আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

সরষের মধ্যে ভূত: বিকল্প বর্জন সূত্রে নতুন বানান : স্বরোচিষ সরকার

প্রচ্ছদ রচনা : বাংলা ভাষা

উনিশশো নব্বইয়ের দশকে বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের পরিমার্জিত সংস্করণ সম্পাদনার সময়ে লক্ষ্য করেছিলাম, অভিধানটির পূর্ববর্তী সংস্করণে ‘খামাখা’ শব্দের আঠারোটি বানান আছে (খামখাহ, খামাখাহ, খামাকাহ, খামাকা ইত্যাদি)। অভিধানের সংকলকগণ মধ্যযুগের পুথি থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের মুদ্রিত গ্রন্থ থেকে শব্দ সংগ্রহ করেছিলেন। হাতে লেখা পুথির যুগে যেমন বানানের বৈচিত্র্য ছিল, ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পরেও তা হ্রাস পায়নি। শব্দটি তাই আঠারো জন বিখ্যাত লেখকের রচনায় আঠারো রকম বানানে লিপিবদ্ধ হয়। সংকলকগণ আঠারোটি ‘খামাখা’ সংগ্রহ করেছিলেন আঠারোটি আলাদা শব্দ হিসেবে। বাস্তবে যে এগুলো অভিন্ন শব্দ, ভুক্তি রচনার সময়ে তা বোঝা যায়। তখন তা অভিন্ন ভুক্তির বিকল্প বানান হিসেবে পাশাপাশি সাজিয়ে দেওয়া হয়। ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের পরিমার্জিত সংস্করণ (প্রকাশকাল ২০০০) করার সময়ে প্রচলিত বানান-সংস্কার বিধি অনুসরণ করে এখান থেকে মাত্র ছয়টি শব্দরূপকে প্রয়োগবাক্যসহ রাখা হয়। এরপর ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘খামাখা’ শব্দের একটিমাত্র বানান লিপিবদ্ধ হয়েছে। ভাষা ব্যবহারে অধিক সুবিধা হবে বিবেচনায় বহু বানানের মধ্য থেকে একটি বানান গ্রহণের এই যে প্রক্রিয়া, এর নাম বানানের বিকল্প বর্জন।

বাংলা বানানের ক্ষেত্রে বিকল্প বর্জন শুরু হয় ১৯২৫ সালে, বিশ^ভারতী যখন বানানের নিয়ম করে। একই শব্দের একাধিক বানান তখন বিশ^ভারতীর প্রকাশনার কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের চিন্তিত করেছিল। সেই চিন্তা দূর করার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ বহু ভাষাবিদ সেই কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁরা বিকল্প বর্জনের জন্য বেশকিছু সূত্র তৈরি করেন, পরবর্তী প্রায় একশো বছর ধরে সেসব সূত্র কমবেশি অনুসৃত হয়ে আসছে। বিশ^ভারতীর অনুসরণে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, বাংলাদেশের টেকস্ট বুক বোর্ড, বাংলা একাডেমি, বাংলা আকাদেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান প্রায় অভিন্ন নীতিতে বিকল্প বর্জনের চেষ্টা করেছেন এবং সেই অনুযায়ী বেশকিছু সূত্র তৈরি করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের সূত্রপ্রণেতাগণ দেখেছিলেন একই শব্দ কখনও দীর্ঘ স্বর দিয়ে কখনও হ্রস্ব স্বর দিয়ে লেখা হয়। সেক্ষেত্রে তাদের সুপারিশ হ্রস্ব স্বরের পক্ষে। একইভাবে কিছু অনুনাসিক বর্ণের ক্ষেত্রে যুক্তবর্ণ ও অনুস্বার দুটোই চলে, সেক্ষেত্রে অনুস্বারের পক্ষে তাঁরা সূত্র তৈরি করেন। এভাবে তৈরি করা যাবতীয় সূত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি শব্দের জন্য অভিন্ন বানান ব্যবহারের সুপারিশ করা। এই সুপারিশ অনেকাংশে সফল হয়েছে এবং এর ফলে বাংলা বানান অনেকাংশে স্থিরতা লাভ করেছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একটি শব্দের একাধিক বানান আছে, এমন শব্দের সংখ্যা আজকাল প্রায় হাতেগোনা।

পাশাপাশি স্মরণীয়, সংখ্যায় কম হলেও বিকল্প বর্জনের এসব সূত্রের সমর্থনে নতুন কিছু বানান তৈরি হয়েছে যেগুলো বানানের বিকল্পহীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে। এটাই হলো সরষের মধ্যকার ভূত।

উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করা যাক। বানান সংস্কারের একটি সূত্রে হ্রস্ব ই আর দীর্ঘ ঈ-র মধ্য থেকে শুধু হ্রস্ব ই-কে গ্রহণ করে বানানকে বিকল্পহীন করার প্রস্তাব করা হয়। সূত্রটি দিয়ে প্রভাবিত হয়ে পরবর্তীকালের সংস্কারকগণ দ্বিতীয় একটি সূত্র তৈরি করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে যাবতীয় অতৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈ বর্জনীয়। যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলা হয়েছে, অতৎসম শব্দে যেহেতু দীর্ঘ ঈ-কার উচ্চারিত হয় না তাই অতৎসম শব্দ থেকে দীর্ঘগুলো বর্জন করা হলে বিকল্প বানান দূর হবে। দ্বিতীয় সূত্রের সাধারণীকরণটি সবার অলক্ষ্যে সমস্যা সৃষ্টি করে, তখন নতুন বিকল্প তৈরি হয়। কেউ মনে রাখেন না, বাংলা ভাষার লিখিত রূপ হাজার বছরের পুরনো। এই হাজার বছর ধরে এখানে এমন বহু শব্দ থাকার কথা, সবসময়েই যা দীর্ঘ ঈ দিয়ে লেখা হয়েছে। সেটা না ভেবে দ্বিতীয় সূত্রটি চালু করার ফলে দীর্ঘ ঈ দিয়ে লেখা বহু শব্দ বাতিল হয়ে যায়। তার জায়গায় হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লেখা নতুন কিছু বানানের জন্ম হয়। তৈরি হয় নতুন বিকল্প। ‘ঈদ’ শব্দের ‘ইদ’ বানান, তেমন একটি উদাহরণ। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে গত পাঁচশো বছর ধরে ঈদকে কেউ ই-কার দিয়ে লেখেননি, সেটা কেউ মনে রাখেন না।

উপরের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সূচিত ‘কী’ বানানটিকেও হ্রস্ব ইকার দিয়ে ‘কি’ হিসেবে লিখতে হতো। কারণ এটি অতৎসম শব্দ। অথচ বানান-সংস্কারকগণ এখানে কোনও হস্তক্ষেপ করেন না। বরং সমাসবদ্ধ যেসব ‘কী’কে রবীন্দ্রনাথ ‘কি’ হিসেবে লিখেছিলেন, যেমন ‘কিভাবে, কিরূপে, কিসের’, সেগুলোকেও তাঁরা ‘কীভাবে, কীরূপে, কীসের’Ñ এভাবে লিখতে চান। অদ্ভুত স্ববিরোধিতা। অর্থাৎ সরষের ভিতরকার ভূত কখনও অপ্রয়োজনে দীর্ঘ ঈ-কার বর্জন করে, কখনও আবার সূত্র লঙ্ঘন করে দীর্ঘ ঈ-কারের আমদানি করে। এভাবে বানান সংস্কারের মূল প্রয়োজন পরবর্তীকালের বানান সংস্কারকগণ ভুলে যান।

বানান সংস্কারের অনেকগুলো সূত্র এভাবে বিকল্প বর্জনের মূল প্রয়োজন ভুলে গিয়ে নতুন করে বিকল্প বানান তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে ণ-ত্ব সংক্রান্ত একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথম দিকে সূত্র করা হলো মূর্ধন্য ণ এবং দন্ত্য ন দিয়ে যদি একই শব্দের একাধিক বানান থাকে, তাহলে দন্ত্য ন বানান গ্রহণ করা হবে। সেই সূত্রে ‘পাণ ও পান’ বা ‘সোণা ও সোনা’ বানানের মধ্যে যথাক্রমে ‘পান’ ও ‘সোনা’ বানানকে সমর্থন করা হয়। কিন্তু ঐ সূত্রকে এগিয়ে নিতে গিয়ে যখন বলা হলো যাবতীয় অতৎসম শব্দ থেকে মূর্ধন্য ণ বর্জন করা হবে তখন আবার সরষের মধ্যে ভূত ঢুকে গেল। কেননা যেসব শব্দে কেউ কখনও দন্ত্য ন ব্যবহার করেননি, সূত্র অনুসরণ করতে গিয়ে সেইসব শব্দে দন্ত্য ন-এর ব্যবহার শুরু হলো। তাতে ভান্ডার, ঠান্ডা, ডান্ডা, কান্ডারি ইত্যাদি বানানের আমদানি হলো। ষ-ত্ব নিয়েও তাঁরা এমন চিন্তা করেননি, তা নয়। বানান সংস্কারের একটি সভায় একজন সদস্য সে প্রস্তাবও করেছিলেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় যখন বলা হলো, ‘ষোলো’ বা ‘ষাট’ বা ‘শিষ’-কে তিনি ‘শোলো’ বা ‘শাট’ বা ‘শিশ’ রূপে দেখতে রাজি কি না তাতে তিনি খানিকটা নিরস্ত হন। এই ষ-ত্ব ভূতকে যে সবসময়ে ঠেকানো গেছে তা বলা যায় না। যেমন যাবতীয় বিদেশি শব্দের ষ্ট-কে স্ট, ণ্ড-কে ন্ড, ণ্ঠ-কে ন্ঠ প্রভৃতি করা হয়েছে। এসব যুক্তবর্ণ বাংলা ভাষায় বিকল্প বর্জনের কাজ করেনি বরং নতুন বিকল্পের জন্ম দিয়েছে।

