আর্কাইভবিশ্বসাহিত্যসাক্ষাৎকার

‘আমাদের সাহিত্যজগতে অবহেলিত সাহিত্য নিয়ে ক্রিটিক্যাল আলোচনা’ : অভিজিৎ মুখার্জি

বিশ্বসাহিত্য : বরেণ্য সাহিত্যিকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘লীলা রায় পুরস্কার’প্রাপ্ত

আলাপচারিতায় অলাত এহ্সান

কলকাতায় জাপানি ভাষা ও সাহিত্যের যুগপৎ চর্চার প্রসঙ্গ উঠলে যাঁর নাম প্রথমেই আসবে তিনি অভিজিৎ মুখার্জি। একসময় জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনয়িারিংয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়ে, তারপর কখনও বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে, বারতিনেক প্রখ্যাত জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তি পেয়ে করেছেন হারুকি মুরাকামির গল্প-উপন্যাস ছাড়াও মিশিমা ইউকিও এবং য়োকো ওগাওয়ার উপন্যাস অনুবাদ। পত্র-পত্রিকায় অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন জাপানের খ্যাতনামা সাহিত্যিক এবং জাপানি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত যাঁরা ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত লেখক তাঁদের সাহিত্যকৃতির বিশ্লেষণ নিয়ে তাঁর বহুপঠিত বই, ‘যে ভারতীয়রা ইংরেজিতে লিখছেন’।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, জাপানি ভাষার শিক্ষকতার সূত্রে স্কুল অব ল্যাংগুয়েজের প্রাক্তন জয়েন্ট ডিরেক্টর শ্রী মুখার্জির প্রিয় লেখক ভি এস নাইপল, গ্রাহাম গ্রিন, হারুকি মুরাকামি এবং ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা।]

ভূমিকা : অভিজিৎ মুখার্জি অধ্যাপনা করেন ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। একাধিকবার জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে সে দেশের ভাষার শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ, দেশে ধারাবাহিকভাবে দোভাষী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে তার। ব্যক্তিগত ও পেশাদারি নৈকট্য আর সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তাঁর উৎসাহ ও চর্চার খতিয়ান এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পাঠাভ্যাসের সূত্রে পরিচয়ের বিস্তৃতি হিসেবে তিনি জাপানি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদে নিবিষ্ট হয়েছেন। বাংলা ভাষায় হারুকি মুরাকামির একমাত্র অনুমোদিত অনুবাদক তিনি। মুরাকামির গল্প-উপন্যাস অনুবাদে তার সুখ্যাতি, পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘লীলা রায় পুরস্কার’। লিখিত মাধ্যমে চারবারে তিনি কথা বলেছেন পূর্বপুরুষের দেশ বাংলাদেশ, ভারতীয় লেখক, জাপানি সাহিত্য ও অনুবাদের নানা দিক নিয়ে। অপ্রিয় সত্য কথাও তিনি বলেন সোজাসুজি, কোনও প্রকার ভনিতা ব্যতিরেকে।

অলাত এহ্সান : হারুকি মুরাকামির ‘উমিবে-নো-কফুকা’ দুই খণ্ডে ‘সমুদ্রতটে কাফকা’ নামে অনুবাদের জন্য আপনি সাহিত্য অকাদেমিও পেলেন অনুবাদে। এটা কি প্রত্যাশিত ছিল ? বইটা নিয়ে পাঠকের সাড়া কেমন পেয়েছেন ? ঢাকায় তো বইয়ের বেশ বিক্রি দেখেছি।

অভিজিৎ মুখার্জি : সাহিত্য অকাদেমি নয়, সেটা আরও বেশি অর্থমূল্যের পুরস্কার। আমি পেয়েছি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘লীলা রায় পুরস্কার’। সাহিত্যে গাদাগাদা পুরস্কারের প্রথাটাকে আমি বেশ সন্দেহের চোখে দেখি, ওতে লেখকের ভাবমূর্তিও যে খুব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তা আমার মনে হয় না, তাই পুরস্কার নিয়ে ভাবিনি। কলকাতায় সাহিত্য ব্যাপারটার সঙ্গে নানা গোষ্ঠী, তাদের আনুগত্য, নানা কানেকশন থাকা প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ইত্যাদি নানা কিছু জড়িত। আমি নেহাতই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাস্টারমশাই, আমাকে স্বাভাবিকভাবেই কেউ চেনে না, এমনকি আমার ছাত্ররাও কখনও জানতে পেলে খুবই বিস্মিত হয়, ফলে পুরস্কার পাওয়ার বিস্ময়টা আমার এখনও কাটেনি। সম্ভবত আগের বছর বইমেলায় মুরাকামির গল্প-সংকলন ভালো বিক্রি হওয়ায়, আমাকে বিবেচনা করা হয়েছিল। একটাই মজার ব্যাপার হলো, তার ঠিক আগের বছর পুরস্কারটা পেয়েছিলেন অধ্যাপক গৌতম ভদ্র, নানা বিষয়ে তুলনাহীন পাণ্ডিত্যের অধিকারী; আমি নিয়মিত তাঁর কাছ থেকে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে জরুরি অনেক কথা জানতে পাই। তখন নিয়মিত আমরা ইউনিভার্সিটির উল্টোদিকে একটা কফির দোকানে গিয়ে আলাপচারিতা করতাম। তিনি জানতেন না যে আমি কখনও লিখি। সেই বছর পুরস্কারটা আমি পেয়েছি জেনে তিনি খুব মজা পেয়েছিলেন।

অলাত এহ্সান : তারপর দেখলাম, একটা ইস্যুতে ভারতে অকাদেমি পুরস্কার ফেরত দেওয়া শুরু হলো। পুরস্কারপ্রাপ্ত সবার নামই হয়তো জানত না পাঠকরা। ওখানে পুরস্কারের অবস্থা কী ?

