গল্প
কিছু কিছু সর্বনাশ মানুষ নিজেই নিজের জীবনে টেনে নিয়ে আসে। আনজুই মৌটুসিকে বাসা পর্যন্ত টেনে এনেছে। এত বছর পর আচমকা বান্ধবীর দেখা পেয়ে কিশোরীর মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল আনজু। যার সঙ্গে ওর তুমুল কৈশোর কেটেছে তাকে হৈ হুল্লোড় করে বাসায় নিয়ে এলে যে সর্বনাশের আর বাকি থাকবে না তা ও ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি।
এই তো বিশ মিনিট আগের কথা। হাঁটবে বলে বাসার কাছাকাছি উদ্যানের গেটে সবে পৌঁছেছে আনজু, তখনই পেছন থেকে শুনতে পেয়েছে কেউ হাওয়া কাঁপিয়ে ওর নাম ধরে ডাকছে! প্রথমে তো আনজু চিনতেই পারেনি এ ওদের সেই মৌটুসি। মৌটুসিকে ওরা টুসি বলে ডাকত। ক্লাস নাইনে পড়াকালীন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল টুসি। টুসির নিজের সর্বনাশের শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকেই। অথচ টুসি বলত, রাতিনের মতো প্রতিভাবান ছেলে আর হয় না। ভবিষ্যতে রাতিন মস্ত বড় চিত্রশিল্পী হবে। টুসিকে না পেলে কিছুতেই এই দেশের ভবিষ্যৎ জয়নুল রঙ-তুলি হাতে তুলবে না―রাতিন এই দিব্যি দিতেই টুসি ওর হাত ধরে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল।
‘বিয়ের পর আর যাসনি ঐ বাড়িতে ?’
‘কোন বাড়ি ? বাবার ওখানে ? গিয়েছি তো, ঢুকতেই দেয়নি।’
টুসির সঘন চোখের পাপড়িতে দুঃখ খুঁজতে খুঁজতে আনজু মগে কফি ঢালে। বেশ গরম পড়েছে বলে প্রথমে টুসি কফি খেতে চাচ্ছিল না। আনজুর সুুসজ্জিত বসার ঘরের দুই টনের এসির শীতলতার মধ্যে বসেও টুসি ঘামে ভিজে উঠছিল। উদ্যানের গেটের সামনে হঠাৎ টুসিকে দেখতে পেয়ে যখন আনজু ওকে জড়িয়ে ধরেছিল তখন ও সুগন্ধি ছাপিয়ে টুসির শরীরে ঘামের উগ্র গন্ধ পেয়েছে। এখন টুসিকে অনেকটা সতেজ দেখাচ্ছে। ওর টিপহীন চওড়া কপাল আর নাকের অগ্রভাগের ঘাম শুকিয়ে এসেছে। আনজু কফিতে চুমুক দিয়ে ‘কেমন আছিস’ জানতে চাইতেই টুসি নিজের কফি জুড়িয়ে দিয়ে এক উঠোন গল্প গড়িয়ে দিয়েছে।
সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালায় টুসি। প্রচুর অর্ডার পায়। আজকাল তো একা হাতে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে। মানুষের হাতে কাঁচা টাকা থাকলে যা হয় আর কি, গাদি গাদি কাপড়-জামা কেনে, বানায়। টুসির মেয়েরা অবশ্য মায়ের হাতে সেলাই করা জামা পরতে পছন্দ করে না। বলে, এসব আজকাল চলে না মা, এখন রেডিমেট পোশাকের চল। টুসির তিন মেয়ে; আয়না, গয়না, বায়না। তিনজনই স্কুলে পড়ে। বড়টা অঙ্কে বেশ পাকা, মেজটা আঁকা-আঁকিতে আর ছোটটা সবকিছুতেই বায়না ধরে।
টুসির অবিশ্রান্ত কথন শুনতে শুনতে আনজু দুই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে।
‘মেজ মেয়ে তাহলে বাবার মতো হয়েছে। রাতিন ভাইও তো খুব ভালো ছবি আঁকে।’
আনজুর কথা শুনে টুসির জ্বলজ্বলে মুখ ম্লান হয়ে যায়।
‘রাতিন এখন আর ছবি আঁকে নারে।’
আনজু অবাক হয়ে টুসির দিকে তাকায়।
‘এই ছবি ছবি করেই না তোদের প্রেম। আঁকা-আঁকি ছেড়ে দিল! অবশ্য শিল্পীরা এমনই। কখন যে তাদের কী করতে ইচ্ছে হয়!’
