আর্কাইভবিশ্বসাহিত্যসাক্ষাৎকার

‘আমি শুধু মনে করি, আমার কিছু বলার আছে’ : মো ইয়ান

বিশ্বসাহিত্য : বরেণ্য সাহিত্যিকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার

২০১২ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী

আলাপচারিতায় : ইউসে রানকুইস্ট চৌ

বাংলা অনুবাদ : শামীম মনোয়ার

[মো ইয়ান চীনা ভাষায় যার অর্থ হলো ‘কথা বলো না’। এটি তাঁর ডাক নাম। প্রকৃত নাম গুয়ান মোয়ে। ২০১২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর ডাক নামকরণ প্রসঙ্গে বলেছিলেন শৈশবে তার বাবা-মা ১৯৫০ সালে চীনের রাজনৈতিক আন্দোলনের সময়ে বাইরে কোনও কথা বলতেন না। তাই পুত্রের নামকরণ করেছিলেন মো ইয়ান। চীনা পুনর্গঠন এবং জাগরণের সময়ে মো ইয়ান কয়েক ডজন ছোটগল্প এবং উপন্যাস প্রকাশের মাধ্যমে লেখক হিসেবে আবির্ভূত হন। তার প্রথম উপন্যাস Falling rain on a spring night। তিনি সাহিত্যকর্মে রূপকথা, লোকগাথা, ইতিহাস এবং সমসাময়িক ঘটনাকে অলীক বাস্তবতার মাধ্যমে উপস্থাপনের দ্বারা তাঁর অসাধারণ সাহিত্যদ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছেন।

চীনের শানতুং প্রদেশের ডালন শহরের গাওমি কাউন্টিতে এক কৃষক পরিবারের মো ইয়ান জন্মগ্রহণ করেন। ডালন শহরটিকে তিনি তার অনেক উপন্যাসে নর্থ-ইস্ট টাউনশিপ নামে উল্লেখ করেছেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তিনি বিদ্যালয় ত্যাগ করে কারখানায় কাজ নেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর তিনি পিপলস্ লিবারেশন আর্মিতে যোগদান করেন। সৈনিকজীবন শুরুর পর থেকে তিনি একাধারে লিখতে থাকেন। Red Sorghum (১৯৮৬), The Garlic Ballads (১৯৮৮), Thirteen Steps (১৯৮৮), The Herbivorous Family (১৯৯৩), he Republic of Wine : A Novel (১৯৯৩), Big Breasts & Wide Hips (১৯৯৫), Red Forest (১৯৯৯), Sandalwood Death (২০০১), Life and Death are Wearing Me out (২০০৩) তার বিখ্যাত উপন্যাস।

মো ইয়ানের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সাক্ষাৎকারটি চীনা ভাষায় গ্রহণ করেছিলেন YuSie Rundkvist Chou। এই সাক্ষাৎকারের ইংরেজি অনুবাদ নোবেল. ওআরজিতে প্রকাশিত হয়।]

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : মি. মো ইয়ান, ২০১২ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য আপনাকে অভিনন্দন। প্রথমত, আমি আপনার কাছ থেকে জানতে চাই… আপনি চীনের শানতুংয়ের একটি ছোট্ট গ্রামের নিরক্ষর পিতামাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেখান থেকে আপনি কীভাবে লেখালেখিতে এলেন ?

মো ইয়ান : হ্যাঁ, আমি শানতুংয়ের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছি কিন্তু আমার বাবা শিক্ষিত ছিলেন। তিনি গ্রামের একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন এবং তিনি ছিলেন গ্রামের একজন সংস্কৃতিমনা বুদ্ধিজীবী। তিনি সবসময় আমাদের পড়াশোনায় উৎসাহিত করতেন।

আমার বড় ভাই ১৯৬০ সালে সাংহাইয়ের ইস্ট চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েছিলেন। সেই সময় আমাদের গ্রামে এটা খুব একটা প্রচলিত ছিল না। তিনি বাড়িতে অনেক বই রেখে গিয়েছিলেন। আমি তখন ছোট ছিলাম। আমি সেই বইগুলো থেকে ভাষা এবং ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকগুলো পড়তাম। ধীরে ধীরে উপন্যাস পড়ার মাধ্যমে সাহিত্যের প্রতি আমার আগ্রহ গড়ে ওঠে।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : আপনি কীভবে লেখালেখি শুরু করলেন ? আপনি কি নিজেই এটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ?

মো ইয়ান : আমি মনে করি, সব লেখকই প্রথমে একজন দক্ষ পাঠক হিসেবে বেড়ে ওঠে। পড়ার সময়ই আমাদের লেখার ইচ্ছা জাগে। আমরা লেখা শিখতে পছন্দ করি। তাছাড়া আমার মতো গ্রামের একজন কিশোরের কাছে সে সময় লেখকরা ছিলেন তারকা, যিনি উপন্যাস লিখতেন তিনি ছিলেন আমাদের কাছে সত্যিই ব্যতিক্রমী।

এছাড়া সেই সময় আমাদের গ্রামে ছিলেন কিছু শিক্ষিত মানুষ। যারা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। তারা শানতুংয়ের রাজধানী জিনান থেকে এসেছিলেন। তারা আমাকে সাহিত্য এবং লেখকদের সম্পর্কে শিখিয়েছিলেন। তাই লেখার প্রতি আমার আগ্রহ অল্প বয়সেই বেড়ে ওঠে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, আমি লেখায় ভালো ছিলাম এবং প্রায়ই আমার শিক্ষকরা আমাকে প্রশংসা করতেন। এই কারণেই আমি ধীরে ধীরে লেখালেখিতে প্রবেশ করি।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : আপনি কি আপনার শৈশব সম্পর্কে আরও কিছু বলতে পারেন ? কেমন ছিল আপনার শৈশব  ?

