বইকথা
কবি মিলু শামসের কবিতায় রয়েছে নিজস্বতা। অনেক কবিতার ভেতর পড়ে বলে দেয়া যাবে এটা কবি মিলু শামসের কবিতা। একজন কবির এটা অনেক বড় দক্ষতা ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর। তার কবিতায় অকৃত্রিম বন্ধনের মায়াময় টান আছে। সম্পর্কটা আত্মার। খুব আপন এই সম্পর্ক। খুব জানাশোনা আর মনে দাগ কেটে থাকে। জীবনে বড় হওয়ার পাশাপাশি অনেক কিছু না চাইলেও ফেলে যেতে হয়, ছেড়ে দূরে চলে যেতে হয়। আর সেরকম করে কাছে আসা হয় না। শুধু মনে সুখ ও কষ্টের জ্বালা ধরায়। তারপর অনেক যুগ পরেও সেই কথা মনে মনে। ঝোপঝাড়, বাঁশঝাড়, ডোবা ও ব্যাঙের ডাক ছাপিয়ে আবছা হয়ে সেই ছবি চোখে ভাসে। বায়স্কোপের বাক্সের কাচে সেই ছবি দেখা। মিলু শামসের কবিতা এভাবে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ভুলে যাওয়া এবং ফেলে আসা অস্তিত্বের কাছে।
তবু ভালো যে, কিছুত আছে পিছন ফিরে দেখার। কিছু কিছু কথা ভাবতে ভাবতে নস্টালজিক হয়ে ওঠা।
তাদের সে পথে বিষাদের ধুলো
গাঢ় নিম গাছ, নিশিন্দা পাতায়
হলুদের ছোপ।
সে পথে হবে না ফেরা কোনও দিন আর
যায় না ফেরা কোনও পথে দ্বিতীয় বার।
(শীত ঘুমে জমে স্মৃতির উল্টোরথ)
শহুরে জীবনের একটা ছবি আঁকেন তিনি। ধোঁয়াশে শহরের ভেতর কিছু মুখ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার কবিতায় যেমন শহরের জীবনের সংগ্রাম, সংকট ও জটিলতা আছে তেমনি উঠে এসেছে গ্রামের বাড়ির উঠোন এবং ধানের খেতে পরিশ্রমী মানুষের কথা।
যেমন তিনি বললেন―
জীবন এমন হয়
যখন পৃথিবীতে প্রেম ও প্রতিবাদের
দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
(বিবমিষা)
তার কবিতায় মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। উঠোনে মেলে রাখা ধানের গন্ধ পাওয়া যায়। আর বুবুকে পাওয়া যায়। হারিয়ে যাওয়া কোনও বুবুকে পাওয়া যায়।
দুপুরেরা হেঁটে যায় ভুবন বাজারে
তুমি আমি কত দূর কত দূর
মালঞ্চ বুবু, শৈশব লেগে থাকা
জামিরের ডালে বাজে সুদূরের সুর।
(মালঞ্চ বুবু)
মিলু শামসের কবিতা খুব জীবন ঘনিষ্ঠ। মাটির সোঁদা গন্ধ তাতে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। কথাগুলোর ভেতর আছে মায়ার ছোঁয়া যা অকৃত্রিম। যেমন―
আমার গায়ে মালতী মাসির ধূপগন্ধী আঁচলের ছায়া।
(মালতী মাসি)
তার সৃষ্টি, উপস্থাপনে তার নিজস্বতা অনন্য। আমরা প্রতিদিন যা দেখি সেই দেখার ভেতর থেকে তিনি তার কবিতার সরঞ্জাম খুঁজে বের করেন। শব্দচয়নে আছে
নান্দনিকতা। শিল্পগুণে পূর্ণ করে তুলে ধরেন তার কথা কবিতায়―
আমাদের টিনের চালের ছোট-বড় ছিদ্র দিয়ে
বাঁকা হয়ে ঢোকা ত্রসরেণু
