আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : বিশ্বজিৎ ঘোষ

প্রচ্ছদ রচনা : বাংলা ভাষা

১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী শীর্ষক সংকলনের সম্পাদকীয় ভূমিকার আরম্ভটা ছিল এ রকম : ‘একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব-পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি এমনি এক যুগান্তকারী দিন। শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে নয়, একুশে ফেব্রুয়ারী সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। দুনিয়ার মানুষ হতচকিত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়েছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য পূর্ব-পাকিস্তানের জনতার দুর্জয় প্রতিরোধের শক্তিতে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে ভাষার দাবিতে পূর্ব-পাকিস্তানের তরুণদের এই বিশ্ব-ঐতিহাসিক আত্মত্যাগে। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে, জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য দুনিয়াজোড়া মানুষের যুগ যুগ ব্যাপী যে সংগ্রাম একুশে ফেব্রুয়ারী তাকে এক নতুন চেতনায় উন্নীত করেছে’ (হাসান হাফিজুর রহমান, ২০১৬ : ১১)। তৎকালীন পূর্ব-বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশে একুশের আবির্ভাব ছিল, প্রকৃত প্রস্তাবেই, একটি যুগান্তের সূচনা। সম্পাদকের ওই ভূমিকাংশে একুশের ফেব্রুয়ারি তথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মৌল চারিত্র্য যেমন উন্মোচিত, তেমনি প্রকাশিত এই আন্দোলনের ভবিষ্যবিস্তারী প্রভাবের পূর্বভাস। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালিকে দিয়েছে নতুন পথের সন্ধান, নির্মাণ করেছে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন সড়ক।

বায়ান্ন সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সফল পরিণতি লাভ করলেও, এ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল দেশবিভাগের অব্যবহিত পরেই। অবশ্য গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী, এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক চলেছে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে এ বিতর্কের এক ধরনের মীমাংসা হয়ে যায়। ১৯১৮ সালে মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ পরিষ্কার অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা। মাউন্টব্যাটেন-পরিকল্পনা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের যৌক্তিক ব্যাখ্যা করে পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। তরুণ লেখক আবদুল হক এবং মাহবুব জামান জাহেদীও অনুরূপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মিল্লাত ও ইত্তেহাদ পত্রিকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন লেখকের প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ এনামুল হক, ফররুখ আহমদ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কাসেম প্রমুখ ব্যক্তি অভিন্ন দাবির সমর্থনে লেখা প্রকাশ করেন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ভাষা-বিতর্কের শুরুতেই বাংলা ভাষার পক্ষে যাঁরা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির পক্ষের প্রথম সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করে সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগেই গঠিত হয়েছিল তমদ্দুন মজলিস। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসেই গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এরপর থেকে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগেই পরিচালিত হয়েছে, তারাই পালন করেছে কেন্দ্রীয় ভূমিকা।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরে বাংলা ভাষা সম্পর্কে বাঙালির আবেগকে আমলে নিতে চায়নি মুসলিম লীগ সরকার। ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের ব্যবহার্য ভাষা ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু চালাবার সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। গণপরিষদে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সঙ্গে-সঙ্গে আরেকটি সংশোধনী প্রস্তাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার্য ভাষা করার দাবি তোলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রূঢ় ভাষায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গণপরিষদে কেবল ব্যবহার্য ভাষা নয়, ধীরেন্দ্র্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন বলে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তিরস্কৃতও হন। প্রধানমন্ত্রীর এই আচরণের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে―তারা গ্রহণ করতে থাকে নানা ধরনের কর্মসূচি। ক্রমে দানা বেঁধে ওঠে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক আরম্ভ হয়। তবে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে কথাবার্তা এবং লেখালেখি আরম্ভ হয় পাকিস্তান সৃষ্টিরও আগে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘আমাদের ভাষা-সমস্যা’ শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই প্রবন্ধে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন এই কথা :

যদি বিদেশি ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোনও যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোনও রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করিতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবি বিবেচনা করা কর্তব্য। (মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ১৯৪৭)

ব্যক্তি-উদ্যোগ ছাড়াও রাজনৈতিক মহলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলাপ-আলোচনা আরম্ভ হয় ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের পূর্বেই। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে মুসলিম লীগের কিছু বামপন্থি সংগঠকের উদ্যোগে ঢাকায় গঠিত হয় ‘গণআজাদী লীগ’ নামের একটি রাজনৈতিক সংস্থা (কামরুদ্দীন আহমদ, ২০১৪)। কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ প্রমুখ সংগঠকের উদ্যোগে গঠিত এই রাজনৈতিক সংস্থার প্রথম ম্যানিফেস্টো প্রকাশিত হয় ‘আশু দাবী কর্মসূচী আদর্শ’ নামে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে। উদ্যোক্তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই চৌধুরী খালেকুজ্জামান কিংবা আলিগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুর পক্ষে যে বক্তব্য দেন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিপন্থি কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে সংগঠনটি পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের প্রধান চিন্তক ও কর্মকর্তা। বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও আইন-আদালতের ভাষা করার পক্ষে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালায় তমদ্দুন মজলিস। ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর, প্রতিষ্ঠার ১৩ দিনের মধ্যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা―না উর্দু ? শিরোনামের একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তমদ্দুন মজলিস। রাষ্ট্রভাষা-বিষয়ক প্রথম পুস্তিকা প্রকাশ প্রসঙ্গে উত্তরকালে আবুল কাসেম লেখেন :

ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সনে সেপ্টেম্বর মাসে। এটা আমি শুরু করেছিলাম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা―না উর্দু  ? এই বইটি প্রকাশ করে। তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এ বইয়েই সর্বপ্রথম দাবি করেছিলাম : বাংলা হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা, সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম, সর্বস্তরে অফিস-আদালতের ভাষা, এই প্রস্তাব কার্যকরী করার জন্য আমি এই বইয়ে ব্যাপক ভাষা আন্দোলন পরিচালনার একটা রূপরেখাও দিয়েছিলাম। বলাবাহুল্য এই সময় (১৯৪৫-১৯৫৩) আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করতাম। এবং তখনই খাতাপত্রে বাংলায় দস্তখত করি বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে কয়েকবার ভীতি প্রদর্শনপূর্বক সতর্ক করে দিয়েছিলেন। (আবুল কাসেম, ২০১৭ : ৩৬৯)

তমুদ্দন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা―না উর্দু ? শীর্ষক পুস্তিকায় রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা গ্রথিত হয়। লেখা তিনটি হলো : মজলিসের পক্ষ হতে লিখিত ‘আমাদের প্রস্তাব’ (এটি রচনা করেন এম এ কাসেম), ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ (রচয়িতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন এবং ‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’ (রচয়িতা আবুল মনসুর আহমদ)। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি―উর্দু ও বাংলা―এই-ই ছিল এই পুস্তিকার প্রধান প্রতিপাদ্য। কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর লেখায় কেন বাংলা রাষ্ট্রভাষা করা উচিত তা যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করেন।

১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব-পাকিস্তান যুব-কর্মী সম্মেলন। সে-সম্মেলনে যুব সম্প্রদায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা না বললেও, পূর্ব-বাংলায় শিক্ষার মাধ্যম এবং আইন-আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। যুব-কর্মী সম্মেলনের গৃহীত একটি প্রস্তাবে বলা হয় : ‘পূর্ব-পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক’ (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৭ : ১৫৪)। এখানে উল্লেখ্য যে, সম্মেলনে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন তখনকার তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ১৭ই নভেম্বর বাংলা ভাষাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার অনুরোধ জানিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের কাছে শত-শত নাগরিকের স্বাক্ষর-সম্বলিত একটি স্মারকপত্র দাখিল করা হয় (দৈনিক আজাদ, ১৮.১১.১৯৪৭)। এই স্মারকপত্রে স্বাক্ষরকারীদের অনেকেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ছিলেন পূর্ব বাংলার মানুষ, অথচ মনে-প্রাণে ছিলেন উর্দুর সমর্থক। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে ছিলেন ফজলুর রহমান; এমনকি উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে তিনি নানা সময়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাবও প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপি সম্পর্কে তার কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ১লা অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সংগঠনের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন এ এস এম নূরুল হক ভূঁইয়া আর কোষাধ্যক্ষ হন আবুল কাসেম। দুজনেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গোড়ার দিকে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম পরিষদ পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

