আর্কাইভগল্প

স্বপ্নবৃত্তান্ত : রাশেদ রহমান

গল্প

অলৌকিক কত কিছুই তো ঘটে দুনিয়ায়! মানুষ যা কল্পনা করে না, করতে পারে না কিংবা কল্পনাতীত; চোখের পলকে তাও ঘটে যায়। যেমন—নিয়ম করে স্বপ্ন দেখা। একই স্বপ্ন—মাসে দুবার; বাংলা মাসের হিসাবে, মাসের প্রথম দিন এবং পনেরোতম দিন রাতে। এটা কীভাবে সম্ভব! আপাতদৃষ্টিতে এটা অসম্ভব, অবিশ্বাস্য কিন্তু আমার বেলায় ঘটে। আমি নিয়ম করে মাসে দুবার একই স্বপ্ন দেখি। কুন্তলা পাল স্বপ্নে আমার কাছে আসে। কুন্তলা এরকম স্বপ্ন দেখে না। সুতরাং সে কিছু জানেও না। দশ বছর ধরে একই স্বপ্ন দেখার ঘটনা ঘটছে। আমি মাঝেমধ্যে কুন্তলাকে এভাবে স্বপ্ন দেখার কথা বলি, সে হেসে উড়িয়ে বিদায় করে আমার স্বপ্নবৃত্তান্ত। হাসতে হাসতেই আমাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করে। বলে—‘তোমার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে, সুমিত ভাই। কোনও সুস্থ মানুষ নিয়ম করে দশ বছর ধরে মাসে দুবার একই স্বপ্ন দেখে না।’ কখনও-সখনও আমাকে মিথ্যাবাদীও বলে…।

আমি কেন পাগল হতে যাব ? আমি দিব্যি সুস্থ মানুষ। প্রতি মাসে একটি করে গল্প লিখছি, কবিতা লিখছি দু-চারটে। আমার মস্তিষ্ক এলোমেলো থাকলে গল্প-কবিতা লেখা সম্ভব ? না, সম্ভব না। পাগল লোকেরা কি সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারে ? পারে না।… আর কুন্তলার সঙ্গে আমি মিথ্যা কথা বলতেই বা যাব কেন ? আমাদের সম্পর্ক তো বাস্তব, খোলামেলা। আমি কুন্তলার ভেতরের সবকিছু পড়তে পারি, কুন্তলাও আমার ভেতরটা পুরাপুরিই পড়তে পারে। তাহলে ?…

কোথায় যেন পড়েছি, নাকি কারও কাছে শুনেছি; আমরা যে রাতভর স্বপ্ন দেখি, এই স্বপ্নের আয়ু মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ১৫ সেকেন্ডেরও কম। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে বিশ^ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে আসা যায়। আমি যে কুন্তলাকে স্বপ্ন দেখি, কুন্তলা স্বপ্নে আমার আমার কাছে আসে, সে তো ওই ১৫ সেকেন্ডের জন্যই। অথচ আমার স্বপ্ন দেখা শুরু হয় ভোর থেকে, কুন্তলা পরদিন ভোর পর্যন্ত থাকে; পুরা ২৪ ঘণ্টা, স্বপ্নে কুন্তলার সঙ্গে ঘর-সংসার করার এই ঘোর ১৫ দিন পর্যন্ত থাকে, কাটে না; আমি বয়ে বেড়াই, তখন যেন কুন্তলাও আমার সঙ্গেই থাকে, মাসের ১৫তম দিন গত হলে, রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর কুন্তলা তো আবার আসেই। অর্থাৎ পুরা মাসটাই স্বপ্নে কিংবা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে কুন্তলা আমার ভেতরেই বাস করে। এ এক অলৌকিক ব্যাপার…!

