আর্কাইভগল্প

ভ্রমণ ১৯৭১ : রাবেয়া রব্বানী

গল্প

‘আমি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছি’ কথাটা বলে আমি আমার গল্পের হাড়িটা শুরুতেই ভাঙতে চাই। ভাঙা হাড়ির চাড়ায় চাড়ায় আলাদা আলাদা জায়গা হবে সেগুলোতে যা যা জমা হবে সেগুলো নেড়ে চেড়ে দেখুন না, পৃথিবীতে হুট করেই এমন টুকরো টুকরো গল্প তৈরি হয় আর প্রমাণ করে ছাড়ে যে, মানুষের জীবন একটা প্যাচ খাওয়া দড়ি, যার জায়গায় জায়গায় গিট।

যদিও আমার পরিবারের সম্মান, ক্ষমতা এখনও অক্ষুণ্ন আছে, কেউ খারাপ মানুষ ছিলেন বা কারও ক্ষতি করেছেন এমন কথা কখনও চাউর হয়ে নেই তবু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আমাদের পরিবার নিয়ে এলাকায় কিছু কথা বাতাসে ভাসে। এর প্রথম কারণ হয়তো আমার দাদা একসময় পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হবার পর আমার দাদা সেখানে যোগ দেননি নিতান্তই রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে। বড় উকিল হওয়া সত্ত্বেও বেআইনি রোজগারের কোনও ইতিহাস আমার দাদার নেই। তিনি হয়তো পরিবর্তন ভয় পেতেন, একটা ছকে চলতে পছন্দ করতেন। যুদ্ধের আগেই তিনি ও দাদি মৃত্যুবরণ করেন। একটা পরিবার ক্ষমতাশূন্য হলে অনিরাপদ হয়ে উঠে এই মর্মেই বড় চাচার ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরেই মুসলিম লীগের কর্মী হয়ে ওঠা। যদিও ক্ষমতার বাইরের মানুষ এই যুক্তি মানবেন না কারণ আমরা শোষককে বুঝি নিজেকে শোষিত ভেবে শাসককে বোঝা কঠিন।

আমার মেজ চাচা কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করতেন। যুদ্ধের সময় আমার বাবা আর ছোট চাচা ছিলেন একেবারেই কিশোর। আমার জন্মের আগেই দাদা ও বড় চাচা মারা যান। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ নিয়ে বাকি চাচা ও বাবার সঙ্গে সঙ্গত কারণেই আমার এ নিয়ে কখনও সেভাবে আলাপ হয়ে ওঠেনি। কিছুদিন হয় মেজ চাচাও মরে গেছেন।

এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তোলপাড় হলে, উল্লাস হলে আমি কখনও প্রগলভ আচরণ করতে পারি না। পাকিস্তানপন্থি  শব্দটা আমাকে ঘিরে রাখে, আমার দেশপ্রেমের সহজ প্রকাশ একটা ভান হয়ে দাঁড়ায়। বিজয়ের মাস এলেই একটা স্বাধীন দেশে, শহিদের দেশে, বীরের দেশে নিজেকে অপাঙতেয় মনে হয়।

এখন আমি সত্যটা জানতে প্রায়ই আমার বাবাকে প্রশ্ন করি, যুদ্ধের সময় কী করেছ আব্বা ? বাবা তার হ্যালুসিনেশনজনিত অদৃশ্য বন্ধুদের সঙ্গে একটু কথা বলে আমাকে বলেন, যুদ্ধে গেছিলাম। আমি বলি, তুমি তো যুদ্ধে যাও নাই আব্বা, ছোট ছিলা। আব্বা ক্ষেপে যান, বেশি বুঝছ ? আমি মি হুমায়ুন কবিরের (বাবার অদৃশ্য বন্ধু) সঙ্গে যুদ্ধে গেছিলাম, তিন মাস যুদ্ধ করসি। আমি আমার ছোট চাচাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তিনিও বেশ রেগে যান। ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকা কৃশ শরীরটা নিয়ে আমাকে চোখ রাঙান আর বলেন―ক্যা, ও তুইও শয়তানগুলোর দলে গেছছ ? আমার ভাইজানরে নিয়া খারাপ কথা কইতে আইছছ ? আমার ভাইজানের মতো ভালো মানুষ দুনিয়ায় নাই। চাচা আমাকে মারতে আসেন। আমার সত্যটা জানা হয় না তাই একটা অযোদ্ধা পরিবারের কালিঝুলি মুছে ফেলতে কিংবা ঢেকে ফেলতে ভ্রমণটা আমার জন্য আবশ্যিক হয়ে পড়ে। ছোট থেকেই আমি শুধু যুদ্ধের সময়ের শুরুটা একটু দেখতে চাইতাম, সত্যটা গল্পের হাড়িতে ঢুকিয়ে ভেঙে ফেলতে চাইতাম। তাহলে চলুন, আমি কীভাবে অতীতে এলাম এই  অপ্রাসঙ্গিক বিষয়টা এড়িয়ে ১৯৭১ সালে আমরা এগিয়ে যাই… 

এমনিতে দেখতে গেলে ১৯৭১ সালের শুরুটা আলাদা কিছু না, সাদা কালো সিনেমার দ্রুতগামী চলচ্ছবি না, রঙিন, বিশেষত্বহীন চেহারার একটা পৃথিবী। আমার বলতেই হচ্ছে ১৯৭১ সাল বলেই এ দেশের ভিকটিম সব মানুষকে আমার ফেরেশতা মনে হয়নি। ভিকটিম পরিস্থিতি মানুষের অপরাধ-প্রবণতাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, মানুষ আগের মতোই চালে পাথর মিশিয়েছে, খুন করেছে, ধর্ষণ করেছে, চুরি-ডাকাতি আর বাদ যাবে কেন!

