আর্কাইভবইকথা

মঈন শেখ-এর ফসলের ডাক : কৃষকবিপ্লবের ইশতিহার : শাহাদাৎ সরকার

বইকথা

বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে একশ্রেণির পাঠকের বড় অভিযোগ ‘অধিকাংশ গল্পকথকের সাহিত্যে এদেশের সমাজ-বাস্তবতা থাকে না’। নেতিবাচক ন্যারেটিভটি এই কারণেই আনা যে, মঈন শেখ ঐসব গোত্রের লেখক নন। বরং মঈন তার গল্পের ভিত গাঁথেন তার চেনা ভূগোলে এবং তাঁর দেখা জগতের মানুষদের নিয়ে গড়ে তোলেন আখ্যানমঞ্জরী।  কিছু লেখক আছেন যারা নিজ যোগ্যতা বলে হয়ে ওঠেন পাঠক প্রিয়। তাদের লেখায় তাদের পথ চলাকে করে তোলে মসৃণ। আর তিনি যা তুলে ধরেন পাঠক তা নিজের বলেই গ্রহণ করে। সেসব লেখায় থাকে না কথার কচকচানি, ইজমের বাহুল্যতা। তাতে থাকে এই চরাচরের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনা। থাকে সুখ-দুঃখের বয়ান। যে বয়ান তার দেখা। আমাদের দেখা। যে বাস্তবতার ভেতর দিয়েই হয়তো অনেকের বেড়ে ওঠাও। মঈন শেখ এই গোত্রীয় লেখক। তার লেখায় ফুটে ওঠে বাঙলা মুলকের মানুষের জীবন চিত্র। এই জীবনচিত্রের সফল কারিগর কথাশিল্পী মঈন শেখ। 

বাংলাদেশের সাহিত্যে মঈন শেখ পরিচিত নাম। আজকের দিনে তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। মঈন শেখ অনেকদিন ধরে গল্প লিখলেও আলোচনার কেন্দ্রে আসেন ‘কুসুম কথা’ লিখে। ‘কুসুম কথা’ তার প্রথম উপন্যাস। যা কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় (২০১৯) ছাপা হলে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপন্যাস পাঠকদের মধ্যে যথেষ্ট আশা জাগায়। আর বইমেলা ২০২২ সালে বাজারে এসেছে মঈন শেখের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ফসলের ডাক’। এটি অবশ্য বই আকারে প্রকাশের আগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে মাসিক ‘শব্দঘর’। প্রথমটা থেকে এটি সম্পূর্ণ আলাদা উপন্যাস। আলাদা বিষয়বস্তুর কারণে, আলাদা চরিত্রের নানামাত্রিক মুভমেন্টের কারণে। তবে এটিও প্রেমের উপন্যাস বটে। তবে যতটা মানব প্রেম, তার অধিক ফসল-প্রেম। ফসলের ডাক গ্রন্থের ব্যাক কভারে প্রকাশক লিখেছেন :

প্রেমের উপন্যাস ‘ফসলের ডাক’। তবে চাষাড়ে প্রেম। এখানে চাষা আভিধানিক সেই মূর্খ, অশিক্ষিত, অমার্জিত লোক নন। তাদের বোধের দেয়াল তথাকথিত শিক্ষিতের চেয়েও টানটান। এখানে আছে প্রেম আছে দ্রোহ; আছে আন্দোলন আছে তুষ্টি। আছে কৃষক, ছাত্র-জনতা আর রাষ্ট্র একই মহাসড়কে ওঠার তুষ্টি।