এই যে আমি আমার স্বপ্নবৃত্তান্তে মেয়েটির নাম কুন্তলা পাল কিংবা শুধুই কুন্তলা বলছি; এটা কিন্তু কুন্তলার প্রকৃত নাম না। ওর মাতৃপ্রদত্ত নাম আরতী রানি পাল। স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেটেও এই নাম, ওর স্বামী রমেশ পালও ওকে আরতী নামেই ডাকে। কখনও-বা ছেলে গৌরবের নাম জুড়ে দিয়ে গৌরবের মা বলেও ডাকে। আর যেদিন এই পাল মশাইয়ের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে, তা মাঝে-মধ্যেই হয়, বিশেষ করে যে রাতে সে কুন্তলার কাছে পরাজিত হয়, কুন্তলার মেদহীন জীবনানন্দের কবিতা বিবস্ত্র শরীরের ওপর উঠে চড়ুই পাখির মতো নামে, সেদিন তো পরাজয়ের গ্লনিতে তার মেজাজ বিষিয়ে থাকবেই, সেদিন কুন্তলাকে সে ‘আরতী রানি পাল’ বলে ডাকতে শুরু করে। আরতী রানি পালের ‘কুন্তলা’ নামটি আমিই দিয়েছি। আমরা দুজন ছাড়া পৃথিবীর আর একটি কাকপক্ষীও জানে না আরতী রানির নাম কুন্তলা এবং সুমিত জহির নামের এক বিশীর্ণ লেখকই শুধু তাকে এই নামে ডাকে…।

কুন্তলা নামটি আরতী রানি পালেরও ভারি পছন্দের। একদিন শুধু ‘কুন্তলা’ শব্দটির অর্থ জানতে চেয়েছিল…।

যে রাতে কুন্তলা আসে, আমরা কখনওই, দশ বছর ধরেই, প্রেমিক-প্রেমিকা থাকি না। স্বামী-স্ত্রীর মতো ঘর সংসার করি। গৌরব আমাদের ছেলে হয়ে ওঠে। গৌরবের বয়স ১৫ বছর। পাঁচ বছর বয়সে আমার কাছেই ছেলেটির হাতেখড়ি। গৌরবকে বাড়িতে পড়াতে হবে―রমেশ পালই আমাকে ধরে নিয়ে গেছিল। আমাকে ধরতেই আমি বললাম―শুনেছি, বৌদি বেশ শিক্ষিত। গ্র্যাজুয়েটও নাকি হয়েছে।  সেই তো ছেলেকে পড়াতে পারে। রমেশদা বলল―ভারি দুষ্টু ছেলে। মায়ের কাছে পড়তেই চায় না। লেখাপড়ার জন্য টিচারের বিকল্প নাই। আগামী বছর স্কুলে ভর্তি করে দেব। তার আগে বছরটা তুমি বাড়িতেই পড়াও…।

এখন মনে হয়, আমি নিজে নিজেই ভাবি। সুমিত জহির রমেশ পালের বাড়ির বিষবৃক্ষ। যে বৃক্ষের চারা রমেশদা নিজেই রোপণ করেছিল। চারাটি কুন্তলার দারুণ পরিচর্যা পেয়ে আজ দশাসই বৃক্ষের রূপ নিয়েছে। বৃক্ষটি, রমেশদা যে কেটে ফেলবে, সেই শক্তি-সামর্থ্যও এখন নেই তার…।

সেদিন, তখন দুপুর আসি আসি করছে, মে মাসের দুপুর তো, একটু দেরি করেই আসে; আমি বটতলা বাজারে আড্ডা সেরে বাড়ি ফিরছিলাম। রমেশ দাদাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশ দিয়ে হালট। একই গাঁয়ে আমাদের বাড়ি। এপাড়া, ওপাড়া। পাকা রাস্তাও আছে। আমি রাস্তা শর্টকাট করার জন্য হালট দিয়ে যাচ্ছিলাম। রমেশদা হালটের পাশে বসে মাটির হাঁড়িতে রঙ দিয়ে নকশা আঁকছিল। হাঁড়ি-পাতিলে নকশা আঁকায় রমেশদার খুব নাম আছে বাজারে। আমাকে দেখেই দাদা উঠে দাঁড়াল। বলল―তোমার কথাই কদিন ধরে ভাবছিলাম, মণ্ডলের নাতি…।