১৯৪৭ সালের ৫ই ডিসেম্বর ঢাকাতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভাই ছিল অখণ্ড বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির শেষ সভা। মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয় এবং এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, উর্দুকে পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা করা হবে না। সাধারণের অবগিতর জন্য পত্রিকায় প্রেস রিলিজ প্রেরণের জন্য কমিটির সভাপতি মওলানা আকরম খাঁকে ক্ষমতা প্রদান করা হয় (The Morning News, 07.12.1947)। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের সরকারি বাসভবন ‘বর্ধমান হাউজে’ (বর্তমানে বাংলা একাডেমির মূল ভবন)। বর্ধমান হাউজে যখন মুসলিম লীগের সভা চলছিল, তখন সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এবং কয়েকজন শিক্ষক উপস্থিত হয়ে বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভের সংবাদ শুনে মওলানা আকরম খাঁ সভা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং সমবেত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে বলেন যে, তাদের দাবি সরকারিভাবে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। ইতঃপূর্বে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে করাচিতে অনুষ্ঠিত হয় উচ্চ-পর্যায়ের এক শিক্ষা-সম্মেলন। এই শিক্ষা-সম্মেলনে পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার এবং আবদুল হামিদ অংশগ্রহণ করেন। করাচি থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পর ৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তেজগাঁও বিমানবন্দরে মন্ত্রীদ্বয় সাংবাদিকদের জানান যে, করাচির শিক্ষা-সম্মেলনে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর The Morning News পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হয। অথচ আগের দিন উক্ত পত্রিকায় এপিআই পরিবেশিত অপর এক সংবাদে বলা হয়―করাচির শিক্ষা-সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে উর্দুকে পাকিস্তানের Lingua Franca করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। সে-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার পাকিস্তান গণপরিষদের উপর অর্পিত হয়েছে (The Morning News, 05.12.1947)।

করাচির শিক্ষা-সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর অপরাহ্ণ ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল ছাত্র-সমাবেশ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এই সমাবেশই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত প্রথম ছাত্র-জমায়েত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজসহ অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সমাবেশে যোগ দেয়। এই ছাত্র-সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেম। এই ছাত্র-সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি জানিয়ে যারা বক্তৃতা করেন তাদের মধ্যে ছিলেন মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ কে এম আহসান, এস আহমদ প্রমুখ। এরা সকলেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা শিক্ষার্থী। সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের (ডাকসু) ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফরিদ আহমদ চারটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সেগুলো বিপুল করতালির মধ্যে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। সমাবেশে গৃহীত প্রস্তাবগুলো ছিল এরকম :

১. বাংলা পাকিস্তান ডোমিনিয়নের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব-পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করা হোক।

২. রাষ্ট্রভাষা এবং লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য আসল সমস্যাকে ধামাচাপা দেওয়া এবং বাংলা ভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা।

৩. পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ফজলুর রহমান এবং প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার উর্দু ভাষার দাবিকে সমর্থন করার জন্য সভা তাদের আচরণের তীব্র নিন্দা করছে।

৪. সভা ‘মনিং নিউজ’-এর বাঙালীবিরোধী প্রচার-প্রচারণার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে এবং জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের জন্য পত্রিকাটিকে সাবধান করে দিচ্ছে। (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৭ : ১৫৫)

সমাবেশ সমাপ্তির পর শিক্ষার্থীরা মিছিল সহকারে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সেক্রেটারিয়েট ভবনে উপস্থিত হয়। সেক্রেটারিয়েট ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন শেষে ছাত্ররা মন্ত্রী নূরুল আমীন এবং হামিদুল হক চৌধুরীর বাসায় উপস্থিত হয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। অতঃপর ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল করে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের সরকারি বাসভবন ‘বর্ধমান হাউজ’-এর সামনে উপস্থিত হয়। ছাত্রদের প্রবল বিক্ষোভে খাজা নাজিমউদ্দীন চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং কী করবেন তা বুঝে উঠতে পারেননি। অতঃপর অসুস্থতার কথা বলে তিনি ছাত্রদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ছাত্রদের দাবির মুখে তিনি একটি লিখিত নোট পাঠান তাদের কাছে, যেখানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা বিষয়ে কোনও ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে তিনি অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। লিখিত নোটে তিনি আরও জানান যে, মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এবং পার্লামেন্টারি পার্টির মত না জানা পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন সুনির্দিষ্ট মত প্রকাশ করতে কিংবা কোনও ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে পারবেন না (The Morning News, 10.12.1947)। নাজিমউদ্দীনের এই আচরণে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ছাত্র-শিক্ষকদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে খাজা নাজিমউদ্দীনের সরকার আন্দোলন দমনে নানারকম অপকৌশল গ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় সমস্ত দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে প্রাদেশিক সরকার গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে তা দমানোর অপচেষ্টা চালায়। ইতঃপূর্বে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানকে ঘেরাও করতে গেলে গুণ্ডাবাহিনী ছাত্রদের আক্রমণ করে―ক্রমে এ অপচেষ্টা ব্যাপকতা লাভ করে।

খাজা নাজিমউদ্দীন-ফজলুর রহমানের অপচেষ্টা সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে স্তিমিত করা যায়নি। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে সমগ্র পূর্ব-বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ব্যাংক, মানি-অর্ডার ফর্ম, ডাকটিকেট, মুদ্রা―সর্বত্র ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহৃত হতে থাকে―উপেক্ষিত হয় বাংলা ভাষা। পূর্ববাংলার সাধারণ জনগণ ও শিক্ষিত মহল পাকিস্তান সরকারের এই বৈষম্যমূলক আচরণে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয় এবং ক্রমে দানা বাঁধতে থাকে প্রতিবাদী মনোভাব। এ পর্যায়েই তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে গঠিত প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাঙালির প্রতিবাদী মনোভাবকে সাংগঠনিক-গণতান্ত্রিক রূপ দেবার প্রথম প্রচেষ্টা গ্রহণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ―একথা আজ ঐতিহাসিক সত্য।

১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি সোমবার করাচিতে পাকিস্তান গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে পূর্ব-বাংলার কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ২৫শে ফেব্রুয়ারি তাঁর বক্তব্যে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাও গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬.০২. ১৯৪৮)। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের উপর গণপরিষদের সদস্যদের মধ্যে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ধীন্দ্রেনাথ দত্তের প্রস্তাব এবং প্রস্তাবের বিপক্ষে লিয়াকত আলি খান, খাজা নাজিমউদ্দীন, তমিজুদ্দিন খান প্রমুখ মুসলিম লীগ নেতা যেসব বক্তব্য দেন, পত্র-পত্রিকায় তা দেখে অনেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিবৃতি পাঠাতে আরম্ভ করেন, ঢাকার একাধিক পত্রিকা সম্পাদকীয় প্রকাশ করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে―অন্যান্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ নানাভাবে প্রতিবাদ করতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা সমবেতভাবে ক্লাস বর্জন শেষে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে রমনা এলাকা প্রদক্ষিণ করে। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয চত্বরে এসে শেষ হয়। এরপর আমতলায় একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম এবং বক্তৃতা করেন পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদ ও ফজলুল হক হল ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মোহামদ তোয়াহা  (নও-বেলাল, ০৪.০৩.১৯৪৮)। ‘বাংলা ভাষার অপমান’ শিরোনামে আজাদ পত্রিকা প্রকাশ করে সম্পাদকীয় নিবন্ধ। অন্যান্য পত্রিকাতেও গণপরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে রিপোর্ট কিংবা সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। ‘পূর্ব-পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষই একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে পেতে চায়’―খাজা নাজিমউদ্দীনের এরূপ মিথ্যাচারে ফুঁসে ওঠে পূর্ববাংলার মানুষ।

সামূহিক এই রাজনেতিক পটভূমিতে ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও তমদ্দুন মজলিসের যৌথ উদ্যোগে ফজলুল হক মুসলিম হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনেতিক কর্মীদের একটি বর্ধিত সভা আহ্বান করা হয়। এই সভা আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের শিক্ষার্থী তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কামরুদ্দীন আহমদ। এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য―আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, আাজিজ আহমদ, সরদার ফজলুল করিম, অজিত গুহ, শামসুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, নঈমুদ্দিন আহমদ, তোফাজ্জল আলী, মোহাম্মদ তোয়াহা, আলী আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমদ, আনোয়ারা খাতুন, শামসুল আলম, শহীদুল্লাহ্ কায়সার, শওকত আলী, তাজউদ্দিন আহমদ, লিলি খান, আবদুল আউয়াল, মুনীর চৌধুরী, ওয়াহেদ চৌধুরী, নূরুল আলম, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ। উল্লেখ্য, এদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী। এই সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ পুনর্গঠিত হয়। একেই বলা হয় ‘দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ বা ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন শামসুল আলম। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রবাস থেকে দুজন করে প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। উল্লেখ্য, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান (মযহারুল ইসলাম, ২০১৭ : ২০)।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হবার পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নতুন গতি পায়। ২রা মার্চের সভাতেই বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এবং পাকিস্তান গণপরিষদে সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ১১ই মার্চ সমগ্র পূর্ব-বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় (নও-বেলাল, ০৪.০৩.১৯৪৮)। রাষ্ট্রভাষা সংগাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংগঠনিক সফরে বেরিয়ে পড়েন, উদ্দেশ্য জেলায় জেলায় ১১ই মার্চ কর্মসূচি পালনের ব্যবস্থা করা। প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য সফরে বেরিয়ে পড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রনেতার স্মৃতিচারণ:

