ক্রোড়পত্রে স্মরণাঞ্জলি : আলী ইমাম
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের নন্দিত এক নায়কের নাম আলী ইমাম। কিশোর পাঠকদের কাছে আলী ইমাম নামটি ছিল অনেক আদরের অনেক ভালোবাসার। গল্প কথক বা স্টোরি টেলার হিসেবে অনন্য উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। গল্প লেখার ক্ষেত্রে কিংবা মঞ্চে অনুষ্ঠানে কথা বলার ক্ষেত্রে অপরূপ একটা ভাষাশক্তি আয়ত্ত করেছিলেন আলী ইমাম। দুটি ক্ষেত্রেই আলী ইমাম ছিলেন তুলনাহীন প্রতিভার অধিকারী। লিখতে পারতেন দুহাতে। রচনার অজস্রতায় তিনি ছিলেন শীর্ষে। সমসাময়িক লেখকরা কেউই সেই উচ্চতার ধারেকাছেও ছিলেন না। ছোটদের বর্ণিল জগতের নন্দিত লেখক আলী ইমাম শীর্ষে ছিলেন জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রেও। কয়েকটি প্রজন্মের কাছে আলী ইমাম নামটি ছিল ভালোবাসাধন্য।
২.
সময়কাল সত্তরের দশক।
আমাদের শিশুসাহিত্যের ভুবনে আলী ইমাম নামটি তখন হীরক দ্যুতির ঔজ্জ্বল্য নিয়ে খ্যাতির মধ্য গগনে দীপ্যমান। অপরূপ একটি ভাষা শৈলী আয়ত্তে ছিল তাঁর। কিশোর পাঠককে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করত আলী ইমামের গদ্য। বিচিত্র মানুষ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পাখিদের প্রতি মমতাময় কথামালায় পরিপূর্ণ ছিল তাঁর গল্পের পটভূমি। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় কিশোরদের হৃদয়ে নতুন নতুন অভিযাত্রায় শামিল হওয়ার দুনির্বার আহবান থাকত তাঁর রচনায়। কয়েকটি প্রজন্মকে তিনি মুগ্ধতা আর ভালোবাসার সৌরভে মোহিত করে রেখেছেন। সেই মোহিত প্রজন্মের একজন ছিলাম আমিও। ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরে আমার জীবনের প্রথম ছড়াটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। আলী ইমাম তখন তুখোড় মেধাবী লেখক হিশেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন।
আলী ইমামের প্রথম প্রকাশিত বইটির নাম ছিল―‘দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া’। ১৯৭৫ সালে বেরিয়েছিল বর্ণমিছিল থেকে। কয়েকটি গল্পের সংকলন ছিল সেটা। বইটির ফ্ল্যাপ লিখেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। কাজি হাসান হাবিব এঁকেছিলেন প্রচ্ছদ। বর্ণমিছিলের কর্ণধার তাজুল ইসলাম ছিলেন আলী ইমামের বচন এবং পাঠমুগ্ধ। তাঁর নিজের প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা ছিল বলে তরুণ লেখক আলী ইমামের জীবনের প্রথম বইটি প্রকাশ করতে গিয়ে লাভ লোকসানের কোনও হিসেবেই যাননি তিনি। বর্ণমিছিলের ছোট্ট একটা অফিস ছিল পুরানা পল্টনে।
এক জীবনে বিচিত্রসব বিষয়ে শত শত বই লিখেছেন আলী ইমাম। সহস্র কিশোরপাঠকের মন জয় করা তাঁর কয়েকটা বইয়ের নাম―শাদা পরি, তিতিরমুখীর চৈতা, বনকুসুমপুর রহস্য, নীলডুংরির আতঙ্ক, পাখিদের নিয়ে, ভয়ংকরের হাতছানি, প্রবাল দ্বীপে আতঙ্ক, পিশাচের ছায়া, বাদাবনে লড়াই, রক্তমাখা পুথি, জাফলঙ্গের বিভীষিকা, সবুজ বাড়ির কালো তিতির, ধূসর পুথি, রক্তপিশাচ তিতিরোয়া, ইয়েতির চিৎকার, গাঙচিল দ্বীপের বিভীষিকা, বুনোহাঁসের রক্ত, হিমকুঁড়ির জঙ্গলে এবং অপারেশন কাঁকনপুর।
স্মৃতি থেকে লিখলাম। তালিকা ধরে লিখলে যুক্ত হবে আরও প্রচুর বই।
সত্তরের দশকে সাপ্তাহিক কিশোর বাংলার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর কিশোর উপন্যাস অপারেশন কাঁকনপুর বিপুলভাবে পাঠকনন্দিত হয়েছিল। নাসিরউদ্দীন ইউসুফের প্রয়োজনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে উপন্যাসটির নাট্যরূপ প্রচারিত হয়েছিল।
৩.
