আর্কাইভগল্প

যেভাবে ঘরের কাব্য রচিত হয় : ওমর কায়সার

গল্প

গরুলুটা খালের ঘোলা জল। দুপাশের ঘন গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের ছায়া পড়ে না। আকাশও দেখা যায় না। মনসা থেকে যাত্রা শুরু। তারপর পাঁচরিয়া, চরকানাই, সাততৈয়া পেরিয়ে এঁকে বেঁকে কর্ণফুলির সঙ্গে গোপনে দেখা মিলল তার। মোহনার মুখটুকু ছাড়া পুরো শরীরটাই সবুজ অবগুণ্ঠনে ঢাকা। মিলনের জায়গাটুকুতে এসে গরুলুটা ঘোমটা ফেলে দিয়ে কলহাস্যে কর্ণফুলির বাহুলগ্ন হয়েছে। বৈঠা চালানো বন্ধ করে অলিমা। ডিঙি বেয়ে বহু পথ পেরিয়ে এখানে এসেছে। চোখের সামনে থেকে হঠাৎই সরে গেল সবুজ। যেন একটা অদৃশ্য সিংহদরজা জলের তরঙ্গে লুকানো ছিল। কোথা হতে বিপুল বাতাস এসে খুলে দিল সেই দরজা। আর ঘটে গেল জল আর নীলের বিস্তার। এখানে কর্ণফুলির জলজ প্রাণীগুলো অলিমাকে স্বাগত জানায়। একটা শুশুক ডিঙির সামনে ডিগবাজি খেয়ে উল্লাস দেখাল। অলিমা দেখে তার চারপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে মীনের সন্তানেরা লাফাচ্ছে। ওরা যেন হঠাৎ তাদের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে ফিরে পেয়েছে। ছোট ছোট মাছ জলের ভেতর থেকে মুখ তুলে ঢেউয়ের মধ্যে বুদবুদ ছাড়ছে। বড়গুলো ডিঙিতে লাফিয়ে পড়ছে, শুন্যে ডিগবাজি খাচ্ছে কেউ কেউ, কেউবা তাদের ভাষায় গান শোনাচ্ছে। অলিমা সেই ভাষা বোঝে। সে কারও কুশল জানতে চাইছে। কারো পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কাউকে হাতের মুঠোয় নিচ্ছে। মুখের কাছে এনে ফিসফিস করে কী যেন বলছে। জল আর ডাঙার প্রাণীদের এক সম্মিলিত উৎসব এটি। আর এই উৎসবের দৃশ্য প্রায় সময় আমি দেখি স্বপ্নে, মাঝে মাঝে জাগরণেও। কেন দেখি? তার একটা যোগসূত্র অনেক খুঁজেছি। মাছ আর মানুষের এরকম সখ্যভাবের নজির অলিমার জীবনে কী আছে? হয়তো আছে, হয়তো নেই।

তবে যতবার এই স্বপ্ন দেখি চোখের সামনে একটা অ্যাকুরিয়াম ভেসে ওঠে। আমাদের ঘরের সেই অ্যাকুরিয়াম। অলিমা তাকে বলত মাছের বাক্স। সেখানে ছিল একা একটি মাছ। সারা গায়ে তার কত রঙ। সীমাবদ্ধ জলের সেই বন্দি জীবনে মাছটি সারা দিন ঘুরে বেড়াত। অলিমা প্রায় সময় এসে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকত। পলকহীন চোখে মাছটির দিকে তাকিয়ে থাকত। আর বিড়বিড় করে বলত…

হন্ সায়রের মাছরে তুই

আঁর ঘরত আইলি

ঢেউয়র জীবন ছাড়ি তুই

বাক্সর জীবন ফাইলি।

(কোন্ সাগরের মাছরে তুই

আমার ঘরে এলি

ঢেউয়ের জীবন ছেড়ে এসে

বাক্সের জীবন পেলি)

 আমি জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে―তুমি কী মাছের সঙ্গে কথা বলো দাদি?

