আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য নির্মাণযুদ্ধ : নাসরীন জেবিন

প্রচ্ছদ রচনা : স্বাধীনতা দিবস

সেলিনা হোসেন একজন সৃজনশীল লেখক। বাংলা আধুনিক সাহিত্যে তিনি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। তাঁর উপলব্ধিজাত অনুভূতি শুধু কথা সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি শাণিত ও শক্তিশালী গদ্যের বিকাশে প্রবন্ধের আকারেও তা প্রকাশ করেছেন। সেলিনা হোসেনের বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার শুধু আলোচনা করলেই তাঁর সৃষ্টির রস আস্বাদন হবে না। পঁচাত্তর বছরের জীবনে তিনি অর্ধশতাধিক গ্রন্থ আমাদের উপহার দিয়েছেন। তিনি কখনও প্রবৃত্তির দাসত্ব মেনে নেননি বরং মানবিক অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন।

গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও লড়াকু জীবনের অনুসন্ধান আজীবন তাঁর সাহিত্য ভাণ্ডার গৌরবান্বিত করেছে। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে আমরা যেমন সনাতন ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও বাংলার লোক পুরাণের ঐতিহ্য ধারণকারী চরিত্র দেখেছি তেমনি আবার সমকালে সমসামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংকটের নানামুখি বিস্তার দেখেছি। সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডার সৃষ্টিতে তাঁকে সহযোগিতা করেছে আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এসব ঘটনা তাঁর সৃষ্টির জগৎটি উন্মোচিত করেছে নানা মাত্রায়। সেলিনা হোসেনের সাহিত্যে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এসব উঠে এসেছে নানা মাত্রার আঙ্গিকে। যুদ্ধের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস তাঁর সৃষ্টির মাঝে বার বার এসেছে।

বাঙালির ত্যাগ-সংগ্রাম কতটা উচ্চকিত থাকলে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব। তারই আলোকে সেলিনা হোসেন রচনা করেছেন যুদ্ধ (১৯৯৮) উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধই এ উপন্যাসের প্রধান উপাত্ত। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্তরকে তিনি ধারণ করেছেন এ উপন্যাসে। উপন্যাসে আলাদা করে কোন কাহিনি নেই কিন্তু প্রতিটি চরিত্র যুদ্ধকে ধারণ করেছে তার চেতনায়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত স্বাধীনতার অসামান্য অর্জনের উপর দাঁড়িয়ে আছে ‘যুদ্ধ’ উপন্যাস। এ উপন্যাস পড়তে পড়তে আমরাও যুদ্ধের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে যাই। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরতে গিয়ে লেখক তীক্ষè পর্যবেক্ষণ শক্তি, মননচেতনা ও কল্পনা শক্তির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। যুদ্ধের সময় আমাদের বেঁচে থাকার সংকট, মূল্যবোধের বিপর্যয়, ধর্মীয় বিশ^াসের উপর আঘাত, প্রিয়জন হারানোর বেদনা, মৃত্যু মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। যুদ্ধ কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। পৃথিবীর সব দেশেই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও উদ্ভূত পরিস্থিতি একই মৌল সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পৃথিবীর সব মানুষের চেতনার গভীরতলে যুদ্ধের ভয়াবহতার চিত্র একই। লেখক একটি সেক্টরের যুদ্ধকে উপাত্ত করে বাংলাদেশের অগণিত মানুষের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছেন।

যুদ্ধ উপন্যাসে একটি মূল্যবান চরিত্র আছে যার কোনও নাম নেই। চরিত্রটি উপন্যাসের মূল প্রেরণা শক্তি। যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসের পেছনে চরিত্রটি মূল প্রেরণা হয়ে কাজ করেছে। প্রত্যেকের ভিতরের শক্তিকে সে উজ্জীবিত করেছে। চরিত্রটি যুদ্ধের সময় পুরো দেশ ঘুরে বেড়িয়েছে এবং যুদ্ধগ্রস্ত মানুষের যন্ত্রণা, ক্ষয়-ক্ষতি আর কষ্টের মাঝে জয়ের আলোক বর্তিকা পৌঁছে দেয়। যুদ্ধ জয়কে ছিনিয়ে নেয়ার শক্তিকে শাণিত করে। এই চরিত্রটি মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা এবং সাহস। মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন সে লালন করেছে চেতনায় আর তা গ্রথিত করেছে জাতির মাঝে। এ যুদ্ধে বার বার শ্রদ্ধাবনত চিত্তে যার নাম উচ্চারিত হয়েছে সে আবু তাহের ও শহিদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মমতাজ এবং ১১ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে।

