আর্কাইভগল্প

বাবা : সিরাজুল ইসলাম মুনির

গল্প

আজকাল আর মোবাইল অ্যালার্মের প্রয়োজন পড়ে না। তার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। কিছুটা অভ্যাস কিছুটা অবচেতনে তাগাদা―তাঁর জেগে ওঠার কারণ। কিন্তু ইদানীং মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। অ্যালার্ম বাজার তখনও ঢের বাকি। ঘুমের ভেতর তিনি তাঁর বাবাকে দেখতে পান, বাবা তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, তিনি পলকহীন তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন। আবুল হাসনাতের বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে ওঠে, তিনি কেঁদে ওঠেন।

আবুল হাসনাত প্রথম যখন ছেলের ডাকে এই দূর বিদেশে পাড়ি জমালেন তখন এখানে সামার। বাবাকে থাকার জন্য এই ঘরটাই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল ছেলে। ঘরটার দেওয়াল জুড়ে বিশাল কাচের জানালা। বাইরের আলো এসে ঘরটা সারক্ষণ আলোকিত করে রাখে। এ বাড়ির সব জানালায় ব্লাইন্ডস লাগানো হলেও তিনি ছেলেকে এখানে ব্লাইন্ডস অথবা স্ক্রিন লাগাতে দেননি। কারণ এই অবাধ আলোটুকু থেকে বঞ্চিত করতে চাননি নিজেকে।

ভোরের প্রার্থনার জন্য জেগে উঠবেন বলে তিনি মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে রাখেন। অ্যালার্ম বেজে উঠলে তিনি শুয়ে শুয়েই জানালার বাইরে তাকান। জানালার ওপাশে গির্জা। গির্জার পেছনে বিশাল চত্বর। চত্বরের পরে ক্রিসেন্ট লেনে রাতের ধূসর চাদর জড়ানো ঝাকড়া মেপল গাছগুলো চোখে পড়ে। ঘুম ভাঙলে এটাই চেনা দৃশ্য, বিছানায় শুয়ে শুয়েই দৃশ্যটা প্রথম দেখেন আবুল হাসনাত।

আবুল হাসনাত নরম কার্পেটমোড়া মেঝেতে পা রাখেন, তারপর ‘জীবিতকে মৃত থেকে নির্গত করা’র মহা পরাক্রমশালী স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান ‘আল্লাহু আকবর’ বলে। সালাতের প্রস্তুতি নিতে তিনি ওয়াসরুমে যান, ফিরে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নিমগ্ন হন ভোরের প্রার্থনায়। সালাতে তিনি তেলাওয়াত করেন, ‘কুলিল্লাহুম্মা মালিকাল মুলক, তুতিল মূলকা মিম্মান তাশাউ…।’ কয়েকটি আয়াত তিনি সালাতের প্রথম রাকাতেই পাঠ করেন। পাঠ করতে করতে তাঁর চোখ নিমীলিত হয়, অন্তর নিমগ্ন হয় স্রষ্টার ধ্যানে। আয়াত পাঠের সাথে সাথে তিনি আয়াতের অর্থ মনে মনে বলতে থাকেন, ‘হে রাজ্যসমূহের অধিপতি আল্লাহ! আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নেন; যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন; আপনারই হাতে রয়েছে কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান।

আপনি রাতকে দিনে পরিবর্তিত করেন এবং দিনকে রাতে পরিণত করেন এবং জীবিতকে মৃত হতে নির্গত করেন ও মৃতকে জীবিত হতে বহির্গত করেন এবং আপনি যাকে ইচ্ছা অপিরিমিত জীবিকা দান করেন।’

আবুল হাসনাত সালাত শেষ করে জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে যখন উঠে দাঁড়ান তখন জানালার বাইরে প্রকৃতিও প্রশান্ত আলোয় ভরে ওঠে। আবুল হাসনাত জানালায় দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকটা সময়। ভোরের নরম আলোটা ধীরে ধীরে কমলা রঙ মেখে ছড়িয়ে পড়ে। মেপল গাছের পাতার আড়াল ছেড়ে খয়েরি ডানার পাখিরা উড়ে যায়, দূরে কোথাও। ক্রিসেন্ট লেনের বাড়িগুলোর কালো টালির ছাদ গড়িয়ে পড়ে কমলা আলো। এদিকটা অনেক খোলামেলা। অনেক দূর পর্যন্ত কোনও বহুতল ভবন নেই। আকাশটা যেন সদ্য নীল জলে ধুয়ে রোদে শুকোতে দিয়েছে কেউ।