সম্প্রতি বাংলা একাডেমি শতাধিক শব্দের বিকল্প বানান ও ভিন্নমত নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। এসব বানানের বড়ো একটি অংশ এই সরষের মধ্যকার ভূতের কারবার। অন্তরীণ বানানকে অন্তরিন করা, আপোস বানাকে আপস করা, ঈগল বানানকে ইগল করা, ইতিপূর্বে ইতিমধ্যে বানানকে ইতঃপূর্বে ইতোমধ্যে করা, ঈদ বানানকে ইদ করা, উপরোক্তকে বানানকে উপর্যুক্ত করা, উপলক্ষ উপলক্ষে বানানকে উপলক্ষ্য উপলক্ষ্যে করা, কোরান বানানকে কোরআন করা, গুণ্ডা ঠাণ্ডা ভাণ্ডার বানানকে গুন্ডা ঠান্ডা ভান্ডার করা, গরু বানানকে গোরু করা, ঠেলাগাড়ি বানানকে ঠ্যালাগাড়ি করা, ডায়েরি বানানকে ডায়ারি করা, ধরণী বানানকে ধরণি করা, পাদ্রি বানানকে পাদরি করা, প্রাণীবিদ্যা বানানকে প্রাণিবিদ্যা করা, বৈকি বানানকে বইকি করা, বৈঠা বানানকে বইঠা করা, বৌভাত বানানকে বউভাত করা, ব্যবহারিক বানানকে ব্যাবহারিক করা, মহামারী বানানকে মহামারি করা, যুবতী বানানকে যুবতি করা, লণ্ঠন বানানকে লন্ঠন করা, শিহরণ বানানকে শিহরন করা, সমসাময়িক বানানকে সামসময়িক করা, সম্মানী বানানকে সম্মানি করা ইত্যাদি তার কয়েকটি উদাহরণ।

দেখা যাচ্ছে বানান সংস্কারকগণ এখানে যুক্তি দেখিয়ে যেসব নতুন বানান তৈরি করেছেন, তাতে বানান সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য লঙ্ঘিত হয়েছে। পাঠককে পুনরায় মনে করিয়ে দিতে চাই, বানান সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি শব্দের যাতে একাধিক বানান চালু না থাকে এবং একাধিক বানানের ক্ষেত্রে একটি বানান যাতে সমর্থিত হয়। কিন্তু সেই কাজ করতে গিয়ে যেসব সূত্র তৈরি করতে হলো, তার ফলে উপরের অনুচ্ছেদের যেসব শব্দের জন্ম হলো সেগুলো বিকল্প বর্জনে সহায়তা করলো না, নতুন নতুন বিকল্প সৃষ্টি করল।

সরষের মধ্যকার এই ভূতের হাত থেকে বাংলা বানানকে কীভাবে রক্ষা করা যাবে, অবশ্যই সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন। মুদ্রাস্ফীতির যুগে এটাকে কোটি টাকার প্রশ্ন বললেও খুব বেশি বলা হয় না।

জনসনের অভিধানে মুদ্রিত ইংরেজি শব্দের বানান যেমন নির্বিবাদে সবাই গ্রহণ করেছিল, বাংলা ভাষায় যদি তেমন একটা অভিধান তৈরি করা যায় তাহলে এসব ভৌতিক ব্যাপার নিয়ে আর কোনও বিতর্ক করতে হবে না। শব্দের বানান নির্ধারণে যেভাবে আজকাল জাতিভেদের মতো তৎসম-অতৎসম বিভাজন করা হয়, সেটাও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। মানুষ তখন সূত্র দেখে বানান ঠিক করতে যাবে না, অভিধান দেখে বানান ঠিক করবে। আর সেই অভিধান যদি কম্পিউটার প্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাহলে তো কথাই নেই। বানান নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থী, লেখক, পাঠক এখন যেভাবে দ্বিধায় পড়েন, তখন সেই দ্বিধা দূর হবে। তবে সেই অভিধান তৈরি করার সময়ে মনে রাখতে হবে, বাংলাভাষী মানুষের একক এখন প্রায় ত্রিশ কোটির; তারা শুধু বাংলাদেশেই বাস করে না, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি প্রদেশে বাস করে, বাস করে ইউরোপ-আমেরিকা- অস্ট্রেলিয়ায়, বাস করে মধ্যপ্রাচ্যে। এই এককের বলে বাংলাভাষী মানুষ পৃথিবীতে ষষ্ঠ বৃহত্তম। সম্ভাব্য সেই অভিধানে এদের সকলের অংশগ্রহণ না থাকতে পারে তবে এদের উপস্থিতির কথা যেন সংকলক-সম্পাদকদের মনে থাকে।

 লেখক : ভাষাতত্ত্ববিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button