শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু : মানবর্দ্ধন পাল
ভাষা-গবেষণা ধারাবাহিক
বারোতম পর্ব
[প্রাচীন ভারতীয় আলঙ্কারিকেরা শব্দকে ‘ব্রহ্ম’ জ্ঞান করেছেন―শব্দ যেন ঈশ্বরতুল্য। পাশ্চাত্যের মালার্মেসহ নন্দনতাত্ত্বিক কাব্য-সমালোচকদেরও বিশ্বাস, শব্দই কবিতা। যা-ই হোক, শব্দের মাহাত্ম্য বহুবর্ণিল ও বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষার বৃহদায়তন অভিধানগুলোর পাতায় দৃষ্টি দিলেই তা প্রতিভাত হয়। আগুনের যেমন আছে অসংখ্য গুণ, তেমনই ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দেরও আছে অজস্র অর্থের সম্ভার। কালস্রোতে ও জীবনের প্রয়োজনে জীবন্ত ভাষায় আসে নতুন শব্দ, তা বিবর্তিতও হয়। পুরনো শব্দ অচল মুদ্রার মতো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে মণি-কাঞ্চনরূপে ঠাঁই নেয় অভিধানের সিন্দুকে।
বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমুদ্রসম―মধুসূদনের ভাষায় : ‘ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। বৈঠকি মেজাজে, সরস আড্ডার ভঙ্গিতে লেখা এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’। ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক―সবকিছু মিলিয়ে শব্দের ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য-সৌগন্ধ এবং অন্তর্গত আনন্দধারার ছিটেফোঁটা ভাষিক রূপ এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’ ধারাবাহিক।]
বই
যে-বইজুড়ে সূর্য ওঠে
পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে
সে-বই তুমি পড়বে।
যে-বই জ্বালায় ভিন্ন আলো
তোমায় শেখায় বাসতে ভালো
সে-বই তুমি পড়বে।
যে-বই তোমায় দেখায় ভয়
সেগুলো কোনো বইই নয়
সে-বই তুমি পড়বে না।
যে-বই তোমায় অন্ধ করে
যে-বই তোমায় বন্দি করে
সে-বই তুমি ছোঁবেই না।
―বই, হুমায়ুন আজাদ
একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়ে পর্বটি শুরু করা যাক। এক যুগেরও বেশি আগে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল বাশার একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল এ দেশের অন্যতম দৈনিক কালের কণ্ঠ-এর শুভযাত্রা সংখ্যায়। চমকপ্রদ সেই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন :
আমি আরও একটা অদ্ভুত উদাহরণ দিচ্ছি, যা শিক্ষিত বাঙালির অজানা; সেটা হলো, বই শব্দটা একেবারে গোড়ার একটি সম্পূর্ণ কুরআনের শব্দ, মানে একেবারে আরবি শব্দ এবং এটা ‘ঈশ্বর’ চিন্তার সঙ্গে যুক্ত শব্দ―সেটা হলো―অহি। অহি শব্দটা থেকে বহি, ‘বহি’ থেকে বই। ‘অহি’ হলো ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ। তাহলে ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ তো সম্পূর্ণ একটা ধর্মীয় ব্যাপার। সুতরাং ‘বই’ শব্দটা গোড়াতেই একটা ধর্মীয় শব্দ, সেটা বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষ শব্দ হিসেবে ব্যবহার করে। এটা হলো শব্দার্থের যে বিবর্তন সেটার উৎস ধর্মীয় হলেও সেটা যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দে পরিণত হতে পারে তার সবচাইতে বড় প্রমাণ ‘বই’। এখন এটা যদি পশ্চিমবঙ্গের একজন হিন্দু বাঙালি জেনে থাকেন ‘বই’ শব্দটি আরবি এবং সেটা একদম ধর্মসম্পৃক্ত শব্দ তাহলে আর আরবি-ফারসি শব্দ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না তিনি।…
‘অহি’―এই ‘অহি’ শব্দটা উচ্চারণ করেই না বাঙালি কারণ হলো―‘ওয়াহ’ শব্দটা বাঙালির উচ্চারণের মধ্যে থাকে না। বাঙালির কাছে দুটো যে ‘ব’―একটা বর্গীয় এবং অপরটা অন্তস্থ। এই বর্গীয় ব-ই শুধু উচ্চারণ করে এবং অন্তস্থ ‘ব’ বাঙালি উচ্চারণ করে না বলে ‘অহি’টা বহি থেকে বই হয়ে গেল।
বই শিক্ষার উপকরণ, জ্ঞানচর্চার আধার―শব্দ সাজিয়ে সৌন্দর্যসৃষ্টি এবং মানবমনে আনন্দদানেরও উপাদান। হাজার হাজার বছর ধরে বই বিশ্বমানবচিত্তে জ্ঞানানন্দ দানের দায়িত্ব নীরবে-নিভৃতে পালন করে আসছে। আলো যেমন অন্ধকার দূরীভূত করে চাক্ষুষ করে তোলে জাগতিক সৌন্দর্য, বই তেমনই অন্তরের আঁধার দূর করে আলোকিত করে জ্ঞানচক্ষু। আলোর শক্তি তেজ দীপ্তি আছে তা দৃশ্যমান করে জগতিক সৌন্দর্য। কিন্তু এসবের বাইরেও বইয়ের আছে এমন শক্তি যা চেতনা ও অনন্ত বৌদ্ধিক শক্তি বিকশিত করে। বই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, দূরের সঙ্গে কাছের, প্রান্ত থেকে অনন্তের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন, বই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতু বেঁধে দিয়েছে―তা তো মিথ্যে নয়! যুগ থেকে যুগান্তরে মানবসভ্যতা ক্রমবিকাশের যোগসূত্রও একমাত্র বই। তাই পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে আছে বইয়ের অকুণ্ঠ প্রশংসাবাণী। বিশ্বখ্যাত কবি-লেখকেরাও বইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সেসব কথা আমরা অনেকেই জানি। তবু স্মরণ করি, বই সম্পর্কে মহৎ লেখকদের কয়েকটি অমর বাণী :
* বইয়ের মতো এমন বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই।
―আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।
* ভালো বন্ধু, ভালো বই এবং একটি শান্ত বিবেক―এটি আদর্শ জীবন।
―মার্ক টোয়েন।
* ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর মহৎ লোকের সঙ্গে আলাপ করা।
―দেকার্ত।
* বই ছাড়া একটি কক্ষ আত্মা ছাড়া দেহের মতো।
―মার্কাস টুলিয়াস সিসারো।
* বই পোড়ানোর চেয়েও গুরুতর অপরাধ অনেক আছে। সেগুলোর মধ্যে একটি হলো বই না পড়া।
―জোসেফ ব্রডস্কি।
* বই হলো শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনও দিন ঝগড়া হয় না, মনোমালিন্য হয় না।
―প্রতিভা বসু।
* বই হলো অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো।
