আর্কাইভপ্রবন্ধ

স্বপ্নময় চক্রবর্তীর জলের উপর পানি : এক মানবিক আখ্যান : পুরুষোত্তম সিংহ

প্রবন্ধ

‘দলিত সাহিত্য আকাদেমি’ গড়ে ওঠার পর ফেসবুকে স্বপ্নময় চক্রবর্তী একটা সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ করেছিলেন। বেশির ভাগ বাঙালি পাঠক সেই ব্যঙ্গ বুঝতে পারেনি। আসলে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর মননকে উপলব্ধির জোর তাদের ছিল না। বাঙালি পাঠকের অন্তত চতুষ্পাঠী উপন্যাসটা পড়া থাকলে সেই লাঞ্ছনা লেখককে সহ্য করতে হতো না। সিভিল সোসাইটির মনে কোথায় সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতা লুকিয়ে আছে, ধর্মহীন বলে নিজের ওজন বৃদ্ধি করা বাঙালির ধর্মজ্ঞান যে সামান্য আঘাতেই ভেঙে যাবে সেদিন বোঝা গেল। সেদিনই মনে মনে ভাবছিলাম লেখক বাঙালিকে আবার একটা বড় ধাক্কা দেবেন। ধর্মের দাসত্ব স্বীকার করে নেওয়া বাঙালিকে আবার বড় শিক্ষা দিলেন জলের উপর পানি উপন্যাসে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাঙালিকে আবার কয়েক পা এগিয়ে দিয়ে গেলেন। ধর্ম ও রাজনীতির অমীমাংসায় ব্যবহৃত দিশাহীন বাঙালিকে একটা পথ বাতলে দিলেন।

লেখক ধর্ম-রাজনীতিকে সামনে রেখে উপমহাদেশের বৃহৎ সমস্যাকে বিস্তৃত পরিসরে চিত্রিত করেছেন। ব্যক্তির সুস্থ জীবনচর্যায় রাষ্ট্র নানা কল-কাঠি নাড়ে। প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করে। ব্যক্তি যখন নিজেই ধর্মকে অতিক্রম করে যেতে চাইছে তখনও রাষ্ট্র সেই ধর্ম ও ধর্মীয় সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে চায় ভোটের অঙ্ক গুটিয়ে নিতে। হত্যা, বলি, দাঙ্গা, উদ্বাস্তু এসব ঘটে চলেছে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে। দাঙ্গায় পালিয়ে যাওয়া ও দেশভাগে উদ্বাস্তু হওয়া কিছু পরিবারকে সামনে রেখে গত শতকের সাতের দশক থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত সময় পরিসরে দেশের রাজনীতি, ধর্মীয় সমস্যা ও ধর্মের দলদাসে পরিণত করার রহস্যসহ উদ্বাস্তু জীবনের বহমান সমাজিক ভাষ্য রচনা করেছেন। উদ্বাস্তু জীবনের দুই প্রজন্মকে সামনে রেখে সমকালীন কলোনি কালচার, উত্তাল রাজনীতি, দেশভাগের কারণ অনুসন্ধান ও ধর্মকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের মুনাফা সব মিলিয়ে এমন এক ফ্রেম রচনা করেন যা অনবদ্য। ধর্মীয় বেড়াজাল অতিক্রম করে মহান দেশের মূলসূত্র কোথায় তা যেভাবে আবিষ্কৃত হয়ে চলে তা এই নষ্ট সময়ে এক মানবিক ভাষ্য রচনা করে। আখ্যান হয়ে ওঠে মানবতার মাইলস্টোন।

চতুষ্পাঠী উপন্যাসের শেষ থেকে এই আখ্যানের যাত্রা শুরু। পণ্ডিত অনঙ্গমোহনের জীবিকা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাত্রা। উদ্বাস্তু পণ্ডিত অনঙ্গমোহন টোল টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কালের খাতায় সংস্কৃত পাঠ উঠে গিয়ে ক্ষুধার বৃত্তি নিবারণে চায়ের দোকানে এসে পড়লেন। চায়ের দোকানকে সামনে রেখে সমকালীন রাজনীতি, ডান-বাম, বুর্জোয়া, ক্ষমতা দখল, সাধারণ মানুষের সংকট নিয়ে আখ্যান গড়ে ওঠে। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গদ্যের যে ব্যঙ্গ, কৌতুক, মৃদু শ্লেষ ও হাস্যরস তা প্রথম থেকেই চলতে থাকে। শ্রেণির রূপান্তরের মধ্য দিয়ে পণ্ডিত অনঙ্গমোহনের যে বিপর্যয় যা স্থান থেকে স্থানান্তরে ও সময় থেকে সময়ান্তরের মধ্যে পৌঁছনোর মধ্য দিয়ে উদ্বাস্তু জীবনের মর্মকথা রচিত হতে থাকে। জীবিকা, শ্রমের সঙ্গে ভাষা সংস্কৃতি যুক্ত। জীবিকা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনঙ্গমোহনের ভাষা বয়ন বদলাতে থাকে। অবিরত তাঁর পণ্ডিত-হকার সত্তায় দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের। কিন্তু সে জানে জীবনে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে শ্রেণি রূপান্তর সত্য। মধ্যবিত্তের সংগ্রাম-সংগ্রামহীনতা, রূপান্তর, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে সময়ের যে আলেখ্য রচিত হতে থাকে তা প্রশংসার দাবি রাখে।

আখ্যান পুরোপুরি রাজনৈতিক। গত শতকের ছয়-সাতের দশকের উদ্বাস্তু জীবন। সময়-রাজনীতি-দেশ নিজেদের অবস্থান নিয়ে ভাবনা ব্যক্ত হতে থাকে। একদিকে উদ্বাস্তুদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান নিয়ে লড়াই ও শ্রেণি সংগ্রাম অন্যদিকে রাজ্যসহ দেশের রাজনৈতিক চিত্র। উদ্বাস্তু জীবনের সংকট ও বিড়ম্বনার চিত্র এখানে বৃহৎ আকারে ব্যাপ্তি পেয়েছে। চতুষ্পাঠী উপন্যাসে যা ছিল বীজ আকারে এখানে তা মহীরূহ হয়ে উঠেছে। আসলে উদ্বাস্তু স্রোত আসার পর সময় যত এগিয়ে গিয়েছে সমস্যা তত ঘনীভূত হয়েছে। উদ্বাস্তু উপনিবেশ, জমি বণ্টন, কর্মহীন জীবন সব মিলিয়ে সময়ের বিভীষিকাকে বড় পরিসরে নির্মাণ করা। অনঙ্গমোহন নিজস্ব সত্তাকে বিসর্জন দিতে পারেননি। সেজন্য সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজের আভিজাত্য, রুচিবোধ, মূল্যবোধ বজায় রাখতে গিয়ে প্রতি পদক্ষেপে সংকটের মুখে পড়েছেন। বিকল্প পরিস্থিতিতে নিজের রুচি, সংস্কৃতি, বিদ্যা বাঁচিয়ে রাখতেই এই দ্বন্দ্ব। সবচেয়ে দ্বন্দ্বে ভুগেছে সে। যা মধ্যবিত্তের সংকট। না পারে কিছু ত্যাগ করতে না পারে কিছু গ্রহণ করতে। সংশয়, সন্দেহ, হতাশা, ক্লেদ, যন্ত্রণায় সে হয়ে উঠেছে সময়ের ভাষ্য। অনঙ্গমোহনের একটা রুচিবোধ আছে, শালীনতা আছে, ভদ্রতা-সংস্কৃতিবোধ আছে। যা সেদিন এপারের কলোনির উপনিবেশে বেমানান। ফলে বারবার অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে হয়েছে। সকলেই উদ্বাস্তু বলে হেয় করে চলেছে। যদিও নিজেকে বারবার স্থির রেখেছে।