‘শিল্পীরা যে কেমন তা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে বল!’
টুসির স্বরে ঘনীভূত হয়ে ওঠা বাষ্পের চাপ পরখ করতে করতে আনজু বলে, ‘এই জন্যই এদের বিয়ে করতে নেই বুঝেছিস। শুনেছি পৃথিবীর বিখ্যাত সব শিল্পী বিয়ে করেননি। লিওনার্দো, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো। ফ্রিদা বিয়ে করেও সুস্থির দাম্পত্যজীবন কাটাতে পারেনি।’
টুসি আনজুর কথা শুনছে, নাকি শুনছে না বোঝা যায় না। ওর দৃষ্টি ঘরের চারদিকে ঘুুরছে। ঘরের প্রতি কোনায় রাখা আধুনিক নকশার কর্নার সেলফে নানা ধরনের ইনডোর প্লান্ট আর শোপিস রাখা। সুসজ্জিত ঘরের দক্ষিণ দিকে স্বচ্ছ কাচের চওড়া দরজা, দরজার ওপাশে বারান্দা। বাকি তিন দিকের দেয়ালে আনজুর পারিবারিক ছবিসহ বিশ্ববিখ্যাত বেশ কিছু চিত্রকর্ম ঝুলছে। প্রতিটি ছবিই টুসির চেনা। এসএম সুলতানের আঁকা পেশিবহুল কৃষক, ভ্যান গঘের স্টারি নাইট, ফ্রিদা কাহলোর সেলফ পোর্ট্রেট। সব শিল্পকর্ম ছাপিয়ে আনজুর পারিবারিক ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে টুসি, কী যেন ভাবে। আনজু বান্ধবীর নীরবতা দেখে উসখুস করে।
‘কী দেখছিস অমন করে ? আরে আমি কিন্তু এসব ছবির সমঝদার নই, সব আমার হাজবেন্ড সংগ্রহ করে। ও এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা করে। প্রতিমাসেই একবার দেশের বাইরে যায়। অথচ তেমন কিছুই আনবে না বিদেশ থেকে। দেশ থেকে গুচ্ছের টাকা খরচ করে ছবির রেপ্লিকা কিনবে। এই বাসার প্রতি ঘরেই বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম দেখতে পাবি। এসব সংগ্রহ করা ফরহাদের হবি বলতে পারিস। আর শপিং করা ছাড়া এখন আমার অন্য কোনও হবি নেই বুঝেছিস। এই তো তোর সঙ্গে দেখা না হলে আজও শপিংয়ে যেতাম, মেয়ের জন্য কিছু জিনিস কেনা দরকার।’
টুসি ছবি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তারপর আনজুর দিকে তাকিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে বলে, ‘আনজু তোর তো মেয়ে আছে। মেয়ের জামাকাপড় বানাস না ? তুইও তো কামিজ পরিস। আমাকে ফোন দিস যখন যা লাগে, বাড়ি এসে মাপ নিয়ে যাব, পৌঁছেও দেব। খুব কম মজুরি নিই জানিস, তোর লাভ হবে। আর আমার সেলাইও ভালো। যেকোনও ডিজাইনের জামা বানাতে পারি। প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে।’
খানিক থেমে টুসি কথা গোছানোর জন্য সময় নেয়। তারপর কান্নার প্রবাহ ঠেলে ধীর লয়ে বলে, ‘বায়নার বাম চোখের ওপরে একটা টিউমার হয়েছে, অপারেশন করতে হবে। এত সেনসেটিভ জায়গায় টিউমারটা, ভাবছি দেশের বাইরে যদি নিতে পারি।’
আনজুর ভ্রু কুঁচকে টুসির দিকে তাকায়। টুসির ভঙ্গুর কণ্ঠস্বর ওর চেহারার সঙ্গে বেমানান। ওর মুখশ্রী বলছে না যে ও অভাবে আছে। টুসি যে জামা পরে আছে সেটার গজ কম করে হলেও চারশ টাকা। সাদা রঙের চিকনকারি কাপড়। ইনারটাও দামি সিল্ক কাপড়ের তৈরি। এছাড়া টুসির মুখের ন্যুড মেকাপের প্রলেপ ইঙ্গিত দিচ্ছে, প্রসাধনী সম্পর্কেও ওর ভালো ধারণা আছে, ও যেনতেন ব্রান্ডের জিনিস ব্যবহার করে না।
‘কী জানি হয়তো কারও কাছ থেকে চেয়েচিন্তে এনেছে এসব―ছোটোলোকের ফুটানির স্বভাব আর কী ! এখনই হয়তো ইনিয়ে-বিনিয়ে টাকা চাইবে।’ মনে মনে পছন্দমতো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো আনজু মুখে কোনও কথা বলে না। বন্ধুকে নীরব দেখে টুসি বলে, ‘তুই একদম ভাবিস না, যেই ডিজাইনই দেখাবি সেটাই বানিয়ে ফেলব।’