এই উপন্যাসের মূল গতি পেয়েছে তাসু মাস্টারের একটা সাইনবোর্ডকে কেন্দ্র করে। অবশ্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে লেখক কিছুটা সময় নিয়েছেন। তাসু মাস্টার জাতীয় নির্বাচনের আগ দিয়ে হঠাৎ এক দিন তিন রাস্তার মোড়ে ভোট বিক্রির একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে বসেন। বিষয়টি প্রথমে হাসি ঠাট্টার বস্তু হলেও ক্রমশ প্রতিটি দৈনিকের শিরোনামে পরিণত হয় একদিন। তাসু মাস্টারের যুক্তির কাছে হার মানে সবাই। সারা দেশের কৃষক এক হয় তাসুর ডাকে। আন্দোলনটা আর তাসুর থাকে না; হয়ে উঠে সারা দেশের কৃষকের। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। তবে এই আন্দোলন অতীতের কৃষক আন্দোলনের মতো নয়। যদিও অনেকে মিলাতে চান সেই আন্দোলনের সাথে। তাসু তাদের চিন্তা শুধরিয়ে দিতে চান। তার সাফ কথা―‘বটগাছের বীজ কোনদিন তেঁতুল বীজের মধ্যে লুকিয়ে থাকে না।’  আসলে সারা উপন্যাস জুড়ে কৃষকের একটাই দাবি প্রস্তাবিত হয়েছে, ফসলের ন্যায্য মূল্য।

ফসলের ডাকের নায়ক মিনহাজ হলেও কেন্দ্রীয় চরিত্র তাসু। পরবর্তীসময়ে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে তা তাসু মাস্টারকে কেন্দ্র করেই। মিনহাজ সেঁজুতি এই আন্দোলনকে নতুন নতুন ফর্মে ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশ জুড়ে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে। তারা হাটে বাজারে লোক জমিয়েছে, গান গেয়েছে, আবার নিজেদের উদ্দেশ্য সাধারণের মাঝে পুশ করেছে কায়দা করে। ঠিক তাবিজ বেচা হকারের মত। এই আন্দোলনের আর একটা বিষয় উপজিব্য হয়ে উঠেছে, তা হলো বিষয়কেন্দ্রিক গান। যেমন হাটের এক মজমায় লোক জোটাবার পর তারা গান ধরেছে : 

আয়রে চাষা ভাই জলদি ছুটে আয়

ডাক দিয়েছে তাসু দাদা থাকুক গায়ে লেগে কাদা

তবু ছুটে আয় বেলা বয়ে যায় ॥

মানুষ যা বোঝার তা বুঝে যায় নিমিষেই। এমন বেশকিছু গান আছে উপন্যাসে, যা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই উপন্যাসের একটি উজ্জ্বল চরিত্র আলো। আলো বেশ রসদ জুগিয়েছে পুরো উপন্যাস জুড়ে। আলো মিনহাজের ছোটবেলার খেলার সাথী। শৈশবে আলোর সাথে জঙ্গলের এক স্মৃতি মিনহাজকে সারা জীবন পোড়ায়। অনেক পরে যখন মিনহাজ বেশি করে পুড়তে লাগে, ততদিনে আলো হয়ে উঠেছে পসারিনী। তবু আলোর সাথে মাঝে মাঝে মিনহাজের দেখা হয়, কথা হয়। তাদের কথোপকথন পাঠকের কাছে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠে। আলো মাঝে মাঝে শহরে থাকে। হঠাৎ একদিন মিনহাজ আলোর কাছে যায়। আলো তাকে একটা বেদানা খেতে দেয়। ‘ফকফকে প্লেটে যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে দানাগুলো। প্লেটটা সামনে দিয়ে বলল―খাও। মিনু কোনও কিছু না বলেই দুটো দানা তুলে মুখে দিল।―‘ফলগুলো খুব মিষ্টি।’

‘গাছটা কিন্তু আমিই লাগিয়েছি গো। এটা হলো প্রথম ফল।’

‘প্রথম ফল আমাকে দিলে?’

‘প্রথম ফল সবার ভাগ্যে জোটে না গো। প্রথম ফল দেবতাকে দিতে হয়।’

‘আমাকে দিলে যে?’

‘ও তুমি বুঝবে না।’

‘তা বুঝালেই পার। আমি কী খুব বোকা?’