উদ্বাস্তু যেন জলের কচুরিপানা। অনঙ্গমোহনও যেন তাই। ক্রমাগত ভেসে চলা। রাজনৈতিক ব্যঙ্গ, উপমহাদেশের চালচিত্র, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান, উপভাষা, ধান্দাবাজি, নব্য উপনিবেশ, নগর কলকাতার চিত্র সমস্ত মিলিয়ে যে কালিক ভাষ্য উপস্থাপন করেন তা সময়ের জরুরি পাঠ হিসেবে বিবেচ্য। লেখকের ভাবনা সঞ্চারকারী প্রতিনিধি-স্থানীয় চরিত্র অনঙ্গ। সে তাত্ত্বিক, জ্ঞানী, সংস্কৃত পণ্ডিত। সে সংস্কার, লোকাচার, বিশ্বাসকে মানে ঠিকই কিন্তু তা সামাজিক প্রথা হিসেবে। আবার ঈশ্বরের স্তবগানে মত্ত নয়। অন্য তা পালন করলেও সেখানে ক্ষিপ্ত নন। সে নাস্তিক নয়, আবার আস্তিকও নয়। সমাজিক প্রথা পালন করেন। তবে বিশ্বাসী নন। আবার অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দেন না।

আখ্যানের বড় পরিসর জুড়ে রয়েছে অনঙ্গমোহন ও বিলু। একজনের দিন শেষ, অন্যজনের শুরু। একজন সংস্কৃত, অন্যজন বিজ্ঞান। নিজের চেতনা অনঙ্গমোহন নাতির মধ্যে দিয়ে যেতে চান। বিলু দাদুর আদর্শ-মূল্যবোধ বহন করে চলে। আখ্যানের শুরুতে সন্দেহ ছিল সেই চেতনা বিলু কতটা বহন করতে পারবে ? যদিও আখ্যানের সমাপ্তিতে দেখা যায় সে হয়ে উঠেছে যথার্থ দোসর। এই ভাঙা দেশে বিলুর জন্ম। দুজনের অভিজ্ঞতা আলাদা। অনঙ্গমোহন দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে এপারে এসেছে। বিলু উদ্বাস্তু পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তান হয়ে যন্ত্রণা ভোগ করেছে। ভাড়া বাড়ি থেকে উদ্বাস্তু কলোনিতে উঠে গেছে। আবার নতুন করে লড়াই শুরু হয়েছে।

লেখক ধীরে ধীরে আখ্যানের পরিসর বড় করেন। ৪৩-এর মন্বন্তর, ৪৬-এর দাঙ্গা, মুসলিম লিগ, কৃষক প্রজা পার্টি, খাদ্য আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন, মরিচঝাঁপি সব মিলিয়ে বিংশ শতাব্দীর একটা বড় পরিসরকে ধরতে চেয়েছেন। মন্বন্তরে মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় সন্তান বিক্রি করে দিয়েছে। কৈলাস দেবনাথ রচনা করে চলেছে ‘ছিন্নমূল’ নামে মহাকাব্য। বিশ্বনাথ মুসলিম শিশু ক্রয় করে আনে। শিশুর কোনও জাত নেই, ধর্ম নেই। সে বোঝে ক্ষুধা। এই অস্থির পরিস্থিতিতে অনেকটা সময় পিছনে গিয়ে তিনি সম্প্রীতির কাহিনি গড়ে তোলেন। তা যতই সাহিত্যিক, যতই বানানো গল্প হোক তবু প্রয়োজন ছিল এই কালচক্রে। স্বভূমিচ্যুত সর্বহারার দল নতুন করে বাঁচার রসদ সংগ্রহ করতে থাকে। কমিটি, ধর্ম, কর্ম, সংস্কৃতি, সংগঠন সব মিলিয়ে নতুন উপনিবেশ গড়ে ওঠে। বৃদ্ধদের প্রখর দৃষ্টি ছিল। নিজস্ব সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কড়া নির্দেশ ছিল―‘অবনী হালদার বলে―মার্কস ল্যানিনের কথা শুন্যাও মরণরে তুচ্ছ করছে জনগণ। চীন-রাশিয়ায় গীতা ছিল না…। শৈলেন অধিকারী নামে একজন, কম কথা বলে। বললেন―সাংস্কৃতিক চেতনাটা কিন্তু লক্ষ্য রাখবেন। দেখেছেন, কোনও উপলক্ষ পেলেই কেমন হিন্দি গান বাজে ? একদম কড়া নির্দেশ দিন যেন আজেবাজে গান না বাজানো হয়। বেলাল্লাপনা।’ (জলের উপর পানি, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০২১, পৃ. ৯১)

একদিকে দেশভাগের কারণ অনুসন্ধান, অন্যদিকে উদ্বাস্তু জীবনের ভয়ংকর পরিণতি আখ্যানে মিশে থাকে। দেশভাগের রাজনীতি থেকে আবহমানকালের রাজনীতির বয়ান আখ্যানকে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা দান করে। রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান-চাহিদা- নিজেদের সুবিধাজনক মনোভাব পর্বে পর্বে বেরিয়ে আসে। ভাঙনের বড় ক্ষত কোথায় লুকিয়ে ছিল, রাজনৈতিক মতভেদের তুলনায় সামাজিক দায়বদ্ধতা, সহাবস্থান কীভাবে সম্প্রদায়ে বিভেদ ঘটিয়ে আসছিল সেই সামাজিক সত্যকে দেখা ও অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ আখ্যানকে গল্পভূমি থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। সেই কন্যাভাসকে, রাজনৈতিক নেতাদের সুবিধাবাদী সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপকে লেখক ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করেন। লোভ-ক্ষমতা নিয়ে মারামারি করতে গিয়ে মানুষ বিসর্জন দেওয়া হয়। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের অবস্থানের মধ্যেই একদিন নকশালদের উত্থান ঘটে যায়। ধ্বংস প্রলয়ে বহু যুবকের গ্রেফতার ও মৃত্যু ঘটে। বিপ্লবের ডাক ও দিন বদলের আহ্বানে সরকারি সম্পত্তি ও সংস্কৃতি ধ্বংসের যজ্ঞ চলে। রাষ্ট্রীয় পুলিশ তা নিধনে অগ্রসর হয়। দেশভাগের পাঁচ বছর পর জন্ম নেওয়া বিলু নকশাল থেকে গা বাঁচিয়ে চলে। কোনও রাজনৈতিক দলেই প্রবেশ করতে চায় না। বিলুর চোখ দিয়ে, অনঙ্গমোহনের চোখ দিয়ে সমকালীন চিত্রকে লেখক দেখান।

ব্রাহ্মণ্যবাদ, ধর্মসংস্কার, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের ভিত্তিস্থাপন কত ভুলের জন্ম দেয়, বিপ্লবের অনুপ্রেরণা, শোষক-শোষিত সম্পর্ক, সব মিলিয়ে ফেলে আসা সময়ের কথকতা এমন দ্রুত গদ্যে এবং ভঙ্গিহীন লহমায় ভেসে চলে যা অনবদ্য। আখ্যানের চলনে কাহিনি, ইতিহাসের তথ্য, ব্যঙ্গ, শ্লেষ ও মাঝে মাঝে কাব্যধ্বনি বিবিধ রসাভাসের জন্ম দেয়। কৈলাসের ‘ছিন্নমূল’ মহাকাব্য নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ মহাকাব্যই বটে। এতবড় ঘটনা, মানুষ হত্যা, দেশত্যাগ ও সেই ত্যাগের কারণ অনুসন্ধান। মুসলিম লিগের বিকাশ, আধিপত্য, পাকিস্তান গড়ে ওঠা, বাংলাদেশের জন্ম সমস্ত চারণকবির মতো ছন্দবন্ধে লিপিবদ্ধ করে চলেন। এও এক নবনির্মিত ইতিহাস। দেশভাগের একেবারে অতল প্রদেশে ভ্রমণ করে জলমাটিসহ ইতিহাস, বিকৃত ইতিহাসকে টানা-হ্যাঁচড়া করে কালবেলার আলোয় উপস্থাপন করেন।

