আর্কাইভক্রোড়পত্র

আলী ইমাম: স্মৃতির ভেতরে বসবাস : আমীরুল ইসলাম

ক্রোড়পত্রে স্মরণাঞ্জলি : আলী ইমাম

তখন সন্ধ্যা।

মৃদু শীতের ছোঁয়া। এমন সময় অন্তুর ফোন। অন্তু মানে আলী ইমাম ভাইয়ের একমাত্র পুত্র। পেশায় চিকিৎসক। খুব ভারী কণ্ঠে সে বলল, আমীরুল কাকু, আব্বু তো আর নেই।  চ্যানেল আইতে খবরটা দিয়ে দিন। আমি স্তম্ভিত হয়ে রইলাম। বিষাদে আচ্ছন্ন আমি। চ্যানেল আইয়ের ছাতিম গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছি। ছাতিম গাছের সোঁদা গন্ধ। আমার তখন কান্না পাচ্ছে। সাগর ভাইকে ফোন দিলাম। সাগর ভাই আর্তনাদ করে উঠলেন। এই সত্য তিনি মেনে নিতে পারছেন না। কারণ প্রায় ৫৫ বছরের পথচলা। শিশুসাহিত্য, শিশু সংগঠন, টেলিভিশন―একটা জীবন আলী ইমাম এবং ফরিদুর রেজা সাগর একসঙ্গে কাটিয়েছেন।

স্মৃতির পর স্মৃতি মনে পড়তে লাগল। আমার সঙ্গেও প্রায় ৪৫ বছর সম্পর্ক। পিতাতুল্য তিনি। অভিভাবক ছিলেন। আলী ইমাম ভাই আমাদের শূন্য করে দিয়ে চলে গেলেন। ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায়। কিছুক্ষণ চ্যানেল আইতে এলোমেলো ছোটাছুটি করলাম। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। সাগর ভাই আবার ফোন দিলেন। নিউজ কেমন হবে আলী ইমাম স্মরণে, মরদেহ কখন চ্যানেল আইতে আসবে, জানাজা কখন হবে―এসব নির্দেশনা দিতে থাকলেন। আমি আবার বাস্তব পৃথিবীতে ফিরে এলাম। শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে কথা বললাম। দুজনই কিছুটা অসুস্থ। তারা আশৈশব আলী ইমামের বন্ধু। একসঙ্গে লেখালেখির জীবন। তারা চ্যানেল আইতে আসতে রাজি হলেন। উপস্থাপক হিসেবে পেলাম সময় প্রকাশনের ফরিদ আহমেদকে। সেট, লাইট, ব্যাকড্রপ সব প্রস্তুত হলো। শাইখ সিরাজ তত্ত্বাবধান করলেন। তিনিও প্রচণ্ড বিষাদ আক্রান্ত। আলী ইমামের প্রয়াণ আমরা কেউ মেনে নিতে পারছি না।

রাত নয়টায় রেকর্ডিং করলাম। দশটায় সম্প্রচার। কান্নাভেজা একটা অনুষ্ঠান তৈরি হলো। ইফতেখার মুনিম, মোস্তাফিজুর রহমান নান্টু, ইমরান পরশ প্রমুখ সদা প্রস্তুত। আলী ইমাম চ্যানেল আইতে প্রচুর অনুষ্ঠান করেছেন। আর্কাইভ থেকে ফুটেজ নিয়ে ইফতেখার মুনিম একটা প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করে ফেলল তাৎক্ষণিকভাবে।