অভিজিৎ মুখার্জি : আমাদের এখানে তো সিরিয়াস লেখাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি নয়, ক’টাকা পায়, এমনকি প্রতিষ্ঠিত লেখকরাও ? তাই পুরস্কারের অর্থমূল্য যেমনই হোক (খুবই মামুলি প্রকৃতপক্ষে), সেটুকুও অনেকের কাছেই একটা প্রাপ্তি। পাঠকের কাছে ওতে পরিচিতি বিশেষ বাড়ে বলে আমার মনে হয় না। দশ-পনেরো বছরে তেমন প্রতিশ্রুতি জাগানোর মতো কেউ আসে না, অথচ দেড়শো-দুশো পুরস্কার বিতরণ হয় সেই সময়ের মধ্যে। ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক নিয়োগের সময় নির্বাচকরা ‘কারুকেই উপযুক্ত মনে হলো না’ বলে রায় দিতে পারেন; পুরস্কারের ক্ষেত্রেও সেটা চালু করলে সাহিত্যের উপকারই হবে বলে মনে হয়। সে যাই হোক, শেষ অবধি কেউ আর সত্যিই পুরস্কারের অর্থমূল্য বা পুরস্কার ফেরত দিয়েছিলেন বলে শুনিনি। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, রাজনৈতিক আনুগত্য যাদের একটা বড় সম্বল, তাদের একটা দায় জন্মেছিল বলে অনুমান করা যায়। তবে বাংলার কোনও সাহিত্যিক কিন্তু ওই নিয়ে মাতামাতি করেননি, তাঁরা এড়িয়ে গেছেন ওই হুজুগ।

অলাত এহ্সান : পুরস্কারের কথায় মনে পড়ল, আপনি তো প্রেসিডেন্টের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। একেবারেই আপনার একাডেমিকের বাইরের কারণে ?

অভিজিৎ মুখার্জি : সেটাই বরং ছিল অ্যাকাডেমিক কারণে। ১৯৮৬ সালে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আমার একটা গবেষণাপত্র একটা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কংগ্রেস উপলক্ষে সেই বছর প্রধান অতিথি ছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, তাঁর হাত দিয়ে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা হয়েছিল। একাডেমিকভাবে যে বিষয়/ক্ষেত্রে আমার কোনও অধিকার থাকতে পারে, সেটা ইঞ্জিনিয়ারিং। সাহিত্য বা অন্যান্য বিষয়ে আমার আগ্রহ মেটানোর সুযোগ তখনই পেয়েছি যখন পড়ানো বা গবেষণার ফাঁকে অবসর তৈরি হয়েছে। জনসংযোগের প্রতি আগ্রহ না থাকায়, সেই অবসরও খুব সীমিত অবসর ছিল না।

অলাত এহ্সান : শিক্ষাজীবনের অনেকটা কাটিয়ে এসে, আপনি লিখতে শুরু করলেন অনেক পরে। লিখতে গিয়েও বিরূপ অভিজ্ঞতা হলো। একবার এক লিটল ম্যাগাজিনের অনুষ্ঠানে আপনার মঞ্চে ওঠা নিয়ে বাধা তৈরি করল সাহিত্যজগতেরই কিছু লোক। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বলতে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

অভিজিৎ মুখার্জি : কী জানো তো, দেশভাগটা ছিল একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দেশভাগের ফলে যে বিপুল উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে এল, অশেষ দুর্ভোগ পোহানোর ফলে তারা মনে করল জীবনের, সমাজের, সংস্কৃতির সবটাই বোধ হয় উপযুক্ত রাজনৈতিক দলের শক্তিবৃদ্ধি করে উন্নত করে তোলা সম্ভব। বিপুল সংখ্যায় তারা বামপন্থি রাজনীতিতে যোগ দিতে থাকল, প্রচারযুদ্ধেও একেবারে ফুট-সোলজার হিসেবে নিজেদের সমর্পণ করল। সেই প্রক্রিয়া থেকেই উদ্ভূত হয় লিটল ম্যাগাজিনগুলো, সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের ধারাতে সরাসরি শ্রেণিযুদ্ধের পথ যখন আর খোলা নেই বলে মনে হলো, তখন তার কর্মীরা বিপুল লিটল ম্যাগাজিন বের করে জনসংযোগের কর্মসূচি নেয়। এই ধরনের রাজনীতিতে বিশুদ্ধতা জিনিসটার খুব গুরুত্ব। আমাদের পত্রিকা ভালো পত্রিকা হবে সব দিক দিয়ে কিন্তু লেখালেখি সবই হবে কেবল আমরা যা বিশ্বাস করি তার পুষ্টি করে। বিদেশি সাহিত্য নিয়ে লিখতে গেলেই, কাগজের বিশুদ্ধতাপন্থি পরিচালন সমিতির কাছে খুব অপরিচিত ও সেহেতু বিপজ্জনক বলে মনে হতো সেইসব ভাব ও চিন্তা, যেসব বিশ্বসাহিত্যের এখনকার উপজীব্য বিষয়। এ ব্যাপারে একমাত্র ব্যতিক্রম বলে দেখেছি প্রয়াত সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্যকে। দীর্ঘকাল তিনি একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন সব রকম স্বরকেই প্রবেশাধিকার দিয়ে।