শিশুসাহিত্যিক আলী ইমামের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কটা এমন যে চাইলে গোটা একটা স্মৃতিকথার বই লিখে ফেলা যায় তাঁকে নিয়ে। আমার শৈশব-কৈশোরের উত্তাল দিনগুলোয় বিপুল স্নেহ-সান্নিধ্য পেয়েছিলাম মেধাবী মানুষটার। আমার বিকশিত হবার সময়টার বড় একটা অংশজুড়ে আলী ইমাম ছিলেন আমার অগ্রজবন্ধুর মতো। আমি ছিলাম তাঁর নিত্যসহযাত্রী। আলী ইমামের দুই অনুজ ছিল আমার সহপাঠী, বন্ধু। কিন্তু আমি এক পর্যায়ে হয়ে উঠেছিলাম আলী ইমামেরই বন্ধু। এতটাই আপন করে নিয়েছিলেন তিনি আমাকে যে তাঁর অনুজ অপু একদিন আক্ষেপ করে বলেছিল―তুই আর আমার বন্ধু নাইরে দোস্ত, এখন তো দেখি তুই আমার ভাইজানের বন্ধু!
সত্তরের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করতেন আলী ইমাম। টেলিভিশনের শাদাকালো যুগের কথা। বিটিভির কালো পর্দায় ঝকঝকে শাদা হরফে প্রযোজনা আলী ইমাম লেখা টেলপটা যখন ভেসে উঠত তখন আমার খুব গর্ব হতো―এই মানুষকে আমি চিনি। তিনিও চেনেন আমাকে!
বিভূতিভুষণের পথের পাঁচালী পড়ে মুগ্ধ হয়ে সংসারে নতুন সদস্য হিশেবে জন্ম নেয়া ছোট ভাইটির নাম রেখেছিলেন অপু। আলী ইমাম ভাই অপুর পরে জন্ম নেয়া আরেকটা ছোট ভাইয়ের নাম রেখেছিলেন কাজল।
আলী ইমামের এই ছোট দুই ভাই আলী হায়দার অপু এবং কাজল ছিল আমার সহপাঠী, নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। একদা এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন আলী ইমামও।
স্কুলে অপু প্রায়ই ছোট্ট একটা চিরকুট আমার দিকে এগিয়ে দিত―এই যে, ভাইজান তোরে দিতে বলছে। চিরকুটে লেখা থাকত―‘প্রিয় রিটন, ছুটির পরে ডিআইটি ভবনে চলে এস। আলী ইমাম।’ তখন ডিআইটি ভবনেই ছিল বিটিভি অফিস। ওখান থেকেই প্রচারিত হতো অনুষ্ঠান।
ছুটির পর আমি চলে যেতাম ডিআইটিতে। আলী ইমাম ভাই আমাকে স্ক্রিপ্ট বুঝিয়ে দিতেন। লাইভ অনুষ্ঠান করে আমি বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু নিজেকে দেখতে পেতাম না টিভি পর্দায়। সেই সময়ে বিটিভিতে প্রচারিত হতো শুধুই লাইভ অনুষ্ঠান। রেকর্ড করা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে আরও কিছুকাল পরে।
ডিআইটিতে এবং পরবর্তীসময়ে রামপুরায় স্থানান্তরিত বিটিভিতে অসংখ্য অনুষ্ঠান করেছি আমি প্রযোজক আলী ইমামের। আউটডোরে ইউনিট নিয়ে যাবার সময় প্রায়শ আলী ইমাম ভাই আমাকে তুলে নিতেন বাড়ি থেকে, তারপর নির্দিষ্ট লোকেশনে গিয়ে কোনও একটা বিষয় নির্ধারণ করে আমার হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিয়ে বলতেন― বলতে থাকো। তাঁর প্রযোজনায় এ রকম কত অনুষ্ঠান যে করেছি আমি তার হিসেব নেই।
ওয়ারি হেয়ার স্ট্রিটে থাকতাম আমি। আর আলী ইমাম ভাই থাকতেন ঠাটারি বাজার বিসিসি রোডে। হাঁটা পথের দূরত্ব। দিবারাত্রির কত সময় যে কাটিয়েছি তাঁর সঙ্গে! তাঁর ড্রয়িংরুমের চারপাশের দেয়ালজুড়ে র্যাক, তাতে শুধু বই আর বই। বইয়ের সমুদ্রে বসবাস মানুষটার। ১৯৮৪ সালে কোলকাতা বেড়াতে গিয়েছি আলী ইমাম ভাইয়ের সঙ্গে, তাঁর স্ত্রী পঁইপঁই করে বলে দিয়েছেন―‘খবরদার যদি কোনও বইয়ের বস্তা নিয়ে ফিরে আসো কোলকাতা থেকে তাহলে বাড়িতে ঢুকতে পারবে না।’ কিন্তু আলী ইমাম ভাই সেবার সত্যি সত্যি বস্তাভর্তি বই নিয়েই ফিরেছিলেন। কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানে ঢুকে আলী ইমাম ভাইয়ের তো মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। যা দেখেন তা-ই কিনে ফেলেন! (ঢাকা তখনও কোলকাতার বইয়ের ডাম্পিংপ্লেস হয়ে ওঠেনি।)
৪.