অনঙ্গমোহন, কৈলাসরা দেশ হারানোর ব্যথা নিয়ে এপারে এসেছে। বিলু, রুনুরা উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান হয়ে সেই কষ্ট সহ্য করে চলেছে। অভাব, ভিটেমাটি না থাকার কষ্ট। মানুষগুলো আবার বিবিধ সংকটে ভুগেছে। অনঙ্গমোহন, কৈলাসের সংকট ভিন্ন। অনঙ্গমোহনও পুত্রবধূ দ্বারা সামান্য লাঞ্ছিত, কৈলাস বেশি। অনঙ্গমোহনের নিজের স্ট্যাটাস বিসর্জন দেওয়ার সংকট, কৈলাসের প্রজন্মের কাছে জানিয়ে যেতে চান। কৈলাস নিজেই স্বাধীনতা সংগ্রামী, সেই সত্য জানান দিতে ক্ষুধার সংকট। অনঙ্গমোহন দেশভাগের অতীতকে খুঁচিয়ে দেখতে চান না। কৈলাস সেই ইতিহাস খুঁচিয়ে নব  চান। অনঙ্গমোহন সংস্কৃত পরিসর টিকিয়ে রাখতে চান। এই পরিবেশ, পরিস্থিতিতে তা টিকবে না তা জানেন তবু মনের মধ্যে জেদ। বিলুর স্বপ্ন পড়াশোনা করে চাকুরি করা। রুনু বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর। বিলুর শ্রেণিচিন্তা পাঠকেন্দ্রিক, ডায়েরিতে লিপিবদ্ধকেন্দ্রিক। রুনু শ্রেণিশত্রু নিধনে বিশ্বাসী। যদিও সেই বিপ্লব, শ্রেণিশত্রু নিধনে নানা বেনোজল ঢুকে গেছে।

গত শতকের সাতের দশকে এক তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরজমান। কংগ্রেস-কমিউনিস্ট-নকশাল। ইন্দিরা গান্ধি-প্রমোদ দাশগুপ্ত-চারু মজুমদার। বিভিন্ন রাজনৈতিক মেরুদণ্ড ও পন্থায় মানুষ নাজেহাল, সমর্থন-অসমর্থন, পক্ষ-বিপক্ষের রেষারেষি, বিপ্লব করার স্বপ্ন, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মৃত্যুসহ মানুষের ক্ষত বৃদ্ধি হয়ে চলে। বিলু এসব দেখে চলে। সেই সত্য তাঁর ডায়েরিতে ধরা থাকে। সময়ের দোসর হিসেবে তাঁর ডায়েরি গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ-অস্থিরতা- নকশাল দমন-হত্যা-সীমান্তে যুদ্ধ সব মিলিয়ে একটা বীভৎস স্কেচ। দেশভাগের মূলে ছিল ধর্ম ও রাজনৈতিক নেতাদের অপদার্থতা। লেখক সেই ধর্মকেই আঘাত করেন। মানুষ প্রকৃত সত্য-ধর্মের মূল বাণী জানতে চায়নি। ধর্মকে সামনে রেখে ক্ষমতা ভোগ করতে চায়। বিনাশকালের সন্তান সাগর (আসলে মুসলিম আসগর কিন্তু বর্তমানে হিন্দু)। এপারে এসে সে মুসলিম বাড়ি সংস্কারে মুসলিম চিহ্ন ভেঙে ফেলে। প্রচলিত ধর্মটাই যেন মানুষকে শেষ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। লেখক সেই সত্যকেই বড় পরিসরে ধরতে চান।

একটা দীর্ঘ উপন্যাস পড়ার জন্য যে সৃজনশীল চলমান গদ্য প্রয়োজন তা লেখক ভালো মতোই আয়ত্ত করেছেন। স্বপ্নময় চক্রবর্তী গদ্যে আগাগোড়াই চমৎকার। ব্যঙ্গ, কাব্যধর্মী বাক্য, উপমার মালা, অনুপ্রাস বৃত্ত ঘিরে বাক্যকে দুলতে দুলতে দ্রুত চালনা করেন। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ইচ্ছামতো ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। ছড়া-প্রবাদ। তবে তা চরিত্রের মুখ দিয়ে। যা সমকালীন সময়ের ভাষ্য হিসেবে অব্যর্থ। তৎকালীন রাজনৈতিক বঙ্গবীরদের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে উদ্বাস্তুরা ভালো চোখে দেখেনি তা স্পষ্ট হয়। পরপর কয়েকটি নির্বাচন, ক্ষমতা দখল ও হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে হিংসা প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। সাতের দশকের জঘন্য রাজনীতি, ক্ষমতা দখল, হত্যা, লুণ্ঠন যেন আখ্যানের বড় চরিত্র হয়ে ওঠে। সেই কালিমাময় রাজনীতিতে, সংঘর্ষময় কর্দমায়, পক্ষ-বিপক্ষের খুন জখমে অনেক মেধাবী ছাত্রও বিপদে পড়ে। রাজনীতি না জানা যুবকও প্রহারের স্বীকার হয়। বিলু তাদেরই প্রতিনিধি। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, পুলিশের বিবেকহীন গুলিতে হারিয়ে যায় সর্বহারার শ্রেণি সংগ্রাম। কাগজের দরে বিক্রি হয়ে যায় মার্কস, লেনিন। ভীতু উদ্বাস্তু মানুষ পুলিশের জাল থেকে বাঁচতে দাঁড়িপাল্লায় উঠিয়ে দেয় সর্বহারার নায়ককে―

‘কাগজওলা তাড়া দিচ্ছে। যে কটা খারাপ মনে হল কাগজপত্র, পত্রিকা-সব দুহাতে নিয়ে কাগজওলার কাছে ফিরল। পাল্লায় চাপলেন লেনিন। অন্যদিকে বাটখারা। আড়হাই কেজি। ছিন্নমূল কাব্যের সঙ্গে বস্তায় ঢুকে গেলেন মার্কস-এঙ্গেলস এবং আরও অনেকে। অঞ্জলি এবং ছায়ারানি দুজনেই পয়সা নিয়ে বলেছিল, এতনা কম কেন ? আরও কিছু দাও!’ (তদেব, পৃ. ১৭৬)

উদ্বাস্তু ডলি খ্রিস্টান হয়ে গেছে। দেশভাগের পর অনেকের জাতি রূপান্তর ঘটেছে। সেদেশে থাকলে কী হতো ? বিহারি মুসলিম নিজের সুবিধার জন্য ওপারে গিয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে পাকিস্তানে গিয়েছে। উজমা আসলে ভারতীয় বংশোদ্ভুত। আজ পাকিস্তানের অধিবাসী।

এক অভাবী উদ্বাস্তু বালক কীভাবে রাজনীতির পাকচক্রে নাজেহাল হচ্ছে আখ্যান সেই সত্য জানান দেয়। সেদিন বহু প্রতিভা এইভাবে হারিয়ে গেছে। বিলুকে সামনে রেখে লেখক তৎকালীন জঘন্য রাজনীতিসহ সময় সন্ত্রাসের চিরুনি তল্লাসি চালান। রাজনীতির পাকচক্রে সেদিন সাধারণ মানুষ কীভাবে নাস্তানুবাদ হল সেই সত্যকে বুনন করে চলেন। রাজনীতির ‘র’ বোঝে না সেসব মানুষকে গ্রেফতার, প্রহার করা হলো। আখ্যানের অলিগলি দিয়ে রাজনীতির ঘোলা জল চলমান থাকে। বিপ্লব নিধনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহত থাকে। শ্রেণিশত্রু দূর করতে চলতে থাকে হত্যালীলা। সাধারণ মানুষের শান্তি কেড়ে নেওয়া হয়। সেই সংকটপূর্ণ জীবনের বর্ণমালা এই আখ্যান। কৈলাসের মহাকাব্য ছায়ারানি কাগজওলার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে পরিত্যক্ত কাগজ বলে। কৈলাস পাগল হয়ে যায়। জাতির ইতিহাস হারিয়ে যায়। সংসারে অভাব থাকলে সভ্যতা, রুচি, সৌন্দর্য কিছুই থাকে না তা প্রমাণ হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে বিলু, অনঙ্গমোহন দুজনেই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। দাসত্ব সময়ের নারকীয় দলিল হয়ে ওঠে সত্তর দশক। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে বলি হয়ে বিদায় নেয় অনঙ্গমোহন―‘অনঙ্গমোহন বসে পড়ে। অনঙ্গমোহন একটা তীব্র আওয়াজ করেছিল। হায় মা, সেখানে প্লুতস্বর ছিল, লুপ্ত এবং উহ্য শব্দ ছিল, অসহায়তা এবং ক্ষোভ ছিল, ঈপ্সা ছিল, কথাটা হে রামের মতো শোনাচ্ছিল নাকি হে মা বলেছিলেন, এই মা কি মাতৃভূমি না জন্মদাত্রী ? কপাল ও কপোল থেকে রক্তরেখা গড়িয়ে ঠোঁটে নেমেছে। অনঙ্গমোহনের কথা বলার চেষ্টায় আহত শব্দের ভিতরে রক্তের বুজকুরি কাটছে। ঠোঁট কাঁপছে।’ (তদেব, পৃ. ১৮৬)

অনঙ্গমোহনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটা অসমাপ্ত পর্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে। এক উদ্বাস্তু আদর্শ পণ্ডিতের জীবনের লড়াই শেষ হচ্ছে। উদ্বাস্তুদের প্রথম পর্বের মহান মানুষ বিদায় নিচ্ছে। যিনি কোনওদিন অনৈতিক ছিলেন না। শুদ্ধ রুচিবোধ, সংস্কৃতি ও মানবিকতা বজায় রেখেছিলেন। সেই সংগ্রামটা শুরু হয়েছিল ‘চতুষ্পাঠী’ থেকে। ‘জলের উপর পানি’ আখ্যানের ১৮৮ পৃষ্ঠায় এসে সংগ্রাম থেমে গেল। এখান থেকে বিলুর একলা পথ চলা। বিলুর দ্বিধা দ্বন্দ্ব আরও প্রবল হল। এতদিন দাদুকে সামনে রেখে একটা সমাধানসূত্রের পথ ছিল সেই পথ বন্ধ হয়ে গেল। আবার জগৎ জীবনকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধির ক্যানভাসও পেয়ে গেল। দাদুর মৃত্যু ও রুনুর গ্রেফতার বিলুর মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলাচলতা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি করল। সময়ের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে চলেছে। অনঙ্গমোহনের ছাত্র অসীম পকেটমার হয়ে গেছে। উদ্বাস্তু মানুষকে জীবনে বেঁচে থাকতে নানারকম সংগ্রাম করতে হয়েছে। চুরি, অপরাধ, শ্রেণি, সর্বহারা, ধর্ম-অধর্ম, নীতি-দুর্নীতি, বাঁচা, বাঁচার জন্য বিবিধ পথ খোঁজা, সব মিলিয়ে বাঁচা নামক প্রক্রিয়াকে কঠিন ও কঠোর সংগ্রামের মুখে দাঁড় করিয়ে জীবনকে বোঝা ও বোঝানো।

উদ্বাস্তুরা একটু মাথা থিতু হতেই বাঙাল-ঘটি দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। সেই দ্বন্দ্বের স্বীকার মাধুরী। উদ্বাস্তু মাধুরী শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। ঘরে-বাইরে সংগ্রাম ও সন্ত্রাস। বাইরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, নকশাল নিধন, ঘরে বাঙাল-ঘটি বিবাদে মাধুরীর করুণ পরিণতি। সামাজিক ক্ষত ও অবমাননের অতল প্রদেশ কত ভয়ংকর যা উদ্বাস্তু জীবনকে সর্বস্বান্ত করেছিল সেই বীভৎস যন্ত্রণালিপি চিহ্নিত হয়ে চলে। উদ্বাস্তু গুণধরের পরিবারের চূড়ান্ত অসাহয়তা। সংকটের নামাবলি দরিদ্র পরিবারকে কীভাবে গ্রাস করে তা স্পষ্ট। অভাবী মানুষ ভাঙতে ভাঙতে আত্মহত্যা করে। সহ্যের বাঁধ ভাঙে। রুনু জেলে, গুণধরের পা ভেঙেছে, মাধুরী শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। মাধুরীর আত্মহত্যা ছাড়া ভিন্ন পথ থাকে না। জীবনের দীনতা, সংকট, বেঁচেবর্তে থাকার লড়াই কত কঠিন-প্রখর আর তা উদ্বাস্তু বলেই ভয়ংকর তা আখ্যানের পরতে পরতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কৈলাস নাতিনী মাধুরীর মৃত্যু রহস্য খুঁজতে দায়ী করে ইতিহাসকে। দেশভাগের ইতিহাসকে। হিন্দু বিতাড়নের জঘন্য পৈশাচিক ইতিবৃত্তকে। রাজনৈতিক নেতাদের হঠকারিতা ও মূর্খতাকে।

ধর্ম, দেবতাকে সামনে রেখে রসিকতা, ব্যঙ্গ, সত্য উন্মোচন, মানুষের ভিত্তিহীন ধর্মীয় আবেগ ভেঙে দেওয়া স্বপ্নময় চক্রবর্তীর বড় বৈশিষ্ট্য। গদ্যে মৃদু ব্যঙ্গ, শ্লেষ, কবিত্ব ও তীব্র বেগ আখ্যানে একটা ঘূর্ণি সৃষ্টি করে। উদ্বাস্তুরা মুসলিমদের ঘৃণার চোখে দেখে। কিন্তু দেশভাগে বিতাড়িত হিন্দুদের জন্য তো এদেশের মুসলিমরা দায়ী নয়। লেখক সুগভীর সমাজ বীক্ষণের প্রদীপে মানুষকে দেখেন। মানুষের মস্তিষ্কে আলো ফেলে ভিতরের স্বরূপ যেমন বের করে আনেন তেমনি সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা, সুপ্ত সম্প্রীতি যা আলো-অন্ধকার মাখা তা প্রকাশ করেন। ধর্ম-ধর্মচ্যুত, অভাব, ধর্মকে ব্যবহার, ধর্মের কোপে নাজেহাল সব একাকার হয়ে যায়। ব্যক্তি নিজেকে মানবিক করে তুলতে চাইলেও সমাজ-রাজনীতি- পরিস্থিতি ও পরিবেশ যেন ব্যক্তির মনে সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার বীজ রেখে যায়। উদ্বাস্তু মানুষের মনে সেই ক্ষোভ ছিলই। ব্যতিক্রম নয় উদ্বাস্তু পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের বিলুও―‘বিলুর মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে আসছিল রিফিউজি কলোনিতে। আপনারা তাড়িয়ে দিয়েছেন বলে আমার পূর্বপুরুষ নিজের দেশ ছেড়ে… চিন্তাটা মাথায় আসতেই বিলু নিজেকে দমায়। বলে―ছিঃ বিলু, তোর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা রয়ে গেছে চুপি চুপি। তোদের ভূমিচ্যুতির জন্য নুরুদ্দিনের কোনও ভূমিকা নেই। বিলুর ভেতরে থাকা পাজি বিলুটা বলে―ছেচল্লিশের দাঙ্গায় হয়তো এরাই বাপ-জ্যাঠা হাতে চপার নিয়ে―অন্য বিলুটা বলে―এভাবে ভাবিস কেন ? হয়তো এরাই বাপ-জ্যাঠা কোনও বিপন্ন প্রতিবেশীকে ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল…’ (তদেব, পৃ. ২১৫)

 ইতোমধ্যেই জারি হয়ে যায় জরুরি অবস্থা। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়। সাধারণ মানুষের তাহিতাহি রব। রাজনৈতিক দলের পক্ষ-বিপক্ষে দোষারোপ চলে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা ও বিরোধী দলের ক্ষমতাচ্যুত করার কম্পিটিশন চলতে থাকে। ঘোষণা করা হল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পেনশন দেওয়া হবে। কৈলাস স্বদেশি কিন্তু কাগজপত্র নেই। জীবন সায়াহ্নে পেনশন পেলে গালমন্দ একটু কম জোটে। ছায়ারানির নিত্য অবহেলা থেকে কিছুটা বাঁচে। উদ্বাস্তু সংগঠন গড়ে ওঠে। উদ্বাস্তু উপনিবেশ ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। কলোনিতে সবকিছু ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। জবরদখল কলোনি সৃষ্টি হয়। পুনর্বাসন পরিকল্পনা ঠিকঠাক না হলে উদ্বাস্তুরা জবরদখলে এগিয়ে যায়। তবে লড়াই দিতে হয়েছে। বাঁচার তীব্র ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা তাদের প্রতিকূল পরিবেশেও বাঁচতে শিখিয়েছে। পুনর্বাসন, সরকারের ভূমিকা, মেহনতি উদ্বাস্তুদের শেষ অবলম্বন, দখল, জমি কেনা, সব মিলিয়ে সেই সময়কে বড় পরিসরে ধরার প্রয়াস এই আখ্যান।

উদ্বাস্তুদের সামনে রেখে রীতিমত আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা উদ্বাস্তুদের ব্যবহার করতে চায়। দাবি আদায়ের ভিত্তিতে নিজেদের সংগঠনের ভিত মজবুত করে। চলতে থাকে লড়াই। নাগরিকত্বসহ সমস্ত সুযোগ সুবিধা আদায়ের লড়াই। মিটিং, মিছিল। পঞ্চাশে আসা রিফিউজি ও একাত্তরে আসা রিফিউজিদের মধ্যে চলে ঠাণ্ডা লড়াই। চলে ঈর্ষা। নিজেকে প্রাচীন অধিবাসী ভাবার ঔদ্ধত্য। ধীরে ধীরে প্রাচীন মানুষগুলো বিদায় নিতে থাকে। অম্বিকা চক্রবর্তী গত হয়েছে। সেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের স্বীকার। নব্য প্রজন্মের উদ্বাস্তুরা সংগঠনে এগিয়ে আসে। নব্য উপনিবেশের ভূত-ভবিষ্যৎ, উপনিবেশ গড়া, পথ চলা, সংগ্রাম, লাঞ্ছনা সব চিহ্নিত হতে থাকে। স্বদেশি কৈলাসের উত্তরপ্রজন্ম রুনু দেশদ্রোহী হয়ে গেছে সময় পরিস্থিতির চাপে। কৈলাসের বয়ানের মধ্যে যে রাজনৈতিক পরিসর আছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাস্যরসে জারিত করে, কথ্য ভাষায় মুড়িয়ে আপাত লঘু ঢঙে দেশের রাজনৈতিক অপদার্থতা প্রকাশ পেয়ে যায়। তেমনি রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি উদ্বাস্তুদের ক্ষোভ কোথায় তা ব্যক্ত হয়। সে পরিসর স্বপ্নময় চক্রবর্তীর নিজস্ব লিখন শৈলীর ক্যানভাস। আপাতলঘু ঢঙে ব্যঙ্গরসে ও মিছরির ছুঁড়ি ব্যবহার করে এমনভাবে বয়ান গড়ে তোলেন যা কাউকে আঘাত না করেও প্রকৃত সত্য জানান দিয়ে যায়।

বিলুর দিদি স্বপ্নার আবার বিবাহ দেওয়া হয় নিতাইদের সঙ্গে। ধর্মের কারণে দেশভাগ। ধর্মরক্ষা করতে দেশত্যাগ। সেই ধর্ম পিছু ছাড়েনি কিছুতেই। কিছু কিছু মানুষ এগিয়ে এলেও কিছু লোকাচার সংস্কার বিসর্জন দিলেও পুরোপুরি ধর্মহীন হয়ে উঠতে পারেনি। তা সম্ভব নয় সামাজিক পরিমণ্ডলে। ফলে ধর্ম থেকেই যায়। অনঙ্গমোহনের পারিবারিক নারায়ণ শিলা আবার গৃহে ফিরে আসে। যা বহন করে চলছিল জ্ঞাতিরা। উত্তরপ্রজন্মের বিলুরা ধর্মকে তেমন বিশ্বাস না করলেও পারিবারিক দায়িত্ব ও ঐতিহ্যের কারণে নারায়ণ শিলাকে মেনে নেয়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় কমিউনিস্টদের উত্থান হতে থাকে। নানা সংগ্রাম, মানুষের পাশে থাকার মধ্য দিয়ে কমিউনিস্টরা সমর্থন পায়। কৈলাসের নামে সরকারি পেনশন চালু হয়। সে ততদিনে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। গুণধরের স্ত্রী ছায়ারানি স্বভাবতই খুশি। অভাবী পরিবারের সুখের বার্তা, অর্থের সংস্থান এলে মুখে খুশির জোয়ার আসে। যে ছায়ারানি এতদিন কৈলাসকে ধিক্কার দিত, কটু কথা বলত আজ স্বদেশি পেনশনের বার্তা শুনে স্বদেশপ্রেমের জোয়ারে ভেসে গেছে। পারিবারিক ঐতিহ্যে গর্বিত হয়েছে।

গত শতকের সাতের দশক যেমন পরিবর্তনের দশক, মুক্তির দশক তেমনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দশক। বামেরা অশ্লীলতা-অপসংস্কৃতি বিরোধী আন্দোলনে নেমেছে। হাংরি আন্দোলনের কথা আমরা জানি। নিতাইকে গ্রেফতার করেছে অশ্লীল পত্রিকা ছাপার অভিযোগে। সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতি-শ্লীল-অশ্লীল সব মিলিয়ে যুগ পরিবর্তনের সমূহদিক চিহ্নিত হয়ে চলে। সেসময় সাহিত্যেও বিরাট পরিবর্তন আসে। প্রথাগত, ধরাবাঁধা গণ্ডিবদ্ধ সাহিত্যকে উড়িয়ে দিয়ে যৌনতার খুল্লামখুল্লা প্রকাশ। আপাত দৃষ্টিতে অশ্লীল বলে মামলা মোকদ্দমা হলেও শেষপর্যন্ত কিছু হয়নি। এই ঘূর্ণিচক্রে বিলু বড় হয়ে ওঠে। পরে দেখা যাবে সে সম্পূর্ণ মানবিক ও যথার্থ মনুষ্যত্বের অধিকারী হয়ে উঠেছে। বলা ভালো স্বপ্নময় চক্রবর্তীর জীবনচিন্তার আদর্শস্থানীয় চরিত্র বিলু। সে মরিচঝাঁপির বীভৎসতা উপলব্ধি করে। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুরা যখন একটা স্থায়ী আশ্রয়ভূমি পেয়েছে তখন মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের পুনরায় স্থানচ্যুত ও উদ্বাস্তু করার প্রবণতা, অত্যাচার চলছে। মরিচঝাঁপির মানুষেরা ভেবেছিল সুন্দরবনে হয়ত বাসস্থান মিলবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত মেলেনি। ফলে মরিচঝাঁপিতেই নব্য উপনিবেশ গড়ে তোলে। নতুন করে লড়াই শুরু হয়―

‘আমাদিগেরে খেলার বল পেইচে স্বাধীন দেশ ? ওপার থিকে লাথাইল, এপারে আলাম, ক্যাম্পে ঢুকল। আবার লাথাইল, দণ্ডকারণ্য গেলাম, থাকতি পারলাম না সিখানে, মরিচঝাঁপি আলাম। আবার লাথাইল, কী করব, এই কলুনিতে এসি পড়লাম, আবার যদি লাথাও, কনে যাব ? কিন্তু লাথি খাব বলি পিঠ পেতি আছি। কোথাও তো যাতি হবে। অন্যের সোম্সারে কত দিন থাকা যেতি পারে ? সবারই অভাবের সোম্সার…।’ (তদেব, পৃ. ২৬৬)

