আর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

জীবনযুদ্ধ : ইউসুফ ইদ্রিস

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

বাংলা অনুবাদ : বেগম জাহান আরা

[ইউসুফ ইদ্রিস, মিশরীয় লেখক। জন্ম : ১৯ শে মে, আল বায়রুম, মিশর; ১৯২৭; মৃত্যু : ১ আগস্ট, ১৯৯১। নিবেদিতপ্রাণ বামপন্থি এই লেখক ডাক্তারি পড়েছেন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশাগত জীবন শুরু হওয়ার পর তিনি সাহিত্যচর্চায় ব্রতী হন। প্রথমে তিনি গামাল আব্দেল নাসেরকে সমর্থন করেছেন। পরে নাসেরের সমালোচনা করার জন্য ১৯৫৪ সালে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে।

তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল হারাম (নিষিদ্ধ) এবং আল-আইব (পাপ)। লেখকের প্রধান বৈশিষ্ট হলো, ক্লাসিক্যাল আরবির সঙ্গে চলিত মৌখিক আরবির মিশ্রণে সাহিত্য রচনা করা।]

সে বেল বাজালে বদির দরজা খুলে দিল। তার পরনে তখন ছিল গ্যালাবিয়ার (এক ধরনের মিশরীয় ঢোলা পোশাক), ওপরে গোসল সেরে পরার একটা কোট। মাথায় সাদা উলের টুপি। আর তার ওপর পাগড়ির মতো করে একটা স্কার্ফ জড়ানো।

দরজা খুলে ফিরে গিয়ে বসতে বসতে বদির বলল, ‘ওহ, আমার হাঁটু দুটো একেবারে ভেঙে আসছে। আমি নিশ্চিত যে, তুমি কোথাও ধরা খেয়েছিলে। কোথায় ছিলে এতক্ষণ ?’

‘কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।’

‘পেলে কোনও কাজ ?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী কাজ ?’

‘আমি প্রাইভেট পড়াতে যাচ্ছি।’

‘কোথায় ?’

‘এখানে।’

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল বদির। হাসির তোড়ে চেয়ার কাঁপতে লাগল। যে পত্রিকাটা সে পড়ছিল, কাঁপতে লাগল সেটাও। এলোমেলো হয়ে যেতে থাকল তার গায়ের গোসলের কোটটা পর্যন্ত।

‘এখানে কোথায়, জানতে পারি কি ?’

‘এখানে, এই অ্যাপার্টমেন্টে।’

‘ও, তবে তো খুব ভালো। তোমার রসবোধ আছে বলতে হয়। ওরা তাহলে তোমার সম্বন্ধে আজেবাজে ফজুল কথা বলে কেনো ? …যাই হোক, রাতের খাবার খেয়েছো ?’

‘খেতে ইচ্ছে করছে না, খিদে নেই।’

‘আমি বিশ্বাস করি না। খেতে ইচ্ছে করে না, এমন ঘটনা তোমার জীবনে ঘটেনি। এটা ডাহা বানোয়াট। কী বলছো তুমি ? খিদে নেই ? খেতেই হবে তোমাকে রাতের খাবার। এসো কিছু খাবে। তোমার সঙ্গে কিছু কথাও বলতে চাই।’

এরপর হামজা আর বেশি আপত্তি করল না। উপায়ও ছিল না, তাকে বসে রাতের খাবার খেতেই হলো।

বদির একটু গম্ভীরভাবে বলল, ‘শোনো হামজা, অন্তর থেকে আমি তোমার কথা ভাবি। তুমি আমার ভাইয়ের মতো। আমরা দুজন পনেরো বছরের বন্ধু এবং সহকর্মী। তাই আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।’

‘কী বলতে চাও, বলো না।’

‘হামজা, ভাই আমার, এবার স্থির হও। এই সবের শেষ করো। জীবনের যথেষ্ট সময় অপব্যয় করেছো। আর বেশি বাকি নেই। অধিকাংশ সময় শেষ করেই ফেলেছো। সারা জীবন কেবল দৌড়ালে। এবার ঠিক করো, কী করবে ? আমার কথায় কিছু মনে করো না ভাই। বিষয়টা বুঝতে হবে তোমাকে। হয়তো আমার কথা রূঢ় শোনাচ্ছে, কিন্তু এটাই বাস্তব।’

একটু হেসে হামজা বলল, ‘ঠিকই বলেছো। আমার মা-ও ঠিক এই রকমই বলত। কিন্তু সুস্থির হব কেমন করে ?’