সময় বহিয়া যায়।
লেখক আলী ইমামের সঙ্গে আমার আন্তরিক একটা পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
সবসময় হাসিখুশি উৎফুল্ল মেজাজে থাকি বলে আলী ইমাম ভাই তাঁর হাসির গল্পের একটা সংকলন উৎসর্গ করেছিলেন আমাকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন―আমাদের এই গোমড়া দেশে/ যে চলেছে নিত্য হেসে…।
বিসিসি রোডের নিজেদের বাড়ি থেকে আলী ইমাম ভাই আজিমপুরে শশুরমশাইয়ের বাড়িতে শিফট করলেন। নানা কাজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আজিমপুর শেখ সাহেব বাজারের মন্দিরলাগোয়া গলিতে আলী ইমাম ভাইয়ের নতুন আবাসস্থলে যাই। এক পুত্র এক কন্যা নিয়ে ছোট্ট সুখি পরিবার আলী ইমামের। পুত্র অন্তু আর কন্যা অনিতা। অনিতা আমার কন্যা নদীর সমবয়েসি। একদিন আজিমপুরে আলী ইমাম ভাইয়ের বাসায় গেছি। আমাকে দেখে লাফাতে লাফাতে ছুটে এল ছোট্ট অনিতা। ওর নাক ধরে ওকে একটু আদর করে দিলাম। আলী ইমাম ভাই বললেন―রিটন তুমি ওর নামটা জিগ্যেস করো তো। আমি জিগ্যেস করলাম―অনিতা মামনি তোমার নাম কি গো ?
মাথাটা ঝাঁকিয়ে বেণি দুলিয়ে অনিতা বলল―আমার নাম শিদেবী।
আলী ইমাম ভাই আমাকে বুঝিয়ে দিলেন ও বলেছে ওর নাম শ্রীদেবী।
আমি হেসে ফেললাম―আরে তাই নাকি! তুমিই তাহলে শ্রীদেবী! ইন্ডিয়ান মুভির বিখ্যাত নায়িকা ?
একটা লাজুক হাসি হেসে অনিতা বলল―হ্যাঁ তো! আমিই শীদেবী।
বললাম―তাহলে একটু নেচে দেখাও। অনিতা দেখাল। ভারি মজা পেয়ে গেলাম আমি। বললাম―মজা তো!
আলী ইমাম ভাই বললেন―মজার এখনও শেষ হয়নি। তুমি ওকে জিগ্যেস করো তো বড় হয়ে ও কী করবে ?
আমি জানতে চাইলাম―শ্রীদেবী মামণি বড় হয়ে তুমি কী করবে ?
এক সেকেন্ডও দেরি না করে অনিতা বলল―বড় হয়ে আমি আমির খানকে বিয়ে করব! হিহিহি।
আমিও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। ওকে আদর করে জড়িয়ে ধরি। এইটুকুন ছোট্ট মেয়েটা ওর ভবিষ্যৎ বিয়ের পরিকল্পনা রিটন কাকুকে বলতে পেরে মহা খুশি। আমার দিকে তাকায় আর হাসে হিহিহি।
৫.