‘বোকাই তো। সেই ছোট্টকাল থেকেই বোকা। এখন আর বুদ্ধিমান সাজতে হবে না।’

‘আচ্ছা সাজব না।’ ছোট্ট জবাব দিল মিনু। সে এখন বেদানার দানাগুলো মুখে পুরে সামনের দাঁত দিয়ে একটা একটা করে ফাটাতে ব্যস্ত। যেন দানা ফাটানোর ঢঙে প্রমাণ দিতে চায়, সে বোকা নয়। যদিও বেদানার রস বাহিরে এসে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে ক্রমশ বোকা করে তুলছিল মিনুকে। আলো হাসে। আলোও মাঝে মাঝে তুলে খায়। তবে দাঁত দিয়ে নয়, সে যেন ঠোঁট দিয়ে কোয়া ফাটাতে চায়। ফাটেও।’

ভাষা ডায়ালগ কিংবা নির্মাণ কৌশলে মঈন শেখ বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। অবশ্য মঈন শেখের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নীল পলাশ অথবা বউ বাসন্তী’তেই ভাষা ও নির্মাণ কৌশলের দক্ষতা দেখিয়েছেন। তার ভাষা নিয়ে আলোচনা করেছেন অনেকেই। ভাষাকে নিজের আয়ত্তে আনার দক্ষতা মঈন শেখের অসাধারণ। তার বলার ঢঙ আর বুনন ক্ষমতা পাঠককে পাঠে বাধ্য করে। যেমন ‘ডাকাডাকি’ পর্বের শুরুতেই লেখক একটা বড় বিষয়ের ছোট বর্ণনা দিয়েছে এভাবে―‘ঝিমুচ্ছে দেশ। ঝিমুচ্ছে সবাই। সাধারণ মানুষ ভাবছে। ছোট-বড়-পাতি, সব নেতারা ভাবছে। ভাবছে চিন্তক শ্রেণি। কেউ ভাবছে হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে। কেউ ভাবছে কপালে চোখ তুলে, বাতাস-শূন্য বুকে। কেউ ভাবছে হাতে কলম তুলে অন্যহাতে চুল খামছে ধরে। ভাবছে সবাই। ঝিমুচ্ছে দেশ।’

ভাষার পাশাপাশি উপন্যাসের গঠন কাঠামো বেশ আকর্ষণীয়। যেমন উপন্যাসের প্রথম পর্বের নাম প্রথম ডাক, এরপর দ্বিতীয় ডাক এবং সর্বশেষ ডাকাডাকি। প্রথম ডাক অংশে কৃষক আন্দোলনের বীজ বপিত হচ্ছে। দ্বিতীয় ডাকে আন্দোলন গ্রাম থেকে শহরে এমনকি সচেতন ছাত্রসমাজে ছড়িয়ে পড়ছে এবং ডাকাডাকি পর্বে আন্দোলন একটি ফলপ্রসূ রূপ লাভ করে। 

এই উপন্যাসে মঈন শেখ নতুন এক চিন্তার কথা বলেছেন। পুরো উপন্যাস জুড়েই রয়েছে একটা আন্দোলনের কথা, ফসলের ন্যায্য মূল্য আদায়ের কথা। তবে নেই কোন সংঘর্ষ, রক্ত ক্ষরণ কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পদের নাশ। অথচ আন্দোলন চলছে সারা দেশ জুড়ে। হ্যাঁ এ কথা ঠিক, তারা কিছু ধান নষ্ট করেছে শহরের বাইরের রাস্তাতে ছিটিয়ে। তবে আন্দোলন প্রক্রিয়াটায় ছিল নতুনত্ব আর অভিনব। এমন আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে বোধহয় এর আগে কেউ দেখেনি। এই আন্দোলন কেমন ছিলো তা লেখকের ভাষায় দেখি :

