আর্কাইভবইকথা

কবি শীলা মোস্তাফার পরিত্যক্ত শরীর ও লুকোচুরি : শৈবাল তালুকদার

বইকথা

অতি আধুনিক আর এক্সপেরিমেন্টালের ভিড় সন্তর্পণে এড়িয়ে আমি কবিতার বই খুঁজি, যাতে কবিতা পাওয়া যায়। কবিতার অভিরুচি যদিও ব্যক্তিমাত্রেই ভিন্ন। বইটি হাতে পেয়ে, আমার মতো করে বইয়ের নামের মধ্যেই যেন কবিতা পেলাম। ধ্রুব এষের করা ছিমছাম রঙিন প্রচ্ছদে জড়ানো শীলা মোস্তফার তৃতীয় গ্রন্থের নাম ‘পরিত্যক্ত শরীর ও লুকোচুরি’ বিদ্যাপ্রকাশ থেকে মজিবর রহমান খোকা বইটি প্রকাশ করেছেন  এ বছরের গোড়ার দিকে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে।  শীলার কবিতার সাথে পরিচয় পত্রপত্রিকার সাহিত্য পাতায়, বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শীলার কবিতা যা পড়েছি আগে, ভালো লেগেছে। তাই হাতে আসার পর সময় নিয়েই পুরো বই পড়ে শেষ করেছি।

প্রথম কবিতা ‘চিঠি’, নস্টালজিয়া, বিরহ আর অভিমানে ভরা সরল প্রকাশ। ‘চায়ের কাপে ছলকে পড়ে সরল নিশ্বাস’। পরের কবিতা ‘গন্তব্য’- হারানো সময়, দিন, পরিচিত চারপাশ আর হারানো মানুষের কাছে ফিরে যাওয়ার নিষ্কলুষ আকুতি- ‘তোমার আধখাওয়া চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেব… একদিন ঠিক আমি ফিরে যাব’। এরপর ‘স্বপ্ন তাথৈ’… এবার যেন মোহ ভঙ্গের পালা… ‘তোমার বড্ড অচেনা মুখ। তোমার তুমিময় গল্প’। বিরহ, ফেরার আকুতি, তারপর হিসেব না মেলার প্রেমের অনুযোগ পড়তে পড়তেই, ‘বিনি সুতোর মালা’য় এরপর সরাসরি বিচ্ছেদ, শর্তহীন, দস্তখতহীন আস্থার হিসেব না মেলার বিচ্ছেদ… নাড়া দিল বেশ। ‘কিত্তনখোলা নদী’ শিরোনামে এবারও স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প, সংবেদনশীল কবি মন কিত্তনখোলা নদীটি দোষারোপ করছেন তাঁর সমস্ত স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে। এগোনো যাক… প্রেম বেদনা এড়িয়ে এবার কবির ভাবনায় অলীক ঈশ্বর যাকে তিনি পরশ্রীকাতরতার দোষে দুষ্ট বলছেন। পৃথিবীর যাবতীয় যাপনের যা কিছু সুন্দর তার নিরন্তর ছন্দ ভঙ্গের বেদনার দায় চাপিয়ে তিনি বলছেনÑ

হে অদৃশ্য পরশ্রীকাতর ঈশ্বর

সে তুমি যাই বলো

সম্রাটের সিংহাসনে তুমি বড় বেমানান।

এরপর ‘অন্তর বাড়ি, যেখানে ফিরে যাওয়া যায় না’Ñ এই কবিতাতেও সরল অকপট স্মৃতি মেদুর কবি, ফেলে আসা যাপনের জন্য। চমৎকার ছবি আঁকেন ছোট ছোট ফেলে আসাগুলো মিলিয়ে। তার যে দেশান্তরি হওয়ার বড় দুঃখ, অন্তরে টানাপোড়েন তাই নিয়েÑ