‘সুস্থির হও―কাজ করো, ঠিক কাজটা করো। বিয়ে করে সংসারি হও। বাড়ি হবে, পরিবার হবে। বাদ দাও ওসব। তোমার মতো শিক্ষিত মানুষের এরকমভাবে জীবন কাটানো ঠিক নয়।’

‘কিন্তু আমার বর্তমান জীবনযাপন নিয়ে আমি সুখী।’

‘সুখী ? কেমন করে ?’

‘আমার সুখী হওয়ার কারণ হলো এই যে, কোথায় এবং কেমন করে তুমি বেঁচে আছো তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কেন তুমি বেঁচে আছো, অন্য মানুষের জন্য কী করছো, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।’

‘আমি বুঝলাম না। তুমি আমার সঙ্গে তামাশা করছো ভাই। এসব কি বলছো ?’

‘ঠিক আছে। অবশ্যই তুমি বুঝতে পারবে না আমার কথা। তোমার নিজের বউ বাচ্চা আছে, নিজের বাড়ি আছে, নিজের কাজ আছে। আমার কিন্তু একান্ত নিজস্ব কোনও জীবন নেই। আমি আমার সমস্ত জীবন মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছি। ওদের প্রয়োজনে আমি ছুটে বেড়াই, আমি দৌড়াই… আমি জেলে যাই, আমি জেলে যাই… মরি। এই তো আমার জীবন।’

‘আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে তোমার বয়ান। ব্যস কথা শেষ ? তুমি তাহলে নবী হয়ে গিয়েছো ? এই পৃথিবীর কিছুই চাও না তুমি ? কোনও উচ্চাকাক্সক্ষা নেই তোমার ?’

‘সাধারণ লোকের চাওয়া পাওয়া আর আমার ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া একেবারে এক।’

‘আহা, কী সুন্দর কথা! তাহলে কি আমি ধরে নিতে পারি যে, তুমি কোনও দিন বিয়ে করবে না ? কোনও দিন নিজের সংসার, বাড়ি গড়বে না ?’

‘নিশ্চয়ই আমি বিয়ে করব, সন্তানাদিও নেব। তবে আমার বিয়ে অবশ্যই আমার আদর্শের অনুগত হবে। শুধু সুখী জীবন যাপনের জন্য নয়। নিশ্চয়ই আমার বাড়িও হবে, যে বাড়িতে অবাধ আসা যাওয়া থাকবে সর্বসাধারণের।’

‘তার মানে তুমি সারা জীবন এই রকমই বাস্তুহারা ভবঘুরে থাকবে ?’

‘একেবারেই না। আমাকে যা বাস্তুহারা বা ছিন্নমূল করেছে, তা কোটি কোটি মিশরীয়দেরও বাস্তুহারা করেছে। এবং এটা ঠিক যে, কোটি কোটি মানুষ এভাবে চিরদিন বাস্তুহারা বা ভবঘুরে থাকতে পারে না।’

বদির অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, হুম, ভালো। মনে হয়, আমার এসব কথার কোনও দাম নেই। বেশ ঠিক আছে, শুভরাত্রি।’ গায়ের ওপর কাপড় টেনে নিয়ে বদির শুয়ে পড়ল এবং নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল অবিলম্বে।