অলিমা বলত―নারে দাদু, বিলাপ গরিদি। মাছর লগে কি আর কথা হন যায়? মাছত বোবা। কথা হইত ন পারে। (নারে দাদু, আমি আসলে বিলাপ করি। মাছের সঙ্গে কী আর কথা বলা যায়, মাছ তো বোবা।)

আসলে বিলাপ করা ছাড়া তার কিইবা আর করার ছিল তখন। অলিমা বলত―এই ঘরগান কেন্ চুপচাপ। এডে আঁর সময় ন হাডের। তোর বইন বেয়াগের বিয়া অই গেইয়ে। তুই আর তোর বাপ হারাদিন বাইরে থাকস। এই অবুঝ মাছের লগে কথা কন ছাড়া আঁর কি আর কাম আছে না? (ঘরটি কেমন চুপচাপ। এখানে আমার সময় কাটে না। তোর বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। তুই আর তোর বাপ সারা দিন বাইরে থাকিস। এই অবুঝ মাছের সঙ্গে কথা বলা ছাড়া আমার কী আর কোনও কাজ আছে?)

মাঝে মাঝে বলত―ওই পাড়র ডাক আইসছি, আঁর বেশি দিন বাঁইচত মনে ন হর। আঁই জীবন লইয়েরে বড় অরান অই গেই। (ও পাড়ের ডাক এসেছে, বেশি দিন আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। এই জীবন নিয়ে আমি বড় ক্লান্ত হয়ে গেছি। )

কথায় বুঝতে পারতাম বড় মুক্তি পেতে ইচ্ছে করছিল তার শেষ দিকে। এই মুক্তি পেয়ে এখন কেমন লাগছে বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে―কেন একা ঘুরে ঘুরে সেই মাছের সঙ্গে কথা বলত? গরুলুটা খাল আর কর্ণফুলির মোহনায় একটা ডিঙিতে হাজারো মাছের উৎসবের ভেতরে যে মানুষ, আর অ্যাকুরিয়ামে বন্দি একা একটি মাছের সামনে একজন মানুষের বিলাপের দৃশ্য আমার ভেতরে একাকার হয়ে একটা ঘোর তৈরি হয়। আর সে ঘোরের ভেতর তার সঙ্গে আমার মাঝে দেখা হয়। কথা হয়, গল্পগুজব হয় আমারই ভাষায়। ফেলে আসা জীবনের অনেক কথা শোনায়। তাকে বলি―তুমিতো বলতে কখন পার হব? কবে যাব? বাঁচতে বাঁচতে বড় ক্লান্ত হয়ে গেছি।

অলিমা বলে―শেষ দিকে আর বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না। বড় মুক্তি পেতে ইচ্ছে করছিল জীবন থেকে।

―তোমার মৃত্যুর পর বড় উৎসব হয়েছিল আমাদের বাড়িতে। তোমার তো অনেক ডালপালা। চারপুত্র, চারকন্যা, নাতি নাতনি, ভাইবোন। সাতগরুর মেজবান দিয়ে গাঁয়ের সব মানুষকে খাইয়েছিল। মা চেয়েছিল তোমার মেজবানটা শহরেই হোক। বাবারা রাজি হয়নি। শেষে পুরোনো ভিটেতে সেই অনুষ্ঠানটা হলো।

নিজের মেজবানের কথা শুনে অলিমা বলেছিল, আমার বিয়ের সময়ও বাপের বাড়িতে এরকম উৎসব হয়েছিল।