ক) শেখ মুজিবুর রহমান

সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হলো। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের (১১ই মার্চ) তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা দিলাম। (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২ : ৯২)

খ) আবদুল মতিন

১১ মার্চ ১৯৪৮ সংগ্রাম পরিষদ সারা পূর্ববঙ্গে ধর্মঘট আহ্বান করে। ছাত্রলীগের নেতারা হরতালে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে পাবনা যাওয়ার নির্দেশ দেন। আমি পাবনা যাই। ১১ মার্চ ১৯৪৮ পাবনায় সফল হরতাল পালিত হয়। এডওয়ার্ড কলেজে এক বিরাট ছাত্রসভায় বক্তৃতা দিই। শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করি। মিছিলে পুলিশ বাধা দেয়। তাতে অনেকে আহত এবং অনেকে গ্রেপ্তার হন। বিকেলে জনসভা করার কর্মসূচি ছিল। পুলিশ জনসভা করতে দেয়নি। (আবদুল মতিন, ২০১৭ : ৬৭)।

১১ই মার্চের ধর্মঘট যাতে সফল না হয়, সেজন্য মুসলিম লীগ নানা অপকৌশল গ্রহণ করে। নানা স্থানে তারা সংগ্রাম পরিষদের সভায় হাঙ্গামা করার চেষ্টা করে। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষ্য : ‘মুসলিম লীগ ভাড়াটিয়া গুণ্ডা লেলিয়ে দিল আমাদের উপর। অধিকাংশ লোককে আমাদের বিরুদ্ধে করে ফেলল। পুরান ঢাকার কয়েক জায়গায় ছাত্রদের মারপিটও করল। আর আমরা পাকিস্তান ধ্বংস করতে চাই―এই কথা বুঝাবার চেষ্টা করল’ (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২: ৯২)। ১১ই মার্চের ধর্মঘট সম্পর্কে বিস্তারিত কর্মসূচি নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১০ই মার্চ রাত্রে ফজলুল হক মুসলিম হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা বসে। এই সভা সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর জানাচ্ছেন : ‘১১ মার্চের ধর্মঘট সম্পর্কে বিস্তারিত কর্মসূচি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ১০ মার্চ রাত্রে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা বসে। ১১ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা না হলেও প্রতিকূল পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কী কর্মপন্থা অবলম্বন করা দরকার সে-বিষয়ে এই সভায় আলোচনা হয়। এছাড়া পরদিন ধর্মঘটের সময় বিভিন্ন এলাকায় পিকেটিং সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়’ (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৭ : ১৪০)। অভিন্ন কথা লিখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে : ‘রাতে কাজ ভাগ হলো―কে কোথায় থাকব এবং কে কোথায় পিকেটিং করার ভার নেব’ (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২ : ৯২)। ১১ই মার্চের ধর্মঘটের জন্য ছাত্ররা ব্যাপক প্রস্তুতি চালায়―কে কোন স্থানে পিকেটিংয়ে নেতৃত্ব দেবে, তাও ঠিক করা হয়। পিকেটিং চলাকালে নেতৃস্থানীয় কেউ গ্রেফতার হলে তার দায়িত্ব কে গ্রহণ করবে, তাও ঠিক করা হয়।

১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের ধারায় এক উজ্জ্বল দিন। এই উজ্জ্বল দিনের স্রষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ। এদিন ঢাকা শহর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। ইডেন বিল্ডিংয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় গেট, রমনা পোস্ট অপিস, পলাশি ও নীলক্ষেত ব্যারাক, জেলা আদালত ভবন, হাইকোর্ট, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ―সর্বত্র সকাল থেকেই পিকেটিংরত ছাত্রদের স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের দমানোর জন্য পুলিশ অত্যাচার করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে, অনেককে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ১১ মার্চের ছাত্র-ধর্মঘট সম্পর্কে কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখেন : ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আব্দুল ওয়াদুদসহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়’ (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১৭ : ২০৬)। ১১ই মার্চের ছাত্র-ধর্মঘট সম্পর্কে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকার বশীর আল হেলাল লিখেছেন :

১১ মার্চ ঢাকা শহরে তোলপাড় চলে। ভোর থেকে ছাত্রনেতা ও কর্মীরা অফিস-আদালত, সেক্রেটারিয়েট, রেল-কর্মচারীরা তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। মফস্বল থেকে ছাত্ররা এসেছিলেন মাতৃভাষার দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে। শহরের রাজপথগুলো বিক্ষোভকারীদের পদভারে কেঁপে ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। তাঁদের দুদিক থেকে আক্রমণ নেমে আসে। একদিকে পুলিশের বেটন বেয়নেট বুট। অন্যদিকে ঢাকার খাজা পরিবার ও মুসলিম লীগের কোনও কোনও নেতা শহরবাসীর কিছু অংশকে ভুল বোঝালেন, ছাত্রসমাজ ও বাংলা ভাষার দাবিকে স্তব্ধ করার জন্য ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনী লেলিয়ে দিলেন। বহু ছাত্র আহত হয়ে, জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে গেলেন, কয়েকশ গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেন। এদের কয়েকজনের নাম এখানে বলা যায়। আন্দোলনরত অবস্থায় গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেন শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, অলি আহাদ, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, আবদুল মতিন, আবদুল মালেক উকিল, শেখ মুজিবুর রহমান।… এদিন গুন্ডারা কমিউনিস্ট পার্টির অফিস তছনছ করে দিয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিরাট সভা হয়। সভা শেষে ছাত্ররা মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মিছিল করে সেক্রেটারিয়েটের দিকে যান। পথে মিছিল বিরাট আকার ধারণ করে, পুলিশ বাধা দেয়, কিন্তু ছাত্র-জনতার একটা দল সেক্রেটারিয়েটের গেছে পৌঁছে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশের মারপিট শুরু হয়। এখানে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা এক পুলিশের বন্দুক ছিনিয়ে নিলে পুলিশের পিটুনিতে আহত হয়ে পড়ে যান। বহু আহত ছাত্রের সঙ্গে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। (বশীর আল হেলাল, ২০১৭ : ১৮৮)।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ছাত্র-ধর্মঘটের সার্বিক অবস্থা ঐদিনে আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ও পুলিশের হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেদিন যে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষ্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন: ‘১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস এবং অন্যান্য জায়গায় পিকিটেং শুরু করল।… সকাল আটটায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হল। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেকদল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হক হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল। এইভাবে গোলমাল, মারপিট চলল অনেকক্ষণ। নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার (এখন নওগাঁর এডভোকেট), শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াদুদ গুরুতররূপে আহত হল। তোপখানা রোডে কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত মিয়া ও আরও অনেক ছাত্র আহত হল। আবদুল গনি রোডের দরজায় তখন আর ছাত্ররা অত্যাচার ও লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারছে না। অনেক কর্মী আহত হয়ে গেছে এবং সরে পড়ছে। আমি জেনারেল পোস্ট অফিসের দিক থেকে নতুন কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটেছি, এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। গেট খালি হয়ে গেছে। তখন আমার কাছে সাইকেল। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য সিটি এসপি জিপ নিয়ে বার বার তাড়া করছে, ধরতে পারছে না। এবার দেখলাম উপায় নাই। একজন সহকর্মী দাঁড়ান ছিল, তার কাছে সাইকেল দিয়ে চার পাঁচজন ছাত্র নিয়ে আবার ইডেন বিল্ডিংয়ের দরজায় আমরা বসে পড়লাম এবং সাইকেল যাকে দিলাম তাকে বললাম, শীঘ্র আরও কিছু ছাত্র পাঠাতে। আমরা খুব অল্প, টিকতে পারব না। আমাদের উপর কিছু উত্তম-মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল। হক সাহেবকে পূর্বেই জিপে তুলে ফেলেছে। বহু ছাত্র গ্রেফতার ও জখম হল। কিছুসংখ্যক ছাত্রকে গাড়ি করে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে আসল। কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল। অলি আহাদও গ্রেফতার হয়ে গেছে। তাজউদ্দনি, তোয়াহা ও অনেককে গ্রেফতার করতে পারে নাই। আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর জনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২ : ৯৪)।

১১ই মার্চ ধর্মঘটের সময় পুলিশের অত্যাচার এবং নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে অপরাহ্ণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক বিরাট ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদ। সভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে ছাত্রদের উপর পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেফতারের তীব্র সমালোচনা এবং বন্দিদের মুক্তি দাবি করা হয়। অন্য একটি প্রস্তাবে পাকিস্তান গণপরিষদে যেসব পূর্ববঙ্গীয় সদস্য বাঙালিদের পক্ষে কথা বলতে অক্ষম তাদের পদত্যাগ দাবি করা হয়। সভা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-মিছিলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এবং বন্দিদের মুক্তি দাবি করে স্লোগান উচ্চারিত হয়।