আমার দাদার নাম রাজালি মণ্ডল। এলাকার প্রভাবশালী জোতদার ছিলেন। বাড়িতে পাঁচ জোড়া হালের গরু। তিনটি দুধেল গাভি। চারজন বছর-কড়ালে কামলা বাড়িতে। তাকে ভালোবাসার কিংবা ভয় করার লোকের অভাব ছিল না গাঁয়ে। আমাদের এখন সেই চোটপাট নেই তা ঠিক, তবু গাঁয়ের লোক রাজালি মণ্ডলের নাতি হিসেবে আমাকেও কিছুটা সমীহ করে। ভালোবেসে নাকি ভয়ে, তা জানি না। গাঁয়ের মানুষ এখন কেউ আমাদের ভয় করে কিংবা করবে, তা মনে হয় না। হয়তো ভালোবেসেই আমাকে মণ্ডলের নাতি বলে সম্বোধন করে। তাছাড়া আমি উড়নচণ্ডী মানুষ। বখে গেছি বা যাব―এ ধরনের কথা বলার লোকও গাঁয়ে কম নেই। যা হোক, রমেশদাকে বললাম―আমাকে মনে করছিলে কেন, দাদা… ?

তুমি তো শুনি লেখক মানুষ, ভালো ছাত্রও ছিলে, দু-চারজনকে পড়াও জানি…।

তারপর কী ঘটেছিল, তা তো আগেই বলেছি। দাদা আমাকে এক প্রকার জোর করেই বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। তার ছেলে গৌরবকে পড়াতে হবে…।

হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, আমি টিউশনি করি। না হলে হাতখরচ চলে না। ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ২৪ শলা সিগারেট লাগে, শহরে আসা-যাওয়া, কবি-লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, দারুর খরচ―মায়ের কাছে টাকা চাইতে লজ্জা করে। একটার পর একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছি। দুবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছি। হয় হয় করেও চাকরি হচ্ছে না। এসডিএসে (সোসাইটি ডেভলপমেন্ট সার্ভিস) মাঠকর্মী হিসেবে যোগ দিতে পারি, এনজিওটির প্রতিষ্ঠাতাÑনির্বাহী পরিচালক আবদুল কাদের ভুঁইয়া আমাদের গাঁয়ের লোক। আমার বড় ভাই, চাচাতো দুভাই, বন্ধুমহলের চার-পাঁচজন কাদের ভুঁইয়ার এনজিওতে ঋণের কিস্তি তোলার চাকরি করে। কাদের কাকা, গ্রাম সম্পর্কে আমরা তাকে সবাই কাকাই বলি, অফার দিয়েছিল আমাকে কিন্তু আমি যোগ দিইনি। এনজিওগুলো আমার কেমন সুদখোর সুদখোর কিংবা একটু ভালো বাংলায় বলতে পারি সুদের ব্যবসায়ী বলে মনে হয়। বেকারজীবন খুবই বিব্রতকর, যন্ত্রণাদায়ক, তবু সুদের ব্যবসায় যোগ দিইনি। কিন্তু খুব সাধারণভাবে বেঁচে থাকতে হলেও যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা আমার নেই। লিখে যা পাই তা দিয়ে সিগারেটের খরচও জোটে না। দাদার আমলের সেই জোতদারি তো এখন নেই। দাদার মৃত্যুর পরপরই আমাদের প্রায় ৫০ বিঘা জমি, যে জমি নিয়ে সরকারবাড়ির সঙ্গে মামলা ছিল, যে জমি নিয়ে প্রায় প্রতি বছরই ধানকাটার মৌসুমে কাইজা হতো। এক কাইজায় খুন হয় আমার জেঠা। সেই জমি বেহাত হয়ে যায়। বাবা দখল রাখতে পারল না সেই জমির। জমির শোক বড় শোক। জমি হারানোর শোকে উ™£ান্ত হয়ে গেছিল বাবা। বছর দুই না পেরুতেই খেতে ধানের চারা রোপণ করতে করতেই বাবার মস্তিষ্কে রক্ষক্ষরণ শুরু। খেতের নরম কাঁচা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে বাবা। পাশের খেতের কামলারা ছুটে আসতে আসতেই সব শেষ…।

আরতী, আরতী, দ্যাখো―কাকে নিয়ে এলাম…। রমেশদা হাঁকডাক শুরু করল।

কাকে নিয়ে এসেছো… ?