বিয়ের কথা বলেই হাওয়া হয়ে গেল। এভাবে বারবার আসে। বারবার যায়। তার বিয়ে হয়েছিল আট বছর বয়সে। গরুলুটা খালের ঘাটে সেদিন সাম্পানের দীর্ঘ লাইন। সেই নৌবহরের একটিতে ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকিয়ে ছিল এক বালিকা বধূ। অচেনা অনেক মানুষের সঙ্গে অচেনা একটা পথে যেতে যেতে ছই দেওয়া সাম্পানের ভেতর থেকে সেদিন অলিমার ইচ্ছে করছিল বাইরের পৃথিবীটা দেখার। বারবার তাই ঘোমটা সরে যাচ্ছিল। কিন্তু কে যেন তা টেনে তুলে দিচ্ছিল প্রতিবারই। মুখ যেন আলোর স্পর্শ না পায়। সে বুঝতেই পারছিল না ঘোমটা কেন বারবার টেনে দেওয়া হচ্ছিল। বাইরের পৃথিবীতে কী আছে? তা কি দেখা বারণ? সেদিনের সেই প্রশ্নের উত্তর কখনও পায়নি। দ্বিধা আর ভয়মাখা মনে যখন সে শ্বশুড়বাড়ির মাটিতে পা রাখছিল তখন একবার হুট করে দেখে নিয়েছিল নতুন জায়গাটি। তখন বুঝতে পারেনি এখানেই কাটবে তার পরের জীবন। আট বছর বয়সে ঘরের বউ হয়ে আসার পর আরও কী যে ঘটেছিল তার জীবনে। তার কত কিছুই সে শোনাত কখনও হেসে, কখনও কেঁদে। একটা দিনের ঘটনা প্রায়ই বলত। বাড়ির পেছনে ছিল একটা পুকুর। ওপাড়ে একটা বড় মাঠ। একদিন চুপি চুপি পুকুরের পাড় ধরে সেই মাঠের কাছে গিয়েছিল। এক ধারে দাঁড়িয়ে দূরের দিকে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। একসময় শাশুড়ি এসে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। সেদিন তার চুলের বিনুনি কেটে দিতে দিতে শাশুড়ি বলেছিল―

ঘরর বউ ঘরত থাবি

নইলে ওবউ হস্ট পাবি।

(ঘরের বউ থাকবি ঘরে/ নইলে কষ্ট পাবি পরে)

অলিমার বর মানে দাদাকে যে বয়সে দেখেছি তার স্মৃতি ধারণ করার ক্ষমতা আমার তখন ছিল না। আমার জন্মের পর দাদা খুব খুশি হয়েছিল। একটা বছর বড় আনন্দে কেটেছে। তারপর পৃথিবীর মায়া ছাড়ল। একান্নবর্তী পরিবারের সমস্ত ভার দাদির কাঁধে দিয়ে মানুষটা চলে গেল। গোয়াল ঘরের সাত-আটটা গরু, হাঁস-মুরগি, পালানের শাকসব্জি, মরিচ খেত, ধানের জমি, পুকুরের ঘাট, খড়ের গাদা সবকিছুতে একটা ছায়া রেখেছিল দাদা। অলিমা সেই ছায়ার মায়ায় কমপক্ষে তিনটি যুগ কাটিয়ে দিল। নিজের চার ছেলে, নাতি নাতনি, দুই দেবর আর জা, তাদের ছেলেমেয়ে সব মিলে ৫০-৬০ জনের একটা সংসার তো নয়, যেন একটা রাজ্য আর অলিমা সেই রাজ্যের মহারানি ভিক্টোরিয়া। রানির সম্মান পেয়েছে কিন্তু রাজাহীন রাজ্যটা চালাতে বড় কষ্ট হয়েছিল তার। তখনকার স্মৃতির কথা বলত এভাবেই―তোর দাদা আঁরে ফেলাই গেলগু। এতত বড় সংসার লই বড় ধাঁধাত পড়ি গেই। কেন কইরগুম দিশ ন ফাইলাম। অকুল সায়রত ভাসি গেলাম। (তোর দাদা আমাকে ফেলে চলে গেল, এত বড় সংসার নিয়ে বড় ধাঁধায় পড়ে গেলাম। কী করব দিশা পেলাম না। অকুল সাগরে ভেসে গেলাম। )

স্বামীর মৃত্যুতে শোকের ফুরসৎ পায়নি অলিমা। রাজ্য চালানোর শক্তি সঞ্চয় করেছিল মনে মনে। বালিকা বয়সে খেলতে খেলতে যে সংসারে জড়িয়ে গিয়েছিল তার ভার যে একদিন তার হাতেই এসে পড়বে তাতো কখনও ভাবেনি। তাই প্রিয় মানুষটা হারানোর বেদনাকে কখনও প্রশ্রয় দেয়নি। যে আবেগ তার ভেতরটা সজল করে রাখত তাকে কখনও চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতে দেয়নি। কারণ ততদিনে সে বুঝে গিয়েছিল সময় তাকে যে দায় দিয়েছে তা মেটাতে হলে চোখের জলে ভাসলে চলবে না। আর তাই খুব শক্ত হয়ে বেঁধে রেখেছিল মনটাকে।