আলো ছড়ালে
আমি মিহি স্বপ্নে ভেসে
রাজপুত্র আর কোটাল পুত্রের মতো
ঘাটে ঘাটে নোঙর ফেলতাম ময়ূরপঙ্খী নায়ের
মাঝ রাতে কখনও মধুমালা কখনও কঙ্কাবতীর সঙ্গে
গজমতীর মালা বদল শেষে
ছুঁতে যেতাম ওদের সোনালি ডানা
(আষাঢ়ে গল্প)
সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন আসে। আসে নতুন প্রযুক্তি। তার প্রভাবে পাল্টে যায় নাগরিক জীবনযাপন। এর কোনওটা ভালো কোনওটা মন্দ। সবকিছু কবিকে ভাবায়। তার অনুভব ফুটে ওঠে কবিতায়―
প্রথমে আমরা বিচ্ছিন্ন হলাম
ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের নামে
হাতে হাতে স্মার্ট ফোন―
আমরা খাবার টেবিলে
গল্প করতে ভুলে গেলাম
চোখে চোখ, ঘাড়ে হাত রেখে
নির্ভরতার অনাবিল আনন্দ উপভোগ
স্মৃতি হতে থাকলো ক্রমশ।
(বিচ্ছিন্ন ক্রমশ)
আধুনিক সভ্যতায় নতুন নতুন জিনিস বের হচ্ছে। নতুন জিনিসের কাছে অচল ও সাবেক হয়ে যাচ্ছে কত কিছু। আমূল পাল্টে দিয়েছে জীবনযাপন ও জীবনের স্বভাব ও প্রকৃতি। এসব জিনিস আমাদের সম্পর্কে দূরত্ব বাড়াচ্ছে, দূরত্ব বাড়াচ্ছে পারিবারিক জীবনে।
মানুষ নিষিদ্ধ তাই একে অন্যের কাছে
সন্তান মা বাবার কাছে
ভাই বোনের কাছে
বন্ধু বন্ধুর কাছে
স্বামী স্ত্রী মুখ ফিরে শোয় দুজন দুদিকে
চুম্বন আলিঙ্গন ভুলে যায়
প্রেমিক প্রেমিকা।
আমরা বিচ্ছিন্ন হচ্ছি এবার
মানব বিধ্বংসী অস্ত্রের চেয়েও
ভয়ংকর এক মারণাস্ত্রের ঘায়ে।
(বিচ্ছিন্ন ক্রমশ)
বিপ্লব বলি বা সামাজিক আন্দোলন বলি তা কখনও একটা জাতিগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। এই আন্দোলনের সংগঠন ও বিকাশ হতে হয় সেই জাতিগোষ্ঠীর শেকড় থেকে। মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস তার সাক্ষী। এই চিরন্তন সত্যের প্রতিফলন তার ‘সাঁওতাল’ কবিতায়।
এই যে বাজার বসেছে উঠোনে উঠোনে
ঘরে ঘরে কেনা বেচা, এইসব বেনিয়ার তোড়ে
মানিয়ে নিয়েছে তারা
পোর্সিলিনের থালায় লুচি আর নিরামিষ মুখে পুরে
চোখে রাখে চোখ, পড়ে নেয়
আলুলায়িত ভাষা দুজনের আপাদমস্তক―
এইসব মানিয়ে নেয়ার খেলা
শেষ হবে একদিন
শালবনে জ্বলবে সাঁওতালি আগুন
তখন তাদের আপনি কি তুমি, তুমি কি তুইয়ের
ব্যাকরণ ভেঙে বেরিয়ে পড়বে মানুষ।
মার্কিন কবি নিকি জিওভানি বলেছিলেন, আমি কবিতা লিখতে চাইনি। কিন্তু যখন কোনও কিছু চোখে পড়ে এবং ভাবি তখন কবিতা নিজ থেকে বের হয়ে আসে।
ভাবনার বাষ্প জমা হতে থাকে কবির ভেতর। বাষ্পকণা জমা হতে হতে বড় মেঘ হয়। ভারাবনত মেঘ বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। কবিতা হলো এই বৃষ্টিধারা।
আমার তরুণী মায়ের ছিল
এমন সরল সবুজের সংসার
দূর মফস্বলেÑ
আহা সেই কোনওকালে!