তারামন মুক্ত স্বাধীন সত্তার অধিকারী। প্রকৃতির সাথে তার বন্ধন অবিচ্ছেদ্য। প্রকৃতির মুক্ত জমিন, ব্রহ্মপুত্র ওকে মুক্ত জীবনের ইশারা দিয়ে যায়। সংসারের চিরচেনা বন্ধন ছেড়ে সীমাকে ছাড়িয়ে সে অসীমের পানে ছুটে চলে। চায় মুক্ত স্বাধীন জীবনের স্বাদ পেতে। বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে তারামনকে বাড়ি যেতে দেয়া হয়নি। আজ বাবা এসেছে তাকে নিতে। তারামনের হৃদয়ে আনন্দের বন্যা। এ আনন্দ বাড়ি ফিরে যাবার চাইতে মুক্তির স্বাদই তাকে আপ্লুত করেছে বেশি। এ আনন্দ লেখক প্রকাশ করেছেন এভাবেই :

‘নিজের বাড়ি ফিরে যাবার আনন্দে একটি শাড়ি ও দুটি ব্লাউজের ছোট পুটলিটা উপরে ছোড়ে আর দুহাতে ধরে।’

 (যুদ্ধ)

আত্মার মুক্তির আনন্দ সার্বজনীন। সে মুক্তি তারামন তার বোন বেনুর সাথে আজীবন ভাগাভাগি করে নিয়েছে। জাম্বুরা গাছ থেকে পেড়ে সে বেনুর দিকে ছুঁড়ে দিত আর বেনু তা ধরে ফেলত।

তারামন বিয়ের ছমাস পর সংসারের খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েছে। বিয়ের পর সংসারের সমস্ত কাজকর্ম সে একা হাতে করত। তারামনের মা মেয়ের শ^শুর বাড়ির জন্য চিতই পিঠা পাঠিয়েছে বাবার কাছে। বাবা মেয়ের শ^শুর বাড়ি এসে শোনেন তারামনের তালাক হয়ে গেছে। বেদনায় মুষড়ে পড়েন বাবা। তালাক প্রাপ্তা মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য বাবা শঙ্কিত। বাবা জানত মেয়ের জামাই মেছের আলি মৃগী রোগী। তবু মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দিয়েছে। কারণ মেছের আলির পরিবার সচ্ছল। দুমুঠো ভাত আর জীবনের প্রয়োজনগুলো মেয়ে মিটিয়ে নিতে পারবে। এ প্রত্যাশায় মেয়েকে বিয়ে দেয়। চির দুঃখের সংসারে আব্দুস সোবহান কিছুটা স্বস্তি চেয়েছিল, চেয়েছিল মুক্তি। মেয়ের তালাক হয়েছে শুনে যেন তিনি বজ্রাহত হলেন। কিন্তু আব্দুস সোবহানকে বিস্মিত করে তারামন। তারামন মুক্তির আনন্দে উজ্জ্বল, উদ্দাম। সে দুঃখিত হয় না। যেন তার নবজন্ম হয়।

তারামন কাপড়ের পুটলি বুকে চেপে ধান খেতে নেমে আসে মুক্তির আনন্দে। টুকটুকে লাল ফড়িংয়ের পিছে সে ছুঁটে বেড়ায় ধরার জন্য। বাবা আব্দুস সোবহান চিন্তিত মুখে মেয়ের দিকে তাকায়। তারামনের আত্মসম্মানবোধ অত্যন্ত প্রখর। আর এই আত্মসম্মানবোধের স্ফুলিঙ্গ বাবাকে আশাবাদী করে তোলে। একদিন আগেই সে স্বামীর কাছ থেকে তালাক শব্দ শুনেছে অথচ তারামন জানে না কেন তার তালাক হয়েছে। স্বামীর হাতে প্রতিনিয়ত মার খেয়েছে সে। তালাক শব্দের সাথে তারামনের আনন্দ মিশ্রিত ছিলÑএ আনন্দ মুক্তির এ আনন্দ আত্মানুসন্ধানের। এ মুক্তির আনন্দ বোন বেনুর সাথে সে এভাবেবই প্রকাশ করেছে :

‘বেনু তুই ঠিক বলেছিস। এ বিয়ে টিকবে না। মৃগী রোগীর সাথে ঘর কী ? অমন ঘরের মুখে ছাই।’

                         (যুদ্ধ)

এ উপলব্ধিজাত অনুভূতির সাথে সমাজ সংসারে তার আশ্রয় আর বেঁচে থাকার অধিকারবোধই এখানে সোচ্চার হয়েছে। সে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে এ সমাজ সংসারকে ? প্রকৃতির দক্ষিণা বাতাস নদীর কুলকুল শব্দ বাংলার প্রকৃতিঘেরা লাল-সবুজের মেল-বন্ধন তাকে নতুন জীবনের স্বাদ এনে দিয়েছে।