উদ্বাস্তু সংগঠন, উদ্বাস্তুদের সামনে রেখে রাজনীতির নতুন প্রণালি, কমিউনিস্টদের জয়ী হওয়া সব মিলিয়ে সে সময়ের মূল্যবান ডকুমেন্ট যেমন গড়ে তোলেন তেমনি হৃদয়গ্রাহী কাহিনি বর্ণনায় মানুষের সমস্যা ও সংকটের কথা লিপিবদ্ধ হয়ে চলে। যোগেন মণ্ডলের নেতৃত্বে নমঃশূদ্ররা দেশভাগের পরও ওপারে ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর আর থাকা সম্ভব হল না। সেদিন মুসলিমরা নমঃশূদ্রেদের আপন ভাবলেও আজ বিধর্মী ভেবেছে। ফলে চলল বিসর্জন। এবার দণ্ডকারণ্যে অবস্থান। কৈলাস দেবনাথ বিদায় নিয়েছে। উদ্বাস্তুদের প্রথম প্রজন্মের সকলেই বিদায় নিলে একটা পর্যায় শেষ হয়ে এসেছে। নবীন প্রজন্মের আবার লড়াই শুরু হয়। দ্রুত সময় বদলে যাচ্ছে। পুরাতন সমাজ পুরাতন কাঠামো নিয়ে বিদায় নিচ্ছে। প্রথম আসা উদ্বাস্তুদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন সময় পর্ব শুরু হচ্ছে। উদ্বাস্তু পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মরা দিন বদলের রহস্য উপলব্ধি করছে। প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন বাজার, বন্ধ কারখানা, নতুন রুচিবোধ নিয়ে নতুন কালের সূচনা হয়ে যাচ্ছে। কলোনিতে অনঙ্গমোহন ও কৈলাস দেবনাথের মূর্তি স্থাপন করা হয়। বাংলায় গত শতকের সাতের দশকে মূর্তিভাঙা হয়েছিল। এখন মূর্তির গায়ে পোস্টার, পানের পিক। সমাজ ব্যবস্থার কুৎসিত অথচ অনিবার্য চিত্র অকপটভাবে প্রকাশ করে দেন। রুনু কানুনগোর চাকুরি নিয়ে কলকাতার বাইরে চলে যায়। দেশদ্রোহী থেকে সরকারি চাকুরি। স্বভাবতই অন্তর্দ্বন্দ্ব চলে। রাষ্ট্রবিরোধী থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের নাটবল্টু। পুঁজিবাদের চিত্র এমন যা প্রতিবাদীকেও বাঁচতে দেয় না। স্বর, বহুস্বরের বহুমুখী বিন্যাসে আখ্যানে এমন এক বলয় নির্মিত হয় যা সময়-রাজনীতি ও মানুষের ত্রিমুখী সংকটকে স্পষ্ট করে।

কৈলাস দেবনাথের মহাকাব্যের নাম ছিল ‘ছিন্নমূল’। যা দ্বৈত অর্থ বহন করে চলে। ছায়ারানি সেই খাতা বিক্রি করে দিয়েছিল। অনঙ্গমোহন তা উদ্ধার করে এনেছিল। বিলু বহুবছর পর তা পেয়েছে। কিন্তু সব যেন এলোমেলো। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। ছিন্নমূল মানুষের মতো খাতাও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিলু চাকুরি পেয়ে বাড়ি করেছে। বাংলাদেশে সেমিনার সূত্রে গিয়ে পূর্বপুরুষের শিকড় খুঁজতে চেয়েছে। এই পর্যায়ে এসে আখ্যানের মোড় লেখক ঘুরিয়ে দেন। পূর্বে আখ্যান ছিল উদ্বাস্তুকেন্দ্রিক। সেই সঙ্গে ধর্ম ও রাজনীতির সমীকরণ। এই পর্যায়ে এসে ধর্মের তলদেশে প্রবেশ ও ধর্মের মানবিকতা ও মুক্তির চিত্র। সমাজ বদলের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুর বিবর্তনে ধর্মেরও অগ্রসরমানতা প্রয়োজন। নইলে যথার্থ ধর্ম তার ভিত্তি হারিয়ে ফেলবে। হিন্দু বিতাড়ন প্রসঙ্গ টেনে আনেন হজরত মহম্মদের মক্কা গমনকে। ধর্মীয় মিথের সঙ্গে দেশভাগ মিশিয়ে দেন। আন্তর্জাতিকতা, সেকুলারিজম, সংখ্যালঘু নানা বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে উপমাহাদেশের মূল সমস্যায় দৃষ্টিপাত ও মুক্তির পথ আবিষ্কার করে চলেন।

দাঙ্গায় শুধু হিন্দু ওপার থেকে এপারে আসেনি। এপারের মুসলিমও ওপারে গিয়েছিল। তবে সংখ্যাটা কম। সংখ্যালঘু মানুষ সর্বদা জঘন্য রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতায় ভুক্তভোগী। উজমা আনসারির বয়ান সেই সত্য জানান দিয়ে যায়। তাঁর পিতা বিহার থেকে ঢাকা, কিছুদিন পরে পাকিস্তানে চলে যায়। যেতে বাধ্য হয়। হিন্দু-মুসলমান সকলেই সাম্প্রদায়িক। সুযোগ পেলে সকলেই সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচার করে। উজমার মধ্য দিয়ে লেখক নানাভাবে সংখ্যালঘু নিপীড়নের নামাবলি স্পষ্ট করেন। দেশভাগে হিন্দু-মুসলিম বিতাড়নের গতি-প্রকৃতি কিন্তু ভিন্ন। হিন্দু অত্যাচারে, মুসলিম স্বেচ্ছায়। হিন্দু আতঙ্কে, মুসলিম সামান্য ভয়ে। হিন্দু দেশছাড়া, মুসলিম নিজস্ব ধর্মীয় রাষ্ট্রে গমন। হিন্দুর স্বভূমি বিসর্জন, মুসলিমের স্বভূমি সন্ধান। কিন্তু এই মুসলিমদের ভাগ্যে ছাই পড়ল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মুসলিমরা উদ্বাস্তু বিহারী মুসলিমদের আর আপন ভাবল না। ফলে বিহারী মুসলিমদের উদ্বাস্তু হয়ে পাকিস্তানে গমন চলল।

উদ্বাস্তু উপনিবেশে নিজস্ব সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে পরিবর্তিত সংস্কৃতি গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সংস্কৃতি একটা চলমান প্রক্রিয়া। মানুষ তার অংশ হিসেবে তা আয়ত্ত করে চলে। সেই কালচারাল মুভমেন্টকে লেখক বড় পরিসরে ধরেন। সেই আয়ত্তকরণে মাঝে মাঝে ভেসে আসে ব্যঙ্গ। তেমনি প্রচলিত সমাজ বিন্যাসকে প্রায়ই ভেঙে ফেলেন। প্রচলিত সত্যের মুখে ঘা দিয়ে প্রকৃত সত্যের জ্বালামুখ আবিষ্কার করেন। আখ্যানের সূচনা কোথায় আর তা গমন করছে কোথায় তা ভাবতে বসলে পাঠক হিসেবে বিস্মিত হতে হয়। উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতা, টিকে থাকা, সংখ্যালঘু মানুষের মনের বাসনা, এদেশের মুসলিমদের অভিপ্রায়, অত্যাচার সব যুক্তি পরম্পরায় উপস্থাপিত হয়। ঘটনার পরতে পরতে বিশ্লেষণ ও আবহমানকাল ধরে চলে আসা বাস্তবকে ছিন্নভিন্ন করে প্রকৃত রহস্য ও জীবনযাত্রার গতিপ্রকৃতি নির্দেশ করেন। গভীর বিশ্লেষণ, সমাজতাত্ত্বিক ভাষ্য, জনজীবনের গভীরে প্রবেশ করে অকথিত সত্য ও প্রচলিত বাস্তবকে দূরে রেখে প্রকৃত বাস্তব এবং তা যুক্তিযুক্ত করে তোলার বয়ান যা আখ্যানকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।

কংগ্রেসসহ মুসলিম লিগের জন্ম, কার্যকলাপ, লিগের বেরিয়ে আসা, স্বতন্ত্র দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা, ধর্মকে সঙ্গী ও দাবিসহ বহুবিধ সত্য লেখক ইতিহাসের দরজা উদ্ঘাটন করে পাঠককে প্রকৃত সত্য দেখান। কংগ্রেসের ভুল কোথায়, ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিকে গুরুত্ব দিলে পরিণাম অন্য হলেও হতে পারত। কংগ্রেসের ক্ষমতা দখল, নিজেকে টিকিয়ে রাখা, যায় পরিণাম দেশভাগ। লেখক বিন্দু বিন্দু সত্যকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঘটে যাওয়া সত্যের পাশে ভিন্ন ঘটতে পারা সত্যের চিত্র এঁকে চলেন। মৌলানা আজাদ, ফজলুল হক, আবদুল গফফর খানকে অতিক্রম করে জিন্না প্রধান হয়ে ওঠে। কেউই জিন্নার ভ্রান্ত ধারণাকে রোধ করতে পারেনি। এমনকি পৃথক বাংলা প্রদেশেরও চিন্তা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রসভায় তা টেকেনি। বাংলাভাগ হয়েই গেল। মানচিত্রে রক্তের তরবারি খেলা শুরু করল। বিনাশ বিসর্জন ঘটে গেল। বিলু শিকড় সন্ধানে গিয়ে নোয়াখালি দাঙ্গার রহস্য, হিন্দু-মুসলিমের যৌথ জীবন, সংঘর্ষ উপলব্ধি করে। সমস্ত হিন্দু নামগুলো বদলে মুসলিম করা হয়েছে। কমলা দিঘি থেকে কামাল দিঘি, লক্ষ্মীপুর থেকে লখিমপুর। বহু মানুষ পাকিস্তান ভেঙে যাক তা চাননি। আবার রাজাকারদের অত্যাচারের সমর্থকও ছিল না। তারা চেয়েছিলেন সকলের মিলিত অবস্থান। একটা দেশের এত ভাঙন অনেকেই ভালো মনে গ্রহণ করেনি।

উদ্বাস্তু, দাঙা প্রতিরোধ যে করা যেত না তা নয়। কিন্তু দেশত্যাগে একটা ট্রমা হয়ে যায়। কে আর অত্যাচারিত হতে চায়। কে আর প্রতিরোধ করে স্বদেশভূমি টিকিয়ে রাখতে চায়। ধর্ম ভয় তো ছিলই। কেউ কেউ আসেনি। অনঙ্গমোহনের এক জ্ঞাতি ননীগোপাল ভট্টাচার্য থেকে গিয়েছিল। বিলু পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি সন্ধানে গিয়ে দেখে তা টুকরো টুকরো হয়ে বারবার মালিকানা বদলের মধ্য দিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। দাঙার সময়ে ধর্মান্তর ঘটেছিল। জীবন বাঁচাতে বহু হিন্দু মুসলমান হয়েছিল। কিন্তু পদবি পরিবর্তন ঘটেনি। সেই ঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্ম বহন করে চলেছে। হাবিবুর রহমান পণ্ডিত, মুস্তাক আহমেদ ঠাকুর নামগুলো সেই সত্য জানান দিয়ে যায়। আখ্যানের বড় গুণ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ। লেখক নিগূঢ়ভাবে জীবনের অতল প্রদেশে নিয়ে গিয়ে যাপনের স্বরূপ আবিষ্কার করেন। ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্মকে সামনে রেখে বহির্বাস্তব অপেক্ষা অন্তর্বাস্তব উন্মোচনে বেশি তৎপর। ঘটনার পরতে পরতে সত্যকে জানার প্রয়াস। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রেক্ষাপটে, ক্ষুদ্র বৃত্ত থেকে বৃহৎ বৃত্তে গিয়ে সমস্ত এলোমেলো করে, তথ্য-তত্ত্বে জীবন-বীক্ষায় ইতিহাসের প্রগাঢ় সত্য উদ্ঘাটনের সুগভীর প্রয়াস। একদিকে ইতিহাসের ধারাবাহিক সত্য উদ্ঘাটন অন্যদিকে সমাজ জীবনের অতল প্রদেশ থেকে মানুষের জীবন-ভাবনা ও অভিপ্রায়ের নানা রোজনামচা আখ্যান স্বতন্ত্র করে তোলে।

জিন্না কীভাবে ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে কুচক্রান্তের গুটি সাজিয়েছিল তা লতিফ সাহেবের বয়ানে স্পষ্ট। মনজুরুলের ভ্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশ ক্রমেই গণতন্ত্র, সংবিধান, রাষ্ট্র বিসর্জন দিয়ে ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে যা ভবিষ্যতে সমূহবিপদের সম্ভাবনা সেই সত্য বড় হয়ে ওঠে। লেখকের বিশ্লেষণে বাংলাদেশের ধর্মীয় প্রবণতা ও সমস্যা ধরা দেয়। তবে আশা আছে। মনজরুলরা নব বাংলাদেশ গড়ার ইচ্ছায় অপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তেমনি গভীর মনস্তত্ত্বের সাহায্যে ব্যক্তিমানুষের ভিতরের রহস্য বের করেন। বিলু চায় বিধ্বংসী ঝড় বাংলাদেশে না গিয়ে অন্ধ-ওড়িশায় আছড়ে পড়ুক। একি দেশদ্রোহীতা ? না পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির প্রতি টান ? লেখকের বয়ানে পাই―‘এরকম ইচ্ছে হওয়া কি উচিত ছিল ? নিজেকেই প্রশ্ন করে। দেশদ্রোহী কোথাকার! পিতৃপুরুষের দেশের জন্য ব্যথা ? তা নিজের দেশের বিনিময়ে। ঠিক কিন্তু কেন ইচ্ছেটা জন্ম নেয় ? এই প্রেম কি জিনবাহিত ? ইলিশ মাছেরা মাতৃ-অনুক্রমে একই নদীতে ঢোকে ডিম পাড়তে। মাতৃনদীতেই সন্তানেরা যায়। রিডলে কচ্ছপেরাও। কোকিলেরা, সাইবেরিয়ার সারসেরা, বোধহয় সমস্ত যাযাবর প্রাণীরাও।’ (তদেব, পৃ. ৩৪৫)

ঈশ্বর-শয়তান-অসুর, শুভ-অশুভবোধ, বিশ্বাস-ভ্রান্ত বিশ্বাস, মানুষের মেনে চলা প্রথা, তার উৎপত্তি ও কেন চলে আসছে তা সম্পর্কে যে নৃতাত্ত্বিক পাঠ আখ্যানে ভেসে আসে তা বিশিষ্টতার দাবি করে। কলকাতা-ত্রিপুরা- বাংলাদেশ-পাকিস্তানের চৌহদ্দিকে সামনে রেখে বিস্তৃত পরিসরে তা বর্ণিত হয়ে চলে। বহু উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরা গিয়েছিল। সেখানে সরকারি চাকরিও পেয়েছিল। কিছুদিন পর থেকেই উপজাতিদের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। উপজাতিরা বাঙালিদের রাষ্ট্রের অংশ ভেবে বিদ্রোহ শুরু করে। উপমহাদেশের একাধিক সমস্যাকে চিহ্নিত করার প্রয়াস এই আখ্যান। ধর্ম, অভাব, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, শ্রেণি, রাজনীতি ও জনবিন্যাস। কেন লড়াই, কেন ছিনিয়ে নেওয়া, কেন বিভেদ ও ভাগ সমস্ত দেখা গভীর জীবনবোধ দ্বারা। কাহিনির সমান্তরাল স্রোতে সমস্যার বহুবিধ বিন্দু রেখে জীবনকে উপলব্ধি করা।