আরতী বৌদি রান্নাঘরে ছিল। মাথায় কাপড় ছিল না। গৌরব বসে ছিল তার পাশে। ছেলেকে সঙ্গে করেই বৌদি বেরিয়ে এল।

ওমা! এ যে সুমিতদা দেখছি। এক গাঁয়ে বাড়ি অথচ পথেঘাটেও দেখা মেলে না। মশাইয়ের নামই শুধু শুনি। এত্ত বড় লেখক আজ আমাদের বাড়িতে! বৌদি বুক-মাথার কাপড় ঠিক করল…।

বৌদিকে চিনি। পথেঘাটে দু-চারবার হয়তো দেখছিও। কিন্তু এভাবে, স্বল্পবসনে, সন্নিকটে এই প্রথম দেখলাম। এ যেন অগ্নিবালিকা। আগুন দিয়ে সৃজিত স্বর্গের কোনও দেবী। আমার চোখ ঝলেসে যাচ্ছিল…।

দাদাকে নিয়ে বারান্দায় বসো। আমি লেবু-শরবত বানিয়ে আনি। যা রোদ উঠেছে আজ…। বৌদি বলল।

বৌদি আবার রসুই ঘরে চলে গেল। গৌরব থাকল আমাদের কাছে। কিন্তু আমার মধ্যে একটা প্রেম-বিকার তৈরি হয়ে গেল। মানুষ অর্থাৎ কোনও নারী এতটা সুন্দরী হতে পারে ? আমার মনে হলো―না, তা পারে না, হয় না কিন্তু আমার সামনে তো স্বর্গের অপ্সরীর চেয়ে এক সুন্দরী নারী দেখলাম, রমেশ পালের বউ, ‘আরতী রানি দাস’, কদিন পরেই যে নারী কুন্তলায় রূপান্তরিত হবে…।

বছরখানেক ঘুরতে না ঘুরতেই এ এক অসম্ভব, অসম্ভব গল্প―আরতী রানি দাস কুন্তলায় পরিণত হয়ে গেল। কিন্তু চলে গেল আমার টিউশনি…।

দুই

আমার টিউশনি চলে গেল কিন্তু কেন―এই প্রশ্নের উত্তর আমি তাৎক্ষণিকভাবে পাইনি। কিছু দিন বিলম্ব ঘটেছে প্রশ্নটির উত্তর পেতে। আমি এই প্রশ্নের জবাব রমেশদার কাছে কখনও চাইনি, কুন্তলার কাছেও না, আরতী বৌদি ততদিনে কুন্তলা হয়ে গেছে। কুন্তলাই জবাব দিয়েছে এক দুপুরবেলা…।

রমেশ পাল সাধারণ হাঁড়ি-পাতিল, ঠিলা-কলসি, ঘটি-বাটি ইত্যাদি নিয়ে সকালবেলা গাওয়ালে বের হয়। রঙকরা তৈজসপত্র ঝাঁকায় থাকে কোনও কোনও দিন। দূর-দূরান্তর গাঁয়ে গাওয়াল করে বাড়ি ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল কিংবা কোনও দিন সন্ধ্যাও নেমে আসে। সেদিন রমেশদা আসে দেরি করে। মানে দুপুরের আগে আগে বেরিয়েছিল। ফিরতে যে সন্ধ্যা হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, বৌদি আমাকে খবর দিয়ে বাড়িতে নিয়েছিল। বলেছিল―সুমিতদা, গৌরবের বাবা তোমাকে সন্দেহ করে…।

কেন, কী সন্দেহ করে বৌদি… ?

তোমার সঙ্গে আমার গোপন, অবৈধ সম্পর্ক আছে…।

তোমার কী মনে হয় বৌদি ? আমাদের মধ্যে সম্পর্ক একটা আছেই, সেটি কি গোপন, অবৈধ… ?

না…।

তাহলে… ?

কিন্তু স্বামী যদি স্ত্রীকে সন্দেহ করে, যে সন্দেহের কারণে তোমার টিউশনি চলে গেল, সেই সন্দেহ আমি কী করে দূর করব… ?

এটা তো নিছক ভুলবশত সন্দেহ। এই সন্দেহ দূর করার চেষ্টা কেন করতে যাবে তুমি ? রমেশদা থাক না সন্দেহের জালে জড়িয়ে…।

তাহলে আমার উপায় কী… ?

