আর্কাইভবইকথা

নক্ষত্র নিভে যায় : সাধারণ অনুভবের অসাধারণ কবিতা : তপন বাগচী

বইকথা

আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলীকে চিনতাম যোগাযোগবিদ্যার পণ্ডিত হিসেবে। বাচনিক দক্ষতাও তুলনারহিত। আবৃত্তিকে মুখ্য জ্ঞান করলে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ বাচিকশিল্পীদের সারিতে তাঁর নাম উচ্চারিত হতো। ক্লাসে তাঁর কথার গাঁথুনি শুনে মনে হতো, স্যার চাইলে কবিতাও লিখতে পারতেন! একদিন ক্লাস শেষে তাঁর ঘরে সেই প্রত্যাশার কথা জানাই। স্যার বললেন, ‘সবাইকে লিখতে হবে কেন ? আমি তো পড়ে আনন্দ পাই। এই যে তোমার কবিতাও তো পড়ি।’ হ্যাঁ, স্যার পড়েন। প্রচুর পড়েন। ইংরেজিতে লেখা কালকে যে বইটি দেশে ঢুকেছে, স্যার সেটিও সংগ্রহ করে ফেলেন। কেবল যোগাযোগবিদ্যার নতুন খবর নয়, বিশ্বসাহিত্যের খবরও তাঁর নখদর্পণে। আমি কবিতা লিখি বলে স্যারের কিছুটা প্রশ্রয় পাই। ধন্য হই।

একবার খুব ইচ্ছে হলো গবেষণা করার। আমি তখন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের গবেষক। এমফিলের ফরম তুলে স্যারের শরণাপন্ন হই। স্যার তো মহানন্দে আমার তত্ত্বাবধায় হতে রাজি হলেন। বিপত্তি ঘটল রেজিস্ট্রারের দফতরে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে এমফিল কোর্সের অনুমোদন নেই। তাহলে সরাসরি পিএইচডি। কিন্তু বিপত্তি সেখানে। পিএইচডি করতে তো এমফিল লাগবে অথবা স্নাতক পর্যায়ে অধ্যাপনার অভিজ্ঞতাসহ গবেষণা প্রবন্ধ লাগবে। প্রবন্ধ তো আছে। কিন্তু  তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে কোর্স চালু নেই। তাই অধ্যাপনার সুযোগ কোথায় পাব ? স্যার আমার সামনে রেজিস্ট্রারকে ফোন করলেন, জানালেন আমার গবেষণার অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে পিএইচডিতে ভর্তি করানো যায় কি না। তারা আইনের দোহাই পাড়লেন। খুব মন খারাপ করে বাংলা একাডেমির বটতলায় গিয়ে বসে থাকি। ওই সময় ঢুকছেন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর আবুল আহসান চৌধুরী। তিনি আমার মন খারাপ দেখে তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই উপহার দিলেন। আমি জানালাম আজকের ঘটনা। স্যার বললেন, তুমি ওই স্যারের একটা প্রত্যয়নপত্র নিয়ে এস যে সাংবাদিকতায় পড়লেও সাহিত্য-গবেষণায় যোগ্যতা আছে। তখন আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী একটি প্রত্যয়নপত্র লিখে দেন। আরেকটি প্রত্যয়নপত্র লিখে দেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ।  আমি ওই প্রত্যয়ন এবং অন্যান্য শর্ত পূরণ করে আবুল আহসান চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে  পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হই। আমার গবেষণার সহ-তত্ত্বাবধায়ক হন প্রফেসর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। ক্লাসরুমের বাইরেই আহাদ স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিবিড় হয়।

২০১৮ সালে স্যার অবসর গ্রহণ করেন। তারপর থেকে দেখি ফেসবুকে স্যার কবিতা লিখছেন। আমার খুব ভালো লাগে। তাহলে স্যারকে যে কবিতা লিখতে অনুরোধ করেছিলাম, তা আর বৃথা যায়নি। ২০২০ সালে বেরিয়ে গেল তাঁর প্রথম কাব্য নক্ষত্র নিভে যায় (অন্যপ্রকাশ, ঢাকা)। নাম শুনেই একটা ধাক্কা খাই। নেভে না বলেই তো তার নাম ‘নক্ষত্র’। সেই নক্ষত্র কী করে নিভে যায়! আবার সে নিভে যায় নিজে। তাহলে এই নক্ষত্র সেই নক্ষত্র নয়। এই নামে এক মলাটে মনে হচ্ছে দুটি কাব্য―‘খোয়ানো শব্দের লেশ’ আর ‘শোক আর দ্রোহের শ্লোক’। মজার ব্যাপার হলো, শিরোনাম কিংবা উপনামের কোনও কবিতা নেই।

আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলীর প্রতিটি কবিতাই অভিজ্ঞতাসঞ্জাত আত্মনিমগ্নতার স্মারক। ধার করা কোনও শব্দ কিংবা রং দিয়ে তিনি এসব ছবি আঁকেননি। তাঁর প্রতিটি চিত্রকল্পই হৃদয়ের রঙে ভালোবাসার তুলিতে আঁকা। সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন সহজ অনুভব। একটি উপলব্ধির যথাযথ নির্যাস ধারণ করে তিনি কবিতার মোড়কে উপস্থাপন করেছেন। কবিতার হরেক মতবাদ তিনি অন্তরের রাখলেও প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি স্বাভাবিকতাকেই অবলম্বন করেছেন। কিন্তু স্বাভাকিতার ভেতর দিয়ে অসাধারণ হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা অলংকরণের যথাযথ ব্যবহারে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কবি লিখছেন ‘বিপুল স্রোতস্বতীর মতো/ তোমার সৃজনের ধারায়/ সতত আমরা স্নিগ্ধ হচ্ছি।’ (রবীন্দ্রনাথের প্রতি) এখানে স্রোতস্বতীর সঙ্গে সৃজনধারায় উপমা ফুটে উঠেছে।  এই ‘স্রোতস্বতী’ই আবার কবির কলমে হয়ে যায় ‘স্রোতস্বিনী’। কবি লেখেন―