আমি ১৯৭১ সালে এসেছি এক মাস আগে, মার্চ মাসের ২৭ তারিখ। তখন একটা গণহত্যার পর ঢাকা ছিল উত্তাল অথচ এই সোনাপুর গ্রামে ডাকছিল কোকিল! গাছের পাতা থেকে থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছিল! ধানের খেত থেকে শনশন শব্দ আসছিল! একদল প্রাণী তাদের ভূ-সীমানা নিয়ে খুনোখুনি করুক তাতে প্রকৃতির কিছুই যায় আসে না। প্রকৃতি যে আসলে নির্বিকার এক ক্যাবলা কান্ত তার প্রমাণ আমি ভীষণভাবেই পেয়েছিলাম সেদিন।

এসেই আমি খান বাড়িটা খুঁজছিলাম। আমি চেয়েছিলাম এখানে ওখানে না তাকিয়ে সোজা বাড়িটা খুঁজে নেব। কিন্তু কিছুদূর যেতেই বুঝতে পেরেছিলাম ১৯৭১ এর প্রকৃতি নির্বিকার হলেও মানুষের নানাবিধ প্রতিক্রিয়া চলমান। আমার চামড়ার স্যান্ডেলের নিচে মানুষের মল লেগে গিয়েছিল। আমি হয়তো অসাবধানই ছিলাম কিংবা আমি হয়তো ভাবতেই পারিনি একটা যুদ্ধক্রান্ত দেশে কেউ পায়ে চলা পথে হেগে রেখে যেতে পারে। পথের দুপাশে বিশাল বিশাল বন্ধ্যা ক্ষেত। বস্তুটার কঠিন আকৃতি দেখে মনে হয়েছিল মল ত্যাগকারী চাইলে সেখানেও কাজটি করতে পারত। ব্যাপারটা স্পষ্ট যে কেউ জেনে বুঝেই করেছে এবং সাধারণত এই রকম কাজ মানুষ জেনে বুঝেই করে থাকে। ধরে নেয়া যেতে পারে কাজটা একজন দুখী মানুষের, সে নিজে কষ্ট পাচ্ছে অন্যকেও কষ্ট দিতে চাচ্ছে। সে হয়তো খেতে পাচ্ছে না কিংবা সে হয়তো সমাজ দ্বারা নিপীড়িত। মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে যদি বিচার করলে যেকোনও অপরাধকে দুঃখ কষ্টের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যায় কিন্তু সেক্ষেত্রে তখন এটা নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না যে কাজটার সঙ্গে একটি দেশের ভিকটিম অবস্থা জড়িত। যুগ যুগ ধরেই কেন মানুষকে পায়ে চলা পথে মলত্যাগ করতে দেখা যায় কথাটা ভাবতে ভাবতে আমি পা থেকে স্যান্ডেল দুটো ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। পকেটে থাকা ২০২২ সালের কয়েকটা টাকা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলাম খান বাড়ি। আমি আমার বড় চাচা রাইসুল খানের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম নির্লজ্জের মতো। শক্ত সমর্থ শরীরটাসহ বলেছিলাম, আমাকে একটা কাজ দিন, আমি ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছি। ১৯৭১ সালে একজন অপরিচিত তরুণের ঈষৎ আমিষ গন্ধ কারও নাকেই ভালো ঠেকার কথা না। বড় চাচাও আমাকে সন্দেহ করেছিলেন। বেশ কিছুদিন আমি তার দেহরক্ষী লাঠিয়াল হাবুল ও কাবুলের ঘরে একরকম বন্দি ছিলাম। প্রতিদিন একবার আমাকে বড় চাচার জেরার মুখে পড়তে হয়েছে । প্রতিদিন আমি তাকে মিথ্যা করে একই কথা বলতাম, আমার নাম পথিক। আমি এতিমখানায় বড় হয়েছি  ২৫ মার্চ পাকিস্তান আর্মি ঢাকায় আগুন লাগানোর পর পালাতে থাকা মানুষের সঙ্গে এখানে চলে এসেছি। তারপর আশ্রয়ের আশায় এই বাড়িতে আসা। এমন লেজে গোবরে গল্প বড় চাচার মতো বুদ্ধিমান লোক একটানে বিশ্বাস করেননি তবে ফেলেও দিতে পারেননি। জানেনই তো, মাঝে মাঝে গল্পের ক্ষমতা বাস্তবের চেয়েও বেশি।

প্রতিদিন তিনি আমার আধা সেদ্ধ গল্প শুনতেন এবং বলতেন আমি ‘হয়তো’ মিথ্যা বলছি। আমি ভাবছিলাম, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ কেন পাকিস্তানের কাছে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, উত্তরটা সাহস। বিষয়টিা উলটো করে ধরে দুদিন পর আমি পেছনের ডোবায় একটা গুই-শাপ দেখে ভয় পাওয়ার ভান করেছিলাম, চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে নিয়ে খান বাড়িতে হাসা-হাসি শুরু হয়েছিল আর এক তুড়িতেই আমি অন্দরমহলে সচল হয়ে উঠেছিলাম।

২.