টুসিকে কেন প্রশ্রয় দিয়েছে নিজের বোকামির কথা ভেবে আনজু এবার ভেতরে ভেতরে উত্তপ্ত হতে থাকে। এই তপ্তভাব ওর কণ্ঠস্বরে ছড়িয়ে যায়, ‘এতদিন পর দেখা আর তুই কি না অভাব-অভিযোগের গল্প শুরু করলি। বাদ দে, এসব গল্প করতে ভাল্ লাগছে না। আর টেইলারের কাছে জামা-কাপড় বানাতে দিই না বহু বছর। মলে গিয়ে রেডিমেট পোশাক কিনি।’
‘কী বলব তাহলে ? রাতিন কী করে ? ঐ গল্পই তো ভাগ করার কথা ছিল তোর আর আমার।’
আনজুকে চমকে দিয়ে টুসি আচমকা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। কথার পিঠে কথা না বলে আনজু মুখ-চোখ বিকৃত করে সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখা ম্যাগাজিনগুলো দেখে। ম্যাগাজিনগুলো ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। ঘরের শোভা বৃদ্ধি করা হরেক সাহিত্য পত্রিকা আর ফ্যাশন ম্যাগাজিন রাখা হলেও এই বাসায় কেউ এসব খুলেও দেখে না। কে ছড়াল তাহলে, কখন ছড়াল―অদৃশ্য কারও উদ্দেশ্যে প্রশ্নসমূহের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আনজু দুই হাতে টেবিলটা পরিপাটি করে তোলার চেষ্টা করে। আনজুর অনাগ্রহ বুঝেও বিশ্রি স্বরে কথা বলতে থাকে টুসি।
‘প্রথম প্রথম ভালোই করত। আমার বিছানায়, ভাইয়ের বউয়ের বিছানায়। যেমন ধীরস্থিরভাবে তুলিতে হরেক রঙ মাখিয়ে ক্যানভাসে ছবি আঁকত তেমন। একসময় আর পারত না। অত নেশা-ভাং করলে কি আর ঐ কাজ ভালো করে করা যায় ? তা তোর স্বামী কেমন পারে রে? দেয়ালে ঝোলানো তোদের পারিবারিক ছবিতে তাকে যেমন বলশালী দেখছি বিছানাতেও সে নিশ্চয়ই তেমন দুর্দান্ত ?’
আনজুকে দিব্যি কাঁচকলা দেখিয়ে শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করে চলছে টুসি। বন্ধুসুলভ রসিকতার বদলে ওর কণ্ঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠা কটাক্ষ আনজুকে ফালি ফালি করে তুলছে। টুসি বিপর্যস্ত আনজুকে উপেক্ষা করে কাঁধে ফেলা শিফনের ওড়নাটা কোমরে আঁটসাঁট করে জড়িয়ে নেয়। তারপর অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে শূন্য কফিমগটা ডায়নিং টেবিলের ওপরে রেখে আসে।
ঘণ্টাখানেক আগে বন্ধুত্ব নিয়ে দেখানো উচ্ছ্বাস এখন আনজুর কাছে বিশ্রিরকমের আদিখ্যেতা বলে মনে হচ্ছে। টুসিকে ঘাড় ধরে বাসা থেকে বের করে দিতে ইচ্ছে করছে ওর। বিষয়টা ভাবতেই আনজু রোমাঞ্চিত হয়। আনজু কুঁচকানো কপাল একটানে সোজা করে ফেলে বলে, ‘তুই এখন চলে গেলে তোর জন্যই ভালো হয়। আর আমিও একটু বাইরে যাব, ড্রাইভারকে আসতে বলেছি।’
‘কী বলিস! এখনই যাব মানে! তোর স্বামীর সঙ্গে দেখা করব না? কী যেন নাম ভদ্রলোকের ? ফরহাদ, না ? জানিস, ফরহাদ নামে আমার একজন ক্লায়েন্ট আছে। এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসায়ী। বাড়ি বনানী। ফোন নম্বর…।’
‘তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস টুসি।’
আনজুর কণ্ঠস্বরে শীতের প্রবল কাঁপুনি শুরু হয়। কী বলবে, কী করবে মুহূর্তের জন্য বিস্তৃত হতে হতে আনজুর মনে পড়ে যায়, পারফিউম ব্যবহার করতে না চাওয়া ফরহাদের শার্ট থেকে আজকাল সুগন্ধির মৃদু ঘ্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু… বুকের ভেতরে ঘনিয়ে ওঠা সব কিন্তুর বুদবুদকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে দিতে আনজু চিৎকার করে ওঠে, ‘চুপ… একদম চুপ! তোকে আমার বাসায় নিয়ে আসাই উচিত হয়নি!’
