আর্কাইভগল্প

প্রজাপতি : তানজিদা আক্তার

গল্প

স্বচ্ছ সুন্দর প্রকৃতি। চারদিকে আলোর পরিমাণ অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি। গাছগুলো কত স্নিগ্ধ হাসি হাসছে মনের আনন্দে সুর দুলিয়ে। তপ্ত রোদের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে তা তাদের হাসির সুর শুনে বোঝা যায়। আজ পৃথিবীটা অনেক বড় হয়ে গেছে। আকাশটা তার মেঘেদের নিয়ে দূরে সরে গেছে। বোঝাই যায় একটু আগে প্রকৃতিতে বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঝরে যাওয়া বৃষ্টির শেষ মুহূর্তে পাহাড়ি উঁচু-নিচু টিলা বেয়ে হেঁটে চলছে এক অষ্টাদশী। তার দৃষ্টি দেখে মনে হয় কোনও লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে। নূপুরের শব্দ, শান্ত প্রকৃতিকে সুর দুলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে-সুরে সুর মিলিয়ে রঙিন প্রজাপতির পিছে ছুটে চলছে তরুণী। প্রকৃতির এক কীটের পিছনে কেন ছুটছে মনুষ্য তরুণী তার প্রকৃত কারণ নির্দিষ্ট নয়। কেউ বলবে বয়স কম, যা মন চায় তাই করে। কেউ বা বলবে প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর উড়ন্ত কীট, তাই হয়তো নারীমন তার সান্নিধ্য পেতে চায়। আবার কারও কাছে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে যে―প্রজাপতি বিয়ের দেবতা, তাই অষ্টাদশী তার পিছনে ছুটে চলছে। চঞ্চল মন পেতে চায় এক অজানা স্বপ্নের স্বাদ।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে আসছে। ঠাকুমা বাড়ির মূল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। যুবতী কখন বাড়ি ফেরে। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এই সময় বাইরে ঘুরে বেড়ানো কি শোভা পায়! অপেক্ষার প্রহর শেষে মাধবী বাড়ি ফিরল। মাধবীকে দেখে একটু স্নেহের গালির সুরে ঠাকুমা বলল, কাল তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। এই সময়টায় বাড়ির বাইরে একটু কম যাওয়াÑআসা কর দিদি। প্রজাপতি দেবতার আশীর্বাদে বিয়েটা ভালোভাবে হয়ে গেলে হয়। মাধবীর অজানা মনে প্রশ্ন জাগে, ঠাকুমা, প্রজাপতি দেবতা কেন মঙ্গলজনক ? অবশ্য সে প্রশ্নের যথার্থ উত্তর তার ঠাকুমা দিতে পারেনি। মাধবীর বিশ^াসে রয়ে গেছে প্রকৃতির কোলে ছুটে চলা প্রজাপতি―যে প্রজাপতির পানে মাধবী ছুটে চলেছে নিরন্তর। সেই প্রজাপতির আশীর্বাদে যে বিবাহ সম্পন্ন হয় তা অবশ্যই তার সৌন্দর্যের মতোই মঙ্গলকর। এ ধারণা নিয়ে মাধবীর মন আনন্দে ভরে উঠে। পুলকিত সুখস্বপ্ন নিয়ে একসময় নতুন ঘরে পাড়ি জমায় মাধবী।

চলছিল স্বপ্নের মতোই… …

তবে সে-সুখ মাধবীকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। স্বামীর ঘরে অন্যায় নিগ্রহের চাপে অষ্টাদশী মাধবীর প্রজাপতির স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যায়। প্রতিদিনের কাজের চাপ, সংসারের কটু কথা, স্বামীর নিগ্রহে সে দিন দিন প্রজাপতিকে ঘৃণা করতে শেখে। ভ্রান্ত মন প্রজাপতি দেখলেই ধিক্কার দিয়ে উঠে বারংবার। আর অনির্দিষ্ট যৌতুকের দায়ে যেদিন চুলের মুঠি ধরে তার প্রজাপতি স¦প্নের স্বামী হাতের লাল পলা ভেঙে রক্তের লালে একাকার করে ফেলে, সেদিন মাধবী সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। যন্ত্রণার শরীর নিয়ে যখন সিলিং ফ্যানে ঝুলতে যাবে তখন চোখ পড়ে ফ্যানের পাখার ওপর, একটা রঙিন প্রজাপতি মাধবীর দিকে চেয়ে হাসছে আর ধিক্কার দিচ্ছে―তুমি হেরে গেছো মাধবী। বেদনার্ত মাধবীর কাছে প্রজাপতিকে মনে হয় একটা নোংরা কীট। আজকের এই কীটকে তার ক্লেদাক্ত স্বামীরই এক ভয়ংকর প্রতিরূপ মনে হয়। মনের মাঝে গাঁথা সুন্দর প্রকৃতির ভক্তি-ভরা রূপলীলায় ভরপুর প্রজাপতিকে ধিক্কার জানিয়ে তথাকথিত সংসার নামক নরক থেকে বেরিয়ে পড়ে মাধবী।

