আর্কাইভপ্রবন্ধ

কবি মিনার মনসুরের কবিতা : আবুল কাসেম

প্রবন্ধ

‘কোথায় কবিতা নেই বাঙালি জীবনে’―মিনার মনসুরের একটি মেধাবি প্রবন্ধের শিরোনাম। তিনি দেখেছেন বাঙালি জীবনের সর্বত্র কবিতা আছে, কবিতার উপদান আছে, উপকরণ আছে, ভাবাবেগ আছে, ছন্দ আছে, ছন্দহীন গদ্যের দোলা আছে, প্রতিবাদ আছে, বাদানুবাদ আছে, প্রতিরোধ আছে, দ্রোহ-বিদ্রোহ আছে এবং আছে প্রেম-ভালোবাসাও। কবিতার ক্যানভাসে তিনি ব্যাপারগুলো যুক্ত করেছেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন আপন সত্তার গানে, নানা বিষয় বৈচিত্র্যে। ২০২১ সালে নোবেল পাওয়া ঔপনাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ বলেছিলেন, ‘আমরা সারা জীবন একটি গল্পই বলি।’ মিনার মনসুরও বলেন, ‘একটি কবিতা লিখছি আদিকাল থেকে’ (এ জন্মে হলো না)। এরকম বলার মধ্যে থাকে কবি সত্তার চিরন্তনতাবোধ―যা নানা মাধ্যমে কখনও গীতিময় আবার কখনও গদ্যের পরিণয় লাভ করে। কবিতায় ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ, গল্প-উপন্যাসে আত্মপ্রক্ষেপসিদ্ধ নয় বলে তা আসে পরোক্ষভাবে―যেখানে গুরনার কথা অর্থ পায়। এ দিক থেকে কবিরা আত্মপ্রকাশে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন। বহু বৈচিত্র্যে সর্বত্র আছে তাদের গমনাধিকার।

২.

মিনার মনসুরের আবির্ভাব সত্তর দশকের পটভূমিতে। সে সময়টা ছিল বাঙালির জাতীয় জীবনে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, সামরিক শাসন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী অপশক্তির উত্থান বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে আবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেয়। এ সময়ে কবি মিনার মনসুর দুঃসাহসী তরুণ কবি হিসেবে প্রতিবাদী  ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তরুণ কবি দিলওয়ার চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ সম্পাদনায় বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় শাহাদাত বার্ষিকীতে প্রকাশ করেন ‘এপিটাফ’ (১৯৭৮) এবং বঙ্গবন্ধু স্মারকগ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধু একটি লালগোলাপ’ (১৯৭৯)। দুটি প্রকাশনাই দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৮০ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সম্বলিত ‘আবার যুদ্ধে যাবো’ শিরোনামে একটি সংক্ষুব্ধ বুলেটিন প্রকাশ করেন। ১৯৮৩ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ বাজেয়াপ্ত করে স্বৈরাচারী সরকার।

৩.

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কবির প্রথম দিককার কবিতার ভাবাবেগ তাড়িত হয়েছে দ্রোহ এবং প্রতিবাদে। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সে সময়ের জগদ্দল পাথর চূর্ণ করেছে, ভাবিয়ে তুলেছে স্বৈর-শাসককে, তরুণ প্রজন্ম উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে, বয়োজ্যেষ্ঠরা প্রাণিতবোধ করেছেন।

কবির কবিতায় এই দ্রোহ এবং প্রতিবাদের ধারাটা বরাবরই বহতা পেয়ে আসছে। প্রথম দিকে তাঁর প্রতিবাদের ধরন ছিল বয়সের তারুণ্যে উচ্ছ্বল। ১৯৮০ সালে লেখা কবিতায় তাই স্বচ্ছন্দে বলতে পেরেছেন―এইসব রক্তচক্ষু, নিয়মশৃঙ্খল, সাজানো সভ্যতা, মেকিশালীনতা/ সবকিছু ভরে তুই উদ্দাম মুতে দে/ তোরা সব  উল্লাসে মুতে দে/ তোদের নিষ্পাপ মুতে ধুয়েমুছে শুদ্ধ হোক আগামী পৃথিবী’ (মুতে দে কিশোর)। ক্রমে প্রতিবাদটা মনে হয়েছে যথেষ্ট নয়, ঘটে যাওয়া নানা ঘটনায় নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধের জন্ম হয়েছে, একটা অক্ষমতার বেদনাবোধ প্রতিনিয়ত তাঁকে তাড়া করেছে। তাই তাঁকে বলতে দেখা গেল, ‘বায়ান্নের রাজপথ থেকে সালাম বরকত যদি/রক্তমাখা খামে চিঠি লেখে/―ছেষট্টির সেই উত্তাল সমুদ্র থেকে একজন/একজন গুলিবিদ্ধ মনু মিয়া যদি অকস্মাৎ ফুঁসে ওঠে―/একাত্তরের যোদ্ধারা যদি সিংহের গর্জনে দশদিক প্রকম্পিত করে/তাহাদের চকচকে করোটির খামে পাঠায় চরমপত্র/― পঁচাত্তরের উজ্জ্বল মানুষেরা, মানুষের অধিক সেসব সাহসেরা/নারী-শিশু যুবকেরা যদি/দেয়ালের সুদৃশ্য ঝুলন্ত ফ্রেম থেকে/গভীর নিশিথে চুপচাপ নেমে আসে/―আমি কী জবাব দেব (কী জবাব দেব)।

‘আমি প্রতিরোধের কথা বলতে চাই’ কবিতায় ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট। প্রতিবাদই যেন শেস কথা নয়, প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। দীর্ঘ কবিতাটিতে একটি বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় রয়েছে, যিনি ‘আমিত্ব’ বোধের মধ্যে নিজেকে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চান। এখানে তাঁর কণ্ঠস্বর যেমন বলিষ্ঠ তেমনি তাঁর দাবিগুলো সাংবিধানিক অধিকার দ্বারা স্বীকৃত বলে সর্বজনীন দাবি-দাওয়ায় পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বড়কথা এসব দাবি পূরণের অঙ্গীকার নিয়েই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনায় অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্নের সমাজতন্ত্রে ছিল কৃষকের ভূমিতে অধিকার, ফসলের সুষম বণ্টন, মিলগুলোতে, শ্রমিকের মালিকানা, শ্রমের মর্যাদা এবং উৎপাদিত পণ্যে স্বীকৃত অধিকার নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি। এসব বক্তব্যই কবিতায় এসেছে। কবি আরও বলেছেন, ‘আমি সমস্ত শোষণের মূল উৎপাটন চাই/চাই মূলকথা এটাই। ভাবতে অবাক লাগে তরুণ বয়সেই কবি সমাজতন্ত্রের উচ্চতর দর্শন রপ্ত করে কবিতার ভাবকল্পে নিয়ে এসেছেন। দর্শনটা ছিল বঙ্গবন্ধুর ‘দেশজ উন্নয়ন দর্শন’।

কবির  ‘আমি কী আর মানুষ আছি’ কবিতাটি পাঠ করে জাপানি ঔপন্যাসিক ইউকিয়ো মিশিমার বিশ^বিখ্যাত উপন্যাস ‘কান কাকুজি’ বা ‘দ্য টেম্পল অব দ্য গোল্ডেন প্যাভেলিয়ন’-এর কথা মনে এসে গেল। উপন্যাসটি বাস্তব ঘটনা নিয়ে লেখা। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বৌদ্ধভিক্ষু মিজোগুচি। তিনি ছিলেন স্বর্ণনির্মিত বৌদ্ধ প্যাগোটাটির সহকারী পুরোহিত। কুৎসিত চেহারার এ পুরোহিত ব্যক্তিজীবনে অসুখী ছিলেন। তার মা দ্বিচারিণী ছিলেন। সব মিলিয়ে সৌন্দর্যের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন মিজোগুচি। একদিন দৃষ্টিনন্দন স্বর্ণ মন্দিরটিতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। প্রিয় মন্দিরটি পুড়িয়ে দিয়ে তিনি ঐ আগুনে একটি সিগারেট ধরিয়ে তাতে সুখটান দিয়ে ওপরের দিকে কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়া ছেড়ে এমন একটা ভাব করেন যেন এই মাত্র একটি মহৎ কাজ সম্পন্ন করে অতিশয় কৃতার্থবোধ করছেন।