অলিমা বলত―সংসারর ধর্ম অইলদে স্রোতর ভেতর সাম্পান। যেন স্রোত হইবু হক, তোঁয়াত্তে বাই যন পড়িবু। (সংসারের ধর্ম মানের স্রোতের ভেতর সাম্পান। যেমন স্রোত হবে হোক, তোমাকে সেটা চালিয়ে যেতেই হবে)

তো প্রবল স্রোতের ভেতরেও সংসারের সাম্পানটাকে সে থামতে দেয়নি। চালিয়ে নিয়ে গেছে।

অলিমা বলতো―

বৃক্ষর আছে ডালপালা

সংসারর আছে ফল

উগগাততুন উগগা বাড়ে

মাইনসে বাড়ে বল।

(বৃক্ষের আছে ডালপালা

সংসারের আছে ফল

একটা থেকে আরেকটা বাড়ে

মানুষের বাড়ে বল)

 বৃক্ষ থেকে বৃক্ষ হয়। সংসার থেকে সংসার। বৃক্ষ দেয় ফল, সংসার বাড়ায় মানুষ। সেসব নতুন মানুষেরও সংসার হয়। অলিমার সংসার থেকেও নতুন সংসারের জন্ম হয়। আমার দাদারা ছিল তিন ভাই। দাদার মৃত্যুর বছর দুয়েক পর বড় ভাইয়ের স্মৃতিময় সংসার থেকে বেরিয়ে তারা নতুন সংসার করলো। সেই নবযাত্রায়ও ছিল অলিমার স্নেহছায়া। কিন্তু কোথায় যেন একটা ছিন্ন হওয়ার বোধ তার ভেতরে জাগল। বুঝতে পারল জীবনের কোথায় যেন পালাবদল শুরু হয়েছে। যার ওপর ভর করে এই সংসারে তার যাত্রা হয়েছিল, সেই মানুষ আলাদা হয়ে ওপারে চলে যাওয়ার পর থেকেই যেন এই পালা শুরু হলো।

অলিমার দুই দেবর মানে আমার মেজ দাদা আর ছোট দাদা আলাদা হলো। চলে গেল অন্য ঘরে, অন্য উঠানে। সেখানেও ডালপালা। নিজের সংসারটাও বড় হচ্ছে। এক একটা নতুন মুখ আসে। ঘর হাসে। অলিমা ভেতরে ভেতরে চোখের জলে ভাসে। সে টের পাচ্ছে। সংসারে আবার আলাদা হওয়ার ডাক আসছে। তার নিজেরই অজান্তে সবকিছু যেন তার নাগালের বাইরে যাচ্ছে। বাড়ির পেছনে পুকুরের পাড়ে বড় একটা শিরিষ গাছ। কত তার ডালপালা। ছোট ছোট কত পাতা। উত্তরের শীতের হাওয়ায় পাতাগুলো কখন ঝরে যায়। পাতারা কি আগাম টের পেয়ে যায় তাদের একদিন ঝরে যেতে হবে। ওদের কি তখন মনে পড়ে অতীতের সবুজ জৌলুসের কথা?

 মনে পড়ে তোমার?―অলিমা বলল।

―তুমি কখন আমার অজান্তে এসে আমার ভেতরে এসে দাঁড়ালে?

―এলাম, তোমাকে খুব মনে পড়ল তাই। বলত তোমার মনে পড়ে কি না? তোমার বাবা একদিন বলল―গ্রামে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা হচ্ছে না। আজকাল পড়ালেখা ছাড়া কোনও গতি নাই।

―তারপর?

―তারপর আর কী? তোমরা শহরে চলে গেলে, আমাকেও সঙ্গে নিয়ে এলে। তোমার চাচা জেঠারা সবাই শহরে এসে আলাদা হলো। তারপর সবাই কবুতরের খোপের ভেতর থাকতে লাগলে।

―শহরের বাসায় এসে তুমি অন্যরকম হয়ে গেলে।

―নিজের জীবন থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। চেনাজানা সব মানুষ অচেনা হয়ে গেল। ধান মাড়াইয়ের শব্দ, শিরিষ গাছে কাঠালপাকানো পাখি, গোয়াল ঘরের বাছুর, পুকুরের ওপাড়ের সেই মাঠ আমার বুকের ভেতর নাচানাচি করত।

―তুমি কষ্ট পেতে?

―না, না।

―আমার বাবা প্রায় বলত, তুমি মহিয়সী।

―কারণ আমি কখনও কষ্ট পেতাম না। ভাবতাম, আমার নাতি নাতনিরা বড় হচ্ছে, সাহেব হচ্ছে, বিবি হচ্ছে।

―আমার দাদাকে ছেড়ে তুমি কত বছর কাটিয়েছ?

―তোমার দাদাকে হারিয়ে তোমাকে পেয়েছি। তোমার বয়স যত, তার চেয়ে মাত্র একবছর কম আমার বৈধব্যের বয়স।

―আমি যখন চৌত্রিশে পা দিয়েছি তখন তুমি মারা গেলে।

―বহু বছর বেঁচেছিলাম। এত বেশি বাঁচাটা অন্যায়। তুমিও বুঝতে পারবে যখন বেশি বছর বাঁচবে। এখন বেশি দিন বাঁচার যন্ত্রণায় দেখছ না কেমন কুঁকড়ে গেছে তোমার মেজ দাদি আর ছোট দাদি। তুমিতো তাদের দেখতে যাও না। এই শহরের অন্ধকার গলিগুলো তোমাদের অন্ধ করে দিয়েছে। তোমাকে কতবার সেই মাঠের কথা বলেছি, কতবার শিরিষ গাছের কথা বলেছি। বলেছি তাদের দেখতে যেও। আমার কবরের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেক। তোমার মেজ দাদি আর ছোট দাদিকে দেখতে যেতেও বলেছি বারবার।

―আমি তো যাই। ওইতো সেদিন গিয়েছিলাম গ্রামে। তোমার কবরের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম।

―জানি, তোমার যাবার ইচ্ছে আছে। একটা টান তুমি অনুভব করো সেই পুরোনো ঘরের প্রতি। তাইতো তোমার কাছে বারেবারে আসি।

―দাদি, তোমার কবরে কত পাতাবাহার। অ্যাকুরিয়ামের সেই মাছের মতো তাদের রঙ। তোমার জীবনের সব রঙ জড়ো করে যেন ওসব পাতা কারা রাঙিয়ে দিয়েছে। গরুলুটা খালের ধারে ধারে অনেকক্ষণ হেঁটেছি। কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।

―পেয়েছ ?

―না, পায়নি। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা নামছিল। এরপর মেজ দাদির উঠোনে গেলাম। দেখি মেজ দাদি একটা হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করছে।

― এটি তার বহু পুরোনো অভ্যাস। তোমার মনে নেই ছোটবেলার কথা? দুপুরের পর উঠোনে ছায়া যখন লম্বা হতে শুরু করত, তোমার মেজ দাদি অনেকগুলো হারিকেন নিয়ে বসত। চিমনিগুলো পরিষ্কার করত, তেল ভরত, সলতে পরিষ্কার করত। আঁধার গাঢ় হলে সবকটা জ্বালিয়ে দিয়ে সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিত। আলো জ্বালাবার সেই পুরোনো কাহিনির আজো শেষ হলো না।

―তোমার মনে পড়ে? আমার তখন এসএসসি পরীক্ষা। বাড়ি থেকে খবর এল মেজ দাদা আর নেই।

―হ্যাঁ, মনে আছে। পুত্র শোকে আমার দেবরটা বড় কষ্ট পেয়েছে। ওই শোকেই বেচারা মারা গেছে।

― দু-দুটো ছেলে দুজন বউকে বিধবা করে, এতিম তিনটা ছেলেমেয়ে রেখে মারা গেল এক বছরের মধ্যে।

―তো, তোমার মেজ দাদি কী বলল তোমাকে।

―মেজ দাদি এখন মানুষ চিনতে ভুল করে। আমাকে দেখেই হেসে দিল। বলল―সুলতান তুই আইসসুস না।

আমি বললাম― দাদি আমি সুলতান নই, তার ছেলে ফারুক। ‘ও নাতি’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ চুপ। তারপর বলল―

ঘরে হাসে ঘরে কাঁদে

ঘরে মানুষ তোয়ায়

সুন্দর ঘরগান ছাড়ি গেলগুই

আঁর উগ্গা ফোয়ায়।

(ঘর হাসে ঘর কাঁদে/ ঘর মানুষ খোঁজে/ সুন্দর ঘরটা গেল ফেলে/ আমার একটা ছেলে)

শরীরটা তার প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কিন্তু বয়স তার কণ্ঠ কাবু করতে পারেনি। কথায় কথায় শ্লোক। কথায় কথায় কাব্য। আমাদের শহরে চলে আসাটা তার কখনও ভালো লাগেনি। বলে তোরা যখন চলে যাস। তোদের পেছন পেছন ঘরও যায় ওই কবর পর্যন্ত। প্রাচীন মানুষগুলোর মায়ায় ঘর আবার ফিরে আসে। দাদির কথায় ঘরের আর্তনাদ―

চান্নি ফরত দুনিয়া ভাসের

খুসবো মাখা ফুইটটে জুঁই

সত্যপীরের কসম লাগে

আরে ফেলাই না যাইসগুই।

(চাঁদের আলোয় দুনিয়া ভাসে

খশবু মাখা ফুটল জুঁই

সত্যপীরের কসম লাগে

আমাকে ছেড়ে যাসনে ভাই)

মেজ দাদি বলে ঘরের অভিশাপ লাগবে তোদের শরীরে―

মেডির উদ্দি বুকখান লাগাই

চুপপে যারগুই হাপ

সাধর উডান বিরান অইয়ে

ঘরর অভিশাপ।

(মাটির ওপর বুক লাগিয়ে/ নীরবে যায় সাপ/ সাধের উঠান বিরান হলো/ ঘরের অভিশাপ)

এরকম ঘরের কাব্য অনুক্ষণ তার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে―

কবরর না’ন আওয়াজ ছাড়া

নিঝাপ ঘরগান ঠাণ্ডা

কন দেশততুন উড়ি আই

হঅলে পারের আণ্ডা।

(কবরের মতো আওয়াজ ছাড়া/ নির্জন ঘর ঠাণ্ডা/ কোন্ দেশ থেকে উডে এসে/ ঘুঘু পাড়ে আণ্ডা।)

ঘরের কাব্যের একটা ঘোরের ভেতর সময় গড়িয়ে যায়। মেজ দাদি হাউমাউ কাঁদে। কঠিন অসুখে ভুগে মরে যাওয়া তাঁর সন্তান আদুর বউয়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছে। সেখানে সুখের সংসার তার। নাতনি খালেদাও পালিয়ে বিয়ে করেছে। আরেক ছেলে হাকিমের দুই ছেলে বড় হয়েছে। আয়-রোজগার ভালো, তাই মাকে নিয়ে চলে গেছে শহরে। মেজ দাদি এখনও প্রতি সন্ধ্যায় হারিকেনের আলো জ্বালায় হারানো সংসারে। আমার দিকে তাকায় আবার বলে―তুই সুলতান, নাকি সুলতানের ফোয়া? তোর মেজ দাদা ন মইরতো? এত তাড়াতাড়ি ন মইরতো, হাড়িকিড়ি পাখি অই গেইয়ে―আঁর পুত দে, তোর পুত খা, পুতের শোকে লোকটা মরি গেলগুই। (তুই সুলতান, নাকি সুলতানের ছেলে? তোর মেজ দাদা মরত না, মরলেও এত তাড়াতাড়ি মরত না। সে পুত্র শোকে হাড়িকিড়ি পাখি হয়ে গেছে। পুত্রের শোকে লোকটা মরে গেল।)

মেজ দাদিকে পুত্রশোকের ভেতরে রেখে আমি চলে আাসি। আমার পেছনে পেছনে গ্রামের ঘরটি বহু দূর হেঁটে আসে। পেছন থেকে ঘর আমাকে বলে…

তোরে আই আগলাই রাইখুম

আঁচল দি আঁর বুক বেড়াই

ঘুমর মধ্যে সপ্পন দিয়ম

আন্ধা মনর চোখ ছাড়াই।

(তোকে আমি আগলে রাখি/ আঁচল দিয়ে বুক ভরে/ ঘুমে তোমার স্বপ্ন দেব/ আন্ধা মনের চোখ ছাড়া)

অলিমা জিজ্ঞেস করে―তোমার ইসমাইল চাচার কথা মনে পড়ে?

―ছোট দাদির ছেলে? হ্যাঁ, মনে পড়ে। বাবড়িকাটা চুলের সেই মানুষটা মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। আর ছোট দাদি দিনরাত কাঁদত। আবার ফিরে এসে সারা বাড়ি হইচই ফেলে দিত। ছোট দাদি কাজের ছেলে লেউদ্দাকে বলত―ওডা আঁর ইসমাইল আইসছি, খালত জাল দিইয়িরে দুয়া উগ্গা মাছ পাবি না? (ওরে আমার ইসমাইল এসেছে, খালে জাল দিয়ে দু-একটা মাছ পাবি ?)

সবাই ছোট দাদিকেই বকাবকি করত―তুমিই ওকে সোহাগ দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছ। বাইরের টানে বারবার হারিয়ে যাওয়া মানুষটা ঘরে ফেরানোর জন্য বিয়ে করিয়ে দিল। এক বছর বড় মনোযোগ দিয়ে সংসার করল। তারপর একদিন জ্যোৎস্না রাতে চাচি দেখে তার পাশের লোকটি নেই। কেন যে গেল, কোথায় গেল―তার হদিস কেউ পেল না। বহু দিন পর ফিরে আসল আবার। বউয়ের কাছে, মায়ের কাছে মিনতি করল―মারে, বউরে, সংসারর টান বড় টান, আই ফিরি আইসছি। আর হন-দিন তোরারে ছাড়ি ন যাইয়ুম। (মাগো, বউগো, সংসারের টানা বড় টান, আমি আমি ফিরে এসেছি। আর কোনও দিন তোমাদের ছেড়ে যাব না।)

সেবার ফিরে আসার তিন দিন পর বউয়ের কাছে গিয়ে বলল― আঁর বুকত হনে বান দিইয়ি ? আই মরি যাইয়ুম। (আমার বুকে কেউ বাঁধ দিয়েছে। আমি আর বাঁচব না) আর সত্যিই তাই হলো। তার কদিন আগে মাঘের শীতে ছোট দাদা কাঁপতে কাঁপতে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করার আগে ছোট দাদা বলেছিল, তোরা চিন্তা নঅ গরিস। আর পোয়া আই যাইবু। (চিন্তা করিস না। আমার ছেলে এসে যাবে)

ইসমাইল চাচার মৃত্যুর পর তার মেয়ে পারভিনকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিধবা মা আর দাদিকে ভারমুক্ত করতে গিয়ে পড়শিরা দায়িত্বটা একটু তড়িঘড়ি করেই করেছে। কিন্তু বেশি দিন তাকে শ্বশুরবাড়ি থাকতে হয়নি। অসুস্থ স্বামীটা তার মা-বাবা বিয়ে করিয়েছিল রোগমুক্তির আশায়। কিন্তু বিয়েতে রক্ষা হলো না তার। শরীরে যক্ষার ক্ষয় ছিল। ফিরে এসেছে পারভিন নিজের ঘরে। একই ছাদের নিচে থাকতে শুরু করল তিন প্রজন্মের তিন বিধবা―ছোট দাদি, তার ছেলের বউ আর নাতনি।

দাদি আমাকে বলে―তোমরা শহরে পড়াশোনা করেছ। সাহেব হয়েছ, বিবি হয়েছ। তোমরা কী কর? ইসমাইলের বউয়ের কথা বাদ দিলাম। ইসমাইলের মেয়েটা যে এত অল্প বয়সে বিধবা হলো। তাকে আবার বিয়ে দিতে পার না?