―রবীন্দ্রনাথ।
* বই হলো এমন এক মৌমাছি যা অন্যদের সুন্দর মন থেকে মধু সংগ্রহ করে পাঠকের জন্য নিয়ে আসে।
―জেমস রাসেল।
* ঘরের কোনও আসবাবপত্র বইয়ের মতো সুন্দর নয়।
―সিডনি স্মিথ।
* রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে কিন্তু বই, সে তো অনন্ত যৌবনা।
―ওমর খৈয়াম।
আর কে না জানেন, সৈয়দ মুজতবা আলীর আপ্তবাক্যতুল্য উক্তি : বই কিনে কেউ কোনওদিন দেউলে হয় না। বই হলো মানুষের মন ও মস্তিষ্কের পবিত্র সন্তান।
অশোক মুখোপাধ্যায়ের সমার্থশব্দকোষ-এ বইয়ের বেশ কিছু সমার্থক শব্দ পাওয়া যায়। সেগুলো এরকম : বই, গ্রন্থ, পুস্তক, বহি, বুক, পুথি, পুঁথি, শাস্ত্র, পুস্তিকা, চটি, চটিবই, বুকলেট, পুঁথিপত্র, তালপাতার পুঁথি, খুঙ্গিপুঁথি, পাণ্ডুলিপি, পাণ্ডুলেখ, পাণ্ডুলেখা, ম্যানস্ক্রিপ্ট, ম্যানুস্ক্রিপ্ট। বই শব্দের জঠরকথা আমরা জেনেছি। এবার সংক্ষেপে বইয়ের কয়েকটি প্রতিশব্দের উৎস ও বিবরণ জানা যেতে পারে।
★ গ্রন্থ : এটি সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ। √গ্রন্থ্ ধাতুর অর্থ বন্ধন। √গ্রন্থ্ + অ = গ্রন্থ। গ্রন্থন করে বা গেঁথে যা প্রকাশ করা হয় তা-ই গ্রন্থ।
★ পুস্তক : এটিও তৎসম শব্দ। √পুস্ত্ ধাতু বা ক্রিয়ার মূল থেকে পুস্তক। এর অর্থ বন্ধন। যা বন্ধন করে রাখা হয় তা-ই পুস্তক।
এখন তা সেলাই করে ও আঠা দিয়ে আটকে রাখা হয়। ফারসি শব্দ পোস্ত্ ভেড়ার চামড়া। তা বই লেখার কাজে ব্যবহার হতো বলে ফারসিতে বইকে পোস্ত বলা বলে।
★ পুঁথি বা পুথি : পুঁথি শব্দের অর্থ হাতে লেখা প্রাচীন বই। অবিভক্ত ভারতের হুগলির শ্রীরামপুরে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে সব বই ছিল হাতে লেখা। পুঁথি বা পুথি শব্দ তদ্ভব। পুঁথি এসেছে পংক্তি থেকে―পংক্তি > পংতি > পুঁথি। আর পুথি এসেছে পুস্তিকা শব্দ থেকে―পুস্তিকা > পুত্থিআ > পুত্থিয়া > পুথি। ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায়―হিন্দি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, মৈথিলি, গুজরাটি, সিন্ধি, উড়িয়া, অসমিয়া ইত্যাদি ভাষায় বানানভেদে শব্দটি পাওয়া যায়।
★ পাণ্ডুলিপি : পাণ্ডুর বর্ণ বা হলদেটে ও অস্পষ্ট হয়ে গেছে যে লেখা তাকে বলে পাণ্ডুলিপি। এই মূল অর্থ পরিবর্তন হয়ে এখন পাণ্ডুলিপি মানে মুদ্রণের জন্য হাতে লেখা খসড়া কাগজ। পাণ্ডুলিপি তৎসম সমাসবদ্ধ শব্দ।
★ কেতাব : শব্দটি আরবি কিতাব থেকে বাংলায় এসেছে। দুটো শব্দই প্রচলিত। এর মূল অর্থ লেখা বা লিখিত কাগজ। পুথিগত বিদ্যাকে আমরা কেতাবি বিদ্যাও বলি।
এই বই-পুস্তকেরও ভাগ-উপবিভাগের অন্ত নেই : বিষয়ভিত্তিক ভাগ, বাইরের ভাগ, ভেতরের ভাগ―আরও কত কী! বিষয়ের দিকে চোখ ফেরালে মোটা দাগে চোখে পড়বে―ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, সাহিত্য―আরও কত কী! সাহিত্যের দিকে তাকালে বিনা লেন্সেই দেখা যাবে―মহাকাব্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, জীবনী, স্মৃতিকথা―এমন শতমুখী প্রসারণ।