একই স্রোতস্বিনীতে দুবার পা রাখা যায় না

একই গৃহে আর ফেরা হয় না

ভালবাসার কথা দুবার বলা যায় না। (দুবার বলা যায় না)

‘এক নদীতে দুবার নাওয়া যায় না’ এ রকম একটি প্রবাদপ্রতিম চরণকে তিনি কবিতায় ঠাঁই দিলেন আরও কিছু অনুভব যুক্ত করে―

প্রেম তুমি বারবার করতে পারো

কিন্তু ভালোবাসার প্রথম স্তবকিত ঘ্রাণ

আর ফিরে আসে না

অলৌকিক পাখির অচিন সুরের মতো

মিলায়ে যায় অসীম কালসাগরে

গোধূলিতে বিলীয়মান ছায়ার মতো

মিশে যায় দূর থেকে দূরে। (দুবার বলা যায় না)

কবির পক্ষে সুবিধা হয়েছে যে তিনি পরিণত বয়সে লিখতে এসেছেন। সারা জীবনের  যাপনের অভিজ্ঞতা, অন্যের কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা, বিশ্বকবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কবিতা লিখতে এসেছেন। তাই অনুশীলনের ছাপ নেই। একেবারেই পরিণত কবিতা। তাঁর প্রথম কবিতার বই মানে অনেক না লেখা কবিতার বই পেরিয়ে আসা। তাঁর বয়সিরা অনেকেই খ্যাতিমান কবি। কেউ কেউ কবিতা লেখা থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু সেই বয়সে তিনি তারুণ্যের দুর্মর প্রবাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কবিতাসমুদ্রে। যা লিখছেন তাই হয়ে উঠেছে কবিতা। আর অসুবিধা এই যে তিনি নিয়মিত চর্চার ভেতর দিয়ে না যাওয়ায় কোথাও কোথাও একটু-আধটু বেসুরো মনে হতে পারে। গান যেমন কণ্ঠে তুলে তুলে ধারণ করতে হয়। গানের সকল রাগ কিংবা নোটেশন জানলেই গান হয়তো গাওয়া যায়। কিন্তু কোথায় যেন একটু আলুনি থেকে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কবি লিখেছেন ‘দেয়নি সে কোনও দিন ধরা ক্ষণ তরে’। এখন ‘ক্ষণ তরে’ শব্দবন্ধ তিরিশি আধুনিতার ধারায় মিলিয়ে গেছে। আধুনিক কবিতায় এ রকম অনেক শব্দই ক্লিশে হয়ে গেছে। কিন্তু আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী সেই ক্লিশে শব্দকে কবিতায় যুক্ত করতে চাইছেন। বলা যেতে পারে, এটি তাঁর নিরীক্ষা। পাঠক তা গ্রহণ করলেও সমালোচকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংশয় দেখা দিতে পারে। ছন্দে খুব কবিতাই লিখেছেন এই গ্রন্থে।

স্মৃতি, যাওয়ার সময়, আমার বিদ্যালয়, নিঃসঙ্গ ঘুড়ি, অর্থের অনুধাবন, নিষ্প্রভ সালো, শেষের গান, এখনো, প্রতিনিয়ত, মানববন্ধন, সন্ত্রস্ত্র সম্ভ্রম, সত্যের মুখ, বৃষ্টি তুমি থামো, শ্রাবণ রাজা প্রভৃতি কবিতায় ছন্দ ও অন্ত্যমিল প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন। তবে অসতর্কতায় কিছু কিছু শিথিলতা রয়ে গেছে। এহ বাহ্য। ছন্দ-অন্ত্যমিল ছাড়াও উৎকৃষ্ট কবিতা রচনা করা যায়। কবি সেই পথেই হেঁটেছেন। একটি উৎকৃষ্ট কবিতা পড়া যেতে পারে―

বৃষ্টির ছাট এসে বারবার মুছে দেয় সব চিহ্নের দাগ

নক্ষত্রের আলো জেগে রয় কোনও সংকেতের আশায়

শেষের গান শোনার সময় আসেনি বুঝি এখনও হায়

যারা এসেছিল ভিড় করে তারা ফিরে গেছে পায় পায়। (শেষের গান)

এরকম বিষণ্ন কিছু মুহূর্তের  কথা ধরা রয়েছে নক্ষত্র ণিভে যায় গ্রন্থের বেশকিছু কবিতায়। কবিতাগুলো পড়লে, মন দিয়ে পড়লে আমাদের মনের ভেতর কবির বেদনাও গুঞ্জরণ করে ওঠে। প্রাজ্ঞ ও ধীমান কবি আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলীকে অভিনন্দন, অবসরের প্রতিটি ক্ষণকে কাব্যময় করে তোলার জন্য। সাধারণ অনুভবকে তিনি অসাধারণ কবিতা করে তুলেছেন। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব।

 লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button