সময় বহিয়া যায়।
অনিতারা বড় হতে থাকে।
এর অনেক বছর পর, আমি দেশান্তরি হয়ে এক পর্যায়ে কানাডায় থিতু হলাম।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে টানা সাত বছর আমি আর দেশে ফিরতে পারলাম না।
২০০৭ সালের নভেম্বরে দেশে ফেরার পর সেদিনের সেই ছোট্ট পুতুলের মতো মিষ্টি মেয়েটার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায়। সে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা আমার। অন্তু আর অনিতাকে এত ছোট দেখেছি! আর এদিকে কোনো ফাঁকে যে এরা বড় হয়ে গেল তা টেরই পাইনি। বিকেলে বইমেলায় চ্যানেল আইয়ের লাইভ অনুষ্ঠান ‘বইমেলা সরাসরি’ উপস্থাপনা শেষে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি বহেরাতলায়, লিটলম্যাগ চত্বরে। এমন সময় পেছন থেকে ‘রিটন কাকু রিটন কাকু’ বলে কেউ একজন ডাকল। আমি তাকিয়ে দেখি একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত হাস্যোজ্জ্বল মওলানা টাইপ তরুণ আমাকে ডাকছে। কয়েক সেকেন্ড পর দাঁড়িঅলার হাসিটা রিকগনাইজ করতে পারলাম―আরে এ যে অন্তু! আলী ইমাম ভাইয়ের পুত্র অন্তু! আমাদের অন্তু! ওর হাতে একটা বাচ্চা। ওর প্যান্টের নিচের অংশ টাখনু অর্থাৎ পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত মোড়ানো। সহি তরিকায়। ওর বাম পাশে হিজাব পরা একটা মেয়ে। অন্তু পরিচয় করিয়ে দিল―রিটন কাকু এইটা আমার ওয়াইফ আর এইটা আমার ছেলে। আমি মহা বিস্ময়ে অন্তুকে ওর বউকে আর ওর ছোট্ট ছেলেটাকে দেখি! আমি বিস্ময় না লুকিয়েই বলি―তুমিতো অন্তু একেবারে সহি হুজুর হয়ে গেছ! অন্তু হাসে। ছেলেবেলার সেই মিষ্টি হাসিটা। যে হাসিটা আমার অনেক পরিচিত। অন্তুর ডান পাশে আরেকটা মেয়ে। মেয়েটার হাতেও একটা পিচ্চি ছেলে। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে সেই তখন থেকে হাসছে। হাসিটাও আমার অনেক পরিচিত। হাসিটা অনিতার। আমাদের মামণি অনিতার। আমাদের শ্রীদেবী অনিতার। আমির খানকে বিয়ে না করলেও বিয়ে একটা করেছে সে। রাজপুত্তুরের মতো একটা বরও পেয়েছে সে। আর পেয়েছে ছোট্ট মায়াভরা চোখের হস্যোজ্জ্বল একটা পুত্রসন্তান!
আমি অনিতার মাথায় হাত রাখি―আরে অনিতা! তোমরা কখন এত বড় হয়ে গেলে! আমি তো তাহলে একদম বুড়ো হয়ে গেছি!
অনিতা হাসে হিহিহি। আপনি বুড়ো হননি রিটন কাকু। নদী কেমন আছে ?
আমি বললাম―নদী ভালো আছে। নদীটাও বড় হয়ে গেছে তোমার মতোই!
অন্তু আর অনিতা জানাল―আমার সঙ্গে দেখা করবে বলেই ওরা বইমেলায় এসেছে আজ। ওদের মাও আছেন সঙ্গে।
অনিতা আর অন্তুর বাচ্চা দুটোকে আদর করতে করতে বললাম―এই বাচ্চা দুটোর মতোই ছোট্ট এতটুকুন ছিলে তোমরা দুজন। আর আজ তোমাদের দুজনার হাত ধরে বইমেলায় হাঁটছে তোমাদের বাচ্চারা। কী কাণ্ড কী কাণ্ড!
আমার চোখে জল আসে। আমি সেটা লুকোই। এই আনন্দাশ্রু আমার একান্ত নিজের। এটা আমি কাউকে দেখতে দিতে চাই না। আহা জীবন কী সুন্দর একটা রহস্যঘেরা চলচ্চিত্রের মতো! অতীত আর বর্তমানকে কাট টু কাট মন্তাজ কিংবা ডিজল্ভ পদ্ধতিতে জীবন নামের চলচ্চিত্রটা কয়েক সেকেন্ডে আমাকে পরিভ্রমণ করাল হেয়ার স্ট্রিট টু ঠাটারি বাজার বিসিসি রোড। ঠাটারি বাজার বিসিসি রোড টু আজিমপুর। আজিমপুর টু এলিফ্যান্ট রোড। এলিফ্যান্ট রোড টু টোকিও। টোকিও টু নিউইয়র্ক। নিউইয়র্ক টু অটোয়া। অটোয়া টু বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি টু বাংলাদেশ টেলিভিশন। ওম শান্তি!
৬.
১৯৯৪ সালে আমি বাড়ি ভাড়া নিলাম আজিমপুরে। শেখ সাহেব বাজার গলিতে। নিয়তি আমাকে ঠেলে নিয়ে এল এমন একটা বাড়িতে যে বাড়ির বেলকনিতে দাঁড়ালে খুব সরু গলির অপর প্রান্তের জানালায় আলী ইমামকে দেখা যায়। ওরা জানালা খুললেই আমরা আড্ডা দিতে পারি। অন্তু অনীতার মা লিপি ভাবি আর নদীর মা শার্লি কত কথা যে বলে এখানে দাঁড়িয়ে!