এপ্রিলের ৫ তারিখ রাতের কথা বলছি অনেক হইচই শুনে খান বাড়ির কাছের একটা পাটক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। আশেপাশে অনেক মানুষ ছিল। হঠাৎ কয়েকজন ছেলে আমার উপর চড়াও হয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে। জনতা হয়তো প্রমাণ ছাড়া আমাকে এভাবে আঘাত করতে রাজি ছিল না, সবার চেহারা কুচকে গিয়েছিল কিন্তু কেউই এগিয়ে ছেলেগুলো থামায়নি। আমি বাইস্ট্যান্ডার্ড এফেক্ট সম্পর্কে জানতাম বলে নিশ্চিত ছিলাম কেউ আমাকে বাচাতে এগিয়ে আসবে না। অন্য মানুষের বিপদে মানুষ একা একরকম আচরণ করে, ভিড়ের মধ্যে আর এক রকম আচরণ করে। ভিড়ের মধ্যে মানুষ দায়িত্ব ভাগ করে নেয়, যেহেতু অনেকেই এখানে আছে কেউ না কেউ এগিয়ে যাবে আমি যাব কেন ? ব্যাপারটা এমন। এই যেমন ১৯৭১ সালে অনেকেই যুদ্ধে যায়নি, কোটি মানুষের দেশে দায়িত্ব ভাগ হয়ে গেছে। সত্য বলতে, আশি থেকে নব্বই ভাগ মানুষই যুদ্ধ করেনি।

যাই হোক সেখানে বাই স্ট্যান্ডার্ডগ্রস্ত মানুষগুলোর চোখে আমি আমার মৃত্যুকেই দেখতে পাচ্ছিলাম। এরপর পুলিশ এসে আমাকে আর এক দফা পিটিয়েছিল। পুলিশ আক্রমণকারী ছেলেদের সঙ্গে একমত ছিল, একটি এলাকায় এইরকম বীভৎস ধর্ষণ একজন আগন্তুকই করে থাকে।

আমি যে বাড়ির বাইরে আসলে যাইনি তা অন্তত খান বাড়ির লোকজন জানত তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে বড় চাচা আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেননি তবে পুলিশি জেরা খান বাড়িতেই হচ্ছিল। খালি মুখের না পেশিশক্তি বহুল সেই জেরাতে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আমি হাঁটতে পারতাম না, কথা বলতে পারতাম না। ভয় হতো, সময় ভ্রমণের সব শর্ত ঠিক রেখে আমাকে আমার সময়ে অক্ষত ফিরতে হবে। 

সৌভাগ্যক্রমে বড় চাচা এরপর ব্যাপারটায় হস্তক্ষেপ করেন। আমাকে কড়া মাত্রার পেইন কিলার আনিয়ে দেন, পুলিশকে জ্বরের কারণে ইন্টারোগেশনে তিন দিনের বিরতি দেওয়ার অনুরোধ করেন। সে সময়ের স্মৃতি সম্পর্কে আমি আত্মবিশ্বাসী নই, আমার সত্যানুসন্ধানের মুখে ছাই দিয়ে প্রায় দশ দিন চলে যায়। আমার যেটুকু মনে আছে, শুরুতে হাবুল আমাকে ধাক্কা দিয়ে টয়লেটে নিয়ে যেত আর বলত, পেছনের দিকে হাঁটেন কেন, আমার মুখে ছ্যাপ আসে। আমি কি আসলেই পিছনের দিকে হাঁটতাম ? জানি না।

হঠাৎ একদিন ডাক্তার নিয়ে আসা হয়েছে। তিন বেলা ভালো ভালো খাবার আসতে শুরু করে। শাড়ি পরা মায়ের মতো মহিলাটা যে আমার মাথায় পট্টি লাগিয়ে দিত তিনি আসলে আমার বড় চাচি। ভাসা ভাসা শুনতে পেয়েছিলাম, আরও একটা মেয়ের ধর্ষিত লাশ পাওয়া গেছে, বরফ কলের পেছনে। সেই লাশের মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, হাতের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং যৌনাঙ্গ কী আর আস্ত রাখবে! সবাই বুঝে গিয়েছিল অপরাধী অন্য কেউ, আমার আর ভয়ের কিছু নেই। হাবুল টয়লেটে যাওয়ার সময় বলতে শুরু করেছিল,  ভাই এত সুন্দর পিছনের দিকে হাঁটা আপনে কই থেকে শিখছেন ? এত ভাল্লাগে যে মুখে আর থুথু আসে না।

একদিন দুপুরে নিজেকে বড় চাচা, বাবা ও বাকি দুই চাচার সঙ্গে খাবারের টেবিলে আবিষ্কার করেছিলাম আমি। তখনও আমার পেছনে হাবুল প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে ছিল, ফিসফিস করে বলছিল, ভাই। খাওয়ার সময়ও কি আপনে পরের সব তরকারি আগে খাইবেন ? ডরাইয়েন না। খাবার দেখলে আমার মুখে ছ্যাপ আসে না।

 বড় চাচা আমাকে ফ্রয়েডের উক্তি বলছেন, একদিন অতীতের দিকে তাকাইলে দেখবা কষ্টের সময়টাই সবচেয়ে সুন্দর। আমি কি ভুল শুনেছিলাম। হ্যাঁ, আমি ভুল শুনতেই পারি কিন্তু নিজেকে আশ্বস্ত করছিলাম এই ভেবে, ভুল শুনতে শুনতে একদিন সঠিক কিছু শুনতে পাব।

তরকারি নিতে চেয়ে আমি নির্ঘাত সবার সামনে বলে ফেলেছিলাম! ‘কন্ডাকটর ডালের বাটিটা পেছনের দিকে এগিয়ে দিন।’  না হয় সবাই ‘কন্ডাকটর!’ বলে হেসে উঠবে কেন ? আমি বড় চাচার শরীরে ট্রাফিক পুলিশের পোশাক দেখতে পাচ্ছিলাম, তার মাথার উপর সবুজ বাতি দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম তরকারির বাটিগুলো তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন। সেগুলো আমার দিকে চলে আসছে। একে একে আমার প্লেটের চারপাশে ঘুরে ঘুরে থেমে যাচ্ছে। সেগুলো বলছে, আমরা এখন একসঙ্গে আছি তাই বাইস্ট্যান্ডার্ড এফেক্ট আছে আমাদের উপর। সব শেষ করে ফেললেও আমরা কিছুই বলতে পারব না। আপনি নিরাপদ।

