বন্ধুসভার ‘কবিতা উৎসব’ : সাইদুল হাসান
বিশেষ আয়োজন : কবিতা নিয়ে কর্মশালা
সারা পৃথিবী করোনা আক্রান্ত। দেশে দেশে লকডাউন। মানুষ ঘর থেকে বের হয় না। মা সন্তানকে স্পর্শ করে না। বাবা স্পর্শ করে না ছেলেকে। বাবা-মার লাশ কাঁধে তুলে নেয় না ছেলে। মানুষ মানুষের লাশ স্পর্শ করতে ভয় পায়। কী এক ভয়ংকর সময় পৃথিবীময়! সময়টা দুই হাজার বিশ সাল।
বাংলাদেশে প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরাও চুপ। অথচ তারা সারা বছর দেশব্যাপী কত কত কাজ করে। জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ থেকে কোনও নির্দেশ আসছে না। এমন সময় আমরা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ থেকে কয়েকজন উদ্যোগ নিলাম অনলাইনে কাজ করব। যে কথা সেই কাজ। ঘরে বসে বন্ধুদের তৈরি হতে বিভিন্ন কাজ হাতে নেওয়া হলো। আমি বললাম শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তি কর্মশালার কথা। সভাপতি মুমিত ভাইসহ অন্যরা রাজি হলেন। দায়িত্ব নিলাম। অনলাইনে শুরু হলো প্রথম শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তি কর্মশালা। দুই মাসব্যাপী কর্মশালা হলো। কর্মশালা শেষে বন্ধুদের অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হলো। বন্ধুরা লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিল। ফলাফল প্রস্তুত করলাম। কোনও অনুষ্ঠান করতে পারলাম না! সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দেওয়া হলো অনলাইনে।
তখন থেকে মনের জানালায় উঁকি দিয়েছিল ‘কবিতা উৎসব’। সেই উঁকি দেওয়া স্বপ্ন আলো হয়ে ধরা দিল দুই হাজার তেইশ সালে। এর আগে দুই হাজার একুশ সালে অনলাইনে দ্বিতীয় কর্মশালা করালাম। সারা দেশ থেকে বন্ধুদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। এবারে আমাদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের বরেণ্য আবৃত্তি শিল্পীরা। ছিলেন―রূপা চক্রবর্তী, শিমুল মুস্তাফা, মাহিদুল ইসলাম ও রবিশংকর মৈত্রী।
তারই ধারাবাহিকতায় দুই হাজার বাইশ সালে অনলাইনে তৃতীয় কর্মশালা আয়োজন করা হয়। এ পর্যায়ে প্রশিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিই সোলায়মান ভাই ও আমি। তৃতীয় কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিল ৬৬ জন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ৩৬ জন। উত্তীর্ণ হন ২৯ জন। বাচিক শিল্পে যুক্ত হওয়ার প্রয়াসে বন্ধুদের অভিন্দন।
এবারে বন্ধুদের সার্টিফিকেট দেবার কথা বলতেই সবাই বলেন―অনুষ্ঠান করে সার্টিফিকেট দিতে হবে। করোনা চলে গেছে। সারা পৃথিবীর মানুষের জীবন স্বাভাবিক হয়েছে। বন্ধুদের বললাম যদি কবিতা উৎসব করা যায় তাহলে কেমন হয় ? বন্ধুরা একসঙ্গে বলে উঠলেন তাহলে তো খুবই ভালো হয়।
আমি বর্তমান সভাপতি উত্তমদার সঙ্গে পরিকল্পনা শেয়ার করলাম। দাদা রাজি হলেন।
এর মধ্যে আমার ছেলের ডেঙ্গু হলো। ডেঙ্গু হলো বড় ভাতিজার বউয়ের। অতঃপর ছোট ভাতিজার বউয়েরও। সবাই হাসপাতালে থাকল। অবস্থা ভীষণ খারাপ ছিল। এরকম পারিবারিক বেশ কিছু সমস্যার কারণে যথাসময়ে অনুষ্ঠান করতে দেরি হয় বলে দুঃখিত।
এবারে আটঘাট বেঁধে অনুষ্ঠান আয়োজনে নেমে গেলাম। অনলাইনে লাইভ করে অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হলো। সারা দেশের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হলো। কবিতাপ্রেমী সবাই সাড়া দিলেন। বন্ধুসভার প্রধান পৃষ্ঠপোষক আনিসুল হক, সভাপতি উত্তম রায়, নির্বাহী সভাপতি মৌসুমি মৌ, সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক, সোলায়মান কবীর, বহ্নি শিখা, শাকিব, তাহসিন, তাওহীদসহ সকলের সহযোগিতায় এল ‘কবিতা উৎসব’।
অতঃপর…
‘কবিতা উৎসবে কবিতাকে জানা, বোঝা, শেখা সবকিছু হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠল। অনেকটা ঠিক আয়োজনে উপস্থিত বন্ধুদের মতো, যারা সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসে একত্র হয়ে আবিষ্কার করলেন, সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়েও তারা আসলে এক। তার একমাত্র কারণ―কবিতা।’ এমন অনুভূতি প্রকাশ করলেন চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধু নাজিফা তাজনুর।