১১ই মার্চের ছাত্র-ধর্মঘটে পুলিশি নির্যাতন এবং নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবিতে ১৩ই মার্চ থেকে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত টানা ধর্মঘট আহ্বান করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ ছিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ। এ কারণেই সংগ্রাম পরিষদ ১৫ই মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তিন দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র শহরে ছাত্রবিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ১৪ই মার্চ প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের বাসভবনে মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের অধিবেশন বসলে সেখানেও ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। রাত দশটা পর্যন্ত ছাত্ররা মুসলিম লীগের কোনও নেতাকে বাসভবনের বাইরে বের হতে দেয়নি। খাজা নাজিমউদ্দীনের কাছে শহর জুড়ে ছাত্র-বিক্ষোভের সংবাদ আসতে থাকে। এবার তিনি ভীত হয়ে পড়েন। তাঁর ভয়ের প্রধান কারণ ছিল, ১৯শে মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আসার কথা। জিন্নার ঢাকা পৌঁছানোর পূর্বেই তিনি শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে চেয়েছিলেন। তাই কৌশল হিসেবে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের অনমনীয় দৃঢ়তার কারণেই খাজা নাজিমউদ্দীন সেদিন এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

১৫ই মার্চ সকাল সাড়ে ন’টায় সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা কামরুদ্দীন আহমদের বাসায় খাজা নাজিমউদ্দীনের নির্দেশে উপস্থিত হন পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য মোহাম্মদ আলী এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব খাজা নসরুল্লাহ। তারা কামরুদ্দীন আহমদকে জানান যে, ওই দিন বেলা সাড়ে- এগারোটায় ভাষা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। অল্প সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যবৃন্দ একসঙ্গে মিলিত হলেন। সকাল সাড়ে দশটায় ফজলুল হক মুসলিম হলে সংগ্রাম পরিষদের জরুরি সভা বসে। প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদদীনের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে সবাই একমত হন এবং সাক্ষাতের সময় কী বলা হবে তাও তারা সর্বসম্মতভাবে ঠিক করে নেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর একটি চুক্তিতে যেতে চেয়েছে সংগ্রাম পরিষদ। তাই প্রাথমিক একটি চুক্তিপত্রও প্রস্তুত করলেন কামরুদ্দনি আহমদ। সংগ্রাম পরিষদের সভায় খসড়া চুক্তিপত্রটিও সর্বসম্মতভাবে অনুমোদিত হয় (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৭ : ৮৩-৮৪)। নির্ধারিত সময়ে বর্ধমান হাউজে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সভা আরম্ভ হয়। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে সেদিন আলোচনা সভায় যোগ দিয়েছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, নঈমুদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আজিজ আহমদ, আবদুর রব চৌধুরী প্রমুখ। এরা সকলেই ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা শিক্ষার্থী। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আলোচনাকালে তুমুল তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং দেখা দেয় প্রবল উত্তেজনা। সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক যে চুক্তিপত্র তৈরি করা হয়, তার কিছু ধারা মেনে নিলেও কয়েকটি মানতে অসম্মতি জানান খাজা নাজিমউদ্দীন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাত্রসমাজেরই জয় হলো। নাজিমউদ্দীন ছাত্রদের সব দাবিই মেনে নেন। চুক্তিপত্রটি চূড়ান্ত হলেও তখন স্বাক্ষরিত হয়নি। চুক্তিপত্রটি নিয়ে কামরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, নূরুল ইসলাম প্রমুখ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চলে যান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বন্দিদের তা দেখানো ও তাদের সম্মতির জন্য। কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখ চুক্তির শর্তাবলি ভালো করে দেখার পর সেটি অনুমোদন করেন। কারাগার থেকে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা বর্ধমান হাউজে ফিরে আসেন। অতঃপর সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দীন আহমদ চুক্তিপত্রটিতে স্বাক্ষর করেন। স্বাক্ষরের পূর্বে খাজা নাজিমউদ্দীন চুক্তিপত্রে কয়েকটি সংশোধনী আনেন।

আট দফা চুক্তিপত্র অনুসারে শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য কারাগারে বন্দি প্রায় সকলকে মুক্তি দেওয়া হলো ১৫ই মার্চ সন্ধ্যায়। ১৬ই মার্চ দুপুর একটায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের বিশাল সমাবেশ হয়। এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই সভা সম্পর্কে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিবুর রহমান বিশদভাবে লিখেছেন (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২ : ৯৬-৯৭)। আমতলার ছাত্রসভায় ব্যাপক বিক্ষোভ চলছিল, খাজা নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে চুক্তিপত্রের কথা তখনও সাধারণ ছাত্ররা জানে না। তাই বিক্ষোভ থামানো যাচ্ছিল না। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান বললেন যে, পরিষদ ভবনে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন চলছে। মিছিল সহকারে সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে আজকের কর্মসূচি সমাপ্ত হবে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে―পরিষদ ভবনের (বর্তমান জগন্নাথ হলের পুনর্নির্মিত অক্টোবর স্মৃতি ভবন) সামনে গিয়ে তারা ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। পরিষদ ভবনেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষ-বিপক্ষ সদস্যদের মধ্যে তখন চলছিল তুমুল বাক-বিতণ্ডা। পরিষদের বিরোধী দলের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রটি পাঠ করে শোনাতে বলেন। নানা টালবাহানার পর নাজিমউদ্দীন চুক্তিপত্রটি পাঠ করে শোনাতে বাধ্য হন। পুলিশের আক্রমণ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রদর্শন সমাপ্ত হয়। এ সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল প্রাঙ্গণেও ছাত্ররা ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সামূহিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১৬ই মার্চ সন্ধ্যার পরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক জরুরি সভা বসে। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ ছাত্রনেতৃবৃন্দ। এই সভা সম্পর্কে অসমাপ্ত আত্মজীবনীত শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন :

সন্ধ্যার পরে খবর এল ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের সভা হবে। ছাত্ররাও উপস্থিত থাকবে। আমার যেতে একটু দেরি হয়েছিল। তখন একজন বক্তৃতা করছে আমাকে আক্রমণ করে। আমি দাঁড়িয়ে শুনলাম এবং সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। তার বক্তৃতা শেষ হলে আমার বক্তব্য বললাম। আমি যে আমতলার ছাত্রসভায় বলেছিলাম, কাগজ দিয়েই চলে আসতে এবং এ্যাসেম্বলি হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে চলে যেতে অনুরোধ করেছিলাম এবং বক্তৃতাও করেছিলাম, একথা কেউ জানেন কি না ? যা হোক, এখানেই শেষ হয়ে গেল, আর বেশি আলোচনা হলো না এবং সিদ্ধান্ত হল আপাতত আমাদের আন্দোলন বন্ধ রাখা হলো। কারণ কয়েক দিনের মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ঢাকায় আসবেন পাকিস্তান হওয়ার পরে। তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে হবে। আমরা ছাত্ররাও সংবর্ধনা জানাব। প্রত্যেক ছাত্র যাতে এয়ারপোর্টে একসঙ্গে শোভাযাত্রা করে যেতে পারে তার বন্দোবস্ত করা হবে। (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২ : ৯৭-৯৮)।

প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি মেনে নেওয়ার কারণে ছাত্ররা এইরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বলে মনে করা হয়। যদিও রাষ্ট্রভাষা বাংলা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনও বক্তব্য না থাকায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই চুক্তিপত্রটি পরবর্তীসময়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রথম ঢাকা সফর, তাই ছাত্ররা ভেবেছিল তিনি হয়তো রাষ্ট্রভাষা সমস্যার একটা সমাধান দেবেন। তাই আপাতত তারা কঠিন আন্দোলন না করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা শেখ মুজিবুর রহমানের মন্তব্য থেকে অনুধাবন করা যায়। অন্যদিকে সরকার পক্ষও চাচ্ছিল না মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরের সময় কোনও বিক্ষোভ প্রদর্শন বা আন্দোলন না হয়। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় এ বিষয়ে বদরুদ্দীন উমরের ব্যাখ্যা : ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের চুক্তি সম্পাদন এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম পরিষদের সবগুলো দাবি মেনে নেওয়ার আসল কারণ ছিল পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফর। এই সফরের সময় জনগণ কর্তৃক, বিশেষত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীগণ কর্তৃক সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মতো কোনও পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না ঘটে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নাজিমুদ্দীন ও তার সরকার যথেষ্ট নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া তাঁরা আশা করেছিলেন যে, জিন্নাহ উর্দুর পক্ষে প্রকাশ্যে মতামত প্রদান করলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে এবং পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হবে। (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৭ : ১৬৫)।

পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথমবারের মতো ঢাকা আসেন ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ। তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছলে হাজার হাজার লোক তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত পথের দুপাশে তাঁকে দেখার জন্য অসংখ্য লোক দীর্ঘসময় অপেক্ষা করে। ২১শে মার্চ অপরাহ্ণে ঢাকার নাগরিকদের পক্ষ থেকে রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে সংবর্ধনা জ্ঞাপনের আয়োজন করা হয়। ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও ঢাকার ছাত্র-আন্দোলন সম্পর্কে অনেক কথা বলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে জিন্নাহ তাঁর নেতিবাচক বক্তব্য উচ্চারণ করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তা স্পষ্টভাবে বলে দেন। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরে হবে একথা বলে তিনি সেদিন রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন :

… Let me make it very clear to you that the state Language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Any one who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan. Without one State Language, no Nation can remain tied up solidly together and function. Look at the history of other countries. Therefore, so far as the state language is concerned, Pakistan’s language shall be Urdu, but, as I have said, it will come in time. (Mohammad Ali Jinnah, 1968 : 88)

পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৪শে মার্চ সকাল দশটায় কার্জন হলে এক বিশেষ সমাবর্তন সভা আয়োজন করে। এই সমাবর্তন সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তৃতাই পুনরাবৃত্তি করেন। পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু একথা ঘোষণা করে জিন্নাহ বলেন : There was no junstification for agitation but it did not suit their purpose to admit this. There sole object in exploiting this controversy is to create a split among the Muslims of the state, as indeed they have made no secret of there efforts to incite hatred against non-Bengali Musalmans. Realising, however, that the statement that you Prime Minister made on the language controversy, on return from Karachi, left no room for agitation, in so far as it conceded the right of the people of this province to choose Bengali as their official language if they so wished, these persons changed thier tacties. They started damanding that Bengali should be the state language of the Pakistan centre and since they could not overlook the obvious claims of Urdu as the official language of a Muslim state, they proceeded to demand that both Bengali and Urdu should be the state language of Pakistan. Make no mistake about it. There can be only one state language, if the component parts of this stae are to march forward in unison, and that language, in my opinion, can only be Urdu ? (আহমদ রফিক ও এম আর মাহবুব, ২০১৭ : ২৬৮-২৬৯)

রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনা সভা এবং কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠান―উভয় স্থানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্টভাষা হিসাবে যখন উর্দুর কথা বলেন, তখন ছাত্ররা No No ধ্বনি দিয়ে প্রতিবাদ উচ্চারণ করে। জিন্নাহর জনসভার সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া শেখ মুজিবুর রহমান তুলে ধরেছেন এভাবে : ‘১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা আসলে হাজার হাজার লোক তাঁকে অভিনন্দন জানাতে তেজগাঁ হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় হাজির হয়েছিল। আমার মনে আছে, ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন আমরা সকলেই ভিজে গিয়েছিলাম, তবু ভিজে কাপড় নিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলাম। জিন্নাহ পূর্ব-পাকিস্তানে এসে ঘোড় দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ আমরা প্রায় চার পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, মানি না’ (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২ : ৯৯)। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন সভায় জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদে ছাত্রদের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ছাত্রনেতারা বলেন :

ক) শেখ মুজিবুর রহমান

… ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’―তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না’।

জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তাঁর মুখের উপরে তাঁর কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যত দিন বেঁচেছিলেন আর কোনও দিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২ : ৯১)।

খ) আতাউর রহমান খান

… জিন্নাহ সাহেব উর্দুর স্বপক্ষে মন্তব্য করার পর আমাদের দুই রো সামনে বসা নাইমউদ্দিন ‘নো’ ‘নো’ ‘নো’ বলে দাঁড়িয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরাসহ আশপাশের সবাই ‘নো’ ‘নো’ বলে দাঁড়িয়ে উঠি।… ঘটনাটি আমার সামনেই ঘটেছিল এবং নাইমউদ্দিন আমাদের দুসারি সামনেই বসা ছিল।  নাইমউদ্দিন ছাড়া অন্য কাউকে প্রথম দাঁড়াতে আমি দেখিনি। নাইমউদ্দিনের উঠে দাঁড়ানোর কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। (আতাউর রহমান খান, ২০০০ : ৩৭)

গ) সরদার ফজলুল করিম

সেই সমাবর্তনে আমিও শরিক হয়েছিলাম।… সমাবর্তনে পাশ করা ছাত্রদের সার্টিফিকেট বিতরণ হয়ে গেছে। কায়েদে আজম এবার প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন। উপযুক্ত মর্যাদায় কার্জন হলের বিরাট মিলনায়তন শান্ত। কায়েদে আজম বক্তৃতা করে চলেছেন। ইংরেজী ভাষাতে। কাটা কাটা তাঁর কথা। অকরুণ কাঠিন্যে আজও তিনি বললেন : ‘আই টেল ইউ: উর্দু অ্যালোন শ্যাল বি দি স্টেট ল্যাংগুয়েজ অব পাকিস্তান।’ আহত তরুণের দল জাতির বিবেকের বাণী হয়ে এক অপূর্ব ঐকতানে বেজে উঠল ‘নো, নো, নো’। (সরদার ফজলুল করিম, ২০০৪ : ৩৪)।

রেসকোর্স ময়দান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কিন্তু কোনও রকম বিক্ষোভ না দেখিয়ে তারা জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবি আদায়ের কৌশল গ্রহণ করে। গভর্নর জেনারেলের কাছে সাক্ষাৎকারের অনুরোধ জানালে তিনি ২৪শে মার্চ সন্ধ্যায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসতে সম্মতি জানান। নির্ধারিত সময় আরম্ভ হয় সভা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি দলে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দিন আহমদ, লিলি খান, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম, অলি আহাদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আলোচনার শুরুতেই জিন্নাহ বলেন যে, খাজা নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে রাষ্ট্র্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যে চুক্তি হয়েছে তা তিনি স্বীকার করেন না। কারণ তিনি অভিযোগ করে বলেন―রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা জোরপূর্বক খাজা নাজিমউদ্দীনের স্বাক্ষর আদায় করেছে। জিন্নাহ দৃঢ়তার সঙ্গে জানান যে, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়। তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে জিন্নাহ আর আলোচনা করতে অসম্মত হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই সাক্ষাৎকার পর্বটি সমাপ্ত হয়। এ সময় ছাত্ররা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে একটি স্মারকলিপি প্রদান করে। স্মারকলিপিতে মূল কথা ছিল :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের একমাত্র মুসলমান যুবকদের লইয়া গঠিত এই কর্মপরিষদ মনে করেন যে, বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। কারণ… তারা মনে করেন যে, উহা পাকিস্তানের সমগ্র জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের ভাষা এবং পাকিস্তান জনগণের রাষ্ট্র হওয়ায় অধিকাংশ লোকের দাবি মানিয়া লওয়া উচিত। … যে কোনও পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেক নাগরিকের কয়েকটি মৌলিক অধিকার আছে। কাজেই যে পর্যন্ত না আমাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয় সে পর্যন্ত বাংলা ভাষার জন্যে এই আন্দোলন চালাইয়া যাওয়া হইবে। (আহমদ রফিক ও এম আর মাহবুব, ২০১৭ : ২৭১)

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরের সময় উর্দুর পক্ষে তাঁর অবস্থান গ্রহণের কারণে স্তিমিত প্রায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পায় নতুন গতি। কিন্তু এ সময়ে ব্যাপক কোনও বিক্ষোভ সংঘটিত হয়নি, ডাক দেওয়া হয়নি কোনও ধর্মঘটেরও। এ পরিস্থিতিতে জিন্নাহর ঢাকা ত্যাগের অব্যবহিত পরে ১৯৪৮ সালের ৬ই এপ্রিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাঁর স্বাক্ষরিত চুক্তি লঙ্ঘন করে ভাষা-বিষয়ক নিম্নরূপ প্রস্তাব পেশ করেন :

ক) পূর্ব-বাংলা প্রদেশের ইংরেজির স্থলে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রহণ করিতে হইবে এবং

খ) পূর্ব-বাংলার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হইবে যথাসম্ভব বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ স্কলারদের মাতৃভাষা। (East Bengal legislative Assembly Proceeding- Vol, 1, 1949 : 57)

―পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গটি নাজিমউদ্দীন সুকৌশলে এড়িয়ে যান। কিন্তু ব্যবস্থাপক সভার বিরোধী দলীয় সদস্যবৃন্দ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে খাজা নাজিমউদ্দীনের চুক্তিপত্রের কথা সম্যক অবহিত ছিলেন। তাই তারা নাজিমউদ্দীনের ভাষা-বিষয়ক প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করতে বলেন। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অভিমতের কথা উল্লেখ করে নাজিমুদ্দীন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করেন। খাজা নাজিমউদ্দীনের এই বিশ^াসঘাতকতার কথা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানতে পেরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ওইদিন সন্ধ্যার পরে ফজলুল হক হলে সমবেত হয়ে নাজিমউদ্দীনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে।