রাজনীতিতে সেই আস্থা আর পরবর্তী প্রজন্ম ধরে রাখতে পারেনি কিন্তু দলাদলির অভ্যাস ও সংস্কৃতিটা পূর্ণমাত্রায় রয়ে গেছে। সেরকমই দলাদলির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ কিছু সাহিত্যিক এক সম্পাদককে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, মঞ্চে যদি আমাকে বলতে ডাকা হয় তাহলে তিনি পত্রিকা চালাতে সব রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হবেন। সম্পাদক খুলে বললেন আমাকে। হাসির ব্যাপার। আমিও আর যাইনি সেই অনুষ্ঠানে।

ওঁর জন্মদিন উপলক্ষে একটি ফিল্ম-সোসাইটির অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বলতে উঠে বলেছিলাম, আমরা যে সত্যজিৎ রায়কে পেয়েছি আর ওঁর বেড়ে ওঠা যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটা দেশে, এই দুটোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। অ্যাম্পায়ার জিনিসটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, ওঁর মনোজগৎটা গড়ে দিতে। এতে নানারকম উষ্মার সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমাকে।

অলাত এহ্সান : দেশের বাইরে অবস্থান করার সুযোগে বাঙালিদের আরেকটু বেশি ছেঁকে দেখার, নিরপেক্ষভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে আপনার। সেটা কেমন ?

অভিজিৎ মুখার্জি : মোটের ওপর সেটা খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়। গভীর শ্রদ্ধা আছে তাঁদের প্রতি, এমন বেশ কয়েকজন মানুষ বাঙালিদের মধ্যে জন্ম নিলেও, মোটের ওপর আশাব্যঞ্জক নয় ছবিটা। অদূর ভবিষ্যতে বাঙালি সমাজের ছবিটা কেমন হতে যাচ্ছে, সেটা বিবেচনা করলে, ছবিটা ভালো নয়। বাঙালিদের সম্বন্ধে হতাশ হয়ে রবীন্দ্রনাথের ক্ষুব্ধ মন্তব্য তুলে দিতে পারতাম আমি কয়েক জায়গা থেকে, তবে না দিলেও চলে।

দ্বিতীয় পর্ব

ভারতীয় লেখক প্রসঙ্গে:

অলাত এহ্সান : ভি এস নাইপল আপনার প্রিয় লেখক। তাঁর বিশেষত্ব কীভাবে আলাদা করেন ?

অভিজিৎ মুখার্জি : ওঁর নানা বিশেষত্বই লেখক হিসেবে ওঁর আকর্ষণকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে আমার কাছে। সেই নিয়ে আমি খুঁটিয়ে লিখেছি অনেক জায়গায়। সেসব কারণ ছাড়াই, একটি নির্দিষ্ট বিশেষত্বের কারণে, যে পাঠকরা বহু ব্যাপারে ওঁর মতকে গ্রহণ করতে অপারগ, তাঁরাও অধিকাংশ ওঁর বেশির ভাগ লেখাই পড়েছেন। আর সেটি হলো ইংরেজির মতো ইতোমধ্যেই যথেষ্ট সমৃদ্ধ একটা ভাষাকে তিনি যে সৌন্দর্য দান করেছেন নিজের গদ্যে, যত অভ্রান্তভাবে নিজের বক্তব্যকে পাঠকের একেবারে মর্মে গেঁথে দিয়েছেন ভাষা ব্যবহারের কুশলতায়। আমার মতো বহু পাঠক আছেন, যাঁরা, তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়েও হিউমার প্রয়োগে ওঁর অভূতপূর্ব দক্ষতার, প্রায় বলা যায়, মোহজালে জড়িয়ে পড়েছেন―এ জীবনে আর মুক্তি নেই।

অলাত এহ্সান : নাইপলকে একেবারে বিরূপভাবে দেখা হয় বাংলাভাষী অঞ্চলে। এর উৎস কী ? আপনি তো অনেকবারই তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। আমার মনে হয়, ওসব লেখা দিয়ে রীতিমতো বই হতে পারত।

অভিজিৎ মুখার্জি : তা হয়তো হতে পারত কিন্তু না হলেও ক্ষতি কিছু নেই, ওগুলোর যে কোনো একটা পড়ে নিয়ে ওঁর বইগুলো বরং খুঁটিয়ে পড়লে উপকার বেশি।

নাইপলের লেখায় একটা বাক্য ছিল এ রকম : চবড়ঢ়ষব মবঃ ঢ়ঁহরংযবফ ভড়ৎ ঃযব ষরবং ঃযধঃ ঃযবু ঃবষষ ঃযবসংবষাবং―মিথ্যে কথা বলার জন্য লোক শাস্তি পায়, যখন সেসব মিথ্যে তারা নিজেরাই নিজেদের বলে। আর এখানেই ভানসর্বস্ব বাঙালির অস্বস্তি তাঁকে নিয়ে। বারবার তিনি বলেছেন, ইউরোপ যে এতটা উন্নতি করেছে তার পিছনে রয়েছে তাদের নিরন্তর আত্মমূল্যায়ন ও আত্মবিশ্লেষণ। বাঙালি নিত্যনতুন মিথ্যা আবিষ্কার করে নিজেকেই বাহবা দেওয়ার নেশায় মশগুল। অথচ সবদিকে চূড়ান্ত ব্যর্থ। তাদের চক্ষুশূল হবেন না তো কার চক্ষুশূল হবেন তিনি ?