 হামজা ঘুমাতে পারল না। একটু আগের কথাবার্তা তাকে মনে করিয়ে দিল, সে আর বদির অনেক দূরের শুধু নয়, একেবারে আলাদা মানুষ। এই ঝলমলে অ্যাপার্টমেন্টে আসার পর থেকেই তার এমন মনে হয়েছিল। এমন কি এখানে ‘জনতা’ শব্দটা উচ্চারণ করাও অদ্ভুত মনে হলো। এই ঝাড়বাতি, মূল্যবান কার্পেট এবং ব্র্যান্ডেড আসবাবপত্রের মাঝে এমন কথা বলা বড়ই বেমানান। তার ইচ্ছেগুলো মনের চোখে অনেক গুণ বড় হয়ে উঠেছিল। তার মা, তার বাবা, সবার কথা বেশি করে মনে হলো। রেলকর্মী বাবার দুই ধারে সরু করে পাকানো বিশাল গোঁফ ছিল। রেল ক্যাম্পই তাঁর শৈশব এবং কৈশোরের একমাত্র স্মৃতিচারণ ক্ষেত্র। কর্মকর্তারা এই ক্যাম্পগুলো রেল কর্মীদের জন্য তৈরি করেছিল স্টেশনগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে যাতে লাইন মেরামতির কাজে সুবিধে হয়। বদ্ধ ছোটো ঘুপচি এলাকায় বাস করত রেল কর্মীরা। সবার সঙ্গে সবার নিত্য মুখোমুখি দেখা হতো। দারিদ্র্য ছিল তাদের নিত্যকার গোপন সঙ্গী। তারা জীবনের সংগ্রাম করত একসঙ্গে। কর্মীদের বউরা শুক্রবার সকালে একসঙ্গে গোসল করত আর রাতের নানা ঘটনা নিয়ে গর্বিত হয়ে গল্প করত। কর্মীরা সেচ খালে একসঙ্গে গোসল করত স্ত্রী-সঙ্গের পর পবিত্র হওয়ার জন্য। ক্যাম্পের জীবনে সকালটা ছিল মহিলাদের দখলে। আবার সন্ধ্যায় হাঁস মুরগি হারিয়ে যাওয়া নিয়ে চলত তুমুল বিরামহীন ঝগড়া। মহিলাদের টাকার একমাত্র উৎস ছিল হাঁসের ডিম। আর পুরুষদের ছিল হাতে বানানো সিগারেট। কিন্তু আসল টাকা পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে ঘুরত অন্য হাতে। প্রত্যেক ক্যাম্পেই একটা করে নেকড়ের মতো ধূর্ত মানুষ থাকত, যারা তাদের দাড়ি দেখিয়েই বউদের পেছনে লুকাত। তারা জানত না, কিন্তু ছেলেমেয়েরা এবং বউয়েরা তাদের জন্য সতর্ক থাকত। প্রত্যেক ক্যাম্পেই একজন করে চিহ্নিত কৃপণ থাকত, যে লক্ষ লক্ষ টাকা জমাত নিজের গাঁয়ে একখণ্ড জমি কেনার জন্য। প্রত্যেক ক্যাম্পেই একজন করে ধার্মিক স্বপ্নদর্শী মানুষ থাকত, পুরুষেরা যাকে নিয়ে ঠাট্টা করত। আর মহিলারা তারই কাছ থেকে দোয়া চেয়ে নিত। প্রত্যেক ক্যাম্পেই একজন করে সুন্দর বউ থাকত, যাকে নিয়ে হিংসা বিদ্বেষ ঝগড়ার অন্ত থাকত না। প্রতি বছর ডজন ডজন শিশুর জন্ম হত ক্যাম্পে। লক্ষ লক্ষ মশা এবং কীটপতঙ্গের উৎপাত ছিল। আর ছিল সারা রাত কুকুরের ঘেউ ঘেউ। তারা যেন পাহারা দিত দারিদ্র্য, পানির জগ এবং ক্ষীণজীবী মানুষগুলোকে।

প্রতিদিন কোনও না কোনও সমস্যা, ঝগড়া, চেঁচামেচি, কাড়াকাড়ি, ফোরম্যানের কর্তৃত্ব নিয়ে কথা কাটাকাটি, কর্মীদের দ্বারা কর্তৃত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা, বেতনের স্কেল নিয়ে কথা, বেতন না বাড়ার কথা, ইত্যাদি লেগেই থাকত। মহিলারা গর্ভধারণের জন্য উন্মুখ থাকত, পুরুষেরা ঋণের ধান্দায় থাকত। কর্মীদের সম্পদ ছিল মেরামত করা হলুদ প্যান্ট, লম্বা কাঠের ক্যাপ এবং পায়ে মিশরীয় সৈনিকদের পরিত্যক্ত ভারী বুট। রেলের হুইসেল আসে যায়। কোনও কিশোরী জানালা খুলে রেল দেখে, চিন্তা করে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, স্থানীয় কোনও শহর এবং তাঁর শিক্ষিত মানুষের স্বপ্ন দেখে, এবং তিনটে সোনার পাতের চুড়ির কথা ভাবে।

প্রত্যেকদিন সমস্যা, ঝগড়া, চেঁচামেচি, কাড়াকাড়ি লেগে থাকার পরও, দিন শেষে সূর্য ডোবার পর চুলার ধোঁয়া বন্ধ হয়ে গেলে এবং রেলের ধোঁয়া বন্ধ হয়ে গেলে মানুষগুলো বাড়ি ফেরে। কী শীত কী গ্রীষ্ম তারা এসে জমা হয় বাড়ির সামনে। সেখানে নিচু টেবিল পাতা থাকে। তাঁর চারপাশে মানুষেরা গোল হয়ে বসে। রাতের খাবার শুরু হতেই শেষ হয়ে যায়। তারপর আয়েশ করে। কখনও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কিছু ভালোমন্দ কথাবার্তা হয়। তাদের চোখ তখন ঘুমে ভারী। হতাশার চেয়ে আশার কথাই তারা তখন বলে। স্ত্রীরা অস্থির থাকে, স্বামীরা থাকে শান্ত। মহিলারা শঙ্কিত থাকে, পুরুষরা আশ্বাস দেয়। স্ত্রীরা হাই তোলে, স্বামীরা ক্লান্ত স্বরে বলে, ‘কাল সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