সকালের এই আয়োজনটুকু মুগ্ধ হয়েই দেখেন আবুল হাসনাত। তখনো বাড়ির কেউ জেগে ওঠে না। সবার ঘরের দরজা বন্ধ। তিনি করিডোর ধরে হেঁটে চলে আসেন লন্ড্রিরুমে। লন্ড্রিরুমটা অনেক বড়, বেশ ওয়াকিং স্পেস আছে। লন্ড্রি রুমটা বাড়ির সামনের অংশে। জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার এ মাথা-ওমাথার অনেকটাই দেখা যায়। রাস্তার দুই পাশেই বাড়ি, সব বাড়ির বাইরের অবয়ব অনেকটা একই রকম। বাড়ির সামনে ড্রাইভওয়ে, সেখানে দুটি-তিনটি করে গাড়ি পার্ক করা। সব ছবির মতো সুন্দর। রাস্তায় একফোটা আবর্জনা নেই, একটা ঝরাপাতা অথবা ছেঁড়া কাগজ নেই, বাতাসে ধুলো নেই। কদাচিৎ কখনও একটা-দুটা মানুষ চোখে পড়ে। আবুল হাসনাত জানেন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কিছু মানুষ এরই মধ্যে গাড়ি নিয়ে কাজে চলে গেছে। অন্যরাও তাদের অফিস অথবা কাজের জায়গায় ধীরে ধীরে বের হয়ে যাবে। রাস্তাটা তখন বিরানভূমির মতো লাগে আবুল হাসনাতের।

ছেলে অনেক বছর থেকেই আছে টরেন্টোয়। ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর একদিন বাবার কাছে এসে বলে, কানাডার একটা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন হয়েছে। আমি সেখানে পড়তে যেতে চাই।

আবুল হাসনাত অবাক হয়ে ছেলেকে দেখেন। এই একরত্তি ছেলে, কখন এত সেয়ানা হয়ে গেল, এখনও তো চলতে চলতে বাসার গলিরাস্তাটা পেছনে ফেলে সামনে হেঁটে যায়, এমনই বেভোলা আর সরল।

আবুল হাসনাত না না করে ওঠেন। কিন্তু বাধ সাধলেন ছেলের মামা। টরেন্টো থেকে ফোন করে বললেন, আপনার সমস্যা কোথায়! ছেলে আমার তত্ত্বাবধানে থাকবে, ওকে পাঠিয়ে দিন।

এই দ্রুত ধাবমান শহরে এসে ছেলে হারিয়ে যায়নি। পড়াশোনা শেষ করেছে, চাকরিও করছে। কয়েক বছর আগে আবুল হাসনাতের বন্ধুর কন্যাকে বিয়েও করেছে।

আবুল হাসনাতের চাকরি শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে। অবসর জীবন টিভি দেখে, বইপড়ে আর নিয়মিত ধর্মকর্ম করে কাটে। মাঝেমধ্যে গ্রামে যান, নিজেকে তিনি সৌভাগ্যবান মনে করেন কারণ এখনও তাঁর বাবা-মা বেঁচে আছেন এবং সচল আছেন। বাবা-মা ছাড়াও ভাই-বোন, ফুপু ও খালারা আছেন। আরও অনেক আত্মীয়-স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গ্রাম ও শহরে। চাকরি শেষ হবার পর তিনি ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখতে যান। সবাই তার এই আসা-যাওয়ায় খুব খুশি। ফুপুরা এই বুড়ো খোকাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, কতদিন পরে তোকে দেখলাম বাপ, বোনেরা কেঁদে-হেসে একাকার করে। ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল তার, গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি ইতিহাস ও রাজনীতির বই তার পছন্দ। বই কিনতে কিনতে বাসাটা এখন ছোটখাটো লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছেন। টকশো দেখেন মধ্যরাতে, মাঝেমধ্যে বেশ লাগে রাজনীতিবিদদের ঝগড়াঝাটি, কিন্তু মাঝেমধ্যে কতগুলো তথাকথিত বুদ্ধিজীবী চলে আসেন, তাদের কথা শুনলে জেদ চেপে যায় তার, তারা কৌশল করে সংবিধানের মৌলচেতনাকে হত্যাকারী দুই সামরিক শাসকের পক্ষে কথা বলেন। আবুল হাসনাত কাউকে কাউকে মুখোশ পরা দেখতে পান, মুখোশটা খুললেই দেখা যাবে, এই ব্যাটা একাত্তরের জানোয়ারদের প্রতিনিধিত্ব করছে।

যানজট ও জলজট আকীর্ণ, ধুলোওড়া, গাড়ির তীব্র শব্দমোড়া ঢাকার নাগরিক জীবন আর গ্রামবাংলার সবুজ বিস্তৃত ধানক্ষেত, পাটক্ষেত, হলুদ সরিষার মাঠ, জাংলায় বাতাসে দোল খাওয়া কচি লাউ, ঝিঙে, শিশিন্দা, নদীবক্ষে-বিলে ভাসমান কচুরিপানার বেগুনি ফুল, খেসারি লতার সবুজ মায়াভরা গ্রাম আবুল হাসনাতের জীবনটা আনন্দে ভরে রাখছিল। ওইসময় একদিন ছেলে ফোন করল, তার কণ্ঠে উদ্বেলিত আনন্দ।

 আব্বু, একটা সুখবর আছে।

কী বাবা?