একালের বই ভেতরে-বাইরে আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি দুই অর্থেই শিল্প। মূল বইয়ের আগে থাকে বিভিন্ন অংশ। সুমুদ্রিত একটি বইয়ের দিকে তাকালে প্রথমেই দেখা যাবে বাহারি মলাট, যার পোশাকি নাম প্রচ্ছদ। শক্ত বোর্ডে মোড়ানো থাকে প্রচ্ছদ। এখন এই প্রচ্ছদের ওপরেও থাকে সুদৃশ্য জ্যাকেট। প্রচ্ছদের নিচে থাকে পুস্তানি বা দপ্তি। জ্যাকেটের প্রথম ফ্ল্যাপে থাকে বই-পরিচিত আর শেষে লেখক-পরিচিতি। বইয়ের আকৃতি-প্রকৃতি এবং গুরুত্ব বুঝে বাঁধাই হয় বিভিন্ন রকম : বোর্ডবাঁধাই, কাপড়-বাঁধাই, রেক্সিন-বাঁধাই, চামড়া-বাঁধাই, পেপারব্যাক ইত্যাদি। হাফটাইটেল, ফুলটাইটেলের পর প্রকাশনা, প্রাপ্তিস্থান ও বিনিময় মূল্যসহ বিভিন্ন তথ্যের জন্য বরাদ্দ থাকে এক পৃষ্ঠা। তারপর উৎসর্গপত্র। বিশেষ কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে যখন বইটি তুলে দেওয়া হয় তখন তার নামপত্রের পৃষ্ঠাটি হলো উৎসর্গপত্র। এককালে উৎসর্গপত্রের ধারণাটি বাংলা বইয়ে ছিল না। তা লেখকের ঐচ্ছিক বিষয়। পাশ্চাত্যের প্রকাশনাশিল্প থেকে উৎসর্গপত্রের বিষয়টি বাংলা পুস্তকশিল্পে আমদানি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের গবেষক অনির্বাণ রায়ের উৎসর্গপত্র (সোপান, কলকাতা, ২০১৮) নামে একটি বই আছে।
এর মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন : উৎসর্গপত্র বইয়ের অঙ্গ। এক থেকে একাধিক ছত্রে তার আয়তন-বিস্তৃতি। এতে ধরা থাকে একটা বিশেষ কণ্ঠস্বর, দৃষ্টিভঙ্গি, মর্জিমেজাজ, সমাজ-সময়ের ধূসর ছবি, ইতিহাসের টুকরো, জীবনের ভগ্নাংশ―এমন কত কিছু।
মূল বই শুরুর আগে থাকে সূচিপত্র বা বিষয়ের নামলিপি। এরপর বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে লেখক বা বিশিষ্টজনের ভূমিকা। এই ভূমিকা বা বিষয়বস্তু বর্ণনেরও আছে চমকপ্রদ নাম। একটু অপরিচিতগুলোই লিখি : উপক্রমণিকা, অনুক্রমণিকা, আমুখ, অনুক্রমণী, মুখপাত, আভাষ, বাঙ্মুখ, গৌরচন্দ্রিকা, উপোদ্ঘাত। এগুলো সাধারণত প্রাচীনকালের বইয়েই লক্ষ্যযোগ্য। একটি স্বাস্থ্যবান গ্রন্থে থাকে একাধিক অধ্যায় বা পরিচ্ছেদ। এরও আছে বিচিত্র নাম : প্রকীর্ণক, সর্গ, বর্গ, স্কন্ধ, কাণ্ড, অঙ্ক ইত্যাদি।
পৃথিবীতে যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানে সীমা প্রসারিত হচ্ছে ততই বিস্তৃত হচ্ছে গ্রন্থের বিষয়, বাড়ছে বৈচিত্র্য। বই পড়তে যারা ভালোবাসেন তাদের আমরা পাঠক, বইপ্রেমী, গ্রন্থপ্রেমী, বইবিলাসী, পুস্তকপ্রেমী ইত্যাদি বলি। তবে একটু নিন্দার্থে বা তুচ্ছার্থে, গ্রন্থকীট, বইপাগলা, বইপোকা ইত্যাদিও বলি।