আমার প্রিয় বারান্দা, প্রিয় ঘর, অসমাপ্ত বাড়ির ছাদ

ছাদের অমীমাংসিত রডগুলো ছেড়ে

সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম।

আর শেষ লাইনে বলছেন ‘মেয়েদের কাঁদতে নেই’। একটু খটকা লাগল। এর পরের কবিতায় কবি খোলাখুলি, সরাসরি নারীবাদী। তীব্র তাচ্ছিল্য করছেন সমাজের পুরোনো অচলায়তনেরÑ সামাজিক বিবাহে কন্যা সম্প্রদানের পুরো ধারণা এবং মনস্তত্ত্বকে। একটি মেয়ের আবেগ, অনুভূতি, স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিসত্তা কি করে পুরোপুরি উহ্য করে দিয়ে জলাঞ্জলি দেয়া হয় এই কন্যা সম্প্রদানের নামে। আর এই গভীর বেদনাবোধ, অপমানবোধকে কবি চিত্রিত করেছেন সামাজিক বিবাহে বহু শ্রুত একটি বাক্যেÑ ‘তোমার হাতে তুলে দিলাম’Ñ নারী স্বাতন্ত্রকে  সামাজিক প্রথাগতভাবে যেভাবে নিয়ত অপমান তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাই কবি বিবাহের নাম দিয়েছেন ‘প্রহসনের চিত্রিত আঁধার’।

পরের কবিতা ‘ছয় ফুট বাই আট ফুট’Ñ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তার মতো করে সোচ্চার হয়েছেন কবি।

‘মা দিবস এবং একটি অসম্পূর্ণ সন্তান’ পুরো অন্য বিষয়। এই কবিতায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছুঁয়েছেন কবিÑ ভুল শরীরে জন্ম নেয়া ‘মানুষ’-র যে ভয়ংকর মানসিক টানাপোড়েন এবং তার ফলে আত্মহনন, সেই দুই সামাজিক সমস্যার যোগসূত্র এবং মানবিক দুঃখ-কষ্ট। খুব কাছ থেকে দেখা অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা এই কবিতা, যা পড়লে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক উদারতা দুটোই প্রভাবিত হবে।

এবারের কবিতা ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’Ñ তীব্র ভর্ৎসনা করেছেন আমাদের সমাজে চারপাশের সকলের কথা এবং কাজের অসামঞ্জস্যতাকে।

পরপর বেশ কটি বক্তব্যধর্মী কবিতার পর আবার প্রেমে বিচ্ছেদে চাওয়া পাওয়ার হিসেবে ফিরছেন ‘পরের জন্মে’, ‘যতটুকু রয়ে গেলে’Ñ

কিন্তু এই ইউক্যালিপ্টাস গাছের নিচে এলেই

সেই চেনা গন্ধ, সেই শুকনো পাতা ঝরা

সেই তোমার জল ভরা চোখ

তোমার মুখ ফিরিয়ে নেয়া।

‘আত্মগোপন’ সহজ-সরল পরিত্রাণ, ইচ্ছেমত যাপনের জন্য আত্মগোপনের ইচ্ছা। ‘আমার ঈশ্বর’-এ প্রথাগত ঈশ্বরের ভাবনার বিপরীতে মানবিক ঈশ্বর খুঁজেছেন কবি। ‘আমার ঈশ্বর হরিজন হয়ে দুহাতে পাপ সরান’Ñ এই পংক্তিতিতে অনেকক্ষণ ঘোরগ্রস্ত হয়ে রইলাম।

একটু এগোই ‘ইরাবতী জল’ হাজার বছরের পুরোন সিল্যুয়েটে চিরন্তন মানব-মানবীর শাশ্বত প্রেম অপূর্ণতার হারিয়ে যাওয়া ছুঁয়েছেন কবিÑ

সহস্র বছরের তৃষ্ণা নিয়ে আজো আমি

ভেসে বেড়াই… মনি মহেশ হ্রদের জলে।

‘স্বচ্ছ মানুষ’ কবিতায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। সরল প্রকাশে কবি আবার মানুষের অস্বচ্ছতা, দ্বিচারিতার ব্যত্যয় বিদ্রুপ করেছেনÑ