মুক্তির আলোয় এক সময় বাবার সাথে সে তার মার কাছে পৌঁছে যায়। তালাকের কথা শোনার পর মা কুলসুম তাকে পেটাতে থাকে। সমাজ সংসারে তালাকপ্রাপ্তা নারীর বঞ্চিত জীবনই কুলসুমকে অসহায় ও আতঙ্কিত করে। মেয়ে কেন ঘর সংসার করতে পারলো না। চির দুঃখের সংসারে তারামনের আবার ফিরে আসাকে মা মেনে নিতে পারে না। কিন্তু তারামন ছিল নির্বিকার। বোন লাল ভানু আর মায়ের অপমান তাকে লজ্জিত করেনি বরং বঞ্চনা থেকে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছে।

তারামনের দেখার দৃষ্টি আলাদা, চেতনা জগৎ আলাদা-সেখানে স্বাধীনতা আর মুক্তি ছাড়া কিছু নেই। মেয়ের আত্মিক মুক্তির স্বাদ বাবার মনে নতুন দিনের স্বপ্ন এনে দিয়েছে।

দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী এক নেতা অসীম সম্ভাবনার বীজ বপন করে দেয় বাঙালি জাতির হৃদয়ে। হঠাৎ হঠাৎ তার উপস্থিতি হয় আর যুদ্ধাহত অসহায় মানুষগুলো আশার আলো দিয়ে যায়।

নেতার লক্ষ্যই থাকে জাতি যেন যুদ্ধে শক্তি অর্জন করতে পারে, কৌশল ঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারে, দিতে পারে দিক নির্দেশনা। যুদ্ধের সময় অমিত সম্ভাবনার বীজমন্ত্র যার হাতে, নিয়ত সাহস সঞ্চয়কারী সে লোকটির পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক বুদ্ধিমত্তার সাথে বলেছেন :

‘লোকটি অনবরত হেঁটে যায়। ওদের কোনও নির্দিষ্ট বাড়ি নেই। গ্রাম নেই, শহর নেই। ও কোনও বিশেষ নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ায় না। ওর নিজস্ব কোন মেঠো পথ নেই কিংবা পাকা সড়ক, যে পথে ওকে বার বার যেতে হয়। ওর অবাধ গতি সর্বত্র। ও শুধু যেতে শিখেছে।’

 (যুদ্ধ)

এই যে চলমানতাবোধ, কৌশল আর বুদ্ধিমত্তাই যেন যুদ্ধজয়ের ইতিহাস রচনা করেছে। এ চলমানতা অন্য কোন কাজে যাওয়া নয়। এ যাওয়া শুধুই যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়া। যুদ্ধ থেকে সাফল্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ চলার কোনও বিরাম নেই। বাংলার সবুজ-শ্যামল সুন্দরবন খেলে যায় তার চোখে।

যুদ্ধের সময় পাকিস্তান আর্মিরা দিনের পর দিন মানুষ মারছে। মানুষের শরীর থেকে মাংসের কুচি বার করে দিচ্ছে। কীত্তনখোলা নদীর পাড়ে লাশ ফেলে দেয়। বার বার ব্রাশ ফায়ারে কেঁপে ওঠে যুদ্ধের ময়দান। কীত্তনখোলার নদীর বুকে টেনে নেয় চির দুঃখী বাংলার মানুষকে।

যুদ্ধ মানুষের মানবিক চেতনাবোধ দৃঢ় করে। মানুষকে অসাম্প্রদায়িক করে। যুদ্ধ কখনও জাতিগত ভেদাভেদ উস্কে দেয় না বরং আলাদা করে কে হিন্দু কে মুসলিম তা কেউ যুদ্ধের সময় মনে রাখে না। সুভাস পরিবারের জোয়ান ছেলে দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। বাবা নিখিল মা সরলা প্রতিনিয়ত আতঙ্কিত থাকে ছেলের জন্য। বড় ছেলে দেবেশের বয়স বাইশ বছর। সুভাসই তাদের একমাত্র ছেলে সেও যুদ্ধে গেছে। সরলার আট মেয়ে বিয়ে হয়েছে সবার, লক্ষ্মী-স্বরস্বতী ছাড়া। দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পুরো পরিবার একাট্টা। যুদ্ধের সময় ঘরে বসে থাকলে আত্মমর্যাদা রক্তাক্ত হয়Ñএ সত্য লেখক নিষ্ঠার সাথে সুভাসের চরিত্রের মাঝে প্রকাশ করেছেন। যুদ্ধে মারা গেলেও সে যেন মরে নাÑঅনন্ত তৃষ্ণায় বেঁচে থাকে। যুদ্ধ তার চেতনার নিজ ভূমিতে। দেবেশ হারিয়ে গেলেও লাল টুকটুকে সিঁদুর পরে থাকে সুষমা। হয়তো সে চেতনার অতল স্পর্শে অবচেতনের গভীর থেকে সিঁথির সিঁদুর জ¦ল জ¦ল করে তার সিঁথিতে।