আমি তরকারি নিচ্ছিলাম না বলে চামচ হাতে নিয়ে আমার মায়ের মতো চাচিটা এগিয়ে এসেছিল, বেশি বেশি যত্ন করছিল। আমি তাকে ফিসফিস করে চার্লস বুকোয়স্কি শোনাচ্ছিলাম, আমার জন্য সমবেদনা নয়, জীবনের কঠিন সময়েও আমি কৌতুক বোধ করতে পারি, আমি পিছনের দিকে এগিয়ে চলা এক কুকুর, আমার জন্য নয়, সমবেদনা শেয়ালদের জন্য রাখুন। বড় চাচি কি এসব শুনেও না শোনার ভান করেছিল, না কি শুনতেই পায়নি ? আর যদি না-ই শুনেই থাকবে তাহলে কেন বলেছিল, দেখতাছ না সবুজ বাতি জ্বলতাছে, বাবা তুমি আগায় যেতে পারো।

এসব দৃশ্য কি সত্যি? এখন আমি নিশ্চিত না।

৩.

এপ্রিলের বিশ তারিখ, এই বাড়ির বাইরের যুদ্ধ পাক খেয়ে ফিরে যায় ভেতরে ঢুকে না। যেন একটা ভিন্ন ভূখণ্ডে আমি নিরাপদে আছি। আমি এখন বেশ সুস্থ, আমাকে খান বাড়ির অস্থায়ী গৃহ শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে। পড়ানোর উছিলায় আমি প্রাথমিকভাবে বাবা ও চাচাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছি। আমার বাবা খুব অস্থির স্বভাবের একজন কিশোর, চাচা বেশ দুষ্ট। বাবার চেহারার দিকে তাকালে আমার বুক কাঁপে। প্রথম দিনই পড়ানোর ফাঁকে আমি তাকে বলি, বাবর তুমি যুদ্ধে যেতে চাও ?

ছোট চাচা হেসে উঠে, অয় যাইব যুদ্ধে! অয় তো তেলাপোকা দেখলে ডরায় ?

আর ওমনি দুই ভাই মারামারি শুরু করে দেয়। আমার কথা এগোয় না।

আমি নানান উছিলায় মেজ চাচার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছি। তার কথা বলার লোক কম। আমি তার অভাবের থালাতেই হানা দিয়েছি একজন কৌতূহলী অজ্ঞ হিসেবে।

আজ আমি প্রথমে তার সঙ্গে ইতিহাস নিয়ে কথা বলা শুরু করেছি। তারপর ভূ-রাজনীতি আপনা আপনি  উঠে এসেছে। যুদ্ধের কথাও এসেছে। হঠাৎ মেজ চাচা চিনু আমাকে জিগ্যেস করল, দেশ, দেশ করো। দেশ আইলো কই থেইক্কা ?

কই থেইক্কা ?

থালা-বাটি থেইক্কা।

বুঝলাম না।

মানুষ আগে দল বানায়া থাকত ? একজনের আর একজনের দরকার আছিল। আস্তে আস্তে ধর্ম, নিয়ম এই সব কিছু মানুষের লগে কিছু মানুষের ঝামেলা বান্ধাইল, মানুষ টুকরা হইতেই থাকল, এমুন এক টুকরার নাম পরিবার, এইটা হইয়া উঠল মূল এন্টিটি মানে একটা বস্তুর মতো আর সমাজ হইল জিনিসটা রাখার একটা হোল্ডার মানে থালাবাটি। একসময় সমাজেরও শেকড় জন্মাইল, থালা বাটি থেইক্কা বস্তুর রূপ নিল, তারও নিজেরে রাখনের লেইগা থালা বাটি দরকার হইল। সেই বাটি হইল দেশ। কি বুচ্ছ কউ ?

বুচ্ছি, দেশ হইল একটা হোল্ডার মানে থালাবাটি।

হ, বাটি। এক বাটিতে আমরা খালি মটরশুঁটিরাই থাকমু, এমুন জিনিসটা। বঙ্গভঙ্গ কইরা মুসলমান হিন্দু বাংলা উর্দু মিলছে। যুদ্ধ একটা লাগারই কথা আছিল। এমনে চলে না।

আপনি তাহলে যুদ্ধ সাপোর্ট করেন চিনু ভাই।

নাহ সাপোর্টের কিছু নাই। মানুষের প্রকৃতি হিসাবে কইলাম। যুদ্ধ কোন খেলা না। অনেক মানুষ মরবে, যারা দেশের জন্য মরবে তারা আখেরে কিছুই পাবে না, স্বাধীন দেশ যারা পাইব তারা নিজেরটাই ভাবব, মানুষের লেইগা ভাবব না।

বুঝলাম না।

এতকিছু না বুঝলা। দেখো, পাকিস্তানের এলাকা কমলে শক্তিও কমবে। পূর্ব বাঙলা ছোট। ভারতের মনে কোন্ প্যাচ আছে তা কি আমরা জানি ? ওরাও যে লেঞ্জা হান্দাইব না তার গ্যারান্টি কি ? আমরা একটা নতুন দেশ বানাইলেও কি সব থাইম্মা যাইব। এইখানেও ভাগ হইব। দেশ স্বাধীন হইলে এর ভিত্রেও অনেক ছোট ছোট দেশ দেখতে পাইবা। এই দল, সেই দল। মানুষের পাড়াপাড়ির শেষ নাই।

কিন্তু এভাবে অন্য তরকারির লগে থাকলে তো আমগো দেখাই যাইব না ।

হঠাৎ হাবুল কাবুল দুজনই চিনুর ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছিল―চিনু ভাই, রামু গোয়াইল্লার পোলাটা মুজিব পার্টি করত  না ?