এরপর সুস্পষ্ট কোনও কর্মসূচির অভাবে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন পুনরায় স্তিমিত হয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট, কর্মচারীদের আন্দোলন ও ধর্মঘট, কর্মচারীদের আন্দোলন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব প্রদান, পুলিশ ধর্মঘট―এসব ঘটনা ও অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে পার হতে থাকে সময়―অতিক্রান্ত হয় ১৯৪৮ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন ও ধর্মঘট ছাত্র আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করলেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এ সময় তেমন গতিশীল ছিল না, বরং বলা যায় অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন খানিকটা স্তিমিত হয়ে পড়লে পাকিস্তান ঔপনিবেশিক সরকার বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আরবি হরফে বাংলা ভাষা লেখার প্রচেষ্টাই হচ্ছে এই নতুন ষড়যন্ত্র। আরবি হরফে বাংলা লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করা এবং এটি ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। এর মূল কারিগর ছিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান, কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন তার সহযোগী। ১৯৪৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান আরবি হরফে বাংলা লেখার যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন : ‘পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তানের ভাষা বিভিন্ন, এবং এক অংশ অপর অংশের ভাষা গ্রহণ করিতে পারে না। কাজেই সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা হইবে যথাক্রমে বাংলা ও উর্দু। এই দূরবর্তী দুই দেশের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য দূর করিবার একমাত্র উপায় উভয়ের মধ্যে একই অক্ষরের প্রবর্তন। বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই আরবি অক্ষরে লেখা হইলে উর্দুভাষী বাংলা বই পড়িবার সুযোগ পাইবে আর বাংলাভাষী উর্দু বই পড়িতে পারিবে। এইভাবে পরিণামে বাংলা ও উর্দু ভাষার সমবায়ে ও সংমিশ্রণে এক নূতন ভাষা গড়িয়া উঠিবে’ (আহমদ রফিক, ২০১৭ : ১৯২-১৯৩)। এরপর ফজলুর রহমানের প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে নানা লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে, সৃষ্টি হয় তুমুল তর্ক। হরফ-বিতর্ক ১৯৫১ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। উভয় পক্ষই যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে নিজেদের মত। এ পরিপ্রেক্ষিতে শতাধিক ব্যক্তির স্বাক্ষর সংবলিত একটি স্মারকলিপি ১৯৫১ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের কাছে দেওয়া হয়। স্মারকলিপিতে যাঁদের স্বাক্ষর ছিল, তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, অধ্যাপক আবুল কাসেম প্রমুখ।

১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ কালপর্বে প্রতি বছর ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ। ১৯৫০ সালের ১২ই নভেম্বর বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সরকারের বিভিন্ন অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্র-ধর্মঘটের আহ্বান জানায়। ধর্মঘট পালনকালে মিটিং ও শোভাযাত্রায় ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি উত্থাপন করে। ১৯৫১ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ছাত্রসভার আয়োজন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা খালেক নেওয়াজ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় নেতৃবৃন্দের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করা হয় এবং পরিষদ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ২২শে মার্চ ‘পতাকা দিবস’ উদযাপন করা হয় এবং গণপরিষদ সদস্যদের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সংবলিত স্মারকলিপি প্রদানের লক্ষ্যে একটি খসড়া কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি একটি খসড়া স্মাকলিপি প্রস্তুত করে। ২৫শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি-ছাত্র হাবিবুর রহমান শেলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে খসড়া স্মারকপত্র নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর এটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্মারকলিপিটি মুদ্রণের পর ১১ই এপ্রিল পাকিস্তান গণ-পরিষদ সদস্যদের কাছে দেওয়া হয় এবং প্রকাশের জন্য সকল পত্রিকা অফিসে পাঠানো হয়। ১২ই এপ্রিল দেশের সব পত্রিকায় স্মারকলিপির সংবাদ প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, পাকিস্তান গণ-পরিষদের অনেক সদস্য বাংলা ভাষা জানেন না বলে তখনও পর্যন্ত সরকারি ভাষা ইংরেজিতে এটি রচিত হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক গণপরিষদ সদস্যদের কাছে পাঠানো স্মারকলিপিটির সুচনা ও সমাপ্তিটা ছিল এরকম :

We, the students of Dacca University, who initiated the language movement in East Bengal three years ago who are how more determined than ever to secure for Bengali the status of state language of Pakistan, will  this opportunity, while you are all assembled at Karachi, to press on more our legitimate claim…

We remain them and the people’s representatives who are at the helm of affairs that until and unless the claim of Bengali is fully established in the province as well as at the centre, the students of Dacca University shall not rest.

Date 11th April, 1951

Dacca University

State Language Committee of Action.  (আমদ রফিক, ও এম আর মাহবুব, ২০১৭ : ২৭২-২৭৫)

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫১ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর একটি সভায় মিলিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ। আন্দোলনকে চাঙ্গা রাখার উদ্দেশ্যে পূর্ব-বাংলার সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগাযোগের জন্য একটি লিফলেট প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয় সভায়। ওইদিন দুটি লিফলেট প্রস্তুত করা হয়। লিফলেটদ্বয় ছাপিয়ে পূর্ব-বাংলার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ। ১৯৫২ সারের ১১ই মার্চ পূর্ববঙ্গের সমস্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানো হয় লিফলেটে। কোনও ব্যক্তি-নামে নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের নামে মুদ্রিত হয় লিফলেটদ্বয়। এই লিফলেট পেয়ে সমগ্র দেশেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনরায় কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ কর্তৃক প্রচারিত লিফলেটদ্বয়ের মূল কথা ছিল:

ক) লিফলেট-১

… আসুন―আমরা ১১ই মার্চ নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও সভা করে আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করে পুনরায় লৌহদৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে বাংলাকে উর্দুর সাথে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে ঘোষণা করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করি। (আহমদ রফিক ও এম আর মাহবুব, ২০১৭ : ২৭৬)।

খ) লিফলেট-২

পাকিস্তানকে সবল করতে হলে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করুন। আপনারা নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন ও আপনাদের স্থানীয় এলাকায় রাষ্ট্রভাষা কমিটি স্থাপন করুন।… আপনারা এই মহৎ কর্তব্যে এগিয়ে আসুন। জনসাধারণকে বুঝিয়ে দিন বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে পাকিস্তানের কত অনিষ্ট করা হবে। আমরা পাকিস্তানের অনিষ্ট চাই না, তাই যারা অনিষ্ট করতে চায় তারা যাতে মিথ্যা প্ররোচনা ও ধর্মের দোহাই দিয়ে তা করতে না পারে তার ব্যবস্থা করুন এবং তা করা তখনই সম্ভব যখন আমরা সংগঠিত হব। আজ সংগঠনের আশু প্রয়োজন। বন্ধুগণ, আপনাদের স্থানীয় এলাকায় সংগঠন করুন ও স্থানীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি স্থাপন করে কেন্দ্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করুন। (আহমদ রফিক ও এম আর মাহবুব, ২০১৭ : ২৭৭)

১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন খাজা নাজিমউদ্দীন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে খাজা নাজিমউদ্দীন ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি ঢাকা আসেন এবং পরের দিন অপরাহ্ণে পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। জনসভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি উচ্চারণ করেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনও ভাষা নয়। তবে পূর্ববঙ্গের অফিস-আদালতে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে কোন ভাষা চলবে তা পূর্ব-বাংলার জনগণই নির্ধারণ করবেন (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৭ : ১৫১)। খাজা নাজিমউদ্দীনের ওই বক্তৃতা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চার করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পূর্ব-বাংলার সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ ও মিছিল-মিটিং আরম্ভ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেয়ালে- দেয়ালে পোস্টার লাগায় এবং ৩০শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং ছাত্র-ধর্মঘটের আহ্বান জানায়। ৩০শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ থেকে খাজা নাজিমউদ্দীনের কাছে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি রক্ষার আহ্বান জানানো হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জনসভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৫২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনেরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ৩০শে জানুয়ারির সভায়। সভা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মিছিল সহকারে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে (The Pakistan Observer, 31.01.1952)

পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করে। ৩০ জানুয়ারির সভার অব্যবহিত পরেই অন্য সংগঠনগুলোও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রশ্নে তৎপর হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ৩০শে জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে সর্বস্তরের ছাত্র-যুবকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রদের পাশাপাশি অনেক রাজনেতিক কর্মী-সংগঠক এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ নামে রূপান্তর করা হয় (শেখ সাদী, ২০২০ : ১৩৩)। সভায় সর্বসম্মতভাবে ৪০ সদস্যের কর্মপরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন কাজী গোলাম মাহবুব। কর্মপরিষদের সদস্য হিসেবে ছিলেন মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, আতাউ রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, খালেক নেওয়াজ খান প্রমুখ। ইতঃপূর্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আহূত ৪ঠা ফেব্রুয়ারির ধর্মঘটকে সভায় সমর্থন জানানো হয়। পরবর্তী দিন ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে সর্বদলীয় একটি সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ এবং পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ৩১শে জানুয়ারির সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এই সভায় সর্বসম্মতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২৭শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমউদ্দীনের রাষ্ট্রভাষা-বিষয়ক বক্তব্যের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদজ্ঞাপন এবং তার সেই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। আরবি হরফে বাংলা লেখার পাকিস্তানি চক্রান্ত বন্ধ করার দাবি জানিয়েও সভায় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৪ঠা ফেব্রুয়ারি যে ধর্মঘট আহ্বান করে, সে-কর্মসূচির প্রতিও সভায় সমর্থন জানানো হয়।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট শেষে ছাত্ররা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মিছিল সহকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। এরপর গাজীউল হকের সভাপতিত্বে আমতলায় একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, আবুল কাসেম, খালেক নেওয়াজ খানসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা বক্তৃতা দেন। ২৭শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমউদ্দীনের বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে বক্তারা তার বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। ১৯৪৮ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে খাজা নাজিমউদ্দীনের স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নেরও দাবি জানানো হয় সভায়। এই সভাতেই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’কে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি অঙ্গ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারি থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের পরবর্তী অধিবেশন শুরু হবার কথা ইতঃপূর্বেই সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এদিকে লক্ষ রেখেই ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমগ্র পূর্ববাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় সভা থেকে। সভা শেষে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল সহকারে রাস্তায় বের হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্লোগান দিতে দিতে প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবন হয়ে হাইকোর্টের সামনে দিয়ে নবাবপুর রোড, পাটুয়াটুলি, জজ কোর্ট, আর্মানিটোলা, নাজিমুদ্দীন রোড অতিক্রম করে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে মিছিল শেষ হয় (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৭ : ১৭৬)।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি যে সাধারণ ধর্মঘটৈর ডাক দেয়, সে-ব্যাপারে সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক জরুরি সভা বসে। গুরুত্বপূর্ণ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। সভায় আবুল হাশিমসহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রায় সকল নেতা উপস্থিত থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সভায় সংগ্রাম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়াও একুশে ফেব্রুয়ারির সাধারণ ধর্মঘট সর্বাত্মক সফল করার জন্য সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ৪ ফেব্রুয়ারি কেবল ঢাকাতেই নয়, পূর্ব-বাংলার সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানেই সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সার্থক করার কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য ২০ তারিখ বিকেল পাঁচটায় নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক বৈঠক বসে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আবুল হাশিম। বৈঠক চলাকালেই সারা ঢাকা শহরে মাইকের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় যে, ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে আগামী ৩০ দিনের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। রেডিও থেকেও ১৪৪ ধারা জারির সংবাদ পৌনঃপুনিক প্রচার করা হয়। ১৪৪ ধারা জারির কারণে সমগ্র পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে―রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। সভার আলোচনার ধরন আমূল পাল্টে যায়। ২১ তারিখ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ধর্মঘট পালন করা এবং পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়া হবে কি না, সে-ব্যাপারে আলোচনা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষ এবং বিপক্ষ মতের মধ্যে তুমুল বিতর্কের সষ্টি হয়। সভায় উপস্থিত অধিকাংশ সদস্যই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আবুল হাশিম, কামরুদ্দীন আহমদ, খয়রাত হোসেন, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, কাজী গোলাম মাহবুব, আবদুস সামাদ প্রমুখ। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে এদের মূল যুক্তি ছিল―১৪৪ ধারা ভাঙলে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে―বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, ফলে সরকার আসন্ন সাধারণ নির্বাচন স্থগিত করার সুযোগ নিতে পারে। ১৯৪৭ সালের আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচন হয়নি, এ পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জের ধরে যদি সরকার নির্বাচন বাতিল বা স্থগিত করে, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হবে। অন্যদিকে বিরোধী দল এখনও তেমন সংগঠিত নয়, সংগ্রাম পরিষদের সাংগঠনিক কাঠামোও দেশব্যাপী এখনও গড়ে ওঠেনি―তাই বিরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। অপরদিকে যারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছিলেন, তাদের যুক্তি হলো―১৪৪ ধারা না ভাঙলে সরকারের কাছে নতি স্বীকার করা হয়েছে বলে বিবেচিত হবে এবং তা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হবে। এই মতের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন অলি আহাদ, আবদুল মতিন, গোলাম মাওলা, শামসুল আলম প্রমুখ। সভায় ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মোহাম্মদ তোয়াহা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে কথা বললেও ভোটদানে বিরত থাকেন। কমিউনিস্ট পার্টির স্বতন্ত্র মত ছিল বলে তিনি ভোট দেননি। নেতৃত্বের মধ্যে বিতর্ক চলতেই থাকে। প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য উক্ত সভায় প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত গাজীউল হকের মন্তব্য :

ভোটাভুটির পরও অলি আহাদ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘এই সিদ্ধান্ত আমরা মানি না এবং আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রসভা হবে সে-ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে যদি রায় হয়, তবে আমরা ভাঙার পক্ষে।’ অলি আহাদের বক্তব্য শুনে আবুল হাশিম রাগতস্বরে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রসভা হবে সে ছাত্রসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে শামসুল হক রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত ছাত্রদের জানিয়ে দেবেন এবং তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের তরফ থেকে বক্তব্য পেশ করবেন। যদি তবু ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙে তবে স্বাভাবিকভাবেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বিলুপ্তি ঘটবে। আবুল হাশিমের এই বক্তব্যও প্রস্তাব আকারে গৃহীত হয়। (গাজীউল হক, ২০০০ : ৯৪)

নবাববপুরে আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা চলাকালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি বৈঠক বসে। এই বৈঠকে ২১ তারিখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এই সিদ্ধান্ত নবাবপুরে আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে বৈঠকরত নেতৃবৃন্দকে জানান হলে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য বদরুদ্দীন উমরের ভাষ্য : ‘… অধিকাংশ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না সেটা পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাতেই চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হবে।… ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখের এই বেঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসভায় সর্বদলীয় কর্ম পরিষদের পক্ষ থেকে শামসুল হক ও কাজী গোলাম মাহবুব ছাত্রদের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তের বিষয় অবহিত করবেন এবং সেই সঙ্গে সিদ্ধান্তটি ব্যাখ্যা করবেন’ (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৭ : ১৭৭)।

নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছলে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন হল থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হয়―নেতৃবৃন্দ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য জরুরি সভার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি হবে না এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২০ তারিখ রাত ১২টায় ফজলুল হক মুসলিম হল এবং ঢাকা হলের মধ্যবর্তী পুকুরের পূর্বধারের সিঁড়িতে ছাত্র নেতৃবৃন্দ মিলিত হয়। বৈঠকে মোট ১১ জন ছাত্রনেতা উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন―হাবিবুর রহমান শেলী, মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান, আবদুল মোমিন, এম এ বারী এটি, এম আর আখতার মুকুল, কমরুদ্দিন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, আনোয়ার হোসেন, গাজীউল হক এবং আবদুস সামাদ। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো যেকোনও মূল্যেই ১৪৪ ধারা ভেঙে পরিষদ ভবনে যেতে হবে। বৈঠকে ২১ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আমতলার সভার কর্মপরিকল্পনা এবং ১৪৪ ধারা ভাঙার রণকৌশলও ঠিক করা হয়।

অবশেষে আসে চিরকালের বাঙালির জন্য শোক বেদনা গর্ব আর গৌরবের উজ্জ্বল এক দিন―১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে আমতলার সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তায় বের হতে থাকে, পুলিশ প্রথমে বাধা দেয়, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে, অবশেষে গুলি করে। বেশ কয়েকজন ছাত্র শহিদ হয়, অনেকে আহত হয়―সৃষ্টি হয় বিশ্বমানবসমাজের ইতিহাসে অতুলনীয় এক উজ্জ্বল অধ্যায়। গুলিতে যারা শহিদ হন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আবুল বরকত―যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে বন্দি। বন্দি অবস্থায় চিকিৎসার জন্য তিনি এলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে মাঠ-পর্যায়ের পুলিশ সদস্য জনৈক মানিক শিকদারের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দ দেখা করেছেন এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা লাভ করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানই ছাত্র নেতৃবৃন্দকে যেকোনও মূল্যে ১৪৪ ধারা ভাঙার নির্দেশ দান করেছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অনেক শিক্ষকও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে আবুল কাসেম, কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, নূরুল হক ভূঁইয়া প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। একই সঙ্গে উল্লেখ্য, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনের অনেকেই পাকিস্তানি আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরোধিতাও করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশি নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। ১৯৫২ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারির উক্ত প্রতিবাদসভায় হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করা হয়। শিক্ষক সমিতির এই প্রতিবাদ সভার রিপোর্ট গবেষক উল্লেখ করেছেন এভাবে :