আমি অন্তুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে চলেছি। আলী ইমাম ভাইয়ের মরদেহ সকাল ১০.৩০টায় বাংলা একাডেমি নজরুল মঞ্চে সকলের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নেয়া হবে। বাদ জোহর চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে জানাজা হবে। চ্যানেল আই ছিল আলী ইমামের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে এমন অনেক অনুষ্ঠান তিনি উপস্থাপনা করেছেন―সাহিত্য বিষয়ক যেকোনও অনুষ্ঠানে আলী ইমামের সরব উপস্থিতি। তার কর্মের পৃথিবী বিশাল বড়। টেলিভিশনে শিশুশিল্পী হিসেবে অংশ নিতেন। পরে প্রযোজক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু। জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে অবসর গ্রহণ। এর পাশাপাশি তিনি একজন প্রথিতযশা শিশুসাহিত্যিক। আজীবন তিনি ছোটদের জন্য দুহাতে লিখেছেন। ১৯৬৩ সাল থেকে তার লেখালেখির শুরু। কচি-কাঁচার আসর, খেলাঘর, টাপুর টুপুর, মুকুল, নবারুণ, শিশু, ধান শালিকের দেশ―এসব পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। তার বই প্রকাশিত হয়েছে প্রায় পাঁচশত। বই প্রকাশিত হলে তিনি শিশুর মতো আপ্লুত হতেন। খুব ভালো কথক ছিলেন তিনি। আমরা মুগ্ধ হয়ে তার বক্তব্য শুনতাম। বিগত তিরিশ বছর ধরে তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্কুল কর্মসূচিতে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন বক্তৃতা দিয়ে। কোনও ক্লান্তি নেই তার। বিপুল প্রাণশক্তি। বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন।

আমাদের পরম গুরু আবদুল্লাহ আবুু সায়ীদকে ফোন দিলাম। স্যার খুব ভালোবাসতেন আলী ইমামকে। টেলিফোনে বেদনা ঝরে পড়তে লাগল সায়ীদ স্যারের। আমাকেও বললেন, শরীরের যত্ন নিও।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা, শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন সবাই জানাল, আলী ইমাম ভাইকে নিয়ে তারা স্মরণসভা করবেন।  প্রত্যেকেই বেদনায় আচ্ছন্ন। কারণ আলী ইমাম ভাই অসম্ভব পজিটিভ মানুষ। সবার সঙ্গে সহজে মিশতে পারতেন। সবার মাঝে স্মৃতির ছাপ রেখে যেতেন। আহমাদ মাযহারের সঙ্গেও নানা বিষয়ে কথা হতে লাগল বারবার। মন বড় অস্থির। অনেক বেশি কথা বলছি সন্ধ্যা থেকে। মাযহারের সঙ্গে আলী ইমাম বিষয়ে অনেক কথা হলো। গভীর রাত পর্যন্ত অক্লান্ত সেই আলোচনা। হাসান রাউফুন, পিয়াস মজিদ. আশিক মুস্তাফা, অদ্বৈত মারুত, মামুন সারওয়ার, মঈন মুরসালিন, নাফে নজরুল সবাই উদ্রগীব। ফেসবুকে অনবরত পোস্ট হচ্ছে তার মৃত্যুসংবাদে সবার মন খারাপ। ঠাটারি বাজারে পৈতৃক বাড়ি, আজিমপুরে শ্বশুরবাড়ি―কত দিনরাত্রি। কত স্মৃতি। আলী ইমাম ভাইয়ের ছোট শ্যালক রাজন আমার স্কুল বন্ধু। ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগল না আমার। তারপর সুখে দুঃখে, আনন্দ-বিষাদে আমাদের জীবন বয়ে যেতে লাগল। আমাদের জীবনে আলী ইমামের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। আমাদের লেখালেখির প্রচণ্ড উৎসাহদাতা তিনি। মনপ্রাণ ভরে তিনি সবসময় প্রশংসা করে গেছেন। আমাদের মানস গঠনে তার ব্যাপক ভূমিকা। লেখালেখি, টেলিভিশন সব কাজেই আলী ইমামের ভালোবাসা ও প্রেরণায় আমরা ঋদ্ধ হয়েছি। টেলিভিশনের কাজ শিখেছি তার কাছে। পরে পূর্ণতা পেয়েছি সাগর ভাইয়ের কাছে।

নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, আল মনসুর, সাইদুল আনাম টুটুল, আলী ইমাম, রিয়াজউদ্দিন বাদশা, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন এরা ছিল পরস্পর হরিহর আত্মা। 

এদের পরম্পরা ধরে ফরিদুর রেজা সাগর, ইমদাদুল হক মিলন, আফজাল হোসেনের আগমন। এর পরের পরম্পরা আমাদের বলা যেতে পারে। লুৎফর রহমান রিটন, আসলাম সানী, আহমাদ মাযহার, শহিদুল আলম সাচ্চু প্রমুখ।

অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ইমাম ভাই ছিলেন খুব অস্থির মানুষ। নানা কাজ নিয়ে তিনি সারাক্ষণ ছটফট করতেন। কত ধরনের তার কোনও হিসেব নাই।

অনায়াসে তিনি একদিনে তিনটা অনুষ্ঠান প্রযোজনা করতেন। চার-পাঁচটা বই একসাথে লিখতেন। বই তৈরি করতেন। প্রুফ দেখতেন। পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতেন। বইয়ের মেকাপ দিতেন। বই পেস্টিং করতেন। যেন তিনি দশভূজা।

পুরো দেশ তিনি বারবার ঘুরে বেড়িয়েছেন। কচি-কাঁচার মেলার আহবায়ক হিসেবে অধুনা পাকিস্তান চষে ঘুরেছেন। পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনের কর্মসূত্রে দেশ পরিভ্রমণ করেছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির মাধ্যমে বেশ কয়েকবার দেশভ্রমণ করেছেন। আলী ইমাম ভাইয়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সেটা হচ্ছে আলী ইমাম ভাইয়ের ভোজনপ্রিয়তা। অসম্ভব ভোজনরসিক। কাবাব-রুটি, কাচ্চি বিরিয়ানি, মাটন ভুনা, ইলিশ মাছ, লোকায়ত বাংলার খাবার―এসবই ছিল তার প্রিয়। গরুর মাংসের কাবাব দিয়ে তিনি ডালভাত খেতে খুব পছন্দ করতেন। গরুর মাংসের যেকোনও রেসিপি আলী ইমাম ভাইয়ের জিহ্বাকে অসংযত করে তুলত। তার কোনও সংকোচ ছিল না। তিনি রাস্তার ধারের হোটেল কিংবা পাঁচতারা হোটেলে একই রকম রুচি নিয়ে খেতেন।

চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের তিনি ছিলেন অন্ধ ভক্ত। রায়ের কোনও সমালোচনা তিনি সহ্য করতেন না। রায়ের চলচ্চিত্র, শিশুসাহিত্য, সম্পাদনা, প্রচ্ছদ নির্মাণ সবকিছুতেই তিনি পাগলের মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন। আলী ইমাম সমগ্র বাংলা ভাষার প্রেক্ষাপটেই একজন শক্তিমান শিশুসাহিত্যিক। তার অজস্র বইয়ের সমুদ্র থেকে মনিমুক্তো খুঁজে বের করা কঠিন। দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া, নীল ডুংরির আতঙ্ক, শাদা পরি, বনকুসুমপুর রহস্য, ভয়াল ভয়ংকর, চারজনে রুপালি ফিতে―থোকা থোকা অসংখ্য বইয়ের নাম উল্লেখ করা যায়।

তার লেখার বৈশিষ্ট্য নিয়ে শত শত পৃষ্ঠা লেখা যায়। ভালোমন্দ সমালোচনাও করা যায়। কিন্তু এখন ভাবি, এত লেখা কীভাবে সম্ভব?