হ।

ওরে পাওয়া যাইতাছিল না, আজকা লাশ পাওয়া গেছে। পইচ্চা গেছে লাশ। উহ! পচা গন্ধ!

আইচ্ছা।

হাবুল থুথু ফেলল। চিনু চাচা বিরক্ত হলো, যা যা। আমি জানতে চাইছি তর কাছে ? আর অই তরে না কইছি আমার সামনে ছ্যাপ ফালাইবি না।

কি করমু লাশ দেখলে অনেক ছ্যাপ আসে মুখে।

চিনু মুখ বিকৃত করে বলেছিল, এহ! তাইলে এই বছর তর শইল্লের সব ছ্যাপ শেষ হইয়া যাইব। যা, হারামজাদা।

এত মর্মান্তিক একটা ঘটনা শুনেও আমি কেন হেসে ফেলেছি তার দোষ মানুষের কৌতুক বোধের ত্রুটির উপর চাপিয়ে দিন। ধরে নিন ভয়াবহ একটা  খবরে আসলে আমার নার্ভাস এনার্জি নির্গমিত হচ্ছে। চিনু চাচা অবশ্য হাসছে না। আমার দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, কই জানি ছিলাম। ও আইচ্ছা তুমি কি আওয়ামী লীগ কর নাকি মিয়া ?

না, আমি কোন দল করি না। এমনে জানতে চাইতাছি। আমরা আছিলাম এক বাটিতে থাকার ব্যাপারটায়।

ও হ। একলগে থাকার অশান্তি একটা আছে। অশান্তি হইল মাতবরির জায়গাটায়, পাকিস্তানের মাতব্বরি ঠিক রাখার লেইগা এসব করছে। আগেও রাজারা বড় মাপের দেশ এক নীতিতে চালাইতে চাইছে। তবে মানুষ এই জিনিস মানে নাই কখনওই, যুদ্ধ বানছে। মানুষ আগে পরে দেশ আর ভাষার জায়গাটায় তার মায়েরে চাইছে।

মায়েরে কেন চাইব ?

দেহ, দেশকে মা কওয়া হয়, দেশ তো বাবাও হইতে পারত। মাটি, প্রকৃতি, ভাষারেও মা বলা হয় ? বাবা কি আমাদের জন্য কিছুই করে না। মা শব্দটাই ক্যা আসে ঘুইরা ফিরা ?

ক্যা ভাই ?

চিনু চারকোনা আয়নাটায় নিজেরে কিছুক্ষণ দেখে কিছুক্ষণ থুতনি চুলকেছিল তারপর উঠে টেবিলে ঢেকে রাখা ইশপগুলের ভুসি  ঢকঢক করে গিলে বলেছিল।

ভুসি পেট পরিষ্কার করে। খাওনি ?

জি না।

মা আর বাপে তফাত আছে। বাপ আমগো হুদা পালেই না নিয়ন্ত্রণও  করে, বিচারও করে কিন্তু মায়ের কাম লাই দেয়া, রক্ষা করা। তুমি যদি  খুনিও হও তবু তোমার মা তোমারে বাঁচাইব। মা হইল গিয়া একটা গোল্ড হোল্ডার। টেকসই, বিশ্বস্ত। কী বুঝলা ?

বুচ্ছি, দেশ হইল একটা সোনার বাটি।

রাইট। সোনার বাটি। সবকিছুর মতো মানুষেরও নিজেরে ধরে রাখার জায়গা ঠিক করতে হয়। মায়ের কাছ একেবারে আরামের সঙ্গে নিজেরে রাখন যায়। তোমারে রক্ষা করতে করব, সে তোমারে কিছু ছাড় দিব, অনেক কিছু দেইখাও দেখব না, তুমি আরাম পাইবা। এবার নিশ্চয়ই বুচ্ছ দেশ জিনিসটা কি ?

বুচ্ছি, দেশ একটা মহিলা, মানে মা, মানে গোল্ডেন হোল্ডার, মানে সোনার বাটি।

হা হা। ভালো বুচ্ছ। দেখো না মুজিব কয় সোনার বাংলা চাই। কিয়ের সোনা, হোয়াই গোল্ড ? সোনার বাটি হইল মা। যেমুন ভাষা, নিজের ভাষা তুমি ভুলভাল কইতে পারবা। আরামের নাম মানুষ দিছে স্বাধীনতা। এই যে তুমি ভুসি খাইয়া আরামে হাগবা নো ইন্টোরেগেশন, গেইট ওপেন, এটাই স্বাধীনতা।

আমি হাগামুতার কথা এড়িয়ে বলেছিলাম, আচ্ছা ভাই, ভাষাও তাইলে একটা বাটি। তাইলে যুদ্ধে হারলে বাংলাদেশের মানুষ সবদিকেই থালা বাটি হারাইব ? তাইলে আপনের কথা মতোই এখন চিনু ভাই যুদ্ধটা দরকার আছে।

ধুর। দরকার বইলা কিছু নাই। সবকিছু ভাইঙ্গা আবার হইব এইটাই ল অব নেচার। দরকার থাকলেও হইব, না থাকলেও হইব। ভাঙাগড়া একটা রিসাইকেলিং প্রসেস। দেশ হইবই। কিন্তু যুদ্ধ আসলে কেউই চায় না। হেরোডোটাসের একটা কথা আছে, কেউ শান্তির উপর যুদ্ধ বেছে নেওয়ার মতো বলদা না। কারণ শান্তির মইধ্যে ছেলে দাফন করে বাবার লাশ আর যুদ্ধে, বাবা দাফন করে ছেলের লাশ।

আচ্ছা কিন্তু যেহেতু যুদ্ধ লাইগাই গেছে, যদি দরকার লাগে আপনে মানুষের পাশে দাঁড়াইবেন না ?