অলাত এহ্সান : ভারত নিয়ে নাইপলের তিন খণ্ড স্মৃতিকথা প্রকাশের পর বেশ হইচই হয়েছিল। তখন ভারতে তাঁর এক সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ নিয়েও বিরোধিতা হয়েছিল। তখন অমিতাভ ঘোষ তাঁর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাঁর স্মৃতিকথা নিয়ে আপনার কী পর্যবেক্ষণ ?

অভিজিৎ মুখার্জি : ওগুলো স্মৃতিকথা ঠিক নয়। পোস্ট-কলোনিয়াল বা উত্তর-ঔপনিবেশিক পৃথিবী নিয়ে ওঁর যে বিস্তৃত চর্চা, সেখানে ত্রিনিদাদের একটা জনগোষ্ঠীর একজন হিসেবে, নিজের চারপাশটা জন্মাবধি যেমন দেখেছেন, সেটার একটা ইতিহাসগত বিশ্লেষণের জন্য ভারতে আসা প্রয়োজন ছিল; সেই জন্য ১৯৬২ সালে এসেছিলেন একবার, লিখেছিলেন ইন্ডিয়া: অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস। ‘ডার্কনেস’ বলেছিলেন, কারণ ভারতকে সবটা বুঝে ওঠা ওই স্বল্প অবসরে সম্ভব ছিল না। যথেষ্ট আলো পড়ল না বলে ডার্কনেস বললেন। কিন্তু এ দেশের মূর্খ বুদ্ধিজীবীরা না পড়েই দলবদ্ধ হয়ে ওর নিন্দায় মুখর হওয়ার চেষ্টা করল। তিনি নাকি ভারতকে একটা অন্ধকারে ডুবে থাকা দেশ বলে অভিহিত করেছেন! এখনও এমন মূর্খ বহু আছে, যারা এ কথা বলে থাকে। রাজনৈতিক শক্তির প্রচারের জোরে ঠেকনা দিয়ে তুলে ধরা মহামানবদেরই আমরা ভারতের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী বলে চিনি। সভ্যতা হিসেবে ভারত তার অতীতকে বহন করে বা বিস্মৃত হয়ে, ঠিক কোন অভিমুখে চলেছে, সেটা বুঝতে বছর বারো-তেরো পরে আবার এসে দেখেটেখে লিখেছিলেন ইন্ডিয়া: আ উন্ডেড সিভিলাইজেশন। আর সবশেষে আশির দশকে এসে একটু যেন নতুন ভারত, যে কি না তার পুরনো রীতিনীতির বাঁধন খসিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছে, দেখে লিখেছিলেন, ইন্ডিয়া: মিলিয়ন মিউটিনিজ নাও।

কিন্তু হইচই হয়েছিল অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে। জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনে নেহরুর ভাগ্নি নয়নতারা সেহগল যখন খুব করুণ সুরে ভারতের নানা ব্যর্থতার কারণ হিসেবে বলতে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ আমলের পরাধীনতার কথা; তখন নাইপল বলেছিলেন, সে তো অনেক আগের কথা, মাঝখানের এই দীর্ঘ সময় ভারত করছিলটা কী ? তখন গর্জে উঠল প্রগতিশীল প্রতিবাদী রাজনৈতিক চেতনা। নানা হাস্যকর অভিযোগ, অভিমান তারা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন বিক্রম শেঠ ও অমিতাভ ঘোষ। তাঁরা নাইপলের মতটাকেই যুক্তিসঙ্গত মনে করেছিলেন।

অলাত এহ্সান : আপনার অমিতাভ ঘোষ আবিষ্কারও ইন্টারেস্টিং। তিনি আপনার প্রিয় লেখকদের মধ্যে আরেকজন।

অভিজিৎ মুখার্জি : হ্যাঁ, একটু অদ্ভুতভাবে পরিচয় হয়েছিল ওঁর লেখার সঙ্গে। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির মেম্বার হয়ে প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম বই আনতে, ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী বললেন―আমি যেসব বই চাইছি সেসব ইস্যু করা আছে। দূরে র‌্যাক দেখিয়ে বললেন―ওখানে দেখুন, কোনওটা পছন্দ হলে নিয়ে যান। গিয়ে দেখলাম, নামি লেখকদের কারুর কোনও বই নেই, এক অচেনা, বাঙালি নামধারী লেখকের দুটো ইংরেজি উপন্যাস পড়ে আছে―দ্য সার্কেল অব রিজন, আর দ্য শ্যাডো লাইনস। হতাশ মনে সেগুলোই বাড়িতে এনে পড়ে আমার আর ধন্দ কাটে না, এত ভালো দুটো উপন্যাস অথচ লেখকের কোনও খ্যাতি নেই! তার বছর খানিক পরে খ্যাতি ছড়াতে শুরু করল। দ্বিতীয় বইটা পড়ে খুশবন্ত সিং লিখলেন, ঞযরং রং যড়ি হড়াবষং ংযড়ঁষফ নব ৎিরঃঃবহ, ঃযরং রং যড়ি ষধহমঁধমব ংযড়ঁষফ নব ঁংবফ.

অলাত এহ্সান : অমিতাভ ঘোষের লেখা অনেক বেশি ইতিহাসসংশ্লিষ্ট। হালে তিনি পরিবেশকে তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন দারুণভাবে। এই কারণেই কি তিনি আপনার প্রিয় লেখক ? আরও কী পান তাঁর লেখায় ?