               মিনার মনসুরের কবিতাটিতে এরকম ক্ষোভের প্রকাশ আছে। আমাদের সকলের কাছে জ্ঞান মন্দির সম আনিস স্যারের প্রতি তিনি যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তা কীন কাকুজি স্বর্ণমন্দির পুড়িয়ে দেয়ার মতো কাজ মনে হতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘সুসাহিত্যিক আনিস সাহেব―আপনি তো স্যার/সবার প্রিয় গুরুর মতো দেশ বিদেশ স্বনামখ্যাত/সৌম্য এক ঋষির মতো ভরাট কণ্ঠ দরাজ হাসি/তার ওপরে গেরুয়া রঙ পাঞ্জাবিটির পকেট ভর্তি/পদক বোঝাই; আপনি যখন দেবযানী আর/শকুন্তলার জটিলতর ব্যাপার স্যাপার অনায়াসে/ যেতেন বলে আমরা তখন অমৃতের সে সব গিলে/অমরত্ব পেয়ে গেছি এই ভাবনায় আত্মহারা দিব্যচোখে/ দেখতে পেতাম আগের জন্মে আপনি ছিলেন বিদ্যাসাগর/মনে যদি না নেন কিছু জানতে ভীষণ ইচ্ছে করে। বৌ-বাচ্চা আর মটরগাড়ি এসব নিয়ে বেশ তো আছেন/ কিন্তু ওরা কেমন আছে? গরুর মতো বাধ্যগত/আপনাদের ঐ সনদ পাওয়া ছাত্রগুলি, জানেন কিছু। তাই বলে আনিস স্যারের প্রতি অশ্রদ্ধা আছে তা বলা যাবে না। ‘কষ্টের সময় আপনজনকেই আঘাত করে। কবিতাটিতে পিতা, আমছিপারার ওস্তাদ, হাইস্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর সকল শিক্ষকের প্রতিই ক্ষোভের প্রকাশ আছে। ক্ষোভটা বোঝা যায় শেষের কয়টি পঙ্ক্তিতে, ‘মানুষ নামের মিথ্যে সনদ/ আমরা কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে/ আপনারা সব গেলেন কোথায়?’

ক্ষোভ, প্রতিবাদ, দ্রোহ প্রথম দিকের কবিতায় খোলামেলা হলেও পরিণত বয়সের কবিতায় বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপক্কতার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রকাশ ঘটেছে ‘প্রতর্ক ছাড়িয়ে প্রমিতিতে।’ ‘মুখোশে গিয়েছে ঢেকে স্বদেশের মুখ’ ‘এ তো পুতুলের খেলা’ ‘মুখোশের এই খেলা তুমি থামাতে পারবে না’ প্রভৃতি পদ্য এবং গদ্য কবিতায় ক্রমন্বয়ে গভীর হয়েছে চিন্তা ও মননের বাকপ্রতিমা, যেমন, ‘ওই যে আরেকজন নাগা সন্ন্যাসীর মতো এক পায়ে আছেন দাঁড়িয়ে/ যেন বা অনন্তকাল সমাধিস্থ তিনি মাছেরাই শুধু জানে/তার অন্য প্রতিভার খোঁজ।’ অথবা ‘তোমরা অযথা ক্রদ্ধ হও, নিদ্রাকে রক্তাক্ত করো/ থুথু দাও আকাশের দিকে। প্রবীণ আকাশ হাসে/তার অভিজ্ঞাতা ঢের বেশি―বয়োবৃদ্ধ অবোধ শিশুরা সব/ পেতেছে সংসার বালুচরে (এ তো পুতুলের খেলা)। ’

সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র অঙ্কনে মিনার মনসুরের প্রজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। ‘কোথাও আছে নবজাতকের মতো অনিন্দ্য সুন্দর আলো’ এবং ‘ভালোবাসা আর যন্ত্রণাকে তুমি আলাদা করতে পার না’―দুটি কবিতায়। একটি গদ্য কবিতা, অন্যটি অনুপ্রাসহীন পদ্য, চিত্রটা প্রায় একই রকম, বক্তব্যও একই।’ চিত্রটা এরকম; মা মৃত্যু শয্যায়, কিশোরী কন্যা বিবস্ত্র পড়ে আছে কলেজ পড়ুয়া ছেলে ‘শেয়াল তাড়াতে গিয়ে নিজেই মরে পড়ে আছে শেয়াল-কুকুরের মত।’ দেশপ্রেমিক সিভিল সমাজ সমাজের ভাবমূর্তি রক্ষাকারীগণ যুক্ত হয়েছেন। তাদের লক্ষ্য নিরীহ কবি। তার ভাগ্যেই নেমে এল বুটের লাথি, রাইফেলের বাটের রক্তাক্ত আঘাত। অপরাধীদের বাঁচিয়ে দিয়ে এভাবেই সমাজের ভাবমূর্তি রক্ষা করছেন এরা। কবি অবাক হয়ে বলেন, ‘এমন অদ্ভুত কথা আজও কেউ বলে: এরা। টানেলের শেষ আছে এবং কোথাও আছে নবজাতকের মতো অনিন্দ্য সুন্দর আলো।’

পরের কবিতাটি দুর্ধর্ষ সিনেমার গল্পের মতো, ‘ওরা তোমাকে পিষ্ট করে চলে যাবে/ কেউ ফিরেও তাকাবে না। ওরা তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে/না মধ্যরাতে নয়, প্রকাশ্য দিবালোকে/ হাতুড়ি দিয়ে গুঁড়ো করে দেবে হাত পা―লবণ ছিটিয়ে দেবে/বহুতল ভবনের ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে দেবে নিচে/ কিংবা বস্তাবন্দি করে ভাসিয়ে দেবে শীতলক্ষায়/―স্বজনের হাতে তুলে দেবে লক্ষটাকার চেক/ আর স্বচিত্র শোকবার্তা পাঠাবে পত্রিকায়/জনসমক্ষে তোমার কিশোরী কন্যাটিকে ওরা ধর্ষণ করবে/অ্যাসিডে ঝলসে দেবে তার ছোট্ট কোমল দেহ/এবং বীভৎসতা ছড়িয়ে দেবে ইন্টারনেটে/ অতঃপর গোরিলার মতো সগর্বে বুক চাপড়াবে/ জান্তবপদভারে প্রকম্পিত করবে চারদিক/তবু জন্মান্ধ রাষ্ট্র কখনওই ওদের পাবে না খুঁজে/শুধু তোমার হৃদয়কে খুঁচিয়ে যাবে নিরন্তর।’ এখানেই কবিতাটি শেষ হতে পারতো, হয়নি কারণ ভাগ্যদেবতার কাছে আরও কিছু পেতে বাকি আছে। কবি লিখলেন, ‘আততায়ী ওত পেতে আছে প্রাসাদে তোমার/ তবুও তোমাকে ফিরতেই হবে/―কেননা ভক্তের রক্তেই তুষ্ট থাকে ভালোবাসার দেবতা/―ভালোবাসা আর যন্ত্রণাকে তুমি/আলাদা করতে পারো না কিছুতেই’ সর্বজ্ঞ নিয়তি যেন কথা বলছেন। একটি পূর্ণ সিনেমার কাহিনিকে কয়েকটি পঙ্ক্তিতে নির্ভুল কবিতা করে তোলা বিস্ময়কর কবিত্ব শক্তির পরিচয় বৈকি!

দ্রোহ, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধেও যখন কবি ফল দেখছেন না তখন থাকে শ্লেষ, বিদ্রƒপ আর তিরস্কারের নিয়তি। দুটি কবিতায় যেন সে কথাটিই উচ্চারিত হয়েছে।

৪.