দেবেশ বুকে ধারণ করে বাংলা ভাষার চেতনা। ভাষা আন্দোলনের সময় মায়ের ভাষাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য তার আকুতি লেখক অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। বাপ-দাদার ভিটে মাটি ছেড়ে তারা কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতে পারে না। বাংলাদেশ তাদের নিজ দেশÑযার সাথে তাদের আজন্মের বন্ধন। তাই নিখিল একদিন তার বাবাকে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছে :

‘আমি তেমন ছেলে নই বাবা ভিটেমাটি ছেড়ে পালাব।… ইন্ডিয়া কেন যাব ? ইন্ডিয়া কি আমার দেশ ?… দেশ ভাগের সময় তুমি যাওনি। উল্টো জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সাথে ঝগড়া করেছ… এটা জয় বাংলার সময়, দেশটা স্বাধীন হবে গো বাবা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলে আটক আছে শুনেছি। শুনেছি দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য নিজে ধরা দিয়েছেন। এখন আমাদের জোয়ান ছেলেগুলো যুদ্ধ করবে। আর্মি যদি ওদের ধরে নিয়ে যায় তবে বুঝতে হবে ওরাও দেশের জন্য মরছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে মরা আর নির্যাতনে মরা দুটোই সমান।’

 (যুদ্ধ)

যুদ্ধের মাঝে বেঁচে থাকার সংকট, মূল্যবোধের রূপান্তর ধর্মীয় বিশ^াস স্বজন হারানোর বেদনা মৃত্যুর ভিতর দিয়েও জীবন শাশ^তকালের আবহ নিয়ে এগিয়ে যায়।

যুদ্ধের সময় কৌশল করে বেঁচে থাকতে হয়। সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেললে কাউকে হারানো হয় না। কারণ হারানোর দায়িত্বটা আসলে নিজেকেই নিতে হয়। যুদ্ধের সময় চৌদ্দ পুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে নিখিল দেশ ত্যাগ করতে চায় না। অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ লেখক আত্মিক সত্তার মধ্যে অনুভব করেছেন। আমাদের মনোজগতের যে ধর্মবোধ তা যে সমাজাদর্শ দ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত তা লেখক সচেতনভাবে প্রকাশ করেছেন।

স্বাধীনতার শক্তি ধারণকারী যে লোকটি পুরো দেশ ও জাতির বিবেক হয়ে চষে বেড়াচ্ছে যার কোন নাম নেই। শ্রেণি নেই, নেই আত্মপরিচয়ের আড়ম্বর সে-ই স্বাধীনতার অমিত সম্ভাবনার বীজ বুকে ধারণ করেছে। তার মনোজগতের চেতনাপুঞ্জের ঘনীভূত প্রতিরূপই স্বাধীনতার রূপ। স্বাধীনতাকামী একটি জাতীয় অস্তিত্বকে লোকটি তার চেতনায় ধারণ করেছে। যুদ্ধের পুরো ঘটনাকে সে দৃষ্টিগ্রাহ্য করেছে এভাবেই :

‘জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে মাতিয়ে তুলেছে আমবাগান। লোকটি লক্ষ্য করে আমবাগানের চারপাশে অবস্থান নিয়েছে কমান্ড সদস্যরা। যদি পাকিস্তান আর্মি আক্রমণ করে তাহলে তারা রক্ষাব্যুহ তৈরি করবে। লোকটি ওদের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।… লোকটি মৃদু হেসে হাত তোলে। ওরা নির্বিকার। পলকহীন তাকিয়ে আছে। এখন ওদের ডিউটি। সৌজন্য বিনিময়ের সময় না। লোকটি খুশি হয়ে মাথা নাড়ে। তারপর ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়।’

(যুদ্ধ)

আমাদের স্বাধীনতার মৃলীভূত চেতনার গভীর স্তরকে লেখক তার কলমের ডগায় উজ্জীবিত করেছেন এভাবেইÑ

‘মাইকে বলা হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পাকিস্তানে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে তিন উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ।… লোকটি মঞ্চের এই অসাধারণ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে।… সৈয়দ নজরুল ইসলাম এসে দাঁড়ালেন পতাকার সামনে। আস্তে আস্তে পতাকা উঠে যাচ্ছে উপরে। তিনি উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। স্থির দৃষ্টি-স্বাধীনতার পরিপূর্ণ স্বপ্ন তার দুচোখের দৃষ্টিতে। লোকটির মনে হলো ওর নিজের মাথার উপরে গ্রথিত বাঁশে উড়ছে পতাকা। ওই পতাকা নিয়ে হেঁটে যাবে প্রতিটি ঘরে-প্রতিটি মানুষের কাছে।’

স্বাধীনতা অর্জনের এরূপ নাটকীয় বর্ণনা কৌশল সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ দিয়ে লেখক বিবেচনা করেছেন।