মো ইয়ান : সব লেখকই তাদের শৈশব, বিশেষ করে শৈশবের স্মৃতি নিয়ে লেখা শুরু করেন। আমার জন্ম ১৯৫৫ সালে। যখন থেকে আমার স্মৃতি তৈরি হতে শুরু করছে, সেই সময় ছিল চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়। অধিকাংশ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, মানুষ কঠিন জীবনযাপন করছে, মানুষ না খেয়ে মরছে। এমনকি আমাদের গ্রামেও। আমি মনে করি এই ধরনের সময় থেকে গড়ে ওঠা কোনও শিশুর স্মৃতি ভীতিকর হতে পারে।

আমার মনে আছে আমাদের গ্রামে অনেক শিশু ছিল যারা শীতে একটু উষ্ণতা পাবার আশায় ভোরের কুয়াশা ভেদ করে যখন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ত তখন আমরা দেয়ালের উপরে বসতাম। আমাদের সবার পরনের কাপড় ছিল ছেঁড়া ফাঁটা এবং তালি মারা। তাছাড়া আমাদের গায়ে খুব কমই কাপড় চোপড় থাকত। আমাদের পেটও ফোলা, কারণ পুষ্টির অভাব। আমাদের হাত-পা শীর্ণ, ক্ষুধার্ত শিশুদের যেমন হয়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমি খুব দুষ্টু ছিলাম। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। বহিষ্কারের পর বড়দের সঙ্গে আমি কোনও কাজেও যোগ দিতে পারিনি কারণ আমার খুব বেশি কর্মদক্ষতা ছিল না। তাই আমি একাই গরু ও ভেড়া চরাতাম। সেই নির্জন পরিবেশে আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য শুধু প্রাণীগুলো আর গাছপালাই ছিল। আমি মনে করি আমার যে ধরনের শৈশব ছিল তা ছিল অনন্য।

যখন পরবর্তীসময়ে আমি লিখতে শুরু করি, আমার শৈশবের সবকিছু আমার কাছে ফিরে আসে, আমি আমার সেই স্মৃতিগুলো লেখায় ব্যবহার করি। বাস্তব জীবন থেকে প্রাপ্ত ধারণা এবং ঘটনাগুলো মিশিয়ে আমি আমার প্রথম উপন্যাস লিখে ফেলি।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : আপনি কেন পঞ্চম শ্রেণিতে বহিষ্কৃত হলেন  ?

মো ইয়ান : তখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং শ্রেণি সংগ্রাম চলছিল। মানুষ ছিল নিরাপত্তাহীন। স্বাধীনতার আগে আমাদের পরিবার জমি জমার মালিক ছিল, সেই প্রেক্ষাপট আমাদের অনুকূল ছিল না। এমন পরিবারের শিশুরা তখন স্কুলে গেলেও তারা ভালো করত না। ‘ভালো করা’ বলতে আমি শিক্ষকদের কাছে পছন্দনীয় হওয়া বোঝাচ্ছি। শিক্ষকরা যদি আপনাকে পছন্দ না করেন তাহলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন এবং স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।

আরেকটি কারণ হলো সেই সময় স্কুলে খুব বেশি পড়াত না। আমরা ভাষা ক্লাসে এবং গণিত বা অন্যান্য ক্লাসেও ‘চেয়ারম্যান মাও এর উদ্ধৃতি’ পড়তাম। ছাত্ররা পড়তে চাইত না, বিদ্রোহ করত। ছাত্ররা প্রতিদিন গোলমাল করত।

আমার বাবা-মা বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি সেখানে কিছু শিখতে পারব না। সুতরাং যখন আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়, তাঁরা আমার পক্ষে লড়াই করেননি। আর আমিও স্কুল সম্পর্কে খুব বেশি একটা আগ্রহ দেখাইনি। তাই আমি খুব অল্প বয়সেই স্কুল ছাড়লাম। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১১।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : তখন আপনার কেমন লাগত  ?