আলী ইমাম ভাই ছিলেন প্রচুর পরিশ্রমী। বলতেন, আমি কলমপেষা মজুর। আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে তার কথা শুনতাম। আজিমপুরে ইমাম ভাইয়ের বাসায় রাত জেগে কাজ করেছি। লিপি আপা পরম যত্নে আমাদের ভাত খাওয়াতেন। সেসব দিনের কথা কেমন করে ভুলি। আলী ইমাম ভাই জীবিতকালেই বর্ণময় স্মৃতিমধুর, দরদি এক চরিত্র। তাঁর সঙ্গে কত ঘটনা। কত স্মৃতি, কত কাহিনি ছড়িয়ে আছে। তিনি ছিলেন আমাদের জীবনের অংশ।

বাংলা একাডেমি নজরুল মঞ্চে তার মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম―আলী ইমাম ভাইও স্মৃতির ভেতর বসবাস শুরু করলেন। আমরা এখন রিক্ত, নিঃস্ব, শূন্য। আমরাও স্মৃতি হয়ে যাব।

আলী ইমাম ভাইয়ের বক্তৃতার বাণী ধার করে বলতে চাই, ‘মাধবীর কানে কানে বাতাস কহিল মৃদুস্বরে, নিজেরে চেন না তুমি আমরা তোমারে চিনি সবে।’

আলী ইমাম ভাই ভালো থাকবেন।

দুই

প্রিয় তানভীর ইমাম। আমাদের অন্তু। আলী ইমাম ভাইয়ের একমাত্র পুত্র। পেশায় চিকিৎসক। পিতৃসেবায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু পিতা আলী ইমাম সকল মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নিলেন। সেদিন ২২ নভেম্বর আলী ইমাম চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে এলেন। খাটিয়ায় শাদা কাপড় পরিধান করে তিনি শায়িত। নিথর নিস্তব্ধ তার দেহ। জানাজায় শত শত মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্তু তখন খুব দৃপ্তকণ্ঠে বলল, ‘আমার বাবাকে মাফ করে দেবেন আপনারা। আমার বাবাকে আমি খুব কমই পেয়েছি। তিনি তো সারা জীবন আপনাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। কাজ করেছেন। আপনারাই তার স্বজন, বন্ধু-সুহৃদ। তাই আমার কিছু বলার নেই। দোয়া করবেন, আমার বাবা যেন ভালো থাকেন।’ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম অন্তুর দিকে। ছোট্ট অন্তু এখন পুরোদস্তুর একজন ভদ্রলোক। পরিশীলিত রুচি, হাস্যরস আর বিনয়ী অন্তুকে দেখে আমরা সবাই খুশি। অন্তু দারুণ বাস্তবতার সঙ্গে মৃত আলী ইমামের সকল কাজ সমাধান করল। আজিমপুর গোরস্থানে বাবাকে নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিল। কিন্তু ওকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই―ভেতরে ভেতরে অন্তু কতটা ভেঙে পড়েছে।

আলী ইমামের অনেক পরিচয়। কমবেশি সবাই সেটা জানেন। তিনি একাধারে শিশুসাহিত্যিক, টিভি ব্যক্তিত্ব, শিশু সংগঠক, সুবক্তা, টিভি উপস্থাপক। বহু গুণের অধিকারী। দুহাতে ছোটদের জন্য লিখেছেন। গল্প-ছড়া কবিতা, ফিচার, নিবন্ধ, প্রবন্ধ, অনুবাদ, নাটক―কোনও মাধ্যম তিনি বাদ দেননি। আলী ইমাম ভাই একটা জেনারেশনের প্রতিনিধি। শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, ভূঁইয়া ইকবাল, সাইদুল আনাম টুটুল, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, আল মনসুর―স্কুল জীবন থেকেই তারা পরস্পরের বন্ধু। একসাথে বহু ধরনের কাজ তারা করেছেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাদের প্রত্যক্ষ অবদান আছে। আলী ইমাম ভাইরা শিশুসাহিত্যের ধারা বদলে দিয়েছেন। শিশুসাহিত্যে ইসলামিকরণের বিরোধিতা করেছেন। ইরান তুরান বা বোগদাদি কিসসা কখনও লেখেননি। শিশুসাহিত্যে বাংলাদেশকে তুলে আনতে চেয়েছেন।