হামজা এবং অন্য ছেলেমেয়েদের জন্য দিনটা আসত তাদেরই জন্য। তারা দৌড়াদৌড়ি করত, লাফালাফি করত, সেচ খালের পানিতে সাঁতার কাটত। তারা রেল লাইনের পাতগুলো গুনত, একটা লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটত, নুড়ি কুড়িয়ে চকমকি খেলত। বাবাদের অনুকরণ করে চড়ুই শিকার করত গুলাল এবং ছোটো ছোটো পাথর ছুড়ে। তাদের সবচেয়ে ভালো খেলা ছিল লোহার কাঁটা রেল লাইনের ওপর রেখে অপেক্ষা করা রেলের জন্য। রেলের চাকার চাপে সেটা সমান হয়ে পাতলা এবং চাকুর মতো ধারাল হতো। রেল লাইনের দু ধারে ক্যাকটাস ঝোপে এক ধরনের ফল (অপুনিয়া) হতো অনেক। মৌসুমে বহু মানুষ সেটা কেটে নিতে যেত। রেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ব্যবসায়ীরাও যেত সেই ফল কাটতে এবং তারা পাহারা দিত যেন অন্যেরা ফল কেটে নিতে না পারে।

তার মতো ছেলেমেয়েরাও সবাই অসুস্থ থাকত ‘বিলহাজারিয়া’ (রক্তে বীজাণুঘটিত অসুখ), পেটে হুক ওয়ার্ম, হাম, মালেরিয়া এবং চোখের অসুখে। তাদের মধ্যে কারও জন্ডিস এবং প্লীহার অসুখ থাকত। ওদের গায়ের স্বাভাবিক রঙ কোনও দিন ফিরে আসত না।

তার ওপর আছে শেখ জিদান কোরানিক স্কুলের বাধ্যতামূলক পড়া এবং কড়া পিটুনি। প্রাথমিক স্কুলে প্রথম সে ইউনিফরম পায়, তার সঙ্গে পায় গাঢ় বিশ্রি রঙের ফেজ টুপি। শতকরা ৮৫% নম্বর পেয়ে সে পাস করে এবং মাধ্যমিকে ফ্রি পড়ার যোগ্য হয়। তার বাবা আনন্দিত হয়। কিন্তু মা চাইল সে ব্যবসা শিখুক, আর পড়ার দরকার নেই। তার বাবা চাইল, সে একজন ইঞ্জিনিয়ার হবে এবং রেল কোম্পানিতে কাজ করবে তার বসের বসের বসের বসের মতো। মা তার বাবার হিংসাত্মক প্রতিযোগিতা প্রতিরোধ করার জন্য তুকতাক জাদুমন্ত্রও প্রয়োগ করেছিল। বাবা তাঁর শতছিন্ন প্যান্ট দেখিয়ে বলেছিল, ‘নিজেকে উন্নত শ্রেণিমর্যাদার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলো। নইলে এই রকম শতছিন্ন প্যান্টই জুটবে তোমার কপালে।’ এবং সে উন্নত হয়েছিল।

মাধ্যমিক সার্টিফিকেটের পর দুর্যোগটা নেমে এল। বহুদুরে আলেকজান্দ্রিয়ায় নির্বাসনের সময় মাত্র এক পাউন্ড বা পঞ্চাশ পিয়াস্তারের জন্য হামজাকে প্রচণ্ড বেদনাময় সংগ্রাম করতে হয়েছে। এইভাবে এক বছর কেটে গেল। আরও তিন বছর কাটাতে হবে। সে প্রার্থনা করত, ‘ও দয়াময়, আমার জন্য সব কিছু সহজ করে দাও।’ কিন্তু এরই মধ্যে তার কিছু বদ অভ্যেস গড়ে উঠেছিল। মানুষকে খুঁচিয়ে জ্বালাতন করত, তাসের জুয়া খেলত, মদ খেত, কসাইখানার মাংসের ওপর লাল ছাপের মতো টকটকে লাল লিপস্টিক দেওয়া কোঁকড়া চুলের মহিলাদের পেছনে ঘুরত। বাবার কাছে মিথ্যে কথা বলত। বন্ধুদের ঠকাত। এক বছর সে ফেল করল। বাবার কাছে গোপন করল সেই কথা। তার বাবার ধারণা, মেধাবী ছাত্র হিসেবে নিশ্চয়ই সে পাস করেছে। কিন্তু না। প্রতারিত হলো বাবা এবং মর্মে মর্মে মরে গেল।