বঙ্গবন্ধু ও দেশপ্রেম মিনার মনসুরের কবিতার অন্যতম দিক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর দুঃসাহসী প্রকাশনার কথা আগেই বলেছি। বঙ্গবন্ধুর অস্বাভাবিক মৃত্যু তাঁকে কতটা ব্যাহত করেছে তার পরিচয় আছে ‘পিতা, তোমার মৃত্যুর পর’ কবিতায়। তিনি লিখেছেন, ‘অকস্মাৎ মধ্যরাতে বেয়নেটবিদ্ধ/বিপন্ন মানবতার বিশাল ক্রন্দনে/ আমার সেই যে ভেঙেছে হৃদয়, ভেঙেছে আশ্রয়/সেই যে ভেঙেছে ঘুম, ভেঙেছে বিশ^াস/আজও আমি ঘুমোতে পারি না।’

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক ভেবেছেন তিনি। কেন এ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড তাও প্রচণ্ডভাবে তাঁকে ভাবায়। তিনি যেন বুঝতে পারেন, ‘কর্মচ্যুত শ্রমিকের/ বেদনায় ব্যর্থতায় ক্ষয়ে আসা হাড়ে প্রতীক্ষায়/নুয়ে আসা বিদীর্ণ পাঁজরে তুমি ছিলে সর্বজয়ী/ বিশাল সাহস/ ছিলে বিপ্লবের হিরণ¥য় মহানসাধক/ মালিকের রক্তচোখ পুড়ে যেত তোমার আগুনে/রক্তচোষা মহাজন-জোতদার নিত্য আতঙ্কে কাটাত নিশি/তোমার সাম্যের হাতে তার মৃত্যু লেখা ছিল; তাই/তুমি শুধু বঙ্গবন্ধু নও―কারও কারও শত্রুও ছিলে’ (তুমি শুধু বঙ্গবন্ধু নও)।

তাঁর মূল্যায়নটা এরকম: ‘একটি তর্জনী-কেবল একটি তর্জনী তখন গর্জন করে উঠেছিল। আর তাতে বদলে গিয়েছিল আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস’ (কেবল একটি তর্জনী)। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা এরকম প্রচুর কবিতা রয়েছে তাঁর―যা নিয়ে আলাদাভাবে গবেষণা হতে পারে।

কবি মিনার মনসুরের দেশপ্রেম তর্কাতীত। তাঁর কাছে দেশ মানে একটি ভূখণ্ড বা মানচিত্রই নয়, দেশের মানুষ, অত্যাচারিত নিষ্পেসিত দুখি মানুষ এবং তাদের মুক্তি। এই তাঁর এবং সকলের আশ্রয়। নিজেও তাই দুঃখতাড়িত জীবনে যেন দেশের কাছেই চান কাতর আশ্রয়, ‘বাংলাদেশ, প্রিয় ইথাকা আমার, আমি/বিস্মৃত ওডেসিউস-অভিশপ্ত সন্তান তোমার/―ইথাকা আমাকে নাও, দুদণ্ড আশ্রয় দাও বুকে/বুক থেকে অন্তত একবার নামাতে দাও এই/ অভিশপ্তজীবনের অনিবার্য কান্নার কৈলাস’। কবি নিজে ভালো নেই, দেশের মানুষও কষ্টে আছে। কিন্তু এ জন্য তো এত রক্ত দেয়া হয়নি। তাই লিখলেন ‘দেশটাই যেন আজ বারোয়ারি বিশাল বাজার/শহিদের শিরন্ত্রাণ কিংবা বীরের এ রক্তস্রোত মায়ের এ অশ্রুধারা/ কি না বিকিকিনি হয় এই হাটে শুধু/যার জন্যে এত রক্ত এত অশ্রুপাত/তাকে আজ কোথাও দেখি না’ (যার জন্যে এত অশ্রুপাত)।

দেশের দুঃসময়ে, ক্রান্তিকালে, সংকটে একাত্ম হয়ে যান আন্দোলন-সংগ্রামে। বলতে পারেন, ‘মুছে দিতে আমাদের ক্ষমাহীনকলঙ্কের দাগ/সপ্তসমুদ্র মন্থন করে আবার উঠেছে জেগে/নীলকণ্ঠ নতুন প্রজন্ম-শাহবাগ শাহবাগ।’ ‘শাহবাগনামা’ কবিতায় বলেন কেন তিনি এই আন্দোলনে উচ্ছ্বসিত। কারণ ‘কিছুই যায় না দেখা―শুধু শত জড়াজড়ি নারী ও শিশু/তবু তার সাক্ষ্য চাই, বড়ই নাচার তিনি আইনের কাছে/কে দেবে ইহার সাক্ষ্য? নেরুদা নিহত; সংশপ্তক শুয়ে আছে/ রায়ের বাজারে। বিবেক বিকিয়ে খায় একালের যত যীশু’। তাই কবিতাও ক্ষুদ্ধ তাঁর, জাতীয় পতাকা মিছিলে নেমেছে/মিছিলে নেমেছে―শহিদ মিনার।

৫.

ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং কাল বা সময় সচেতন কবি মিনার মনসুর। শুধু বদ্বীপের মানচিত্র নয়, তাকে ছাড়িয়ে বৈশি^কবোধ, বিশ^ভূগোলের স্থান এবং কালগত ধারণা ও উপলব্ধি ভাবনার অনুষঙ্গরূপে, সাদৃশ্যমূলক অর্থালংকারের উপমারূপে যুক্ত হয়েছে তার কবিতায়। সাংস্কৃতিক ইতিহাস এবং ঐতিহ্যবোধ থেকে গভীরতর প্রেমের অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দ দাশ একই ভাবকল্পে ‘স্বপ্ন’ এবং ‘বনলতা সেন’ কবিতা লিখে কবিতা প্রেমিদের মনে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন। রোমান্টিক প্রেমের কবিতা হিসেবে কবিতা দুটির সুখ্যাতি রয়েছে।

মিনার মনসুর রোমান্টিক প্রেমের কবিতা নয়, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে যুক্ত করেছেন ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক বিশ^বোধকে। যেমন : ‘খাণ্ডব খেয়েছ তুমি; তোমার পোট্রেট/আঁকা আছে কুরুক্ষেত্রের বিশাল ক্যানভাসে। গোয়ের্নিকায়/তোমাকেই এঁকেছেন পাবলো পিকাসো তাঁর মহান তুলিতে/পচিশে মার্চের রাতে ঢাকার আকাশে শেষবার/তোমাকে দেখেছি, তুমি শুধু পোড়ামাটি চেয়েছিলে।’

               তাঁর মানবতাবোধের ব্যাপ্তিও বৈশি^কমাত্রা ছুঁয়েছে, কঙ্গো থেকে কারবালা, স্রেব্রেনিকা থেকে জালিয়ান ওয়ালাবাগ, আরাকান থেকে আফগানিস্তান, দজলা ফোরাত থেকে গঙ্গা ও নাফ―কোথাও জলের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু রক্তস্রোতে শ্যাওলার মতো ভেসে যাচ্ছে মানবতার বিবস্ত্র দেহ (তবুও গঙ্গা ও নাফ)। দেখে মনে হয় বিশে^র ইতিহাস তিনি ভালোভাবেই জানেন আর তা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট থেকে নিয়ে এসে তার জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করে কবিতাকে বৈশি^কমাত্রা দিয়ে দেন। খুব কম শক্তিমান কবিই তা করতে পেরেছেন।

কবির সময় সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায় বহু কবিতায়, তার মধ্যে একটি এরকম, ‘এই যে সময়/কতনা সহজে বলি―সময়ের টানাটানি খুব/অথচ হয়নি জানা কোথায় উৎপত্তি তার কোথায় বিনাস/ইদানীং হকিং নিয়ে ভাবি-যদিও দুর্বোধ্য তবু/বিস্ময়কর ‘কালের ইতিহাস’/ তাঁর। এরকম বহুকিছু নিয়ে ভাবি আজকাল’ (আমিতো বলি না কিছু)। হকিং এবং সময় নিয়ে যিনি ভাবেন তাকে সাধারণ কবি মনে করার কোনও কারণ নেই। বৃহৎ এবং ব্যাপ্ত মহাকাল কীভাবে তাঁর একাকী যাত্রার সঙ্গী এ নিয়েও ভাবনা আছে, ‘এ বড় কঠিন যাত্রা একাকী আমার/ সামরিক গোয়েন্দার মতো চতুর্পাশে^ ওত পেতে আছে এক ভয়ানক প্রতারককাল/―যেন অন্ধ এই শতকের অভিশপ্ত ইডিপাস আমি (এ বড় কঠিন যাত্রা)। তাঁর মনে হয়েছে সময়কে পথ ছেড়ে দেয়াই ভালো। কারণ ‘ওর তাড়া আছে’ (তোমার কোনও ত্রাণকর্তা নেই)।