প্যারেন্টস ইমিগ্রেশন প্রোগ্রামের আওতায় আপনাদের নাম এসেছে।

সেটা আবার কী?

আপনারা এখন থেকে কানাডাতে থাকবেন। আপনারা পার্মানেন্ট রেজিডেন্ট অর্থাৎ পিআর কার্ড পেয়ে যাবেন, কানাডিয়ান গভর্নমেন্ট আপনাদের চিকিৎসার সকল ভার বহন করবেন। পাঁচ বছরের মধ্যে তিন বছর থাকলে আপনারাও কানাডিয়ান পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন।

ছেলের কথায় আবুল হাসনাত মনে মনে হাসেন। ছেলেকে মুখে কিছু বলেন না, তার মনে কষ্ট হতে পার, ছেলের খুশিই তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের। আবুল হাসনাতের মনে পড়ে তার চাকরি থেকে অবসর যাবার দিনের কথা। সেই অবসরের দিন থেকেই তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন জীবন থেকে অবসর যাবার। এইতো সেদিন শৈশব-কৈশোরের স্কুল-সতীর্থ বন্ধু সালেহ চৌধুরী জীবনের চূড়ান্ত অবসরে চলে গেছে। আবুল হাসনাতদের একটা স্কুল অ্যালামনাই আছে, নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে সদস্য সংখ্যা দুই হাজারের বেশি । আবুল হাসনাত একদিন সালেহকে বললেন, তুমি অ্যালামনাইর জীবন সদস্য হয়ে যাও।

সালেহ এক অদ্ভুত কথা বলল, জীবন আর কতদিন, এখন আর এ সদস্যপদের কী দরকার?

সালেহ চৌধুরী তার একমাস পরেই হঠাৎ করে মারা গেল। সে কী চূড়ান্ত অবসরের আগাম সংবাদ পেয়ে গিয়েছিল? ছেলের এই খুশি উদযাপনের মধ্যেই আবুল হাসনাতের মনে পড়ল সতীর্থ বন্ধুর কথা। তার তো একটা সবুজ পাসপোর্ট আছেই, কানাডার পাসপোর্ট কী তাকে চূড়ান্ত অবসরযাত্রা থেকে রক্ষা করতে পারবে?

ইমিগ্রেশনের খবরে ছেলের মায়ের আনন্দ দেখে কে! তিনি আনন্দে আত্মহারা। কানাডায় যেতে পারার আনন্দে নয়, ছেলের কাছে তার থাকা হবে সেজন্যে। তিনি কিছুক্ষণ আনন্দে কাঁদলেন, কাঁদতে কাঁদতে বললেন, সেই কবে থেকে ছেলেটা আমার কাছে থাকে না। দুধের বাচ্চাকে বিদেশ বিভুঁইয়ে পাঠিয়ে দিয়েছ, মায়ের বুকের হাহাকার বোঝার ক্ষমতা তোমাদের পুরুষদের কখনও হবে না।

দীর্ঘ সংসার যাত্রায় আবুল হাসনাতের এটা জানা হয়েছে, স্ত্রীদের কাছে সংসারের তাবৎ সমস্যার জন্য স্বামীরাই দায়ী থাকে। এখানেও আর অন্যথা হবে কেন!

বাবা ও মাকে খুশি রাখার মিশনে নেমেছে যেন ছেলে। প্রথম কদিন খুব ব্যস্ততা গেছে তার। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে, তারপর বাবা-মাকে নিয়ে ছুটেছে সার্ভিস সেন্টারে, সোশাল সিকিউরিটি নম্বর, পিআর কার্ড, অন্টারিও কার্ডের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। সময় লাগছে না, এসব গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টসের জন্য কারও সঙ্গে দেন-দরবার করতে হচ্ছে না। বরং এসব সেবা দেবার জন্য সার্ভিস সেন্টারের কর্মীরা অপেক্ষা করে আছে, সঙ্গে থাকে তাদের এফিসিয়েন্সি ও বিনয়। ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ডের জন্য ছেলে সঙ্গে করে ব্যাংকে নিয়ে গেছে। সপ্তাহান্তে ডাকে ডকুমেন্টসগুলো চলে এলো। বখশিশের জন্য কেউ দরজায় দঁড়িয়ে থাকেনি। ফ্যামিলি ডাক্তার ঠিক করা হলো ঘরে বসেই, ফোনে ফোনে। একদিন পরেই ‘ওয়াক ইন ক্লিনিক’ থেকে কল এল। ডাক্তরের সঙ্গে অ্যাপয়ন্টমেন্ট। সময়ের হেরফের নেই। যথাসময়ে হাজির হয়ে শারীরিক সমস্যাগুলোর কথা বলা। ফ্যামিলি ডাক্তার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে রেফার করলেন, বড় বড় মেশিনে ফুল চেক-আপ চলল। ডায়বেটিস, কিডনি, হার্ট, লাঙ, চোখ, কান― সব দেখা হলো। ছেলের মায়ের শত সমস্যা। তার নিজেরও সমস্যা আছে কিন্তু সেগুলো তত গভীর নয়। ফার্মেসি থেকে গুনে গুনে তিন মাসের মেডিসিন দিয়ে দিল। তিন মাস শেষ হবার আগেই আবার ফার্মেসি থেকে ফোন আসবে, মেডিসিন নিয়ে যাও। আবুল হাসনাতের জীবন সকাল-সন্ধ্যার ঔষধ-অভ্যস্ত জীবনে প্রবেশ করল।