প্রায়ই, সোম-মঙ্গল যেকোনও বারে গভীর রাত্রিতে আলী ইমাম ভাই বাড়ি ফিরলে ভাবির সঙ্গে খানিকটা ঠোকাঠুকি হয়। সেই ঠোকাঠুকির অধিকাংশই, বলতে গেলে প্রায় সবটুকুই আমরা শুনতে পাই। আফসোস করে আলী ইমাম ভাই একদিন বলেছিলেন―আচ্ছা রিটন ঢাকা শহরে এত এত জায়গা থাকতে তোমাকে আজিমপুরেই বাড়ি ভাড়া নিতে হবে কেন ? আজিমপুরে নিয়েছ ঠিক আছে কিন্তু সেটা শেখ সাহেব বাজারেই হতে হবে কেন ? আর যদি হলোই বা তোমার বাসাটা ঠিক আমার জানলা বরাবরই হতে হবে কেন ? কোনও মানে হয়!
আমি হাসি―আপনি আমাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইলেও নিয়তি আমাদের দূরে থাকতে দেবে না আলী ইমাম ভাই!
৭.
আলী ইমাম আর আমি একসঙ্গে বহু জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে গেছি। সুন্দরবন গেছি। কোলকাতা গেছি। চট্টগ্রাম-রাজশাহী কত জায়গাতেই না গেছি আমরা একসঙ্গে! কখনও টিভির জন্যে অনুষ্ঠান বানাতে। কখনও সাহিত্যের অনুষ্ঠানে। কখনও শুধু এককাপ চা পান করতে। হ্যাঁ, গুড়ের চা খেতে এক বিকেলে আমি আর আলী ইমাম ভাই ওয়ারি থেকে সদরঘাট গিয়ে নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা নামের একটা গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। ওখানে একটা বিখ্যাত চায়ের দোকান ছিল। আমরা দুজন কয়েক কাপ করে গুড়ের চা খেয়েছিলাম। আমাদের পাগলামির কথা শুনে অনেকেই হেসেছিল। খাওয়ার ব্যাপারে আমাদের দুজনারই বিপুল আগ্রহ। বহু বিচিত্র খাবার আমরা খেয়েছি এক জীবনে।
১৯৮৪ সাল।
আমি আর শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম সত্যজিৎ দর্শন শেষে ঢাকায় ফিরছি কলকাতা থেকে। বেনাপোল বর্ডারে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। আমাদের চোখের সামনে কলকাতা বর্ডার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা তাড়াহুড়ো করে ইমিগ্রেশনের প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করছি। তিনচারজন দালালের খপ্পড়ে পড়লাম। ওরা বলল―দাদা, আপনারা তো আজ আর বর্ডার ক্রস করতে পারবেন না। ওই যে দেখুন আসল লোকটাই চলে যাচ্ছে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে। আজ আপনাদের সারারাত এখানেই কাটাতে হবে দাদা। তারচে দুশো রুপি ছাড়ুন, ইমিগ্রেশনের ওই বড় কত্তাকে ধরে একটা সিল লাগিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এমনিতেই ওই বড় বাবু খুব বদরাগী। আপনারা পড়েচেন ওই বাবুরই হাতে।
আলী ইমাম ভাই প্রায় রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু আমি বললাম―লাগবে না। আমরা কোনও অবৈধ মাল নিয়ে যাচ্ছি না যে তার জন্যে আপনাদের দুশো রুপি ঘুষ দিতে হবে।
আমার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল দালালরা। ওদের একজন অন্যজনকে বলল―এই লাল ছার্টটাকে (আমার পরনে লাল শার্ট ছিল।) ছেকসন চৌছট্টিতে ফেলতে হবে।
আলী ইমাম ভাই কিছুটা ঘাবড়ে গেছেন। আমাকে ফিসফিস করে বললেন―টাকাটা আমিই দিচ্ছি। তুমি খামোখা ঝামেলায় জড়িও না। আমি বললাম―ভয়ের কিছু নেই। আমি শেষ চেষ্টাটা করি।
একটা দালাল বলল―যান দাদা বড়বাবুর একটা ঝাপ্টা খেয়ে আছুন।
দুটো পাসপোর্ট নিয়ে দৌড়ে গেলাম বর্ডারের শেষ ধাপের শেষ কর্তার কাছে। তিনি তখন সত্যি সত্যি আক্ষরিক অর্থেই ঝাঁপ বন্ধ করছেন। শুধু তালা মারা বাকি। আমি গিয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম―সরি আমাদের একটু দেরি হয়ে গেছে। কাইন্ডলি যদি একটু…
ভদ্রলোক খুব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। তারপর আমাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন―আরে! আপনি একজন লেখক না ? কিছুদিন আগে একটা বইয়ের লাস্ট কভারে আপনার ছবি আমি দেখেছি! ঢাকাকে নিয়ে লেখা ছড়া। একজন যাত্রী কলকাতা যাবার সময় আমাকে দিয়ে গিয়েছিল!