আমি মানুষের পাশেই দাঁড়ায় আছি। আমার মানুষ আমার পরিবার।

এই উত্তরে আমার মন শান্ত হয় না। আমি হড়বড় করে বলি, ভাই এই যে শেখ মুজিব বা অন্য নেতারা দাঁড়াইছে। জেলে যাইতাছে। মরার ডর নাই। আরও কত জুয়ান পোলারা নিজের ভবিষ্যৎ না দেইখা যুদ্ধে যাইতাছে, যাইব।

চিনু একটু হেসেছিল তারপর মুখ উপরের দিকে রেখে একটা শ্বাস নিয়ে সে বলেছিল,  সব যুগে সব গোত্রেই বেশির ভাগ লোক লোক থাকে যারা শুধু তার পরিবারের লগে খাড়াইব আর কিছু জন্ম নেয় এমুন, যারা পরিবার থুইয়া বড় সংখ্যার মানুষের লেইগা জান দেয় আর এমনেই আমরা বাইচা আছি। এরা ইতিহাসে মোড় আনে, বদলায়, এরাও একটা প্রসেসের অংশ। এসব মানুষ এক্সেপশন। শুনো, যুদ্ধে না যাওয়াটাও একটা যুদ্ধ। যুদ্ধ না যাওয়াও কোনও যুদ্ধ বিরোধিতা না।

কেমনে ?

ধর, কেউর বউ বাচ্চা বুড়া মা আছে। তার কামাই খায় সেই নিরাপত্তা দেয়, সে চাইলেও যাইতে পারব না। যেমুন আমি  যাইতেও চাইলেও ভাইজান যাইতে দিবেন না।

কেন ? তিনি কি থালাবাটির বিষয়টা বোঝেন না ?

বড় চাচার প্রসঙ্গ আসতেই চিনু চাচা হঠাত ভ্রু কুচকে ফেলেছে, আচ্ছা কথা হইতাছে দেশ নিয়া আমগো নিয়া প্যাঁচাও কে ? আসলে তুমি গ্রামে কী করতে আইছ হ্যাঁ ?

পলায় আছি।

তাইলে পলায় থাকোগা। যাও!

আমি চুপ হয়ে গেলাম।

যাও এখন।

চিনু চাচা আবার ধমকে উঠে আমাকে একরকম বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। এভাবে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে বলে আমার খারাপ লাগছে না। একজন আর্টিস্টের উপর রাগ করার মতো গর্দব আমি না। আপনারা বলতে পারেন মেজ চাচা কীভাবে একজন আর্টিস্ট হলো! তবে আমি আপনাদের হেমিংওয়ের একটা উক্তি মনে করিয়ে দিতে চাই, প্রতিটা চিন্তাশীল ব্যক্তিই একজন আর্টিস্ট।

৪.

এমনিতে হাবুল কাবুলের পেট থেকে কোনও কথা বের করা যায় না। পত্রিকা ব্যবসায়ীদের মতো তারা সকল বক্তব্যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন জুড়ে দেয়। এই তো এখনই আমি হাবুলকে জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ির বাইরে যাওয়া যায় না। উফ যুদ্ধ থামব কবে ?

যুদ্ধ তো শুরুই হয় নাই মনে হয় স্যার, থামব কি  ?

শান্তি জাতীয় কমিটি না করছে পশ্চিম পাকিস্তান ? তাইলে কি সব ঠাণ্ডা হইব না ?

হাবুল উত্তর দেয়, মাইনসের দুনিয়ায় আবার শান্তি আছে ?

তাইলে কাগো দুনিয়ায় শান্তি আছে ?

হাবুল উত্তর দিল না। কাবুল ফিচফিচ হাসল আর লুঙ্গির প্যাচ খুলে গুল বের করে দাঁতের চিপায় দিয়ে মুখ বন্ধ করে ফেলল। হাবুল বিড়ি ধরাল। আমিও একটা চেয়ে নিলাম। তেমন ভালো লাগল না। ধোয়া গেলা শেষ করে আমি জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা হাবুল, রাইসুল ভাই মুসলিম লীগের বড় নেতা দেইখা কি পাকিস্তান এই বাড়ির কারও ক্ষতি করে না ?

কে কার পক্ষে তা বোঝা কি সহজ আর পক্ষ নেয়াও কি সহজ ?

কঠিন কেন ?

কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, এই খান বাড়ির মানুষগো সবাই এত ডরায় ক্যা ?

নিজেই ভাইবা দেখেন রাইসুল ভাইরে দেখলে আপনি দাঁড়ায় যান ক্যা ? আপনেরে কি সে মারছে না বাঁচাইছে ?

আমি এবার হাবুলের প্রশ্নের উত্তর, প্রশ্ন দিয়েও দিতে পারলাম না। হাবুল বিড়ি শেষ করে জানালা দিয়ে থুথু ফেলল। গলা খাকড়ি দিয়ে আর কিছু বের করতে চেষ্টা করছে। এবার কাবুলকেই জিগ্যেস করলাম, সত্য করে বলত এই বাড়ির মানুষজন কি পশ্চিম পাকিস্তান দলের ?

কাবুল একটু চিন্তা করে পালটা প্রশ্ন করে, আপনার কি তাই মনে হয় ?

হঠাৎ খুব কাছেই একটানা গুলির শব্দে আমাদের প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা থেমে যায়। কাবুল আর আমি দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম বড় চাচা ঘর থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তার হাতে রাইফেল।

বড় চাচা বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে পিছনে ফিরলেন সঙ্গে সঙ্গে বাবা, ছোট চাচা, চিনু চাচা এবং বড় চাচির ছায়ামূর্তিগুলো যার যার ঘরে ঢুকে গেল। মনে হলো একটা নীরব নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সব জানালা বন্ধ হয়ে গেছে। এবার বড় চাচা আমার দিকে কঠিনভাবে তাকালেন। আমি তবু তার সামনে গেলাম ও নড়লাম না। হাবুল কখন এসেছে খেয়াল করিনি। সে রাগ দেখিয়ে প্রশ্ন করল, স্যার আপনে কি আবার অজ্ঞান অইতে চান ?

উলটো প্রশ্ন করতে আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করলাম, মানুষ বেশি থাকলে ভালো না ?

আরও গুলির আওয়াজে বড় চাচা আর আমাকে কিছু বলার সময় পেলেন না। জোর কদমে হাঁটা শুরু করলেন। বাড়ির বাইরে কিছু দূর যেতেই আমরা চারজন পাকিস্তানি মিলিটারি আর কয়েকজন বাঙালির ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম। এতক্ষণ তারা ফাঁকা গুলি করছিল। তাদের উপর টর্চের আলো ফেললেন বড় চাচা। প্রতিক্রিয়ার মতো আরও চারটা টর্চ জ্বলে আমাদের দিকে তাক হলো। তারপর সরে গিয়ে আশেপাশের ডোবাক্ষেত আর গাছপালার দিকে স্থির হলো। আলোর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিফলনে সবাইকে ভূতুড়ে দেখাল।

বড় চাচাকে দেখে মিলিটারিটা হাত বাড়িয়ে দিল। আমার বুকটা ধক করে উঠল। বোঝাই যাচ্ছে তারা পূর্ব পরিচিত। 

বাম হাত উঁচু করে মিলিটারিটা একটা কাটা হাত দেখাল, ইস্ট পাকিস্তানি খুন মে দাম নেহি। ক্যায়ছে গুলাবি গুলাবি, হো সাকতা হ্যায় এনিমিয়া হ্যায় সাবকি। ইয়ে দেখিয়ে জানাব ম্যায় তো ইয়ে সাবিত কারণে কে লিয়ে হাত কাটকে ভি লে আয়া। হা হা হা।

 পাঞ্চ লাইন বলার মতন করে মিলিটারিটা পেছনে তাকাল। বাকি সবার হেসে উঠতেই হলো তবে বাঙালিদের হাসিতে জোড় ছিল বেশি। আমি মিলিটারিগুলো ভালোভাবে দেখলাম, চারজন  বয়সে তরুণ। আক্রমণকারী দেশ বলেই যে তারা নাচতে নাচতে পূর্ব পাকিস্তানে মানুষ মারতে চলে এসেছে তা নিশ্চয়ই না। তারা সবাই প্রাতিষ্ঠানিক সামরিক সেনা, সামরিক আদেশ মানতে বাধ্য। একটি ভিন্ন ভূ-সীমানায় যুদ্ধ করতে এসে প্রতি মুহূর্তেই তাদের মরে যাওয়ার ভয় থাকে। এই গরমেও তাদের সামরিক পোশাক পড়ে থাকতে হয়। কখনও হয়তো খুনোখুনি আর ভাগ দৌড়ে খাওয়া পড়ার সময় চলে যায়। যুদ্ধে একজন সামরিক সেনা একটা বিষধর সাপের মতো। ভিন্ন প্রাণীকে আক্রমণের এই কারণ আসলে নিজের মৃত্যুভয়। সারাক্ষণ তারা ফণা তুলে থাকে পারলেই বিষদাঁত বসিয়ে দেয়। যত দ্রুত পারা যায় যুদ্ধ শেষ করতে তারা মরিয়া হয়ে উঠে। তারা নিজেদের নিষ্ঠুর প্রমাণ করতে থাকে। তাদের পরিবারের লোকদের ঠিক এমন একটা হাত থাকলেও, তাদের বাবার হাতে এমন একটা ঘড়ি থাকলেও, তারা শক্তিশালী তরুণ হলেও দ্রুত বীর্যস্থলনে ভোগা সামরিক নেতাদের কথা তাকে মেনে চলতে হয়। আমি বুঝতে পারলা, বেচারারা! আসলে ভয় দেখাচ্ছে না তারা ভয় পাচ্ছে।

সময় ভ্রমণ শর্ত অনুযায়ী আমি এখানে কিছু বদলাতে পারবনি, আমি কাজ খুবই ব্যক্তিগত কিছু তথ্য নেওয়া, ব্যাপারটা আমার অপারগতার গায়ে স্বস্তি দেয়। আমি নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করি। আমি অজান্তেই শব্দ করে হাই তুলে ফেললাম। দেখাদেখি হাবুলও অক্সিজেনের অভাব বোধ করতে শুরু করল, তারপর কাবুল। তারপর অপারগ হয়ে একে একে চার মিলিটারি তার বাঙালি মোসাহেবরাও হাই তুলল। এমন উপর্যুপুর হাই তোলাতুলিতে কিছুক্ষণ ১৯৭১ সাল আর দশটা বছরের মতোই ক্লান্ত চেহারা নিতে চাইল। কিন্তু বড় চাচা আমার মুখের উপর টর্চের আলো ফেলে তাতে দাগ কাটলেন। তার চোয়াল উঠানামা করতে দেখা গেল। আমি গম্ভীর হয়ে গেলাম। মনে হলো তাকে না জানিয়ে একটা অপারেশন ঘটে গেছে হয়তো তিনি এই ব্যাপারে ক্ষুব্ধ। কাটা হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারিটাকে তিনি শ্লেষ্মা জড়িত কণ্ঠে বললেন, কিছ হিসাব সে আপকো ইয়ে দিক্কাত লে নে পারা ? আপকে পাছ লিস্ট হ্যায় তো হামে দিজিয়ে।

কিউ আপ কো হামারে রিসার্চ আচ্ছা নেহি লাগা ?