বাবা-মার মনকে খুশি রাখতে ছেলের চেষ্টার কমতি নেই। ছুুটির দিনের বাইরেও ছুটি নিয়ে বাবা-মাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সুন্দর সুন্দর পার্ক, ঐতিহাসিক স্থান, ফান-প্লেস, নানাদেশের খাবারের দোকান, বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন উৎসবে। উইকেন্ডে আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া-আসা তো আছেই। একদিন হেঁটে হেঁটে বাড়ির কাছেই পাবলিক লাইব্রেরিতে বাবাকে নিয়ে গেল ছেলে। হাজার হাজার বইয়ের সমারোহে বাংলা বইয়ের বিশাল কালেকশন সেখানে। লাইব্রেরি কার্ড করা হলো। প্রতি সপ্তাহে সেখান থেকে পছন্দের বই নিয়ে আসেন আবুল হাসনাত।

ছেলে আর বউ, দুজনেই চাকরিজীবী, আগে তারা তাদের দৈনন্দিন খাবার নিয়ে এতটা মাথা ঘামাত না, দোকান থেক কিছু একটা খাবার কিনে নিয়ে আসত অথবা অনলাইনে আনিয়ে নিত। কিন্তু বাবা-মা আসার পর, ড্যানফোর্থের বাঙালি দোকানগুলো থেকে বাংলাদেশি মাছ-তরকারি কেনা শুরু হলো। ছেলে ভাবল, বাবা-মা যেসব খাবারে অভ্যস্ত সেগুলো না হলে তাদের অসুবিধা হতে পারে। ছেলের মা ভাবল, কতদিন ছেলেটাকে ভালোমন্দ খাওয়াতে পারিনি। এবার সে সুযোগ তৈরি হলো তার জন্য, তিনি আগ্রহ নিয়েই ছেলের সঙ্গে বাংলা গ্রোসারির দোকানে যান, পছন্দ করে মাছ-মাংস-তরিতরকারি কেনেন। এবার কিচেনটাও পুরোপুরি সচল হলো, তিনি নিজেই রান্নাবান্না করেন, ছেলেকে নিজে বসে থেকে খাবার পরিবেশন করেন।

প্রকৃতিতে রূপবদল ঘটতে শুরু করেছে। রঙের বাহার লেগেছে যেন। টরেন্টো শহর সমতল ভূমির শহর নয়, ঢেউ খেলানো, কোথাও পাহাড়ে, কোথাও সমতলে, কোথাও অবতলে ছোপ ছোপ রঙের খেলা। মেপল গাছের পাতাগুলো কী সুন্দর রঙবদল করেছে, কোনওটা হলুদ, কোনওটা লাল, কোনওটা কমলা। কেবল মেপলই নয়, সবারই মনে রঙ লেগেছে, রঙ যেন আতশবাজির রঙের মতো বনভূমির বিশাল বিশাল আমেরিকান বিচ, আয়রনউড বৃক্ষের পাতার অরণ্যে। কেবল রঙ বদলায় না খ্রিস্টমাস ট্রি, চিরসবুজ, যেন সে জিসাসের অপরিবর্তনীয় চিরসত্য ও রূপের প্রতীক, তার কোনও পরিবর্তন নেই। ছেলে তার গাড়িতে করে দ্রুত ধাবমান বিশাল হাইওয়ে অথবা শহরের রেগুলার রাস্তাগুলো ধরে এই রঙের লাবণ্যে উপচে থাকা শহর দেখাতে নিয়ে যায়, কখনও শহর ছাড়িয়ে আরও দূরে। শহরের কাচঘেরা আকাশচুম্বী দালানগুলোর দেয়ালে প্রতিফলিত হয় রঙের খেলা―হলুদ, লাল, কমলা। পথের পাশে এতদিন যেগুলো অকারণ জঙ্গল মনে হয়েছিল, সেগুলোতে রঙ ধরেছে, কী আশ্চর্য সুন্দর ঘন লাল, ঘোর লেগে যায় চোখে। কী নাম এর, বুকের ভেতর এত রঙ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে এই দুর্দান্ত সময়ের! শহরের বাড়িগুলোও পাল্লা দিয়ে ফুলের সমারোহে সেজেছে। কোথা থেকে পেল এত বাহারি রঙের ফুলের গাছ? ছেলে বলে, এখানে বিশাল বিশাল গ্রিনহাউজ আছে, যেখানে হাজার রকমের ফুল চাষ হয়।