‘বই’ শব্দটি আরবি থেকে বিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে তা আমরা আগেই জেনেছি। বইয়ের ইংরেজি ইড়ড়শ এসেছে প্রাচীন ইংরেজি ইড়প থেকে―এর মানে বীচ গাছ। জার্মান ভাষায় বলে ইঁপয, ইতালিয়ানে খরনৎড়, ফরাসিতে খরাৎব, রুশ ভাষায় কহরমধ, চিনাতে ঝযঁ। এই যে বই নিয়ে এত কথা―কাকে বলি বই ? সাধারণ অর্থে ছাপা কাগজ একসঙ্গে গাঁথা হলেই বই হয়। তবে ইউনেস্কোর সূত্রমতে, ৪৯ বা তার অধিক মুদ্রিত পৃষ্ঠা একত্র গাঁথা হলেই তাকে বলা হয় বই।
তবে ব্যবহারিক বাংলায় শব্দটি একার্থক নয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানসহ বিভিন্ন অভিধানে শব্দটির চারটি ভুক্তি আছে। সেগুলো নিম্নরূপ :
★ বই : বিশেষ্য পদ। আরবি বহী থেকে বই। গ্রন্থ, পুস্তক, কিতাব। এছাড়া খাতা এবং চলচ্চিত্র অর্থেও অনেক লেখক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ১৭৮২ সালে জনৈক ফরাসি ওগুস্তাঁ ওসাঁ বহী শব্দটি প্রথম বই অর্থে ব্যবহার করেন। রবীন্দ্রনাথের লেখায় পাওয়া যায় : ‘আমি দার্শনিক তত্ত্ব নই, আমি ছাপার বই নই।’ (১৮৯৭)। গিরিশচন্দ্র ঘোষ খাতা অর্থে লিখেছেন : ‘তুমি অ্যাঁ, আমার বই খারাপ করলে।’ (১৮৮৬)। বই শব্দটি চলচ্চিত্র অর্থে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন : ‘তেমন জোর বই নেই―আর্টিস্টও নেই।’ (১৯৩২)।
★ বই : অব্যয় পদও। বই ও বৈ―এই দুই বানানেই শব্দটি সেকালে লেখা হতো, একালেও লেখা হয়। বিনা, ব্যতীত, ছাড়া, ভিন্ন, বাদে, অতিবাহিত, বাহির, অপেক্ষা, অথবা, নিশ্চয় ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। কয়েকটি উদাহরণ :
* ‘গোপিকার চিত্তে আন নাহি তোমা বই।’ (মালাধর বসু, ১৫০০, ছাড়া অর্থে)।
* চৌদ্দ বৎসর বৈ আসিবেন ঘরে। (পরে বা বাদে অর্থে, কৃত্তিবাসী রামায়ণ)।
* মেষ গরু অজা আদি কেহ করে বৈ। (বাহির অর্থে, শ্রীধর্ম্মমঙ্গল, ঘনরাম চক্রবর্তী)।
* ঋণ বৈ পাপ নাই সংসার ভিতর। (অপেক্ষা অর্থে, বঙ্গসাহিত্য পরিষদ, ১৯১৪)।
* রসিকরাজ, তুমি গাইতে জান ?… দিগগজ বলিলেন, জানি বৈ কি! (নিশ্চয় অর্থে, বঙ্কিমচন্দ্র)।
* তুমি তো ফিরিয়া যাবে আজ বই কাল। (অথবা অর্থে, রবীন্দ্রনাথ, ১৮৯০)।
★ বই : ক্রিয়াপদ। সংস্কৃত বহনার্থক। √বহ্ ধাতু থেকে উৎপন্ন। ব্যাপ্ত, বিস্তৃত বা রাষ্ট্র (প্রচারিত) অর্থে প্রয়োগ করা হয়। বহে, বহা, বহেন, বহি ইত্যাদি ক্রিয়াপদ এই ধাতু থেকে তৈরি। চালান বা স্থানান্তর অর্থেও শব্দটি একদা ব্যবহৃত হয়েছে। কয়েকটি উদ্ধৃতি :
* তোমার কলঙ্ক বাপা হবে দেশ বই। (ব্যাপ্ত অর্থে, ঘনরাম চক্রবর্তী)।
* সে সমস্ত জিনিস বই করেছে। (চালান অর্থে, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস)।