অভিজিৎ মুখার্জি : এই মুহূর্তে যদি ভাবতে বসি, লেখার ভিতর দিয়ে কী কী জরুরি কথা তিনি পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তবে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। লেখাগুলোর মাধ্যমে ওর চিন্তার জগৎটার ক্রম উন্মোচনের মুনশিয়ানায়। যেন প্রথম দিন থেকেই জানতেন কী কী ওঁকে লিখতে হবে, কেমন পরম্পরায় সেগুলো পেশ করতে হবে একের পর এক উপন্যাসে।

তিনি প্রথম উপন্যাসে ধরেছিলেন ইতিহাসে যুক্তিবাদী আধুনিকতার যে ধারণা, তার সীমাবদ্ধতার কথা। তারপর দ্বিতীয় উপন্যাসে দেখিয়েছেন ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যে ছেদ টানতে হয়, তার উপযোগিতা কী। মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতার ধারণাও কিন্তু আধুনিকতার দর্শনের একটা একটা স্তম্ভ। তৃতীয় উপন্যাস থেকে ক্রমাগত এসেছে এশিয়ার একটা বিকল্প পরিণতির সম্ভাবনা―কীভাবে ইউরোপীয় আগ্রাসনের শিকারে হারিয়ে গেছে, এমনকি আমাদের স্মৃতি থেকেও। এর পরেই এসেছে উপনিবেশের ইতিহাস। দেখিয়েছেন, আধুনিকতার যুক্তির মধ্যে কোথায় রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক আধিপত্যের প্রতি একটা প্রশ্রয়ের দিক। মূলত এশিয়ার যেসব দেশ উপনিবেশ হিসেবে ইউরোপীয় আধিপত্য ও লোভের শিকার হয়েছে, তাদের কথা এসেছে একের পর এক উপন্যাসে। ওঁর আইবিস ট্রিলজির শেষ উপন্যাস দ্য ফায়ার অব ফ্লাড। তাতে তিনি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, ওই পশ্চিমি লোভ ও নিষ্ঠুরতার নজির যখন অন্যান্য মহাদেশের সমাজেও গ্রহণযোগ্যতা পেল, তখন থেকেই কীভাবে পরিবেশের সংকটের একটু একটু করে শুরু। আজ তিনি পরপর কয়েকটা বইয়ের মাধ্যমেই দেখাচ্ছেন, পরিবেশের এই অধঃপতন সমাজের ও সভ্যতার আত্মিক অধঃপতনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এসেছে। মানুষকে ফিরে পেতে হবে তার আধুনিকতাপূর্ব পুরাতন সত্তার স্মৃতি, আত্মিকভাবে যুক্ত হতে হবে এই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণি ও বস্তুর সঙ্গে। ‘উদ্ধারের রহস্য লুকিয়ে আছে উৎসের মধ্যে, খুঁজতে যেতে হবে সেইখানে’।

অলাত এহ্সান : অমিতাভ ঘোষের হাংরি টাইড উপন্যাস অনুবাদ নিয়ে একটা মজার ব্যাপার আছে। সেখানে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের অনেক পাঁচালি তিনি বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। আবার যখন তার উপন্যাস ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ হলো, তখন কিন্তু পাঁচালিগুলো আর অনুবাদ করতে হলো না, সরাসরি তুলে দিলেই হলো। অনুবাদ এ ক্ষেত্রে মূলকে সংরক্ষণ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে, আরবি সাহিত্যের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছিল। একবার যে আরবি সাহিত্য স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছিল, পরে অনেক মূল গ্রন্থ হারিয়ে যাওয়ায়, স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করে তার পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল।

অভিজিৎ মুখার্জি : অমিতাভ ঘোষের গান-আইল্যান্ড উপন্যাসে উল্লেখ আছে এক প্রাচীন লাতিন শব্দবন্ধের : টহফব ড়ৎরমড় রহফব ংধষঁং, যার অর্থ হলো, উদ্ধারের জন্য ফিরে যেতে হবে উৎসের কাছে। পৃথিবীজুড়ে যে পরিবেশ সংকট, তার মূলে আধুনিক সংস্কৃতির কিছু খামতির কথা তিনি বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। গান আইল্যান্ডর পরের বই জাংগলনামাতেও বনবিবির জহুরানামা ইত্যাদি মূল উপকরণ হয়ে উঠেছে। প্রাচীন সমাজের প্রজ্ঞাকে উদ্ধার করার ওপর জোর দিচ্ছেন তিনি।

অলাত এহ্সান : আপনার ‘যে ভারতীয়রা ইংরিজিতে লিখছেন’ বইটা লেখার উৎসাহ তৈরি হলো কখন ? কীভাবে লিখলেন ?