আনজুকে ধ্বংসস্তূপে গাড়তে গাড়তে টুসি অদ্ভুত এক ভ্রুভঙ্গি করে।
‘টেইলারিংয়ের ক্লায়েন্ট না কিন্তু। আমার সাইড ব্যবসার ক্লায়েন্ট। সপ্তাহে এক-দুদিন সময় দিলেই পুষিয়ে যায় আমার।’
আনজু ছুটে গিয়ে টুসির গালে-পিঠে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে। আনজুকে হতবাক করে টুসি একবারের জন্যও ওকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে না। উল্টো হাসে। ওর হাসি বিষধর সাপের মতো মুহুর্মুহু ছোবল মারে আনজুর শরীরে। আনজুও ছাড়ে না, টুসিকে বিশাল পাইথনের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরে। টুসির বুকের নাজুক অংশে শেষ ঘুষিটা মেরে আনজু নেতিয়ে যায়। সোফায় শরীর এলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘তুই চলে যা। আর কোনও দিনও আমার বাড়িতে আসবি না।’
‘এখন আর শরীরে কোনও ব্যথা পাই না’ বলতে বলতে গা ঝাড়া দিয়ে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায় টুসি।
টুসির মুখ দেখে আনজুর হৃৎপিণ্ড হিম হয়ে আসে। শ্বাস নিতে পারছে না বুঝতে পেরে হা করে বাতাসের অস্তিত্ব খুঁজতে থাকে। বাতাসের মধ্যেই ডুবে-ভেসে আছে তবু যেন কোথাও বাতাস নেই। এমন শ্বাসরুদ্ধকর চাপের ভেতরে থেকেও আনজু হাত উঠিয়ে দরজার দিকে তাক করে, ‘বেরিয়ে যা।’
টুসি আনজুকে পুনরায় অবাক করে ওর জায়গা থেকে এক পা-ও নড়ে না।
‘এই সত্যি শোনার পরেও তো তুই ফরহাদকে ছাড়তে পারবি না। মজ্জাগত দাসত্ব ছেড়ে বের হতে পারবি? আমার মতো ?’
তেরছা দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে টুসি।
জাগতিক ভুবন থেকে মুহূর্তের জন্য উধাও হয়ে যায় আনজু। পুনরায় হিংস্র হয়ে উঠতে গিয়েও দমে যায়। টুসি দমে না। কীটের মতো জেগে উঠছে টুসির লোভ। লোভী চোখেমুখে যেই হাসি ছড়িয়েছে সেই হাসির তীব্র্রতা আনজুর শরীরে শূলের মতো বিঁধছে।
‘এত বড়লোকের সতী-সাধ্বী বউ তুই, তোর বড়লোক স্বামী নিশ্চয়ই তোর হাতে গুচ্ছের টাকা দিয়ে যায়। ওখান থেকে ছিটেফোঁটা কিছু ঝাড়লেই আমার মতো ছোটলোকেরা বেঁচেবর্তে থাকে।’
‘তুই কি আমাকে ব্লাকমেইল করছিস ?’
‘তা কিছুটা করছিই তো, এমন সুযোগ ছাড়লে কী চলে বল? তিন-তিনটা মেয়ে নিয়ে এই বাজারে একা চলা কি সোজা কথা!’
