জালালুদ্দিন রুমির রুবাইয়াত : কাজী জহিরুল ইসলাম
কাব্যানুবাদ (প্রথম পর্ব)
কাব্যানুবাদ (প্রথম পর্ব) :
১.
‘কোন সাহসে নিত্য খোঁজো এমন প্রিয়তমা
হৃদয় ভাঙার বাণিজ্য যার এখনও রমরমা’
ভাঙা-গড়ায় নেই পরোয়া আমি যে তার দাস
তার চরণে রাখতে ব্যাকুল আমার হৃদয় জমা।
২.
তাকে পাব বলে তারই কাছে রোজ পরাজিত হই আমি
আছে কিছু আর এই পৃথিবীতে তার চেয়ে বলো দামি ?
দগ্ধ করে সে প্রেমের আগুনে আমাকে যন্ত্রণাতে
অথচ সে ছিল চিরকাল শুধু প্রেমের করুণাকামী।
৩.
আমি মাটি আর পড়ে থাকা শত পদছাপ হলে তুমি
কেন শুধু বলো আমিই তোমার অদেখা পা দুটো চুমি
কোথাও তোমাকে দেখি না কেন যে আমার দু চোখ মেলে
শুধু দেখি শুয়ে পদছাপ আঁকা নির্জন জলাভূমি।
৪.
পাশে থেকে তুমি জাগিয়ে রেখেছো ঘুম নেই আঁখিপাতে
তোমার বিরহে নিদ্রাবিহীন অশ্রুসিক্ত রাতে
প্রতিটি রাতের আছে ব্যবধান যদি জেনে নিতে চাও
কাছে এসে বসো ভালোবেসে প্রিয় হাত রাখো এই হাতে।
৫.
আত্মার যত কুয়াশা ও মেঘ ইবাদতে কেটে যাবে
দিবস-রজনী তোমার হৃদয় যদি এই গান গাবে
বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু প্রতি পলে নিঃশ্বাসে
কলুষমুক্ত হৃদয় তখন আলোর রাস্তা পাবে।
৬.
জীবনের যত হেঁটে আসা পথ পেছনে এসেছি ফেলে
প্রেম ছাড়া আর কিছু নেই দেখি ঘুরে ঘুরে চোখ মেলে
আত্মার খুব গভীরে প্রোথিত প্রেমেরই আর্তনাদ
সমর্পণের আহ্বান শুধু উঠে আসে সব ঠেলে।
৭.
কারাগার থেকে বের হয়ে এস আত্মাকে খুঁজে পাবে
ঝরনাতে নয় নদী-স্রোতে এসো, সমুদ্রে যদি যাবে
মগ্ন থেকেছো পৃথিবীর পথে পৃথিবী হয়েছে বোঝা
উঁচু পথে ওঠো কল্পলোকের প্রান্তরে সাঁতরাবে।
৮.
আমি উন্মাদ শুধু তার প্রেমে, মোহ-ঘোরে আচ্ছন্ন
ছিল না আত্মসংযম কোনও হয়তো ছিলাম বন্য
ভীতি-সঞ্চারে মৃতপ্রায় আমি তখন ছুঁয়েছো তুমি
স্পর্শে তোমার নবরূপ পেয়ে হয়ে গেছি আজ ধন্য।
৯.
প্রেমিক তো সে-ই হয়েছে যে লোক আলুথালু উন্মাদ
খুলে যায় তার মান-অপমান লাজ-লজ্জার বাঁধ
যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু নেই প্রেমিকের পরিণাম
প্রেম পেয়ে গেলে পরোয়া কে করে অন্য কিছুর স্বাদ।
১০.
যদি না সুবাস নিতে পারো তুমি এসো না প্রেমের বাগে
নগ্ন না হলে ত্বক জাগে বুঝি ঝরনার অনুরাগে
বস্ত্রে আচ্ছাদিত থাকো যদি এ-পথে এসো না তুমি
শূন্য হস্তে ফিরে গেছে তারা যারাই এসেছে আগে।
১১.