যুদ্ধ উপন্যাসে চৌদ্দ বছরের ছেলেটিকে আমরা দেখেছি যে গরু নিয়ে মাঠ থেকে ফিরেছেÑসেও স্বাধীনতার চেতনাকে বহন করেছে। সে মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়। যুদ্ধে তাকে না নিলে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতের থালা সে এগিয়ে দেবে। মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুকের নল পরিষ্কার করে দেবে।

কাউকে খবর পৌঁছানোর হলে সে পৌঁছে দেবে। তার চেতনায় মুক্তিযুদ্ধকে এভাবেই সে ধারণ করেছে। তাকে কি আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলব না ? তেমনিভাবে তারামন, কুলসুম, রবি, নবি এরা সবাই যেন যুদ্ধ মেখে রাখে দেহ-মনে।

তারামন সর্বজ্ঞদৃষ্টিকোণ দিয়ে যুদ্ধকে আকড়ে ধরে, বড় ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে মিলিটারি এ পাড়ে আসতে পারবে না তারামনের অপ্রতিরোধ্য প্রতিরোধের জন্য। স্বাধীনতার চেতনায় শাশ^তকালের রহস্যময়তা বহন করে চলেছে তারামন বিবি। পরিবারকে যুদ্ধের ভয়ে বিপদগ্রস্ত দেখেও চিত্রধর্মীর এরূপ বর্ণনা ঔপন্যাসিকের পক্ষেই সম্ভব।

প্রাণে বাঁচতে যখন তারামন বিবিরা সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে যায় তখন যাত্রাপথে তারামন একটি বুনো ফুলে ছিঁড়ে বোন লাল ভানুর দিকে সযত্নে এগিয়ে দেয়Ñএই এগিয়ে দেয়া যেন চেতনায় স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনে দেয়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারামন মনে প্রাণে ধারণ করেছেÑউড়ে গিয়ে সে যেন স্বাধীনতার মুক্তি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে।

চিত্ররূপময়, দৃশ্যানুগ এবং নাটকীয় বর্ণনা কৌশল অবলম্বন করে লেখক যেন স্বাধীনতার বীজমন্ত্রকে অন্তর্লক্ষণ দ্বারা আলাদা গতিময়তায় উজ্জীবিত করেছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর অমিত তেজ আর সম্ভাবনাকে তারামন বুকে ধারণ করেছেÑযেন সে বঙ্গবন্ধু হতে চেয়েছে। চেয়েছে নেতা হতে। যখন যুদ্ধে যেতে চেয়েছে তখন তার চোখ দুটো উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত জ¦লে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের রাইফেল যখন সে স্পর্শ করে সারা গ্রাম যেন তার সামনে দুলে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধার রাইফেল উচিয়ে তার উপলব্ধিজাত আত্মিক অনূভূতিকে শাণিত করে সে স্বাধীনতাকে তরান্বিত করেছে এভাবে :

‘হ্যাঁ আমি নেতা হবো।… পানি তুই সবখানে চলে যা। সবাইকে বলে দে তারামন নেতা হতে চায়। ফড়িং তুই সবখানে উড়ে যা সবাইকে বলে দে তারামত নেতা হতে চায়। বাতাস আমি নেতা হব। তুই আমাকে উড়িয়ে সবখানে নিয়ে যায়। সব গাঁয়ে সব মানুষের ঘরে ঘরে। তারামনের মনে হয় উত্তেজনায় ওর ভিতরটা থরথর করে কাঁপছে। ও এক ছুটে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চায়।’

                (যুদ্ধ)

স্বাধীনতার সমস্ত অনিশ্চয়তাকে দূরে ঠেলে তারামন অস্ত্রহাতে উঠিয়ে বলতে পেরেছিল জয় বাংলা। তারামনের কণ্ঠে যেন ব্রহ্মপুত্রের গর্জন। তারামন অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে জনযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করেছে। এর মাধ্যমে উপন্যাসকে মহত্তর পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

সৃজনশীল সাধনার ব্যাপকতা থাকার ফলে স্বাধীনতা আর মুক্তির ঐক্যে পৌঁছাতে লেখকের আত্মবিশ^াস ও চিন্তার শৃঙ্খলা জীবন বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। লেখক নিজের ভিতরেও স্বাধীনতার বাস্তবতাবোধকে অনুসন্ধান করেছেন। তাই তারামনের জীবন অনুসন্ধান স্পৃহা লেখককে এত উজ্জীবিত রেখেছে যা তার জীবন দর্শনজাত ঔজ্জ্বল্য।

