো করে হেসে উঠল। এমনকি অন্য যে কয়জন চা-খোর বসেছিল ওখানে তারাও যোগ দিল হাসিতে। মায় বুবু এবং তার ফাই-ফরমাসখাটা পিচ্চিটাও।

তা এখন যে আবার সেই ইস্যু নতুন করে উঠছে! এত বছর পরে, যখন মীমাংসিত হয়ে গেছে যে একুশের বইমেলা কেবল বাংলাদেশের লেখক-প্রকাশকদের জন্য। এটি কোনও আন্তর্জাতিক মেলা নয়। তখন এই প্রসঙ্গ তুলছে কেন লোকজন ?

জানি না।

কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন বানিয়ে দেয় ওরা। বিনিময়ে এখানে দিলে ক্ষতি কি খুব বেশি হবে ?

তাহলে একুশের বইমেলার চরিত্র পুরোই পাল্টে যাবে।

চতুর্থ আরেকজনকে দেখা যায় তাদের পাশে এসে বেঞ্চিতে ঠেলে-ঠুলে জায়গা করে নিতে। সে শেষের বাক্যটি শুনেছে। ঠাস করে চড় মারার মতো বলে উঠল―ওসব চেতনা-ফেতনা ফালতু কথা। আসলেই আপনেরা, মানে বাংলাদেশের লেখকরা ইন্ডিয়ান লেখকদের সঙ্গে কমপিটিশনে যেতে ভয় পান।

আগের তিনজনের কেউ রেগে উঠল না। তবে উত্তর দিতে  শুরু করে―যদি কমপিটিশনের কথাই বলো, শব্দটা একেবারেই জঘন্য, তবু বলি ইন্ডিয়ান লেখকদের সঙ্গে কমপিটিশন কি আমাদের করতে হচ্ছে না সবসময় ? ঢাকার, চট্টগ্রামের, রাজশাহীর, সিলেটের সব বড় দোকানে ঢুকলে মনে হয় না কলকাতার কোনও বইয়ের দোকানে ঢুকেছি ? পাঠক সমাবেশে, বাতিঘরে, প্রথমায়, তক্ষশিলায় ঢুকলে কয়টা বাংলাদেশি লেখকের বই পাওয়া যায় ? অথচ ঐ দোকানগুলিতে ঢুকলে তুমি এমন সব ভারতীয় লেখকের বই পাবে যাদের নাম কলকাতার পাঠকরাও হয়তো জানে না। তাছাড়া কমপিটিশন বলে কিছু কি হয় সাহিত্যে ? হতে পারে বাজার দখল। সেটি পুঁজির বিষয়। সাহিত্যের বিষয় নয়।

সাহিত্যও তো পুঁজির সঙ্গে সম্পর্কিত।

সেই উত্তর আহমদ ছফা দিয়ে গেছেন। কার্ল মার্কস দিয়ে গেছেন দেড়শো বছর আগে।

কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি তো আলাদা।

তোমাকে একটা প্রশ্ন করি ?

করেন।

কলকাতায় তো গেছো।

অনেকবার গেছি।

সেখানকার কোনও দোকানে বাংলাদেশি লেখকের লেখা বই দেখেছো ?

না।

কেন তারা বাংলাদেশি লেখকদের বই রাখে না সে কথা জিজ্ঞেস করেছ কোনও সময় ?

উত্তরে আমতা আমতা করে নতুন আসা যুবক―না মানে, ওরা বলে বাংলাদেশের লেখকদের সম্পর্কে জানে না পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। তাই সেখানে নিলে বিক্রি হবে না।

কিন্তু তুমি যে বললে কোয়ালিটিতে টিকতে পারে না বাংলাদেশের লেখক-কবিরা।

আমতা আমতা বাড়ে―সেটাও কিছুটা কারণ বটে।

এবার রেগে যায় তিনজনের একজন―সোমেন চন্দ ছোট লেখক ? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ? শওকত ওসমান ? শওকত আলী ? সৈয়দ শামসুল হক ? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ? হাসান আজিজুল হক ? শামসুর রাহমান ? আল মাহমুদ ? শহীদ কাদরী ? হাসান হাফিজুর রহমান ? আবুবকর সিদ্দিক ? কলকাতায় কয়জন আছে তাদের সমমানের ?

