আর্কাইভবইকথা

নিশাত জাহান রানা সম্পাদিত জনগল্প ’৭১ : রাজিউদ্দীন আহমাদ

বইকথা

২০১৮ সালে যখন দেশে এসেছিলাম তখন আমার ছোটভাই মানিক বললে, আমাদের এক বন্ধু, নিশাত জাহান রানা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ যাঁরা দেখেছেন তাঁদের তখনকার অভিজ্ঞতার গল্প সংগ্রহ করে সেগুলো ছেপে প্রকাশ করার একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আপনি একটা লেখা দিতে পারবেন? আমি বললাম, অসুবিধা নেই, দেওয়া যাবে; কিন্তু, কখন লাগবে? মানিক বললে, আপনি নিজেই কথা বলে নিয়েন। আমি রানাকে আপনার সক্সেগ কথা বলে নিতে বলব। এরপর রানার ফোন পেলাম, কথা বললাম কিন্তু ভালোভাবে কিছু বুঝতে পারলাম না। লেখা চায় কিন্তু সে লেখাতে যুদ্ধে আমার অবদান বা সে ধরনের বিশদ কোনও বিবরণ সে চায় না। তার কথা হলো, এমন লেখা তো ’৭১-এর পর থেকে মানুষ লিখেই যাচ্ছেন; সে চায় আমি যা দেখেছি তার বিবরণ। লিখলাম কানাডায় ফেরার আগেই, সম্ভবত ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। তাকে দিয়ে চলে গেলাম। এরপরে আর কিছু জানি না। ভেবেছি, যেমন লেখা রানা চায় তেমন হয়তো আমি লিখতে পারিনি। এবার (২০২০) দেশে আসার পরে আমার সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে কিছু লিখে দেবার জন্য নভেম্বরে রানার একটা মেসেজ পেলাম। যা দিয়েছিলাম তা হয়তো তার পছন্দ হয়নি, তাই সে জানাল, আমি একটা বানিয়ে নিলাম রাজিভাই। কষ্ট দিলাম আপনাকে। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ রানার কাছ থেকে আর একটা মেসেজ পেলাম। আপনি দেশেই আছেন তো? আজ আমাদের জনগল্প ‘৭১ (২য় খণ্ড) প্রকাশিত হলো। অনুগ্রহ করে আপনার ঠিকানাটা দিলে বই পাঠাব। পাঠিয়ে দিলাম ঠিকানা, বইও পেয়ে গেলাম যথাসময়ে। সক্সেগ ছোট্ট একটা চিঠি। ১২৭ পৃষ্ঠার সুন্দর রুচিসম্মত একটা বই। স্বভাবমত পড়ে ফেললাম প্রথম প্রচ্ছদ থেকে শেষ প্রচ্ছদ পর্যন্ত। মোট তেরোটা লেখা ছাপানো হয়েছে, আমার লেখাটা দশ নম্বরে। লক্ষ্য করলাম, আমার আগের নয়জন প্রত্যেকেরই জন্ম আমার আগে এবং পরের তিনজনের জন্ম আমার পরে।