দিন শেষে একজন স্বচ্ছ মানুষ

কাঁচের ওপারে ছুঁতে পারে স্বচ্ছ মানুষ

আর অন্যজন আয়নায় নিজের অবয়বের সাথেও

লুকোচুরি করে।

‘খবরে প্রকাশ’ আর ‘এ যুগের দ্রৌপদী’Ñ নজর কাড়ল কবিতা দুটি। বলিষ্ঠ বক্তব্যধর্মী, নারীর বিরুদ্ধে সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে কবি সোচ্চার সরবে। সাথে সাথে নারীকে সাহস যুগিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে।

তোমাকে ঘিরে থাকুক কলন্কিত সবুজ বাহিনী

তার মাঝে উন্নত শিরে

জেগে থাক পদ্ম।

‘সুতা আর পলিয়েস্টার’ ‘সংজ্ঞা চাইছে কে’ দুটো কবিতা গঠনশৈলীর দিক থেকে মনে ধরল। চিরায়ত কবিতার চেয়ে ভিন্ন আদলের। বেশ ভালো লাগল।

এবার আর একটি কবিতা, যেটি পুরো বইটি ধারণ করে আছে। ‘পরিত্যক্ত শরীর ও লুকোচুরি’। পরিবারের মধ্যে থেকে নিকট আত্মীয়ের হাতে শিশুরা কীভাবে নিয়ত ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে এবং এতে তাদের শিশু মনের উপর কি সূদুরপ্রসারী বীভৎস প্রভাব পরছে আমি, আপনি, আমাদের, আমাদের মায়েদের চোখের সামনেÑ তার প্রতিচিত্র এই কবিতা প্রথম পুরুষে। একটি নারী শিশুর কী তীব্র মনো বেদনা এবং অসহায়ত্ত তার করুণ গল্প।

আমি আর হাইড এন্ড সিক

খেলি না মা

আমি জেনে গেছি

আমাকে কেউ খুঁজে পায় না এ খেলায়।

কারো পায়ের শব্দ পেলে

আমি অশরীরি আত্মার মতো শরীর থেকে বেড়িয়ে যাই

ভালো মেয়ে হয়ে

ঘরের ওই কোণে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর

অন্য এক শরীরের যন্ত্রণা দেখি।

সমাজের কিছু বর্বরের এই আদিম প্রবৃত্তি যা দিনের পর দিন আমাদের সমাজ লুকিয়ে রাখে, এড়িয়ে যায় আর ক্রমাগত যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে চিরতরে মানসিকভাবে মরে যাচ্ছে, পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে আমাদের নারী শিশুরা তার বিরুদ্ধে কলম ধরায় কবিকে নত মস্তকে সম্মান জানাই।

বেশকিছু ভালো সমৃদ্ধ কবিতা আছে বইটিতে যেগুলো কবিতার নিবিষ্ট পাঠকের পছন্দের আনন্দের খোরাক হবে। শীলার বইটি প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন, অপূর্ণতা, সামাজিক অনাচার, নারীর প্রতি সামাজিক বৈষম্য, সমকাম এবং আত্ম হননের ব্যাপারে সচেতনতা, মানুষের বৈপরীত্য, মনো বৈকল্যÑ এমন সব বহুধা বিষয়কে ধারণ করেছে। একজন গণ সচেতন, নারীবাদী, প্রবল প্রেমিক, সরল, অকপট কবি হিসেবেই শীলার কবি সত্তার প্রতিচ্ছবি তার বইটি। পাঠক কবিতায় শীলাকে জানুক, তার কবিতার অকপট সচেতন মানসকে স্বাগত জানাক এবং কবিতার জয় হোক। শুভ কামনা কবি শীলা মোস্তফা, আপনার কবিতা আরো সমৃদ্ধ হোক।