উত্তর জোগায় না চতুর্থ জনের মুখে।

খেই ধরে আগেরজন―ইনারা কি পাঠক তৈরি করেননি নিজেদের ? পুঁজির অসম প্রতিযোগিতার মধ্যেও এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হননি ? ভারতীয় লেখকদের বইতে আমাদের দোকানগুলো সয়লাব। তবু তাঁরা কি বাংলাদেশের সাহিত্য নির্মাণ করে যাননি ? এখনও করছেন না তিরিশ-চল্লিশজন লেখক-কবি-প্রাবন্ধিক-গবেষক ? এদেরকে কি কলকাতায় পরিচয় করিয়েছে সেখানকার বই ব্যবসায়ীরা ?

ইন্ডিয়ান গভমেন্টের শুল্কবাধা একটা বড় ব্যাপার।

তাহলে আমাদের দেশে কেন শুল্ক তাদের সমান না করে কম করা হচ্ছে ?

উত্তর আসে না কোনও।

প্রশ্নকর্তা তখন নিজেই বলে―আমি নিজে অবশ্য শুল্ক কম রাখারই পক্ষে। ইন্ডিয়ান লেখকদের বই আমি পড়তে চাই। অনেক সমৃদ্ধ বই আছে তাদের। বিশেষ করে তাত্ত্বিক এবং গবেষণামূলক বই। আর ভারতীয় অন্য ভাষা থেকে অনুবাদকৃত বই। আর পশ্চিমবঙ্গের লিটল ম্যাগ তো অবশ্যই পড়তে চাই। কিন্তু একই সঙ্গে চাই আমাদের বই ওদের বাজারে ঢোকার শুল্কটাও কমানো হোক।

কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধতা নেমে আসে। সেই নিস্তব্ধতার অস্বস্তি কমানোর জন্যই একজন বুবুকে বলে―আর এক রাউন্ড চা দ্যান বুবু।

তাতেই কথার স্থবিরতা কেটে যায় যেন। একজন বলতে শুরু করে―বাংলাদেশের কয়জন লেখক অমিয়ভূষণ মজুমদারের বই পড়েছে রে! কমলকুমার তো দূরের কথা। দেবেশ রায়ের নাম জানে। কিন্তু পড়েছে কয়জনা ? সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের বই তো বেশি চলে না। পশ্চিমবঙ্গের গর্ব করার মতো জিনিস হচ্ছে কয়েকটি লিটল ম্যাগ। কয় কপি বিক্রি হয় এই দেশে ?

এবার কোনও দ্বিমত আসে না।

কমপিটিশনের কথা যদি বলো, বই বিক্রি কমে যাওয়ার কথা যদি বলো, তাহলে চিন্তায় পড়তে পারে হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশকরা, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হক, ইমদাদুল হক মিলনের প্রকাশকরা। আর আমরা নামই জানি না এমন কিছু মানহীন বেস্টসেলার লেখক।

কিন্তু তোমরা কি কমপিটিশনের ভয় পাও না ?

না। একেবারেই না।

কেন ?