★ বই : বিশেষ্য পদ। গন্ধ বা দুর্গন্ধ। ফারসি বু শব্দের অর্থ গন্ধ। লোকবাংলায় শব্দটি বিবর্তিত হয়ে বো, বুই বা বইতে পরিণত হয়েছে। সুগন্ধ অর্থে খুশবু এবং দুর্গন্ধ অর্থে বদবু এ দেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। হাসান আজিজুল হকের লেখায় আছে : ক্যামন ভকভক করে বই বেরুইচে দেখচিস ? (১৯৬০)। তাছাড়া বই শব্দটি গ্রামবাংলায় বসি বা বহন করি অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন―আমি একটু বই (বসি বা বহন করি)। বসা বা বহন-এর বর্তমান কালের উত্তম পুরুষের রূপ। বই শব্দটির বর্তমানে একটি বিলুপ্ত অর্থ কচুর লতি। বৈদিক সংস্কৃত শব্দ ব্রয় থেকে বই। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের অভিধানের দ্বারস্থ হলেই তা জানা যায়। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান-এ শব্দটি দেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
একুশ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে বইয়ের অনেক আধুনিকায়ন হয়েছে―বেড়েছে ই-বুকের প্রচার-প্রসার। গ্রন্থাগার বিজ্ঞান হয়েছে উচ্চতর শিক্ষায় অধীত বিষয়ের অন্তর্গত। অনেকের ধারণা, এই তথ্যপ্রযুক্তির আন্তর্জালিক যুগে পাঠাভ্যাস ও পুস্তক-প্রীতি ক্রমবিলীয়মান। কিন্তু বই পড়া ও বই কেনা কমলে প্রকাশকের সংখ্যা এবং বইপাড়া ও বইমেলার পরিধি বৃদ্ধি পায় কীভাবে ? প্রতি বইমেলায় নতুন বই প্রকাশের সংখ্যা ও বিক্রয়ের পরিমাণ দুই-ই ক্রমবর্ধমান―তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
বই যেমন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনী প্রতীক, তেমনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোগোতে উৎকীর্ণ এর ছবি। বই একালে প্রতীকায়িত হয়েছে জ্ঞান বিজ্ঞানের আলো এবং সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের লক্ষ্যে। পাশ্চাত্যের গ্রন্থাগারগুলোর স্থাপত্যশিল্পেও লক্ষ করা যায় বইয়ের বিচিত্র কারুকাজ। এ দেশেও একটি কলেজের প্রবেশদ্বার দেখেছি নির্মিত হয়েছে রাশি রাশি সাজানো বইয়ের নকশায়। বই অনেক বিদগ্ধ পাঠকের কাছে মাথার পাশে শয্যাসঙ্গীও। বই যে নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে মোক্ষম প্রতিবাদের মূক ভাষাও হতে পারে তাও আমরা এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দেখলাম। সেখানে রবীন্দ্রনাথের হাতে ছিল পেরেকবিদ্ধ গীতাঞ্জলি―যা থেকে রক্ত ঝরছে।
লেখাটি শেষ করি সৈয়দ মুজতবা আলীর বইকেনা প্রবন্ধের বহুপঠিত একটি রম্যগল্প দিয়ে। তিনি লিখেছেন : এক ড্রইংরুম-বিহারিনী গিয়েছেন বাজারে স্বামীর জন্মদিনের জন্য সওগাত কিনতে। দোকানদার এটা দেখায়, সেটা শোঁকায়, এটা নাড়ে, সেটা কাড়ে কিন্তু গরবিনীর (উভয়ার্থে) কিছুই আর মনঃপূত হয় না। সবকিছুই তার স্বামীর ভাণ্ডারে রয়েছে। শেষটায় দোকানদার নিরাশ হয়ে বললে―‘তবে একখানা ভালো বই দিলে হয় না ?’
গরবিনী নাসিকা কুঞ্চিত করে বললেন―‘সেও ওঁর একখানা রয়েছে।’
যেমন স্ত্রী, তেমনই স্বামী। একখানা বই-ই তাদের পক্ষে যথেষ্ট।
[চলবে]সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