টরেন্টো মেঘা শহর, শহরের ভেতর শহর। চলতে চলতেও শহর শেষ হয় না। টরেন্টোকে বলে জিটিএ অর্থাৎ গ্রেটার টরেন্টো এরিয়া। এর ভেতর আছে পঁচিশটা মিউনিপ্যালটি। আবুল হাসনাতরা থাকেন অ্যাজাক্সে। অ্যাজাক্স থেকে যেখানেই যাক না কেন, জিপএস আগেভাগেই স্থানের দূরত্ব ও গন্তব্য পৌঁছার সময় বলে দেয়। পথের সামনে দুর্ঘটনা বা জ্যামের কারণে সম্ভাব্য বিলম্বের সময়ও জানিয়ে দেয়। আকাশে ঘুরে বেড়ানো স্যাটেলাইট থেকে কেবল টরেন্টো নয়, পৃথিবীর নানা শহরে চলমান লক্ষকোটি গাড়ির যাত্রীর জন্য বার্তা প্রেরণ করছে। আবুল হাসনাত অবাক হয়ে মানুষের জয়যাত্রার ইতিহাস নিয়ে ভাবেন। এসব শুনতে শুনতে কখনও কখনও তার মনে হয়, এই শতাব্দীতেই মানুষ জেনে যাবে, পৃথিবীতে আসা ঐশী বাণী ও বার্তাবাহকের ধর্ম প্রচারের ঘটনাসমূহ। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানুষের বলা অথবা অন্য সকল শব্দাবলি ইথারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই শব্দজ্যামকে ব্যবচ্ছেদ করে একদিন মানুষ বের করে নেবে ঐশীগ্রন্থের বাণী অথবা নবি-অবতারের ঘটনাসমূহ কতটা সত্য, কতটা অলীক। বার্তাবাহক কর্তৃক চুপিচুপি নবি বা অবতারকে শোনানো ঐশী বাণী মানুষ বের করতে না পারলেও ইথারে ভেসে বেড়ানে নবী বা অবতারের মুখনিঃসৃত বাণীসমূহ যা তাঁরা মানুষের কাছে প্রচার করেছিলেন, আগামী দিনের মানুষ সেটা ঠিকই বের করে নেবে।

রঙের উৎসব শেষ হতেই শুরু হয় পাতা ঝরার দিন। হেমন্তে বাংলাদেশেও পাতা ঝরে। সবুজপাতা রঙ বদলায়, ক্ষণস্থায়ী সে রঙ, যেন ঝরার জন্যই সে বিবর্ণ হয়েছিল। ঝরে যাওয়া পাতাগুলো শুকিয়ে যায় একদিনেই, পথের ধুলোয় মিশে তারা সৌন্দর্য হারায়। টরেন্টো শহরের পাতাঝরা সেরকম নয়। এখানে এটা রঙের উৎসব। এই শহরটা যেন একটা পরিকল্পিত পার্কের শহর। একটু পরপরই খোলা মাঠের বিস্তৃতি, মাঠের চারপাশ জুড়ে গাছের সারি, মাঠের একটা অংশজুড়ে শিশুদের খেলার জন্য নানা আয়োজনও আছে। বড়দের জন্য বসার ও হাঁটার ব্যবস্থা আছে। এত বৃক্ষ ও সবুজের শোভাময় শহর পৃথিবীতে কমই আছে। পাতারা ঝরে পড়ে, লাল, হলুদ, কমলা―তারা রাঙিয়ে দেয় সবুজ ঘাস আচ্ছাদিত রাস্তার দুপাশ, পার্ক, বনভূমি।

পাতাঝরার দিনগুলো আগাম বার্তা নিয়ে আসে শীতের। গ্রেট লেকসের বুক ছুঁয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ছুটে আসে উদ্বাহু, অন্টারিও লেকের জলে সে হাওয়ার শিহরন, বৃক্ষশোভাময় টরেন্টোর বৃক্ষরাজি ও গুল্মসারি পাতা ঝরিয়ে শুকনো ঝোপের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। পাতা ঝরতে না ঝরতেই শুরু হলো তুষারপাত। বেশ ফুরফুরে মেজাজে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে তুষারের কণাগুলো সাদা বৃষ্টির মতো ঝরে ঝরে পড়ে। তুষারের বৃষ্টিতে ভিজতে বেশ মজা, হুড ঢাকা জ্যাকেটের উপর আলতো হয়ে ঝরে কিন্তু ভিজিয়ে দেয় না। ঝরতে ঝরতে রাস্তা, মাঠ, বাড়ির ছাদ সবকিছু ধবধবে সাদা তুষারে ঢেকে দেয়। আর ওই যে পাতাবিহীন শূন্য বৃক্ষগুলো অথবা ক্রিস্টমাস ট্রিগুলো―সেগুলোও তুষারবৃক্ষ হয়ে যায়। তুষারে ঢেকে যাওয়া রাস্তাগুলো মিউনিপ্যালটির স্নো রিমোভার এসে পরিষ্কার করে দেয়। ফলে টরেন্টোর রাজপথ সচল হয়ে থাকে চলমান হাজার গাড়ির চাকায়, চাকা যেহেতু সচল, নাগরিক জীবনও সচল থাকে। তুষার কখনও বরফ হয়ে যায়, যখন শূন্য তাপমাত্রার নিচে চলে যায় উষ্ণতা।