অভিজিৎ মুখার্জি : ২০০১ সালে নাইপল নোবেল প্রাইজ পাওয়ায় কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন জগতের একটা বড় অংশ একটু মুশকিলে পড়ে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন, ওই বছরের কোনও একটা সংখ্যায় তাঁকে নিয়ে কটা কথা সাধারণভাবে পাঠকরা প্রত্যাশা করবেন, অথচ এই সব ম্যাগাজিনে যাঁরা লেখেন, এক ধরনের বিদ্বেষবশত তারা ওঁর লেখা কিছু পড়েননি। আমার এক বন্ধু বা সহপাঠী, খুব মেধাবী ছাত্র ছিল, সে একটা র‌্যাডিক্যাল গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যারা একটা লিটল ম্যাগাজিনও বের করত। ওই বন্ধু আমাকে অনুরোধ করে, নাইপল সম্বন্ধে ওদের পত্রিকার আপিসে গিয়ে কিছু আলোচনা করে আসার জন্য। সেই আলোচনার পরে ওঁরা আমাকেই অনুরোধ করে একটা বড় লেখা লিখে ফেলার জন্য। আমিও দেখলাম যে চারপাশে যত ভিত্তিহীন কথা নাইপল সম্বন্ধে প্রচার পেয়েছে, সেগুলো সম্বন্ধে অন্তত পাঠককে সচেতন করার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে, আগে কখনও কিছু না লিখলেও, কষ্ট করে লিখেও ফেললাম একটা বেশ বড় দৈর্ঘ্যরে লেখা। এরপর ওরা আমার থেকে জানতে চায়, যাকে বলা হয় ইন্ডিয়ান রাইটিং ইন ইংলিশ, সেই ধারার লেখকদের সম্বন্ধে আমি এক এক করে ধারাবাহিকভাবে লিখতে পারি কি না। পড়া ছিল তাঁদের অনেক লেখাই।  তাই আমি একটা বেশ চ্যালেঞ্জ অনুভব করে রাজি হয়ে যাই। সেভাবেই সাম্প্রতিককালের নয় জন লেখক-লেখিকাকে নিয়ে লিখি, সংকলিত হয়ে বইটা বেরোয় ভাষাবন্ধন প্রকাশনা থেকে। পরে এখন অবশ্য ওটা ‘বুকস ওয়ে’ প্রকাশনার থেকে বেরোয়।

অলাত এহ্সান : ভারতে বাংলাভাষী লেখকদের একটা অহম্ আছে, সাহিত্যের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে। কিন্তু অন্য ভাষার সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা-উন্নাসিকতা আছে। তাদের সাহিত্য নিয়ে আপনার মন্তব্য কী ?

অভিজিৎ মুখার্জি : অবজ্ঞা-উন্নাসিকতা কি অধুনা বাইরে প্রকাশ্যে আনেন ? ওটা এখন পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট হয়ে গেছে, বারবার প্রসঙ্গটা উঠে এসে। উন্নাসিকতা ভেতরে-ভেতরে থাকতে পারে, ঠেকাবে কে ? বাংলার বাইরের সারা বিশ্বের সাহিত্যই তো তুচ্ছ এঁদের অধিকাংশের কাছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এটা শুরু করেছিলেন বাঁশবনে শেয়াল রাজা হতে। কোনও স্পষ্ট মূল্যায়নের বদলে আগড়ম-বাগড়ম মন্তব্য করতেন। ওরহান পামুক, মিলান কুন্দেরা, অমিতাভ ঘোষ, কেউ রেহাই পায়নি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, মন্তব্যগুলো বইটই না পড়েই করতেন।

ভারতের অন্য অনেক ভাষারই সাহিত্যের দীর্ঘতর ঐতিহ্য রয়েছে প্রাচীনতর কাল থেকে। তাদের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললে তুলোধোনা হয়ে যাবে। তবে স্বাধীনতার পর থেকেই, পুরস্কারের মাধ্যমে, নানা পৃষ্ঠপোষক সরকারি প্রতিষ্ঠানের দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ, রাজনীতি, জাতির আত্মপরিচয়, এগুলোর ব্যাপারে সরকারি ন্যারেটিভটা অনুসরণ করানো হয়েছে একটা বড় অংশের লেখকদের দিয়ে। লেখকরা অধিকাংশই সাহিত্যিক প্রকরণ বা আঙ্গিকের ব্যাপারে খুব বেশি আদান-প্রদানে না গিয়ে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়ই বরং কাছাকাছি এসেছেন বেশি। অবশ্য এর বাইরেও অনেকে থেকেছেন বৈকি কিন্তু পাদপ্রদীপের আলো তেমন পড়েনি তাঁদের ওপর। মোটের ওপর যেটুকু পড়ে দেখার সুযোগ হয়েছে, আমার মনে হয়েছে, বিশ্বসাহিত্যের ইস্যুগুলোর সঙ্গে সমান্তরালে চলার নিদর্শন তেমন নেই। রোহিন্তন মিস্ত্রি স্বাধীনতাপরবর্তী ভারতের যে ছবি এঁকেছেন তাঁর উপন্যাসগুলোতে তা কিন্তু এঁকেছেন টরন্টোতে বসে, ইংরেজিতে লিখে। সেই ছবি ভারতীয় ভাষার লেখকদের কলমে অত স্পষ্ট হয়নি, রাজনৈতিকভাবে অত ছাপ ফেলেনি তাদের আঁকা ছবি।

অলাত এহ্সান : সালমান রুশদি তো একবার ভারতীয়দের ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে মন্তব্য করে হইচই ফেলেছিলেন―ইংরেজি ভাষায় ভারতের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো হচ্ছে। আপনি দুই সাহিত্যেরই পাঠক। আপনি কীভাবে বলবেন ?

অভিজিৎ মুখার্জি : দেখো, এটা খুব বড় একটা প্রসঙ্গ, একটা রীতিমতো দীর্ঘ প্রবন্ধেও সবটা আলোচনা করা মুশকিল। তবে প্রথমেই আমার একটা দৃঢ় বিশ্বাস আমি জানিয়ে রাখি। আদান-প্রদানের সুযোগ ও চল অনেক বেড়ে যাওয়ায় অনেক কিছুরই চর্চার যেমন ভাষার ভিত্তিতে বিভাজন হয় না, করা অর্থহীন―যেমন সংগীত, গণিত ইত্যাদি―সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সেটা করা উচিত না। সারা পৃথিবীজুড়েই সাহিত্য একটা বিষয়, বিভিন্ন ভাষায় রচনা করা হয় মাত্র এবং সেটা অনুভব করার মতো অগ্রগতি সভ্যতার হয়েছে বলে আমি মনে করি। ফলে, ‘ভারতীয়দের ইংরেজি সাহিত্য’ কথাটার পরিবর্তে বরং বলো, ইংরেজি ভাষায় ভারতীয়দের সাহিত্যচর্চা―‘ইন্ডিয়ান রাইটিং ইন ইংলিশ’। ওই নামেই এই ধারাটা পৃথিবীতে পরিচিত।