পৃথিবীতে কখনও যুদ্ধ নিয়ম মানেনি। মানবতার স্খলন উন্মত্ততা বহুবর্ণিল আকারেও ধরা দেয়। জীবন হয়ে ওঠে বিক্ষুব্ধ। যুদ্ধ কখনও সমান্তরালভাবে প্রভাবিত হয় না, নিয়ম নীতি মানে না। তেমনি যুদ্ধের সময় পাকিস্তান মিলিটারি নষ্টামিকে তাদের অধিকার বলে জেনেছেÑ তাই তারা সে অধিকার অর্জন করে উল্লাসে ফেটে পড়েছে। সৈনিকের জন্য যুদ্ধের সময় সব অনিয়মই নিয়ম। তাদের উল্লাস আমরা এভাবেই দেখেছি :

‘বেনুকে যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যায় জিপে করে। বেনুর মা তখন মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদে। বোনকে ধরে নিয়ে গেছে বলে বেনুর জীবনের অনিশ্চয়তাবোধ দুঃসহ আকার ধারণ করে। ও বুঝতে পারে না এ যাওয়া কেমন যাওয়া।’

                                     (যুদ্ধ)

যুদ্ধের সময় দুঃখ জীবনের ইতিহাস আমাদের সাময়িক প্রবঞ্চিত করে বটে তবে লেখক একথা বলতে ভোলেননি। অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ তাকে স্বপ্নচারী করেছে প্রতিনিয়ত। যুদ্ধের সময় নিখিলকে দেখেছি বাজারে গেলে টুপি মাথায় রাখে। সে আযান দেয়া শিখেছেÑ পরিবারের সবাইকে কলেমা মুখস্থ করে রাখতে বলে।

যুদ্ধের সময় যুদ্ধ ক্ষেত্রে না গিয়েও চেতনায় যুদ্ধকে লালন করে মানুষ। আর সে চেতনার সুখই যুদ্ধ। সে যুদ্ধের আনন্দ আমরা হেমন্ত আর স্বরস্বতীর জীবনে দেখেছি এভাবেই :

‘হেমন্ত যখন বলে, যুদ্ধ একটা চুমু। তখন স্বরস্বতী শারীরিক কামনায় নয়, মানসিক আবেগে বিহবল হয়ে ওঠে। গভীর চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে হেমন্ত বলে, তোমাকে শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে যদি আমি মরে যাই, তাহলে আমার কোনও দুঃখ থাকবে না। আমিতো তোমার মানুষ হয়েছি স্বরস্বতী। আমি গ্রেনেড খেলা শিখেছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যেসব গান মুক্তিযোদ্ধাদের মাতিয়ে তোলে আমি তার সঙ্গে তবলা বাজাই। আমি ওদের শরীরে ঢুকে যাচ্ছি। ওদেরকে মাতিয়ে তুলছি আর ওরা জয় বাংলা বলে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেÑতখন সেটা আমার যুদ্ধ হয়।’                                                         

(যুদ্ধ) 

যুদ্ধের সময় প্রকৃতির অনুষঙ্গও একাত্ম হয়ে যায়। যখন মিলিটারির গাড়ি যায়, রাস্তা গুম গুম করেÑসেই শব্দে কেঁপে ওঠে পুকুরের জল, ভিটেমাটি-গাছের পাতা থেকে উড়ে যায় পাখি।

যুদ্ধের সময় সব অনিয়মই নিয়ম হয়ে যায়। সব অসম্ভবই সম্ভব। জানাজা পড়াতেও ছেলে মেয়ে নেইÑমানবতাবোধই প্রবল। সব সংস্কারকে ভেঙে সমান্তরাল করে দেয় যুদ্ধ। যুদ্ধ মানুষকে মানুষ করে দেয়। যুদ্ধ এক ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মের করে দেয়। যুদ্ধের কোন মাস নেই, বছর নেইÑশুধু আছে দিনের হিসেবে বেঁচে থাকা। যুদ্ধের সময় মানুষ জীবন দিয়েছে, মেয়ে দিয়েছে, ভিটে দিয়েছে আর কি দিতে হবে ? এ প্রশ্ন যেন সেদিন বিশ^ বিবেককেও তাড়িত করেছিল। বেনুর সাথে মাখনের ভালবাসা ছিল। স্বপ্ন ছিল নীড় বাঁধার।

বেনুর গর্ভ হওয়াকে সে অঙ্গ যখম বলে চিকিৎসা করতে বলে মাকে। সে দায় বুড়ির কাছে রুদ্ধোশ^াসে গর্ভ ফেলার ঔষধ চায়। এ ঔষধ বেনুর ভবিষ্যতের জন্য ভীষণ প্রয়োজন। গর্ভপাত বেনু করতে পারেনি। গর্ভ বড় হতে থাকে। শরীরের মধ্যে শরীরের উপস্থিতি সে টের পায়। মাখনের সাথে ভালবাসার সম্পর্কে সে বলেÑ ‘যুদ্ধে আমার অঙ্গ যখম হয়েছেÑআমি ভালো হয়ে যাব, আমি তোমারই আছি। পেটের ভিতর যুদ্ধ নিয়ে বেনু ঘুরে বেড়ায়। গর্ভ হওয়ার জন্য বেনুর মা যখন মেয়েকে হারামজাদি বলে গাল দেয় তখন বেনু মায়ের সামনে কঠিন দৃষ্টি মেলে দেয়Ñসে দৃষ্টির সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। বেনু উত্তেজিত হয়ে মাখনকে বলে, গর্ভ কীসের গর্ভ এটা জরায়ুুর জখম। তুমি দিয়েছ পা, আমি দিয়েছি জরায়ুু। যুদ্ধ শিশুই হবে আমাদের যুদ্ধের সাক্ষী।’