আমি বললাম―জি। ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ নাম বইটার। (ওটা সেই বছরই বেরিয়েছিল!)
―পড়েছি আমি ওটা। দেখুন তো কী কাণ্ড! সেই আপনিই কি না আমার সামনে দাঁড়িয়ে!
এরপর ঝাঁপ খুলে ড্রয়ার থেকে সিল-প্যাড বের করে আমাদের দুজনার পাসপোর্টে ধামাধাম দুটো ক্লিয়ারেন্স ছাপ্পড় মেরে দিলেন ভদ্রলোক।
দালালগুলো বিস্ময়ের অকুল দরিয়ায় নিক্ষেপ করে ভারতের সীমানা পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম বাংলাদেশে।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলী ইমাম ভাই সেই সন্ধ্যার গল্পটা বলতেন। লাল শার্ট পরা কৈশোরোত্তীর্ণ সদ্য যুবা রিটনের সাহসের প্রমাণ হিসেবে গল্পটা তিনি বলতেন প্রায়শ।
৮.
কথা যে কত সুন্দর করে বলা যায় তার উপমা ছিলেন আলী ইমাম। বক্তৃতা যে কত চমৎকার হতে পারে তার উদাহরণ ছিলেন আলী ইমাম। অবিরাম অপরূপ সব শব্দের দুর্দান্ত চয়নে আলী ইমামের কথামালা হয়ে ওঠে অনন্যসাধারণ। বাংলা ভাষা যে কতটা শ্রুতিমধুর সেটা আলী ইমামের বক্তৃতা শুনলে বোঝা যায়। ছেলেবেলা থেকেই আমি তাঁর বক্তৃতার বিমুগ্ধ শ্রোতা। তাঁর কথা বলার অপূর্ব দক্ষতার একটা ঘটনা বলি।
আমি তখন ‘লাবণী’ নামের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করি। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় আমার অফিস। একদিন সন্ধ্যার আগে আগে আলী ইমাম ভাই এসে উপস্থিত। আমার পরনে সাদাকালো ঝলোমলো শার্টটার প্রশংসা করে বললেন―তোমাকে নিতে এলাম। চলো যাই টিভিতে। রাত আটটার নিউজের পরপর মিনিট পনেরোর একটা স্পেস পাওয়া গেছে। তুমি আর আমি মিলে সময়টার সদ্ব্যবহার করি চলো। তুমি কয়েকটা বইয়ের পরিচিতি দাও আর আমি একটা ডকুমেন্টারি চালিয়ে ওতে কথা পাঞ্চ করে দেব ডাইরেক্ট।
তো গেলাম।
সংবাদ পাঠক তাঁর সংবাদ পাঠ শেষ করা মাত্র আমাকে কন্ট্রোল রুম লাগোয়া নিউজ বুথে বসিয়ে দেয়া হলো। আমি কয়েকটা বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরলাম। লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। আমার অংশটা শেষ হওয়া মাত্র চালু হয়ে গেল রেকর্ডেড ক্যাসেট। অপরূপ বাংলাদেশের গ্রামের একটা দৃশ্য ভেসে উঠল বিটিভি পর্দায়। নেপথ্যে আলী ইমামের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। আমি নিউজ বুথ থেকে বেরিয়ে দেখি একটা মনিটরের সামনে বসে পর্দায় ভেসে ওঠা দৃশ্য দেখতে দেখতে তাৎক্ষণিক যুৎসই শব্দমালা বসিয়ে দিচ্ছেন আলী ইমাম। লিখিত স্ক্রিপ্ট ছাড়া চলমান ছবির সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে অবিরাম অর্থবহ বাক্যবিন্যাস এতটা অনায়াসে করছিলেন তিনি যে আমি তো আমি, কন্ট্রোল রুমের কর্মীরাও বিস্মিত। ক্যামেরায় নৌকার গলুইকে বিগ ক্লোজ শটে ধরা হয়েছে। স্লো মোশানে পুরো নৌকোটা পরিস্ফুট হতে হতে বাংলাদেশের নৌকো সম্পর্কিত একগাদা তথ্য আলী ইমাম ভাই ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছেন সুললিত কণ্ঠে অপরূপ দক্ষতায়। পুরনো দিনের একটা ইট-সুরকি খসেপরা মসজিদের ছবি ভেসে উঠল স্ক্রিনে। আলী ইমাম ভাই পুরাত্তত্ব-স্থাপত্যকলা আমাদের ঐতিহ্য ইত্যাদির সঙ্গে বর্তমানকে এমনভাবে মেলালেন যে মনে হলো অনেক খাটাখাঁটনি করে রচিত একটা সুলিখিত স্ক্রিপ্ট বুঝিবা তিনি পাঠ করে যাচ্ছেন। কথক হিসেবে আলী ইমামের এই গুণের কথা অনেকেই জানেন না। এই ব্যাপারে অনন্য ছিলেন তিনি।
৯.