সত্যি বলতে কী, অত খুঁটিয়ে সারা ভারতের নানা ভাষার সাহিত্য আমার পড়া নেই―তেইশটা জাতীয় ভাষা! ভাষাবন্ধন বলে একটা কাগজের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম, সম্পাদকীয় বোর্ডের একজন হিসেবে, সেই সূত্রে কিছুটা কিছুটা পড়া। তাই প্রকৃতপক্ষে কোনও অথেনটিক মন্তব্য করার অধিকার আমার নেই। রুশদিকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল, বাংলা সাহিত্যের বিগত দিনের বড় বড় লেখকের কথা উল্লেখ করে, তিনি তখন স্বীকার করেছিলেন যে সেগুলো সবটা ওঁর পড়া ছিল না। ওঁর মন্তব্য ছিল সমসাময়িক লেখালেখি নিয়ে। আমার নেহাতই ব্যক্তিগত ধারণা হলো তিনি খুব ভুল বলেননি। তিনি কিন্তু একটা প্রবন্ধে স্পষ্ট লিখেছিলেনও, কেন সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। যে কোনও একটা সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পরিস্থিতির, ইতিহাসের এবং সেহেতু সাহিত্যের মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ থাকে, বিদেশে গিয়ে, নানা দৃষ্টিকোণের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যখন একজন সাহিত্যিক এমনকি তাঁর নিজেরই দেশের পরিস্থিতির কথা লেখেন, তাতে সার্বিকতা আসে, ভারসাম্য থাকে।

অলাত এহ্সান : কলকাতা সবসময় লিটল ম্যাগের কারণে নিজেদের বিশিষ্ট মনে করেছে, আপনার দেখাটা কেমন ?

অভিজিৎ মুখার্জি : উফ্ফ্! তোমাদের ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নেই ? বোঝো না, কোনও না কোনও দিক দিয়ে নিজেদের বিশিষ্ট মনে করতে না পারলে কত লোক পাগল হয়ে যাবে, কামড়েও দিতে পারে ? এত অনুদার কেন ? লোককে বিশিষ্ট হতে দেখলে, মনে এখনও প্রশ্ন জাগে ?

তৃতীয় পর্ব

জাপানিজ সাহিত্য নিয়ে:

অলাত এহ্সান : হারুকি মুরাকামির লেখার সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে হলো ? কীভাবে তার লেখার অনুবাদে যুক্ত হলেন ?

অভিজিৎ মুখার্জি : কলকাতায় একজন ফোনে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল হারুকি মুরাকামির লেখা পড়তে, ইংরেজি অনুবাদে পড়ে তার খুব ভালো লেগেছিল। নামটা আমার মনে থেকে গিয়েছিল। তারপর ২০০৭ সালে আমি জাপানে গিয়েছিলাম ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অনুদানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রজেক্টের কাজে। সেখানে তেমন কাজের চাপ ছিল না। একটা গবেষণাগারের তখনকার গবেষণাগুলোর ওপর একটা রিপোর্ট তৈরি করার দায়িত্ব ছিল। সেই এক মাসে আমি ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে ওঁর একটা ছোটগল্প সংকলন আনিয়ে পড়তে থাকি এবং মুগ্ধ হয়ে যাই। কলকাতায় ফেরার পর আমার এক জাপানি সহকর্মী বইটা আমাকে জাপান থেকে আনিয়ে দেন। আমি বিচ্ছিন্নভাবে একটা আধটা করে অনুবাদ করে এ পত্রিকা সে পত্রিকায় ছাপতে দিই। পাঠকেরা অবিলম্বে সাড়া দেন। ধীরে ধীরে আমি অধিকাংশ গল্পই একসময় অনুবাদ করি এবং একটা সংকলন বের হয় একসময়। সেবার বইমেলায় বইটার বিক্রি হয় সমস্ত রকম প্রত্যাশা ছাপিয়ে।

অলাত এহ্সান : তাঁর উমিবে-নো-কফুকা আপনি অনুবাদ করলেন সমুদ্রতটে কাফকা নামে, দুই খণ্ডে। জাপান অ্যাম্বাসির সহায়তায় যাদবপুর ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করল, আপনার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে।

অভিজিৎ মুখার্জি : অ্যাম্বাসি এসব ব্যাপারে সহায়তা দিতে পারে না। আর্থিক অনুদান এসেছিল জাপান ফাউন্ডেশনের থেকে। ওঁরা অনূদিত প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদ জাপানে ওঁদের এক্সপার্টদের দিয়ে যাচাই করিয়ে নিত, কিছু দিন পর পর। সেই এক্সপার্টদের মধ্যে, আমি পরে শুনেছি, দুজন ছিলেন খুব ভালো বাংলা জানা, দুজন জাপানি পণ্ডিত আর একজন ছিলেন খুব ভালো জাপানি জানা বাংলাদেশি। তাঁরা সুপারিশ করলে তবে ছাপতে দেওয়া যেত। আমার সৌভাগ্য, তাঁরা প্রত্যেকবারই বেশ প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু বলে রাখি, এ ব্যাপারে মুরাকামির অনুমতির জন্য যাদবপুর ইউনিভার্সিটি প্রেসকে প্রায় দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল, মাঝে মাঝে তাগাদাও দিত, শেষে প্রেসের ডিরেক্টার অধ্যাপক অভিজিৎ গুপ্ত একবার অক্সফোর্ড যাওয়ার পথে মুরাকামির এজেন্ট কোম্পানি কার্টিস ব্রাউনের লন্ডনের অফিসে গিয়ে হত্যে দিয়ে বসে থেকে তাদের থেকে অফিশিয়াল ট্রান্সলেশন রাইট আদায় করে আনেন। মূল বইটাও দু খণ্ডেই। কাফকা অন দা শোর নামে ইংরেজি অনুবাদটা, ব্যবসায়িক বিবেচনায় একটা অখণ্ড বই হিসেবে প্রকাশ করা হয়।