আবার মিলিটারিটা পিছনে তাকালো সবাই হাসছে কি না নিশ্চিত করতে।

বড় চাচা না হেসে বললেন, লিস্ট হামে দিজিয়ে। হামারি পাছ কুছ অথরিটি হ্যায়, শান্তিছে বহত কিছু হো ছাকতা হ্যায়।

মিলিটারিটা আশেপাশে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা তো আইয়ে শান্তিছে ব্যাঠকে বাত কারে ?

বড় চাচা ঘুরে খান বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপকে  ক্যাম্পমে চালিয়ে।

হাবুল কাবুল ও আমাকে বাড়ির ভেতর ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে এল। হাবুলকে অনবরত থুথু ফেলতে দেখা গেল। কাবুল এক দৌড়ে ঘর থেকে গুলের শিশিটা নিয়ে এসে বলল, গুল না নিলে আমারও ছ্যাপ আসে। আমি গেট বন্ধ করে ভেতরে চলে এলাম।

আজ রাতে আমি একা। আমার কাজ শেষ, হয়তো এর চেয়ে বেশি কিছু বোঝার নেই। আমাকে ফিরতে হবে। আমার পরিবার আসলেই পাকিস্তানপন্থি এই বিচ্ছিরি বিষণ্নতায় শরীর কাঠ হয়ে আছে। বিশাল বিছানাটাকে খোলা মাঠের মতো দেখাচ্ছে। অনেক রাত নিশ্চয়ই তবে কয়টা বাজে বুঝতে পারছি না। কাটা হাতটায় অবশ্য একটা ঘড়ি ছিল। চোখে ঘুম চলে আসতেই আমার হিপ-নিক জার্ক হলো, পড়তে পড়তে আমি একটা কাটা হাত হয়ে উঠলাম। অন্য কারও হাতের মুঠোয় দুলতে দুলতে চলতে আমার মনে হলো জীবন্ত শরীরে ঠিক এভাবেই তো আমি কাঁধ থেকে দুলতাম! সামনে থেকে পেছনে, পেছনে থেকে সামনে, থেমে থেমে, তালে তালে।

৫.

বেশি বেলা করে ঘুম ভেঙেছে আজ। খেতে ইচ্ছে করছে না বাবা-চাচাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বড় চাচি পিঠা বানাচ্ছেন। বাইরে মানুষ মরছে এই বাড়িতে কি না পিঠা বানানো হচ্ছে! হতাশ লাগছে। সন্ধ্যা নামতে সবাই একটু কম সচেতন হয়ে যায় এই বাড়ির। তখন চলে যাব আমি। আকাশের এক কোনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই, ঘুম ভেঙেছে সন্ধ্যার পর তাও বড় চাচির বিলাপ আর চিৎকারে। বৈঠকখানায় গিয়ে দেখি বাবার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে এবং ছোট চাচা ভেউ ভেউ করে কাঁদছেন আর কথা বলছেন। বাড়িটা ভেতর থেকে বন্ধ হাবুল কাবুল লাঠি নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের কেউ নেই। ছোট চাচার জবানিতে কয়েক মিনিটে আমার মাথায় ঢুকল বাবা ও ছোট চাচাকে সকাল বেলা পুকুর পাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল ধরে নিয়ে গিয়েছিল। দুইটা কবরের উপর তাদের বেধে রাখা হয়েছিল। কাজটা তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের যাদের একজনের বাবাকে কাল রাতে হত্যা করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিয়াজ হোসেন ভাগ্যক্রমে সেখানে গিয়ে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে এসে বাসায় দিয়ে গেছেন।

আমার মাথায় দ্রুত প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। বড় চাচা এখন কোথায় ? যে লোকটা বাবা ও চাচাকে দিয়ে গেছেন তিনি কোথায়। আমি বাড়ির চারপাশে ঘুরতে লাগলাম। পুকুর পাড়ে দুজন মানুষের পরিছায়া দেখা যাচ্ছে। আমি পা টিপে সেখানে গেলাম।

বড় চাচা কাঁদছেন লোকটার হাত ধরে, আমার বাচ্চা-কাচ্চা নাই নিয়াজ এই তিন ভাইই আমার বাচ্চা। আল্লাহ আমার জানের বদলে আমার ভাই গুলিরে বাঁচাইও।

নিয়াজ নামের লোকটা বলল, আমরা আছি রাইসুল ভাই। একসঙ্গে আমরা সবাইরে বাচায় রাখমু।

বড় চাচা এবার নাক-চোখ মুছে লোকটার হাত শক্ত করে ধরে বললেন, নিয়াজ, আমি কথা দিলাম এই এলাকায় আর একটা লাশ পড়ব না। রাইফেলটা নিয়া যাও। এই মাসের শেষে আর দুইটা রাইফেল আমি ব্যবস্থা করে…

হঠাত হাবুল আমার পিছনে এসে দাঁড়াতেই শব্দ হলো আর নিয়াজ নামক লোকটা টর্চ ফেললেন। বড় চাচার রাগী চোখ দেখার আগেই আমি পিছনে দৌড় দিলাম। এক দৌড়ে বাড়ির বাইরে। হাবুল কাবুল কি পিছনে আসছে ? জানি না। একটা যুদ্ধ জয়ের আনন্দ নিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার সময়ে। যেতে যেতে আপনাদের বলে যাচ্ছি, বড় চাচা আসলে এই বাড়ির, এই এলাকার একজন মা, একজন সোনার বাটি। কোনও মা-ই দেশ বুঝে না, যুদ্ধ বুঝে না, বুঝে শুধু জীবিত সন্তান। সঙ্গে একটা প্রশ্নও রেখে যাচ্ছি, যুদ্ধের সময় আপনার মা আপনাকে বলল, বাবা যুদ্ধে যাইস না, তাহলে কি আপনার মা দেশ বিরোধী, পাকিস্তানপন্থি ?

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button