শিকাগো থেকে

 লেখক : প্রাবন্ধিক

বইকথা

কবি শীলা মোস্তাফার পরিত্যক্ত শরীর ও লুকোচুরি

শৈবাল তালুকদার

অতি আধুনিক আর এক্সপেরিমেন্টালের ভিড় সন্তর্পণে এড়িয়ে আমি কবিতার বই খুঁজি, যাতে কবিতা পাওয়া যায়। কবিতার অভিরুচি যদিও ব্যক্তিমাত্রেই ভিন্ন। বইটি হাতে পেয়ে, আমার মতো করে বইয়ের নামের মধ্যেই যেন কবিতা পেলাম। ধ্রুব এষের করা ছিমছাম রঙিন প্রচ্ছদে জড়ানো শীলা মোস্তফার তৃতীয় গ্রন্থের নাম ‘পরিত্যক্ত শরীর ও লুকোচুরি’ বিদ্যাপ্রকাশ থেকে মজিবর রহমান খোকা বইটি প্রকাশ করেছেন  এ বছরের গোড়ার দিকে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে।  শীলার কবিতার সাথে পরিচয় পত্রপত্রিকার সাহিত্য পাতায়, বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শীলার কবিতা যা পড়েছি আগে, ভালো লেগেছে। তাই হাতে আসার পর সময় নিয়েই পুরো বই পড়ে শেষ করেছি।

প্রথম কবিতা ‘চিঠি’, নস্টালজিয়া, বিরহ আর অভিমানে ভরা সরল প্রকাশ। ‘চায়ের কাপে ছলকে পড়ে সরল নিশ্বাস’। পরের কবিতা ‘গন্তব্য’Ñ হারানো সময়, দিন, পরিচিত চারপাশ আর হারানো মানুষের কাছে ফিরে যাওয়ার নিষ্কলুষ আকুতিÑ ‘তোমার আধখাওয়া চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেব… একদিন ঠিক আমি ফিরে যাব’। এরপর ‘স্বপ্ন তাথৈ’… এবার যেন মোহ ভঙ্গের পালা… ‘তোমার বড্ড অচেনা মুখ। তোমার তুমিময় গল্প’। বিরহ, ফেরার আকুতি, তারপর হিসেব না মেলার প্রেমের অনুযোগ পড়তে পড়তেই, ‘বিনি সুতোর মালা’য় এরপর সরাসরি বিচ্ছেদ, শর্তহীন, দস্তখতহীন আস্থার হিসেব না মেলার বিচ্ছেদ… নাড়া দিল বেশ। ‘কিত্তনখোলা নদী’ শিরোনামে এবারও স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প, সংবেদনশীল কবি মন কিত্তনখোলা নদীটি দোষারোপ করছেন তাঁর সমস্ত স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে। এগোনো যাক… প্রেম বেদনা এড়িয়ে এবার কবির ভাবনায় অলীক ঈশ্বর যাকে তিনি পরশ্রীকাতরতার দোষে দুষ্ট বলছেন। পৃথিবীর যাবতীয় যাপনের যা কিছু সুন্দর তার নিরন্তর ছন্দ ভঙ্গের বেদনার দায় চাপিয়ে তিনি বলছেনÑ

হে অদৃশ্য পরশ্রীকাতর ঈশ্বর

সে তুমি যাই বলো

সম্রাটের সিংহাসনে তুমি বড় বেমানান।

এরপর ‘অন্তর বাড়ি, যেখানে ফিরে যাওয়া যায় না’Ñ এই কবিতাতেও সরল অকপট স্মৃতি মেদুর কবি, ফেলে আসা যাপনের জন্য। চমৎকার ছবি আঁকেন ছোট ছোট ফেলে আসাগুলো মিলিয়ে। তার যে দেশান্তরি হওয়ার বড় দুঃখ, অন্তরে টানাপোড়েন তাই নিয়েÑ