অলাত এহ্সান : অনুবাদের জন্য মুরাকামির উমিবে নো কাফুকা উপন্যাসকে বেছে নেওয়ার কারণ কী ?

অভিজিৎ মুখার্জি : সে অনেক কথা! বাংলার লেখককুলের কথা ছেড়েই দিন, পাঠককুলেরও যেন নজর আর আজকাল তেমন ওপরের দিকে ওঠে না। চাহিদা না থাকলে লেখার মান উন্নত হওয়ার তো কথা নয়। কী বিষয়বস্তুতে, কী ফর্মে, জগৎজুড়ে নতুন চিন্তার যেসব ঢেউ, তা আর বাংলা সাহিত্যের আঙিনা অবধি এসে পৌঁছায় না। সম্প্রতিকালে যে বইটি দর্শনে, বিষয়ে, ন্যারেটিভ ফর্মে, চরিত্র সৃষ্টিতে, স্টাইলে একেবারে মাইলস্টোন উপন্যাস হয়ে থাকার সমস্ত শর্ত পূরণ করেছে বলে আমি মনে করি, সেটি কিন্তু এই ‘উমিবে নো কাফুকা’। বাংলার পাঠক, সাহিত্যমোদী এই বই পড়ার সুযোগ পেলে বুঝবে বিশ্বসাহিত্য কোথায় চলে গেছে, উত্তেজিত হবে, আপ্লুত হবে―এই প্রত্যাশা নিয়েই আমি এই বইটাকেই বেছে নিয়েছিলাম। মানবসভ্যতা বলে যদি কোনও একটি ধারাকে নির্দেশ করা যায়, তার কাছে ঠিক এই সময়ের উপযোগী এক অতি জরুরি দর্শনকে অভিনব আঙ্গিকে পেশ করছে এই উপন্যাস।

অলাত এহ্সান : প্রথমে মুরাকামির ছোটগল্প অনুবাদ করে আপনি তাঁর সংকলন করেছিলেন। এখানে অনেক গল্প তো আগেও অনুবাদ হয়েছে। আপনিও করলেন। এই পুনরাবৃত্তি কেন জরুরি ছিল ? কিংবা আপনার বিশেষত্ব কোথায় ?

অভিজিৎ মুখার্জি : এক মহিলা আমার কোনও এক পরিচিতজনের রেফারেন্সে একবার আমাকে ফোন করে করে বেশ কিছু জাপানি নামের প্রকৃত উচ্চারণ কী হবে জেনে নেন। জাপানের সংস্কৃতি সংক্রান্ত অন্য কিছু প্রশ্নও তাঁর ছিল। পরে একজন আমাকে জানাল যে তিনি নাকি মুরাকামির কয়েকটা গল্প অনুবাদ করে বই বের করেছেন। অনুবাদ, প্রত্যাশিতভাবেই ইংরেজি থেকে হয়েছে। ভূমিকায় তিনি লিখে দিয়েছেন যে উচ্চারণ ইত্যাদি ব্যাপারে তিনি একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়েছেন কিন্তু বিশেষজ্ঞের নাম উল্লেখ করেননি। করেননি যেহেতু, বইয়ের কোনও কপি সেই বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি। আমি তাহলে জানব কী করে―কোন কোন গল্প অনুবাদ হয়েছে ? আমি সত্যি বলতে কী, ইংরেজি থেকে অনুবাদের ব্যাপারে তেমন কৌতূহলীও নই।

জাপানি কোনও গল্প বা উপন্যাস বাংলায় আমি অনুবাদ করলে আর অন্য অনুবাদ পড়ার তেমন প্রয়োজন নেই! হাঃ হাঃ, রসিকতা করলাম। তবে বিনয় করতে হলে কী লিখতে হতো তা তুমিই বরং অনুমান করে নাও। আমার কোনও বিশেষত্ব থাকলে তা আছে জাপানি ভাষায় ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার অভিজ্ঞতা, বহুবার সে দেশে গিয়ে সেই সমাজের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ও পেশাদারি নৈকট্য, একাধিকবার জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে সে দেশের ভাষার শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ, দেশে ধারাবাহিকভাবে দোভাষী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আর সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় আমার উৎসাহ ও চর্চার খতিয়ান―বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পাঠাভ্যাসের সূত্রে পরিচয়ের বিস্তৃতি এইসবের মধ্যে। এর বেশি কিছু নিজের সম্বন্ধে বলাটা শোভন নয়। তবে অনুবাদক হিসেবে আমি যে বিবেচনাটা সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিই সেটা হলো, অনূদিত অবস্থায় এটি পড়তে পাঠকের ভালো লাগবে কি না আর লেখক মূলত যে কথাটা বলতে চাইছেন, অনুবাদ হয়ে সেটাতে কোনও বিকৃতি যাতে না আসে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button