আবার ঋতুর পরিবর্তন ঘটবে, বাতাস থেকে চলে যাবে শীতল স্পর্শ। বর্ষা নামবে, সে বর্ষা বাংলাদেশের মত অতো দাপুটে নয়, মাঠঘাট ভাসিয়ে দিয়ে বন্যা ঘটায় না। বর্ষা যেতে সময় নেয় না, বর্ষা যেন সামারের জয়ডঙ্কা বাজিয়ে আসে, সামারে সবুজে ভরে যাবে প্রকৃতি, আবার জমে উঠবে অন্টারিও লেকের পার ঘেঁষে বানানো পার্ক ও বিচগুলো।

দুই

এখন উইন্টার। বাংলাদেশেও শীতকাল। উত্তরের জনপদে শীত জেঁকে বসে, হিমালয় থেকে নেমে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়, মাঠের ফসল পর্যন্ত শীতের হাওয়ায় পুড়ে যায়। তবু ভালো, তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে যায় না। তেমন হলে হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহে ভরে যেত ওই জনপদ। এখানকার মানুষ সুরক্ষিত, প্রতিটি ঘরবাড়ি, অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, মানুষগুলো ঘরের বাইরে এলেও সুরক্ষিত পোশাকে আবৃত থাকে শরীর। একমিনিট অথবা এক সেকেন্ডের জন্য বিদ্যুৎ চলে যায় না। তাই জীবন এখানে স্বাভাবিক, বাসিন্দাদের জীবন নিরাপদ।

আজও আবুল হাসনাতের মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি শুয়ে শুয়েই দেখেন,

গির্জার মাঠের লাইটপোস্টগুলো আলো ফেলছে সাদা তুষারঢাকা চত্বরের ওপর। সন্ধ্যায় প্রচুর তুষারপাত হয়েছিল। লাইট পোস্টের মাথার ওপর দিয়ে ক্রিসেন্ট লেনের বাড়িরগুলোর তুষারঢাকা সাদা ছাদ দেখা যায়। আজ কী চাঁদনি রাত? এপাশ থেকে আকাশের চাঁদ দেখা যায় না। সামনের দিকটায়, লন্ড্রি রুমে দাঁড়ালে হয়তো চাঁদ দেখতে পেত।

আব্বা কী আজও এসেছেন? জানালার ওই পাশে আকাশের কোথাও থেকে তিনি তাকে দেখছেন? আবুল হাসনাত সচেতনভাবে বিশ্বাস করেন, এমনটা কখনও সম্ভব নয়। কিন্তু তার বিশ্বাসের সঙ্গে এই ভাবনার মিল নেই। তার মনে হতে থাকে আব্বা আছেন আলমে বরযখে, তিনি ভালো মানুষ ছিলেন, জীবনে কখনও মানুষের অমঙ্গল চিন্তা করেন নাই, আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস নিয়েই তিনি ধর্ম পালন করছেন, কাজেই মৃত্যুর পর আলমে বরযখের ভালো আত্মাদের জায়গা ইল্লিয়্যিনে তার জায়গা হয়েছে। আত্মারা এই মহাজগতের সর্বত্র যেতে পারে। আব্বা মৃত্যুর সময় তাকে তো দেখতে পারেননি সেজন্য হয়তো বারবার তাকে দেখতে আসেন। আবুল হাসনাত তাঁর বড় সন্তান, জীবনের প্রথম ভালোবাসার ফোটাফুল, তাকে একনজর দেখার জন্য মৃত্যুর সময়ও তিনি ছটফট করেছেন। কিন্তু ছেলের উপর তীব্র অভিমানে তাঁর হৃদয়টা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। সেই অভিমান থেকে শোক আর সেই শোকই তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল এই জগৎ-সংসারের মায়া থেকে। কোনও একজন পূত্রবধু তাঁকে আড়ালে ‘বৃদ্ধ’ বলে কটাক্ষ করেছিল, সেটা তিনি শুনে ফেলেছিলেন, সেকারণে তিনি রাগ করে স্ত্রীর হাত ধরে নিজের বাড়ি ছেড়ে মেয়ের বাড়ি চলে গেলেন। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে বড় ছেলের কাছে তিনি এর বিচার চেয়েছিলেন। আবুল হাসনাত তাঁর বড় ছেলে। আবুল হাসনাত বলেছিলেন, ওতো এমনধারার মেয়ে নয়, আপনি হয়তো ভুল শুনেছেন।