সময় নিয়ে উচ্চতর ধারণা থেকে বাঙালি কবিদের মধ্যে উঁচু মানের কবিতা লিখেছেন কবি আহসান হাবীব। কবিতার নাম ‘সময় অসময়’। চিত্রকল্পটা এরকম: একটা সাদা বক ঝিলের ধারে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কবি এর মধ্যে অনন্তের বিকাশ দেখেছেন। এতে আত্মদর্শনের ব্যাপার আছে। কবি টি এস এলিয়টের ‘ফোর কোয়ার্টেট’ কাব্যগ্রন্থে এই সময়ের বিকাশ নিয়ে একটি কবিতা আছে। চিত্রকল্পটা এরকম: বার্ণ নটর্নের গোলাপ উদ্যানে একটি সাদা গোলাপ বাতাসে দুলছে। ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মে বিশ^াসী এলিয়ট হঠাৎই আবিষ্কার করলেন গোলাপটি হচ্ছে যীশুখ্রিস্টÑতার পেছনে যে বিশাল সময় তিনি ঈশ^র। উপনিষদে আছে, মানুষ অমৃতের সন্তান। পবিত্র কোরআনে একটি সূরার নাম ‘আছর’। আছর মানে সময়। আল্লাহ তাতে সময়ের কসম করেছেন। চিন্তাবিদদের ধারণা, আল্লাহর নিজের কসমই করেন। তা হলে সময়ই কি ঈশ^র? আহসান হাবীব তা হলে নিজের মধ্যে কাকে দেখেছিলেন?

৬.

যাঁর কবিতায় এত উত্তাপ দ্রোহের প্রকাশ, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দৃঢ়সংকল্প, তিনিই আবার নিভৃত-নিঃসঙ্গতার নির্জন কবি। আপাত দৃষ্টিতে একে কবিমানসের বৈপরীত্য মনে হলেও তা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। সমুদ্রের তলদেশ ভূমিকম্প আর প্লেটনিক কম্পন ছাড়া শান্তই থাকে। সেখানে বোধহয় সে নিঃসঙ্গ। বাতাসই তাকে  বৈরিতা করে ক্ষেপিয়ে তোলে। ঝড়ের আগে অবশ্য সমুদ্র শান্তই থাকে। সমুদ্রপাড়ের কবির ওপর তার প্রভাব থাকা বিচিত্র নয়। ব্যাপারটা মনে হয় তাও নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে তা হলে কী?

‘তুমি বলতেই পারো’ গদ্য কবিতায় আছে ‘আমিও কাঁপছি। তবে পুলকে নয়, নিঃসঙ্গতার শীতে। সেই শীতের দাঁত কতটা তীক্ষè হতে পারে পাস্তেরনাকই কেবল তা জানতেন। শত্রু কখনও নিঃসঙ্গ হয় না।―যদি বলি আমার নিঃসঙ্গতার কারণ তুমি―তাও পুরোপুরি অসত্য নয়। নিঃসঙ্গতার শীত আমাকে ছিড়ে ফেলছে ক্ষুধার্ত তুষার ভালুকের মতো।

বরিস পাস্তার নাকের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ডা. জিভাগো’ নিঃসঙ্গতার আবহে সৃষ্ট। উপন্যাসটির মূল চরিত্র নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্বে লালিত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার আবদ্ধ জীবনকে রূপকে এনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পশ্চিমের পুঁজি বাদীদের আনুকূল্যে প্রকাশের পরের বছরই উপন্যাসটির জন্য নোবেল পেয়ে যান পাস্তারনাক। এ রাজনীতিকে বাদদিলে বিশ^সাহিত্যের সেরা একটি উপন্যাস ‘ডা. জিভাগো’ এবং তা নিঃসঙ্গতাকে শিল্পমণ্ডিত করে তোলার জন্য। উচ্চ আদর্শবোধের চারিত্রিক নিঃসঙ্গতা যেন মহাভারতের সাধুপুরুষ যুধিষ্ঠিরকেও স্পর্শ করে গেছে, ‘তোমার প্রস্থানে একটুও কাঁপবে না অযোধ্যার ধুলোমাটি/কুরুক্ষেত্রে তুমি চির একা’। নিঃসঙ্গতাবোধের আরও গভীরে তাঁর চিন্তার রেখা, ‘প্রাগৈতিহাসিক এ শূন্যতার অন্ধকারে/পৃথিবীর শেষ সূর্যাস্তের মতো ডুবে যেতে যেতে/সে নিজেকে প্রশ্ন করে পৃথিবীটা এত/নির্জন শীতার্ত কেন’ (কিছুই পড়ে না মনে)?

জার্মান কবি ও ঔপন্যাসিক হেরমান হেসের কবিতায় আছে ‘তুষারসিক্ত কুয়াশার পথ খুঁজি/অনুভব করি শুধু নিজের স্পন্দন/অন্যকে জানবার সুযোগ কই/আমরা সবাই একা।’ একটি নিঃসঙ্গতাবোধ ইংরেজ কবি কিটসকে জীবনভর তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। বিষাদ ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। অসংখ্য কবিতায় সে পরিচয় আছে। বেশি আছে ঙৎ গবষধহপযড়ষু-তে।

কবি শামসুর রাহমান বলেছেন, ‘কবি তাঁর নিঃসঙ্গতা/কাফনের মতো জুড়ে রাখে আপাদমস্তক, হাঁটে/ফুটপাতে একা/―তাঁকে হেঁটে যেতে দাও ছায়াচ্ছন্ন পথে, দাও সাঁতার কাটতে/বায়ুস্তরে একা’ (কবিকে  দিও না দুঃখ)।

কবি মিনার মনসুর তবুও নিঃসঙ্গতার জীবন ছেড়ে আসতে চান। ‘অশরীরী ঈগলের ছায়া’ কবিতায় আছে, ‘শ^াপদসংকুল এই জীবনের বহুরূপী সমুদ্র সৈকতে/স্বজনের সারিসারি মৃতদেহ ঠেলে/স্বপ্নের বিকৃতশব কাঁধে/আমি কি আমৃত্যু বলো হাঁটব একাকী’?

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনও কোনও কবির কাছে এই একাকিত্বটাই কাঙ্গিত। রাশিয়ান  কবি রসুল হামজারভের কবিতায় আছে, ‘পুরোপুরি একা হতে চাই/পরিত্যাগ করতে চাই অতি চেনা পথ/এবং ঘাসের ওপর ঢিলেঢালা ফেলে রাখতে চাই/ভাঁজহীন ভাবনা ও স্বপ্ন’ (অনুবাদ: হাবীবুল্লা সিরাজী)।

কবি মিনার মনসুর চাইলেও যে নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারবেন না সে কথা নিজেই বলেছেন, ‘নির্বাসন দিতে চাও নিঃসঙ্গতাকে? পারবে না। এ হলো সেই গেরস্থ বিড়াল তাকে যেখানেই নির্বাসন দাও, যেভাবেই দাও সে ঠিকই পথ চিনে ফিরে আসবে’ (তোমার কোনও ত্রাণকর্তা নেই-৪)।

কবির নিঃসঙ্গতা খারাপ কিছু নয়। তা বরং কৃষ্ণগহ্বরের মতো-বিশ^সৃষ্টির রহস্য ধরে রাখে। এ রহস্যভেদ করতে চেয়েছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানি সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর। স্টিফেন হকিং এর লেখায় আছে, চন্দ্রশেখর কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করতে চাইলে তাঁর কেমব্রিজের গাইড তাকে ভারতীয় উল্লুক বলে গালিই দেননি, শুধু মারতে নাকি বাকি রেখেছিলেন। বলেছিলেন, মৃত বিষয় নিয়ে গবেষণার কী আছে? সম্ভবত বিজ্ঞানি আইনস্টাইনের হস্তক্ষেপে তিনি কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। আইনস্টাইন এই তরুণকে পছন্দ করতেন কারণ শুরুর দিকে ‘থিউরি অব রিলেটিভিটি’ যাঁরা বুঝতেন তাদের মধ্যে তাঁকে আধাজন বলে মনে করতেন আইনস্টাইন (শুরুতে আড়াইজন এই থিউরিটি বুঝতেন―একজন আইনস্টাইন নিজে, একজন তাঁর বন্ধু এডিংটন, গণিতের অধ্যাপক এবং আধাজন চন্দ্রশেখর। তিনি তখন জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন)। চন্দ্রশেখর ১৯৮৩ সালে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পান। তিনি দেখিয়েছেন বিশ^সৃষ্টির রহস্যে কৃষ্ণগহ্বর কতটা দায়ী। কেউ গবেষণা করে দেখতে পারেন কবির নিঃসঙ্গতা তাঁর সৃষ্টির জন্যও কতটা দায়ী কিংবা দরকারি।

৭.