চিঠি থেকে জানতে পারলাম, চাইলে বইটার আরও কিছু কপি আমি শতকরা ৩০ ভাগ কম দামে সংগ্রহ করতে পারি। আমি প্রথম খণ্ডের একটা কপি এবং দ্বিতীয় খণ্ডের কয়েকটা কপি পাঠাতে বললাম এবং সময়মত পেয়েও গেলাম। প্রথম খণ্ডে ১২৮ পৃষ্ঠায় মোট ২৬ জনের লেখা ছিল; প্রচ্ছদ একই কেবল রঙ আলাদাÑ প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০১৯; অর্থাৎ তখনও আমি দেশেই ছিলাম। এই প্রথম খণ্ডে রানার লেখা প্রেক্ষাপটটি পড়ে বুঝতে পারলাম তার এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য এবং সে ঠিক কী ধরনের লেখা খুঁজছিল। উদ্দেশ্যটা জেনে আমার খুব ভালো লাগল। আমার অনেক স্বপ্নের এটা যেন একটা যা পূর্ণ হতে চলেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে যে বিষয় আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিত তা হলো স্বাধীনতার লড়াইয়ের উপকরণগুলোর হিসেব ঠিকমত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না করা। সমমনা কাউকে পেলেই বিস্ময়ের সক্সেগ এ বিষয়ে আলাপ করতাম; সরকার, বিশেষ করে, মুজিব সরকারের নিকুচি করতাম; ভিতরে ভিতরে ক্ষোভে ফেটে পড়তাম কিন্তু নিজে যে কিছু করা যায় তা কখনও ভেবে দেখিনি। ভেবেই নিয়েছিলাম, এমন একটা বিশাল কাজ সরকার ছাড়া আর কে করবে! তাই যত ক্ষোভ সব সরকারের উপরে। নিসাত জাহান রানার জনগল্প ’৭১ প্রকল্পটি আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে যে, আমি কতটা বোকা ছিলাম Ñ আমার চিন্তা-ভাবনা কতটা সীমিত ছিল। আর কেবল আমি কেন, আমি যাঁদের সক্সেগ আলাপ করতাম তাঁদের মধ্যে একজনও তো এ কথা আমাকে বলেন নি! আমি আগাগোড়া একজন ভাল কর্মী, আমাকে বললে আমি তা বহু আগেই শুরু করতে পারতাম, কাজটা আরও এগিয়ে থাকত, আরও বহু মানুষকে আমরা পেতাম যাঁরা গত হয়ে গেছেন। সব কিছুই যে আমি চিন্তা করতে পারব বা আবিষ্কার করতে পারব এমন তো কোনো কথা নাই! যাকগে, better late than never- না হবার চেয়ে দেরীতে হওয়াও ভাল। কিন্তু বুঝতে পারলাম না, কাজটা শুরু করতে রানা এত দেরি করল কেন! যাকগে, শুরু তো হয়েছে। প্রথমেই তাই, এমন একটা কাজ শুরু করার জন্য রানাকে জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন। রানাকে আমি এও বলতে চাই যে, এ কাজ তুমি চালিয়ে যাবে―দেখবে অর্থ যোগানোর জন্য গৌরি সেনদের অভাব হবে না। সঙ্গে তোমার সাহায্যকারীও পাবে। একটা উপদেশ, তোমার সাহায্যকারীদের মধ্য থেকে এ কাজ তোমার অনুপস্থিতিতে চালিয়ে নেবার উপযুক্ত করে কিছু সহযোগীকে তৈরি করবে যেন কাজটা থেমে না যায়। নানান কারণে ক্রমেই তোমার কাজ কঠিন হতে থকবে, তার জন্যও তোমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

কেবল দুটা সংখ্যা বের হয়েছে। আমরা অনেক কিছুই জানতে ও দেখতে শুরু করেছি। কাজ যতই এগুবে আমরা আরও অনেক কিছু জানব ও দেখব। প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথা দিয়েই বলি… প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাই যেমন ব্যক্তির তেমনি দেশের ইতিহাসের উপকরণ। তিনি আরও বলেছেন, ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মৌখিক ইতিহাস। শেষের কথাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর সেই গুরুত্ব¡পূর্ণ ইতিহাসটাই আমরা পাব ব্যক্তিবর্গের বয়ান থেকে। মৌখিক ইতিহাস ঠিক আছে কিন্তু আমার মত সেগুলো রাস্তা-ঘাটে আর হোটেল-রেস্তোরায় বলে বেড়ালে তো আর হবে না, সেগুলো যথাযথভাবে নথিভুক্ত (recorded) হতে হবে আর সেটাই জনগল্প ’৭১। এটা চলমান থাকুক এই আমার কামনা।

এখানে আরও একটা গুরুত্ব¡পূর্ণ কথা আছে। সেটা হলো আগে-পরের বিষয়গুলোও কিন্তু একটা নির্ভরযোগ্য ও সঠিক ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এগুলো ছাড়া ইতিহাস বিকৃত হবার সমূহসম্ভাবনা থেকে যায়। লেখাগুলোর মধ্যে সে সমস্ত বিষয় ও উপাদান হয়তো আমরা কিছু কিছু পেয়ে যাব কিন্তু ততটা পাব বলে আমার মনে হয় না যদি না আমরা সুস্পষ্টভাবে সে পথে না এগোই বা লেখকদের বলে না দিই। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পরে সত্তরের ভোট আর সেই ভোটের ফলের কারণে বিরোধ যা আমাদের ঠেলে দিয়েছিল একটা যুদ্ধ লড়তে। যুদ্ধের পরেই বা আমরা কী করলাম যার জন্য প্রত্যক্ষ করতে হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নৃসংশতম হত্যাযজ্ঞ? একটা উদাহরণ দিয়ে একটু ব্যাখ্যা করে বলি।