আব্বার অভিমান কী তখনই তাঁর বুকের কোথাও বীজ হয়ে বপন হয়ে গিয়েছিল? সেই অভিমানের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ধীরে ধীরে সেটা বৃক্ষ হয়ে গিয়েছিল? আবুল হাসনাত এরপরও বহুবার বাবার সঙ্গে কথা বলেছেন, কিন্তু দূর প্রবাসে বসে টেলিফোনের অপর প্রান্তে বসে-থাকা বাবার অভিমানকে তিনি বুঝতে পারেননি। বাবার অভিমানের সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্ষোভ। তিনি নিজের বাড়ি ছেড়ে এসেছেন রাগ করে, তাঁর এই মনোবেদনার সঙ্গে এটাও যুক্ত হয়েছে, বড়ছেলে পরিবারের অবিভাবক কিন্তু বাবার রাগের কারণটা কী, সেটা সে বুঝতে তো চায়নি বরং ভিন্ন অর্থ করছে। এমনকি এ বিষয়ে অবিভাবকের কর্তৃত্ব নিয়ে বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার মতো কোনও ভূমিকাও রাখেনি।

বাবার এসব মনোবীক্ষণের কথা আবুল হাসনাত জেনেছিলেন কয়েক দিন পরে, বাবার মৃত্যুর পর যখন তিনি দেশে গিয়েছিলেন তখন মা তাকে এসব কথা বলেছিলেন। বাবার মৃত্যু হয়েছিল তাঁর মেয়ের বাড়িতে। শারীরিক অসুস্থতা তেমন তাঁর ছিল না তবে অনেক দুঃখ-বেদনায় কাতর ছিলেন তিনি। একদিন হঠাৎ করেই কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে অথবা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিঃশব্দে তাঁর মৃত্যু হয়ে গেল।

 মা তাকে বলেছেন, তোমার বাবা সবাইকে ক্ষমা করেছেন কিন্তু তোমার উপর ‘অসন্তোষ’ নিয়ে গেছেন। মা-ই ছিলেন বাবার জীবনের প্রিয়সঙ্গী, তাঁর দুঃখকষ্ট তিনিই সবার থেকে বেশি জেনেছেন। আবুল হাসনাত ছিলেন বাবার সবচেয়ে আদরের ধন, অনেক অধ্যবসায় আর সাধনা দিয়ে তিনি তাকে মানুষ করেছেন। হায়! এই দূর বিদেশে এসে তিনি তার বাবাকে হারালেন, মায়ের বলা বাবার সেই ‘অসন্তোষ’ তার ললাটে লেখা হয়ে গেল। বাবার বুকের ভেতর জমে ওঠা অভিমান আর ক্ষোভ তাঁকে বাঁচতে দিল না, আবুল হাসনাত এখন বিশ্বাস করেন, তিনি যদি ছেলের এই আহবানে সাড়া না দিয়ে এই দূর বিদেশে চলে না আসতেন, তাহলে আজ নিজের বাবাকে এভাবে হারাতে হতো না।

 প্রথম যখন আবুল হাসনাত টরেন্টো এসেছিলেন, প্রথম প্রথম কিছু দিন তার ভালোই লেগেছিল। তারপর একসময় অনুভব করেন, এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি, চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিমুগ্ধ করা সুন্দর সুন্দর দালান, দ্রুত ধাবমান গাড়ি, জিপিএসের অলৌকিক বাণীর ভেতর তিনি বন্দী হয়ে গেছেন। বাংলাদেশের একজন বন্ধু ফোনের অপর প্রান্তে বসে জানতে চায়, কেমন চলছে তোমার জীবন?

আবুল হাসনাত বলেছিলেন, ‘সোনার খাঁচায় বন্দি জীবন।’

শুনে বন্ধু উপহাসের হাসি হেসে বললেন, এমন করে কেন বলছ? তুমি তো অনেক ভাগ্যবান, না চাইতেই পেয়ে গেলে। আসলে অনায়াসে পাওয়া জিনিসের কদর নেই। সবাই যেখানে উন্নত জীবনের আশায় সেসব দেশে চলে যেতে চায়, সেখানে তুমি একি কথা বলছ? নাকি আমাকে তুমি বোকা ঠাওরেছ?

আবুল হাসনাত বন্ধুকে বোকা বানাতে চাননি। মনের কথাই বলেছেন, তাঁর পঁয়ষট্টি বছরের স্মৃতি-ভালোবাসার দেশ ফেলে, অগুনতি মানুষের ভালোবাসা ফেলে তিনি কোথায় এসে পড়েছেন? এ খাঁচা তিনি ভাঙবেন কেমন করে?