কবি মিনার মনসুরের ‘প্রেমের কবিতা’ প্রকাশ করেছে ‘অ্যাডর্ন’। এছাড়া তাঁর সকল কাব্যগ্রন্থ এবং নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থে রয়েছে অজস্র প্রেমের কবিতা। মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতায় বেদনার সুরই বেশি অনুরণিত। এজন্যই যে, ‘আমাদের মধুরতম সঙ্গীত সেগুলো, যেগুলো বেদনার কথা বলে’।

খাঁটি ভালোবাসা পাবার জন্য মানুষ কতরকম প্রতিজ্ঞাই না করে। এটি চিরন্তন এক চাওয়া যে, ভালোবাসার মানুষ কখনও ছলনা বা প্রতারণা করবে না। মিনার মনসুরের কবিতায় আছে, ‘ভালোবেসে যেটুকু দেও সেটুকু শুধু আমার/এই তো আমার দাবি―এটুকু পেলে/গৌতম বুদ্ধের মতো বোধি বৃক্ষতলে/আমিও সন্ন্যাস নেব; নিখাদ ঔদাস্যে/পাপাসক্ত এই দেহ থেকে একে একে ছুড়ে দেব/যাবতীয় কামক্রোধ হিংসার পোষাক’ (ভালোবেসে যতটুকু দাও’)।

এরকম একটি গা-ছোঁয়া প্রতিজ্ঞার পরও কেন যেন সন্দেহ তাঁর, ‘সেই যে দুপুর তুমি দিয়েছিলে সারাটি দুপুর/সে কি ভালোবেসে? নাকি করুণাবশত’। সন্দেহটি অমূলক নয়। ‘তবু তুমি থাকো’ কবিতায় তা আরও স্পষ্ট। এখানে না পাবার আশঙ্কা যেন উৎকণ্ঠায় পরিণত ‘আমি আর কোনও কালে তোমাকে পাব না/এই শেষ এভাবেই হয়ে যাবে সব খেলা/―এখানে কিছুই স্থায়ী নয়-অবিনাশী পচনশীল/শিল্পও পচনশীল/ ঈশ^রমূলত এক পচনতাড়িত/সম্মিলিত উৎকণ্ঠার নাম’। একসময় উপলব্ধি করেছেন, ‘আমরা কেবল কথার কাঁচে বাতাসের হৃদয় ভেঙেছি’ (‘মনোবীক্ষণ’)।

মীনরাশির জাতিকা কথা রাখেনি, ‘বলেছিল হেসে/তোমাকে সমুদ্রের শিয়রের কাছে; অথচ সে দেখে নাই দীর্ঘকাল সমুদ্রের মুখ’। ‘এলিজি’ কবিতায় বিদ্যাপতির সে বিখ্যাত কবিতা ‘এ সখি―শূন্যমন্দির মোর’ এর উদ্ধৃতি রয়েছে। এ কবিতায় বলেছেন, ‘কেঁদেও পাব না তোমাকে বর্ষার অজস্র জলধারে―সে আমি জানতাম। আমার মন্দির তবু কানায় কানায় পূর্ণ ছিল তোমার শূন্যতায়। অকস্মাৎ সেই শূন্যতাও কেড়ে নিলে তুমি’।

চাইলে এরকম আরও উদ্ধৃতি দেয়া যায়। দুঃখ বোধ, না পাবার বেদনাবোধ শ্রেষ্ঠসব প্রেমের কবিতার জন্ম দিয়েছে। প্রিয়জনদের হারিয়েও কবির মধ্যে হাহাকার, ‘যাকে ছুঁই সেই তো নেই হয়ে যায়/যে দিকে তাকাই শুধু হায় হায় রব/গোলাপ বাগান ফুঁড়ে জেগে ওঠে/সারি সারি সমাধিফলক’ (কানামাছি কানামাছি)।

কবি আবুল হাসান অকালে মারা যাবার পর কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন, তাইতো নশ^র নারী কবির বিশ^াসে/ভালোবেসে যাকে ছুঁই সেই যায় দীর্ঘপরবাসে’।

প্রিয়জনকে হারাবার গভীর দুঃখবোধ থেকে যে কবিতার জনম, তাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবি লোরকা প্রিয়তম বন্ধু ইগনাশিও ষাঁড়ের গুঁতোয় হাজার মানুষের চোখের সামনে মারা যাবর পর যে শোকগাথা লিখেছেন তা বিশ^সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা। তাতেও হাহাকার, ঞযবৎব রং হড় ড়হব যিড় রহ মরারহম ধ শরংং/ফড়ংব হড়ঃ ভববষ ঃযব ংসরষব ড়ভ ঃযব ভধপবষবংং ঢ়বড়ঢ়ষব―

মৃত্যু ও প্রেম লরকার কবিতায় দুঃখবোধ শিল্পে পরিণত করেছে। মিনার মনসুরের কবিতা পড়ে লোরকার কথাই মনে হয়। প্রগতিবাদী লোরকাকে প্রতিক্রিয়াশীল ফ্রাংকোর সৈন্যরা প্রথমে জেলে নেয়, তার কয়েকদিন পর নিয়ে যায় সমাধিক্ষেত্রে, ফ্রাংকোর অনুচরদের হাতে নির্মমভাবে নিহত লোরকার ভগ্নিপতির কবরের পাশে। সেখানেই লোরকাকে প্রহারে প্রহারে রক্তাক্ত করা হয় এবং তাঁর লুটিয়ে পড়া দেহে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

৮.

শ্রাবণের কবি মিনার মনসুর। বাঙালি কবিদের ওপর প্রকৃতির প্রভাব অচ্ছেদ্য। এখানে প্রকৃতিই যেন কবিকে কবি করে তোলে। কোনও কোনও বিখ্যাত বাঙালি কবি ঋতুর অভিধায় বিশেষণায়িত। হেমন্তের কবি যেমন জীবনানন্দ দাশ তেমনি কবি মিনার মনসুরের রয়েছে শ্রাবণপ্রীতি। তিনি শ্রাবণের কবি। তাঁর কবিতায় শ্রাবণ উপস্থি হয়েছে নানা রূপে, নানা চরিত্রে, রূপকে-প্রতীকে, চিত্রকল্পে ও সুরে। তাঁর ‘আমার সবটা শৈশব ডুবেছিল থই থই জলে’ কবিতায় আছে শ্রাবণের ভীতিকর রূপ তাঁকে শৈশবে কেমন ভীতবিহ্বল করে রাখত। তা নিয়ে মায়ের উৎকণ্ঠারও শেষ ছিল না। মা তাঁর ‘অদ্ভুত মায়াময় চোখ দুটো ছাতার মতো মেলে রাখতেন শ্রাবণ আকাশে।’ কবি বলেছেন ‘আমার ধুকবুক করা ছোট বুকের ভেতরও লুকিয়েছিল শ্রাবণের অনেক আকাশ।’ এবং এখনও, ‘শ্রাবণের ক্ষুব্ধ আকাশ ক্লান্তিহীন ছুড়ে যাচ্ছে বর্ষণের তীক্ষèশর―লক্ষ্য তার আমার অবাধ্যমস্তক।’ শ্রাবণের মেঘ কেটে গেছে। তবুু যেন, ‘ছিন্নমস্তা শ্রাবণের থমথমে মুখে অবিরাম আছড়ে পড়ছে তার পরাবাস্তব আলো।’

‘মা এখন থেমে যাওয়া নদী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘দৌড় তো থামেনি’। তাতে আছে ‘বদলায়নি কিছুই। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শৃঙ্খলিত মেয়েটি শ্রাবণ কী জিনিস জানে না।’ অথচ স্কুলের পথভুলে সহপাঠীর হাত ধরে সেও এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ধানমন্ডিলেকে। ‘সবই শ্রাবণের কারসাজি।’ পরে বললেন; কীসের জন্মোৎসব এখানে। বৈরি শ্র্রাবণের কৃষ্ণ কাদাজলে ঢেকে জীবনের শতছিন্ন বিবর্ণ ক্যানভাস। কংক্রিটের এই ফুটন্ত কড়াইয়ে কে কাকে মনে রাখে।’