তুমি শক্ত হও কুন্তলা। তুমি মনে রাখবে―রাতে পরম-সৌহার্দ্য-সূচক-সময়ে রমেশ পাল তোমার কাছে পরাজিত হয়। তোমাকে সুখ দিতে পারে না। তারপরও সুমিত জহিরের সঙ্গে তোমার যে সম্পর্ক এখানে শরীর নেই, সংসার নেই; ‘প্ল্যাটোনিক’ প্রেম―রমেশ পাল কি কিছুই অনুমান করতে পারে না, কেন তোমাকে সন্দেহ করবে ? লোকটি কি একজন কুরুচিপূর্ণ বুড়ো… ?

বুড়ো তো বটেই। আমার চেয়ে ২০ বছরের বড়…।

তারপরও তুমি লোকটিকে ঘৃণা না করলেও, ভয় করবে কেন ?

লোকটি আমার স্বামী যে, আমার ছেলের বাবা…।

তাহলে সুমিত জহির কে ? তার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক… ?

ক্ষমা করো, সুমিতদা। এই প্রশ্নের জবাব নেই আমার কাছে। তোমার কাছে আমি যাই। তুমি বলো―স্বপ্নে যাই; স্বপ্নেই আমরা ঘর-সংসার করি, সংসার করার জন্য স্বামী-স্ত্রী হিসেবে যা কিছু করা প্রয়োজন, আমরা সবই করি। আজ তোমাকে আমি নিজেই ডেকে এনেছি। রমেশ পাল গাওয়ালে বেরিয়েছে। গৌরব স্কুলে গেছে। আমার ঘরে এখন শুধু তুমি আর আমি। স্বপ্নে আমরা যা করি, এখন বাস্তবেও আমরা তা-ই করতে পারি। সবই পারি কিন্তু ভয় যে আমার কাটে না…।

নারী-পুরুষ―কেউ কাউকে ভালোবাসলে―দ্বিধাদ্বন্দ্ব, ভয়-সংস্কার―কিচ্ছু থাকার সুযোগ নেই। ভালোবাসা এক অপার, নিঃসীম পথ পরিক্রমা; হাঁটতে হবে, হাঁটতেই হবে; তা হোক স্বপ্নে কিংবা বাস্তবে…।

রমেশদা আমাকে তার বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকিয়েছিল, সে তো জানত না―তার অসুখী স্ত্রী, আরতী রানি পাল অসুখী ছিল কি না তাও সে বুঝত কি না, জানি না। সে চুরি হয়ে যাবে, বাস্তব-জীবনে নয়, মন থেকে চুরি হবে…।

কুন্তলা পাল, রাতে, স্বপ্নে আমার ঘরে আসে। আমার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়―ভোরবেলা…।

আমাদের বাড়ির পাশেই শিমুলতলা মসজিদ। জয়নুদ্দিন মণ্ডল, আমার পরদাদা এই মসজিদ স্থাপন করেছিল। আমার দাদা রাজালি মণ্ডল মসজিদের সংস্কার করে। দুটো গ¤ু^জ নির্মাণ করে মসজিদের। আগে এক গম্বুজের মসজিদ ছিল এটি―এখন তিন গম্বুজ। অন্তত দুশো বছরের পুরনো মসজিদ। এই মসজিদে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত আজান হয়, নামাজ হয়। এখন গাঁয়ে আরও তিনটি, পূর্বপাড়া, পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়া মসজিদ হয়েছে। মসজিদগুলোর দেয়াল ও মেঝে টাইলস করা। চকচক-ঝকঝক করে মসজিদের চৌহদ্দি। সেই তুলনায় আমাদের শিমুলতলা মসজিদ জরাজীর্ণ, জীর্ণশীর্ণ কিন্তু প্রত্যেক নামাজের ওয়াক্তে, জুম্মাবারে মুসল্লির সমাগম এই মসজিদেই বেশি হয়। ভোরবেলা মসজিদের আজানে আমার ঘুম ভাঙে কিন্তু আমি বিছানা ছেড়ে উঠি না, উঠতে ইচ্ছা করে না। রাত জেগে লেখালেখি করি, ভোরবেলার ঘুমটাই আরামপ্রদ মনে হয়। কিন্তু কুন্তলা যে রাতে আসে, ভোরবেলা আমাকে ঘুম ভাঙানোর জন্য ডাকাডাকি শুরু করে…।