মো ইয়ান : আমি কিছুটা একাকী বোধ করতে লাগলাম। শিশুরা দল বেঁধে আড্ডা দিতে পছন্দ করে কিন্তু আমার বয়সের সবাই তখন স্কুলে। তারা হয়তো অনেক কিছু শিখছে না কিন্তু তারা এক সঙ্গে মারামারি করছে, ঝগড়া করেছে এবং মজা করেছে। যখন আমি আমার স্কুলের সামনে দিয়ে গরু ও ভেড়া চরাতে যেতাম তখন আমি স্কুল গেটের বাইরে থেকে দেখতাম, ভিতরে আমার বয়সের বাচ্চারা মজা করছে। আমিই একমাত্র বাইরে। আমার তখন খুব একাকী লাগত।

এছাড়া আমি জানতাম না আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি কী করব। আমি একসময় এই স্কুলেই ছিলাম। এখন এই অল্প বয়সেই গরু চরাচ্ছি। আমি কি আর কিছু করতে পারব ? আমার ভবিষ্যৎ কী হবে ? আমি বড় হয়ে কী করব ? এক ধরনের নিরাশা বোধে আক্রান্ত হতাম। কিন্তু আমার সেই শৈশবের অভিজ্ঞতা লেখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আমি আমার উপন্যাসে সব ধরনের প্রাণী এবং উদ্ভিদ সম্পর্কে লিখেছি। আমি প্রকৃতির সঙ্গে একজন শিশুর ঘনিষ্ঠ ও রহস্যময় সম্পর্ক সম্পর্কে লিখেছি। যা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারই অবিচ্ছেদ্য অংশ।

যদি আমি আমার অতীতের দিকে ফিরে তাকাই… প্রথমত, যেটার জন্য আমার অনুতাপ হয় তাহলো আমার খুব অল্প বয়সেই স্কুলে যেতে না পারা। আবার একই সঙ্গে, আমি এটি সম্পর্কে এক ধরনের আনন্দও অনুভব করি। যদি আমি ছোটবেলায় সেই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না যেতাম তবে হয়তো আমি লেখক হতে পারতাম না। যদি হতাম তাহলে হয়তো অবশ্যই অন্যরকম লেখক হতাম। ভিন্ন ধরনের বই লিখতাম।

এই কারণেই, এক অর্থে, অল্প বয়সে খামারে ফিরে আসা, প্রকৃতি এবং গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন আমাকে লেখক হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে। অবশ্যই, আমি আমার বাচ্চাদের খামারে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের লেখক বানানোর জন্য স্কুল থেকে বের করে আনব না। এটি সেভাবে কাজ করে না।

আমি যেমনটা আগেই বলেছি, আমার শৈশবের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা আমার লেখায় অনেক সাহায্য করেছে। কিন্তু যদি আমি কীভবে আমার শৈশব কাটাব তা বেছে নেওয়ার সুযোগ পাই তবে আমি আমার সেই নিঃসঙ্গ এবং ক্ষুধার্ত শৈশবের পরিবর্তে অবশ্যই সুখেরটাই বেছে নেব।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : কীভবে এটি আপনাকে লেখায় সাহায্য করেছে ?

মো ইয়ান : প্রথমত, আমি প্রকৃতির সঙ্গে একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। স্কুলে বেড়ে ওঠা একটি শিশু, এবং মাঠে বেড়ে ওঠা একটি শিশুর প্রকৃতির সঙ্গে রয়েছে ভিন্ন সম্পর্ক, প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতিও তাদের ভিন্ন অনুভূতি। অন্যরা প্রতিদিন অন্য বাচ্চা এবং শিক্ষকদের দ্বারা ঘিরে থাকত। কিন্তু আমি প্রতিদিন ঘেরা থাকতাম ভেড়া, গবাদি পশু, গাছপালা, ঘাস এবং বৃক্ষরাজি দিয়ে। প্রকৃতির প্রতি আমার যে অনুভূতি তা ছিল খুবই সূক্ষ্ম এবং আবেগমথিত। অনেক দিন ধরেই আমি ভাবতাম প্রাণী এবং উদ্ভিদ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। এবং এও আমি অনুভব করতাম যে আমি যা বলতাম তা তারা বুঝতে পারে। এই ধরনের অভিজ্ঞতা অনন্য এবং মূল্যবান।

এছাড়া আমি শিশুদের দলের সঙ্গে সময় কাটাইনি। আমি থাকতাম বড়দের সঙ্গে। সেখানে আমার কথা বলার অধিকার ছিল না। তারা আমার বাপ চাচার মতো, তারা বয়সে বড়। আমি তাদের কথার মাঝখানে কথা বললে তারা তিরস্কার করবেন। তাই আমি শুধু তাদের কথা শুনতাম। আমি বেশির ভাগ শিশুদের চাইতে আগেই বড়দের জগৎটা লক্ষ্য করতে শুরু করেছিলাম। আমি আর সবার চাইতে আগেই বড়দের শুনতে শুরু করেছিলাম।

দাদা-দিদিমার কাছ থেকে আমি গ্রামীণ সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনেছি। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, কিংবদন্তি, ঐতিহাসিক ঘটনা এমনকি মিথ এবং ভূতের গল্পও আছে। যেমন একটি নেকড়ে বা মোরগের মানুষে পরিণত হওয়ার গল্প। তাই বিভিন্ন লোকজ উপাদান এবং মৌখিক ঐতিহ্য আমার বইগুলোতে দৃঢ়ভাবে চিত্রিত, কারণ সেগুলো আমার অভিজ্ঞতার অংশ।