আবার গেলেন সেই থইথই জলে, যেখানে ‘নিঃসঙ্গ নাবিক। কেবল তারই জন্য কী বিপুল আয়োজন শ্রাবণের―’। বহুদিন আর তার দেখা নেই। তারপর কৈলাস থেকে দুর্গার বেশে বেণুরা যখন আসে তখনই ‘শ্রাবণের আকাশ স্তব্ধ হয়ে থাকে তার নির্বাক চোখে’।       

শ্রাবণের আরেকটা পরিচয় মেলে ‘তুমি আছ, তুমি নেই’ কবিতায়। ‘আজো অপরূপ বেলি ফোটে ঝড়ে যায়/বকুলে বকুলে ছেয়ে যায় কালের শ্যাওলা শাসিত পথ/শ্রাবণ ধারায় বয়ে যায় হৃদয়ের একূল ওকূল’।

‘ও তন্বী বিদ্যুৎ’ কবিতায় দেখা গেল শ্রাবণের আরেক রূপ, ‘এই যে আয়ত চোখ- মৌনতার মেঘে/ঢাকা গহন শ্রাবণ এবং সহসা/আকাশ বিদীর্ণ করা চোখের বিদ্যুৎ/কবি কেন বজ্রাহত?’

একসময় যেন কবির মানসিকতার পরিবর্তন সূচিত হয়। শ্রাবণের থই থই জল একসময় আনন্দ  আর খেলার অনুষঙ্গ হয়ে আসে, ‘কাগজের নৌকায় তোমাকে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম শ্রাবণের থই থই জলে। খেলাচ্ছলে, এখন অপরূপ রৌদ্রের জলে ভেসে যাচ্ছে আমার বিষণ্ন অ্যাপার্টমেন্ট’ (বিসর্জন)।

শ্রাবণকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে পাওয়া গেল ‘ইচ্ছে হয় শ্রাবণকেই মা বলে ডাকি’ কবিতায়। এই গদ্য কবিতায় কবি লিখেছেন; শ্রাবণ এলেই নাড়িতে টান পড়ে। কোন সুদূরের আকাশ থেকে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। অদ্ভুত একটা মা মা ঘ্রাণে ভরে ওঠে আমাদের ট্রাম্পগ্রন্থ ধরিত্রী। আমি অন্ধ ছিলাম। শ্রাবণই আমাকে এই অপরূপ পৃথিবীর রূপ দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল।―মা অধরা বহুকাল, ইচ্ছে হয় শ্রাবণকেই মা বলে ডাকি। ঘুমিয়ে পড়ি তার মেঘ মখমল কোলে’।

স্টিফেন স্পেন্ডার লোরকার কাব্যবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছিলেন, ঙহব রং ধধিৎব ড়ভঃবহ রহ যরং ঢ়ড়বসং ড়ভ ফড়ঁনষব ঢ়রপঃঁৎব: ঃযব ৎবধষরষু ড়হ যিরপয যরং ঢ়ড়বঃৎু রং ফৎধরিহম ধহফ ংঁঢ়বৎরসঢ়ড়ংবফ ধনড়াব ঃযরং ৎবধষরঃু, ধহ রহফবঢ়বহফবহঃ, ঁহৎবধষঢ়রপঃঁৎব’.

মিনার মনসুরের কবিতায়ও আমরা বড় কবিদের এ বাস্তব এবং প্রতীকী জগৎ একই সঙ্গে পাশাপাশি পাই। উপন্যাসে কাজটি করেন হারুকি মুরাকামি। তিনি অবশ্য পরাবাস্তববাদী ঔপন্যাসিক।

৯.

মিনার মনসুরের কবিতার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে গদ্য কবিতা বা টানা গদ্যের কবিতা। এ ধারার কবিতা বর্তমান সময়ে যাঁদের হাতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মিনার মনসুর তাঁদের অন্যতম।

গদ্যকবিতা লেখার জন্য কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। চণ্ডীদাস রজকিনীর জন্য ১২ বৎসর বরশি ফেলেছেন। আর কবি বুদ্ধদেব বসু ১২ বছরের (১৯৫৩-৬৫) সাধনায় ‘দোকানিরা’ নামের গদ্যকবিতা প্রণয়িনীর প্রেমকে পূর্ণতা দিতে পেরেছিলেন। সেকি সমাধান! পদ্যকে কবিতা করা অপেক্ষাকৃত সহজ। কাউকে ১২ বছর অপেক্ষা করতে হয় না।

বাংলা ভাষায় গদ্যকবিতার সূচনা রবীন্দ্রনাথের হাতে। তিনি ১৯৩১ সালে প্রথম ‘শিশুতীর্থ নামে একটি গদ্য কবিতা লেখেন। তারপর বেশ কিছু কবিতা লিখে ১৯৩২ সালেই গদ্যকবিতার কাব্য ‘পুনশ্চ’ প্রকাশ করে ফেলেন। তবে গদ্যকবিতা তার শিশুচরিত্র পাল্টে সাবালক হয়ে ওঠে ত্রিশের বুদ্ধদেব বসু এবং জীবনানন্দের হাতে। তখন অবশ্য গদ্যে-পদ্যে বিবাদ ছিল। সাত্ত্বিক কবিমাত্রই এ বিবাদ মেটাতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে এসে সে বিবাদ মেটালেন। তাতেও মনে হয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘স্বরাজ্য মজ্জায় মজ্জায় না থাকলে নৈরাজ্য অমঙ্গল প্রসূ। তাই ভয় পাই তপস্য কঠিন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যেটা মোক্ষ আমাদের ক্ষেত্রে হয়তো তা সর্বনাশের সূত্রপাত।’

না, গদ্য কবিতা বাংলা সাহিত্যে তো নয়ই, কোনও সাহিত্যেই সর্বনাশ ডেকে আনেনি। বরং অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়েছে সাদা বলাকার পাখায় হিরকপালকের সংযুক্তি ঘটিয়েছে। গদ্য কবিতায় কবি শামসুর রাহমান জোয়ার এনেছিলেন। এই আঙ্গিকে অসাধারণ দক্ষতায় তিনি লিখে যেতেন কংক্রিটের নাগরিক জীবনের কথা।

গদ্য কখন কবিতা হয়ে ওঠে? গদ্যকবিতার বৈশিষ্ট্যই বা কী! কবিতার শক্তিসামর্থ, তার চলন, নির্মাণ, চিত্রকল্প, রূপকল্প, প্রতীক রূপক, সংবেদনরীতি, বিষয় ও বোধ, বাক-প্রতিমা, অর্থের ইঙ্গিত আর প্রহেলিকা প্রভৃতি বোধগম্য হবার আগেই সঞ্চারিত করার প্রবণতা যদি কোনও গদ্যে থাকে তাকে কবিতা বলতে বাধা কোথায়?