পথ চলতে গিয়ে কখন যে সন্ধ্যা নামে মাধবীর ক্লান্ত মন তা টের পায় না। পথ চলতে চলতে ঘোর কাটলে মাধবী বুঝতে পারে সে এক অজানা উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে। কোথায় যাবে ? কী করবে ? তা সে জানে না। চিরায়ত বাঙালি নারী কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাবার বাড়ি ফিরে যায়। তবে সেখানেও সে আগের সমাদর পায় না। অগত্যা সন্তানসম্ভবা মাধবীকে ফিরতে হয় তার স্বামীর ঘরে। দুই পক্ষের বাক-বিতণ্ডা শেষে মাধবী ফিরে আসলেও প্রজাপতির আশীর্বাদ নামক স্বামীকে আর সে মনের মণিকোঠায় রাখতে পারে না।

এরপর অনেক দিন কেটে যায়। মাধবী মধ্যবয়সী নারীতে পরিণত হয়। এই সংসারের নিয়ম-নীতি মেনে নেওয়া সকল কাজে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এখন সে পরিণত। প্রজাপতির সুখস্বপ্ন খুব বেশি ধরা দেয় না তার কাছে। সে-বিষয়ে তার চিন্তা করার সময়ও নেই এখন। সে এখন পূর্ণ গৃহিণী। স্বামী, সন্তান ও সংসার নিয়ে এক পরিণত মাধবী। দেখতে দেখতে মাধবীর বয়স বাড়ে আর পূর্ণাঙ্গতা আসে। মাধবী এখন আর তরুণী না, সে এখন মা।

আজ মাধবীর নতুন স্বপ্ন দেখার দিন। আজ মাধবীর মেয়ের বিয়ে। বাইরে থেকে মাধবীকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক খুশি। অন্তরের মাধবীকে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। একটু পরেই পাত্রপক্ষ আসবে ইলাকে দেখতে, আশীর্বাদ করতে। ইলা মাধবীর একমাত্র মেয়ে। নামটা মাধবী নিজেই রেখেছিল। নাচোলের নেত্রী ইলা মিত্রের প্রতিবাদী চেতনায় মগ্ন হয়ে মেয়ের এ নাম রেখেছে মাধবী। যন্ত্রণার মাঝেও টিকে থাকতে হয় কীভাবে তা জেনেছে মাধবী ইলা মিত্রের জীবনী থেকে। তাই মেয়ের নাম রাখে ইলা।

আজ ইলার বিয়ে। মাধবী অনেক ব্যস্ত। শত ব্যস্ততার ফাঁকে সন্ধ্যাপ্রদীপ জে¦লে পূজার ঘরে মেয়ের জন্য প্রার্থনা করতে গিয়েই প্রজাপতির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে প্রজাপতি দেবতার কথা। অষ্টাদশী জীবনে সেই পাহাড়ি গাঁয়ের প্রজাপতির কথা মনে পড়ে। মাধবী ভুল করেছিল একদিন, সুন্দর প্রকৃতির প্রজাপতিকে জীবনদেবতা ভেবেছিল। প্রজাপতি হলেন ব্রহ্মা দেবতা। তিনি প্রজাদের পতি। পরম ব্রহ্মাকে নমস্কার জানিয়ে জীবন শুরু। এই অর্থ আজকে মাধবীর কাছে পরিষ্কার। মাধবীর কাছে এই অর্থ আরও ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। মাধবী এই ব্রহ্মা বলতে পতিদেবতাকে বুঝেছে। সমাজ নারীদের সে শিক্ষাই দেয় যে, প্রজাপতি নামক ব্রহ্মা দেবতার আশীর্বাদে পতি নামক কীটের কাছে নারী হৃদয়কে লীন হতে হবে; যে স্বামী নিজেকে দেবতার আসনে বসিয়ে শত প্রজা নামক নারী-হৃদয়কে রাক্ষসের মতো গিলে খাচ্ছে।

উদ্ভ্রান্ত মন নিয়ে পূজার ঘরে বসে মনের সব ক্লেদ দূর করে ক্ষত-বিক্ষত মাধবী ইলার কাছে যায়। মায়ের মনের যন্ত্রণা যেন চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে স্পষ্ট। ইলা মায়ের এই অবস্থা দেখে বলতে থাকে―মা, খারাপ লাগছে ? অসুখ করেছে ? মাধবী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে আমার অসুখ অনেক আগেই হয়েছে ইলা। আমি আজ এই অসুখ সারাতে চাই। প্রজাপতি নামক ব্রহ্মা দেবতার পূজা করে তুমি যে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছ, সেই দেবতার পূজা আমি তোমাকে করতে দেব না।

এর চেয়ে ফুলের পাপড়িতে, গাছের শাখায়, ছাদের কার্নিসে, খোলা জানালার কোনায় যে কীট প্রজাপতি রয়েছে সেই প্রজাপতির মাঝেই বোধহয় সত্য কোনও ঈশ্বর রয়েছে। প্রজাপতি রঙিন পাখা মেলে ভেসে বেড়ায় শূন্যে―সে প্রজাপতিই জীবনদেবতা―পুঁথির পাতার প্রজাপতি নয়। সত্যিকারের জীবনদেবতা স্ত্রীর শরীর নিয়ে স্বামীকে খেলতে দেয় না―দেয় ভালোবাসা আর বিশ^াস আর নির্ভরতা। যে কীটের রঙিন ছোঁয়ায় তোমার মন পুলকিত হয়, সেই তো আসল মনের দেবতা।

মায়ের কথার মাঝেই ইলা দেখতে পেল বারান্দার রেলিংয়ে একটা রঙিন প্রজাপতি বসে আছে। ইলা মাকে প্রজাপতি দেখিয়ে দিল আঙুল দিয়ে। মাধবী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রঙিন প্রজাপতিটার দিকে…

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button