২০০৯ সালে আলী ইমাম ভাই তাঁর ছড়া ও কবিতাসমগ্র বইটি সাগর ভাই, আমীরুল আর আমাকে উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন―‘বাংলা শিশুসাহিত্য ঋদ্ধ হয়েছে/যাদের অবিরাম লেখনীতে/শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত/তিনজন প্রিয়ভাজনেষু/ ফরিদুর রেজা সাগর/লুৎফর রহমান রিটন/আমীরুল ইসলাম।’
তিন বছর পর ২০১২ সালে বইটা তিনি আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের বন্ধু মহসিন রেজার মাধ্যমে। বইটা হাতে নিয়ে প্রচ্ছদ উলটে উৎসর্গ পাতায় যাবার আগেই পুস্তানির পর প্রথম পাতায় আলী ইমাম ভাই তাঁর ঝকঝকে হস্তাক্ষরে লিখেছেন―‘[রিটন, তুমি ছিলে আমার দুই সহোদরের সহপাঠী। পুরনো ঢাকার ঠাটারি বাজারে কেটেছে স্মৃতিময় কিশোরকাল। আজ বার্ধক্যের সীমায় উপনীত হয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে উপলব্ধি করছি তুমি আমার সেই দুই সহোদর অপু আর কাজল (যাদের নাম রেখেছিলাম সত্যজিৎ প্রভাবিত আর পথের পাঁচালিতে মগ্ন হয়ে)-এর চাইতেও আমার জীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রেখেছ।
শুধু রক্তের সম্পর্কটাই কি মানুষের জীবনে প্রধান ?
আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।
আলী ইমাম, ৬/৩/১২]’
আসলেই।
রক্তের সম্পর্কটাই মানুষের জীবনে প্রধান নয়। কোনও কোনও সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চাইতেও বেশি। আমার উদ্দেশে লেখা আলী ইমাম ভাইয়ের এই বাক্য এক ঝটকায় আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল নব্বুইয়ের দশকের এক দুপুরে। বিটিভি ভবনে আলী ইমাম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রচণ্ড ঝগড়া হলো। তখন বিটিভি রামপুরা ভবনের একটি কক্ষে পাশাপাশি টেবিলে বসেন আলী ইমাম, মোহাম্মদ আবু তাহের, ম হামিদ, হাবীব আহসান এবং খ ম হারুণ। আমার সঙ্গে ঝগড়ার সময় ওরাও কেউ কেউ ছিলেন। তাঁর একটি কথায় ও আচরণে আমি রিয়্যাক্ট করেছিলাম প্রচণ্ডভাবে। (তিনি হঠাৎ হঠাৎ মানুষের সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করতেন। এটা তাঁর স্বভাবের মধ্যে ছিল।) প্রচণ্ড রেগে গিয়ে রামপুরা ভবনটার বাইরের পৃথিবীতে তাঁর সঙ্গে আমার মোলাকাতের ঘোষণা দিয়ে আমি বেরিয়ে এসে রিকশায় উঠতেই ছুটতে ছুটতে আলী ইমাম ভাই আমার পাশে উঠে বসলেন। স্বভাবগত আচরণের জন্যে বারবার দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু আমি কঠোর অবস্থান থেকে নড়ি না। মৌচাকের দিকে রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। মালিবাগ রেল ক্রসিংয়ে রিকশা থামলে আলী ইমাম ভাই আমার একটা হাত চেপে ধরলেন। তারপর এমন অদ্ভুৎ একটা কথা বললেন যে আমার সমস্ত রাগ পানি হয়ে গেলো। আলী ইমাম ভাই বললেন―দেখো রিটন আমি মরে গেলে আমার খাটিয়া তোমাকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে সবার আগে। তুমি মরে গেলে সবার আগে আমাকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে তোমার খাটিয়া। আমাদের তো এভাবে ঝগড়া করা মানায় না!
মুহূর্তেই আমার চোখের সামনে অবাক করা দৃশ্যটা ভেসে উঠল। খাটিয়ায় শুয়ে আছি আমি। খাটিয়ার হাতল কাঁধে বিষণ্ন অশ্রুসজল আলী ইমাম আরও অনেকের সঙ্গে আমার কফিনটি বহন করে চলেছেন! ডিজল্ভ। এবার খাটিয়ায় আলী ইমাম ভাই। খাটিয়ার হাতল কাঁধে বিষণ্ন অশ্রুসজল আমি আরও অনেকের সঙ্গে আলী ইমাম ভাইয়ের কফিনটি বহন করে চলেছি! আহারে!