১৯৮০ সালে মিনার মনসুর সম্ভবত প্রথম গদ্যকবিতা লেখেন। কবিতার নাম ‘ব্যর্থতা’। তখন তিনি বিশ বছরের তরুণ। এত কম বয়সে গদ্যকবিতার মেজাজ এবং শিল্পাঙ্গিক ধরতে পারা তাঁর কবি প্রতিভারই পরিচয় বহন করে। বোদলেয়ার গদ্যকবিতা লেখেন তাঁর বয়স যখন ভাটির দিকে। আশি বৎসর বয়সের রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন সত্তর পেরিয়ে, বুদ্ধদেব এবং জীবনানন্দরা পরিণত বয়সে।

‘ব্যর্থতা’ রূপকধর্মী কবিতা। দীর্ঘ অন্ধকারে হাঁটছেন তাঁরা। একজনের কাক্সিক্ষত উজ্জ্বল আলোকের হাতছানি’। আরেকজনের কাছে ‘উজ্জ্বলতা অসহ্য, জঘন্য’। তাঁর কাছে অন্ধকারই বাঞ্ছিত।’ কী এক আচ্ছন্নতায় তাঁদের রক্ত হিম হয়ে আসে। সামনে বীভৎস সকাল।’ একদল উলঙ্গ ক্ষুধার্ত মানুষ তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে, এরা ওদের ক্ষুধার্ত  চিৎকার না―শোনার চেষ্টা করেন’। প্রথম গদ্যকবিতা বলেই হয়তো ব্যর্থতাটা উচ্চমাত্রা পায়নি। কিন্তু তার পরিণত মান ধরা পড়ে প্রায় একই ভাবাবেগ বা বিষয়বস্তুর কবিতা ‘শব্দব্রহ্মে’র মধ্যে।

নেলসন ম্যান্ডেলা অনাহারক্লিষ্ট কংকালসার আফ্রিকান শিশুটিকে ডাকেন, ‘অস্থির প্রহর গোনেন বারাক ওবামা, মহাত্মা গান্ধী রাখেন সান্ত¦নার হাত এবং ‘মাদার তেরেসা হাঁটে গেড়ে বসেন তারপাশে’। শিশুটি এসবের ধারধারে না। কারণ ‘তার বিপন্ন অস্তিত্ব জুড়ে শুধু অবমানিত শিবের গর্জন ‘ব্রহ্মের মতো সে একহাতে ক্রোধের প্রলঙ্করী ঝড় সামলায়, অন্য হাতে কান্নার সুনামি’।

মিনার মনসুরের কোনও কোনও কবিতায় সালভাদর ঢালির প্রসঙ্গ এসেছে। অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের শিল্পী তিনি, বিশেষ করে সুররিয়ালিস্টিক বা পরাবাস্তববাদী শিল্পী। ‘ব্যর্থতা’ কিংবা ‘শব্দব্রহ্ম’ পাঠ করে ঢালির কথা মনে হয়। আরেকটি কবিতা ‘মহিষ’। প্রতীকী। ‘বিচিত্র বর্ণের অভিজন সমুদ্রে জাতিগত পরিরচয়টাই তার আত্মবিচারের একমাত্র খড়কুটো’। ‘তোমার কোনও ত্রাণকর্তা নেই’ দীর্ঘ কবিতা। এতে আছে ভিন্ন ভিন্ন নয়টি বার্তা। বুঝে উঠতে পারা কষ্টসাধ্য। হকিং এর ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ এর মতো, পড়তে ভালো লাগে, বুঝে ওঠা কঠিন। বিজ্ঞান অবশ্য বুঝবার বিষয়, কবিতায় সে বালাই নেই, কেননা কবিতার কান্ডারিরা বলেন, ‘প্রকৃত কবিতা বোধগম্য হবার আগেই সঞ্চয়িত হয়’ (টিএস এলিয়ট)। পরাবাস্তববাদী কবিতা হলে তো কথাই নেই। ‘লুই কানের সন্তান’ কবিতার কথা ধরা যাক। আবার ঐ দারিদ্র পীড়িত দুখি মেয়ে। লুইকানের সন্তান খ্যাত জাতীয় সংসদ ভবনের কাছে আশেপাশেই থাকে। রাস্তায় বাড়ি ঘর। বস্ত্র আছে কী নেই। উপেক্ষার হিমে―আগুন সব নিভে গেছে। সংসদে তার কথা হয় না। হয় সুবিধাবাদীর কথা। কী কথা? কবিই বলছেন, ‘গলায় রক্ত তুলে বলবে নাকি―মাননীয় স্পিকার, শুল্কমুক্ত গাড়ি নয়, সুবিশাল বাড়ি নয়, ঠিকাদারির বখরাও নয়―একবার শুধু সে ওই উপেক্ষিতা আগুনের পাশে গিয়ে বসতে চায়। ওর বড় শীত করছে।’

‘একটি অসমাপ্ত ষাড়ের রচনা’ মনে হয় একটি স্বপ্নকাব্য। কবিতাটি পাঠ করলে পরাবাস্তববাদী লেখক হারুকি মুরাকমির ‘দ্য কালারলেস সুকুরু তাজাকি অ্যান্ড হিজ ইয়ার্স অব পিলগ্রিমেজ’ উপন্যাসের কথা মনে হয়। সুকুরুও এরকম একটি স্বপ্ন দেখে। তবে তা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে না জেগে তা শুধু সুকুরুই নয়, লেখকও বুঝতে পারছেন না। পরাবাস্তববাদী কাজে এমনটাই হয়।

কয়েকটি কবিতায় ঘোড়ার প্রতীকী উপস্থিতি আমাদের অ্যাবসার্ড বিশ্বের দুর্বোধ্যতায় নিয়ে যায়। ঘোড়া হাসে কিংবা উড়তে পাবে ব্যাপারগুলো অ্যাবসার্ডই বটে তবে অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। দুর্বোধ্য অ্যাবসার্ড এসব আটফর্ম বিশ্ব জয় করেছে। কালজয়ী শিল্পের তকমা পেয়েছে। ঢালি শিল্পে, কাফকা উপন্যাসে, নাটকে স্যামুয়েল বেকেটেরা এরকম আপাত দুর্বোধ্য ধারার কাজ করে বিখ্যাত হয়ে আছেন।

১০.

কবি মিনার মনসুর সাহিত্য, বিশেষ করে কাব্যশাস্ত্র সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান রাখেন। এজন্য তাঁর কবিতা শাস্ত্রীয়ভাবে ব্যাকরণসিদ্ধ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইতিহাস চেতনা, নিজস্ব কলাকৈবল্যবোধ এবং দক্ষ শিল্পী শ্রমিকের নিষ্ঠা ও গ্রহণযোগ্য মুগ্ধ করা শ্রম।

‘কী জবাব দেব’ কবিতাটির কথাই ধরা যাক। কবিতাটিতে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ছেষটির ছয় দফা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পঁচাত্তরের সপরিবার বঙ্গবন্ধুর হত্যার মতো জাতীয় ইতিহাসের মর্মস্পর্শী নানা ঘটনার উল্লেখ আছে। কিন্তু এত ত্যাগে যে অর্জন তা যখনই ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, ইতিহাসের সে দায়কে কবি নিজের (ঙহি) করে নিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ যাকে বলেছেন, ‘কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারত্ত’―এ কবিতার ভাব এবং বিষয়টি তা উচ্চমাত্রা দিয়েছে। এ কবিতার বক্তব্য শুধু কবির নিজের নয, সর্বজনীন জবাবদিহির বার্তা নিয়ে এসেছে। এ বার্তার ভাষা ‘বিকশিত চৈতন্যের ভাষা’। তাতে একটি শব্দও আরোপিত নয়। কবিতা শব্দ শিল্প―তা মর্মে উপলব্ধি করে শব্দশিল্পী কবি সহজ ও সাবলীল শব্দ বিন্যাসে যেন স্থাপত্যে পাথর বসানোর কাজ করেছেন, এমনই তাঁর নির্মাণ। পঙ্ক্তি, পর্ব ও মাত্রাবিন্যাসের মধ্যে রয়েছে সুশৃঙ্খল পরিমিতিবোধ।

জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘কাব্যের ছন্দ তো অনেক রকম, গদ্যও তো একরকম ছন্দ; কবি যখন ভাবাক্রান্ত হন, তখন চোখতার ছবি দেখে, কাল শোনে এবং চোখও অনুভব করে যেন ছন্দ বিদ্যুৎ; কোন ছন্দে কবিতাটি রচিত হবে মুহূর্তের মধ্যেই তা নির্নীত হয়ে যায়’ (কবিতায় আত্মা ও শরীর, কবিতার কথা)। মিনার মনসুর যেন এই বাণী অনুসরণ করেই ছন্দ ব্যবহার করেছেন। ‘কবি প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র হলো ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য কবি প্রতিভার পরিচয় বহন করে।’

‘কী জবাব দেব ‘কবিতায় কতগুলো শব্দ রূপকল্প এবং চিত্রকল্পের অর্থালংকারে অর্থবহ হয়ে উঠেছে। ‘রক্তমাখা খামে চিঠি,’ ‘তাজা খুনে রাঙানো পতাকা, ‘লাল সাম্যের পতাকা’, ‘দেয়ালে ঝুলন্ত ফ্রেম থেকে গভীর নিশিথে চুপচাপ নেমে আসে’ প্রভৃতি শব্দগুলো শুধু কবিতার রক্তাক্ত পটভূমি রচনা করে না, সমাজতান্ত্রিক সমাজ, মুক্তিযুদ্ধের ‘চরমপত্রে’র বার্তা দেয়। ‘কী জবাব দেব’ শব্দগুচ্ছই শ্লেষাত্মক অর্থালংকারে আবৃত।