যুদ্ধের সময় কর্নেল তাহেরের বীরত্বের কথা আমরা ভুলব না। তারামনের দুপায়ের জোড়ে মনে হয় তাহেরর খণ্ডিত পা যুক্ত হয়েছেÑসমস্ত দেশে যেন সে পা ছুঁটে বেড়ায় স্বাধীনতার জন্য।

যুদ্ধের সময় পুরো দেশে এক প্রতীকী শক্তি ঘুরে বেড়িয়েছে। সে আর কেউ নয় যার ডাকে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি সে নেতৃত্বদানকারী নেতা। সে যুদ্ধের সাহসী চেতনা পৌঁছে দিয়েছে সবার মধ্যে। এ শক্তি বাঙালি জাতির আত্মিক শক্তি। যুদ্ধের সময় সে শক্তি একটি মিথ হয়ে কাজ করেছে। যার নাম বঙ্গবন্ধু। এই মিথের উপরই আমরা আমাদের শক্তিকে এক করে যুদ্ধে লড়েছি। আর এই শক্তির অপর নাম স্বাধীনতা।

যুদ্ধ উপন্যাসে যুদ্ধের মধ্যে ব্যক্তির বেঁচে থাকার সংকট, মূল্যবোধের রূপান্তর, ধর্মীয় বিশ^াসে আঘাত, স্বজন হারানোর বেদনা, মৃত্যুর ভিতর দিয়েও জীবন শাশ্বতকালের আহ্বান নিয়ে এগিয়ে যায়।

কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন যুদ্ধ উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে সর্বদা একটি রাজনৈতিক চেতনাবোধ দ্বারা বেষ্টিত থেকেছেন। সামাজিক দায় পূরণ করার জন্য একজন মানুষের সোস্যাল কমিটম্যান্ট থাকাটা তিনি খুব জরুরি মনে করেছেন। ঔপন্যাসিক শিল্পের শরীরকে পুষ্ট করতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের কারণে মানুষের জীবন-যাপনের পরিবর্তনকে শিল্পসম্মতভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে রাজনৈতিক সচেতনতাবোধকে লেখক এভাবেই উপস্থাপিত করেছেনÑমানুষ সরাসরি যুদ্ধ না করেও যুদ্ধের মাধ্যমে মানুষের মূল্যবোধগুলো কীভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে সেগুলো দেখাতে চেয়েছেন। যেমনÑএতে একটি ফ্যামিলি আছে, হিন্দু পরিবার। সেখানে যে ব্যক্তিকে মসজিদে যেতে হচ্ছে তার ফলে পুরো ফ্যামিলি আহত হচ্ছে, তার ধর্মীয় বিশ^াস আহত হচ্ছে। যুদ্ধ মানে এই নয় যে, সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া। যুদ্ধ উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে আমি কিছু ফিলসফিক্যাল কথা বলার চেষ্টা করেছি। যেখানে ধর্মীয় বিশ^াসÑযা আমাদের জীবন-যাপনের অঙ্গ সেটা আহত হচ্ছে। সেখানে নারীর সতীত্ব নষ্ট হচ্ছে। সে ধর্ষিত হচ্ছে। সেই শিশুটিকে রাখবে কি রাখবে না :

‘সেই সিদ্ধান্ত একজন নারীকে নিতে হচ্ছে, যতই সে যুদ্ধের শিশু হোক। আবার একটি মেয়ে বলছে যে, তার প্রেমিকের যুদ্ধে পা কাটা গেলে সে যদি মুক্তিযোদ্ধা হয়, তাহলে সে ধর্ষিত হওয়ার ফলে তার জরায়ুতে ক্ষত হচ্ছে। সে নিজেও মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের মূল অনুভবকে আমি এভাবে দেখাতে চেয়েছি। মানুষটি অনবরত যাচ্ছে। লোকটি এই জন্য যে, সারা দেশের মানুষ যুদ্ধে সামিল হচ্ছে। কাজেই একটি নাম দিয়ে আমি প্রতীকায়িত করতে চাই না। লোকটি মানে অজস্র লোক লক্ষ লক্ষ লোক, কোটি কোটি লোক সাত কোটি লোক।’