যে রাতে, বাংলা মাসের প্রথম কি পনেরোতম দিবসগত রাতে, আমি তো বুঝি, কুন্তলা আজ আসবে; আমাদের বাড়িটাই কুন্তলাময় মনে হয়। কুন্তলার সুগন্ধে বাড়ির ঘরদুয়ার ম-ম করে। আহা কী সুখ! কী সুখ! মাসের এই দুটো দিন সুখের প্রস্রবণ প্রবাহিত হয় আমার শিরা-উপশিরায়, মনে-হৃদয়ে, করোটিতে…।

মসজিদে ফজরের আজান হতেই কুন্তলা বিছানা ছাড়ে। স্নান করে। তারপর আমাকে ডাকাডাকি। ‘আর কত ঘুমাবে গৌরবের বাবা ? ওঠো…।’

দেখুন পাঠক, আমি আর কুন্তলা যেন সত্যি-সত্যি স্বামী-স্ত্রী! গৌরব আমাদের দুজনের সন্তান। এরকম স্বপ্ন মানুষ দেখে নাকি ? কিন্তু আমি তো দেখি, মাসে দুবার…।

কুন্তলা স্নান সেরে তুলসিতলায় প্রত্যুষের পূজা করে আর খেয়াল রাখে আমি বিছানা ছাড়ছি কি না। অন্যদিন আমি ভোরবেলায়ই ঘুম থেকে উঠি। অভ্যাসমতো ভোরেই আমার ঘুম ভাঙে। আমি বিছানা ছাড়ি কিন্তু যে রাতে কুন্তলা আসে, সেদিন বিছানা ছাড়তে গড়িমসি করি। পূজা সেরে কুন্তলা আবার আমাকে ডাকতে এলে ঘুম-জাগরণের মধ্য থেকে ওকে আবার বিছানায় টেনে নিই। ও মৃদু চিৎকার শুরু করে―কী করছ, কী করছো―গৌরবের বাবা। কেবল পূজা দিয়ে এলাম। চিৎকার করে বটে কুন্তলা কিন্তু জোরেশোরে বাধা দেয় না আমাকে। আমি একটু জোর করি, জানি তো, কুন্তলাও আবার বিছানায় যেতে চাইছে। আমি জোর করলেই ঢুকে যাবে কাঁথার ভেতর…।

আহা! স্বপ্নে কী সুখ…!

আমরা সারা রাত খুনশুটি করি। আমি নতুন গল্প-কবিতা কী লিখলাম―ওকে পড়ে শোনাতে হয়। যখন গল্প পড়ি তখন কুন্তলা আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। আমি ওর শরীরের ঘ্রাণ শুষে নিই। কুন্তলার শরীরের ঘ্রাণ আমাকে উজ্জীবিত করে, প্রাণবন্ত করে তোলে। লেখার শক্তি পাই। কুন্তলা এক রাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে, সেটা হয়তো মাসের প্রথম দিন, পরবর্তী ১৫ দিনের শক্তি সঞ্চিত হয় আমার করোটিতে…।

সেদিন রাতে কুন্তলাকে আমার সদ্য লেখা―‘ও মানুষ, ও অসুর’―গল্পটি পড়ে শোনাই। গল্প শুনতে শুনতে ওর চোখে জল এসে গেল। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদল কতক্ষণ। তারপর বলল―‘এত খারাপ হতে পারে মানুষ… ?’

কুন্তলা ভারি নরম মনের মানুষ। গল্প-আখ্যানের চরিত্রের দুঃখ-কষ্ট দেখেও কেঁদে ফেলে…।

স্বপ্নে আমরা অষ্টপ্রহরে কীর্তন শুনতে যাই। গালা, সদুল্লাপুর, এলেঙ্গা, বাংড়া, পৌজান, টেরকি―কোথায় কোথায় যে কীর্তন শুনতে যাই―তার কোনও লেখাজোখা নেই। আমি আর কুন্তলা―যেন স্বামী-স্ত্রী, আমরা পাশাপাশি বসি। আয়োজক নারীদের কেউ এসে আমাদের দুজনের কপালে তিলকমাটির ফোঁটা দিয়ে যায়। যে গাঁয়ে, যে নারীই আমাদের কপালে-কপোলে ফোঁটা এঁকে দেন, তিনিই বলবেন―আহা! কী চমৎকার জুটি গো। যেন স্বর্গ থেকে রাধা-কৃষ্ণ নেমে এসেছে…।