কবির প্রকাশিতব্য কাব্যের কবিতা ‘তুমিই হাদি, তুমিই আদি’। রচনাকাল ১৩-১৯ আগস্ট ২০২২, গদ্যকবিতা। বেশ বড় কবিতাটির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই আছে, ‘শকুনটি অস্থিরভাবে মাটি আঁচরায়। শ্রাবণের ভেজামাটি। তারপরও তার নখ টনটন করে ব্যথায়। রায়ের বাজার থেকে বত্রিশ নম্বর। এদিকে জ্যান্ত গিলে ফেলা সজারুর মতো খিদেটাও খোঁচাচ্ছে ভীষণ। পঞ্চাশ বছর তো আর কম সময় নয়। বস্তুত সে একটি ভোজের অপেক্ষায় আছে। মহাভোজ-ঠিক আগস্ট ১৯৭৫-এর মতো। গদ্য কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনা এখানে পরাভূত আতঙ্কিত হবার মতো পিলে চমকানো বার্তার কাছে। তবু টিএস এলিয়টের মতোই বলতে হয়, প্রকৃত কবিতা বোধগম্য হবার আগেই সঞ্চারিত হয়।

আন্তর্জাতিকতাবাদ, বিশ্ব ঐতিহ্য ও বিশ্বের চলমান ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা মিনার মনসুর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘প্রিয় ইথাকা আমার’ কবিতায় আছে ‘বাংলাদেশ, প্রিয় ইথাকা আমার, আমি/বিস্তৃত ওডেসিউস-অভিশপ্ত সন্তান তোমার/দুঃখের দূরতিক্রম্য সহস্র সমুদ্র পাড়ি দিয়ে/ক্যালিপসো ও মার্সির মায়াজাল ভেঙে/হেডেসের ত্রিশূলে বিদ্ধ হতে হতে/সর্বস্বান্ত মুমূর্ষু এসেছি ফিরে তোমার মাটিতে’। প্রাচীন গ্রিক মিথের এমন সাদৃশ্যমূলক অর্থালংকারের উপমা কবিতাটি অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কবির উপমা ব্যবহারের ধরন অভিজ্ঞানের অভিচেতন মূল্য অনুসন্ধানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।

দূরাতীতের বিশ্ব যেমন কবির ভাবাবেগকে আলোড়িত করেছে, তেমনি চলমান বিশ্বের ঘটনাবলিও তাঁর বিবেককে ধারুণভাবে মর্মাহত করেছে। তিনি ‘কিয়েভ থেকে―লিখছি এ দীর্ঘশ্বাস’ কবিতায় শ্লেষের সঙ্গে লিখেছেন, ‘আমাদের ত্রাতা বাইডেন বলেছেন: যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে, শেষ পর্যন্ত আপনিই জিতবেন, মর্যাদাপূর্ণ শান্তি চুক্তি হবে, হবে, হবে, সব হবে। কিন্তু বোমায় বিধ্বস্ত আমার নিদ্রা, আমার জাগরণ কি আর ফিরে আসবে―বলুন, বলুন মহান দেশপ্রেমিক ভেøাদিমির জেলেনস্কি’।

শুধু ইউক্রেনবাসীদের নয়, গুটি কতক পশ্চিমা বাদ দিলে সারা বিশ্বই জেলেনস্কির ওপর ক্ষুব্ধ। বিশ্ব আজ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে তার বাইডেনের প্রতি অন্ধভক্তির কারণে। কবি মনে করেন, এই ‘ত্রাতা’ শুধু ইউক্রেন নয়, সারা বিশ্বকেই মহাযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে। ব্যাপারটা সাধামাটা গদ্যেই বলেছেন। তবে তাঁর সব গদ্যকবিতাকে স্রেফ সাদামাট ভাববার কারণ নেই, তাঁর ‘পড়তে পড়তে বেমক্কা ঝুলে থাকা’ যেমন মেঘেরা ফান ‘করে ভাবে সার্কাস’, তেমনি পরাবাস্তববাদী চিন্তা কখনও কখনও মেধা ও মননের বাস্তববোধের সীমা অতিক্রম করেছে। যেমন : ‘দালির ঘড়ির মতো গলে গলে যুগপৎ সামনে ও পেছনে প্রসারিত হলো ওদের চার জোঁড়া চোখ। যে পেছনে ফিরল তার চোখে মায়াময় ছবির অ্যালবাম-দূরগামী ট্রেনের মতো ধাবমান। যে চোখটি সামনে প্রসারিত তা মুখ থুবড়ে পড়েছে মোনালিসা মেঘের দেয়ালে’ (পরাবাস্তাব)।

‘কোথায় কবিতা নেই বাঙালি জীবনে’ দিয়ে শুরু হয়েছিল, শেষটা বোধ হয় করা যায় অসাধারণ এক কবিতা ‘কবিদের কবি তুমি’-এর ঐতিহ্য লালিত গৌরবগাথা দিয়ে। ‘কত কবি হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব/কত যে কবিতা তারা, লেখে―কী বিচিত্র তার ভাষা ও সংকেত।’ এ কবিতায় যাঁরা কবি তাঁরা বাস্তবে সবাই কবিতা লেখেননি। তবে কবিতার মতোই সবাই মহৎ র্কীতি রেখে গেছেন। যেমন : ‘যে নাঙ্গা সন্ন্যাসী আজও দীপ্র রয়েছেন বসে’ সম্রাট মোর্যের/দরবার আলো করে তিনিও মহান কবি এক এ-বঙ্গের’/আর বিক্রমপুরের ওই যে শ্রমণ ভিক্ষাপাত্র হাতে নগ্ন পায়ে যিনি/অবিরাম চলেছেন ছুটে কালের প্রাচীর ভেঙে।’

তাঁর কাছে কবি আজ শুধু মানুষই নয়, ‘তেরশত নদ-নদী জন্মাবধি লিখে যাচ্ছে অজস্র কবিতা/ তারাই তো আদিকবি এ বাংলার’।―নদী তবু নির্বিকার/ বাংলার বিস্তীর্ণ শষ্য ক্ষেত্র জুড়ে তার কবিতার খাতাখানি/ ভরে আছে বহু বর্ণ কবিতা ফসলে’। আর ঐ যে মানুষটি/ তুমি যাকে গেঁয়ো চাষা বলে ডাকো―চর্যার চেয়ে ও আদিতম তাঁর কাব্যকীর্তি’।

এতসব কীর্তিমান মানুষের অবদানের পরও দুঃখিনী বাংলা’ মায়ের অশ্রু আর’ বীরের শোণিতধারাই দেখেছে। ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ এজন্য ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ঠিক কখনই সমুদ্রের বিপুল গর্জনে/ তখনই অলৌকিক এক অঙ্গুলি হেলনে/লেখা হয়ে যায় সেই অমর কবিতাখানি আর অন্তহীন/ রাত্রির তপস্যা শেষে কবি করোজ্জ্বল দিন সসম্ভ্রমে বলে/কবিদের কবি তুমি- বঙ্গপিতা―তোমাকে প্রণাম’।

সারা কবিতায় দুয়েকটি শব্দ অন্য কবির মনে হলেও কবিতাটি এক অনবদ্য সৃষ্টি। কবির জ্ঞাতার্থ এবং ব্যক্তার্থ-দুইই অবলীলাক্রমে প্রকাশ পেয়েছে এই কবিতায়। কবি এখানে কবিতা লেখেন না, স্ব স্ব ক্ষেত্রে সৃষ্টির ফসল ফলিয়ে কবি হয়ে ওঠেন।

মিনার মনসুর বাংলা কবিতায় নিজের আসনটি পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন―একথা বললে বোধহয় ভুল বলা হবে না। এজন্যই বলতে পারেন, ‘সতত উড্ডীন জেনো আমার পতাকা/ মৃত্যুই জীবনের শেষ কথা নয়’ (যখন ঘুমিয়ে যাব)।

আমরাও তা বিশ্বাস করি।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button