আমার প্রিয় বারান্দা, প্রিয় ঘর, অসমাপ্ত বাড়ির ছাদ

ছাদের অমীমাংসিত রডগুলো ছেড়ে

সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম।

আর শেষ লাইনে বলছেন ‘মেয়েদের কাঁদতে নেই’। একটু খটকা লাগল। এর পরের কবিতায় কবি খোলাখুলি, সরাসরি নারীবাদী। তীব্র তাচ্ছিল্য করছেন সমাজের পুরোনো অচলায়তনেরÑ সামাজিক বিবাহে কন্যা সম্প্রদানের পুরো ধারণা এবং মনস্তত্ত্বকে। একটি মেয়ের আবেগ, অনুভূতি, স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিসত্তা কি করে পুরোপুরি উহ্য করে দিয়ে জলাঞ্জলি দেয়া হয় এই কন্যা সম্প্রদানের নামে। আর এই গভীর বেদনাবোধ, অপমানবোধকে কবি চিত্রিত করেছেন সামাজিক বিবাহে বহু শ্রুত একটি বাক্যেÑ ‘তোমার হাতে তুলে দিলাম’Ñ নারী স্বাতন্ত্রকে  সামাজিক প্রথাগতভাবে যেভাবে নিয়ত অপমান তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাই কবি বিবাহের নাম দিয়েছেন ‘প্রহসনের চিত্রিত আঁধার’।

পরের কবিতা ‘ছয় ফুট বাই আট ফুট’Ñ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তার মতো করে সোচ্চার হয়েছেন কবি।

‘মা দিবস এবং একটি অসম্পূর্ণ সন্তান’ পুরো অন্য বিষয়। এই কবিতায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছুঁয়েছেন কবিÑ ভুল শরীরে জন্ম নেয়া ‘মানুষ’-র যে ভয়ংকর মানসিক টানাপোড়েন এবং তার ফলে আত্মহনন, সেই দুই সামাজিক সমস্যার যোগসূত্র এবং মানবিক দুঃখ-কষ্ট। খুব কাছ থেকে দেখা অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা এই কবিতা, যা পড়লে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক উদারতা দুটোই প্রভাবিত হবে।

এবারের কবিতা ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’Ñ তীব্র ভর্ৎসনা করেছেন আমাদের সমাজে চারপাশের সকলের কথা এবং কাজের অসামঞ্জস্যতাকে।

পরপর বেশ কটি বক্তব্যধর্মী কবিতার পর আবার প্রেমে বিচ্ছেদে চাওয়া পাওয়ার হিসেবে ফিরছেন ‘পরের জন্মে’, ‘যতটুকু রয়ে গেলে’Ñ

কিন্তু এই ইউক্যালিপ্টাস গাছের নিচে এলেই

সেই চেনা গন্ধ, সেই শুকনো পাতা ঝরা

সেই তোমার জল ভরা চোখ

তোমার মুখ ফিরিয়ে নেয়া।

‘আত্মগোপন’ সহজ-সরল পরিত্রাণ, ইচ্ছেমত যাপনের জন্য আত্মগোপনের ইচ্ছা। ‘আমার ঈশ্বর’-এ প্রথাগত ঈশ্বরের ভাবনার বিপরীতে মানবিক ঈশ্বর খুঁজেছেন কবি। ‘আমার ঈশ্বর হরিজন হয়ে দুহাতে পাপ সরান’Ñ এই পংক্তিতিতে অনেকক্ষণ ঘোরগ্রস্ত হয়ে রইলাম।

একটু এগোই ‘ইরাবতী জল’ হাজার বছরের পুরোন সিল্যুয়েটে চিরন্তন মানব-মানবীর শাশ্বত প্রেম অপূর্ণতার হারিয়ে যাওয়া ছুঁয়েছেন কবিÑ

সহস্র বছরের তৃষ্ণা নিয়ে আজো আমি

ভেসে বেড়াই… মনি মহেশ হ্রদের জলে।

‘স্বচ্ছ মানুষ’ কবিতায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। সরল প্রকাশে কবি আবার মানুষের অস্বচ্ছতা, দ্বিচারিতার ব্যত্যয় বিদ্রুপ করেছেনÑ