সেবায়েত-নারীর সংলাপ শুনে কুন্তলা গলবস্ত্র হয়ে আমাকে প্রণাম করে। তারপর মাথা তুলে স্বস্থানে বসে গুনগুন করে ‘যমুনার জলে ডুবে মরে রাধা/ কে উদ্ধারিলে/ হে দয়াময়, কে উদ্ধারিলে/ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ তব নাম…।’

কুন্তলা আমাকে প্রণাম করল। আমি সৃষ্টিকর্তার শরণ নিলাম। ‘হে দিন-দুনিয়ার মালিক, আমাকে নিয়ে তুমি এ কী খেলা খেলিছো। রমেশ পালের স্ত্রী আমাকে স্বামীজ্ঞানে প্রণাম করে। গৌরবের বাবা বলে ডাকে, আমি ওকে নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে কীর্তন শুনে বেড়াই। এই সমাজবিরোধী-কাণ্ডের শেষ পরিণতি কী ? রমেশ পাল তো আমাদের দুজনকেই সন্দেহ করা শুরু করেছে…।’

আমার মুখপানে তাকাল কুন্তলা। আর্দ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করল―কী ভাবছো গৌরবের বাবা ?

না। কিছু না…।

কীর্তনে এসে, দেবতাদের আসরে বসে, আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ… ?

না কুন্তলা, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। বলার মতো হলে অবশ্যই বলতাম…।

সেদিন গালা ঠাকুরবাড়ি নামকীর্তন শুনছিলাম। দিনাজপুরের গোপীনাথ সম্প্রদায় কী মধুর সুরে যে মহানামসুধা পরিবেশন করছিল! ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে―হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে’―মহাপ্রভুর নামসংকীর্তন ছড়িয়ে পড়ছিল সমস্ত চরাচরে। এরই মধ্যে আমার ভাবান্তর। কুন্তলার বুকের ভেতরটা খচখচ করছিল। সে সহ্য করতে পারছিল না। কুন্তলা বলল―তুমি কি এই মহাপ্রভুর সংকীর্তন আসরে আমাকে মিথ্যা ছলনায় ভুলিয়ে রাখতে চাও… ?

না কুন্তলা, না। এই পবিত্র মঞ্চে অলক্ষ-দেবতার সামনে মিথ্য কথা বলে আমি পাতকী হতে চাই না। ভাবছিলাম―আমাদের এই সম্পর্কের শেষ পরিণতি কী… ?

তুমি কি ভয় পাচ্ছ ? ভীত-সন্ত্রস্ত! আমি মেয়েমানুষ ভয় পাই না, তুমি পুরুষমানুষ হয়ে ভয় পাচ্ছ… ?

সমাজ-সংসার বলে তো একটি শৃঙ্খলিত বস্তু আছে, কুন্তলা। আমরা সমাজের বাইরের কেউ নই। সমাজের বাইরে, স্বেচ্ছায় সমাজচ্যুত হয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। সমাজ কি আমাদের এই সম্পর্ক মেনে নেবে… ?

গাঁয়ের কিংবা দেশের সমাজপতিরা কে কী ভাবল, কে কী বলল―আমি কোনও কিছুর ধার ধারি না। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি, কি ভালোবাসি না―আমার কাছে এটাই মূল বিবেচ্য। আমাদের মধ্যে ভালোবাসা থাকলে, আমরা যা করছি, তাতে পাপ নেই। আর যদি আমাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা না থেকে থাকে, আমাদের সম্পর্ক যদি শুধুই শরীরসর্বস্ব হয় তবে তুমি পাতকী, আমি পাতকিনী। আমাদের দুজনেরই পরকালে জায়গা হবে দোজখ-নরকে…।

ধন্য কুন্তলা, ধন্য। তোমার সাহসের বলিহারি। ভালোবাসার জোর বলি, আর শক্তিই বলি―কুন্তলার এই প্রবণতাকেই বুঝি তাই বলে…।

একরাতে কুন্তলা বলল―আমরা তো চোখের পলকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারি, বিশ^ভ্রমণ করতে পারি…।

হ্যাঁ, তা পরি। কেন একথা বলছো…।

একবার দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় যেতে চাই…।

কেন, বলো তো…!