পুনশ্চ >
২১ নভেম্বর ২০২২।
বাংলাদেশ থেকে সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার দূরের দেশে, টেক্সাসের হিউস্টন শহরে আজ খুব সকালে আমার ঘুম ভাঙল শাহাবুদ্দিন নাগরীর হোয়াটসএপ মেসেজে। ঘুম ঘুম চোখে দেখি নাগরী ভাই লিখেছেন―রিটন শোক সংবাদ। আলী ইমাম ভাই ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর বিদেহী আত্মার জন্যে দোয়া করো…
এলোমেলো হয়ে গেলো আমার সকালটা।
কিছুক্ষণ পরে ফোন করলেন আবেদ খান―রিটন আলী ইমামের মৃত্যু সংবাদটি জানার পর প্রথমে তোর কথাই মনে পড়ল আমার…
আবেদ ভাইকে আমি বহু বছর আগে আলী ইমাম কথিত সেই খাটিয়া বিষয়ক কথাটা বলি। বলতে বলতে ভেঙে পড়ি। আমার পৃথিবীটা ঝাপসা হয়ে আসে। অশ্রুর প্রবল প্লাবন এসে আমার কণ্ঠকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবেদ খান বলেন―তোর সঙ্গে পরে কথা বলব রে। তুই নিজেকে সামলে নে আগে।
ঢাকায় আমি ফোন করি অন্তুকে, আলী ইমামের পুত্র ডাক্তার তানভীর ইমাম অন্তুকে। ঢাকায় তখন সন্ধ্যা। আমার ফোনটা রিসিভ করে অন্তু বললো―রিটন কাকু, আমি এখন বাবার লাশ নিয়ে একটা মসজিদে অপেক্ষা করছি। এখানে বাবার গোসল হবে।
আমি বললাম―কাকু, সময়টায় তোমার বাবার কফিনের পাশে আমারও থাকবার কথা ছিল অন্তু…।
আহারে জীবন! জীবন আমাদের সঙ্গে কী রকম কানামাছিই না খেলে! কথা ছিল আগে কিংবা পরে আমরা একে অন্যের খাটিয়া কাঁধে তুলে বহন করব। সমাহিত করব। কিন্তু নিয়তি সেটা হতে দিল না…।
প্রিয় লেখক আলী ইমাম, ভাই আমার, আপনার কফিন থেকে সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার দূরের দেশে বসে নীরবে অশ্রুসজল বিদায় জানাই আপনাকে।
২০২০ সালের একুশের বইমেলায় ঝিঙেফুলের স্টলে কয়েকটা শুক্র-শনির বিকেলে জীবনের শেষ দেখার দিনগুলোতে বহু বেদনার কিছু কাহিনি আমাকে বলেছিলেন আপনি। শেষ জীবনে খুব কাছের মানুষ বলে জানা নিজের একান্ত আপন মনে করা মানুষদের অবজ্ঞা অসম্মান অপমানের গল্পগুলো আমাকে বলতে গিয়ে কণ্ঠ বারবার ধরে আসছিল আপনার। কয়েকবার আপনি অশ্রু লুকিয়েছেন আমার কাছ থেকে। আপনার নখের যুগ্যি নয় এমন মানুষদের মাধ্যমে আপনাকে করা অসম্মানগুলো আমাকে জানাচ্ছিলেন যখন, তখন, কান্নার গমককে গিলে ফেলতে গিয়ে কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন আপনি। ঝিঙেফুলের কর্ণধার খসরু ভাই সেই দৃশ্য দেখে দূরে সরে গিয়েছিলেন।
সান্ত্বনার ছলে আমি আপনার হাতটা ধরে রেখেছিলাম। আপনি ফের বলেছিলেন ওই খাটিয়ার গল্পটা আহা…।
প্রিয় আলী ইমাম, বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের অবিস্মরণীয় নায়ক, কিশোর পাঠকদের প্রিয় লেখক, অসংখ্য কিশোরের মনে রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চারের বীজ বুনে দেয়া অগ্রজ বন্ধু আমার, ভাইয়ের অধিক ভাই বন্ধুর অধিক বন্ধু আমার, শান্তিময় হোক আপনার অনন্তযাত্রা।
অমৃতলোকে পরম শান্তিতে থাকুন প্রিয় আলী ইমাম ভাই…
লেখক : শিশুসাহিত্যিক
অটোয়া থেকে