দিন শেষে একজন স্বচ্ছ মানুষ

কাঁচের ওপারে ছুঁতে পারে স্বচ্ছ মানুষ

আর অন্যজন আয়নায় নিজের অবয়বের সাথেও

লুকোচুরি করে।

‘খবরে প্রকাশ’ আর ‘এ যুগের দ্রৌপদী’Ñ নজর কাড়ল কবিতা দুটি। বলিষ্ঠ বক্তব্যধর্মী, নারীর বিরুদ্ধে সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে কবি সোচ্চার সরবে। সাথে সাথে নারীকে সাহস যুগিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে।

তোমাকে ঘিরে থাকুক কলন্কিত সবুজ বাহিনী

তার মাঝে উন্নত শিরে

জেগে থাক পদ্ম।

‘সুতা আর পলিয়েস্টার’ ‘সংজ্ঞা চাইছে কে’ দুটো কবিতা গঠনশৈলীর দিক থেকে মনে ধরল। চিরায়ত কবিতার চেয়ে ভিন্ন আদলের। বেশ ভালো লাগল।

এবার আর একটি কবিতা, যেটি পুরো বইটি ধারণ করে আছে। ‘পরিত্যক্ত শরীর ও লুকোচুরি’। পরিবারের মধ্যে থেকে নিকট আত্মীয়ের হাতে শিশুরা কীভাবে নিয়ত ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে এবং এতে তাদের শিশু মনের উপর কি সূদুরপ্রসারী বীভৎস প্রভাব পরছে আমি, আপনি, আমাদের, আমাদের মায়েদের চোখের সামনেÑ তার প্রতিচিত্র এই কবিতা প্রথম পুরুষে। একটি নারী শিশুর কী তীব্র মনো বেদনা এবং অসহায়ত্ত তার করুণ গল্প।

আমি আর হাইড এন্ড সিক

খেলি না মা

আমি জেনে গেছি

আমাকে কেউ খুঁজে পায় না এ খেলায়।

কারো পায়ের শব্দ পেলে

আমি অশরীরি আত্মার মতো শরীর থেকে বেড়িয়ে যাই

ভালো মেয়ে হয়ে

ঘরের ওই কোণে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর

অন্য এক শরীরের যন্ত্রণা দেখি।

সমাজের কিছু বর্বরের এই আদিম প্রবৃত্তি যা দিনের পর দিন আমাদের সমাজ লুকিয়ে রাখে, এড়িয়ে যায় আর ক্রমাগত যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে চিরতরে মানসিকভাবে মরে যাচ্ছে, পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে আমাদের নারী শিশুরা তার বিরুদ্ধে কলম ধরায় কবিকে নত মস্তকে সম্মান জানাই।

বেশকিছু ভালো সমৃদ্ধ কবিতা আছে বইটিতে যেগুলো কবিতার নিবিষ্ট পাঠকের পছন্দের আনন্দের খোরাক হবে। শীলার বইটি প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন, অপূর্ণতা, সামাজিক অনাচার, নারীর প্রতি সামাজিক বৈষম্য, সমকাম এবং আত্ম হননের ব্যাপারে সচেতনতা, মানুষের বৈপরীত্য, মনো বৈকল্যÑ এমন সব বহুধা বিষয়কে ধারণ করেছে। একজন গণ সচেতন, নারীবাদী, প্রবল প্রেমিক, সরল, অকপট কবি হিসেবেই শীলার কবি সত্তার প্রতিচ্ছবি তার বইটি। পাঠক কবিতায় শীলাকে জানুক, তার কবিতার অকপট সচেতন মানসকে স্বাগত জানাক এবং কবিতার জয় হোক। শুভ কামনা কবি শীলা মোস্তফা, আপনার কবিতা আরো সমৃদ্ধ হোক।

শিকাগো থেকে

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button