এটি একটি অনন্য দৃষ্টিকোণ একটি শিশুর চোখ দিয়ে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করা। যখন একজন বয়স্ক মানুষ কোনও কিছু দেখেন, তিনি যা দেখেন তাতে অবাক হন না। কিন্তু যখন একটি শিশু নিচ থেকে উপরের দিকে তাকায়, যেটা একটি ঊর্ধ্বমুখী দৃশ্য এটি অনেক কিছু দেখায় যা বড়রা দেখতে পায় না। এটি আমার লেখার ক্ষেত্রেও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।

অবশ্যই আরও অন্যান্য দিকও আছে, যেগুলো আমি একবারে ব্যাখ্যা করতে পারব না।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : আপনার শৈশবে, প্রকৃতির সঙ্গে আপনার একটি নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আপনি যখন আজকের চীনের দিকে তাকান, আপনি এটি সম্পর্কে কেমন অনুভব করেন ?

মো ইয়ান : আমি একজন সংরক্ষণবাদী। আমি আমার বইয়ে আমার সংরক্ষণবাদ স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছি। Life and Death are Wearing Me Out এবং ‘ Big Breasts and Wide Hips’-এ আমি পরিবেশের উপর অত্যধিক শোষণ এবং পরিবেশ ধ্বংসের জন্য আমার যন্ত্রণা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছি।

আমি সবসময় বিশ্বাস করি যে আমাদের উন্নয়নের গতি ধীর করা উচিত। আমাদের এত দ্রুত পরিবেশের উপাদানগুলোর উপর শোষণ করা উচিত নয়। আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা উচিত। সমস্ত গ্রামকে শহরে পরিণত করা বন্ধ করুন। আমাদের উচিত জমিগুলো বিশ্রাম দেওয়া। আমাদের ভূমিকে এতটা কঠোর পরিশ্রম করতে দেওয়া উচিত নয় যেন এটি একজন মানুষ।

১৯৮০ সাল থেকে চীনের পরিবেশ দূষণ এবং ধ্বংসের কারণে আমি খুবই ব্যথিত। এর জন্য আমার খুব খারাপ লাগে। আমি যখন দেখি সব জায়গায় কারখানা গড়ে উঠছে, এমনকি এমন একটি গ্রাম যেটা আমার খুব চেনা… যখন আমি দেখি বালক বেলায় যে নদীটিতে আমি সাঁতার কেটেছি, মাছ ধরেছি সেটি এখন একটি নোংরা খালে পরিণত হয়েছে তখন যে কষ্টটা আমি পাই তার বর্ণনা দিতে পারব না। যখন দেখি আমার গ্রামের গাছগুলোর শরীরে পুরাতন প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝুলছে… এই ধরনের প্লাস্টিক দূষণ আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়। এ কারণেই, যখন আমি জাপান এবং অন্যান্য দেশে বক্তৃতা দিই, তখন আমি এই ধরনের অতিশোষণের সমালোচনা করি, যা কেবল অস্থিতিশীল উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক লাভকে কেন্দ্র করে।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : সাহিত্যের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আপনি কি মনে করেন আজকের সাধারণ মানুষের কাছে সাহিত্যের কোন অর্থ আছে ?

মো ইয়ান : সাহিত্য ও বাস্তবতার মধ্যে সম্পর্ক; মানুষের সঙ্গে এর আবেগগত সংযোগ; এমন একটি বিষয় যা অনেকের কাছেই তত্ত্বীয়। সাহিত্যের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো: প্রথমত, এটিকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন করবেন না। এমন আশা করবেন না যে একটি উপন্যাস, একটি কবিতা অথবা একটি নাটক আমাদের সমাজের বাস্তবতাকে পরিবর্তন করবে। এটি একটি খুব উচ্চ প্রত্যাশা। অবশ্যই এটা ঘটেছে, সাহিত্যের একটি অংশ একটা যুদ্ধের দিকে পরিচালিত করেছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা খুবই বিরল। প্রায়শই, সাহিত্যের প্রভাব খুব সূক্ষ্ম।

এর কারণ সাহিত্য হলো শিল্পের একটি রূপ। নান্দনিকতার প্রশংসার মধ্যে দিয়ে এর প্রভাব ধীর লয়ে মজবুত হয়, যেমন বসন্তের বৃষ্টি মাটিকে আর্দ্র করে। তাই আমি মনে করি, সাহিত্যকে এতটা উঁচু আসনে বসানো, সাহিত্যের মাধ্যমে বাস্তবতাকে পরিবর্তন করার প্রত্যাশা, এটি সাহিত্যের উপর বেশি বোঝা বা দায়িত্ব অর্পণ করা।