‘তা মেয়েদেরও তোর পথে নামাচ্ছিস না কেন ? মা মেয়েরা একসঙ্গে ইনকাম করবি, ধান্দা বড় হবে।’
আনজু নিজের বিষের ছোবলে এবার নেশাসক্তের মতো হয়ে ওঠে। এতক্ষণ পর যেন টুসিকে জায়গামতো আঘাত করতে পেরেছে সেই পরিতৃপ্তিতে আনজু হাসে। ওকে অবাক করে টুসিও হাসে কিন্তু আনজুকে আর হাসতে দেয় না। পাকা ব্লাকমেইলারের মতো চাপা কণ্ঠে বলে, ‘বেশি দেরি করিস না। রাত হতে থাকলে আমার রেটও বাড়তে থাকে। ধর এখন আমার রেট এক লাখ। রাত বাড়লে তা দ্বিগুণ হবে। আর আমার মেয়েদের নিয়ে টান দিলে রেট কততে গিয়ে ঠেকবে ভেবেছিস একবার ?’
টুসি নির্লজ্জের মতো দেয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের সৌন্দর্য দেখে। অবাধ্য ওড়নাটা একবার মাথায় দেয়, একবার কাঁধে ফেলে। টুসির নির্লজ্জতা দেখতে দেখতে আনজুর শরীরের পেশি কঠিন হয়ে ওঠে। একবার ভাবে ওকে টাকা দেবে আরেকবার ভাবে, যা করে করুক কিছুতেই টাকা দেবে না। একটা টাকা দেবে না। ভাবতে ভাবতে এক ঝটকায় উঠে গিয়ে আনজু শোবার ঘরের তিন পাল্লার বিশাল কাঠের আলমারির ড্রয়ার থেকে পাঁচশ টাকার একটা বান্ডেল বের করে। মাঝেমধ্যে এমন দু-একটা বান্ডেল ভিক্ষুককে দেওয়ার ক্ষমতা ওর আছে―ঠোঁটে এমন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি এঁকে আনজু টুসির দিকে টাকাটা ছুঁড়ে দেয়।
‘এখনই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। আর কোনও দিন আসবি না।’
মার্বেল পাথরের চকচকে মেঝে থেকে টাকার বান্ডেলটা কুড়িয়ে নিয়ে ব্রার আড়ালে ঢোকাচ্ছে টুসি। সাদা জামার ভেতরে গোলাপি ব্রার ভাঁজ গলে ওর পুরুষ্ট স্তনজোড়া বেরিয়ে আসতে চাইছে। শরীরের প্রস্ফুটিত সৌন্দর্য দেখাতেই যেন টাকাটা জায়গামতো রাখতে অনেকটা সময় নেয় টুসি। টাকাটা জায়গামতো চালান করে কায়দা করে বলে, ‘ফরহাদকে বলিস, মিস অনন্যা এসেছিল। আর মিস অনন্যা তার অন্যতম ভ্যালুয়েবল কাস্টমারের বাসা খুব কষ্ট করে খুঁজে বের করেছে।’
আনজু হ্যাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে দাঁড়ায়। ওর শরীরের চামড়ার নিচে ঘৃণার প্রবল স্রোত বইতে থাকে। আনজু কর্কশকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘বেশ্যা।’
‘সে কী রে! আমার মতো বস্তির মাতারিরা না বলবে বেশ্যা, তুই তো বলবি ব্লাডি হোর!’
আনজু প্রবল ঘূর্ণির মধ্যে পাক খেতে খেতে জান্তব স্বরে চিৎকার করে ওঠে, ‘বেশ্যা একটা। তোকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসাই আমার ভুল হয়েছে।’
টুসি আনজুর রোষ উপেক্ষা করে আপাদমস্তক কাঁপিয়ে হাসে।
‘হু আমি বেশ্যা আর তোর পোষাপুরুষটা খুব ভালো। খুব ভালো।’
‘ব্লাডি হোর…।’
মুখ ফসকে টুসির শেখানো গালিটা বেরিয়ে আসে বলে নিজের গালে নিজেরই চড় মারতে ইচ্ছে করে আনজুর। আনজুর অবস্থা দেখে টুসি প্রশ্রয়ের ঢঙে বলে, ‘এইবার ঠিক আছে।’
হতচকিত আনজু দাঁড়িয়ে দেখে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েও টুসি ওর ঘরেই থেকে যায়।
সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত