আর্কাইভগল্প

গায়িকা : মোহীত উল আলম

গল্প

বাবা চাকরি করতেন ঢাকায়। আমরা মা আর দুই বোন মিলে থাকতাম চট্টগ্রামে। বাবা সপ্তাহে সপ্তাহে আসতেন। বাবার পাম্পশুর একটা আলাদা আওয়াজ ছিল। বারান্দায় পাম্পশুর সে আওয়াজ শুনলেই কান প্রখর হয়ে যেত আমাদের দু বোনের।

সেবার বাবা এলেন কোরবানির ঠিক আগের সন্ধ্যায়। রাস্তায় বিস্তর জ্যাম পড়েছিল। বাবার বাস তিন ঘণ্টা বিলম্বে পৌঁছেছিল। মেজো মামাকে দিয়ে মা আগের দিনই এক কিলোমিটার দূর থেকে একটি ষাঁড় কিনে রেখেছিলেন। আমরা দুই বোন গরুকে আদর-যত্ন করে রাত্রে যেই মাত্র ঘুমাতে যাব, তখনই বাবার পাম্পশু মচমচ করে উঠল বাইরের বারান্দায়।

বাবা হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসলেন। বাইরে বৃষ্টির একটা তোড় শুরু হয়েছে। বারান্দার সামনে বাঁধা গরুটা একবার হাম্বা ডাক দিল। বাবা বললেন, গরুটা সজল খুব সুন্দর কিনেছে, রানুর মা!

রানু মানে আমি বললাম, খুব সুন্দর হয়েছে না, বাবা!

বাবা আমার দিকে ফিরে বললেন, ও তোর জন্য একটা ভালো খবর আছে। তুই জেলার গানের প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছিস। তবে তোর নাম ক্রমিকে এক নম্বরে দেয় নাই। দুই নম্বরে দিয়েছে।

মা বাবার পাতে একটা ইলিশ মাছের টুকরা তুলে দিতে দিতে বললেন, কে দেয় নাই ?

বাবা বললেন, রহমত সাহেব, আমার বস। তাঁর মেয়েকে প্রথমে দিয়ে রানুকে দ্বিতীয় স্থানে দিলেন। আমাকে যেন কোরবানির গরু পেয়েছেন, সেভাবে বোঝালেন, এখানে এক নম্বর, দুই নম্বর কোনও ব্যাপার নয়, আসল প্রতিযোগিতায় যেটা নির্ধারণ হবে, সেটাই ফাইন্যাল।

তানু আমার ছোট বোন। সে আর আমি একত্রে কুসুমকুমারী স্কুলে পড়ি। আমি ফাইভে, ও আমার এক ক্লাস নিচে, ফোরে। দুজনেই আমরা গান করি বাসায় আর স্কুলের ফাংশানে। আমাদের বাবা-মা দুজনেই গানপাগল, গানও ভালো। আমরা বাবা-মার দেখভালে দিনে দিনে আমাদের পাড়ায় আর স্কুলে নাম করে ফেলছি।

বাবা বললেন, আমি এবার কোরবানি উপলক্ষ্যে দু দিন বেশি ছুটি নিয়েছি। রানুর স্কুলের হেডমিসট্রেসকে বলতে হবে জেলার প্রতিযোগিতা যেদিন হবে সেদিন যেন তিনিও থাকেন। তিনি নিশ্চয়ই এর মধ্যে সরকারি চিঠি পেয়ে গেছেন।

প্রতিযোগিতার দিন যেন আর আসে না। আমি দিন গুনি, তানুও দিন গোনে, কিন্তু প্রতিযোগিতার তারিখটা যেন বরাবরই পিছিয়ে যাচ্ছে। বর্ষা আরও চেপে বসেছে। আমার মায়ের রোকা কলাগাছের বাগানটা ঠিক আমার জানালার পাশে। দুপুরবেলায় অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। তানু আমার পাশে ঘুমোচ্ছে। আর আমি এক নয়নে জানালার বাইরে বৃষ্টিভেজা কলাপাতার স্থির ছবি দেখছি। হঠাৎ আমার মনে হলো, এরকম কলাপাতার মতো স্থির থাকব কি আমি জীবনে! কিন্তু এই ধরনের স্থির অবস্থা থেকে বের হব কোন পথে, কীভাবে, সেটা যেমন আমি বুঝতে পারছিলাম না, তেমনি বুঝতে না পেরে ঐ কচি মনেও আমার মধ্যে একটা অস্থিরতা তৈরি হলো। আমি  বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। আমাদের বসার ঘরই আমাদের গানের চর্চার রুম। কিংবা গানের রুমই আমাদের বসার ঘর। দেয়ালের এক পাশ জুড়ে হারমোনিয়াম, তবলা, বেহালা, সেতার, খঞ্জনি, বাঁশি এবং আরও গান-বাজনার এটা সেটা। আমার দাদার বাড়িতে যেমন, তেমনি নানার বাড়িতেও গানবাজনার চল আছে। সজল মামাদের ব্যান্ড ‘কিরওয়ানি অর্কেস্ট্রা’ দেশ জুড়ে নাম করা। তানুকে জাগালাম না। ও তবলাটা ধরত। তাই আবার জাগালাম, ওঠ, হোঁৎকা মেরে দুপুরে ঘুমানোর কোনও দরকার নেই। নে, চল, গান করি।

আমি হারমোনিয়ামের রিডে হাত দিলাম। তানু তবলায় বোল দিল। বাইরের বৃষ্টির আওয়াজটা খানিকটা বেশি, তবে এত বেশি নয় যে আমার গলা সেটা ছাপিয়ে উঠবে না। কী একটা যেন হচ্ছিল, আমি যেন গাইছিলাম না, কে একজন যেন আমার ভিতরে ঢুকে গাইছিল। আমি যেন বাজাচ্ছিলাম না, কে একজন যেন আমার হয়ে বাজাচ্ছিল। প্রথমে গাইলাম, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ ভিতরে থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় যেন আমার হয়ে গানটি গেয়ে দিলেন। মা তাঁর দুপুরের বিশ্রাম থেকে উঠে আলস্যাক্রান্ত শরীরে ডিভানের ওপর বসলেন। আমি আরেকটা গান শেষ করে বললাম, মা, তুমি ও তানুও গাও আমার সঙ্গে। মা খঞ্জনিটা হাতে নিয়ে বললেন, না, আমি এটা বাজাই, তুই-ই গা। সামনে প্রতিযোগিতা না ? প্র্যাকটিস কর। তানুও বলল, আপ্পি, তুমিই গাও, খুব ভালো হচ্ছে তোমার গান। মা তখন বললেন, আচ্ছা, খঞ্জনিটা থাক। আমি বরঞ্চ ভিডিও করি, তোদের বাপকে পাঠাব।

এরপর আমি ধরলাম, ‘পদ্মার ঢেউ রে!’ ঠিক ফিরোজা বেগম সন্ধ্যাজীকে সরিয়ে দিয়ে আমার ভিতর ঢুকে গেলেন। এই গানটাতে অন্তরা থেকে বের হয়ে আরোহণে ওঠার সুরটা বেশ কঠিন, কিন্তু ফিরোজা বেগমই যেন গেয়ে দিলেন, ‘সে প্রেমের ঘাটে ঘাটে বাঁ…শি বা…জা…ই’ বলে এমন এক টান চড়ে বসল আমার গলায় যে বৃষ্টি যেন খানিকটা থমকে গিয়ে তার বর্ষণ বন্ধ করে ঘরের ভিতর ঢুকে আমাকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকল। সারা বাড়িতে যেন ঐ ‘বা… জা… ই…’ টানটা ওপর থেকে নিচে, নিচে থেকে ওপরে, বসার ঘর থেকে শোবার ঘরে, শোবার ঘর থেকে বসার ঘরে অনুরণন তুলে চলল। মা সজল মামার কাছ থেকে ভিডিওর অনেক কেরামতি শিখেছেন। তিনি একেবারে আমার মুখের ওপর জুম করে তাঁর স্যামসাংটা ধরলেন। স্কুলে আমার গানের শিক্ষয়িত্রীরা বলেন, সহপাঠিনীরাও বলে, মাঝে মাঝে মা-বাবাও বলেন, আমার চেহারার সঙ্গে নাকি ফাতেমা-তুজ-জোহরার চেহারার মিল আছে। তাই এইবার মা যখন ভিডিওটা আমার মুখ থেকে সরিয়ে নিলেন, আমি আরেকটা নজরুল গাইবার আয়োজন নিলাম। এইবার আপনাআপনি যেন ফাতেমা-তুজ-জোহরা আমার গলায় ভর করলেন। তাঁর মতো গানের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করলাম। চরাচরের সব কিছু ভুলে আমি ফাতেমাজির সুরের ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে, প্রতি বন্দিশের মুখড়াকে ঠিক রেখে, নজরুলের ধ্রুপদী লয় সম্পূর্ণ ঠিক রেখে অপূর্ব মধু ঢেলে গাইতে থাকলাম, ‘মরণ বিষাদে অমৃতেরই স্বাদ আনিলে নিষাদ মম।’ তারপর ফাতেমাজির কণ্ঠেই যেন আমার কণ্ঠ ধীর লয়ে উঠে গেল মুখড়ার আরোহণে, ‘গানগুলি মোর আহত পাখির সম / লুটাইয়া পড়ে তব পায়ে প্রিয়তম।’ মনে হলো, শুধু আমাদের বাসার ভিতরে নয়, বাসার সামনের গলিতে, গলির মুখে, প্রধান সড়কের সংযোগস্থলে যত গাড়ির শব্দ, লোকজনের চলাচলের শব্দ, সব শব্দ যেন আমার কণ্ঠ অপহরণ করে নিয়েছে। এক শব্দহীন পৃথিবীতে শুধুই আমি গাইছি; এবং, আমি জানি না, কেন, কিন্তু এই অল্প বয়সেই আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি গড়াতে লাগল। মা গম্ভীর হয়ে গেলেন, প্রথমে একটু হয়তো তাঁর হাসবার উপক্রম হয়েছিল, কিন্তু গানের গভীর রোদনে আসক্ত হয়ে আমার মা গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমি গাইতেই থাকলাম। কী যেন আমার ভিতর থেকে মুক্তি, মুক্তি করে সঙ্গীতময় মূর্ছনায় আর্তি জানাতে লাগল। সে কলাপাতার ভেজামগ্ন স্থির প্রতিচ্ছবি থেকে আমি যেন মুক্ত হয়ে দিগি¦দিক সঞ্চারিত হতে লাগলাম। গানটা শেষ হলে মা এবার বললেন, মা, এবার একটা গজল ধর তো, নজরুলের। মা নিজেও খুব ভালো গান নজরুলের গান। কিন্তু তিনি গাইবেন না। আমাকেই গাইতে বলছেন। তিনি বললেন, তুই গাইতে থাক, আমি একটু চা করে নিয়ে আসি।

আমি তানুকে বললাম। এবার কাহারবা বাজাবি। আমি গাইছি, ‘এত জল ও কাজল চোখে, পাষাণী আনলে বল কে।’ ফাতেমার এই গানটিতে একটি ছন্দোময় প্রবহমানতা আছে। কাহারবা বোল ঠিক রেখেও তাঁর গলার মধ্যে যে সাধারণ অসংকোচ অল্প ওঠানামা আছে, একটু কাঁপা কাঁপা সুর, সবগুলিই যেন আমার কণ্ঠে ভর করল, যখন আমি মুখড়াটা কয়েকবার গাইলাম, ‘এত জল ও কাজল চোখে, পাষাণী আনলে বল কে।’ কিন্তু আমি জানি, আমাদের পারিবারিক আসরে মায়ের একটা খুব প্রিয় গান না গাইলে অনুষ্ঠান শেষ করা যাবে না। ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই কেন মনে রাখ তা’রে।’ বাবা  মায়ের এই গানের অনুরোধ শুনলেই বলেন, এটা তো আমার অনুরোধের গান। ব্যাটা ছেলের গান, তুমি কেন অনুরোধ করো ? মা বলেন, কী জানি বাবা, আমার মনের সঙ্গে খুবই যায় গানটা।

তো আমি গানটা ধরলাম। এবার ফিরোজা বেগম আমাকে একবারে কব্জা করে নিলেন। আমার সমস্ত অস্তিত্ব¡ ছাড়াও দরজা-জানালা, বাথরুমের জলনিষ্কাশনের ছিদ্র কিছুই বাকি রইল না। সবকিছুই তাঁর দখলে। আমি নজরুল-ফিরোজাকে একত্রে করে কাঁদতে লাগলাম, ‘ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।’ আমি এবার সুর নিচের লয়ে এনে গাইতে থাকলাম, ‘দয়া কর, মোরে দয়া কর, আর আমারে লইয়া খেলো না নিঠুর খেলা, / শত কাঁদিলেও ফিরিবে না প্রিয় শুভ লগনের বেলা।’ মা চা খাওয়া বন্ধ করে কাঁদছেন। তখন পরিবেশ হালকা করার জন্য আমি গাইলাম, ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ বেণুকার সুর।’

আমার গাইবার পর আমি তবলা ধরলাম, তানু ধরল হারমোনিয়াম। তানুর রবীন্দ্রসঙ্গীতের গলা। কিছুটা ভরাট, কিছুটা মাদকতায় ভরা। সে ধরল, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার।’ বর্ষার রিমঝিম বরিষণ কেবল শেষ হয়েছে। আমি খুব তৃপ্ত হয়ে আমার পড়ার টেবিলে বসে আগামীকালের অংকের ঝামেলা নিয়ে বসলাম। এক মণ তুলা আর এক মণ লোহা যদি ওপর থেকে ছুড়ে দেওয়া হয়, আর যদি প্রকৃতিতে কোনও বাতাস না থাকে, তা হলে কোনটা আগে মাটিতে পড়বে ? তুলা না লোহা ? মাথা ঘামাতে থাকলাম।

ওমা, এক সময় একদিন প্রতিযোগিতার দিন এল। চট্টগ্রাম জেলার শ-খানেক স্কুলের মধ্যে প্রতিযোগিতায় বাছাই হতে হতে পঁচিশটা স্কুলে এসে থেমেছে। প্রতি স্কুল থেকে তিনজন, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রত্যেকেই দুটো করে গান করবার সুযোগ পাবে। তাই সকাল থেকে অনুষ্ঠান শুরু হলো থিয়েটার ইনস্টিটিউটে। সন্ধ্যায় প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের নাম ঘোষণাসহ পুরস্কার দেওয়া হবে। প্রতিযোগীরা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।

মা আমাকে একটা উজ্জ্বল গোলাপি রঙের বুটিদার ফ্রক পরালেন। মাথায় দিলেন গোলাপি ফিতা বেঁধে। পায়ে বাবা কিছুদিন আগে ঈদ উপলক্ষ্যে এক জোড়া গোলাপি রঙের ক্যাডস কিনে দিয়েছিলেন। সঙ্গে গোলাপি মোজা। আমি মায়ের ফর্সা রঙ পেয়েছি, তাই মা যখন আমার কচি ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক মেখে দিলেন, চোখের আইল্যাশও একটু গোলাপি রঙে মেজে দিলেন, তখন আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমাকে পুরোই সিন্ডেরালার মতো লাগছে। তানুও সেজেছে পুরো নীল সাজে। ওকে দেখাচ্ছিল এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের এলিসের মতো। তানু মায়ের হাত ধরে আর আমি বাবার হাত ধরে প্রায় নাচতে নাচতে গাড়ি থেকে নামলাম। কী গানের প্রতিযোগিতা, আমার প্রিন্সেসের সাজ তখন আমার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

কিন্তু সময় আর কাটে না। প্রতিযোগীরও যেন শেষ নেই। গম্ভীর মুখে একদল বিচারক বসে আছেন। সবাই বলাবলি করছিল, চট্টগ্রামে কখনও এত স্টার একত্রে আসেননি। আমি তো কাউকে চিনি না। বাবা মা-ই একজন একজন করে চেনাচ্ছিলেন। ঐ যে একদম মাঝখানে বসে আছেন উনিই ফাতেমা-তুজ জোহরা। জুরিদলের একজন। তাঁর ডান পাশে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, তাঁর আরও ডান পাশে সাদী মোহাম্মদ, একটু মোটামতো যিনি উনি খায়রুল আনাম শাকিল, তাঁর এ পাশে চট্টগ্রামের ছেলে নকীব খান, আর সর্ববামে সামিনা চৌধুরী, আর একদম কোনায় আলিফ লায়লা।

আমরা মায়ের আনা প্যাকেট লাঞ্চ সেরে ফেললাম। দুপুরের খাবারের প্রায় ঘণ্টা খানেক পর আমার বাবা ভিতর থেকে খবর নিয়ে জানলেন, আমার ডাক পড়তে পড়তে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

তো রয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে যাকে প্রাথমিকভাবে সিরিয়ালে প্রথম করা হয়েছিল, সে মেয়ের স্কুলের নাম এবং ওর নামও জানা হলো। তিন্নি। জুলেখা রহমান তিন্নি। তার বাবা রহমত সাহেব এবং তার মাও এসেছেন। সন্ধ্যা যখন নেমে এল, মাগরিব নামাজের পরপর আবার প্রতিযোগিতা শুরু হলে এবার সত্যি সত্যি মাইকে আমার নাম শুনতে পেলাম। বাবা-মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। যা মা, ভালো করে হারমোনিয়ামটা বাজিয়ে গলা ছেড়ে গাইবি। যে দুটো গান ঠিক করে দিয়েছিলাম, সে দুটাই গাইবি।

আমার কেন যেন মোটেও ভয়ডর করছিল না। দেখেছি অনেক প্রতিযোগীই হারমোনিয়াম বাজাতে পারে নাই, হারমোনিয়ামওয়ালা বাজিয়ে দিয়েছেন। আর হারমোনিয়াম যেন সবসময় আমার সঙ্গে গান করে। 

কনসার্ট শুরু হলে আমি ধরলাম ফাতেমাজির গলায়, ‘এত জল ও কাজল চোখে, পাষাণী আনলে বল কে।’ কী গাইলাম আমি জানি না, পুরো হলভর্তি লোকের তালি, আর জুরি বোর্ডের কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেলেন। হাত তালি শুধু নয়, প্রশংসাও তাঁদের চোখে খেলছে।

আমি মোটেও নার্ভাস নই, বরঞ্চ আরও গান গাইতে আমি উন্মুখ। এবার আবার কনসার্ট ঠিক হলে হারমোনিয়ামে সুর তুললাম আর কণ্ঠস্বর সর্বোচ্চ উঠিয়ে ফিরোজা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে ধরলাম : ‘পদ্মার ঢেউ… রে।’ ধরেছি মাত্র, হলের মধ্যে তার রেশ শুরু হয়েছে মাত্র, আর অমনি ফুড়ুৎ―সমস্ত অডিটোরিয়াম অন্ধকারে ডুবে গেল। ইলেকট্রিসিটি ছাড়া কী-বোর্ড বন্ধ, হঠাৎ যেন কী হয়ে গেল! আর পরক্ষণে শত শত দর্শকের হাত উঁচা করা মোবাইলের টর্চ লাইটের প্রভায় আকাশের তারকারাজির মতো হলের মধ্যে এক অতিপ্রাকৃত আলোর সঞ্চরণ হলো। কিন্তু লাইট আর আসে না।

আমি মঞ্চ থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম বাবা-মা অসহায় অবস্থায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। বাবা একবার আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে কী যেন বললেন। আমাকে কী গেয়ে যেতে বললেন ? হারমোনিয়াম আর তবলায় তো বিদ্যুৎ লাগে না। ও দুটো হলেই আমার চলে। এমন সময় খুবই ভদ্র কণ্ঠে জুরি বোর্ডের ওখান থেকে নকীব খান আমাকে চাপা গলায় বললেন, তুমি গেয়ে যাও।

বিদ্যুৎ ছাড়া আমার গান যেন আরও ভালো হলো। গানটা যেন আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে পুরো হলময় ঘুরে ঘুরে সবার কানে কানে সুর তুলে আবার আমাকে আমার জায়গায় বসাল। আমার নিজের কণ্ঠই আমার কাছে অপরূপ লাগছিল। এক সময় গানটা শেষ করলাম, আর দর্শকেরা তাদের হাতের মোবাইল বাতি এদিক থেকে ওদিকে নাচাতে নাচাতে চিৎকার করে বলছে, ওয়ান মোর, ওয়ান মোর।

আর এ সময় বিদ্যুৎ আবার ফিরে এল। যাকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছিল ক্রমিক নম্বরে সে এবার গাইল। তার দুটো গানের সময় বিদ্যুৎ কোনও গণ্ডগোল করল না।

শুধু দশজনকে পুরস্কার দেওয়া হবে। দশম থেকে চতুর্থ পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণায় আমার নাম উচ্চারিত হলো না। এ প্রথম জানলাম যে পুরস্কারের সময় নিচের দিক থেকে নাম ঘোষণা করা হয়। তৃতীয়টা গেল পুলিশ ইনস্টিটিউটের এক ছাত্রীর কাছে। আমার বাবা-মা ভিতরে ভিতরে কাঁপছেন। আমি টের পাচ্ছি। তানুও মুখ গোমড়া করে বসে আছে। কিন্তু আমি কোনও কিছু আলাদা বোধ করছিলাম না। দ্বিতীয় নামটি উচ্চারিত হলো একজন ছাত্রের, ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের জুনিয়র সেকশনের ছেলে। দ্বিতীয়তেও যখন আমার নাম এল না, তখন আমার বাবা-মাসহ আমিও এবারে হতাশ হলাম। কারণ এক নম্বর ক্রমিকের মেয়েটাও ভালো গেয়েছে। তার বাবা আবার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। আমরা ধরেই নিলাম যে পুরস্কারটা তার কাছেই যাবে।

নকীব খানই জুরিদের পক্ষে নাম ঘোষণা করছিলেন। তিনি তাঁর অত্যন্ত মার্জিত গলায় উচ্চারণ করলেন, আজকের এই বিশাল গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে কুসুমকুমারী স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সর্বজয়া আহমেদ রা… নু। তাকে অভিনন্দন! 

মা-বাবাকে চেয়ার থেকে তুলে আনতে আমার আর তানুর কী কষ্ট যে হলো!

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button