আবার এটিকে কারও ছোট করাও উচিত নয়। সাহিত্য শুধু মজা করার জন্য নয়; এর উদ্দেশ্য কেবল কিছু হাসি আঁকা নয়। আমি মনে করি সাহিত্যের সবচেয়ে মূল্যবান গুণ হলো মানুষের আত্মার অধ্যয়ন। সাহিত্য সত্য এবং দয়ালুর প্রশংসা করে। সাহিত্য যা অন্ধকার এবং কুৎসিত তা প্রকাশ করে এবং সমালোচনা করে। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আমাদের মনকে আরও সমৃদ্ধ এবং আরও বিস্তৃত করা এবং আমাদের আরও দয়ালু এবং আরও উদার করা। মানুষের মনোজগতের রূপান্তরের মাধ্যমে সাহিত্য আমাদের সমাজ উন্নয়ন এবং উন্নতিকে প্রভাবিত করে। কিন্তু আমি মনে করি এটি একটি খুব ধীর প্রক্রিয়া।

সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক নিয়ে আমার একটি উপমা আছে এবং সেটা হলো মানুষের সঙ্গে তার চুলের সম্পর্ক। অবশ্যই মাথাভর্তি চুল থাকা ভালো। এটি সুন্দর দেখায় এবং মাথাকে বিভিন্ন কিছু থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। কিন্তু একজনের মাথায় বেশি চুল নাও থাকতে পারে, যেমন আমার মতো তবে এটাও তো ঠিক, আমি এখনও সুস্থ আছি। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই। একটি সমাজে অনেক উপন্যাস, কবিতা, কবি এবং লেখক থাকতে পারে যা খুবই ভালো। কিন্তু যদি কমও থাকে, জীবন তবু চলমান… টিকে থাকবে। তাই আমি মনে করি, সাহিত্য হোক বা শিল্প, এটা মানুষের চুলের মতো।

সবশেষে যখন একজন ব্যক্তি মারা যায়, তাকে মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়। যদি তার সমাধি বহু বছর পর খনন করা হয় তবে আমরা দেখতে পাব যে তার মাংস মাটির সঙ্গে মিশে গেছে কিন্তু তার চুল রয়ে গেছে। আমি বলতে চাচ্ছি, সমাজে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয় এবং অদৃশ্য হয়ে যায় সম্ভবত কেবল সাহিত্য এবং শিল্পই টিকে থাকে।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : এটি একটি খুব আকর্ষণীয় উপমা। যখন আপনি লিখতে শুরু করলেন, এর কারণ কী ছিল ? আপনি কী নিয়ে ভাবছিলেন ?

মো ইয়ান : কেউ যদি এমন প্রশ্ন করত তবে আমি কিছুটা রসিকতা এবং কিছুটা গম্ভীরতা মিশিয়ে বলতাম, আমার লেখার প্রাথমিক কারণ―আমি দিনে তিনবার ডাম্পলিং (আপেল ও অন্যান্য ফলের সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে তৈরি এক ধরনের পুডিং) খেয়ে সুখী জীবন-যাপন করতে চেয়েছিলাম। আমাকে এই উত্তর এত ঘন ঘন দিতে হতো যে আমি এতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সত্যই, এখনও আমার উত্তর একই। আমার লেখার প্রাথমিক কারণ মহৎ ছিল না।

কিছু লেখক বলেন, ‘আমি চাই আমার লেখা সমাজ পরিবর্তন করুক।’ ‘আমি সাহিত্যের মাধ্যমে সুন্দর মন তৈরি করতে চাই।’ তারা সাহিত্যকে এসব সংজ্ঞা দেয়। এরকম অনেক লেখক আছেন। আমি মনে করি আমার মতো চীনা লেখকদের জন্য, যারা কৃষিনির্ভর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং দারিদ্র্যের মধ্যে নিম্ন শ্রেণির জীবন যাপন করেছেন, আমাদের লেখার প্রাথমিক কারণ হয়তো সম্ভবত খুব সহজ―এমনকি নিচু ধরনের। এটি ছিল টেবিলে খাবার, আমাদের পরিস্থিতির পরিবর্তন এবং আমাদের অবস্থানের উন্নত করার জন্য। কলম হাতে নেওয়ার আসলে অনেক উপাদানগত সুবিধা রয়েছে।

অবশ্যই, লেখার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যখন আপনার জীবনে পরিবর্তন আসে ফলে সাহিত্য সম্পর্কে অন্যান্য অনেক ধারণা স্বাভাবিকভাবেই আসে। সুতরাং প্রাথমিক কারণটি আসলে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। কিন্তু আমার প্রাথমিক ধারণাটা আসলে এরকমই ছিল।

আমি আগেই বলেছি আমাদের গ্রামে কিছু শিক্ষিত লোক এসেছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন যারা ১৯৬০ এর দশকে ‘একটি ভুল’ করেছিলেন। আজ, যখন আমরা বলি ‘একটি ভুল হয়েছে’, সেটি উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে লিখেছি। কারণ শাস্তি হিসেবে তারা আমাদের গ্রামে এসেছিলেন।

তাদের একজন আমাকে বলেছিলেন, তিনি এমন একজন লেখককে চেনেন যিনি প্রাচুর্যতার ভিতর বাস করেন এবং দিনে তিনবার ডাম্পলিং খান। আমার মতো পরিবারগুলোতে কেবল বসন্ত উৎসবের সময় ডাম্পলিং খাওয়া হয়, তাও বছরে একবার বা দুবার। কিন্তু এমন কেউ আছেন যিনি দিনে তিনবার ডাম্পলিং খান ! আমরা অবিশ্বাসের মধ্যে ছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম একজন রাজাও এমন জীবন-যাপন করতে পারেন না। কিন্তু লেখক হিসেবে কেউ পারেন! তাই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি যদি বই লিখতে পারি, তবে আমিও কি এমন জীবনযাপন করতে পারব ?’ ‘অবশ্যই’, তিনি বললেন। তাই এটিই আমার লেখার প্রথম কারণ ছিল।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : তখন এটাই তাহলে কারণ ছিল কিন্তু এখন আপনার লেখার কারণ কী ?