সেলিনা হোসেনের যুদ্ধ উপন্যাস আমরা আলাদা মাত্রায় উপস্থাপিত হতে দেখেছি। একটি ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক কালকে তিনি উপাত্ত করে উপন্যাস লিখেছেন যেখানে তার চিন্তা-চেতনা ও মননবোধের উন্মেষ ঘটেছে। আবেগ সেখানে প্রশয় পায়নি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর যোদ্ধারা যেমন জীবন বাজি রাখা সাহসের উপর ভিত্তি করে জীবনপণ লড়াই করেছে। তেমনি পাকিস্তানের যোদ্ধারাও যে বৃহৎ ক্ষমতাশালী ছিল তাও আমরা এ উপন্যাসে উপস্থাপিত হতে দেখেছি। যুদ্ধের মূল সত্তাকে যদি আমরা উপন্যাসে উপস্থাপন সত্যাসত্যভাবে করতে যাই তাকে সমালোচক এভাবেই মন্তব্য করেছেনÑ

‘একটি প্রলয়ঙ্করী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত ঔপন্যাসিকের পক্ষেই সম্ভব মুক্তিযুদ্ধের রক্তোজ্জ্বল চেতনার শিল্পরূপ নির্মাণ। যুদ্ধরত সমস্ত জাতিসত্তার প্রাণস্পন্দনকে শিল্পমণ্ডিত করতে গেলে যে গভীর জীবনীশক্তি এবং শৈল্পিক নিরাসঙ্গ প্রয়োজন, কতিপয় ব্যতিক্রম বাদে আমাদের উপন্যাসে এই অনিবার্য সমন্বয় তেমন লক্ষ করা যায় না।’

সেলিনা হোসেনের যুদ্ধ উপন্যাসে যুদ্ধকে আমরা বিশাল পটভূমিতে উপস্থাপিত হতে দেখেছি। সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে পূর্বকালীন সমসাময়িক পরিস্থিতির যেমন বর্ণনা সেখানে উপস্থিত তেমনি পাকিস্তান শাসকদের অত্যাচার, নিপীড়ন আর শোষণের বর্ণনাও আছে। লড়াইয়ের অপ্রতিরোধ্য একটা শক্তি আমরা সেখানে দেখছি যা যুদ্ধ উপন্যাসকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।

যুদ্ধ উপন্যাস সম্পর্কে লেখিকা বলেছেন :

‘যুদ্ধ উপন্যাসটি আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে একটি বড় ক্যানভাসে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এখানে সরাসরি যুদ্ধের ১১নং সেক্টরের কথা যেমন এসেছে, তেমনি যুদ্ধের সময় উদ্ভুত পরিস্থিতি, মূল্যবোধে আঘাত এবং মানুষের মানসিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং যুদ্ধের ফলে তৈরি সংকট, উদ্ভূত পরিস্থিতি তাদের জীবনে কি অভিঘাত সৃষ্টি করেছে এই সমস্ত কিছু নিয়েই আমি যুদ্ধ উপন্যাস রচনা করেছি।’

লেখিকা আরও বলেছেন :

‘যুদ্ধের ক্যানভাসটি সমগ্র বাংলাদেশ। এখানে প্রতিটি মানুষই যুদ্ধে যাচ্ছে। লোকটি অনবরত যাওয়ার অর্থ যুদ্ধে যাওয়া। এখানে আমি মূল্যবোধে আঘাত করার চেষ্টা করেছি। এখানে একটি মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে, যুদ্ধের যাবতীয় অনুভব স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা নিজের মধ্য ধারণ করে। তাহলে আমি তাকে ধর্ষিতা হয়েছে বলব কেন ? যে অর্থে ছেলেটি পা হারিয়েছে সে অর্থে মেয়েটির শরীরের একটি অঙ্গ ক্ষত হয়েছে বলে স্বীকার করতে হবে।’

সেলিনা হোসেনের যুদ্ধ উপন্যাস আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক বড় এক সম্পদÑএকটি বৃহৎ অর্জন। যে যুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। আত্মিক মুক্তির জায়গা থেকে সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং তাদের একমাত্র লক্ষ্যই ছিল মুক্তি অর্জন।

ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন আত্মজিজ্ঞাসায় সমাজ গর্ভের শেকড় সন্ধানী হয়েছেন। দেশ ভাগের পর বাঙালির জীবনে নেমে এসেছিল ভয়ংকর সমাপ্তি আর তখনই তাঁর দীপ্ত আবির্ভাব আমাদের আশান্বিত করেছে। দলিল, শোষিত, নিষ্পেষিত, অধিকারহারা যে জীবন সে জনজীবনের সহযাত্রী হয়েছেন সাহিত্যের অতন্দ্রপ্রহরী সেলিনা হোসেন।

 লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button