কারণ আমরা যারা লেখার জন্যই জন্মেছি, সে বাংলাদেশেরই হোক আর ভারতেরই হোক, তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় না। হয় পরিপূরকতা। এখানে অর্থনীতি আমাদের সাহিত্যের মানদণ্ড নয়। মানদণ্ড হচ্ছে সাহিত্য। সেই লেখকদের মধ্যে অপরের লেখা নিয়ে ঈর্ষা থাকতে পারে। কিন্তু সেই ঈর্ষাটাও ইতিবাচক। আহা সাধন চট্টোপাধ্যায় এমন অসাধারণ লেখা লিখলেন, আমাকেও লিখতে হবে। এর চেয়ে ভালো লেখা লিখতে হবে। সেটি আবার দেশের ভেতরের সাহিত্যনিবেদিত লেখকদের মধ্যেও ঘটে। শহীদুল জহিরের লেখা ঈর্ষা জাগায়, আকিমুন রহমানের লেখা ঈর্ষা জাগায়, সেলিম মোরশেদ ঈর্ষা জাগায়, মনিরা কায়েস ঈর্ষা জাগায়। মঈনুল আহসান সাবের ভাই, হরিপদ দত্তদা, মঞ্জু সরকার ভাই তো আছেনই। ঈর্ষা আছে। কিন্তু দেখা যাবে সবাই আমরা সবার প্রশংসা করছি। সবাই একজনের ভালোলাগা লেখাটি আরেকজনের সামনে প্রমোট করছি। পড়তে উৎসাহ দিচ্ছি। সেই একই কাজ তো আমরা করি স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র, অভিজিৎ সেন, অনিল ঘড়াই-এর ক্ষেত্রেও। এবং তারাও আমাদের ব্যাপারে একই মনোভাব পোষণ করেন।

এই ব্যতিক্রমটা ঘটে কীভাবে ?

কারণ আমরা, মানে, যাদের যাদের কথা বলা হলো, তারা কেউই পুঁজির দাসত্ব করি না। নিজের নিজের জায়গা থেকে বাঙালিত্ব আর বাংলা সাহিত্যকে আরেকটু উঁচুতে তুলে ধরার চেষ্টা করি। অন্ততপক্ষে সাহিত্যের অধঃপতন ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করি।

তোকে তো অনেকেই ইন্ডিয়াবিরোধী বলে।

কিছু কিছু ইস্যুতে আমি তো ইন্ডিয়াবিরোধী বটেই।

ব্যাপারটি স্ববিরোধী নয় ?

প্রশ্নই ওঠে না। বরং যারা একতরফা ভারতের গুণমুগ্ধ অথবা একতরফা ভারতবিরোধী তারা আসলে প্যাথলজিক্যাল সাইকো।

ভারত সাহায্য-সহযোগিতা না করলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি কী হতো তা আমরা বলতে পারি না।

ঠিক।

তাহলে ভারতের বিরোধিতা করা কি ঠিক ?

ভারত যখন ফারাক্কা দিয়ে পদ্মাকে শুকিয়ে মারে তখনও ভারতের বিরোধিতা করা যাবে না ? তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করে নেয় তখনও ?

সে তো আমাদের ব্যর্থতা।

ঠিক।

তাহলে ভারতকে দোষ দিচ্ছিস কেন ?

কারণ ভারত সেই সরকারকেই বাংলাদেশের ক্ষমতায় দেখতে চাইবে যাদের তারা পছন্দ করে। সুন্দরবন ধ্বংসের ঝুঁকি নিয়ে রামপালে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র বসাচ্ছে সরকার এমনটি ভাবা যায় ? কোনও সরকার চাইবে ? অথচ সেটাই ঘটতে যাচ্ছে বাস্তবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র তো যে কোনও জায়গাতে বানানো যেতে পারে। একটার জায়গাতে দশটা বানানো যেতে পারে। কিন্তু আরেকটি সুন্দরবন কি সৃষ্টি করা যাবে ?

আমাদের পাবলিক তো এসব নিয়ে টুঁ-শব্দ করে না।

পাবলিক শব্দ করে না। কিন্তু মনেপ্রাণে কি গ্রহণ করছে সবাই ? ছাপাষো মানুষ রোজ রোজ বিদ্রোহ করে না, বিক্ষোভ করে না, রাস্তায় নামে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই ফুঁসছে, কষ্ট পাচ্ছে। সুষ্ঠু ভোট হলে আসল ফলটা দেখার সুযোগ ঘটবে।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button