এমনই আরও অনেক ভালোলাগা অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সারাদেশ থেকে আগত বন্ধুরা। তারা সবাই খুব খুশি এমন আয়োজনে। তাদের চাওয়া প্রতি বছর যেন এরকম ‘কবিতা উৎসব’ হয়।
বলছিলাম গত ২৯ জুলাই শনিবার অনুষ্ঠিত কবিতা উৎসবের কথা। ‘যে কবিতা শুনতে জানে না, সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে’―কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর বিখ্যাত পঙ্ক্তিকে ধারণ করে প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ আয়োজন করে ‘কবিতা উৎসব’ ২০২৩। এ আয়োজন এবারই প্রথম। আর তার সাক্ষী হতে পেরে গৌরব বোধ করছি। ২৯ জুলাই শনিবার কারওয়ান বাজার প্রথম আলোর দশম তলায় সভাকক্ষে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় ‘কবিতা উৎসব’।
উৎসব শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে সঙ্গে সকালটা অন্যরকম নান্দনিকতা পায়। এর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তর মম বিকশিত কর, কাজী নজরুল ইসলামের নম নম বাংলাদেশ মম কবিতার বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশিত হয়। বৃন্দ আবৃত্তি করেন―সোলায়মান কবীর, মাহাবুব পারভেজ ও বহ্নি শিখা। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। শুরুতে অতিথি ও বন্ধুদের গোলাপ ফুল দিয়ে বরণ করে নেন বন্ধু মেঘা। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক। উৎসব সকাল ১০টায় শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলে। দিনব্যাপী এ উৎসবে আলোচক হিসাবে ছিলেন কবি সাজ্জাদ শরিফ, সাহিত্যিক আনিসুল হক, বরেণ্য আবৃত্তি শিল্পী মীর বরকত ও শিমুল মুস্তাফা। উপস্থিত ছিলেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায়, সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক ও অন্যান্যরা।
কবিতা কীভাবে পড়া উচিত, এ বিষয়ে তাৎপর্যময় আলোচনা করেন কবি সাজ্জাদ শরিফ। রবীন্দ্রনাথ, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ আরও অনেক কবির কবিতা পড়ে পড়ে উদাহরণ দিয়ে তিনি কবিতার বাতাবরণ স্পষ্ট করেন। তুলে ধরেন মানব বোধের যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। বলেন, ‘কবিরা মনের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখেন। তাই কবিতায় সারা পৃথিবী জীবন্ত। কবিতা সরাসরি কথা বলে না। বলে সুর দিয়ে, ছন্দ দিয়ে, রূপক দিয়ে।’
বাকপ্রত্যঙ্গের ব্যায়াম নিয়ে কথা বলেন আবৃত্তিশিল্পী মীর বরকত। বলেন―শরীরকে সবল রাখতে যেমন প্রতিদিন ব্যায়াম করা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি কণ্ঠ সতেজ ও সবল করতে কণ্ঠের ব্যায়াম করা প্রয়োজন। আবৃত্তি, সংবাদ পাঠ, উপস্থাপনা করতে সক্রিয়, নমনীয় ও বলিষ্ঠ বাক-প্রত্যঙ্গ দরকার। সাতটি সচল ও স্থির বাক-প্রত্যঙ্গ―জিব, ঠোঁট, দাঁত, তালু, চোয়াল, নাক ও স্বরতন্ত্রী। এদের প্রত্যেকটির সঠিক অনুশীলন কীভাবে করতে হয়, তার ব্যবহারিক অনুশীলন করে দেখান। সবাই সেগুলো খাতায় লিখে নেন এবং অনুশীলন করে শিখে নেন। এ পর্বটি সবাই আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন। আলোচনা শেষে তিনি মজার একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান।
বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী শিমুল মুস্তাফা আলোচনা করেন আবৃত্তির কলাকৌশল নিয়ে। শুরুতেই তিনি আবৃত্তির ক্ষেত্রে গুরুবিদ্যার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। বলেন, ক্রিকেট খেলায় যে যত কৌশল রপ্ত করতে পারেন সে তত ভালো ক্রিকেটার। ঠিক তেমনি আবৃত্তির ক্ষেত্রে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে যত কৌশল রপ্ত করতে পারেন তিনি তত ভালো আবৃত্তি শিল্পী হয়ে ওঠেন। তিনি অনুকরণ ও অনুসরণ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। বলেন―শুরুতে সবাই অনুকরণ করে। তারপর আসে অনুসরণের বিষয়। বিস্তর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে এক সময় নিজেই নতুন সৃষ্টি করতে পারেন। কবি সাহিত্যিকরা কে কাকে অনুকরণ করতেন তার অনেক উদাহরণ দেন। আবৃত্তিশিল্পে নিজের গুরু হিসেবে উল্লেখ করেন কাজী আরিফ ও কাজী সব্যসাচীর নাম। শুরুর দিকে নিজে কবিতা লিখতেন সে কথাও বলেন। আমাদের সবার সহজাত জানা একটি বিষয় শুদ্ধ করে দেন। বলেন―‘যতীন্দ্রমোহন বাগচীর “কাজলা দিদি” কবিতাটা আসলে তাঁর দিদিকে নিয়ে লেখা নয়। ঠাকুরমাকে নিয়ে লেখা। বলেন, “জয় বাংলা” স্লোগান ও “বাংলাদেশ” নাম দিয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’ এরকম অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরেন। আবৃত্তিকে মস্তিষ্কের শিল্প বলে উল্লেখ করেন। বলেন আবৃত্তি শিল্পী হতে হলে উন্নত বোধসম্পন্ন মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে। শতাধিক বন্ধু পিনপতন নীরবতায় শিমুল মুস্তাফার অসাধারণ আলোচনা উপভোগ করেন। আলোচনা শেষে তাঁর কণ্ঠে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা ‘দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের গান’-এর আবৃত্তি মিলনায়তনজুড়ে ছড়িয়ে দেয় মুগ্ধতা।
কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন―‘লেখকের পড়া আর পাঠকের পড়া এক নয়। পাঠক পড়েন এবং মুগ্ধ হন। লেখক পড়েন, মুগ্ধ হন এবং ভাবেন, “কেন মুগ্ধ হলাম ?” এখানেই পাঠক ও লেখকের মধ্যে সত্যিকারের পার্থক্য।’ তিনি আরও বলেন―‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে শুধু কবিতা।’ বলেন―‘লিখতে হলে পড়তে হবে পড়তে হবে আর পড়তে হবে।’
আলোচনার মাঝে মাঝে উৎসবজুড়ে চলছিল কবিতা আবৃত্তি। আবৃত্তি করে শোনান আবৃত্তি শিল্পী সাইদুল হাসান, সোলায়মান কবীর, মাহবুব পারভেজ ও বহ্নি শিখা।
অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল কবিদের স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। সারাদেশ থেকে আগত ত্রিশের অধিক কবি কবিতা পাঠ করে শোনান। শ্রোতারা করতালির মাধ্যমে কবিদের অভিনন্দিত করেন। অনুষ্ঠানের সেরা আকর্ষণ ছিল আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। সারা দেশ থেকে আগত পঁচিশ অধিক বন্ধু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। সেরা দশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন―নাফিজা তাজনুর, মেহজাবীন মৌসী, আদিবা সুলতানা, নিদ্রা আক্তার, শহিদুল ইসলাম, মুনিরা শাহনেওয়াজ কেয়া, দোলন রানী দে, জাফির হাসান, অমৃতা বিশ্বাস ও ফারজানা ইসলাম।
আয়োজনের শেষ পর্বে সেরা দশ আবৃত্তিশিল্পীর হাতে তুলে দেওয়া হয় সনদ ও বই। শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তি কর্মশালার তৃতীয় আবর্তনে উত্তীর্ণদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সনদ ও বই। বই ও সনদ তুলে দেন আনিসুল হক।
সভাপতি উত্তম রায়ের সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে চমৎকার একটি আয়োজনে শেষ হলো।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ এর সহসভাপতি সাইদুল হাসান ও ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার উপদেষ্টা সোলায়মান কবীর।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির মধ্যেও সারা দেশের বিভিন্ন বন্ধুসভা থেকে প্রায় শতাধিক বন্ধু উৎসবে যুক্ত হন। অনুষ্ঠান শেষে দিনাজপুর থেকে আগত বন্ধু শাহনাজ চৌধুরী কেয়া অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন―‘আমি গতকাল সারা দিন প্রথম আলো পুষ্টি বিতর্ক প্রতিযোগিতা শেষ করে রাতে রওনা হয়ে সারা রাত জেগে সকালে ঢাকায় পৌঁছে সরাসরি কবিতা উৎসবে এসে যুক্ত হয়েছি। আমার কোনও ক্লান্তি নাই। বরং নিজে গৌরব বোধ করছি এমন চমৎকার একটি আয়োজনে যুক্ত হতে পেরে। জয় হোক বন্ধুসভার। জয় হোক মানবতার।’
লেখক : সহসভাপতি,
প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ
ছবি : প্রথম আলোর সৌজন্যে