প্রেম আমাদের আত্মার মাতা, নবির দেখানো পথ
আমাদের তবু প্রেমের সঙ্গে অহরহ দ্বৈরথ
অন্ধকারের ঝিল্লি রয়েছে মাঝখানে একটানা
ওপারে যাবার দৃঢ় প্রত্যয়, দরকার কসরত।
১২.
আত্মা ধরায় নেমেছে কেবল প্রেমের একটি গুণে
বেহেশতে আর ফিরবে না মন সহস্র গুণ শুনে
বিভ্রান্তির প্রলোভন তুমি এক্ষুণি যাও ভুলে
প্রেমের সঙ্গে গড়ো সংসার পৃথিবীতে বীজ বুনে।
১৩.
আমার নীরব দেহখানি তুমি মাটিতে শোয়ায়ে দিও
একটু অদূরে দাঁড়িয়ে দু ফোটা অশ্রু ঝরিয়ো প্রিয়
যদি দেখো কারও চুম্বনে আমি জেগে উঠি পুনরায়
হয়ো না অবাক এটাই সত্যি এই কথা জেনে নিও।
১৪.
কখনও ভেবেছি সম্রাট আমি ক্ষমতার বীর চূড়া
কখনও অন্ধ-কারাতে বন্দি থুত্থুরে এক বুড়া
এই দোলাচলে ক্ষত-বিক্ষত আনন্দ নেই মনে
এই আমিটা তো নিজেরই সৃষ্টি, জাগতিক মোহ-সুরা।
১৫.
আমি তো আমার প্রেমকে দেখেছি একা একা হেঁটে যায়
দীর্ঘ তন্বী, হলুদ পুষ্প ডান হাতে চমকায়
শুধু একবার চুমু খাবো ঠোঁটে লাফ দিয়ে উঠে যাই
সে বলে, বাঁচাও, চোর চোর দেখো আমার পেছনে ধায়।
১৬.
অন্যের গলা করেছি নকল নিজের কণ্ঠ নেই
নিজের ভেতরে বহু স্রোত দেখে হারিয়ে ফেলেছি খেই
নিজেতেই নিজে ডুব দিয়ে দেখি নিজস্ব নেই কিছু
হয়তো কিছুটা নিজের স্বরূপ চিনি দূরে দাঁড়ালেই।
১৭.
জেনে নাও তুমি গোপন সত্যি বেহেশতে যাবে যদি
হৃদয়ে তোমার করুণা খোদার মিলে যদি নিরবধি
সত্যের পথ পাবে তুমি তবে, মৃত্যু ঘটার আগে
হৃদয়কে রেখো সারাটা জীবন ভালোবাসা-ভরা নদী।
১৮.
কী বলে গানের ওই প্রিয় সুর তুমি কি সে কথা জানো ?
‘আমার দেখানো রাস্তায় এস আমার কথাটি মানো,
হয়তো যদি বা ভুল পথে হাঁটো এই পথই জেনো ঠিক
প্রশ্নের সব উত্তর পাবে, সত্যের সন্ধানও।’
১৯.
বন্ধুর সাথে মিলন ঘটেছে এই মধুময় রাতে
আনন্দে মেতে ঘূর্ণন নাচে হাত রাখি তার হাতে
হৃদয়কে বলি, ভেবো না, ভোরের চাবিটা দিয়েছি ফেলে
অন্তবিহীন চলবে নৃত্য আঁধার জলপ্রপাতে।
২০.
প্রেমরসে ডুবে প্রভু বিস্মৃত কিছু নেই তার মনে
‘কিছু মধুরস দেবে কি আমাকে, মিলি তবে বন্ধনে ?’
‘কী আছে আমার দেবো বলো তুলে তোমার আঁজলা ভরে’
প্রভু সম্রাট ভুলে গেছে তার দখল কতটা ধনে।
—-
সচিত্রকরণ : রজত