তার বাবা আর পেরে উঠছিল না। হামজার চাহিদা তার গলা চেপে ধরেছিল। তার মা মাথার স্কার্ফে নকশা করতে শিখেছিল। সংসারটাকে টিকিয়ে রেখেছিল সেইটুকু আয়। এমন কি ফোরম্যান প্রতি মাসে পঞ্চাশ পিয়েস্তার দিত। তার বাবা হামজার ছোটো ভাইকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিল, যেন হামজার লেখা পড়াটা অন্তত চালানো যায়। কারণ সে বড় এবং প্রায় রোজগারের উপযুক্ত হয়ে আসছে। ৬ মার্চ শুরু হলো মিছিল, কমিটি এবং সম্মেলন। সেই সময় তার ভাই শান্টিং ইয়ার্ডে কাজ করত। একদিন সকালে রেলের চাকার নিচে পড়ে তার তার পা কাটা গেল। ছয় মাস মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সে আবার কাজে ফিরে এল এক-পা নিয়ে। রেল ক্রসিঙের জায়গায় পাহারাদারের চাকরিতে বহাল হলো সে।

হামজা গ্র্যাজুয়েট হয়ে একটা কারখানায় চাকরি শুরু করল। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে সে খবরের কাগজ ছাপাল ইউনিয়নের সংবাদ দিয়ে। রাজনীতিতে মিশে গেল সে। তাঁর জীবন হয়ে উঠল রাজনীতি। সারাক্ষণ বেকার সমস্যা নিয়ে মিটিং এবং আলোচনা এই সব নিয়ে থাকত। রাজনৈতিক পুলিশ তাকে চিহ্নিত করেছিল। তার প্রথম সাজা হয়েছিল মিথ্যে অভিযোগে। সে হয়ে পড়েছিল আটচল্লিশ নম্বর নজরবন্দি মানুষ। তারপর আল-তুর, হাইকসটেপ এবং আলেকজান্দ্রিয়া বিদেশি জেলেও বিশ মাস কাটাতে হয়েছিল তাকে। তারপর ছাড়া পেয়েছিল। কিন্তু মিশরে যখনই কোনও ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আসত, তখন বন্দি করা হতো তাকে। এছাড়া প্রত্যেক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানাদির সময় দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাকে আটক রাখা হতো পুলিশ স্টেশনে। বিষয়টা এমন হলো যে, বছরের শুরুতেই সে হিসাব করতে পারত, বছরের কোনও কোনও সরকারি ছুটির দিনে সে আবার কোনও না কোনও অভিযোগে পুলিশ স্টেশনে আসবে।

সম্পদ বলতে গ্র্যাজুয়েশনের সময় তৈরি করা একটা মাত্র স্যুট ছিল তার। ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টার থেকে এক পাউন্ড দিয়ে একটা চশমা কিনেছিল। আর ছিল পুরনো একজোড়া জুতো। কখনও সে বাবার কাছে টাকা পাঠাত। কিন্তু মায়ের চাহিদা সত্ত্বেও তাকে এক জোড়া কালো স্যান্ডেল কিনে দিতে পারেনি। তার মা তখনও স্কার্ফে নকশা সেলাই করত। বাবা বুড়ো হয়ে গিয়েছিল। সাদা হয়ে গিয়েছিল তার গোঁফ। ফোরম্যানের চাকরিটা আর ছিল না। খোঁড়া ছোটো ভাই তখনও রেল আসা-যাওয়ার সময় গেট খুলত এবং বন্ধ করত। বোন নাবাবিয়ার তখনও বিয়ে হয়নি। এই অবস্থায় তারা অন্য ক্যাম্পে চলে গেল।

মা তার সন্তানের সুমতির জন্য প্রার্থনা করত নিয়ত। আর বাবা মানুষদের বলত তার নিজের শোষণ-বঞ্চনার কথা এবং শাপশাপান্ত করত সরকার ও রেল কর্তৃপক্ষকে। চারপাশের সমস্ত ব্যাপারটাই তার কাছে বীরত্বের গাথা হয়ে উঠেছিল, যখন একটা রেল যাওয়ার পর ছোটো ছেলেমেয়েরা বলত, ‘ঐ রেল হামজার কাছে যাচ্ছে।’

‘তুমি কি ঘুমাবে না হামজা ?’

‘হ্যাঁ বদির, এখনই ঘুমাবো আমি ।’

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button