অন্তু, তুমি এক গর্বিত পিতার সন্তান। অসাধারণ এক ব্যক্তি তিনি। সবার সঙ্গে মধুর আচরণ করতেন। যাদের পছন্দ করতেন তাদের খোঁজ-খবর রাখতেন নিয়মিত। প্রত্যেকের সঙ্গে অত্যন্ত সদ্ভাব। আলী ইমাম ছিলেন সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী এক মানুষ। তার সহকর্মীরাও তাকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারত না। এতে আলী ইমাম ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত করতেন না।

আমাদের সাথে তার সম্পর্ক চার দশকের অধিককাল। আনন্দ-বেদনায়, সুখে দুখে তিনি ছিলেন আমাদের মাথার ওপর অকৃত্রিম ছায়া। তার প্রস্থান মানে আমাদের নিকটতম অভিভাবকের প্রস্থান। আলী ইমাম ভাইয়ের কাছে প্রথম টেলিভিশনের বিস্ময়ের দরজা উন্মোচিত হয়েছে। তার কাছেই কাজ শেখার হাতেখড়ি। সময়কে কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেটাও শিখেছি তার কাছে। খুব সাধারণ, আড়ম্বরহীন জীবনযাপন করতেন তিনি। খুব শীতে গায়ে কোট চাপাতেন তিনি। প্রতিদিন সকালে ঠাণ্ডা জলে স্নান করতেন। পাতলা চপ্পল পরতেন। শীত ছাড়া কখনও জুতো পরতে দেখিনি। কাজ পাগল এক মানুষ তিনি। কাজ ছাড়া থাকতে পারতেন না। সারাক্ষণ তিনি কাজ বানিয়ে নিতেন। ঘরে বাইরে সর্বত্র কাজ নিয়ে তার ভাবনা। টিভি অনুষ্ঠান, বই লেখা, বই তৈরি করা―এসবই ছিল তার মূল কাজ। আলী ইমাম ভাই ছিলেন অসম্ভব প্রাণশক্তিসম্পন্ন মানুষ। অন্য মানুষের ভেতরের শক্তিকে তিনি বের করে আনতে পারতেন। লোকদের মধ্যে তিনি ছিলেন সত্যিকারের আমাদের কালের নায়ক।

তার ঈষৎ অনুজ ফরিদুর রেজা সাগর, ইমদাদুল হক মিলন, ইফতেখারুল ইসলাম, আফজাল হোসেন প্রত্যেককে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন। তারা ঈষৎ অগ্রজ আলী ইমামকে সম্বোধন করতেন―‘হেলাল ভাই’। এত প্রাণময় ব্যক্তি যে চিরবিদায় নিতে পারে তা আমাদের ভাবনার অতীত। তার পক্ষাঘাত অসুখের কয়েক দিন আগে তিনি আমাদের গোলারটেকের পৈতৃক বাসায় এলেন বিকেলে। আমি কয়েক দিন আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি। আলী ইমাম ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন আরেক প্রাণবান্ধব কবি আসলাম সানী। আড্ডা জমে উঠল। চলল পানাহার। আমি নীরস শ্রোতার মতো আড্ডায় অংশ নিচ্ছি। তিনি তখন বললেন, ‘আমীরুল মৃত্যু সবসময় ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। তাকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নাই। জীবন যতক্ষণ আছে ততক্ষণ জীবনের মতো থাকতে হবে।’

জীবন থেকে ছুটি নিয়েছেন আলী ইমাম ভাই। যেন একটা যুগের অবসান হলো। আলী ইমাম ভাই আমাদের কালের রেনেসাঁ মানব।

তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

 লেখক : শিশুসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button