মো ইয়ান : আজ আমি অবশ্যই দিনে তিনবার ডাম্পলিং খেতে পারি। এমনকি মধ্যরাতেও এখন আমি ফ্রিজ থেকে বের করে এনে সেটা রান্না করে খেতে পারি। তাই আজ, আমার সেই প্রথম দিনগুলোর চাওয়াগুলো দীর্ঘদিন ধরে অর্জিত হয়েছে। তাহলে এখন আমাকে কী চালিত করে ? কী আমাকে লেখালেখি করতে অনুপ্রাণিত করে ? আমি শুধু কয়েকটি বাক্যে তা ব্যাখ্যা করতে পারব না।

প্রথমত, আমি শুধু মনে করি আমার কিছু বলার আছে। আমি আমার চিন্তাভাবনা লিখতে চাই এবং আমার পাঠকদের কাছে একটি সুসজ্জিত কাজের মাধ্যমে বর্ণনা করতে চাই।

দ্বিতীয়ত, সমাজে এমন অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে লেখা আমার কর্তব্য মনে করি।

আরেকটি কারণ হলো সাহিত্যকে শিল্প হিসেবে উদ্ভাবনের জন্য আমার অনুসন্ধান, যা আমাকে লিখতেও অনুপ্রাণিত করে। যেহেতু কাল্পনিক রূপটি প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল, যার কমপক্ষে এক হাজার বছর কেটে গেছে। আর্ট অফ লিটারেচার এবং ফিকশন এর মধ্যে সর্বদা নতুন ফর্ম আবির্ভূত হয়েছে। লেখকরা কথাসাহিত্যের আকার পরিবর্তন করতে থাকেন, তা ভাষা বা বিন্যাসেই হোক। সুতরাং আমাদের প্রজন্মের লেখকদের জন্য সৃজনশীলতার জায়গা আছে কি ? আমার মনে হয় আছে। আমি কথাসাহিত্যকে একটি শিল্প হিসেবে দেখি এবং এর বিকাশকে অসীম হিসেবে দেখি। এর বিন্যাসেও অসীম সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ফিকশন বা কথাসাহিত্যের জন্য আবেগপ্রবণ সাধনা, আমাকে লেখা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : আপনি কেন একটি ছদ্ম নাম ব্যবহার করেন এবং কেন তা মো ইয়ান ?

মো ইয়ান : একটি সংবাদ সম্মেলনে আমি এ বিষয়ে কথা বলেছি। আমার নাম গুয়ান মোয়ে। নামের দ্বিতীয় অংশ যদি ভেঙ্গে বলা যায় তাহলো মো ইয়ান। ঐতিহ্যগত লেখায়, বাম দিকে আছে য়ান বা ‘ইয়ান’ এবং ডানদিকে ‘মো’। অর্থাৎ ‘মোয়ে’, ‘মো ইয়ান’-এর মতো শোনাচ্ছে।

আরেকটি কারণ হলো, খুব কথা বলে আমি এমন শিশু ছিলাম। সেসব দিনে যদি কেউ খুব বেশি কথা বলত তবে সে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে সমস্যায় ফেলার সম্ভাবনা তৈরি করত। এটা যে সবসময় রাজনৈতিক বিষয় ছিল তা না, যখন কেউ প্রতি-বিপ্লবীদের সম্পর্কে কিছু বলে তা আবার সামাজিক সম্পর্কেও সমস্যা তৈরি করতে পারে। কেউ এমন কিছু বলতে পারে যা প্রতিবেশীকে অসন্তুষ্ট করতে পারে বা তার বাবা-মার বিরক্তির কারণও হতে পারে। তা প্রতিবেশীর রাগের কারণও হতে পারে। যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন আমি খুব বাচাল ছিলাম যা আমার বাবা-মাকে অনেক সময় কষ্ট দিয়েছিল। তারা প্রায়ই আমার সমালোচনা করত, বোঝাত এবং এমনকি আমাকে তিরস্কার করত। আমার বেশি বেশি মুখ চালানোর অভ্যাসের জন্য তারা আমাকে বকাঝকা করত।

এছাড়াও যখন আমি লেখালেখি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন আমার কিছু কুসংস্কারমূলক ধারণা ছিল যে অনেক বড় লেখকের ছদ্মনাম আছে। লু শুন এবং বা জিনের মতো লেখকরা সবাই ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। অনেক বিদেশি লেখকও। সুতরাং আমি ভেবেছিলাম, উপন্যাস লিখতে হলে প্রথমে একজনের ছদ্মনাম থাকা উচিত। তাই এগুলো সম্পর্কে চিন্তা করে, আমি নিজের নাম ‘মো ইয়ান’ করে ফেললাম। ।