In a protest and mourning meeting of the teachers of Dhaka University presided over by Dr. Ifrat Hossain Juberi, about a dozen proposals were passed. Below we reproduce a summary : Pakistan government is requested to declare that Bangla has been adopted as a state language of Pakistan. Dhaka University is requested to take practical steps to introduce Bangla as medium of instruction. This meeting condemns the heinous murder of students and attacks on them on February 21 and the following days. This meeting calls upon the Government to form an enquiry committee under a high court judge to conduct an investigation of the events of February 21 and the follwoing days. These meeting demands straight away discharge of the officers responsible for the events. This meeting demands withdrawal of sec 144 and all the police pickets and army units from the Dhaka city immediately. This meeting also demands lifting of censorship of all kinds from the newspapers. This meeting demands, allowing compensation to all affected families. This meeting calls for uncoditional release of all personnel arrested during the last few days on the charge of involvement in the movement. Among those who were present in the meeting and took part in deliberation were Munir Chowdhury and abdur Razzaque. (Sayeed Hyder, 2011 : 195)

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অবদানের কথা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করতে হয়। সে-সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল না। আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণও ছিল না বললেই চলে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য দশ জনের এক একটি দল রাস্তায় বের হওয়ার কৌশল গ্রহণ করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। প্রথমে ২/৩ ব্যাচ ছাত্র বের হয়। তারপর বের হয় ছাত্রীদের দল। ছাত্রীদের দলে ছিলেন সুফিয়া খাতুন, শাফিয়া খাতুন, শামসুন নাহার, রওশন আরা বাচ্চু, মমতাজ বেগম, আনোয়ারা খাতুন, হালিমা খাতুন, সুফিয়া খান, রওশন আহমেদ দোলন, ঊষা বেপারী প্রমুখ (Sayeed Hyder, 2001 : 228-237) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের এই ভূমিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চির-উজ্জ্বল এক অনুষঙ্গ।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মুখ্য ভূমিকা পালন না করলেও, কয়েকজন শিক্ষক এই আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার কারণে মুনীর চৌধুরী, মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, পৃথ্বিশ চক্রবর্তী প্রমুখ শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়। সরাসরি সংশ্লিষ্ট না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের নির্দেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯২১ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বিবরণীতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি, অথচ এই আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। একুশে ফেব্রুয়ারির পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সম্পর্কে বার্ষিক বিবরণীতে বলা হয় ‘দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়’ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় বার্ষিক বিবরণী, ১৯৫২ : ৩৭)। উল্লেখ্য, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী ১৯৫২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার কারণে ২৪শে ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণে তাঁকে প্রক্টরের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এক বছর পরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল (বর্তমান সিন্ডিকেট) বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও ধর্মঘটে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্ররা অবস্থান গ্রহণ করলে কয়েকজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়, পরে আন্দোলনের চাপে কর্তৃপক্ষ বহিষ্কারাদেশ বাতিল করতে বাধ্য হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে এসব নেতিবাচক ভূমিকা রাখলেও, তা ছিল অতি নগণ্য একটা বিষয়। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সরকারের নির্দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এইসব ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়। তবে সামগ্রিক বিবেচনায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রাখে দূরসঞ্চারী ঐতিহাসিক ভূমিকা। এই ভূমিকা ব্যাখ্যা করে রংগলাল সেন লিখেছেন :… চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলা ভাষার আন্দোলন সাফল্য লাভ করে। এ আন্দোলন থেকে সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে ইহজাগতিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। আর এটি কোনও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বাংলা ইশতেহার ছাড়া সাইকোস্টাইল করে উর্দু ইশতেহার বিলির মাধ্যমে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধাপক মরহুম রিজভী তৈরি করে দেন। সফল ভাষা আন্দোলনের ফলে শুধু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হলো না, পূর্ববাংলার সমাজে বিশেষ করে ছাত্রদের মন-মানসিকতায় বিরাট পরিবর্তন সাধিত হলো।… জনসাধারণের মধ্যে পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, সার্থক ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালু করার আওয়াজও জোরেশোরে উচ্চারিত হতে থাকে, যা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। (রংগলাল সেন, ২০১২ : ১৫৮)

১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্ন বেতনভুক্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা নানা দাবিতে আন্দোলন আরম্ভ করেন। কর্মচারীদের আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সমর্থন দেয়। আন্দোলন ক্রমেই দানা বেঁধে ওঠে। কর্মচারীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ছাত্ররা যৌথ ধর্মঘটের আহ্বান জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় ‘ছাত্র-কর্মচারী পরিষদ’। এই আন্দোলনে সমর্থন জানাতে গিয়েই ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। কর্মচারীদের এই আন্দোলন এবং আন্দোলনে সমর্থন জানানোর কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের বহিষ্কারাদেশ ও কারাবরণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পালন করে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাদের চিন্তা থেকেই এই আন্দোলনের উদ্ভব, তারাই দেয় এই আন্দোলনের সাংগঠনিক ও গণতান্ত্রিক ভিত্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার-সচেতন সংগ্রামী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রগতিপন্থি শিক্ষকমণ্ডলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই আন্দোলন সংগঠনে পালন করেন সক্রিয় ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক- কর্মকর্তা-কর্মচারীর সক্রিয় কর্মপ্রয়াসের মধ্য দিয়ে আজ থেকে সত্তর বছর পূর্বে এই যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা-ই নির্মাণ করে দেয় আমাদের স্বাধীনতার মহান ভিত্তিভূমি।

নির্বাচিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধপঞ্জি

আবদুল মতিন, ২০১৭। ‘একুশের হয়ে ওঠা’, একুশের পটপভূমি : একুশের স্মৃতি (সম্পাদক : মতিউর রহমান) শীর্ষক গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধ, ঢাকা : প্রথমা প্রকাশন।

আতাউর রহমান খান, ২০০০। ওজারতির দুই বছর, ঢাকা : নওরোজ কিতাবিস্তান।

আবুল কাসেম, ২০১৭। ‘ভাষা আন্দোলনের আরেক অধ্যায় বাঙলা কলেজ’, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন: ইতিহাস ও অনুষঙ্গ (সম্পাদক : আহমদ রফিক ও এম আর মাহবুব) শীর্ষক গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধ, ঢাকা : অনিন্দ্য প্রকাশ।

আহমদ রফিক ও এম আর মাহবুব, ২০১৭। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও অনুষঙ্গ (১-৩ খণ্ড), ঢাকা : অনিন্দ্য প্রকাশ।

কামরুদ্দীন আহমদ, ২০১৪। পূর্ব-বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স।

গাজীউল হক, ২০০০। আমার দেখা আমার লেখা, ঢাকা : মেরী প্রকাশন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিক বিবরণী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫২।

বদরুদ্দীন উমর, ২০১৭। পূর্ব-বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন সমাজ (১-৩ খণ্ড), ঢাকা : সবর্ণ।

বশীর আল হেলাল, ২০০৩। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ঢাকা : আগামী প্রকাশনী।

মযহারুল ইসলাম, ২০১৭। ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, ঢাকা : আগামী প্রকাশনী।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ১৯৪৭। ‘আমাদের ভাষা-সমস্যা’, দৈনিক আজাদ, ০৭.০৭১৯৪৭।

রংগলাল সেন, ২০১২। ‘ভাষা আন্দোলন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (সম্পাদক: রঙ্গলাল সেন ও অন্যান্য) শীর্ষক গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধ, ঢাকা : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।

শেখ সাদী, ২০২০। বঙ্গবন্ধু অভিধান, ঢাকা : কথাপ্রকাশ।

শেখ মুজিবুর রহমান, ২০২২। অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিডে।

শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১৭। কারাগারের রোজনামচা, ঢাকা : বাংলা একাডেমি।

সরদার ফজলুল করিম, ২০০৪। ‘মোহমুক্তির সূত্রপাত’, সেই সে কাল : কিছু স্মৃতি কিছু কথা শীর্ষক গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধ, ঢাকা : প্যাপিরাস।

হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদক), ২০১৬। একুশে ফেব্রুয়ারি, ঢাকা : সময় প্রকাশন।

East Bengal Legistative Assembly Proceedin- Vol-2, 1949, Dhaka.

Mohammad Ali Jinnah, 1968 : Selected Works, Karachi: Book Mart.

Sayeed Hyder, 2011, The Greet Language Movement, Dhaka : Swarupa.

সহায়ক পত্র-পত্রিকা

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬.০২.১৯৪৮

দৈনিক আজাদ, ১৮.১১.১৯৪৭

নও-বেলাল, ০৪.০৩.১৯৪৮

 লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button