এখানে এলে মাও আসেন
অতীতগন্ধী বাতাসে ভর করে
মা ও মফস্বল একাকার
হৃদয়ের কোনও এক নির্জন ঘাটে।
(আসছে শীতে)
রাজনৈতিক সচেতন কবি। মানুষ আন্দোলন করে স্বাধীনতা আনে, গণতন্ত্র আনে। কিন্তু রাষ্ট্রের হিসাব অন্য রকম। রাজনীতিতে প্রতারণা হয়। সর্বস্ব ত্যাগ করেও মানুষের চাওয়া পূর্ণ হয় না। তার কবিতায় শুধু হতাশা নয় বরং আলোময় ভবিষ্যৎ দেখায়, যদিও সে আলো জোনাকির।
মুঠো বাঁধা হাতগুলো
একে একে ঢুকে গেছে
ভাঁজখোলা পরিপাটি
প্যান্টের পকেটে
বড় বেশি একা লাগে
কখনও সখনও
নগরীর ভিড় ঠাসা পথে
তবু তার মনে হয়
জোনাকিরা আজও জ্বলে
কোথাও না কোথাও
হয়তবা দূরের অচেনা জংশনে।
(মিছিলের পা)
সামাজিক বৈষম্যের কথা তুলে এনেছেন তিনি তার এক দীর্ঘ কবিতায়। দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজের সংগ্রামের কথা তুলে এনেছেন। কবিতাটা অন্যতম সার্থক সৃষ্টি তার। কুসংস্কারের শেকলে বাঁধা সমাজের অংশকে আশান্বিত করে ও সংগ্রামী করে তোলে―
উঁচু শিক্ষালয়ে হলো না যাওয়া
এই এক ডানা ভাঙা আশার
বিবরে দিয়ে পাথরচাপা
ভাইবোন ছিন্নবৃন্ত
দুপথে রাখে পা।
ভাই করাচিতে
উচ্চশিক্ষার পাঠ নিতে
বোন শ্বশুরালয়ে।
(আংটি ও এক কিশোরীর গল্প-২)
আমরা শোষিত হচ্ছি তৃতীয় বিশ্বের মানুষ হয়ে। তার কথা তিনি বললেন। সেই সঙ্গে যথার্থভাবে উপস্থাপন করেছেন প্রাচীন মিথ।
আমি এক বোকা মানুষ তৃতীয় বিশ্বের
রাজপুুত্র প্যারিসের মতোই
বুঝি না কি থেকে কি হয়―
তবু আঁতকে উঠি
আত্মঘাতী এই এক্সপেরিমেন্ট শেষে
পৃথিবী কোন রূপে ধরা দেবে
মানুষের কাছে ?
(তৃতীয় বিশ্বের বোকা মানুষ)
আমার কাছে মনে হয় সহজ করে বলাটাই আধুনিকতা। অনেকে অনেকভাবে আধুনিকতার সংজ্ঞা দিতে পারেন। সহজ করে একজন কবি প্রকাশ করতে পারেন তখন যখন বিষয়টা সম্পর্কে তার পুরো ধারণা থাকে। আর যখন নিজে পাঠক হয়ে নিজের লেখা পড়ে সহজবোধ্যতা মাপতে পারেন। এসব করতে পারেন তিনি শিল্পগুণের সঙ্গে আপোস না করেই। শিল্পী এসএম সুলতান বিমূর্ত শিল্প নিয়ে কথা বলেছিলেন। বিমূর্ত ছবি দেখে মানুষ জিগ্যেস করে তার অর্থ। দর্শকের ভেতর এক ধরনের পীড়ন কাজ করে। সেভাবে তার ভেতর বোঝার ঘাটতি রয়ে গেছে। তিনি বললেন, সহজ ও বোধগম্য করে তুলে ধরাই শিল্প। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সহজবোধ্যতা পাঠককে নিবিড় করে কবির লেখার সঙ্গে উপভোগ করতে পারে কবিতার কথা ও সৌন্দর্য।
কবি মিলু শামসের কবিতার বৈশিষ্ট্য হলো সহজবোধ্যতা। যে বিষয় নিয়ে তিনি লেখেন তা সরল করে উপস্থাপন করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কাজটা করতে গিয়ে তিনি কবিতার শিল্পগুণের সঙ্গে কখনও আপোস করেননি।
লেখক : প্রাবন্ধিক