তাসুর ভোট-বিক্রির ক্যাম্প এখন আর নেই। তা হয়েছে আন্দোলনের ক্যাম্প। সেই মোড় এখন আন্দোলনকারীদের মোড়। কৃষকের মোড়। মোড়ের চেহারাতে এখন জৌলুস এসেছে। বিজলি বাতি ঝিলমিল করে জ্বলে উঠে সন্ধ্যা হতে না হতেই। ভাটা পড়েছে বাজারের মধ্যে। বাজারে লোকজন তেমন বসে না; যা বসে তা মোড়ে। মোড়ের দুপাশে নতুন করে আরও দুটো চায়ের দোকান বসেছে। তাসুকে বাইরে তেমন দেখা যায় না। বলতে গেলে বাড়িতেই থাকে। অবশ্য তাসু এখন কোথায় থাকে বা কী করছে সেদিকে কারও খেয়াল নেই। এখন যেন সবাই তাসু। তবে একটা ব্যস্ততা যে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। কার্তিক মাস। খেত-খামারে কাজ নেই। তাই এখন তারা নতুন কাজে ব্যস্ত। অন্তত এটুকু বোঝা যায়, যে যার দায়িত্ব নিয়ে শুধু ছুটছে আর ছুটছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র এসেছে এই গ্রামে। এই এলাকায়। এই থানায়। তারা যে সবাই এই এলাকার, তাও নয়। অন্য উপজেলার বা জেলারও। পরিকল্পনা এঁকে বিএফআর গ্রুপের অন্যদের সাথে এসেছে। এসেছে সামনের জনসভা সফল করতে। তারা ছুটছে দিগি¦দিক। দলীয় প্রার্থীদের কর্মীরা যেন বুঝে উঠতে পারছে না, এরা কী করছে আর কী করতে যাচ্ছে। এরা কখন মিটিং করছে আর কীভাবেই বা কাজ ভাগ করে নিচ্ছে। ৭৩-এ যেমন পূর্ববাংলা কমিউনিস্টদের কার্যক্রম মানুষ ঠাহর করতে পারেনি; ঠিক এখন পারছে না এদের। পার্থক্য শুধু এটুকু; তারা লুট করেছে থানা, লুট করেছে ধানের গোলা; আর এরা লুট করছে মানুষের মন।

সবচেয়ে বড় কথা, সরকার তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। সংসদে তাদের পক্ষে আইন পাস হয়। তাসু মাস্টার জেল থেকে বের হয়। বের হওয়ার পর তাসুর মনে নতুন এক জাগরণ তৈরি হয়। সেই জাগরণের প্রতিচ্ছবি নিম্নরূপ―

তাসু বাহির রাস্তায় এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তার ডান হাত মিনহাজের আর বাম হাত ফারুকের কাঁধে। আরও একবার চারদিকে দেখতে ইচ্ছা করল তার। দেখলেন। সামনে দেখলেন বাড়ির ছাদ, কলেজের ছাদ। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আবার। তার মনে হলো ছাদগুলো অনেক উঁচু। আর ছাদের মানুষ, ছাদের ছাত্ররা আরও উঁচু। উচ্চতা এগিয়ে চলে আকাশের পানে। বসন্তের এই শেষভাগে তাসুর মনে হলো, চারদিকের মামুষগুলো শুধু মানুষ নয়। বসন্ত সেজেছে মানব-সাজে। এই সাজ হতে ভেসে আসে সোঁদা গন্ধ। চারদিকে সব সোঁদাগন্ধী মানুষ। রুক্ষ ধরণীর বুকে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি যেন হয়ে গেছে। তাই এই সোঁদা গন্ধের ভুরভুরি। এই বসন্ত আজ মাটিগন্ধা বসন্ত। এই ডাক ছিল মাটিগন্ধার ডাক। বুক ভরে বাতাস টানে তাসু।

তাসু আবারও তাকালেন আকাশের দিকে। সূর্যের দিকে। সূর্য স্বমহিমায় গনগনে। সূর্যকে সাক্ষী রেখে মনে মনে বললেন―তার বন্দিত্ব এই জাগরণকে আটকাতে পারেনি। জাগরিত হয়েছে আরও হাজার গুণ। তোড়ের মুখে এ বাঁধ না পড়লে চারদিক ভাসত কী করে? বাঁধ দেবার আর জায়গা রইল না। রইল কি?

তবে সমাপ্তির শেষ প্রশ্নটি যেন আগামীর বিপ্লবীদের জন্য রেখে গেলেন তাসু। যারা মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সামনে থাকবেন আগামীতে।

বিষয়, আঙ্গিক, উপস্থাপন আর ভাষা বুননে যে মুনশিয়ানা লেখক দেখিয়েছেন, তাতে পাঠকের মনে ‘ফসলের ডাক’ একদিন স্থায়ী আসন গাড়বেন বলে আমাদের বিশ^াস। প্রকাশনার মানের দিক দিয়ে প্রকাশক ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে ঢাকার প্রসিদ্ধ পাবলিশার্স। প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষ। মূল্য ২৬০ টাকা। বইটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করছি।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button