আবার এটি পিতামাতার শিক্ষার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানানোরও একটি উপায়। এটি আমার জন্য এক ধরনের অনুস্মারক এবং উৎসাহমূলক। আমি মনে করি, যদি কেউ একজন লেখক হতে চান তাহলে তাকে কম কথা বলতে হবে এবং বেশি লিখতে হবে। অতি কথন শক্তি নিঃশেষ করে দেয় এবং সময় কেড়ে নেয়। তবে যদি কেউ একজন শুধু লেখার জন্যই কথা বলে সময় এবং শক্তি ব্যয় করে তাহলে সে আরও বেশি লিখতে পারবে। তাই আমার ছদ্মনামের অর্থের একটি অংশ হল নিজেকে কঠোর পরিশ্রমের জন্য উৎসাহিত করা।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : যদি আপনি আপনার কাজের দিকে পিছন ফিরে তাকান, আপনি কি কোনও পুনরাবৃত্তিমূলক থিম বা পুনরাবৃত্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পান ?

মো ইয়ান : দুটি পুনরাবৃত্তিমূলক থিম আছে। একটি ক্ষুধা, অন্যটি একাকিত্ব। আমি এটা অনেকবার উল্লেখ করেছি। আমার উপন্যাসগুলোতে, বিশেষ করে আগেরগুলোতে এই দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ থিম বারবার এসেছে। কারণ এই দুটি জিনিস আমাকে সবচেয়ে বেশি এবং গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। যখনই আমি অতীত সম্পর্কে লিখব, এই দুটি থিম অনিবার্যভাবে উঠে আসবে।

আমি মনে করি আরও একটি আছে, যা আমি আজ অবধি অনুসরণ করে চলেছি: মানুষের আত্মার গভীরতা অন্বেষণে আমার আগ্রহ। মানুষ কেন এভাবে আছে ? কেন কিছু ভালো এবং কিছু খারাপ ? যখন একই জিনিসের মুখোমুখি হয়ে মানুষ কেন এত ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় ? কেন কিছু কিছু মানুষ স্বাভাবিকভাবেই দয়ালু, আবার অন্যরা অন্যরকম। কেউ কেউ আরামদায়ক জীবন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং তারা ভালো শিক্ষা পাওয়ার পরও বড় হয়ে এত খারাপ হয় ? এগুলো আমার কাছে অচেনা লাগে। আমি আমার লেখার মাধ্যমে একটি উত্তর খুঁজতে চাই এবং গভীর সমস্যাটি অধ্যয়ন করতে চাই, যার কোনও সহজ উত্তর নেই।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : এটি আমার কাছে মনোবিজ্ঞানের মতো শোনাচ্ছে। আপনি এর কোনও উত্তর খুঁজে পেয়েছেন ?

মো ইয়ান : আমি উত্তর খুঁজে পাইনি। মাঝে মাঝে আমি কুসংস্কারের শিকার হই। মাঝে মাঝে আমি মনে করি… আমরা প্রায়ই বিশ্বাস করি যে শিক্ষা এবং সামাজিকীকরণ বংশগত বৈশিষ্ট্য দূর করতে পারে। আমরা যখন কেউ ভালো বা খারাপ হওয়ার কথা বলি, আমরা প্রায়ই এটিকে সামাজিকীকরণের সঙ্গে যুক্ত করি। কিন্তু আমার দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার পরে আমি এটাই মনে করি, সবসময় সামাজিকীকরণের দ্বারা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। কিছু মানুষ এভাবেই জন্মগ্রহণ করে। তাদের চিন্তার প্রক্রিয়া ভিন্ন। তাদের জন্ম অন্যদের ব্যয়ে নিজের স্বার্থ প্রচারের জন্য। আবার কেউ কেউ কষ্ট সহ্য করতে এবং অন্যের জন্য ভালো কাজ করার জন্য জন্মগ্রহণ করে।

আমি মনে করি এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা। ঈশ্বর মানুষের জগতকে আরও জটিল করতে চেয়েছিলেন তাই তিনি কনফুসিয়াসের মতো গড়পরতা উচ্চ নৈতিকতার সত্য সাধুদের একটি দল তৈরি করেছিলেন। এই ধরনের লোকেরা নিঃস্বার্থ এবং অন্যান্য মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। অন্যান্য মানুষের স্বার্থে, তারা যা সবচেয়ে বেশি মূল্যবান তা তারা ত্যাগ করে। এটি শিক্ষার ফল নয়।

আমাদের দুজনের মতো সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দয়া দেখানোর মৌলিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমাদের ভিতরে একটি ধূসর এলাকাও রয়েছে, যা কখনও কখনও আমাদের স্বার্থকে প্রথমে রাখে। কখনও কখনও আমাদের অশ্লীল আবেগও থাকে। বেশির ভাগ মানুষই এরকম।