আবুল হাসনাত বাবার কবরের গায়ে নতুন গজানো দূর্বাঘাসে হাত বুলিয়ে বাবাকে বলে এসেছেন, ওখানে আমার ভালো লাগে না আব্বা। এই তো এখানে আমি আপনার স্পর্শ পাচ্ছি। আবুল হাসনাতের চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে শিশিরের মতো ঘাসের পাতায় জড়িয়ে থাকে। সেই অশ্রু বহমান থাকে আবার পিয়ারসন্সের রানওয়েতে পুনর্বার বিমানের চাকা স্পর্শ করা পর্যন্ত।

অ্যাজাক্সের বাড়িটা তাকে একাকী একটা জীবন কাটাবার সুযোগ করে দিয়েছে। ছেলের মা তার অসুখ-বিসুখ আর ওষুধপত্র নিয়ে পাশের ঘরে থাকেন। এখন চারপাশে তুষারের স্তূপ জমে আছে। কোথাও কোথাও তুষারগুলো বরফ হয়ে গেছে। নতুন পড়া তুষারের উপর হাঁটতে বেশ লাগে কিন্তু বরফ হয়ে গেলে পা রাখা যায় না। পিছলে পড়লে হাতপামাথা ভাঙবে। আগে বিকেলে মুক্ত বাতাসে হাঁটতে বের হতেন আবুল হাসনাত। কাছেই দুটো পার্ক, সেখানে হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে আছে। পার্কে না গেলেও সমস্যা নেই, রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে যেথায় খুশি চলে যাওয়া যায়, ধুলো কিংবা বাতাসে মিশে থাকা বিষাক্ত কার্বনের ভয় নেই। উইন্টার আসার পর আর বের হওয়া হয় না। ঘরবন্দি জীবনে নতুন উপসর্গ শুরু হয়েছে তার। আবুল হাসনাতের মনে হতে থাকে, তার জীবনটা এখন ‘বড়শিতে গাঁথা মাছের’ মতো হয়ে গেছে।

আবুল হাসনাত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ধূসর আকাশের দিকে বাবাকে খুঁজতে থাকেন। আকাশ থেকে এখন তুষার ঝরছে না। গির্জার মাঠে জমে থাকা তুষার সন্ধ্যায় ঝরেছিল। সকালেই চলে আসবে স্নো রিমোভার। মাঠের দেওয়ালে সেগুলো ঠেলে নিয়ে স্তূপ করে রাখবে। ওগুলো ওখানে বরফ হবে, তারপর তাপমাত্রা বাড়লে গলে যাবে।

মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। আবুল হাসনাত চমকে ওঠেন। সেই মাঝরাত থেকে তিনি এখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন তারপর প্রাত্যহিক প্রার্থনার প্রস্তুতি নিতে সচল হন।

প্রার্থনার ভেতর বাবার মুখটা মনে পড়ে। প্রতিদিনই পড়ে, বাবা কখনও তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যান না, প্রার্থনার সময় তো নয়ই।

প্রার্থনা শেষ হলে করিডোর পার হয়ে আবুল হাসনাত লন্ড্রিরুমের জানালায় এসে দাঁড়ান। সামনের রাস্তাটা পুরোটা ঢেকে আছে সাদা তুষারে, ডানদিকে শুভ্র তুষারে ঢাকা পার্কের বিশাল মাঠ দেখা যায়, বামদিকে ক্রিসেন্ট রোড দেখা যায়, সেটাও তুষারে ঢাকা, রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোর কালো রুফগুলোও মোটা সাদা তুষারের চাদরে ঢাকা পড়েছে। আকাশটার রঙও আজ সাদা। তুষারের প্রতিফলিত রশ্নিরেখা আকাশটাকে এমন শুভ্রতা দিয়েছে।

আবুল হাসনাতের খুব অদ্ভুত লাগে, আকাশ-মাটি সবকিছুই আজ সাদা আলোয় ভরে গেছে, আব্বার সাদা পাঞ্জাবির মতো, সাদা পায়জামার মতো অথবা তাঁর কাফনের মতো শুভ্র। আবুল হাসনাতের মনে হয়, আব্বা ওই শুভ্র আকাশের কোথাও আছেন।

 আবুল হাসনাত চিৎকার করেই আব্বাকে ডাকেন, আব্বা, এখন আমি কী করব?

আব্বা কী আশেপাশেই কোথাও আছেন? আবুল হাসনাত স্পষ্ট শুনতে পান, আব্বা বলছেন, ছেলের কথা শুনতে হয় বাপ! এই তো আর একটা বছর, কষ্ট করে থাকো, পাসপোর্ট নিয়ে চলে যেয়ো। আর তোমার মাকে দেখে রেখো।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button