দেবরাজ ইন্দ্র ভারি সুপুরুষ। তাকে একবার দেখতে বড় সাধ…।

কোনও সুন্দরী নারীই স্বেচ্ছায় ইন্দ্রসভায় যেতে চায় না। দেবরাজের নারী-প্রীতি ও আসক্তি অসম্ভব প্রবল। তাকে লম্পট বললেও অতিরিক্ত বলা হবে না। তার শিষ্যরা প্রতি রাতেই দশ-বারোজন সুন্দরী অপ্সরী তার সভায় হাজির করে। তারা সেখানে নাচে। শিষ্যরা উর্বশী, মেনকা, রম্ভা― নৃত্যদলের দশ-বারোজনেকেই জানিয়ে দেয়―দেবরাজের সামনে তারা যেন যৌনমুদ্রার নাচন নাচে। কতক্ষণ নাচতে হবে, জানো ? যতক্ষণ না কামোন্মাদ ইন্দ্রের কমোদ্দীপক যৌননৃত্য দেখতে দেখতে তার বীর্যস্খলন ঘটে। তুমি ইন্দ্রসভায় গেলে তোমাকেও যৌনমুদ্রায় নেচে ইন্দ্রর বীর্যস্খলন ঘটাতে হবে। তোমার মতো অপরূপ সুন্দরী নারী বিশ^ব্রহ্মাণ্ডে বিরল। ইন্দ্র তোমাকে ছাড়বে না। তারপরও তুমি ইন্দ্রসভায় যেতে চাও… ?

যেতে চাই…।

কারণ কী… ?

ইন্দ্রের মতো সুপুরুষ দেবতাকে দেখে, তার সভায় নেচে তোমাকে যদি ভুলতে পারি, সুমিত ভাই…।

এসব তুমি কী বলছো, কুন্তলা ? তুমি আমাকে ভুলতে চাও! ভুলতে পারবে আমাকে… ?

তোমাকে ভুলতে চাই এবং ভুলতে হবে…।

এত দিন পর, হঠাৎ এমন কী হলো যে আমাকে ভুলতে চাও ? রমেশদা কি খুব বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে… ?

পাল মশাই তো নপুংসক। তার যন্ত্রণা আমি গায়ে মাখি না…।

তবে… ?

তোমাকে যে আমি গৌরবের বাবা বলে ডাকি, গৌরব তা জেনে গেছে। আমি ছেলের সামনে দাঁড়াতে পারছি না।

এসব কী বলছো তুমি, কুন্তলা ? তুমি স্বপ্নে আমাকে গৌরবের বাবা বলে সম্বোধন করো। স্বপ্ন দেখি আমি। গৌরব এ কথা জানবে কী করে… ?

তা জানি না। সবই ঈশ^রের খেলা…।

তিন

আমার স্বপ্ন দেখা শুরু হয় বাস্তবের এক ভোরবেলা। শেষ হয় পরদিন ভোরে।

আজানের শব্দ কানে এলেই ঘুম ভেঙে যায় কুন্তলার। কুন্তলা বিছানা ছেড়ে স্নানঘরে ঢোকে। স্নান শেষে বাজিতপুরের পাটভাঙা সুতির শাড়ি পরে স্নানঘর থেকে বেরোয়। হাতে সিঁদুরের কৌটা। রুপার তৈরি কৌটাটি আমিই কিনে দিয়েছি। কুন্তলার কুন্তল পিঠের ওপর ছেড়ে দেওয়া। কোমর বেয়ে জল ঝরছে। কুন্তলা বলল―গৌরবের বাবা ওঠো। সীমন্তে সিঁদুর পরিয়ে দাও…।

সিঁদুর পরিয়ে দেব ? তোমার সিঁথির সিঁদুর কোথায় গেল… ?

সারা রাত যে ঝাঁপাঝাঁপি করেছো তাতে সিঁদুর অক্ষত থাকে ? স্নানও তো করেছি। এসো, সিঁদুর পরিয়ে দাও। আমি এখন যাব…।

যেই না কুন্তলার সীমন্তে সিঁদুর পরাতে যাব অনামিকায় সিঁদুর তুলেছি, আমার ঘুম ভেঙে গেল। সম্মুখে কেউ নেই। কিছু নেই। শুধুই অন্ধকার…।

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button