এই কালবেলায় ধর্মীয় উন্মাদনার পাকচক্রে ‘জলের উপর পানি’ এক মানবিক আখ্যান। ধর্মীয় মিথের দরজা উন্মোচন করে তিনি বারবার অখণ্ড সংস্কৃতির সন্ধান করেছেন। হিন্দু-মুসলিমের প্রচলিত বিভেদ মুছে দিয়ে ঐতিহ্যের সিঁড়ি দিয়ে অতীতকে তুলে এনে দেখিয়েছেন পথ একটাই। এই কালবেলায় এমন আখ্যান যত লেখা হবে ততই সমাজের মঙ্গল। তবে সামাজিকতা বলে কিছু থেকেই যায়। যা পালন খারাপ নয়। আদবানিজি লোক ইতিহাসের গভীর থেকে কাহিনি তুলে এনে দেখান জাতি রূপান্তরের ইতিহাস। শুধু তাই নয় মহান শিল্প বীণা যেন বাজিয়ে যান। ধর্মের সংগতি-অংসগতি, প্রয়োগ, মানা-না মানাসহ বহুবিধ তাৎপর্যময় বয়ান এনে মানুষকে সভ্য করার নব প্রয়াস এই আখ্যান। বহুযুগ আগে লেখা ঈশ্বরের বাণী বা ধর্মীয় বয়ান আজকের পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোয় ভিত্তিহীন তা জানান দেয় বিলু। বহুবিধ দৃষ্টান্ত, ধর্মের মোহ, ধর্মীয় গুরুর চোখরাঙানি, ভিত্তিহীনভাবে তা মানা আজকের দিনে অর্থহীন তা বিলু-উজমার আলোচনায় উঠে আসে। তবে তা ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করে না। তারা ধর্মের ভালো-মন্দ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে। মন্দ দিকগুলো আক্রমণ করে। ধর্মীয় ভাবাবেগ-ধর্মমোহ থেকে কীভাবে মানব সমাজকে এগিয়ে আনা যায় তার চেষ্টা করে। তবে ধর্ম মানেই খারাপ তা কিন্তু নয়। বিলু ধর্মের উপর চোটে গেলে উজমা মনে করিয়ে দেয়―‘উজমা বলে মানুষের একটা নিজস্ব ধর্ম আছে, যেমন পানির ধর্ম আছে, অক্সিজেনের, মার্কারির…। সেটা একসঙ্গে বেঁচে থাকার ধর্ম। কিন্তু স্বার্থবুদ্ধি বিধর্মী করে। ধার্মিক হওয়াটা খারাপ কিছু না। আদবানিজিও তো ধার্মিক। কিন্তু দেখুন কেমন তিনি মানবধর্মে বিশ্বাসী। নবিরা, অবতাররা সেটাই মনে করিয়ে দিয়েছেন, বারবার। প্রথাগত ধর্মগুলো মানুষকে লোভ দেখিয়ে কিংবা ভয় দেখিয়ে ভালো কাম করতে বলেছে আর খারাপ কাম করতে নিষেধ করেছে।’ (তদেব, পৃ. ৩৯১)

ধর্মীয় বিভেদের পাকচক্রকে ভেঙে দিয়ে মহান মিলনের কথা বলে এই আখ্যান। যা যুগ যুগ ধরে বলা হয়ে আসছে অথচ সাম্প্রদায়িক মিলন ঘটেনি তাই যেন ঘটিয়ে দিয়ে গেল হিন্দু বিলু ও মুসলিম উজমা। এই আলো পৃথিবীতে মানবতাই যে শেষ সত্য সেই সত্যকে আরও বড় করে প্রতিষ্ঠা করে যায়। নিয়মের যেমন পরিবর্তন, সংশোধন হয়, তেমনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সামাজিক নিয়মের সংশোধন জরুরি। সময়ের চলমানতায় বিবর্তনশীল সমাজ পরিসরে ধর্মীয় নিয়মের সংশোধন, গ্রহণ-বর্জন জরুরি। আর তা সম্ভব হলেই মানব সমাজ এগিয়ে যাবে। বিজ্ঞানের মতো ধর্মও একটা চলমান প্রক্রিয়া। তার সংশোধন, গ্রহণ-বর্জন করতে না পারলে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। কাহিনির মধ্য দিয়ে মানবতন্ত্র ও মানবিক জীবনচেতনার যে পাঠ আবিষ্কার করেন তা বাংলা আখ্যানের অন্যতম দিক বলে দাবি করা যেতে পারে।

বিলু-উজমার যখন বিবাহ হচ্ছে তখন বাবরি মসজিদ বিবাদ চরমে ওঠে। রাজনৈতিক নেতাদের কর্মতৎপরতা, ভোটের জন্য মানুষকে খুশি করার প্রবণতা, ধর্মীয় উস্কানিকে সামনে রেখে নব গঠিত দলের লড়াই চালিয়ে যাবার প্রয়াস, সবমিলিয়ে জটিল সমস্যাকে ধরার চেষ্টা। একদিকে ব্যক্তি (বিলু, উজমা) ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে নব্য মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর অন্যদিকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি ধর্মকে ইন্ধন জোগাচ্ছে। এইভাবে ব্যক্তির সমস্ত সদইচ্ছা, কর্মপ্রবণতা ব্যর্থ হয়ে যায়। একদিকে বিলু-উজমার সুখের দাম্পত্য জীবন, অন্যদিকে রাম মন্দির গড়ে তোলার ঝড়ঝাপটাকে সামনে রেখে সমকালীন ভারতের এক বীভৎস ঘটনার সাক্ষী রেখে যান। হিন্দুত্ববাদকে নিয়ে চারিদিকে উত্তাল ঢেউ। ঘরে দুজন যথার্থ ধর্ম নিয়ে আলোচনা করে। মিথ, সামাজিকতা, ঐতিহ্য সব মিলিয়ে মানবতা, সহাবস্থান ও সম্প্রীতির সন্ধান করে।

 রাজনীতির নক্কারজনক পরিস্থিতিতে বিলুর সন্তান জন্ম নিতে চলেছে। হিন্দুত্ববাদের প্রবল আগ্রাসন, আধিপত্য, লুণ্ঠনে যখন দেশ উত্তাল তখন একটি শিশু জন্ম নিতে চলেছে হিন্দু-মুসলিমমের যৌথ দাম্পত্য জীবনে―‘উজমা বলে, আসলে তুমি হিন্দু ঘরের ছেলে আর আমি মুসলিম ঘরের মেয়ে। আমাদের সন্তানের নাম ভারত। কোনও পদবি থাকবে না। আমাদের সন্তান হলো আমাদের পুরস্কার। পুরস্কারকে জলপানি বলে। জল আর পানি মিলে গেলে পুরস্কার হয়। আমাদের ভারত জলপানি।’ (তদেব, পৃ. ৪১১)

তবু একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে যায়। মানুষ ইচ্ছা করলেই সম্পূর্ণ ধর্মহীন হতে পারে না। রক্তের মধ্যে কোথায় যেন একটা সংস্কার খেলা করে। বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে দুজন নিজেকে উদার প্রমাণ করতে গিয়ে গর্জে ওঠে। রক্তের সংস্কার যেন নেচে ওঠে। যা অনেকটা কৃত্রিম। তা থেকে ব্যক্তি বেরিয়ে আসতে চাইলেও পারে না। অথবা নিজের সত্তাকে অন্যের কাছে স্পষ্ট করতে পারে না। তবে বিলুদের স্বপ্ন সার্থক হয়নি। রাম মসজিদ স্থাপনকে কেন্দ্র করে রীতিমত দাঙ্গার চিত্র নানাদিকে। সেই উত্তাল পরিস্থিতিতে আহত হয়ে উজমা মৃত সন্তান প্রসব করেছে। আসলে এই বীভৎস পরিস্থিতি নতুন শিশু জন্মের উপযুক্ত নয়। দেশে এক অন্ধত্ব, বন্ধ্যা বিরাজ করছে। তারা মানবতন্ত্র, মানবতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষের জয়গানের নিশান উড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

তবে ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষের জয়ে আখ্যানের সমাপ্তি ঘটেছে। অঞ্জলি প্রচলিত ধর্মকে বিসর্জন দিয়েছে। বিলু-উজমা দত্তক পুত্র নিয়েছে। সেই মানব শিশুর কাছে যেতে পারিবারিক নারায়ণ বিসর্জন দিয়ে চলেছে অঞ্জলি। ধর্ম ও শিশুর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি করতে চাননি। শিশুর কোনও ধর্ম নেই। ধর্মান্ধতা নেই। নতুন শিশু গড়ে উঠবে মুক্ত পরিবেশে, পরিসরে। প্রচলিত ধর্মের জলাঞ্জলি দিয়ে নবশিশুর যথার্থ পরিসর রচনা করতে চেয়েছেন। ব্যক্তি ধর্মসত্তা বিসর্জন দিলেও রাষ্ট্র তো দেয় না। রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজন মোতাবেক ধর্মকে ব্যবহার করে। তাই সেই শিশু কতটা সুরক্ষিত আমরা জানি না। জানি না বলেই এমন আখ্যান রচনা করতে হয় স্বপ্নময় চক্রবর্তীকে।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button