বেশকিছু দিন থেকেই মোহাম্মদ লক্ষ্য করছিলেন, তিনি যখন কথা বলেন তখন সাহাবিদের মধ্যে কেউ কেউ কী যেন লিখতে থাকেন। এক দিন তিনি জিগ্যেসই করে বসলেন, আমি যখন কথা বলি তখন তোমরা কিছু লিখতে থাক। তা, তোমরা কী লেখ? একজন উত্তর দিলেন, হুজুর আপনি যেসব কথা বলেন সেগুলোই আমরা লিখে রাখার চেষ্টা করি যাতে করে আমাদের অবর্তমানে আপনার কথাগুলো হারিয়ে না যায়, বিকৃত না হয়, প্রকৃতটাই যেন মানুষ জানতে পারে। মোহাম্মদ সাহাবিদের কথা শুনলেন এবং একটু চিন্তা করে বললেন, লিখছ লিখ তবে এর দায়-দায়িত্ব কিন্তু আমি নিতে পারব না। মোহাম্মদের এই ছোট্ট বক্তব্য কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আগে-পরের কথা বা অবস্থার উপরে অন্য যেকোও একটি কথা বা কাজের গূঢ় ব্যাখ্যাগুলো নিহিত থাকে। যা-ই হোক, সাহাবিদের লেখাগুলো কিন্তু যত্নসহকারে কোথাও সংরক্ষিত ছিল না। মোহাম্মদের মৃত্যুর পরে, বিশেষ করে খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলের পরে, সমস্ত কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এগুলো মোহাম্মদের মৃত্যুরও পাঁচ-সাতশ বছর পরে ইমাম বোখারি, ইমাম হানাফি, ইমাম সাফি, ইমাম তিরমিজি প্রমুখ কঠর পরিশ্রম করে সংগ্রহ করেন যা আমরা হাদিস নামে চিনি। সেগুলোর পরে এ বিষয়ের পণ্ডিতগণ যাচাই-বাছাই করে সহি বা প্রকৃত শুদ্ধগুলো আমাদের উপহার দেবার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন আজও। তাই আমরা আজও নিশ্চিৎ নই কোনটা সঠিক আর কোনটা মনগড়া।

সুতরাং প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার করা যদি আমাদের মূল উদ্দেশ্য হয় তবে যুদ্ধের আগে-পরের বিষয়গুলোও অত্যন্ত মূল্যবান ও প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরে আমরা অনেকেই এর উপাদান খুঁজে পাই ১৯৪৮ সালে একটা ভিন্ন ভাষা আমাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার সংকল্পের মধ্যে, ৫২-তে পুনর্বার ভাষার উপরে সশন্ত্র আক্রমণের মধ্যে, ৫৪-তে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে টিকতে না দেওয়ার মধ্যে, এমন কি ৬৬-তে ৬-দফা দাবির মধ্যে! কিন্তু সত্যি কি তাই? ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবকে বিকৃত করে ১৯৪৭ সালে আমরা দুটো পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরোধিতা করলাম না কেন? পাঠান, পাজ্ঞাবি, সিন্ধি আর বালুচদের সঙ্গে আমাদের কী এমন সম্পর্ক ছিল যে তাদের নিয়েই আমাদের একটা দেশ হতে হবে? ভারতের অন্য কোনও অঞ্চলে কি মুসলমানদের আধিক্য ছিল না? তাঁরা যদি ভারতের অধিবাসী হয়ে টিকে থাকতে পারেন তবে আমরা পারলাম না কেন? আজ যদি কোনও কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভেঙে গিয়ে দুই বা পঞ্চাশটা স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়ে যায় তবে কি আমরা বলব এর বীজ সেই ১৭৭৬ সালেই রোপিত হয়েছিল বা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর পতনের বীজ যথাক্রমে ১৯১৭ ও ১৯৪৫ সালেই অঙ্কুরিত হয়েছিল? আমার মনে হয়, এমন উপসংহার সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই আগে-পিছের বিষয়গুলো এতটা মূল্যবান।

আমার মনে হয়, রানার এই প্রকল্পে কাজটি হয়ে যাবে। মানুষ যখন স্মৃতিচারণ করবেন তখন না চাইলেও এমনিতেই বহু তথ্য এসে যাবে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাহায্য করবে প্রকৃত ইতিহাসকে খুঁজে পেতে। সেখানেই এর সার্থকতা, সেখানেই এটা অমূল্য।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button