― পারভিন বিয়ের কথা শুনলে ভয় পায়। সে আর বিয়ে করবে না। তবে সে শহরে চলে এসেছে, একটা হাসপাতালে চাকরি নিয়েছে। নার্সিংয়ের চাকরি। সে বলে―রোগীদের সেবা করতে আমার ভালো লাগে। আমাকে তোমরা বিয়ের কথা বলবে না।

― না পারভিন বিয়ে করবে। তোমরা আসলে দায় এড়াতে এসব কথা বলছ।

― তুমিতো পৃথিবীতে নেই। এতটা নিশ্চিত হলে কী করে ? পারভিনের মনের খবর তুমি জানবেও-বা কী করে ?

― আমি পৃথিবীতে নেই কে বলল? আমি তো তোমার ভেতরে আছি, আমার রক্ত তোমার ধমনিতে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা প্রবাহিত হবে। আমি থাকব, শোনো আমার কথা―পারভিন যে হাসপাতালে চাকরি করে সেখানকার একটা ছেলেকে সে ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বিয়েতে তার ভয়। তাকে বোঝাও। সে মনে করে বিয়ে হয়ে গেলে তার মা আর দাদিকে কেউ দেখবে না। যে ছেলে তাকে বিয়ে করতে চায়, তাকে সে শর্ত দিয়েছে। তার চাকরির টাকা সে মা আর দাদিকেই দেবে।

― ছেলেটা কী জানে পারভিনের অতীত?

― জানে, ছেলেটা সব শর্তে রাজি হবে।

― বিয়ের আগে এরকম অনেকেই শর্তে রাজি হয়। পরে সব ভুলে যায়। আসলে কী জানো? পারভিন নিজের স্বামীর মৃত্যু দেখেছে অল্প বয়সে। বাবার মৃত্যু দেখেছে। তাই আর কোনও বন্ধনে সে যেতে চায় না। যদি আবার… 

―তুমিও তো আমাকে হারিয়েছ। বাবাকে হারিয়েছ। কিন্তু ঠিকইতো ভালোবেসে বিয়ে করেছ।

―কই আমি তো কাউকে হারাইনি দাদি। তুমি শুধু আড়াল হয়েছ? যদি হারাতাম তবে এভাবে আমাদের দুজনের কথা হতো?

―আমি তো তোমার সঙ্গে কথা বলি না। তুমি আসলে তোমার নিজের সঙ্গেই কথা বলো। আমরা আসলে হারাই না। সংসারে বিষাদ আছে, আনন্দ আছে। সেই বিষাদ আমরা আগলে রাখি, যাতে আর কাউকে ছুঁতে না পারে, আলো যাতে নিভে না যায়। পরে সে বিষাদ আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, গ্রাস করে।

―তোমরা, তোমরা মানে কারা?

―আমরা মানে আমার মতো বিষাদের রমণীরা। ওই যে তোমার মেজ দাদি এখনও আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছে। সেও আবহমান বিষাদের রমণী। কিন্তু আর কদিন? কদিন বাঁচবে সে? এরপর?

একটা বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেল অলিমা মানে আমার দাদি। হয়তো একদিন আসবে আবার। নয়তো স্বপ্নে দেখব। গরুলুটা খাল পেরিয়ে ডিঙি বাইতে বাইতে মাছের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কর্ণফুলির ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে সে যাচ্ছে। তার একপাশে মনসা গ্রাম। যেখানে ঘরের কাব্য অনুক্ষণ বাতাসে বাতাসে। জানি না কজন আছে পৃথিবীতে অলক্ষ্যে যাপন করে ঘরহীন বিরল সংসার। ঘর ছিল, ঘর আছে, হয়তো-বা স্মৃতিবাক্স হয়ে মানুষের নিজস্ব কান্নায়। তাকে কী মনে রাখবে আমাদের পুরোনো পৃথিবী ?

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button