আরেক দল আছে যারা সাধুদের বিপরীত। তারা জন্মগতভাবেই খারাপ। তাদের নৈতিকতার কোনও ধারণা নেই। মানুষ আমাদের পছন্দ করে কারণ আমাদের নৈতিকতার একটি মৌলিক ধারণা আছে, যদি আমরা এমন কিছু করি যা অন্যকে আঘাত করে আমাদের খারাপ লাগে, আমরা নিজেদের সমালোচনা করি, এমনকি আমরা অনুতপ্তও হই। যারা মন্দ জন্মগ্রহণ করে তাদের নৈতিকতার কোন মৌলিক ধারণা নেই এবং কোনও বিবেক নেই। যখন তারা এমন কিছু করে যাকে আমরা অত্যন্ত মন্দ মনে করি, তারা কি তা করে না। তাদের খারাপ লাগে না, তারা এটা নিয়ে ভালো থাকে।

সুতরাং আমি কেবল এসবের পিছনে যুক্তি ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দিতে পারি। ঈশ্বর তিন ধরনের মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাই আমরা শুধু আমাদের তুলনা এবং বৈপরীত্য চিন্তা করতে পারি।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : আপনার কি ধর্মীয় বিশ্বাস আছে ?

মো ইয়ান : আমি একজন polytheist। এটা এসেছে আমার শৈশব থেকেই যখন আমি মাঠে গরু চরাতাম। সেই পরিবেশে, আমি অনুভব করতে পারি যে সমস্ত জিনিসের আত্মা আছে। গার্সিয়া মার্কেজ অনুরূপ কিছু বলেছিলেন, ‘প্রতিটি জিনিসের তাদের নিজস্ব জীবন আছে। এটা কেবল তাদের আত্মাকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপার।’ যখন আমি গরু পালন করতাম তখন আমি অনুভব করতাম যে পাখি, মাটিতে থাকা প্রাণী এমনকি গাছ এবং ঘাসেরও একটি আত্মা আছে। সবকিছুরই অনুভূতি আছে। তাই আমি মনে করি আমি শৈশব থেকেই polytheist ছিলাম।

আমাদের গ্রামেও এই লোকসংস্কৃতি চালু রয়েছে। আমাদের গ্রাম থেকে খুব বেশি দূরে নয় চিং রাজবংশের সময় পু সাংলিং নামে বিখ্যাত একজন লেখক ছিলেন। তিনি বিভিন্ন প্রাণী এবং উদ্ভিদের দেবতাদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, যা মানুষের আকৃতিতে পরিবর্তিত হতে পারে। এই ধরনের বিশ্বাস গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার দাদা-দিদিমা এবং প্রতিবেশীরা প্রায়ই আমাকে এই ধরনের গল্প বলতেন।

তারপর আমি যখন শহরে গেলাম, সেখানে আমি মার্কসীয় নাস্তিকতা এবং বিভিন্ন দেবতা সম্পর্কে তত্ত্বসহ অনেক তত্ত্ব শিখেছি। এবং আমি ভাবলাম যে সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাস মানবতার আধ্যাত্মিক সম্পদ এবং এটি একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যয়ন করা উচিত।

তাই এখন আমি মনে করি আমার ধর্মীয় বিশ্বাস আছে। আমি সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করি যা মানুষকে সদয় হতে শেখায়। কিন্তু আমি কোনও ধর্মের অনুসারী নই।

ইউসে রানকুইস্ট চৌ : আমাদের সময় প্রায় শেষ। আমি জানতে চাই, নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্যটা আপনার কাছে কী কোনও অর্থবহন করে ?

মো ইয়ান : টাকা… যখন আমার কাছ থেকে চীনা সাংবাদিকরা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তখন তারা বলেছিল, ‘আপনি এত বড় অঙ্কের পুরস্কার পেয়েছেন। আপনি এই অর্থ দিয়ে কী করার পরিকল্পনা করছেন ?’ আমি মজা করে বলেছিলাম, ‘আমি বেইজিংয়ে একটি বড় বাড়ি কেনার পরিকল্পনা করছি’ কিন্তু কেউ একজন সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, ‘এই টাকা দিয়ে হয়তো হবে না।’ বেইজিংয়ের রিয়েল এস্টেটের দাম খুব বেশি। হয়তো এর দ্বারা ১০০ বর্গ মিটারের একটা বাড়ি কেনা যেতে পারে।

এই টাকা ছাড়াও আমি আরামে থাকতে পারি এবং আমার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারি কিন্তু এটি আমাকে আরও কিছু করার সুযোগ দেবে। প্রথমত, আমাকে জীবিকা নির্বাহের জন্য দ্রুত বা বিশ্রাম ছাড়া আর লিখতে হবে না। এখন আমি আমার লেখালেখির মসৃণ পথ তৈরি করতে পারব কারণ প্রচুর টাকা কামানোর জন্য আমার উপর চাপ আসবে না। পরিবর্তে আমি উচ্চ মানের লেখা তৈরি করতে পারব। এছাড়াও আমার এলাকায় সাহায্যের প্রয়োজন আমার এমন বন্ধুদের এবং আত্মীয়-স্বজন বা গ্রামবাসীদের সাহায্য করার জন্য আমি এই অর্থ ব্যবহার করতে পারব

আপনাকে আবারও ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button